রাজপাট – ৪৭

৪৭

বৈশাখে বিষম ঝড় 
এ হিয়া-আকাশে। 
কে রাখে এ তরি 
পতি-কাণ্ডারী বিদেশে।।

.

তুমুল কালবৈশাখী হল, কিন্তু বৃষ্টি হল দু’-চার ফোঁটা। এ সময় বৃষ্টি হলে যারা আউশ ধান লাগিয়েছে তাদের ভাল। কিন্তু মাটি শুষ্ক রয়ে গেল যেমন কি তেমন। তবে দেহে কিছুটা আরাম বোধ হচ্ছে। মাটিতে ঝরে পড়েছে আম। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আম কুড়োতে বেরিয়েছে। ঘরে যাদের গাছ আছে তারা নিজের উঠোনের আম কুড়িয়েও সন্তুষ্ট নয়। বেরিয়েছে পরের বাড়ির গাছতলা থেকে যদি কিছু পাওয়া যায়। যে-বাড়িতেই ঢুকতে যায়, তাড়া খায়, দৌড়ে পালায় আর হি হি করে হাসে। 

আমের বাগান নেই গ্রামে। কিন্তু আম-কাঁঠালের গাছ প্রায় সব বাড়িতেই আছে একটা-দুটো। ইদরিশের বাড়িতেও আছে একটা ঝাঁকড়া আমগাছ। একদল বাচ্চা তাই মাসুদার আঙিনায় গিয়ে জুটল। ভয়ে ভয়ে পা রাখছে তারা। শব্দ না হয়। আম পড়ে আছে অনেক, অথচ কেউ কুড়োয়নি, এ দৃশ্যে পুলকিত তারা। এই ব্যতিক্রমে বিস্ময় বোধ করার বয়স তাদের হয়নি। তারা হুটোপাটি করে আম কুড়োতে লাগল। দু’জন ঝাঁপিয়ে পড়েছে একটি আমের ওপরেই। এ বলছে, আমায় দে, ও বলছে, আমায় দে। 

ঘর থেকে বেরিয়ে এল তখন মাসুদা। বাচ্চারা স্থবির। যেন ধমকালেই পালাবে সীমানা ছেড়ে। মাসুদা বলল—অ সোনা, মারামারি করে না। সবাই নাও, অ্যাঁ? সবাই নাও। 

তাড়া খাবে, পালাবে তাড়া খেয়ে, এমনই তাদের প্রত্যাশা। আর মজাও ওখানেই। এই সুমিষ্ট সম্ভাষণে তারা বিমূঢ় হয়ে গেল। হাতের আম আঁকড়ে ধরে শান্ত হয়ে গেল তারা। একটি শিশু একখানিও আম পায়নি। সে নাক খুঁটছিল। মাসুদা বলল-তুমি আম পাও নাই? হ্যাঁ বাপধন, আম পাও নাই তুমি? পেড়ে দেই। চল পেড়ে দেই। 

উঠোনের কোণ থেকে একটি বাঁশ নিয়ে তরুণ কাঁচা আমগুলি খুঁচিয়ে মাটিতে ফেলল সে। শান্ত হয়ে আসা বাচ্চারা অশান্ত হল নিমেষেই। মাসুদা নিজে তিনটি আম ধরিয়ে দিল শিশুটির হাতে। বলল—ধুয়ে খাবা। হ্যাঁ সোনাবাবা? 

সে এর মাথায় হাত রাখল, ওর গাল টিপে দিল। ঘোর সন্ধ্যা যেন আমগাছের ডাল ধরে ঝুলছে। ঝাঁপ দেবে এখুনি। আর নিমেষে রাত্রি নামবে। বাচ্চারা বুকের কাছে আম কয়টি চেপে ধরে ঘরে ফিরছে এবার। মাসুদা তাকিয়ে ছিল ওই দিকেই। তার চোখ জলে ভরে আসছিল। ফরিদা! ফরিদা! সে বেঁচে থাকলে এমনই দলের মধ্যে আম কুড়িয়ে বেড়াত। ভর সন্ধ্যায় দাওয়ার ওপর মাথায় হাত দিয়ে বসল সে। ভাবতে থাকল, আহা গো! কী কষ্ট পেয়েছে আমার ফরিদা! আহা গো! দাপিয়ে মরল। মেয়েটা আমার দাপিয়ে মরল। হায় রে, পানির তলায়, একটু বাতাসের জন্য হাঁকপাঁক করেছে সে। কলজে বুঝি ফেটে গেছে তার। 

সে আঁচল চেপে ধরে চোখে। বুক উথলে কান্না পায়। বারেবারে কাঁদে, তবু যেন কান্না ফুরোয় না। সে যে কেবল খালি করে চলে গেল। বুক খালি করে গেল। তার যে আর দ্বিতীয়টি নেই যে বুকে চেপে ধরবে। হায়! ওই মেয়েকে খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করবে বলে তারা আর সন্তান আনেনি। এখন তার শূন্য বুকে হাহাকার উঠে আসে। ফরিদা যদি অসুখ হয়ে মারা যেত, তা হলেও সে বুঝি সান্ত্বনা পেত। সে কিছুক্ষণ ডুকরোয়। তারপরই তার রাগ গিয়ে পড়ে আমিনার ওপর। তার নিজের দাদার ওপর। ওই পরিবারের ঘর-বাড়ি, দ্রব্যাদি, এমনকী খড়কুটোও তার রোষ থেকে মুক্তি পায় না। সে উঠোনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে—মর মর। মর তোরা। কলেরা হোক তোদের। তোরা সর্পাঘাতে মর। ঘরে আগুন লেগে ছারখার হয়ে যাক। তোদের মরণ দেখলে আমার চোখ জুড়োয়। 

আবার ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে সে। হাঁপায়। ভাল করে খায় না ঘুমোয় না। শরীর ভেঙে পড়ছে। টই-টই বাইরে ঘোরা মানুষ ইদরিশ তাকে ফেলে একদিনের তরেও গ্রামের বাইরে যায়নি। কিন্তু তার তো ঘরে বসে থাকলে চলে না। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ তারা। তা ছাড়া ঘরে বসে থাকলে ইদরিশেরও বুক ফেটে কান্না আসে। পুরুষমানুষ, নিজের বিবিকে সামলায় আর কলজে চেপে বসে থাকে যাতে কান্না ছিটকে বাইরে না আসে। মাসুদা ফরিদার ছোট ছোট ফ্রকগুলি বুকে চেপে ধরে। গন্ধ শোঁকে। কখনও ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, কখনও ঘুমের মধ্যে ফরিদাকে দেখে জেগে যায়। কাঁদে। ইদরিশ মাসুদাকে বুকে চেপে ধরে। সান্ত্বনার ভাষা পায় না। কেবল বলে—পাগল হোয়ো না, পাঞ্চল হোয়ো না মাসুদা, আমি তবে কোথায় যাই! 

