রাজপাট – ৪৬

৪৬ 

বৈশাখ মাসে ফতেমা গো 
কি করুইন বসিয়া। 
তোমার যাদু কান্দন করে 
কাডা শির লইয়া।। 
ডাইন হস্তে কঙ্কনা বান্ধ্যা 
বাম হস্তে বালারে। 
আড়াই দিন আছলাইন মাগো 
ইল্লালার দরবারে।। 
হায় হায় রে—
ফাতেমা যে বলে জবরিল 
তুমি আমার ভাই। 
আইজকা অইতে ইমাম উছেন 
রইল কোন ঠাঁই॥ 
আইন্যা দেও আইন্যা দেও ভাইরে 
বলি যে তোমারে। 
নয়নেরই পুতলি আমার 
আইন্যা দেও আমারে। 
হায় হায় রে—

.

সকাল হতে গ্রীষ্মের কাঠিন্যে বন্ধ হয়ে গেছে পাখির গান। দারুণ দাহে পশু-পাখি-মানুষের গলা শুকিয়ে উঠছে। শিশুরাও এমনকী দামালপনা করছে না, বরং পাথরগুটি খেলছে দাওয়ায় বসে। ভৈরবের জলধারা সরু হয়েছে আরও। আরও শীর্ণ। তবু সেই জল স্নিগ্ধ। শীতল। ভোর হতে নদীর পাড়ে লোক। সুযোগ পেলেই একটু গা ভিজিয়ে নিচ্ছে। রৌদ্রপোড়া থমথমে দিবসে কচি বৃক্ষপত্রগুলি কাতর। সতৃষ্ণ। 

মানুষের তবু কাজের বিরাম নেই। বরকত আলির ঘরে আজ গ্রাম সংসদের বিশেষ সভা তিনটে নাগাদ সভা বসবে। তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে আকাশের দিকে দেখছেন। প্রকৃতির ভাব দেখে মনে হচ্ছে আজ ঝড় উঠবে। 

দুপুর-দুপুর এসে গেল লোকজন। বরকত আলি যাদের খবর দিয়েছিলেন তারা এল। মোহনলাল এল। এতদিন গ্রাম সংসদের সভায় সভা-ভাষ্য নথিবদ্ধ করত যুধিষ্ঠির সেনের মেয়ে কবিতা। এবার ডাকা হয়নি তাকে। মোহনলাল নিজেই লিখে দেবে যা লেখার। নতুন করে আলোচনার কিছু ছিল না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চর-বণ্টনের তালিকা থেকে বাদ গেল আইনুল মোল্লার নাম। এ ছাড়া পথ তৈরির পরিকল্পনা ও আনুমানিক ব্যয়ের খসড়া বিষয়ে একমত হল সকলে। মোহনলাল লিখছিল— 

আজ বিকেল তিনটেয় তেকোনা গ্রামের জনাব বরকত আলির গৃহপ্রাঙ্গণে জনাব বরকত আলির সভাপতিত্বে তেকোনা গ্রাম সংসদের বিশেষ অধিবেশন শুরু হয়। সরকারি অনুদানের অর্থ কীভাবে ব্যয় করা হবে তার পরিকল্পনার জন্য এই সভা আহ্বান করা হয়েছে। 

এই পরিকল্পিত কর্মসূচি নিম্নে লিখিত হল। 

১. তেকোনায় প্রবেশের পথে মাটি ফেলা ও ইটের টুকরো বসানো। 

২. বাউলের আখড়া থেকে ইদরিশ আলির বাড়ি পর্যন্ত একইভাবে পথ তৈরি। 

৩. হোসেনুর বিশ্বাসের বাড়ি থেকে করম মণ্ডলের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা তৈরি। 

৪. জহরুদ্দিনের বাড়ির সামনে নালার ওপর ছোট পুল তৈরি। পুলের উপকরণ হবে কাঠ। 

৫. নদী পারাপারের বাঁশের সাঁকো মেরামত এবং বাৎসরিক ঠিকাদার নির্বাচন। 

৬. পাড় থেকে নদীতে নামার জন্য ইটের ধাপ নির্মাণ। 

৭. নতুন চর বণ্টন। চরের জমি পাবে হোসেনুর বিশ্বাস, জহরুদ্দিন, আনসারি মিঞা, কাদের মিস্ত্রি, ফকরু মিস্ত্রি। 

সমগ্র কর্ম সম্পাদনের জন্য অনুদানে প্রাপ্ত তিন লক্ষ টাকা ধার্য হল। এই কাজে গ্রামের বেকার যুবকরা অংশ গ্রহণ করতে পারবে। তাদের নির্দিষ্ট হারে মজুরি দেওয়া হবে। এ ছাড়া পার্শ্ববর্তী গ্রাম রেশমকুচি থেকেও কয়েকজনকে সুযোগ দেওয়া হবে। এই কাজ সম্পাদনা ও পরিচালনার জন্য একটি সমিতি নির্মাণ করা হল। সমিতির প্রধান হিসেবে থাকছেন মোহনলাল চট্টোপাধ্যায়। তাঁকে সাহায্য করবেন হোসেনুর বিশ্বাস, সমিরুদ্দিন, মাতিন শেখ, মফিজ মিঞা। 

.

কেউ আঙুলের ছাপ দিল। কেউ স্বাক্ষর করল। যারা স্বাক্ষর করল তাদের মধ্যে মোহনলাল বাদে বাকিরা কেবল কোনও ক্রমে স্বাক্ষরটুকুই শিখে রেখেছে। 

মোহনলালই সঙ্গে এনেছিল সমিরুদ্দিন, মাতিন শেখ, মফিজ মিঞার দলটিকে। বরকত আলি তাদের ডাকেননি। সভা শেষ হয়ে গেলে গোটা দলটিকে নিয়ে বেরুল মোহনলাল। এখন তার অনেক কাজ। জব্বার নামের লোকটাকে ধরতে হবে। দলে টানতে হবে। রেশমকুচির নুর মহম্মদকে ছেঁটে দিতে হবে। দল বাড়াতে হবে। এবং শুধু এই পঞ্চায়েতের নয়। অন্যান্য পঞ্চায়েতগুলিতে নিজের প্রসার ঘটাবে সে। দ্রুত, খুব দ্রুত করতে হবে এইসব। এর সঙ্গে হরিহরপাড়ার চাকরিটা যদি পেয়ে যায়, তা হলে হরিহরপাড়াতেও আস্তে আস্তে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করবে। এসব কাজে সমিরুদ্দিনের দলটিকেই সে মনে করছে উপযুক্ত। কারণ তারা বেপরোয়া। সীমান্ত বন্দোবস্তের পেশা তাদের মধ্যে গড়েছে এক দুরন্ত স্বভাব। মোহনলাল তাকেই কাজে লাগাতে চায়। ভালমানুষের ছেলেকে দিয়ে সব কাজ সবসময় হয় না। সে জানে, এই সমিরুদ্দিন, মাতিন শেখরা একটি রাজনৈতিক দলের অনুগ্রহ পেতে কতখানি কাতর। সে দেবে এই অনুগ্রহ। বিনিময়ে এদের সম্পূর্ণ ব্যবহার করবে। নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য হাতিয়ার বানিয়ে নিতে হয়। প্রয়োজন ফুরোলে হাতিয়ার ছুড়ে ফেলে দেওয়াই তো যায়। 

সে জানে না তাকে কতদূর যেতে হবে। কিন্তু সে প্রস্তুতি নিয়ে চলেছে। দেখেছে সে, দলের আশ্রয়ে পুষ্ট উদ্দাম সমাজবিরোধীর দাপুটে খেলা। যাকে আশ্রয় দিয়ে দল হল শক্তিমান, অবশেষে পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি গড়ে তোলার পালা এলে, দল তাকেহ ঝেড়ে ফেলে দিল। দাপুটে লোকটা কোণঠাসা হয়ে গিয়ে হাজার শত্রুর হাতে ক্রীড়নক। 

এ-ও এক অস্ত্র বটে। এই গড়ে তোলা, ছুড়ে ফেলা, গড়ে তোলা এবং ছুড়ে ফেলা ফের। এই অস্ত্র সে-ও নেবে না কেন? বহু খ্যাত নেতৃত্বের প্রতিষ্ঠা হয়েছে এমত পথেই। 

সে বরকত আলির বাড়ি থেকে বেরিয়ে সমিরুদ্দিন ও মফিজ মিঞাকে বাইকে তুলে নিল। তখন মাতিন শেখ তার বাইকে হাত দিয়ে বলল—এরকম একটা গাড়ি কিনতে কত লাগে? 

শব্দ করে হেসে উঠল সবাই। 

—তুই কিনবি? তুই কিনবি? 

মাতিন শেখের উচ্চতা চার ফুটও নয়। একটি হাত কবজি থেকে কাটা। গোরুর জন্য খড় কাটতে গিয়ে হাতসুদ্ধু নামিয়ে দিয়েছিল। মাতিন শেখের স্বরও সরু। দাড়ি গজায়নি ভাল। বলা চলে হাফ-মাকুন্দে। তার শখ, সে একটি মোটরবাইক কিনবে। গোপনে টাকা জমাচ্ছে সে। কেউ জানে না। 

সমিরুদ্দিন বলল—তুই বাইকের খবর নিয়ে কী করবি? তোর তো বাইকে উঠতে গেলে মই লাগবে। 

আবার হেসে উঠল সবাই। এবার মোহনলাল বলল—কিনলে বোলো পনেরোয় ছেড়ে দেব। আমি নতুন কিনব একটা। 

ধুলো উড়িয়ে চলে গেল সে। মাতিন শেখ ওই ধুলোর মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির দিকে চলল। ছোট বাড়ি তাদের। বাঁশের বেড়ায় গোবরমাটির চাপড়া দেওয়া। উঠোনের পাশে একখানি ঘর ইটের। মাতিন শেখ বানিয়েছে উপার্জন করে। জমিজমা নেই তাদের। যা ছিল, চার বোনের বিয়ে দিতে বিক্রি করে দিয়েছে তার বাবা কিসমত আলি। মুসলমানের বিবাহে বরপণ ছিল না। কিন্তু চালু হয়ে গেছে অলিখিতভাবে। ভিটেটুকু ছাড়া এক অর্থে কিসমত আলি ভূমিহীন। গোরু চরিয়ে সামান্য উপার্জন করে। চরের জমির ভাগ দাবি করার উপায় নেই তাদের, কারণ তাদের জমি নদীগর্ভে যায়নি। তাদের পরিবার এখন তার উপার্জনের ওপরেই বেশি নির্ভরশীল। কিন্তু মাতিন শেখের উপার্জন অনিয়মিত। সীমান্তে পাখি মারার কাজে এখন বহু লোকের লাইন। বরাদ্দ অর্থের পরিমাণও কমে এসেছে। তা ছাড়া তারা মালের বাহক মাত্র। বিক্রয় করে না। নির্দিষ্ট জায়গায় মাল পৌঁছে দেওয়া তাদের কাজ। লাভ বেশি থাকে তাদের, যারা বিক্রি করে। সবচেয়ে বেশি লাভ সোনার বিস্কুট ও মাদক আনতে পারলে। ফিকির খুঁজছে তারা। অন্তত মাদকের লাইনটা যদি ধরা যেত। সোনার বিস্কুটের জন্য প্রধানত কাজ করে মেয়েরা। পেট কাপড়ে বেঁধে তারা মাল পাচার করে। দেখতে লাগে যেন ছ’মাসের পোয়াতি। বেটাছেলে মানুষ তারা, পোয়াতি সাজা তাদের কম্মো নয়। শুধু যদি মাদকের লাইনটা একবার ধরতে পারে! 

তবু, এই অনিয়মিত, অনিশ্চিত আয় হতেই মাতিন শেখ টিপে-টিপে টাকা জমাচ্ছে গোপনে। ওই ইটের ঘরে আছে এক তালাবন্ধ তোরঙ্গ। তারই মধ্যে রাখে সে টাকা। রাখে জমি কেনার অভিলাষে নয়, গাই-বলদ কেনার অভিলাষে নয়, তার স্বপ্ন ওই। সে কিনবে একখানা মোটর বাইক। মোটর বাইকে চেপে হু হু হাওয়া কাটিয়ে শাহেনশার মতো চলবে সে। ওঃ! চুল উড়বে তার। একখানা গগলস্ কিনবে। নীলরঙের জ্যাকেট একটা কিনে রেখেছে ইতিমধ্যেই। সেই জ্যাকেট গায়ে চাপিয়ে বাইক হাঁকাবে সে। ওঃ! কতদিনের স্বপ্ন তার। কতদিনের! 

নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে সে। কোমরে বেঁধে রাখা চাবি দিয়ে তোরঙ্গের তালা খুলে অনিমেষ চেয়ে থাকে লুকনো সম্পদের দিকে। কত টাকা আছে? শেষ গুনেছিল চার হাজার সাতশো নব্বই। তার পরেও তোরঙ্গে এসেছে আরও টাকা। সে টাকাগুলি বার করে। গোছগাছ করে সাজায়। গান্ধিবাপুর মুখগুলি একদিকে করে। আলাদা আলাদা করে একশো টাকা, পঞ্চাশ, দশ, পাঁচ এমনকী দু’ টাকার নোট। চারখানা পাঁচশো টাকার পাত্তিও সে সরিয়ে রাখে সযত্নে। গুনবে এবার। কত হল? কত হলে একখানা বাইক কেনা যায়? কত বলল মোহনবাবু? পনেরো। পনেরো হতে আর কত বাকি? 

হঠাৎ দমকা হাওয়া এসে ছড়িয়ে দিল, উড়িয়ে দিল টাকা-কড়ি। সে ঝাঁপিয়ে পড়ল টাকার ওপর। বুকে চেপে সরীসৃপের মতো ঘষে ঘষে সংগ্রহ করল ছড়িয়ে পড়া টাকা। কিছু দাঁতে কামড়াল। আবার এক দমকা হাওয়া। সে টাকাগুলি তোরঙ্গে রেখে দরজা খুলে বাইরে এল। ঈশান কোণ থেকে দ্রুত ধেয়ে আসছে কালো মেঘ। সঙ্গে ঝোড়ো বাতাসের ঝাপট। চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে দ্রুত। হাওয়ার জোর বাড়ছে। কালবৈশাখী আসছে। কালবৈশাখীর মাতন দেখতে দেখতে, হাওয়ার দাপট দেখতে দেখতে খুশি হয়ে উঠল তার মন। ধুলো উড়ল মেঘের মতো। আর কুটোকাটা এসে লাগল তার গায়ে। সে কাটা হাতখানি চুলকে নিল ভাল হাতখানি দিয়ে। তারপর চোখ আড়াল করল। হাওয়া তাকে ঠেলতে লাগল এবার। তার মা এসে দাঁড়াল পাশে। বলল—এই ঝড়ে গোরু-বাছুর নিয়ে কোথায় গেল মানুষটা! 

হাওয়া আর ধুলো তাদের জিভ জড় করে দিল। ঘরে এল তারা। মা গেল মাটির ঘরে। মাতিন শেখ এল ইটের ঘরে। কালবৈশাখীর ঠাসা অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে তোরঙ্গে তালা দিল। গোনা হল না কত আছে। দুপদাপ শব্দ হচ্ছে এখন। আম পড়ছে। কাটা হাতে মাথা রেখে নড়বড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল সে। কালো কুচকুচে মুখে ছোটছোট চোখ তার। চিবুকের কাছে ছুঁচল একগোছা দাড়ি। এটুকুই সে লালন করছে সযত্নে। গলার স্বরও তার ভারী নয়। সরু কিন্তু মেয়েলি নয়। বরং খ্যানখেনে। ঝড়ের তাণ্ডব দেখতে দেখতে সে প্রথমে বাইকের কথা ভাবে। তারপর বাইকের ওপরে নিজেকে চালকের আসনে বসায়। অতঃপর সংগোপনে বার করে আনে সেই স্বপ্ন। তার স্বপ্নাধিক স্বপ্ন। পেছনে বসে আছে একটি মেয়ে। সুন্দরী য়ে। তাকে জাপটে ধরে আছে। সে রীতিমতো সেই মেয়ের বুকের চাপ অনুভব করে পিঠে। তার ঠোঁট ফাঁক হয়ে যায়। স্বপ্নাবেশে অবুঝ লালা ঠোঁটের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসে। দলের মধ্যে একমাত্র তারই একটা বিবি মেলেনি এখনও। বন্ধুরা বলে—তোর জন্য অর্ডারি মাল আনতে হবে শালা। আল্লার কাছে মোনাজাত দিতে হবে তোর উপযুক্ত বিবি পাঠাবার জন্য। 

সে জানে, বিবির অভাব হবে না, যদি পকেটে রেস্ত থাকে। এই যদি তার দালান থাকত, বিঘে ছয়েক জমি থাকত, আর সেইসঙ্গে বাইক থাকত একটা তবে তার এই কাটা হাতেই মেয়ে দেবার জন্য দরজায় লোক লাইন দিয়ে দিত। সে স্বপ্ন দেখে, প্রথমে বাইক, তারপর বিবি। করবেই, করবেই, করবেই সে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *