৪৯
জ্যৈষ্ঠ মাসের মিষ্ট ফল
গাছে নাই সে পাকে।
গাছের ফল দেখো ভাইরে
ডাইলে পাইক্কা থাকে।।
গাছের ফল গাছে রইল
না অইল ভক্ষণ।
মিরক শিকারে গেল
ভাই দুনোজন! হা
য় হায় রে—
.
প্রবল বর্ষণের কারণে বেশ কয়েকদিন রাত্রে বেরুতে পারেনি মোহনলাল। গান শোনার ছলে কয়েকবার আখড়ায় গিয়েও জাহিরা নামের সেই নারীর দেখাও সে পায়নি। বর্ষা আগে-ভাগেই এসে গেল বলে তার হৃদয় আকুল হয়ে উঠেছে। ভরা বর্ষায়, জলকাদাভর্তি মাঠে তাদের অভিসার কী করে সম্ভব হবে! তাকে ঘটিয়ে তোলার জন্য, সমস্যার সমাধানের জন্য, তার ভাবনার অন্ত নেই। অকারণ বিষাদে, অকারণ বিরক্তিতে ছেয়ে আছে তার মন।
কিন্তু বর্ষায় অভিসারী বিমর্ষ হলেও তস্কর উদ্বেল হয়ে ওঠে। বর্ষা চোরের উপযুক্ত মরশুম। চুরি করব না এমন সংকল্প করলেও মধ্যরাত্রে সে বেরিয়ে আসছে ঘর ছেড়ে। পরপর তিন রাত্রি না বেরুলেই তার শরীরে-মনে যেন কাঁটা লাগে আজকাল। মনে হয়, রাবেয়া তাকে ঘৃণা করছে। রাগ করছে তার ওপর। মনে মনে বলছে, এ আপদ বেরোয় না কেন?
সে অতএব বেরিয়ে পড়ছে। বেরুনোর সময় আশেপাশে তাকায় না সে কখনও। যদি ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকে সেই লোক, আর চোখাচোখি হয়ে যায় তার সঙ্গে! চোখে চোখ পড়লে নিজের ইমান রাখতে অবশ্যই তাকে সাড়া-শব্দ করতে হবে। জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। এমনকী অসময়ে অন্ধকারের গোপন আচরণের জন্য তাকে প্রহার করতেও হতে পারে। কিন্তু এগুলোর কোনওটাই সে চায় না। কারণ রাবেয়া এতে সুখী হবে না। বরং চেঁচামেচিতে পাড়া-পড়শির কাছে প্রকাশিত হয়ে পড়বে ইতিকথা। সে তা হতে দিতে পারে না কখনও-ই। সে অতএব বেরিয়ে পড়ে গৃহ ছেড়ে। ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। খবর সংগ্রহের জন্য দেওয়ালে কান পাতে। তুলে নেবার মতো কিছু পেলে অভ্যাসবশত নেয় এবং অশরীরী প্রেতগুলির মধ্যে নির্ভীক বিচরণ করে। কিন্তু জিন-পরির দেখা সে আর পায়নি। বর্ষণে সিক্ত হয়ে সে পেয়েছে একটিই খবর- আখড়ায় গুরু আসবেন। এ কোনও জবর খবর নয়। তবু এই সংবাদ সে মোহনলালের কাছে পরিবেশন করল।
সিদ্ধার্থর কথা তার মনে আছে। কারও ক্ষতি হয়, এমন কোনও খবর প্রকাশ করতে বারণ করেছিল সে। এ খবরে কার কী ক্ষতি হবে? হবে না। নিসার নিশ্চিন্ত
নিসারের কাছে এর মূল্য যতই কম হোক, মোহনলালের কাছে এই সংবাদ মূল্যবান হয়ে উঠল। গুরুদর্শনের অছিলায় কি সে যেতে পারে না আখড়ায়? দেখতে পারে না সেই নারীকে? নিসারের কথা সঠিক হলে তার হাতে আছে আরও দু’দিন। সারাদিন টিপটিপ বৃষ্টি পড়তে থাকল আর ঘরে বন্দি থাকল সে। ভাবল। কী কী করার আছে তার।