মুখে রুচি লাগে না, তবু সে খেতে চায় যাতে মাসুদা রাঁধা-বাড়ি করে। সামান্য সঙ্গতির মধ্যেই এটা-ওটা রান্নার উপরোধ করে। ইদরিশ ঘরে এক স্বাভাবিকতার বাতাবরণ ধরে আনতে চায়। পড়শিনিরা আসে, বসে। সান্ত্বনা দেয়। মাসুদা স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করে। আবার পাগল হয়ে যায়। 

দাওয়ার খুঁটিতে ঠেসান দিয়ে বসল সে এখন। চোখ বন্ধ করল। সন্ধ্যার আঁধার হতে বেরিয়ে কে এসে দাঁড়াল তার সামনে। প্রথমে সে ঠাহর করতে পারল না। চোখের অন্ধকার সরাতে সরাতে বলল—কে তুমি গো! কে? 

কোনও জবাব এল না। সে ভাল করে দেখল। হ্যাঁ, হ্যাঁ। এ তো বোষ্টুমিদিদি। ফরিদাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কী বলছে যেন, কী বলছে? 

—মুড়ি খাবে মানিক? সোনার ধন আমার। মুড়ি খাবে? 

ঝুলি থেকে মুড়ি বার করে সে তুলে দিচ্ছে ফরিদার ঠোঁটে। মাসুদা ফুঁপিয়ে উঠছে— বোষ্টুমিদিদি, বোষ্টুমিদিদি! 

ময়না বৈষ্ণবী বলছে—আহা গো! বড় কষ্ট তোমার মাসুদা! কেঁদো না। 

—সহ্য করতে পারি না দিদি। খালি খালি লাগে। সব ফাঁকা গো। সব শূন্য। 

—জানি গো জানি। বুকের ধন গেলে এমনই তো লাগার কথা। 

—কী পাপ করেছিলাম দিদি? আর পাপী তো পাপী, আমি পাপী! আমার ওই ছোট্ট ফরিদা, শিশু ফরিদা, তার কী দোষ ছিল বলো! 

—ভগবানের মার কার ওপর এসে পড়বে তা কে বলবে বলো? কে তার বিচার করবে?

—আমি কী করি! কী নিয়ে থাকি! 

—কাজের অভাব কী মাসুদা? 

—আমি যে কিছুই করতে পারছি না গো…! 

—এই দেখো মাসুদা! ভাল আছে তোমার মেয়ে!

-–তোমার কোলে আছে দিদি? 

—আছে। 

—আমার কোলে দাও দিদি ওকে। 

—দিই। 

—ফরিদা-আ-আ-আ! আয় রে-এ-এ-এ। 

কেঁপে ওঠে সে। জেগে ওঠে। ছুটে গিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে। ফরিদা! ফরিদা! ইদরিশ ঘরে ফেরে তখন। মাসুদার মাথায় হাত রাখে। বলে- মাসুদা! শান্ত হও। পাঁচপিরের করুণা তো আছে আমাদের ওপর। আবার ফরিদাকে আনব আমরা মাসুদা। 

—শোনো। 

মাসুদা ঘোর চোখে তাকায়। আঁকড়ে ধরে ইদরিশের বাহু। ইদরিশের বুক হু-হু করে। তার মনে হয়, মাসুদা বুঝতে পারছে না কেন, তাকে এমন দেখলে ইদরিশের বুকে উথালি-পাথালি করে। সে যে আর যন্ত্রণা ধরে রাখতে পারছে না। সন্তান হারানোর শোকের সঙ্গে বিবির এই বিধুর ব্যাকুলতা তাকে দ্বিবিধ যাতনায় বিদ্ধ করে চলেছে। মাসুদা আবার ডাকল—শোনো! 

—বলো। 

—আমরা যে ওইসব ব্যবহার করেছিলাম তার পাপেই কি আমাদের সোনা চলে গেল? 

—না মাসুদা। বিশ্বসুদ্ধু লোক নিরোধ ব্যবহার করে। তাদের তো পাপ লাগে না। এ আমাদের নসিবের দোষ। 

—কিন্তু আর কারও তো এমন হয় না? 

—হয় মাসুদা। কত লোকের তো ছেলে মরে যায়। জাভেদ মিঞার মরেনি? জব্বার মিঞার মরেনি? মনে করে দেখো। আরও কত জনের অল্পবয়সি ছেলে মারা গেছে। 

—তারা কি ওইসব ব্যবহার করত না? 

–না। এ গ্রামে ওসবের চল কোথায়? মাসুদা, ওগুলো পণ্ডিত মানুষের তৈরি। মানুষের ভালর জন্যই। 

সে মাসুদার চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। গালে চুম্বন করে। মাসুদা তার বুকে মুখ ঘষে। সে টের পায়, তার বুকে লেগে যাচ্ছে মাসুদার চোখের জল। সে মাসুদার পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। চোখে জল আসে আরও। দাঁতে ঠোঁট কামড়ে সে কান্না রোধ করার চেষ্টা করে আর মাসুদাকে শুইয়ে দেয়। দু’জনেই, গর্ভসঞ্চারের অভিপ্রায়ে, নিজের নিজের শরীরে তীব্রভাবে কামনার দীপালোক জ্বালাতে চায়। কিন্তু শোকের জোলো ভারী বাতাস ভিজিয়ে দিয়েছে পলতে, বারুদে দিয়েছে অগ্নিধর্মের নির্বাপণ ঘটিয়ে, তেলে মিশিয়েছে জল। শোকের আবর্তে কাম চৌকাঠ পর্যন্ত এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। আর ঘরের ভিতর স্বামী-স্ত্রী যৌনভাবে যুক্ত হওয়ার পরিবর্তে শোকের জলে ভিজিয়ে দিচ্ছে পরস্পরের গাল। সময় লাগবে, আরও সময় লাগবে। কাম ফিরে যাচ্ছে দুয়ার থেকে। 

.

দুলু বাউল বেরিয়েছিল জসিম বাউলকে সঙ্গে নিয়ে। জব্বারের বাড়ি গিয়েছিল তারা। গুরু আসার দিন স্থির হয়েছে, জানাতে গিয়েছিল। ফিরে আসছে যখন, তারা এক মুহূর্ত দাঁড়াল ইদরিশের বাড়ির সামনে। দুলু বাউলের মনে পড়ল, ইদরিশ আর মাসুদাকে পছন্দ করত ময়না বৈষ্ণবী। আসত এই বাড়িতে। আজ ময়না বৈষ্ণবী নেই। ইদরিশের জীবনেও ঘটে গেছে কত বড় বিপর্যয়। ময়না বৈষ্ণবীর জন্য তার মন পুড়তে থাকল। বাউলের স্বভাব নয় শোক ধরে রাখা। জীবনের নিত্য সংঘটন বলে দুঃখকে তারা উড়িয়ে দেয় সহজেই। শোককে করে পরাভূত। যতদিন এ জীবন, ততদিনই আনন্দের সন্ধান। কিন্তু দুলু বাউল সে, আদ্যন্ত বাউল হয়েও শোক ভুলতে পারে কই! সে ভোলেনি তার প্রথম নারীকে। সে ভুলতে পারে না ময়না বৈষ্ণবীকে। বুড়িয়া এসে যাবার পরও ময়না বৈষ্ণবী তার সঙ্গে থাকে সারাক্ষণ। সে ভেবেছে কতবার, ময়না বৈষ্ণবী তার জীবনের মানুষ হয়নি বরং ভাল হয়েছে। কারণ বাউলে-বৈষ্ণবে মিল আছে, তফাতও আছে বিস্তর। এই বরং ভাল যে বুড়িয়া এসেছে তার জীবনে। সে কি স্থায়ী, না অস্থায়ী, সে জানে না। তবু ওই তার অর্ধবয়সী যৌবনবতী মেয়েটির প্রতি এখন নির্ভরশীল সে। মোহগ্রস্ত। তাকে ছেড়ে কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। তবু কি ময়না বৈষ্ণবী ছাড়তে চায়? অপরিসীম শক্তি তার। মনের গভীর জুড়ে তার বসবাস। বুড়িয়ার সঙ্গে আজও সে সক্ষম হয়নি সফল সাধনায়। ব্যর্থ হয়েছে তার বজ্রোলি মুদ্রা ধরা। ব্যর্থ হয়েছে গুরুজপ। তবু সে চেষ্টা করছে। করেই চলেছে। গুরুর আশীর্বাদে এখনও গর্ভবতী হয়নি বুড়িয়া এ এক নিশ্চিন্তি। 

এই আকর্ষণ, এই দেহসাধনা, এই তীব্র মোহ পার করেও দুলু বাউল যেখানে পৌঁছয় সেখানে সেই বস্তু নেই যা সে ময়না বৈষ্ণবীর সান্নিধ্যে পেত, তার নাম প্রাণের আরাম। বৈষ্ণবীকে দেখে তার শরীরে-মনে কামনা ফুটেছে কিন্তু গভীর শ্রদ্ধায় পবিত্র হয়ে গেছে বোধ-চেতনা। এই অনুভব বুড়িয়াকে দেখে জাগে কই! দৈহিক মোহমাত্র ছাড়া বুড়িয়াকে দেখে দুলু বাউলের জাগেনি স্নেহ, জাগেনি গভীর শ্রদ্ধা, জাগেনি প্রেম। যেন এক সাধনচুক্তিতে তারা মিলিত হয় পরস্পরে। দেহবোধ ছাড়া আর কিছু নেই সেখানে। উদার বসন্তে দুলু বাউল ছিল উন্মত্তপ্রায়। বুড়িয়া ছাড়া আর কোনও কিছু তার চেতনায় স্থান পায়নি। এককুড়ি বৎসরেরও অধিককাল নারীসঙ্গ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রেখেছিল সে। অপেক্ষা করেছিল মনের নারীর জন্য। অথচ সে জড়িয়ে গেল এমন নারীর সঙ্গে যার সঙ্গে তার মনের সংযোগ ঘটল না। এর চেয়ে কি ভাল ছিল না তার আজীবন নারীসঙ্গ-বঞ্চিতই থাকা? বসন্ত চলে গেছে। গ্রীষ্মের দাবদাহে ধীরে ধীরে সচেতন হয়ে উঠছে দুলুক্ষ্যাপা। মন ভরে যাচ্ছে গ্লানিতে। বিষণ্ণতায়। বাউলের নিয়মে সে অধর্ম করেনি। বুড়িয়া স্বয়মাগতা। সে বুড়িয়ার ইচ্ছাকে সম্মান দিয়েছে। কিন্তু তার নিজের ধর্মকে অসম্মান করেছে সে। প্রেমসঞ্চারের জন্য অপেক্ষা না করে শুধুমাত্র নারীদেহের ফাঁদে ধরা পড়েছে। 

এখন আর পিছিয়ে আসার উপায় নেই। এখন আর সে বদলে ফেলতে পারবে না অতীত। সে অতএব নিজেকে সমর্পণ করেছে সময়ের হাতে। যা হবার, হবে। শুধু গানের আশ্রয়ে ও মনের ভার দূর হয় না, এ এক বিষম জ্বালা। সে গুনগুন করে—

মানুষে মানুষ বিরাজে খুঁজে নেওয়া বড় দায়, 
মানিক চিনে দু’-একজনে শ্রীমহাজনের কৃপায় 

জসিম বাউল বলে তখন—একটা কথা বলি দুলুভাই। 

—বলো। 

—বলব বলব ভাবি। আবার মনে ভয় পাই। পাছে রাগ করো। 

—বলতে বাধা কী! এক ভিতে থাকি, একই গুরুর শিষ্য। আমরা কি আলাদা নাকি? 

