৪৪
চৈত্র না মাসেতে
পচিয়া বয় বাও।
কান্দে তালু শুকায় কন্যার
মুখে না আসে রাও।
মুখে না আসে রাও হে কন্যা
চোক্ষে না ধরে নিন্দ।
হাতে হাতে চন্দ্র দিয়া
হারাইলাম গোবিন্দ ॥
মোহনলাল যখন বেরিয়ে যায় তখন সম্পূর্ণ দুটি আলাদা গৃহে ঘুম আসছিল না দুজনের। ঘরজামাই নিসার স্ত্রী রাবেয়ার গৃহে ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে ভাবছিল জিন-পরির কথা। সে কি সত্যি দেখেছিল জিন-পরি? হ্যাঁ। সন্দেহ নেই, দেখেছিল সে। যেমন রাবেয়াকে দেখে ঘুরতে-ফিরতে, দেখেছিল সেইরকমই। তফাত কেবল, জিন-পরির পোশাক ছিল না। আর তার পিঠে ছিল ফিনফিনে ডানা। ওইসব দেখে সে ভয় পেয়েছিল। অত রূপ, ওই চোখ-ঝলসানো রূপ, সে কি কোনও মানুষ সহ্য করতে পারে! সে তো কতই দেখে মৃত মানুষের ঘোরাফেরা। কিন্তু ভয় পায় না। ওইসব জীবাত্মা ক্ষতিকারক নয়। পৃথিবীর টানে চলে-ফিরে বেড়ায়। কিন্তু জিন-পরির দেহ ছায়ায় গড়া শূন্যময় ছিল না! নদীর পাড়ে আজও এসেছে কি জিন-পরি? আজও সে নগ্ন ও নৃত্যপর? আজও দেখা যায় তাকে?
না। জিন-পরি পুরুষের রক্ত শুষে খায়। পুরুষকে নির্বীর্য করে ফেলে।
সে শুয়ে পড়ে। কিন্তু রাত্রি তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। রাতচরা পাখির মতোই তার অদৃশ্য ডানা ঝাপট মারে পিঠে। সে আবার উঠে বসে। যতদিন সে ধরা পড়েনি কারও কাছে, ততদিন সে ছিল স্বাধীন। এখন তাকে নিয়মিত দিতে হবে রাত্রিচারণের কৈফিয়ত। সে হঠাৎ বিষণ্ণ বোধ করে। তারপর আবার উঠে দাঁড়ায়। আবার তার মনে পড়ে জিন-পরি। তাকে দেখার ইচ্ছেয় মন হু-হু করে। শুধু দেখবে আর একবার। কাছে যাবে না। ছোঁবে না। পালাবে না। ওঃ কী রূপ! কী রূপ! সে ভাগ্যবান এই রূপ সে দেখেছে! পৃথিবীতে এই দৃশ্যের একমাত্র অধীশ্বর হতে পারত সে-ই। কিন্তু কপাল খারাপ তার। দেখা হয়ে গেল ছোটবাবুর সঙ্গে। আঃ! জিন-পরি দৃশ্যের জন্য তার প্রাণ হু-হু করে, মন হু-হু করে আবার। রাত্রে গোপন পদসঞ্চারের জন্য চিত্তবৃত্তি হু-হু করে। চৌর্যবৃত্তির জন্য হু-হু করে তার দক্ষ পেশি ও স্নায়ুতন্তুগুলি। সে দরজা খুলে বেরুতেই রাবেয়া বলে—যাচ্ছ যাও। খালি হাতে এসো না।
সে একবার ফিরে তাকায়। চোরাই মাল রাখার জন্য জলের জালার নীচে একটা গর্ত করেছে রাবেয়া। আগের দিন সেই গর্ত খালি গেছে। এবার থেকে খালি যাবারই কথা ছিল। সে যদি আর না-বেরোয় রাত্রে? কোনওদিন না বেরোয়? সেই লোকটার কী হবে তা হলে? আঃ! ওই অভিসারের দফা-রফা সে করে দিতেই পারে চাইলে। সে একবার ভাবে, ফিরে যাবে, রাবেয়ার কাছে ঘোষণা করে দেবে, সে আর চৌর্যবৃত্তি ধরবে না। কাজ পেয়েছে। খেটে খাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বহির্মুখীই হল সে। রাত্রি তাকে ডাকে। জিন-পরি ডাকে। নিশি ডাকে।
জাগরণের কোনও তাগিদ ছিল না। তবু নিদ্রিত ছিল না সিদ্ধার্থ। মোহনলাল যখন বেরিয়ে যাচ্ছে, সে একবার ভেবেছিল, ডাকবে। কিন্তু তার পরেই সে মোহনলালের গোপনাচরণ উপলব্ধি করেছিল। বাইরে গিয়ে বায়ুসেবনই যদি একমাত্র উদ্দেশ্য হয় তা হলে মোহনলালের পক্ষে স্বাভাবিক ছিল তাকে ডেকে নেওয়া। সে জানালায় দাঁড়াল। দেখল বাড়ি থেকে বেরিয়ে দক্ষিণ দিকে চলে যাচ্ছে মোহনলাল। সে সিগারেটের প্যাকেট ও দেশলাই নিয়ে নেমে এল নীচে। উঠোনে এসে অবাক হল। সদরের কাছে চট বিছিয়ে খোলা আকাশের নীচে শুয়ে আছে দু’জন। ঘুমের মধ্যে মশা মারছে তারা। দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে গেলে এদের ঘুম ভাঙাতে হবে। সে বসল হাঁটু মুড়ে। একজনের গায়ে আলতো হাত দিয়ে ডাকল—এই! শুনছ! এই!