চরের জমি বণ্টনের দিন কোনও কাজ হয়নি, কারণ তালিকায় কোনও কংগ্রেসির নাম না থাকায় চরে বিক্ষোভ অবস্থানের আয়োজন করেছিলেন অর্জুন সেন এবং নুর মহম্মদ। অন্তত পঞ্চাশ জন লোককে জমায়েত করেছিলেন তাঁরা। নিজেদের পক্ষ থেকে অন্তত ছ’জন কৃষকের তালিকা তারা পেশ করেছিলেন পঞ্চায়েত প্রধান, ব্লক উন্নয়ন আধিকারিক এবং ভারপ্রাপ্ত রাজস্ব আধিকারিকের কাছে। সেই তালিকায় এমনকী ছিল বহেরা গ্রামের দু’জন কৃষকেরও নাম। বহেরায় বাড়ি হলেও ভৈরবের এ পাড় ছুঁয়ে এক লপ্ত জমি ছিল তাদের। সকাল থেকে সবুজ ক্ষেত-জমির মধ্যে ডুবে থাকা আলপথে কখনও হেঁটে গেল ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা, কখনও রক্তলালের দল। যে-যার দাবি হেঁকে গেল। নিজের কোলে ঝোল টানতে সকলেই চায়। সে চাইবে না কেন? এ নিয়ে তার কোনও অপরাধবোধ নেই।
ভূমি বণ্টনের দ্বিতীয় দিন ধার্য হয়েছে এ মাসেই। হাতে আছে আর সাতদিন। এরই মধ্যে একটা চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করতে হবে। এবং সে এখনও চায়, সেই তালিকায় একজনও কংগ্রেসির নাম থাকবে না।
এছাড়া বৃষ্টি কমলেই পথ নির্মাণের কাজ শুরু করবে সে। তিন লক্ষ টাকার মধ্যে দেড় লক্ষ এ-গ্রামের জন্য বরাদ্দ হয়েছে। দেড় লক্ষের কাজ হবে অন্য জায়গায়। এই কাজের ব্যবস্থাও তাকে করতে হবে। এগুলো ছাড়াও নানা ব্যক্তিগত কাজ আছে তার।
তার জায়গায় সিদ্ধার্থ থাকলে কী করত? সে নিশ্চিত সিদ্ধার্থ থাকলে জিনপরি উড়ে যেত হাওয়ায়। সিদ্ধার্থকে সে অস্বীকার করতে চায় প্রাণপণে, ঠেলে দিতে চায় প্রাণপণে, কিন্তু মনে মনে এসেই যায় সিদ্ধার্থর অনুসরণ। একজন সফল দৌড়বীরের মতোই সে তার সামনের প্রতিযোগীকে অনুসরণ করে তাকে ছাড়িয়ে যেতে চায়।
জিনপরির সন্ধান-সংকল্প ত্যাগ করে সে নিজেকে বোঝায়, পালাবে কোথায়, লুকোবে কোথায়, এ-গ্রামেরই যখন, ধরা পড়ে যাবে ঠিক। তার চেয়ে ভাল কাজগুলো ঠিক করে নেওয়া। তার মনে পড়ে বিক্ষোভ অবস্থানের দিন জব্বার মণ্ডল গলা চড়াচ্ছিল খুব। সে চুপচাপ বসে ছক কষে নানারকম। তারপর আকাশের দিকে তাকায়। বৃষ্টি পড়ছে না আর। মেঘ হালকা হয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে। তার মন প্রসন্ন হয়ে উঠল। বেরিয়ে পড়ল সে। বরকত আলির সঙ্গে দেখা করে বলল—কিছু খরচ করতে হবে আপনাকে চাচা।
বরকত আলি জিগ্যেস করলেন—কীসের?
—আমরা যে তালিকা বানিয়েছিলাম জমি বণ্টনের জন্য, সেটাই থাকবে। শেষ পর্যন্ত। তার জন্য খরচ করতে হবে। ইট পাথর ইত্যাদি কেনার জন্য আপনি আমাকে পঁচিশ হাজার টাকা দেবেন। আমি আপনাকে হিসেব পুরো বুঝিয়ে দেব।
—বর্ষা না কমলে রাস্তা বানানো হবে কী করে?
—শুধু ইট ফেলা হবে।
—তুমি কী করতে চাইছ?
—অর্জনকাকা যাদের নাম দিয়েছে তালিকায়, সেই ছ’জনকে মাত্র এক হাজার টাকা করে দিলে লাগে ছ’হাজার টাকা।
বরকত আলি চুপ করে থাকেন। ভাবেন কিছুক্ষণ। তারপর বলেন—বেশ। কাল দিয়ে দেব টাকা। একবার মরালী যেতে হবে তা হলে।
—আমি নিয়ে যাব।
সন্ধের মধ্যে বৃষ্টি ধরে গেল পুরোপুরি। আর মোহনলাল তার দল নিয়ে বেরুল। অর্জুন সেনের তালিকায় যারা ছিল তাদের সঙ্গে দেখা করল একে একে। তার সঙ্গে দশজনের বল। তার মধ্যে অন্তত ছ’জন সীমান্তে চোরাকারবারে যুক্ত হিসেবে চিহ্নিত। সাধারণ গৃহস্থ মানুষ তাদের সম্পর্কে ভীতিজনক কল্পনা করে, কারণ এইসব চোরাপথে এমনকী এসে যায় আগ্নেয়াস্ত্র। এসে যায় মাদক। তারা প্রত্যেকেই ওই পাঁচজনকে দেখে। মোট দশজনকে দেখে। মোহনলাল সমেত দেখে মোট এগারোজনকে। ভীত চোখে তাকায়। সন্ত্রস্ত হয়ে যায় নিজের বিবি-বাচ্চার কথা ভেবে। মোহনলাল বলে—ভেবে দেখ। ওই জমি তোমরা পাবে না। গ্রাম সংসদের সভায় সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত এই তালিকা। অথচ তোমাদের জন্য এলাকায় একটা সংঘর্ষ উপস্থিত হয়েছে।
সমিরুদ্দিন বলে—এই সংঘর্ষে কারও লাশ পড়ে গেলেও কিছু বলার নেই।
নবতালিকাভুক্ত কৃষকের মুখ পাংশু হয়ে যায়। মাতিন শেখ তাই দেখতে দেখতে মিহি গলায় বলে—তা ছাড়া এই লম্ফ জ্বেলে কাজকর্ম। হঠাৎ ঘরে আগুন লেগে গেলে কার কী করার থাকবে?
কৃষকের চোখ বিস্ফারিত হয়ে যায়। তার হাত কাঁপে। কালু শেখ বলে—তোমার ভালর জন্যই বলা ভাইজান। ছেলেমেয়ের সংসার। কখন কী বিপদ ঘনিয়ে আসে! ভূমিহীন মানুষ তুমি। তুমিই যদি মারা যাও, বিবি-বাচ্চা তোমার না খেয়ে মরবে।
যে শুনছে তার গলা শুকিয়ে আসে। পা কাঁপে। মনে হয়, আর বুঝি সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। নিজেরই লাশ ধানক্ষেতে পড়ে আছে, যেন দেখতে পায় সে। তখন মফিজ মিঞা বলে—বরং আমাদের সঙ্গে থাকলে মোরাদের ভাঙা জমির উলটোদিকে যে চর উঠছে তার বণ্টনের সময় তোমার কথা ভাবা যেতে পারে। এই যে মোহনবাবু আছেন। তিনিই দেখবেন।
সেই লোকের তখন চোখে জল এসে যায়। দুটি হাত অবিরাম মাখামাখি করে সে। ভয় হতে যেন এক অভয় পরিত্রাণ খুঁজে পায়। কাঁপা গলায় বলে—দেখবেন বাবু। গরিব মানুষ আমরা।
মোহনলাল আশ্বাস দেয় তখন। বলে—নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই দেখব। তোমার কোনও ক্ষতি হলে কি আমার ভাল লাগবে? তোমরা তো আমার ঘরেরই লোক। তবে ভাই, আমাদের হয়ে কাজ করতে হবে যে কিছু।
জি বাবু।
আজ্ঞে বাবু।
নিশ্চয় বাবু।
এক-একজন কৃষক বলে এক-এক প্রকার। মোহনলাল অসীম পরিতোষ পায়। তার নেতৃত্বকাঙ্ক্ষিত পঁচিশ বছরের দেহ হতে বেরিয়ে আসে পঁয়তাল্লিশ বৎসরের পরিণত স্বর। তার ব্রাহ্মণ্য প্রভুত্বের সঙ্গে যুক্ত হয় বেনে কৌশল, বানিয়া চিত্তবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে চলে ভূস্বামীর অহংকার। সেই অহংকারের সঙ্গে অলঙ্কারের মতো জড়িয়ে থাকে কমিউনিস্টের কৃষকদরদি কণ্ঠস্বর। সবার ওপরে রাজমুকুটের মতো এসে দাঁড়ায় রাজনীতিবোধ।
রাজনীতি মানে সে জানে প্রভূত শক্তির ব্যবহার। সে জানে কর্তৃত্ব। সে জানে ছলে-বলে-কৌশলে জয়লাভ। শক্তি সঞ্চয়! শুধু রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য যে কল্যাণ— সে কথাই তার মনে থাকে না। যেন সৃষ্টিকর্তা মোহনলাল ও সিদ্ধার্থ নামে এই দুটি বন্ধুর সামনে ফেলে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন রাজপাটের বিবিধ উদ্দেশ্য সামগ্রী। বলেছিলেন—কুড়িয়ে নাও। সিদ্ধার্থ কুড়িয়ে নিয়েছে কল্যাণ। মোহনলাল ক্ষিপ্র হাতে কুড়িয়ে নিয়েছিল অন্য সব। ফলে তার কোল ভরে গেছে উপকরণে কিন্তু তাতে আলো নেই। জমাট অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে সে কেবল হয়ে উঠছে কৌশলী। প্রকৌশলী। আর সিদ্ধার্থ কল্যাণের আলোকবর্তিকা হাতে তার থেকে সরে যাচ্ছে কেবল। দূরে সরে যাচ্ছে। মোহনলাল তাকে অস্বীকার করতে চেয়েও বিপরীত ধর্ম নিয়ে অনুসরণ করছে। কারণ, বিপরীতধর্মী হয়েও অন্ধকার চিরকাল আলোকের অনুসরণকারী। এবং অতীতকাল আলোক ও অন্ধকারের গল্প আবহমান সময় ধরে শুনিয়েছে ভাবীকালকে।
.
মোহনলাল বলে তখন—জমি বণ্টনের দিন বলবে, ওই জমিতে তোমার অধিকার নেই। তালিকায় যারা আছে, অগ্রাধিকার তাদের। বলবে তো?
—জি।
—কিন্তু এতে তো তোমার ক্ষতি হল। হল না?
—কী বলব বাবু! ভূমিহীন কৃষক, ভূমি পেলে তার লাভ তো নিশ্চয়।
—তোমার বড় ক্ষতির সামান্য হলেও পুষিয়ে দেব আমরা। যদি আমাদের কথামতো কাজ করো।
—আমাকে কী করতে বলেন?
—নির্বাচনের সময় আমাদের সঙ্গে থাকবে।
—জি।
—সেদিন ঠিকমতো বিবৃতি দিয়ো।
—জি।
—এক হাজার টাকা পাবে তা হলে।
—এক হাজার?
দিন মজুর বা বিনিময় ব্যবস্থা কবুল করা অর্ধভুক্ত কৃষকের চোখ চকচক করে ওঠে। এক হা-জা-র টাকা একসঙ্গে পাওয়া যাবে? একটি মাত্র বিবৃতি দিলে এই টাকা পাওয়া যায়। সংসারের অভাবগুলি মুখব্যাদান করে তার সামনে। চাল ছাইতে হবে নতুন করে। ক’টা গরম জামা বাচ্চাদের জন্য না কিনলেই নয়। একটা অন্তত লেপ যদি বানাতে পারে! বিবিটার কী যে অসুখ—ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে ফিট লাগে। শহরের ডাক্তার যদি দেখিয়ে আনা যায় একবার। হাঁ-মুখ দারিদ্র্য উলঙ্গ নেচে বেড়ায়। জমি পাবে তার নিশ্চয়তা কী! কংগ্রেসের শক্তি এই পঞ্চায়েতে ক্ষীণ, তারা জানে। তা ছাড়া, তা ছাড়া রাজি হওয়া বিনা গত্যন্তর কী!