—মেয়েটার মন নাই এখানে। যেন দু’ দিনের বেড়াতে এসেছে। 

—কী করে বুঝলে? 

—বুঝা যায়। মেয়েটাকে এনে তুমি ভাল করো নাই। 

—গুরুর অনুমতি নিয়েছিলাম। তা ছাড়া আমি আনিনি তাকে। সে যেচে এসেছে।

—যদি চলে যায়? 

—যাবে। বাঁধবে কাকে বলো? মানুষ কি বাঁধার জিনিস? 

—তোমরা দুটিতে যখন সুর মিলিয়ে গাও, দুলুভাই, প্রাণ ভরে সুরের জোয়ারে কিন্তু প্রাণ কান্দেও গো। মনে হয়, এ তো দু’দিনের, এ তো থাকবে না, তোমার কী হবে তখন? 

–কী আর হবে? আমি সদাই প্রস্তুত। 

—গণিমিঞা আর ক’দিন বাঁচবে? জাহিরাকে নিয়ে তুমি সুখী হতে পারতে! 

—কে জানে ভাই! যা ঘটে তা আপনি ঘটে। ও গণি বাউলের বালা। ওর প্রতি আমার নজর দেওয়া ঠিক নয়। যে আপনি আসে, যে স্বাধীন তাকে নিয়েছি। তার যাবারও অধিকার আছে। 

—মানুষমাত্রই তো স্বাধীন। জাহিরা কি স্বাধীন নয়? 

—গণিমিঞার সাধনসঙ্গিনী সে। 

—তুমি দুঃখ পাবে, এই আমার ভয়। ছোট মেয়ে। তার এখানে মন লাগবে কেন? কী উদ্দেশ্যে সে এল, তাই তো বুঝি না। 

—বোঝার দরকার কী! মনের মানুষের সন্ধানে ঘুরে মরছি। মনই হল মগজ। মগজই হল চালক। মগজ যা চায় তা-ই আমি চাই। মগজের ভুল ধরি তার সাধ্য কী! মগজ হল সুকর্ম ও কুকর্ম দুইয়েরই যন্ত্র। আবার মগজই হল যন্ত্রী। তা ওই দশমী দুয়ার আপন যন্ত্র আপনি গড়ে। আমি তুমি বলার কে? দুঃখ পাই তো পাব। তার সঙ্গে আমার দেহযোগ ঘটেছে। তাতে কী! দেহ তো ময়লা হয় না। ময়লা হয় মন। মন না চাইলে ময়লা হবে। ময়লা যদি হতে না চায় ছেড়ে যাবে। দুঃখ পাব। 

সে গুনগুনায়— 

মানুষ আছে প্রতিঘটে, দূরে নয় নিকটে, 
ফুলের কলি আপনি ফুটে, ভ্রমর ছুটে কাছে যায়।
সময়ে ফুল ফুটে সত্য, কিন্তু যারা জানে তত্ত্ব, 
গোড়ায় জল ঢালে নিত্য, ফুল ফুটে গাছের আগায়। 

জসিম বাউল কথা বাড়ায় না। দুলু বাউলও চুপচাপ ভাবতে ভাবতে পথ চলে। বলল বটে সে, দুঃখের পরোয়া করে না, কিন্তু দুঃখে দ্রবীভূত হয়ে থাকছে সে এখনই। ধীরে ধীরে ভাল না লাগা গ্রাস করছে তাকে। ময়না বৈষ্ণবীর মৃত্যুশোক থেকে অব্যাহতি পেতে সে বীরভূম গিয়েছিল। বীরভূম থেকে সঙ্গে এনেছে দুঃখের উপকরণ। তার মন তার বশে নেই। তার শরীর তার বশে নেই। জ্যৈষ্ঠমাসে গুরুদেব এলে বুড়িয়া নামের মেয়েটি দীক্ষা নেবে। তারপর? হয়তো একত্র থাকতে থাকতে তাদের মধ্যে জন্মাচ্ছে প্রেম। সে টের পাচ্ছে না। 

.

আখড়ায় পৌঁছে সে নিজের ঘরে গেল। বুড়িয়া শোয়নি। জানালার কাছে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। লণ্ঠনের আলোয় তার মুখ দেখাচ্ছিল ম্লান। কিন্তু তার বসবার ভঙ্গির মধ্যে, তার উদাস বাইরে তাকিয়ে থাকার মধ্যে সে খুঁজে পাচ্ছিল যেন অতি পরিচিত কারওকে। সে কে, সে বুঝে পাচ্ছিল না। সে কি এই নারীকেই দেখতে দেখতে সেই দেখার সঙ্গেই আজকের ভঙ্গিমার তুলনা করছে? সে বুঝতে পারে না। মাঝে মাঝে তার এমন হয়। মনে হয়, এই ভঙ্গি তার চেনা। কখনও কোনও কথা। কখনও কোনও হাসি। কে যেন আড়াল থেকে আপনার ছবি এঁকে ধরা না দিয়ে পালিয়ে বেড়ায়। 

তার রসপান বাকি ছিল। কড়োয়ায় রস ধরে সে ফিরে এল ঘরে। বলল— রসপান হয়েছে?

বুড়িয়া ফিরল। বলল—না। আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। 

মুখোমুখি বসে বসে আপন আপন কড়োয়ায় রসপান করল তারা। পাশের ঘরে গণিমিঞা কাশছে। তার কাশি একবার শুরু হলে থেকে যায় দীর্ঘক্ষণ। 

কড়োয়া রেখে পরস্পরকে প্রণাম করল তারা। দুলু বাউল বুড়িয়াকে মুক্ত করছে যখন, গণিমিঞার গলা শোনা গেল—জাহিরা। জাহিরা রে। প্যাচ্ছাপ করব। 

এ তাদের নিত্যসঙ্গী। পাশের ঘরের মল-মূত্র-কফ-থুতু তাদের সঙ্গে সঙ্গে ফেরে। হয়তো তারা পরমাশ্লেষে সংযুক্ত, বুড়িয়া দেহসুখের শব্দ তুলছে গলায়, দুলুক্ষ্যাপার দু’হাতের নীচে জগতের কোমলতম বর্তুল— তখন–তখনই—সশব্দে বাতকর্ম করল গণিমিঞা। ও ঘর হতে এ ঘরে এমনকী ভেসে এল দুৰ্গন্ধ! 

মাঝে মাঝে দুলু বাউলের মনে হয়, তার জমানো অর্থভাণ্ডার থেকে বেশি করে টাকা নিয়ে গণিমিঞাকে শহর থেকে সারিয়ে আনবে কিনা। কিন্তু এই বাসনাকে সে প্রশ্রয় দেয় না। যার যেমন জীবন। ওই ক’টা টাকা একবার উড়তে শুরু করলে ফুরোতে লাগবে দেড় দিন। নিজে সে টিপে টিপে খরচ করে ওই অর্থ। কখন কোন বড় কাজে লেগে যায়। রোগ-ব্যাধি নিয়ে কাতর হয়ে কী হবে! মৃত্যু যখন আসবার আসবে। ঠেকাবে কে? ওই সম্পদটুকু আছে বলে সে নিশ্চিন্ত, নির্ভীক। না হলে এই মহাভুবনে সে যে একা বিহার করে, কোনও অবলম্বন ছাড়া—সে বুঝি সম্ভব হত না। 

যে নিঃস্ব, তার মনও সেই নিঃস্বতার সঙ্গে সংসর্গ করে। যার কিছু আছে সে কিছু-থাকাকেই চায়। নিঃস্বতাকে যায় এড়িয়ে। 

বুড়িয়ার দেহ দেখে দুলু বাউলের মনে হল, এ যেন তার কিছু থাকা। নিঃস্বও নয়, বিপুলও নয়। সে আপনার বড় কোলে ছোটখাটো রোগা-সোগা মেয়েটিকে বসিয়ে চুম্বন করল। বুড়িয়া গলা জড়িয়ে ধরল তার। দুলু বাউলের মনে হল, এই মেয়েটি অনায়াসেই তার দুহিতা হতে পারত। মনে হওয়া মাত্র সে আবার চুম্বন দিল বুড়িয়ার কপালে। এই চুম্বনে যৌনাবেগ ছিল না। কিন্তু বুড়িয়া মেয়েটি যৌনাবেগ উপভোগ করে। সে নিজের জিহ্বা প্রলম্বিত করল। হাতের মুঠোয় নিল দুলু বাউলের শুক্রতট। সাধনক্রিয়া শুরু করল দু’জনে। গোড়া থেকেই আজ দুলু বাউল রইল সংযত। নিজেকে উন্মত্ত হয়ে উঠতে দিচ্ছিল না সে। লিঙ্গও সে ব্যবহার করছিল না। সে অঙ্গুলি মধ্যমা প্রসারিত করছিল। বুড়িয়া তীব্র হতে হতে একবার আঁকড়ে ধরছিল তার বাহু, একবার তার হাত টেনে স্থাপন করছিল স্তনে, একবার উন্মত্তা হয়ে ঝাঁপ দিচ্ছিল দুলুক্ষ্যাপার বুকে আর ক্ষেপি-পাগলির মতো শোষণ করছিল দুলু বাউলের ঈষৎ পুষ্ট মধ্যচল্লিশের স্তন। দুলু বাউল বিস্ফারিত হতে চাইছিল কিন্তু সংযত হওয়ার যুদ্ধ সে চালিয়ে যাচ্ছিল নিরন্তর। প্রতিদিন সে হেরে যায়। প্রতিদিন এই তরুণ মেয়েটির সম্পূর্ণতা আসার আগে সে স্খলিত হয়ে যায়। আজ সে হারতে চায় না। এবার থেকে হারতে চায় না। কারণ তার মোহাচ্ছন্নতা কেটে যাচ্ছে। নারীদেহের সান্নিধ্যে বিবশ বিহ্বলতা কেটে যাচ্ছে। সে ধীরে ধীরে ফিরে পাচ্ছে তার আত্মবিশ্বাস। আত্মসংযম। যার দ্বারা, বহু নারীর চোখে মুগ্ধতা দেখেও সে কখনও আপনাকে হারায়নি। এখন তার মনে হচ্ছে, ময়না বৈষ্ণবীর মৃত্যুশোক তাকে এত বিহ্বল করেছিল, এত গভীরভাবে, তীব্রভাবে অধিকার করেছিল যে সে আর আপনাতে আপনি ছিল না। না হলে এই ছোট মেয়েটিকে সে প্রতিহত করতে পারত। 

সে লণ্ঠন এনে কাছে রাখল আর আলোয় ভরে তুলল যোনি। সে ধীরে ধীরে মৃদু স্বরে বিবরণ দিতে থাকল সেই যোনিরূপের। যেন এক চাঁদ ফুটে আছে, যেন এক ফুল ফুটে আছে, যেন এক বনবীথিকায় রচিত হয়েছে চিত্রকূট পর্বত। বড় কাব্যিক সেই বর্ণনা। বুড়িয়া শুনছে আর শিউরে উঠছে। সে উত্তাল হচ্ছে, তাপিত হচ্ছে আর গলছে। গলতে গলতে দ্রবীভূত হয়ে যাচ্ছে অসহায়। দুলু বাউলের বাহু খামচে ধরে সে বলছে—তুমি তুমি তুমি এত পারো! 

সে নিজের বুকের ওপর টেনে নিচ্ছে দুলু বাউলকে। দুলু বাউল এতক্ষণ পর, নারীদেহের ওপর শুয়ে, নারীদেহকে ব্যবহার করে, স্বহস্তে মুক্ত করছে নিজেকে। 

বুড়িয়া হাঁপাচ্ছে তখন। বলছে—আজ আমার খুব ভাল লেগেছে দুলেন্দ্র। 

দুলুক্ষ্যাপা চমকে উঠে বসছে। বলছে—কী বললেন? 

—বললাম, আজকের মতো ভাল আমার আগে কখনও লাগেনি। 

দুলু বাউল এক মুহূর্তের জন্য উদাস হয়ে গেল। এই বাক্যবন্ধ, আজ আমার খুব ভাল লেগেছে দুলেন্দ্র, কোন অতীত থেকে উঠে আসতে চাইছে তার কাছে! 