—জি!
ধড়মড় করে উঠে বসল ছেলেটা। সঙ্গে সঙ্গে আর একজন। সে বলল—তোমরা এখানে শুয়েছ কেন?
—জি?
তারা কী বলবে বুঝতে পারে না। ছোটবাবুর নির্দেশ তারা স্মরণ করে। কারওকে বলা চলবে না তিনি বাইরে গেছেন। সিদ্ধার্থ আবার বলে- তোমরা এখানে শুয়েছ কেন? মশা কামড়াচ্ছে না?
—জি। আমরা ঘরে শুই।
সিদ্ধার্থ এক মুহূর্ত ভাবে। তারপর বলে—ও! বাবু ফিরে এলে দরজা খুলে দিতে হবে বলে এখানে শুয়েছ?
সিদ্ধার্থ এ-সত্য জ্ঞাত আছে জেনে তারা হাঁপ ছাড়ে। কোনও কিছু স্বাভাবিকভাবে গোপন রয়ে গেল তো গেল। কিন্তু কেউ কিছু গোপন রাখতে বললে তা হয়ে দাঁড়ায় দারুণ গুরুভার! তারা একযোগে বলে—জি।
—আমিও যে বাইরে যাব।
তারা ওঠে। দরজা খুলে দেয়। সে বেরিয়ে আসে। হঠাৎ কী মনে হতে পিছনে তাকায় সে। উপরের জানালায় সাদা শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছেন একজন। সে আন্দাজ করে, নয়াঠাকুমা। সে হাত নাড়ে। সেই হাতনাড়া অন্ধকারে হারিয়ে যায়।
নিসার এবং সিদ্ধার্থ একই সময়ে বেরিয়েছিল যার যার বাসস্থান হতে। কিন্তু নিসারের স্থানটি আরও বেশি উত্তরে হওয়ায় তাদের মধ্যে দূরত্ব ছিল অদর্শনের। সিদ্ধার্থ পথ চলেছিল স্বাভাবিক ছন্দে। কারণ সে কোনও তস্কর প্রত্যাশা করেনি। কোনও জিন-পরিও নয়। মোহনলাল সম্পর্কে তার জন্মাচ্ছিল কিছু কৌতূহল। এবং এই কৌতূহলকে সে সম্পূর্ণ সমর্থন করতেও পারছিল না। মোহনলাল যদি তাকে দেখতে পায়, সে কী বলবে? কোনও স্পষ্ট উত্তর ছিল না তার কাছে। হতে পারে, এই অনুসরণের জন্যই তার সঙ্গে মোহনলালের চিরবিচ্ছেদ ঘটে গেল! তবু সে এগোয়। পাড়ার প্রান্তে এসে একটি কান্নার শব্দে সে থমকে দাঁড়ায়। এই কান্নার কারণ জানে না সে। কার বাড়ি, তাও জানে না। ছোট মাটির কুঁড়ে। তার সামনে ছোট দাওয়া। দাওয়ায় একটি ঘটি। চাঁদের আলোয় চকচক করছে। সে ঘটি হতে চোখ ফেরায় এবং তাকায় সামনে। অন্ধকার ঘিরে এখানে আলোর সূক্ষ্ম পরত। কারণ এরপর বসতি নেইকো আর। একপাশে নদীর পাড়। পাড়ে ইতস্তত গাছ। একপাশে ধু-ধু জমি। জমির উপর হঠাৎই, এক ডালপালাহীন গাছই সে ভেবে বসে মোহনলালকে। অতঃপর তার ভুল ভাঙে। কারণ আরও একটি ডালপালাহীন গাছ এসে প্রথম গাছের নিকটতর হয়। এবং দ্বিতীয় গাছকে অনুসরণ করে, প্রথম গাছ আরও দূর অন্ধকারের দিকে চলে গেলে সে ফেরে। সে নিশ্চিত, ওই বৃক্ষদ্বয় একজোড়া নারী ও পুরুষ। একজন মোহন, আরেকজন? সে জানতে চায় না। বহু বিস্তৃত কাজ পড়ে আছে তার জন্য। একজন নারী ও পুরুষের অভিসারের খবরে সে কী করবে! নিজের ওপর বিরক্ত বোধ করে সে। কেন সে এমন কৌতূহলী হল! ফেরার পথে কান্নাময় গৃহটির কাছে সে আবার থমকে দাঁড়ায়। গভীর শোক না হলে এই মধ্যরাত্রে কোন জাগরণ শুধু কাঁদায়? সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। শোকের কারণ না জানলেও শোকগ্রস্তের প্রতি সহানুভূতিতে মন ভরে যায় তার। তখনই বারান্দায় রাখা কাঁসার ঘটি হাতে করে নিঃশব্দে বেরিয়ে আসে নিসার। ঘটি-বাটি-থালা-বাসন-হাঁস-মুরগি এমনকী গোরু ও ধানের বস্তা পর্যন্ত চুরি করেছে নিসার এ-পর্যন্ত। তবে বড় জিনিস চুরি করলে সে সোজা মরালী চলে যায়। সেখানে তার চোরাই জিনিস কেনার বাঁধা লোক আছে। কিন্তু এত দিনের মধ্যে এই প্রথম বমাল ধরা পড়ল সে। কারণ সিদ্ধার্থ পেছন থেকে তার কাঁধ আঁকড়ে ধরেছে।
হাত ছাড়িয়ে দৌড়তে পারত সে। কিন্তু প্রথমে তার মনে হল ছোটবাবুই তাকে ধরেছে। সে ফিরে তাকাল আর অবাক হয়ে গেল। তস্করের রাত্রি-চেরা চোখে সে চিনে ফেলল মানুষটিকে। বলল—সাহেব আপনি?
সিদ্ধার্থ বলল-আমি তো সাহেব না। এটা আপনার বাড়ি?
—না না আমার না।
সিদ্ধার্থ এবার বলে—তা হলে ঘটিটা রেখে আসুন।
নিসার দৌড়ে ঘটি রেখে আসে। তখন জানালার ছোট পরিসরে একটি মুখ এসে দাঁড়ায়। সে মুখ আওয়াজ তোলে-কে? কে যায়?
নিসার সিদ্ধার্থর হাত ধরে টানে। বলে—চলেন স্যার। আমাকে দেখলে বদনাম করবে।
সিদ্ধার্থ নিঃশব্দে হাসে। এগিয়েও যায়। নিসার মাথা নিচু করে তার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটে। যুগপৎ প্রতিক্রিয়া হয় তার। সিদ্ধার্থকে এত কাছে পেয়ে যাওয়ায় তার বিস্ময় ও আনন্দ উৎসারিত হয়ে ওঠে। আবার, এমন মানুষের কাছে চৌর্যবৃত্তি ধরা পড়ে যাওয়ায় বিষণ্ণ হয়ে ওঠে সে। নিজেকে বোঝায়—কী আর করবে! গুনাহ্ কবুল করে নেবে। বড় মানুষের কাছে লজ্জা কী! তার একবারও মনে হয় না সিদ্ধার্থ তাকে পুলিশে ধরিয়েও দিতে পারে। সে এই মানুষের পাশে হাঁটতে হাঁটতে প্রশান্তি বোধ করে বরং। সিদ্ধার্থ বলে তখন—আপনি বদনামের ভয় করছেন, আপনার তো সুনাম হওয়ার কথা নয়!
—বিশ্বাস করেন স্যার। আমি চুরি ছেড়ে দিয়েছি।
—আমাকে স্যার বলবেন না। দাদা বলতে আপত্তি আছে?
—জি না। আপনি আমাকে তুমি বলুন দাদা। তুইও বলতে পারেন। আমি তো আপনাকে চিনি।
—আমাকে চেন?
—জি। আপনাকে কে না চেনে?
—হুঁ! তোমার নাম কী ভাই?
—নিসার। মোহনবাবু আমাকে চেনে।
কথা বলতে বলতে তারা সেই দোকানের নিকটবর্তী হয় যেখানে একটি বেঞ্চ পাতা আছে। সিদ্ধার্থ স্থির করে এখানেই সে অপেক্ষা করবে মোহনলালের জন্য। বলবে —তোকে বেরুতে দেখে আমিও বেরিয়ে এলাম। কিন্তু তোকে দেখতে না পেয়ে এখানে বসে আছি।
সে নিসারকে বলল—চলো ভাই নিসার, বসি ওখানে। বসবে?
—জি।
সে নিজে একটা সিগারেট ধরায়। নিসারকেও দেয় একটা। তারপর বলে—তা হলে নিসার। তুমি পেশায় চোর? কী কী চুরি করো বলো।
নিসার তৎপর হয়ে ওঠে। বলে—দাদা বিশ্বাস করেন। আমি চুরি ছেড়ে দিয়েছি।
—কবে? আজই ছাড়লে?
—জি না। তিনদিন আগে ছেড়েছি। কী করব দাদা! কাজ ছিল না। পেটের দায়ে চুরি করতাম। তা ছোটবাবু, মানে মোহনবাবু কাজ দিলেন। বললেন, চুরি করিস না আর, আমিও কবুল করলাম।
—আজ তা হলে কী হচ্ছিল?
—অভ্যাস। অভ্যাস হয়ে গেছে দাদা। দেখতে এসেছিলাম এক। হল অন্য। যেই জিনিস দেখলাম অমনি চোরের মনটা ডেকে উঠল। না হলে ওই বাড়ি থেকে কি চুরি করা যায়!
—তিনদিন আগে ছাড়লে এরকম হতে পারে। অভ্যাস পাল্টাতে সময় লাগে। তা তুমি কী দেখতে বেরিয়েছিলে?
—আপনি তো ওদিকে গেছিলেন? দেখতে পেয়েছেন?
–কী বল তো?
নিসার সিগারেটে জোরে টান দিয়ে বলে—জিন-পরি, দাদা। জিন-পরি।
সিদ্ধার্থ বলে—তুমি শুধু চুরিই করো না, গাঁজাও খাও। নাকি আর কোনও নেশা?
—না না না। বিশ্বাস করেন। খাবার জোটে না। নেশা করব কী দিয়ে! আমি দেখেছি। জিন-পরি দেখে পালাতে গিয়েই তো ছোটবাবুর কাছে ধরা পড়েছিলাম।
—আচ্ছা?
—শুধু জিন-পরি না। আমি মরা মানুষদেরও দেখতে পাই। কিন্তু তাদের দেখে ভয় পাই না। কিন্তু জিন-পরি? তার কী রূপ! কী রূপ! অত রূপ দেখলে ভয়ে প্রাণ উড়ে যায়। সে-সব আর আপনাকে কী বলব দাদা?
সিদ্ধার্থ সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ছুড়ে দিল অবশিষ্টটুকু। ভাবল, মোহনলাল তা হলে জিনপরির সঙ্গে ঝোপে-ঝাড়ে চলে যাচ্ছে আজকাল! সে প্রসঙ্গ ঘোরাতে চাইল। বলল—ওই বাড়ির কথা কী বলছিলে? ওখানে চুরি করা যায় না কেন?
—ওঃ! কী বলব দুঃখের কথা! খোদা এমন কষ্ট যেন আর কারওকে না দেন কখনও।
সে মাসুদা ও ইদরিশের একটিমাত্র মেয়ে ফরিদার করুণ মৃত্যু আদ্যোপান্ত বর্ণনা করে। শুনতে শুনতে সিদ্ধার্থর কান্না পেয়ে যায়। সমস্ত করুণ মৃত্যু, সমস্ত অস্বাভাবিক মৃত্যুরা তাকে ঘিরে পাক খায় যেন। সে এবং নিসার স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ। অনাকাঙ্ক্ষিত নিষ্ঠুর মৃত্যুর কারুণ্য মর্মে উপলব্ধি করে। অবশেষে নিসার বলে—মেয়েটা এখনও জগতের মায়া কাটাতে পারেনি। এই গাঁয়ের মাটিতে খেলে বেড়ায়। আমি দেখেছি তাকে দাদা।
সিদ্ধার্থ কথা বলে না। নিসারের দর্শনগুলি ফালতু বলে উড়িয়েও দেয় না। হয়তো নিসার নামের ছেলেটি গভীর কল্পনাপ্রবণ। কিংবা কে জানে, বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি যে-গ্রামে, সেখানে নিশুতি রাতের জন্য যদি জমা থাকে কোনও রহস্যময়তা, তাতে ক্ষতি কী! নিসার বলে চলে- যতদিন বেরিয়েছি, শুনেছি ভাবির কান্না। কী আর বলব!
সিদ্ধার্থ আরও একটা সিগারেট দেয় নিসারকে। নিজেও ধরায় একখানা। বলে—চুরি ছেড়ে দিয়েছ, তবু আজ বেরুলে কেন নিসার?
—নিশি ডাকে দাদা। অভ্যাস। দিব্যি সুস্থ ভাল মানুষ ঘুমোতে গেলাম। হঠাৎ ওমনি কে জাগিয়ে তুলল! রাতের এ পৃথিবী, এর এক ঘোর আছে দাদা। দিনের বেলা নদীর ওই সাদা পানি, তাকে ঘিরেই কত রহস্য রাতে। ওই আকাশ, ও শীতে একরকম, বর্ষায় একরকম। ওই জমি, ও শীতে একরকম, বর্ষায় একরকম। দিনে-রাতে সকলেরই রূপ পাল্টে পাল্টে যায়। এমনকী মানুষেরও। দিনে যে ভালর ভাল, রাতে বিবির ওপর তার অত্যাচারের সীমা নেই। রাতে-বেরাতে ঘুরে সব জানা হয়ে যায়। এর একটা টান আছে। একা একা চলে-ফিরে বেড়াই। শুধু ছায়া দেখি। কত কী ঘটে যায়। চুপি-চুপি দেখি। কারওকে বলি না। এ-গাঁয়ের কত ঘরের কত গোপন খবর যে আমি জেনে গেছি। কারওকে বলি না। সেদিন ছোটবাবুকে বললাম শুধু। ছোটবাবু বললেন, এই-ই তোর কাজ। চুরি করবি না তুই। শুধু ঘুরে বেড়াবি নিশুতি রাতে। আর গ্রামের সব খবর দিবি আমাকে।
সোজা হয়ে বসল সিদ্ধার্থ। চর তৈরি করছে মোহনলাল। কিন্তু এ তো অন্যায়। সে কি মানুষের গোপন খবর জেনে সেগুলি রাজনীতিতে ব্যবহার করতে চায়? কীভাবে? সে বলল—এই যে তুমি বললে, গোপন কথা কারওকে বলো না, সেটাই ঠিক কাজ নিসার। তুমি মোহনকে বললে কেন?
—জি, ছোটবাবু বলবেন না কারওকে। লেখাপড়া জানা মানুষ। তা ছাড়া আমি শুধু বললাম, জব্বার মিঞা গোপনে বাউলচর্চা করে। এর বাইরে কিছু বলিনি।
—এই দেখো। আমাকেও বলে ফেলছ তুমি।
—কেন জানি না, আপনাকে সব বলতে ইচ্ছে করে।
—বুঝে শুনে বোলো নিসার। পারলে কাজটা আর কোরো না।
—জি, না করে উপায় কী! এ-কাজের জন্য উনি আমাকে আলাদা টাকা দেবেন। তা ছাড়া, ওঁদের মাঠে খাটি, ওঁর কথা না শুনে করব কী! এই তো উনি বললেন, কী দল করিস? ভোট দিস কাকে? আমি বললাম, করম মণ্ডল যাকে দিতে বলে। সে মুসলিম লিগের নেতা। তা ছোটবাবু বললেন, এবার আমি যাকে দিতে বলব, দিবি।
সিদ্ধার্থ শুনছিল। তার কাছে একটু একটু করে স্পষ্ট হয়ে উঠছে মোহনলাল। মোহন নেতা হতে চাইছে। সে বোঝার চেষ্টা করল। এজন্যই কি শহর ছেড়ে চলে এল মোহন? মোহন কি তাকে প্রতিযোগী ভাবতে শুরু করেছে নাকি? হাসি পেল তার। হায়! তার তো কারও সঙ্গে কোনও প্রতিযোগিতা নেই। দলের কাজকে সে কাজ হিসেবেই নিয়েছে। কিছু একটা তো করতে হবে মানুষকে। সে রাজনীতি করে। এবং রাজনীতিকে কল্যাণে ব্যবহার করতে চায়। সিংহাসনের লোভ এখনও তার মধ্যে জাগেনি। হাসি পাবার সঙ্গে সঙ্গে মন খারাপও হয়ে গেল তার। তারা দু’জনে যেন ত্রিকোণ প্রেমের প্রেমিক! হায়! কী করে বোঝাবে সে, তার কোনও আকাঙ্ক্ষা নেই। সে বিধায়ক বা সাংসদ হতে চায় না। সে যদি বলে, শোন মোহন, তুই শুধু শুধু এরকম করছিস… ধুর! এ-সব অবান্তর ভাবনা। স্রোতের মুখ ফেরানো যায় না। সে আর মোহনলাল স্রোতে ভেসে যাওয়া দুটো কুটো ছাড়া কী! সময় তাদের একত্র করেছিল। সময় তাদের ছাড়িয়ে নেবে। সে জোর করবার কে! যা হবার তা হবে! সে কথা বলছে না দেখে নিসার বলল—দাদা, রাগ করলেন?
—না নিসার। রাগ করব কেন? তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি। তবে ওই যে বললাম, বুঝে-শুনে খবর দিয়ো, কারও সর্বনাশ হয়, এমন কাজ কোরো না।
—জি দাদা।
আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে তারা। এবার নিসার বলে—যদি পারি তো ছেড়ে দেব এ কাজ। কিন্তু বেরুতে আমাকে হবেই দাদা।
—রাত্রির টানে? নিসার।
—দাদা, আপনাকে বলতে মন চায়। কারওকে তো বলতে হবে। দুঃখে প্রাণটা ফেটে যেতে চায়, তবু বলতে তো পারি না।
—বলো।
—রাত্রি আমাকে টানে। রাত্রি আমাকে ঠেলেও দেয়।
—কীভাবে?
—বিবি যদি টেনে রাখত আমাকে, রাত্রির টান কি আমি ঠেলে দিতে পারতাম না? কী বলব! দাদা! তার অন্য একজন মানুষ আছে। আমি তাকে… আমি তাকে….
তখন অন্ধকার খুঁড়ে বেরিয়ে আসছিল মোহনলাল। নিসার চুপ করে গেল। সিদ্ধার্থ ডাকল— মোহন!
চমকে উঠল মোহনলাল। তারপর কাছে এগিয়ে এল—তুই! ও নিসার!
—জি।
—আজ তোর বেরবার কথা ছিল নাকি?
—জি না। হঠাৎ মনে হল। বেরিয়ে পড়লাম। পথেই সিদ্ধার্থবাবুর সঙ্গে দেখা হল।
সিদ্ধার্থ লক্ষ করল, নিসার মোহনের সামনে তাকে দাদা সম্বোধন করল না। তার মনে হল, এক নব্য জমিদারকে প্রত্যক্ষ করছে সে এখন। এই জমিদারের পোশাক আলাদা আর ডানাগুলো ছেঁটে দেওয়া কিছু পরিমাণ। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। তখন মোহনলাল হুকুমের স্বরে বলল—নিসার, এরপর কোন রাত্রে বেরবি, আগে থেকে বলে রাখবি আমাকে। না হলে, ধরা পড়লে তোকে বাঁচাতে আসব না আমি।
নিসার এক মুহূর্ত মোহনলালের দিকে তাকায় পলকহীন। সিদ্ধার্থর মনে হল, দুটি চোখে ওই এক মুহূর্তের জন্য জ্বলে উঠল বারুদ। তারপরই নত হল চোখ। সে বলল—জি।
আর ওই জ্বলে ওঠা দেখে ভাল হয়ে গেল সিদ্ধার্থর মন। সে জানে, ওই জ্বলে ওঠাই মানুষের অনিঃশেষ শক্তির পরিচয়।
মোহনলাল স্বাভাবিক হল এবার। বলল—তুই কতক্ষণ বসে আছিস সিধু?
সিদ্ধার্থ বলল, যা সে বলবে বলে ভেবে রেখেছিল। মোহনলাল তার গ্রাম ভ্রমণের ফিরিস্তি দিল কিছুক্ষণ। এবং ফিরে চলল তারা। বিছানায় শুয়ে মোহনলাল হঠাৎ বলল—চারচন্দ্র মানে জানিস?
সিদ্ধার্থ প্রথমে বুঝতে পারল না। বলল—চারচন্দ্র তো জানি না। একে চন্দ্র, দুইয়ে পক্ষ ছোটবেলায় পড়েছি।
—আরে না, না। সেরকম কিছু না। চারচন্দ্রের সাধনা কাকে বলে জানিস?
—চারচন্দ্রের সাধনা? দাঁড়া। বোধহয় জানি। তোর প্রশ্নটা কি বাউল সংক্রান্ত?
—অত জানি না। শুধু জানি, চারচন্দ্রের সাধনা।
নয়াঠাকুমা এলেন তখন। দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন—এই তোরা ফিরলি? রোজ রাত্রে কোথায় বেরস তুই মোহন?
মোহনের বুকের মধ্যে দুপদাপ শব্দ হল। সে যে বেরোয়, তা ঠাকুমা জানে! সিদ্ধার্থই বা কী দেখেছে? কতটা দেখেছে? একমাত্র ভরসা, নিসার ছিল। নিসারকে সে জিগ্যেস করবে ভাবল, সিদ্ধার্থর সঙ্গে কোথায় দেখা হয়েছিল তার। কিন্তু, আগেকার মতো সরলভাবে সে কিছুতেই বলতে পারল না-শালা, লুকিয়ে উঁকি মারছিলি?
অথচ এ পর্যন্ত যত প্রেমপত্র লিখেছে সে, সিদ্ধার্থকে না পড়িয়ে ছাড়েনি। সিদ্ধার্থর কোনও আগ্রহ ছিল না মেয়েদের ব্যাপারে। প্রেমপত্রের ব্যাপারেও ছিল না। তবু, মোহনলালের অনেক কথাকেই সে গুছিয়ে দিয়েছে অনায়াসে। অথচ আজ তাকে বলা গেল না কিছুই। মোহনলাল নয়াঠাকুমাকে বলল—এখন ঘুমোতে দাও তো। বিরক্ত কোরো না।
—মর জ্বালা! তোরা এতক্ষণ বাইরে বলে যে আমার ঘুম হচ্ছিল না।
মোহনলাল উত্তর দিল না। সিদ্ধার্থ বলল—আপনি শুয়ে পড়ুন ঠাকুমা। আমরা সামনেই ছিলাম।
সে দেখল নয়াঠাকুমা চলে যাচ্ছেন। আর মোহনলাল কপালে হাত রেখে শুয়ে আছে। ঠাকুমা চলে যেতেই সে বলল—মনে পড়ল?
–কী?
—চারচন্দ্রের সাধনা?
—যতদূর মনে হচ্ছে এটা বাউলের বিষয়। ওদের নানারকম গোপন রহস্য আছে। চারচন্দ্র মানে, মনে হচ্ছে, হ্যাঁ বলছি, রজঃ, বীর্য, মল ও মূত্র।
—এই দিয়ে কী সাধনা হয় বল তো?
—তা জানি না। এটাই যে কোথায় জেনেছিলাম বলতে পারব না। তোদের এখানে তো বাউলের আখড়া আছে। গিয়ে জেনে নিস।
উত্তেজনায় উঠে বসল মোহন। কীরকম ঘোরের মধ্যে বলল-বাউলের আখড়া না? ঠিক বলেছিস। ইস আমার আগে মনে হয়নি!
—মনে হওয়া উচিত ছিল।
মোহনলাল চমকে ওঠে। ত্রস্ত হয়ে বলে— কী!
—আরে, গান আছে না, চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে, এর মানে বলতে পারবি! বাউলের গানের মানে খুব সোজা, আবার খুব কঠিন। চাঁদ-টাদ নিয়ে ওরাই কারবার করে।
—আখড়ায় দুলুবাউল বলে একজন আছে। দারুণ গান করে। কাল যাবি শুনতে?
—যাব।
মোহনলাল শুয়ে পড়ে। ভাবতে থাকে সে কি তবে আখড়ার নারী? কে? কী নাম? আজও সে চলে গেছে কিছু না বলে। চলে গেছে অন্ধকারে। সে জোর করছিল। বলেছিল—কে তুমি? নাম বলো।
সে বলেছিল—ওগো চাঁদ! তুমি একটা নাম দাও আমার।
—তুমি জিন-পরি নও। তুমি এ-গাঁয়েরই কেউ।
—কে বলল আমি জিন-পরি?
—লোকে বলে।
—ও মা গো!
—ও মা গো কী! ন্যাংটো হয়ে নেচে বেড়াও। তুমি কি পাগল?
—তোমার জন্য পাগল হয়েছিলাম। এই দেখো না, আজ কি তেমন এসেছি?
–না। আসোনি। কিন্তু আগে আসতে কেন?
—সাধনা করতাম গো। স্বপ্ন দেখলাম, নিরাবরণ হয়ে চাঁদকে নাচ দেখালে মনের মানুষ পাওয়া যায়। এই তো, তোমাকে পেলাম। চাঁদের মতোই রূপ তোমার।
—কে তুমি? কোন বাড়ির? বলো। না হলে যেতে দেব না।
—আজ দেরি হলে আর কোনওদিন আসতে পারব না আমি। সে কি ভাল হবে?
—বলো। বলতেই হবে।
—আমাকে ধরে রাখবে চাঁদ? চলো তা হলে। তোমার ঘরে যাই। সারাদিন সারারাত তোমার সুধা পান করব গো। চকোরী যেমন চাঁদের কিরণ পান করে, তেমনি করব।
সেই নারী ধরা দিতে চাইলে সে ছেড়ে দিয়েছিল। কারণ দেরি করতে তারও ভয় করছিল। এই নারীর সঙ্গে সে কারও চোখে পড়তে চায় না। এখন তার মনে হচ্ছে, আখড়াতেই সে খুঁজে পেয়ে যাবে তাকে। কিন্তু পেয়ে কী করবে? সে জানে না। তার শুধু মনে হচ্ছে, ওই নারী কোথায়, তার জানা দরকার। কারণ, এই দু’দিনেই তার এমন হচ্ছে, ওই নারী ছাড়া সে বাঁচবে না।
সকালবেলা আখড়ায় গেল তারা। দুলু বাউল বসেছিল আঙিনায়। তাকে ঘিরে ছিল পারুলবালা, বুড়িয়া, জসিম বাউল। সাদামাটা বুড়িয়াকে বেমানান লাগছিল না এই দলে। তার শ্যাম্পু না করা রুক্ষ চুল। সাধারণ শাড়ি এবং সাধারণ চোখ-মুখ। সে সিদ্ধার্থ ও মোহনলালকে দেখছিল। মোহনলাল সুন্দর পুরুষ। তবু তার চোখ বারবার চলে যাচ্ছিল সিদ্ধার্থর দিকে। কী যেন আছে মানুষটির মধ্যে। কী!
দুলু বাউল সাদরে অভ্যর্থনা করল তাদের। তারা গান শোনার ইচ্ছে প্রকাশ করলে দুলু বাউল বলল—আপনাদের গান শোনাব, এ তো আমার পরম সৌভাগ্য। আর সিদ্ধার্থবাবু তো আমাদের নেতা। জনগণের নেতা। তাঁকে তো শোনাতেই হবে গান।
দুলু বাউলের কথায় দাঁতে দাঁত পিষল মোহনলাল। কিন্তু তখন ঈর্ষা করার বিশেষ সুযোগ ছিল না তার। সে দেখছিল বুড়িয়াকে, পারুলবালাকে। কারওকেই তার চেনা লাগছিল না। আর কোনও নারী আছে কি না প্রশ্ন করতেও তার সংকোচ হচ্ছিল। আখড়ায় সে আসেনি বিশেষ। দুলু বাউল ভাল গান করে বলে তাকেই সে চেনে বরাবর।
তার প্রশ্নের সরব উত্তরের মতোই দুলু বাউল বলল—জাহিরা কোথায়? জাহিরাকে ডাকো। পারুলবালা জাহিরার ঘরে গেল। ফিরে এসে বলল—গণিমিঞার পেটে বেদনা হচ্ছে। তেল মালিশ করছে সে। বলল, এখন আসবে না।
মোহনলাল উৎসুক চোখে তাকাল ঘরের দিকে। জাহিরা। জাহিরাকে আজ দেখা হল না। তাতে কী! সে আবার আসবে। সে-ই যদি জাহিরা হয়, লুকিয়ে থাকবে কতদিন! সে হঠাৎ বলল—আচ্ছা! চারচন্দ্রের মানে কী!
কেউ কোনও উত্তর দিল না। দুলুক্ষ্যাপা বলল—সে কি ওমনি জানা যায়? তার জন্য সময় লাগে। সাধন লাগে।
—আমি জানতে চাই সে সাধন।
—সে ওমনি হয় না। তার জন্য দীক্ষা লাগে। সময় লাগে। এখন গান শোনেন বাবু।
সে তার দোতারায় শব্দ করে। এবং শব্দ করতে করতেই হঠাৎ বলে বাবু! একটা নিবেদন ছিল।
মোহনলাল বলে—কী!
—শুনেছিলাম ময়না বৈষ্ণবীর ঝুলিখানা আপনাদের বাড়িতে ছিল। সেখানা যদি আমাকে দেন।
নিজের স্বরে নিজেই চমকে উঠল সে। এক মুহূর্ত আগেও সে জানত না, এই প্রার্থনা করবে। বোষ্টুমিই কি বলিয়ে নিল তাকে দিয়ে? সে চোখ বন্ধ করল। তার মনে হল যেন ময়না বৈষ্ণবী বসে আছে উলটোদিকে। অনেকদিন পরে আবার ময়না বৈষ্ণবীকে নয়নে পেয়ে মন ভরে গেল তার। নয়ন ছেড়ে চলে যাওয়া এই নারী এসে যাচ্ছে সকল মাঝে তার। সেই ভাল, সেই ভাল। সে তো চেয়েছিল এমনই। তখন মোহনলাল বলল—আমি ঠাকুমাকে বলব। আপনি একবার যাবেন আজকে।
—যে আজ্ঞে!
গান ধরল সে এবার। ময়না বৈষ্ণবীর খঞ্জনি জোড়া পেলে সে সারাজীবন বুকে করে আগলাবে। সে গাইতে লাগল—
এনে কোন ফুলের সৌরভ জগৎকে মাতালি রে
জমিন ছাড়া গাছের মূল ডাল ছাড়া পাতা
ফল ছাড়া বিচি তাহার অসম্ভব কথা রে।
গাছের নামটি চম্পকলতা পত্রের নাম তার হেম
কোন ডালেতে রসের কলি কোন ডালেতে প্রেম।
লালন শা ফকির বলে ভক্তি প্রেমের নিগূঢ় কথা
যার হৃদয়ে বস্তু নাই সে খুঁজলে পাবে কোথা!