অতএব মোহনলাল দশজন সৈন্যসামন্ত নিয়ে চারজন কৃষককে জয় করে ফেরে। তার মন পুলকে, তৃপ্তিতে ভরে যায়। তার অনুচরদের চোখে তার প্রতি সমীহ সম্ভ্রম ভরে যায়। কর্মকাণ্ডের তরুণ দীপনায় তারা টগবগে হয়ে ওঠে। এই ঝিমনো গ্রামে এখন মাথা তুলছে পরিতৃপ্তির কত রসদ। মোহনবাবু টাকা খরচ করছেন! কত টাকা! সে টাকার উৎস জানে না তারা। বোঝে না, তাদেরই প্রাপ্য পরিষেবা থেকে বঞ্চিত করা এ অর্থ। মোহনলাল তাদের প্রশিক্ষণ দেয়। বহেরা গ্রামের কৃষক দু’জনকে একদিন গিয়ে শাসিয়ে দেবার পরামর্শ দেয়। সমিরুদ্দিন এবং কালু শেখ দায়িত্ব তুলে নেয় নিজের ওপর। মোহনলালের হাতে এখন বহেরা গ্রামের দু’জন কৃষকের বরাদ্দ দু’হাজার টাকার ফাঁদ। সে সৈন্যদল নিয়ে সোজা জব্বার মণ্ডলের গৃহে চলে যায়।
বিদ্যুৎবিহীন গ্রামের রাত্রি সাড়ে আটটা ঘুম ছানে। তবু তারা জব্বার মণ্ডলের গৃহের নিকটে হাঁক দেয়—জব্বারভাই আছ নাকি?
দরজা খুলে বেরিয়ে আসে দুই ভাই। জব্বার ও সুলেমান মণ্ডল। বেশ ক’দিন পর আজ জ্যৈষ্ঠের আকাশে তারা। বায়ুতে কিছু স্নিগ্ধতা রটে যায়। এমন দিনে জব্বার ও সুলেমান মণ্ডলের গৃহে শান্তি বিরাজ করছিল। বাইরে বেরিয়ে অতগুলি মানুষকে একসঙ্গে দেখে জব্বার মণ্ডলের চোখে কিছু প্রশ্ন ফুটে উঠেছিল। একে একে উপস্থিত মুখগুলি লক্ষ করছিল সে। এবার বলল—কী ব্যাপার? এত রাতে?
সমিরুদ্দিন বলল—এই, কিছু কথা ছিল। মোহনবাবু এসেছেন।
জব্বার মোহনের দিকে তাকাল। বলল—আসেন। বসেন। এই, ঘর হতে একটা চেয়ার নিয়ে আয়!
সুলেমান চেয়ার আনতে যাচ্ছিল। মোহন বাধা দিল। বলল—বসার দরকার নেই। ক’টা কথা শুধু বলব।
জব্বার দাঁড়াল মোহনলালের মুখোমুখি। দীর্ঘ শরীর তার। চওড়া বুকের ছাতি। চওড়া কব্জি। কিন্তু সুলেমান রোগা। ছোটখাটো। সে তার বড় ভাইয়ের আড়ালে আড়ালে থাকছে। মোহনলাল জব্বারের চোখে চোখ রেখে বলল—আমরা একটা মিছিল করব।
—কীসের মিছিল? কবে?
এই কাল, পরশু। পঞ্চায়েতের কাজকর্ম পণ্ড করার জন্য কংগ্রেসের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মিছিল।
—প্রথম কথা, কংগ্রেস কোনও সন্ত্রাস করেনি। সেদিন আমাদের যা দাবি ছিল তা ন্যায্য। দ্বিতীয় কথা, আপনারা মিছিল করবেন, করবেন। তার আমি কী বলব।
—আপনিও থাকবেন ওই মিছিলে।
জব্বার হাসে। বলে— মোহনবাবু, আপনি গ্রামের খবর রাখেন আগে ভাল করে। আপনি ভুল জায়গায় এসেছেন। আমরা এ-গ্রামে তিন পুরুষের কংগ্রেস।
—আমি জানি না কে বলল? গ্রামের খবর আমি ভালই রাখি জব্বারভাই। আপনার খবরও রাখি।
জব্বারের ভ্রূ কুঞ্চিত হয়। সে বলে—রাখেন যখন, আমাকে মিছিলে চাইছেন কী বলে?