পাশাপাশি শুয়ে পড়ল তারা। পোশাক পরল না। এই ভীষণ জ্যৈষ্ঠে নগ্নতা বড় আরামের। এই প্রথম, যৌনতা মিটে যাবার পরেও বুড়িয়া জড়িয়ে ধরল দুলু বাউলকে। দুলু বাউল অন্ধকারে হাসল, বুড়িয়া টের পেল না। আজ দুলু বাউল তৃপ্ত। তৃপ্ত কারণ আজ সে জয়লাভ করেছে। আজ তার আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছে। আজ সে বিহ্বল হয়ে যায়নি। কিন্তু তার বুকের মধ্যে ঘুরে-ফিরে বেড়াচ্ছে বিস্ময়। কে, কে, কে? এই মেয়েটি কে? সে বুড়িয়াকে প্রশ্ন করে—আমার মতো বুড়ো লোককে আপনার পছন্দ হল কেন? 

বুড়িয়া বলে—আমরা কি কোনও দিন তুমি বলব না? 

—না যদি বলি? কী হয়? সম্বোধনে কী যায় আসে গো ক্ষেপি? 

—কিছু না। 

—আমার কথার জবাব দিন। 

–কী? 

—আমি এক বুড়ো লোক, আমাকে ধরলেন কেন? 

—আপনি বুড়ো নন। আমাকে প্রথম নিয়েছিল যে, তার বয়স আপনার চেয়ে বেশি। আমার একজন প্রেমিক ছিল। তার বয়স এখন বাহাত্তর। 

—আপনার কথা জানতে ইচ্ছে হয়। আপনার মা কে। বাবা কে। তাঁরা কোথায় থাকেন? 

–কী হবে জেনে? একজন মানুষের সঙ্গে আরেকজন মানুষের সম্বন্ধ হয়। ব্যস। তার জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর সম্পর্কে খোঁজখবর করা এক আদিম ধারণা। 

—মানুষ তো তার শিকড় ছাড়া বাঁচে না। মানুষ তো স্বয়ম্ভূ নয়। এক জন্মের পশ্চাতে আছে অন্তত ছয়টি মানুষের অবদান। 

–কীভাবে? 

—দু’জোড়া নারী-পুরুষ আলাদাভাবে মিলিত হল। তারা একটি পুরুষ ও একটি নারীর জন্ম দিল। তারা মিলিত হল। তবে আপনি জন্মালেন। আমি জন্মালাম। 

—মানলাম। কিন্তু মানুষের শিকড়ের খোঁজ চাই তার নিজের জন্য। আমি কে, আমি কী, এই উত্তরের জন্য। কোনও সম্পর্কের জন্য তা নিষ্প্রয়োজন। আপনার পরিবারের খবর তো আমি জানতে চাইনি। 

—আমাদের সম্পর্কের পরিণতি কী বুড়িয়া? আপনার সঙ্গে আমার বিবাহ হয়নি। আপনি দীক্ষা নিলে আপনি আমার সাধনসঙ্গিনী হবেন। বাউলের ধর্মে তাকে বিবাহের সমান মর্যাদা দেওয়া হয়। 

—বিবাহ সমাজের সৃষ্টি ক্ষ্যাপা। সম্পর্ক কিন্তু সমাজের সৃষ্টি নয়। সম্পর্ক শাশ্বত। স্বতঃস্ফূর্ত। কোনও নাম না দিলেও সম্পর্ক হবে। সম্পর্ক থাকবে। বাকি সব তো বানানো। সংস্কার। আর পরিণতির কথা কি বলা যায়? আজকের মধুর সম্পর্ক কি কালকেই তিক্ত হয়ে যায় না? আপনি সংসারত্যাগী হয়েও সংসারী মানুষের মতো কথা বলছেন। সংসারে মানুষের কত মায়া, কত বন্ধন। সন্তান-সন্ততি, আত্মীয়, বন্ধু। তবু কি সম্পর্ক সুন্দর থাকে? অটুট থাকে? থাকে না। ভেঙে যায়। অর্থহীন হয়ে যায়। চার দেওয়ালের খাঁজে চারজন মানুষ চারটি পৃথক দুনিয়া রচনা করে। তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের কিন্তু নাম থাকবে। পরিণতি কী? শূন্য নয়? একই ঘরে থেকে, কুড়ি বছর বসবাস করার পরও, মানুষ পরস্পরের অচেনা রয়ে যায় না? পরিণতির কথা ভেবে কী লাভ? সম্পর্ক যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ তাকে পূর্ণমূল্য দেওয়া ভাল। 

—এখন কি আমাদের কোনও সম্পর্ক আছে? 

—আপনার সঙ্গে আমার জন্মের সম্পর্ক। সে আমি আপনাকে জেনেই বলছি। আমার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কী তা আপনাকে বুঝতে হবে। 

দুলু বাউল চুপ করে থাকল। সে-ও তো মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কেই বিশ্বাস করে। তবু কিছু আটপৌরে প্রশ্ন করে ফেলল। মানুষের মনের মধ্যে বাসা বেঁধে থাকে সংস্কার। সময় সময় তা মুখ তোলে। সে নিজেও তার ব্যতিক্রম নয়। যে-সমাজকে সে ছেড়ে এসেছে, সেই সমাজ তাকে জড়িয়ে আছেই কোথাও। কিন্তু সত্যিই তো সে সংসারত্যাগী নয়। সংসারত্যাগী তো হতে পারে না কেউ। গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীও সংসারত্যাগী নয়। ময়না বৈষ্ণবীর কথা তার মনে পড়ে। সে বলত—আমার বলে কিছু নেই এই ভাবনায় তুমি আপন সংসার ত্যাগ করতে পারো, কিন্তু জগৎ-সংসার তোমাকে ছাড়বে কেন? আমৃত্যু তুমি তার সকল দুঃখ-শোকে জড়িয়ে থাকবে। তার নানান ভুল-ত্রুটি, মর্যাদা-অমর্যাদা তোমাকে আচ্ছন্ন করে রাখবে না? 

দুলুক্ষ্যাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তত্ত্বে যতই অমিল থাক, বিশ্বাসে যতই পার্থক্য থাক, ওই ময়না বৈষ্ণবীর মধ্যে ছিল তারও পথের সন্ধান। তাকে সম্পূর্ণ না পেতেই সে চলে গেল। হায় হায়! কী করুণভাবে চলে গেল। হঠাৎই সর্বত্যাগী, ঘুরে-বেড়ানো, গান গাওয়া ক্ষ্যাপা মানুষটির মুঠো শক্ত হয়ে আসে। যদি কোনও দিন সে সন্ধান পায় হত্যাকারীদের, যদি কোনওদিন দেখতে পায়, সে শোধ নেবে। চরম প্রতিশোধ নেবে! কী প্রতিশোধ সে জানে না। নির্মমতার বদলে নির্মমতা, মৃত্যুর বদলে মৃত্যু। 

নিজের মধ্যেকার সুপ্ত রোষ পরিস্ফুট হয়ে উঠতে দেখে সে বিস্মিত হয়ে যায়। সে বাউল। তার ধর্ম সুন্দরের সন্ধান। কিন্তু তার হৃদয়ে আত্মগোপন করে আছে হাজার অসুন্দর। সে দিশেহারা বোধ করে। কী তার করা উচিত। কীভাবে ভাবা উচিত। সুন্দরকে যারা হত্যা করে, অবমানিত করে, তাদের প্রতি প্রতিশোধস্পৃহ হওয়াও কি সৌন্দর্য নয়? মানবিক নয়? হ্যাঁ, হতে পারে সেই সৌন্দর্য আগুনের মতো। পোড়ায়। কিন্তু অপ্রেমের বিরুদ্ধে মানুষের মধ্যে জেগে উঠবেই অপ্রেম। তাকে সংযত করার ক্ষমতা মানবিক কিন্তু মানবিকতার এই পরীক্ষা কঠিনতম। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে কথা বলে বুড়িয়া। যেন দুলু বাউলেরই ভাবনার প্রতিধ্বনি তার মুখে শোনা যায়। সে বলে—ময়না বৈষ্ণবী কে? 

দুলু বাউল চমকিত হল। বলল— তার কথা কে বলল? 

—ওরা বলে। পারুলদিদি। জাহিরাদিদি। 

—সে ছিল এ অঞ্চলের চেনা বৈষ্ণবী। 

—আর কিছু নয়? 

—আর কী? 

—আপনি তাকে ভালবাসতেন। 

—সে কথা থাক। তাকে সকলেই ভালবাসত। 

—আর কাকে ভালবেসেছেন আপনি? 

—মানুষ পেলাম কোথা ভালবাসবার? খুঁজতে খুঁজতেই দিন গেল।

—আমাকে ভালবাসেন না? 

—এখনও জানি না আমি। নিজেকে চিনতে সময় লাগবে গো। 

বুড়িয়া চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর বলল—আমিও জানি না আপনাকে ভালবাসি কি না। আমার এক-একজনকে দেখে প্রথমে মনে হয় ভালবাসি। একে সবচেয়ে বেশি ভালবাসি। এর জন্য সব ছেড়ে দিতে পারি। কিন্তু কিছু দিন পরে ক্লান্তি আসে। তখন যাকে ভালবেসেছিলাম সে পাগল-পাগল হয়ে যায় কিন্তু আমি কেন আর ভালবাসতে পারছি না ভেবে দেখে না। আমাকে জোর করে ধরে রাখতেও পারে না। 

—জোর করে ধরে রাখা যায় না কারওকে। 

—না। সেই জোর না। ভালবাসার জোর। যে-ভালবাসা নিরভিমান, তার জোর অসীম। তাকে অস্বীকার করা যায় না। অন্যরা নিজেকে ভালবাসে। আমাকে নয়। আমি তাকে ভালবাসি—এই তৃপ্তিকে ভালবাসে। তাই আমি সরে এলেই ভেঙে পড়ে। কিন্তু যে আমাকে ভালবাসবে, সে কেন হিসেবি হবে? আমি তাকে ধরলাম কি ছাড়লাম তাতে তার কী আসে যায়? 

—এমন লোকের দেখা পেয়েছেন? 

—পাবার সম্ভাবনা আছে। প্রথমে ভেবেছিলাম বৃদ্ধ প্রেমিক এমন হতে পারে। এমন নির্মোহ। নিরভিমান। কারণ তার সব পাওয়া হয়ে গেছে। যা পাওয়া হয়নি তা-ও স্পষ্ট। এবার সে যা পাবে তার সবটাই বাড়তি, সেই পাওনা নিয়ে সে আগ্রাসী অধিকারে বসবে না, কবলিত করতে চাইবে না। কিন্তু তেমন হল না। 

—কেন? 

—কেন জানি না। যামিনী সমাজপতির নাম শুনেছেন? 

—যামিনী সমাজপতি? যামিনী সমাজপতি? তিনি… তিনি কি নাট্যকার? 

—হ্যাঁ। বাংলায় নতুন ধরনের নাটক এনেছেন তিনি। কোনও দৃশ্যপট ছাড়া, কোনও মঞ্চ ছাড়া, খোলা আকাশের তলায় অভিনয়। ধরা যাক, দৃশ্যে কোনও গাছ আছে, তা গাছ না এনে একজনকে হাত তুলে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল। সে-ই হল গাছ। 

—হুঁ। শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক ছিলেন তিনি। 

—বিশ্বভারতীর। 

—হ্যাঁ। বিশ্বভারতীর। তাঁকে দেখেছি। 

—আমি তাঁর নাটকের দলে যোগ দিলাম। এত ভাল লেগেছিল ওঁকে। কী সপ্রতিভ! কী জ্ঞান! কী প্রতিভা মানুষটার! উনি আমাদের শেখাতেন আর আমি ওঁকে দেখতাম। দেখতে দেখতে মনে হল ওঁকে ছাড়া বাঁচব না। ওঁর বয়স তখন আটষট্টি। অবসর নিয়েছেন বহু আগেই। শ্রীনিকেতনের দিকে একটি ছোট কুটির বেঁধে থাকেন। অধিকাংশ সময় থাকেন কলকাতায়। একদিন সরাসরি চলে গেলাম ওঁর কাছে। ওঁর স্ত্রী মারা গেছেন তার পাঁচ বছর আগে। ছেলেমেয়েরা বাইরে। একা মানুষ। বললাম আমি ওঁর কাছে থাকতে চাই। 

—যেমন আমাকে বলেছেন? 