—আপনি এবার থেকে আমাদের সঙ্গে থাকবেন। দেখুন কী অন্যায় করছে কংগ্রেসের অর্জুন সেন। গ্রাম সংসদের বিশেষ সভায় গৃহীত হওয়া তালিকা পালটাতে বলছে। কীরকম অগণতান্ত্রিক কাজ ভাবুন একবার।
—গ্রাম সংসদ দেখাবেন না আমাদের। কেউ জানতে পারল না, বিশেষ সভা হয়ে গেল। এই সভার সিদ্ধান্ত আমরা মানি না। দলের লোকদের নিয়ে সভা করিয়ে একটা তালিকা বানালেন। আমরা জানি ওসব খেলা।
সমিরুদ্দিন বলে—জব্বারভাই, কলাইয়ের ফসল তুলেছ? ছেলে কত বড় হল তোমার? বিবি-বাচ্চা নিয়ে সংসার করো, কী দরকার এত কথায়?
রাগে দুলতে থাকে জব্বার মণ্ডল। এ কী! এসব কী! তাদের গাঁয়ে দলাদলি আছে। রাজনীতি আছে। কূটকচালি কোন্দল আছে। কিন্তু এ তো ছিল না। এই ত্রাসন! এ কী! সে চাপা গলায় বলে—তোমরা বাড়ি বয়ে এসে আমাকে ভয় দেখাচ্ছ? ভয় দেখাচ্ছ তোমরা? শোনো, আমার নাম জব্বার মণ্ডল। কারও খাই না আমি। কারওকে ডরাই না। ভুল জায়গায় এসেছেন আপনি মোহনবাবু। আর এ কাজও আপনার ঠিক নয়। সন্ত্রাস ছড়াচ্ছেন আপনি গ্রামে।
মোহনলাল নিরুত্তাপ বলে—তা হলে আসছেন না আপনি?
–না।
তারা ফেরে। জব্বার মণ্ডল গায়ে একখানা গামছা চাপিয়ে অন্য পথে হনহন করে হেঁটে যায়। অর্জুন সেনের বাড়ি তার লক্ষ্য। এই সমস্ত কথাই সে জানাতে চায় অর্জুন সেনকে। তার ক্ষুব্ধ মস্তিষ্ক মাথার মধ্যে গনগন করে। দু’দিনের ছেলে মোহনলাল, সে কী করে এত সাহস পেয়ে যায়!
ওদিকে মোহনলাল দলবল নিয়ে মাতিন শেখের বাড়িতে ঢাকে। মাতিন শেখের পৃথক মেটে মেঝের ইটের ঘরে বসে সব। মোহনলালকে মধ্যমণি করে ঘিরে বসে। লণ্ঠনের আলোয় এইসব দেখে মোহনলাল পুলকিত হয়ে ওঠে। হচ্ছে! তার হচ্ছে! এতকাল সে রাসুদাকে মধ্যমণি হতে দেখেছে। মিহির রক্ষিতকে দেখেছে। বরকত আলিকে, অমরেশ চৌধুরীকে দেখেছে। আর আর আর দেখেছে তাকে। তাকে। ওই সিদ্ধার্থ নামের ছেলেকে। কী বোকা ছিল সে! কী বোকা! সিদ্ধার্থর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকাই অভ্যাস ছিল তার। আত্মগ্লানিতে ভরে যায় তার মন। এইসব সমিরুদ্দিন, মাতিন শেখের থেকে কিছু আলাদা ছিল না সে তখন। ছি ছি ছি। খানিক আগেকার পুলক ডিঙিয়ে তার অন্তর ছিছিক্কারে ভরে যায়। নিজেকে নিজেই দু’হাতে ঠেলে সবার উপরে তুলে দিতে চায় সে। তখন সমিরুদ্দিন বলে—মিছিলের কথাটা ঠিক বুঝলাম না দাদা। মিছিলের তো কোনও কথা শুনিনি। মোহনলাল বলল—মিছিল তো হবে না।
—তা হলে? আর জব্বার মণ্ডলকে ডাকলেই আমাদের পার্টিতে এসে যাবে ভাবলেন নাকি?
মোহনলাল একটা সিগারেট ধরায়। লম্বা করে টেনে ধোঁয়া ছাড়ে। বলে— জব্বারকে তোমরা কতটুকু জানো?
—কেন দাদা?
—জব্বার মণ্ডল গোপনে বাউলচর্চা করে তা জানো?
উপস্থিত জনমণ্ডলী স্তব্ধ বসে থাকে। মোহনলাল কোনও কথা বলে না। চুপচাপ ধূমপান করে যায়। বাউলচর্চার প্রতি ঘৃণা ও বিতৃষ্ণাকে ফুলে-ফেঁপে উঠতে দেয় সে। শক্ত হয়ে ওঠা মুখগুলি দেখে আমোদ পায়। সে যা চেয়েছিল, যেমন চেয়েছিল, তেমনই ঘটছে। এবার বাকি কাজ তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
তেকোনা মসজিদের ইমাম ফৈজুদ্দিনের ছেলে নইমুদ্দিন ছিল দলে। ভবিষ্যতে সে-ই হবে ইমাম। সে প্রথম কথা বলল।
—গ্রামের মধ্যে এসব চলবে না।
সমিরুদ্দিন বলল—বাইরে থেকে দেখে কিছু বোঝা যায় না।
শুক্রবার নিয়ম করে মসজিদে যায়।
রমজানে রোজা রাখে।
বিয়ে-শাদি সবই করে ইসলাম মতে।
কিন্তু গ্রামে এ চলতে দেওয়া যায় না।
এর বিচার করতে হবে।
বিহিত করতে হবে।
ওকে শিক্ষা দিতে হবে। ঠকাচ্ছে আমাদের!
হ্যাঁ ঠকাচ্ছে!
এত বড় সাহস! গ্রামের মধ্যে এইসব!
ওই আখড়াই যত নষ্টামির জায়গা।
মোহনলাল কথা বলে এবার— আখড়াকে দোষ দিয়ে কী হবে? প্রাচীন আখড়া সেই কবে থেকে গ্রামের একপাশে রয়েছে। ওরা ওদের মতো আছে।
তা ঠিক।
আমরা জব্বারের বাড়ি যাব।
ওকে ধরব।
মারব।
মেরে কবুল করাব ওর নষ্টামি।
মোহনলাল জটিল হাসে। বলে—দাঁড়াও, দাঁড়াও। অত তাড়াহুড়ো করলে হবে না। ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে। যা বুঝলাম, জব্বার মণ্ডল শক্ত লোক। মারধোর করলেও ও স্বীকার নাও করতে পারে। তখন হাওয়া আমাদের উলটোদিকে চলে যাবে।
—তা হলে কী করা যায়?
নইমুদ্দিন বলে—কথা কী করে স্বীকার করাতে হয় জানি। বাউলের গোস্ত খাওয়া বারণ আছে। জব্বার মণ্ডলকে গোস্ত খেতে হবে আমাদের সামনে।
মোহনলাল চোখ ছোট করে। এ সংবাদ জানা ছিল না তার। প্রস্তাব মন্দ নয়। কিন্তু তার চেয়েও ভাল জব্বার মণ্ডলকে হাতে হাতে ধরা। গুরু আসছেন আখড়ায়। অতএব জব্বার মণ্ডল, সুলেমান মণ্ডল আখড়ায় হাজির থাকবে নিশ্চয়। চোর নিসারের খবর অনুযায়ী এই আখড়ায় জব্বারদের যাতায়াত আছে। সে তার পরিকল্পনার কথা বলে।
—আগে ধরতে হবে। তারপর গোস্ত খাওয়াতে হবে জব্বারকে। এখন কারওকে কিছু বলার দরকার নেই। দু’দিন পর মাঝরাত্রে লোক জড়ো করে আমরা আখড়ায় যাব।
সমিরুদ্দিন বলে—তখন যদি ওকে না পাওয়া যায়?
নইমুদ্দিন বলে—পাওয়া যাবে। গুরু এলে বাউলের আখড়ায় প্রায় সারা রাত কাজ হয়। আমি জানি। কিন্তু যদি ধরতে না পারি, তা হলে গোস্ত খাওয়াতে হবে দাদা।
–হুঁ।
মোহনলাল সায় দেয়। অতঃপর আলোচনায় ব্যবস্থা পাকা হয়ে থাকে। এখনই কারওকে কিছু বলা যাবে না কারণ কোনওভাবে জব্বার মণ্ডলের কানে খবর গেলে সে সাবধান হয়ে যাবে। উঠে পড়ে সবাই। পরের দিন ভোরবেলা পাখি মারতে যাবে সমিরুদ্দিন, মাতিন শেখের দল। তাদের রুজি-রোজগারের ব্যাপার। জব্বারের প্রতি আক্রোশে ফুঁসতে ফুঁসতে যে-যার বাড়ির পথ ধরে। মোহনলাল স্বস্তি বোধ করে। জব্বার মণ্ডলের ব্যবস্থা হয়ে গেল। আর দু’জন বাকি। নুর মহম্মদ এবং অর্জুন সেন। সে ভাবতে থাকে। আকাশে দেখা দিয়েছে চাঁদ। সেদিকে তাকিয়ে তার শরীর সহসা শিহরিত হয়। সকলি বিস্মরণে গিয়ে চোখে ভেসে ওঠে জিন-পরির অবয়ব। বাড়ি ফিরে সে খায়, শোয়, কথা বলে। কিন্তু জিন-পরি নাছোড় আঁকড়ে ধরে তাকে। মাঝরাত্রে সে বেরিয়ে আসে। শরীর জুড়ে প্রত্যাশা জাগে তার। প্রতিটি রোমকূপে কামনার সতৃষ্ণ উৎসার। আসবে তো? সে আসবে তো? পায়ে পায়ে সে গ্রামের দক্ষিণপ্রাস্তে যায়। দেখে। নদীতে জল বেড়েছে বৃষ্টিপ্রপাতে। তার ওপর জ্যোৎস্না ঠিকরোচ্ছে আলো। প্রতি মুহূর্তে তার মনে হচ্ছে জল থেকে, জ্যোৎস্না মেখে উঠে আসবে নগ্না নারী। তার পিঠে ফিনফিনে পাখা। চুলে মেঘভার। যদিও সে জানে তার পাখা গুঁড়িয়ে গেছে। এখন সে আসে না অনাবৃত। তবু সে নগ্নতাই আকাঙ্ক্ষা করে আর চতুর্দিকে চায়। মেঘের আড়ালে চাঁদ ঢাকা পড়ে যায়, ঘন হয় অন্ধকার। আবার মেঘ সরে যায়। চাঁদ ওঠে। হালকা জ্যোৎস্নায় দিব্য রূপ পায় পৃথিবী। সে চলে, দেখে, প্রতীক্ষা করে। দেখতে দেখতে পল, অনুপল কাটে। দণ্ড কাটে। কতক্ষণ, কতক্ষণ জানে না সে। অবশেষে ফেরার পথ ধরে সে। কে জানে, বেশি দেরি দেখলে হয়তো নয়াঠাকুমা লোক নিয়ে তাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়বেন। ওই অজানা নারীর প্রতি ক্রুদ্ধ হয় সে। অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা ফুলকি তোলে পায়ের নখে। ক্রমে সেই আগুন ছড়িয়ে যায় আশিরনখ। তার মনে হয়, অসহনীয় এ দহন। এ আগুন। ইচ্ছে করে আখড়া জ্বালিয়ে দিয়ে মেয়েটাকে টেনে বের করে নেয়! আগুন!
হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় সে। আগুন, আগুন! আগুনের ভাবনা তাকে পথ প্রদর্শন করে। উল্লসিত হয়ে ওঠে সে। দ্রুত পায়ে বাড়ি ফিরতে থাকে। জিন-পরির অনুপস্থিতির বেদনা উদ্বায়ী পদার্থের মতো বাতাসে মিশে যায়। আর একটি মাত্র পথ তাকে পেতে হবে। কী কী কী পথ? সেনরা তাদের বড় বেশি ঘনিষ্ঠ পরিবার।