—হ্যাঁ। তবে আপনাকে অনেকদিন বলতে হয়েছে। ওঁকে বলতে হয়েছিল মাত্র একদিনই। একবারই। তবে বাড়িতে আমাকে থাকতে দিলেন না উনি। বললেন, বদনাম হবে। কিন্তু ওইটুকুই। দিনরাত ওখানেই পড়ে থাকতাম। ওঁর কলকাতা যাওয়া কমে গেল। আমি ক্লাসে ফাঁকি দিলাম। উদ্দাম হয়ে উঠল সম্পর্ক। ওই বয়সেও উনি কী ভীষণ পুরুষ হয়ে উঠতেন। কিন্তু মুশকিল শুরু হল মাস দুয়েক পরে। অসম্ভব অধিকারবোধ জেগে উঠল ওঁর। আমাকে কোনও ছেলের সঙ্গে দেখলেই ওঁর মুখ গম্ভীর হয়ে উঠত। কোনও যুবকের সঙ্গে হেসে কথা বললেই আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতেন। আমি প্রথম প্রথম ভাবতাম ভালবাসার তীব্রতা। তারপর ভুল ভাঙল। দেখলাম ভালবাসা নয়। আমাকে ভালবাসেন না উনি। বাসেন নিজেকে। নিজের খ্যাতি, প্রতিপত্তি, প্রতিভা ও সম্মানে জড়ানো আমিত্বকে। আমি তাঁর আত্মগর্বকে তৃপ্ত করেছিলাম, এই মাত্র। তিনি তখনও একজন সক্ষম আকর্ষণীয় পুরুষ— এই অহং-কে তৃপ্ত করেছিলাম। অতএব তিনি আমাকে অধিকার করতে চাইলেন। আমি বুঝলাম। তা ছাড়া স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ আমি সইতে পারি না। আমি কারও সঙ্গে কথা বলতে পারব না কেন? মিশতে পারব না কেন? আমি তো আত্মবিক্রয় করে দিইনি। মাস ছয়েক পরে আমার দম বন্ধ হয়ে এল। আমি ফিরতে চাইলাম। উনি প্রথমে লোভ দেখাতে চাইলেন আমাকে। ওঁর সান্নিধ্যে থাকলে অচিরেই বিখ্যাত হয়ে উঠব আমি। এমন বোঝালেন। তখন আমি ওঁর দল ছাড়লাম। বললাম অভিনয় আর ভাল লাগছে না। উনি কান্নাকাটি শুরু করলেন। তখন ওঁর বাড়ি যাওয়া ছাড়লাম। এবার ভয় দেখালেন আত্মহত্যা করবেন। বললাম, স্বাভাবিক মৃত্যুর বয়সই যখন হয়েছে, তখন আর কষ্ট করে লাভ কী! 

—তারপর? 

—আত্মহত্যা করলেন না। কিন্তু বিয়ে করলেন। 

–কাকে? 

—কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনেছিলেন। সেখানে একটি পরিচারিকা ছিলেন। তাঁকে। 

দুলু বাউল চুপ করে গেল। এত কথা কেন বলল বুড়িয়া! সে কি সাবধান করে দিল! কীসের সাবধানতা? বুড়িয়া যদি চলে যায়, দুলু বাউল কি উন্মত্তের মতো আচরণ করবে? কাঁদবে? 

বুড়িয়া পাশ ফিরে শুতে শুতে বলল—ঘুমিয়ে পড়ুন। রাত হল। 

দুলু বাউলের ঘুম এল না। বুড়িয়ার মতো মেয়ে বিরল। সাধারণের চোখে সে নিন্দনীয় নিশ্চয়ই। কিন্তু দুলুবাউল কিছুতেই তাকে খারাপ বলতে পারল না। কারণ বুড়িয়া অকপট। তার কোনও ছলনা নেই। এই মেয়ের মধ্যে এখনও চলেছে গড়ন-পেটন। এখনও তৈরি হয়নি সে। এখনও সে উদ্দাম। দুর্নিবার। গতিশীল। এই উদ্দামতা তাকে অসাধারণত্ব দিতে পারে আবার ধ্বংসও করে ফেলতে পারে। যাই ঘটুক, দুলু বাউল আজ নিশ্চিত, বুড়িয়া এখানে থাকবে না। থাকতে আসেনি। তা হলে কেন এসেছে! বুড়িয়া কে? কে? তাকে মাঝে মাঝে এত চেনা লাগে কেন? 

সে উঠল। ঘুম আসছে না। দরজা খুলে বেরিয়ে এল সে। স্তব্ধ হয়ে গেছে আখড়া। গণি বাউলেরও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না এমনকী। সে এসে আঙিনার কোণে বসল চুপ করে। তখন পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এল একটি মানুষ। দুলু বাউল অবাক হয়ে দেখল সেই মানুষটি পথের দিকে চলল। এই রাত্তিরে। একা-একা কোথায় গেল? পথে কোনও বিপদ হতে পারে তো! অনুসরণ করার জন্য উঠে দাঁড়াল সে। কিছুক্ষণ গিয়ে আবার ফিরে এল। কেন যাবে! যে বেরিয়েছে, সে তার নজরদারির পরোয়া করেনি। বরং বেরিয়েছে গোপনে। কেন বেরিয়েছে, কোথায় গিয়েছে, তা জেনে দুলুক্ষ্যাপার লাভ কী! সে ফিরে এল আঙিনায়। বসে থাকল। এবং দেখল অতঃপর একটি দীর্ঘকায় মানুষের হেঁটে যাওয়া। কোনওদিকে না তাকিয়ে মোহগ্রস্তের মতো ছুটে যাচ্ছে সে। মানুষটিকে চিনল দুলুক্ষ্যাপা। চাটুজ্যেবাড়ির সোমেশ্বর চাটুজ্যের ছেলে মোহনলাল। আর আখড়া থেকে যে গেল সে কে? তাকে চিনতেও ভুল হল না তার। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *