রাজপাট – ৪২

৪২

চৈতিক মাসে ফতেমা গো 
মক্কা হইল ছাড়া। 
সারা দুইন্যাই খুঁইজ্যা মাগো
অইয়া গেল সারা।।
শা মর্তুজা আলি যুদি 
অইত আমরার বাপ্। 
তে কেন ওজিদার পালে 
দিও এও তাপ ॥ 
বরকত জননী যুদি 
অইত আমার মা। 
তে কেন মরণকালে 
পানি পাইলান না।।
হায় হায় রে—

.

পুজো-পার্বণ, ব্ৰত-শুদ্ধি পরিমণ্ডিত চাটুজ্যেবাড়ির সব কাজে কমিউনিস্ট নাস্তিকতার প্রয়োগ ঘটাতে চাইছিল মোহনলাল। কর্তৃত্বকামনার প্রথম পাঠ সে সেরে ফেলতে চাইছিল আপন গৃহেই। 

নয়াঠাকুমাকে প্রতিমাসে সুবচনী ব্রত করতে দেখে সে ক্ষেপে উঠল। প্রতি বৃহস্পতিবারে হয় লক্ষ্মীর পাঁচালি পাঠ। সে-দায়িত্ব নন্দিনীর। বৃহস্পতিবারের সন্ধ্যায়, শীত নেই গ্রীষ্ম নেই, একখানি রেশমি কাপড় গায়ে দিয়ে পূজার ঘরে বসেন নন্দিনী। লণ্ঠনের আলোয় দুলে দুলে পড়েন লক্ষ্মীব্রতকথা। 

স্বার্থের লাগিয়া স্নেহ স্বামীর উপরে। 
অসমর্থ হলে তারে অনাদর করে। 

ওই ব্রতে সারি সারি লেখা হয়ে আছে কুপ্রবৃত্তি, অলক্ষ্মী নারীর আচরণের কথা। তারা দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে। স্বামী-শ্বশুরকে আদর-যত্ন করে না। স্বামীকে খেতে দেবার আগে আপনি খেতে বসে। স্বামী যথেষ্ট রোজগেরে না হলে গঞ্জনা দেয়। এমন সব হলে লক্ষ্মীদেবী গৃহে বসত করেন না। নারীকুলের আচরণই তাঁর আসনের সহায়। নন্দিনীর কেমন লাগে এইসব পূজারত করতে, তা জানে না কেউ। নয়াঠাকুমা সরবে ঘোষণা করেন, তাঁর ভাল লাগত না কিন্তু এ-বাড়িতে এসে অভ্যাস হয়ে গেছে। এইসব ব্রতপালনের মধ্যে শুধু কল্যাণকামনাই ধরা থাকে না। থাকে একটি পারিবারিক সংস্কৃতিও। নয়া ঠাকুমা তাকে পালটাতে চান না। এমনকী মোহনলাল তার বিরক্তি প্রকাশ করলে নয়াঠাকুমা বললেন—এতকাল করে এলাম। তুমি বললেই তো ছাড়তে পারি না বাপু। 

—কী হয় ঈশ্বর-ঈশ্বর করে? ওই তো ময়নাপিসি। রাতদিন নামগান করত। ওর ওই পরিণতি হয় কেন? 

—তার কথা বোলো না বাছা। সে পুণ্যবান মানুষ। পাপ তার নয়। পাপ অন্যদের।

—পাপ-পুণ্যর কথা তো বলিনি। বলছি ভগবান পিসির ওই দশা করল কেন? 

—ভগবান ইশারা করেন মোহন। পুণ্যবান মানুষের ওপর নির্যাতন করে দেখিয়ে দিতে চান, মানুষের পাপের ভারা পূর্ণ হল। এরপর কোনও বিপর্যয় আসে কি না দেখ। হয়তো খরা হবে। অজন্মা হবে। মড়ক লাগবে। বন্যায় ভেসে যাবে দেশ-গ্রাম। 

—তুমি এরকম কুসংস্কারগ্রস্ত হয়ে উঠবে আমি ভাবিনি ঠাকুমা। 

—কোনটা কুসংস্কার দেখলি? 

—এই যে পাপের ফল, পুণ্যের ফল। খরা হবে, বন্যা হবে, মড়ক লাগবে। এ তো প্রাকৃতিক ব্যাপার। 

–সবসময়ই কি আর প্রাকৃতিক বাবা? খরা বন্যা কি মানুষও ঘটিয়ে তোলে না? প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে শাপ কুড়োয় না? প্রকৃতি আপন নিয়মের ব্যত্যয় সয় না মোহন। তা ছাড়া মানুষ যার ব্যাখ্যা পায় না, তাকেই কৃতকর্মের ফল দ্বারা বিশ্লেষণ করে। এই জন্মের না হলে আর জন্মের। না হলে মানুষের সাধ্য কী, সব মেনে নেয়! পাপ-পুণ্য, কৃতকর্মের ফলভোগ— এই সব ধারণাই মানুষকে দেয় সহনশীলতা। নইলে মানুষের মন বড় ভঙ্গুর। 

—কিন্তু তাই বলে এ-সব অর্থহীন ব্রত? 

—অত কথায় কাজ কী? এতদিন করে আসছি যখন। করি। 

.

নয়াঠাকুমা ছিলেন কায়স্থকন্যা। উনিশশো ছাব্বিশের ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থিনী। মোহনলালের ঠাকুরদাদা হিতেশ্বর চট্টোপাধ্যায় কলকাতা শহরে পড়াশোনা করতে গিয়ে এই নারীকে ভালবেসে ফেলেন। কী করে তাঁদের দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছিল সে এক রহস্য। আসলে নয়াঠাকুমার বাবা ছিলেন শিক্ষিত পুরুষ। ব্রাহ্মধর্মে প্রভাবিত অধ্যাপক। মেয়েদের পুরোপুরি আড়ালে রাখার পক্ষপাত তাঁর ছিল না। কিন্তু হিতেশ্বর বিবাহের প্রস্তাব করলে তিনি আপত্তি করে উঠলেন। বললেন—তার চেয়ে আমার মরণ ভাল। 

নয়াঠাকুমা হিতেশ্বরের সঙ্গে পলায়ন করেছিলেন। তখন তাঁর নাম ছিল নয়মি। নবমীতে জন্ম হয়েছিল তাই নবমী থেকে নাম হয়েছিল নয়মি। কৈশোরের অনিরুদ্ধ আবেগ তাঁকে তাড়না করে এনে ফেলেছিল এই তেকোনা গ্রামে। 

হিতেশ্বর ছিলেন একমাত্র কুলপ্রদীপ। তিনি অসবর্ণ বিবাহ করে এনেছেন! গৃহে লোকের পাহাড় জমে উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত চাটুজ্যে পরিবারে নয়াঠাকুমার ঠাঁই হল অস্পৃশ্য অবস্থায়। শ্বশুর তাঁর হাতের জল খান না। শাশুড়ি তাঁর ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলেন। ঠাকুরঘরে প্রবেশের অনুমতি নেই। এভাবে নগণ্য হয়ে কাটালেন তিনি দু’বৎসর। তৃতীয় বৎসরে গর্ভবতী হলেন। চতুর্থ বৎসরে প্রথম সন্তান। উনিশশো তিরিশ সাল। দেশের অবস্থা ভয়াবহ। চাটুজ্যেরা ভালভাবেই বেঁচে ছিলেন কেবল আর্থিক বনেদিয়ানার জোরেই। 

প্রথম সন্তান এল নয়াঠাকুমার। পুত্র। নাম হল তার শিবেশ্বর। পৌত্র পেয়ে শ্বশুর-শাশুড়ি তাকে বুকে তুলে নিলেন। অস্পৃশ্য নারীর সন্তান কিন্তু অস্পৃশ্য হল না। কারণ পৌত্র পুত্রের ঔরসজাত। স্ববর্ণ। 

সেইসব দিন নয়াঠাকুমা কাটিয়েছেন কত অপমানে—সে খবর আর কেউ জানে না এখন। তবে, কোনও অনুশোচনা ছিল না তাঁর। কারণ হিতেশ্বর তাঁকে ভালবেসেছিলেন। দুঃখ ছিল একটাই। এই অজগ্রামে বই পড়তে পেতেন না। হিতেশ্বর বহরমপুর থেকে বই আনতেন তাঁর জন্য। কলকাতা থেকেও আনতেন। 

পৌত্র জন্মানোর পর হিতেশ্বরের পিতা তারকেশ্বর ছেলেকে ডেকে বললেন—পুত্র উৎপাদন করলে নারী পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হয়। নয়মি এখন এই পরিবারের একজন। তা পৌত্রের অন্নপ্রাশনে আমি বৈবাহিক মহাশয়কে নিমন্ত্রণ জানাতে চাই। তুমি তাঁর বাসায় আমাকে নিয়ে চলো। 

নিয়ে গিয়েছিলেন হিতেশ্বর। কিন্তু অধ্যাপক মহাশয় তাঁদের অপমান করেছিলেন। বলেছিলেন—আপনারা ব্রাহ্মণ হতে পারেন। কিন্তু আপনারা চণ্ডালেরও অধম। যারা নারী অপহরণ করে তারা মানুষ নয়। 

হিতেশ্বর কেঁপে উঠেছিলেন। তাঁর ভয় ছিল, এই বুঝি তারকেশ্বর উন্মত্ত হয়ে ওঠেন। কিংবা হয়তো তাঁর ক্রোধ প্রকাশ পাবে গৃহে পৌঁছে। হিতেশ্বরকে তিনি ত্যজ্য ঘোষণা করবেন। বাড়ি থেকে বার করে দেবেন নয়মিকে। কত কত সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু হিতেশ্বরের আশঙ্কা মতো ঘটল না কিছু। তারকেশ্বর, অধ্যাপকের কটূক্তির উত্তরে বললেন—অপহরণ কেন হবে? আপনার কন্যা সম্মতা ছিলেন। তা ছাড়া হরণ করে বিবাহ তো শাস্ত্রসম্মত। অর্জুন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণভগিনীকে হরণ করে বিবাহ করেছিলেন। 

—আমি এই বিবাহ মানি না। হিতেশ্বর আমার বিশ্বাসে আঘাত করেছে। 

–প্রেম তো কোনও নীতি মানে না বৈবাহিক মশাই। 

—খবরদার আমাকে বৈবাহিক বলবেন না। আমি চাই না আপনারা আর এক মুহূর্তও এখানে থাকুন। 

তারকেশ্বরের মুখ-চোখ লাল হয়ে গিয়েছিল। তবু তিনি বলেছিলেন— শুনুন অধ্যাপকমশাই। অনেক কটুকথা আপনি আমাকে বললেন। এই নব্যযুগে আপনার মতো আধুনিক অধ্যাপকের কাছে এগুলি আমি আশা করিনি। এ তো আমার বলার কথা। আমি স্বল্পশিক্ষিত। ব্যবসায়ী। অজগ্রামে থাকি। তা ছাড়া ক্ষোভও আমার হওয়ার কথা। কারণ আমি ব্রাহ্মণ। আপনারা আমার তুলনায় নিম্নবর্ণীয়। যাক। একথা ভাবতে আমার ভাল লাগছে যে নব্যযুগের প্রেরণা আমাকে স্পর্শ করেছে। আমি একজন সুশিক্ষিত অধ্যাপকের তুলনায় সংস্কারমুক্ত। নিজের প্রতি শ্রদ্ধা আমার বেড়ে গেল মশাই। 

আতঙ্ক নিয়ে গ্রামে ফিরেছিলেন হিতেশ্বর। কিন্তু সেখানেও তাঁর আশঙ্কা মতো কিছু ঘটেনি। গৃহে পা দিয়েই তারকেশ্বর বললেন- বউমা। একটু খাবার জল দাও তো মা। 

হিতেশ্বরের প্রাণ বেরিয়ে যাবার উপক্রম হয়েছিল। যেদিন নয়মিকে নিয়ে এই বাড়িতে এসেছিলেন সেদিন নয়মির কপালের কালীঘাটের সিঁদুর ছাড়া আর কোনও সম্বল তাঁর ছিল না। তবু এত ভয় করেনি। সেদিন তিনি দেখেছিলেন—তাঁর মা নিভাননী জল নিয়ে উপস্থিত। তারকেশ্বর হুঙ্কার দিলেন—তোমার কাছে জল চেয়েছি আমি? সেই অধ্যাপকের বেটি কোথায়? তিনি কি শ্বশুরকে এক গ্লাস জল ভরে খাওয়াতে পারেন না? 

নিভাননী হাতে গ্লাস নিয়ে বোকার মতো বলেছিলেন—ও মা! সে কী কথা! 

তখন একগলা ঘোমটা দিয়ে নয়মি বা নয়া এসেছিলেন একটি রেকাবের ওপর জলভরা গ্লাস বসিয়ে। গ্লাসে লেসের ঢাকনা দেওয়া। এই পরিপূর্ণতার আয়োজন চাটুজ্যেবাড়িতে ছিল না। নয়া তাঁর শিক্ষা চিনিয়েছিলেন। 

স্বামীকে পুত্রবধূর ছোঁয়া জল খেতে দেখে হঠাৎ কেঁদে ফেলেছিলেন নিভাননী। বলেছিলেন—তুমি মানুষ বড় বাঁকা বাপু। 

নয়া শূন্য জলের গ্লাস নিয়ে প্রস্থান করেছিলেন। হিতেশ্বর নির্বোধের মতো বসে ছিলেন কেদারায়। তারকেশ্বর বলেছিলেন—কী হল কী! কাঁদো কেন? 

নিভাননী বলেছিলেন—সোনার পুতুল বউ আমার। কী লক্ষ্মী! কতদিন ভেবেছি, আহা, এমন মেয়েকে অমন অস্পৃশ্য করে রাখার কী আছে! জাত-পাত করে বিরক্ত হয়ে, অপমানে, কত হিদু মোছলমান হয়ে গেল এই গ্রামেই তা তো দেখলাম। আর ছেলে যে আমার ব্রেহ্ম বা কেস্তান হয়ে যায়নি এই না কত! তা তোমার ভয়ে কি কিছু বলতে পেরেছি! আর সেই তুমিই কিনা জল চেয়ে খেলে! ও মা গো! আমি কোথায় যাব? 

—এতে এত আশ্চর্য হওয়ার কী আছে শুনি? সেনবাড়ির জল খাই না আমরা? 

—তা এতদিন এ সুমতি হয়নি কেন? 

—কথা বাড়িয়ো না। এত যখন শখ, সোনার পুতুল তো আর পুড়ে কালো হয়ে যায়নি, যাও বউমাকে বুকে তুলে নাও গে। ওঁর বাপ একটা চামার। ভাবলে, কুটুম্বিতা এতদিন পরে, যদি বকেয়া পণ দাবি করে বসি! ছোটলোক! আমরাই এখন থেকে বউমার বাপ-মা। বুঝলে? 

হিতেশ্বরের চোখে জল এসে গিয়েছিল। তিনি সে-জল লুকোতে পালিয়ে বেঁচেছিলেন। আর নিভাননী কাঁদতে কাঁদতে বধূমাতার সন্ধানে গিয়েছিলেন। তখন সত্যি তাঁকে বুকে তুলে নেবার দরকার ছিল। ঘুমন্ত ছেলের পাশে উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদছিলেন তিনি তখন। নিভাননী আদর করে তাঁর চোখের জল মুছিয়ে দিয়েছিলেন। 

.

সব পেয়েছিলেন নয়মি। আদর। ভালবাসা। সম্মান। কর্তৃত্ব। বাড়ি। গয়না। শুধু ঠাকুরঘরে প্রবেশের আহ্বান উহ্য থেকে গিয়েছিল চিরকাল। ঠাকুরঘরে আছেন লক্ষ্মী-নারায়ণ। আছেন শালগ্রাম। তিনি পূজার আয়োজন করেছেন। দুর্গাপূজার ঝক্কি সামলেছেন। কিন্তু ঠাকুরঘরে ঢোকেননি। শ্বশুর-শাশুড়ির মৃত্যুর পরেও না। এমনকী আজও তিনি প্রবেশ করেননি। অনেক ব্রত শিখিয়েছিলেন শাশুড়ি। সুবচনী, গোক্ষুরব্রত, ভাদুলিব্রত। নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন সব শিখিয়েছেন পুত্রবধূদের। অন্যরা দূরে দূরে চলে গেছে। তারা আর মানামানি করে না বলেই তিনি বিশ্বাস করেন। তিনি জোরও করেন না। নন্দিনীকেও তিনি শিখিয়েছেন। কিন্তু জোর করেননি। ছেলেরা তাঁকে পূজার ঘরে ঢোকার কথা বলেছে অনেকবার। তিনি বলেছেন—আর কেন? এতদিনই যখন মেনে এলাম। 

এ তাঁর অভিমান। যে-বধূকে শ্বশুর-শাশুড়ি কোলে স্থান দিয়েছিলেন, তাকে ঈশ্বরের কাছে অশুচি করে রাখা ছিল কোন নিয়মে? বর্ণের সংস্কার সকল ঘর হতে বিতাড়িত হল, কেবল ঠাকুরঘরের চৌকাঠ ডিঙল না। নয়াঠাকুমার এ ব্যথা গোপন। সন্তর্পণ। বাপের বাড়ির নাম আর তিনি উচ্চারণ করেননি। শ্বশুরকুলকে আপনার করে নিয়েছেন। শ্বশুরকুলের সকল নিয়মনিষ্ঠা মেনে নিয়েছেন। বাপ-মার জন্য তাঁর কোনও গোপন রোদন ছিল কি না কেউ জানে না। তবে, হতে পারে, হিতেশ্বর গোপনে শ্বশুরকুলের খবর রাখতেন। নয়মির পিতা-মাতার মৃত্যুসংবাদ যথাসময়ে পৌঁছেছিল এই অজ গ্রামে। এবং যথাবিধি শ্রাদ্ধাদি সম্পন্ন হয়েছিল। আত্মীয়বিয়োগ এবং বিচ্ছিন্নতার বিপুল ভার, সেইসঙ্গে ঠাকুরঘরে অনধিকারীর বেদনা কত বিপুল ছিল কেউ জানল না। নয়াঠাকুমা একা একা সব বইলেন। এখন আর এ নিয়ে কেউ ভাবে না। আলোচনাও করে না। নিত্যপূজা করেন নন্দিনী। মেয়েদের শালগ্রাম স্পর্শ করা বারণ। তাই সোমেশ্বর এলে নিজেই শালগ্রাম স্নান করান। পূজাও করেন নিজেই। নন্দিনীর ঋতু হলে, পাশের সেনবাড়ির কোনও বধূ লক্ষ্মী-নারায়ণের জল-বাতাসা দিয়ে যান। নয়াঠাকুমার পূজাঘরে প্রবেশানধিকার নিত্যকার হাঁড়ি-কড়া-খুন্তি-হাতার মতোই স্বাভাবিক। 

অতএব একই কথাই তিনি বললেন মোহনলালকেও। 

—এতদিন যখন করে এসেছি, করি। 

—একজন কমিউনিস্টের বাড়িতে এ-সব হওয়ার কথা নয় ঠাকুমা। 

–বাছা! তুমি কমিউনিস্ট। আমি তো নই। আর এটা ব্যক্তি-স্বাধীনতারও তো ব্যাপার নাকি?

— এইসব ব্রতপূজা মানুষের চেতনাকে অন্ধ করে রাখে। 

—ধর্ম জনগণের আফিম, তুই এই বলবি তো এরপর। এইসব শুনে শুনে কান পচে গেল রে ভাই। এসব আর কেউ মানে না। আমি বরং বলি, সকল মতকে মাঠে নামিয়ে দাও। তারা পরস্পর যুদ্ধ করুক। মানুষ ঠিক বেছে নেবে কোনটা ভাল, কোনটা মন্দ। জোর করে চাপাতে যেয়ো না। যত খুলে দেবে, স্বাধীনতা দেবে, তত না তার জোরের পরখ হবে! 

—ঠাকুমা, আপনি এতও জানেন? 

দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সিদ্ধার্থ। 

—এসো, এসো বাবা, এসো। 

নয়াঠাকুমা আন্তরিক আপ্যায়ন করেন। মোহনলাল অবাক হয়ে বলে— তুই! হঠাং! সিদ্ধার্থ হাসে। বলে—তোর বাড়িতে আসার জন্য কি আমাকে খবর দিয়ে আসতে হবে নাকি? 

—আরে না না। বস। কীসে এলি? 

—হরিহরপাড়া অবধি বাস। তারপর হন্টন। 

—এতটা হেঁটে এলি! 

নয়াঠাকুমা বললেন— একটা ঘোড়ার গাড়ি নিতে পারতি। 

—পারতাম। অনেকদিন পর হরিহরপাড়ায় এসে মনটা খারাপ হয়ে গেল। মনে পড়ল ময়না পিসির কথা। তিনি তো হেঁটেই যাতায়াত করতেন সারাটা পথ। দেখলাম। 

সকলে নীরব থাকল কিছুক্ষণ। যেন অলিখিত শোকপালন হল। সিদ্ধার্থ অল্প হেসে স্বাভাবিক করতে চাইল পরিস্থিতি। বলল—কাল তো ঈদ-উল-ফিতর। বরকতচাচার বাড়ি ইফতারে দাওয়াত আছে আমার। ভাবলাম একদিন আগেই চলে যাই। একটু ঘুরে দেখা হবে। 

—বরকতচাচা ইফতারে তোকে ডেকেছেন? আমাকে বলেননি তো! 

—কেন বাবা? তোমার কি দাওয়াত নেই? 

—তা থাকবে না কেন? চিরকালই ছিল। 

—ঠাকুমা আপনি জনতার আফিমের কথা কী বলছিলেন? 

—মোহন খুব খাঁটি কমিউনিস্ট হয়েছে। ব্রত, পূজা, ধর্ম, কর্ম তুলে দিতে চায়। 

—তাই নাকি? ভয় নেই ঠাকুমা। মোহনের দৌড় মোহনের ঠাকুমা পর্যন্ত। বলুক তো গিয়ে মঠের মোহন্তকে! কোনও ইমামকে বলুক। 

মোহনলাল প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে। বলে— আমি আমার বাড়িতেই একথা বলতে পারি। বাইরে বলব কোন অধিকারে? 

–বাড়িতেই বা তুই কোন অধিকারে বলবি? ঠাকুমা তো বলেননি তিনি কমিউনিস্ট?

— চেষ্টা করতে হবে। 

—কী? কমিউনিস্ট তৈরি করার? শুরু হিসেবে ঠাকুমা মন্দ নন। তোর হঠাৎ ব্রত-পূজা-পাঁচালির ওপরেই রাগ হল কেন? 

—রাগ হবে না কেন? ঈশ্বরনির্ভরতা মানুষকে ভুল পথে নিয়ে যায়। কোনও কিছুই দৈবিক নয় এ পৃথিবীতে। 

—পুজোর প্রসাদ খেতে কিন্তু দারুণ লাগে। কিংবা ধর এই ইফতারের দাওয়াত! ধৰ্ম না থাকলে সেটাও থাকত কি? আর ওই ঠাকুরঘরের গন্ধ! কী সুন্দর! 

সিদ্ধার্থ বড় করে শ্বাস টানে। যেন এখানেই পাচ্ছে ঠাকুরঘরের গন্ধ। মোহনলাল চোখ-মুখ কুঁচকে বলে—তুই ব্যাটা কমিউনিস্টের কলঙ্ক। 

সিদ্ধার্থ বলে—একবাটি সিন্নি পেলে, আর সিন্নিতে থাকবে নারকেল কোরা, কাজুবাদাম, আঃ, আমি কমিউনিস্টের কলঙ্ক হতে রাজি আছি। 

—নে। হাতে ঘণ্টা আর শালগ্রাম নিয়ে পুজো করতে যা। তোরাও তো বামুন। তার মধ্যে আজ ঠাকুমার সুবচনী ব্রত আছে। মায়েরও আছে। কাল বৃহস্পতিবার। কাল আছে লক্ষ্মীপূজা। ভাল রোজগার হবে। 

—সুবচনী? সেটা কী ব্রত ঠাকুমা? আপনাদের বাড়িতে এত এসেছি। কাকিমাকে দেখেছি লক্ষ্মীপুজো করতে। কিন্তু ব্রত দেখিনি কখনও। কী হয় আমাকে দেখাবেন ঠাকুমা? 

—দেখাব না কেন? খুব সোজা। আমার মনে হয় কী জান, পূজা-পাঠ দিয়ে মানুষ জীবনকে সালঙ্কারা করে রাখে। ছোঁয়াছুঁয়ি ভাল না। লোককে হেয় করা খারাপ। কিন্তু পূজা কেন খারাপ হবে? উৎসব-অনুষ্ঠান আছে বলে জীবনে রং আছে। বৈচিত্র্য আছে। শহরে তো সিনেমা, থিয়েটার, লাইব্রেরি। এখন হয়েছে টিভি। কত কী! কিন্তু এখানে কী আছে বল? আগেও ছিল না। এখনও নেই। শুধু খাওন, শোওন আর বিষয়-ভাবনা নিয়ে বাঁচা যায় নাকি? 

—সময় কাটানোর উপায়ের অভাব কী! সাক্ষরতা প্রকল্প করো। পরিচ্ছন্নতার শিক্ষা দাও।

— ওরে বাবা! সেসব করতে গেলে লোকে ভাববে ঠাকুমা এবার ভোটে দাঁড়াবেন নির্ঘাৎ।

হেসে ওঠে মোহনলাল ও সিদ্ধার্থ। তখন নন্দিনী আসেন। সিদ্ধার্থকে দেখে বলেন- ভাল আছিস তো বাবা? 

—তুমি ভাল তো? 

—তোর জন্য তা হলে পোস্তর বড়া করি? 

সিদ্ধার্থ হাসে। পোস্তর বড়া তার প্রিয়। নন্দিনী জানেন। এই মহিলাকে দেখলে তার মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। নন্দিনী নয়াঠাকুমাকে বলে—মা, চলুন। ওঁরা এসেছেন। 

ওঁরা মানে সেনবাড়ির তিন বধূ। আগে দশরথ সেনের স্ত্রীও আসতেন মধ্যমণি হয়ে। এখন তিনি অসুস্থ। বিছানায় পড়ে আছেন। চলে যাবেন যে-কোনও দিন। সম্পূর্ণ নিরক্ষর এই মানুষটি নয়াঠাকুমার প্রিয় বান্ধবী। দশরথের স্ত্রী বলে নয়মি তাঁকে ডাকতেন কৌশল্যা। কৌশল্যা থেকে কবে হয়ে গেছে কুশি। নয়া আর কুশি। যদিও কুশি বয়সে নয়মির চেয়ে সাত-আট বছরের ছোট। 

নয়াঠাকুমা উঠলেন। বললেন—যাবি দেখতে? অ সিধু? যাবি? 

নন্দিনী অবাক হয়ে বললেন—ও কোথায় যাবে? 

—যাবে আমাদের সঙ্গে। ব্রত করবে। 

নন্দিনীর হাস্যবিরল মুখ ভরে ওঠে হাসির বিভায়। মোহনলাল বলে— তুই সত্যি যাবি?

—হ্যাঁ। যাব। এইসব তো উঠে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। দেখে রাখি। এই সব নিয়েই তো আমাদের দেশ। 

নন্দিনীকে উৎসাহিত দেখায়। যেন কী এক পরমকর্ম করবেন। যেন এতকাল যে ব্রতপূজা করে এসেছেন, তা সার্থক হওয়ার দিন আজ। 

নন্দিনী বলেন—তুই বরং শিলনোড়াটা নিয়ে চল সিধু। 

—বেশ তো। 

সে ওঠে। রান্না ঘরে গিয়ে পরিষ্কার করে রাখা শিলনোড়া তুলে নেয়। সেনবাড়ির বধূদের কাছেও সে অচেনা নয়। তাঁরা হাসিমুখে তার নিঃসঙ্কোচ গমন উপভোগ করে। দাঁড়িয়ে দেখে সে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে বেশ কিছুটা এসে তারা থেমেছে তিনটি সরু পথের সংযোগস্থলে। তাদের ঘিরে আছে শিশুরা। প্রতি মাসেই তারা দেখে এমন। তবু কৌতূহল মেটে না। 

রাস্তার মোড়ের এককোণে রাখা হল শিলনোড়া। তার ওপরে ও নীচে দেওয়া হল পান ও সুপুরি। শিলের ওপর তেলসিঁদুরে আঁকা হল লক্ষ্মীমূর্তি। এবার সব মহিলারা হাতে একটি করে পান-সুপুরি নিলেন। নয়াঠাকুমা বললেন— পান-সুপুরি দিলাম কাকে? 

সকলে একযোগে বললেন— থুনটোথুনটি দেবতাকে। 

পরপর তিনবার এরকম বলা হল। তারপর সকলে একযোগে বললেন—

পানসুপারি নিয়ে শেষে 

থুনটোথুনটি যাও দূর দেশে 

এবারে শিলনোড়া তুলে নেওয়া হল। সকলে ফিরে এলেন। বাচ্চারা ফেলে দেওয়া পান-সুপুরি তুলে নিতে হুটোপাটি লাগিয়ে দিল। সেনবাড়ির এক বউ চাটুজ্যেদের আঙিনায় আলপনা করে আঁকল চতুষ্কোণ। কখনও এ আঙিনায় হয়, কখনও সেনের আঙিনায়। চতুষ্কোণের চার কোনায় গণ্ডি দিয়ে আঁকা হল ঘর। ঘরগুলির মধ্যে আঁকা হল জোড়া হাঁস। আর মাঝখানে গোল গর্ত করে তাতে দুধ ঢালা হল। তার ওপর দেওয়া হল আম্রপল্লব। মহিলারা উলু দিয়ে এসে দাওয়ায় বসলেন। এসব ভোরবেলা করার কথা। কিন্তু সংসারের কাজ ফেলে আর হয় না। এখন রোদ্দুর চড়ছে। আঙিনায় আর দাঁড়ান যাচ্ছে না। সকলে দাওয়ায় এসে নয়াঠাকুমাকে ঘিরে বসলেন। নয়াঠাকুমা শুরু করলেন ব্রতকথা। 

.

কলিঙ্গদেশে এক গরিব ব্রাহ্মণী ছেলেকে শাকভাত খাওয়াতে বসেছেন। ছেলে বায়না ধরল- আমি মাংস খাব। আমাকে মাংস এনে দাও। নইলে আমি ভাত খাব না। 

ব্রাহ্মণী বললেন- বাবা। আমরা গরিব। মাংস কোথায় পাই বল দেখি।

ছেলে বলল—আমি নিয়ে আসব। 

ক’দিন পর ছেলে একটি খোঁড়া হাঁস ধরে নিয়ে এল। ব্রাহ্মণী ছেলেকে হাঁসের মাংস রান্না করে খাওয়ালেন। পরের দিন জানা গেল ওই হাঁস ছিল রাজার সম্পত্তি। অতএব ব্রাহ্মণীর ছেলে হাঁস চুরি এবং হত্যার দায়ে জেলে গেল। কারাগারে ছেলের বুকে পাথর চাপা দিয়ে রাখা হল। ব্রাহ্মণী কেঁদে আকুল হলেন। তখন এক অজানা অচেনা মহিলা, তাঁর দীনা-হীনার বেশ, ব্রাহ্মণীকে বললেন –বাছা, মা সুবচনীকে ডাকো। তিনি তোমার ভাল করবেন। 

রাত নেই, দিন নেই, সুবচনীকে ডাকলেন ব্রাহ্মণী। সুবচনী সন্তুষ্ট হয়ে রাজাকে স্বপ্নে বললেন—শোনো রাজা। ব্রাহ্মণের ছেলেকে তুমি মুক্তি দাও। হাঁসশালে দেখো গিয়ে, তোমার হাঁস ওখানে রাখা আছে। তোমার মেয়ের সঙ্গে ওই ছেলের বিয়ে দাও আর অর্ধেক রাজত্ব দাও ওকে। আমার কথা না শুনলে তোমার দারুণ অমঙ্গল হবে। 

ঘুম ভেঙে হাঁসশালে গিয়ে রাজা পেলেন তাঁর হারানো হাঁস। সঙ্গে সঙ্গে ব্রাহ্মণীর ছেলেকে মুক্তি দিলেন তিনি। মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে দিলেন। যৌতুক দিলেন অর্ধেক রাজত্ব। ব্রাহ্মণীর অভাবের সংসার সোনার সংসার হল। তিনি সুবচনীপূজার প্রসার করলেন। 

চারকোনা করি ঘর           কাটিলা আঙিনা পর 
আলিপনা দিলেন ব্ৰাহ্মণী। 
প্রতিবেশী বধূগণ      দাঁড়াইল জনে জন 
তাঁহারা পূজিবেন সুবচনী।।
চিত্রবিচিত্র করি            জোড়া হাঁস সারি সারি 
লিখি তায় আরোপিল তাতে। 
আম্রশাখা পূর্ণ করি           দুগ্ধেতে গহ্বর পুরি 
দিব্য শোভা পদ্মিনী পাতাতে।।
সুবচনী পূজা সব            সঙ্গে করো শঙ্খরব 
শুন সবে দণ্ডবৎ হয়ে। 
এয়োরে করিবে দান           লাড্ডু রম্ভা তৈল পান 
সিন্দুরাদি সবে সব দিয়ে।।  
সীমন্তিনী সারি সারি        দাঁড়াইল শোভা করি 
ব্রাহ্মণী চরণে দিয়ে জল। 
অঞ্চল লোটায়ে তাতে         দিলা পুত্রবধূ মাথে 
মনোবাঞ্ছা হইল সফল।।

নয়াঠাকুমা উঠে দাঁড়ালেন। বধুরা তাঁর পায়ে জল দিলেন। নয়া সেই জলে আঁচল ভিজিয়ে, সে-আঁচল নিংড়ে, বধূদের মাথায় সিঞ্চন করলেন। ব্রত সম্পন্ন হল। সেনবধুরা আপন গৃহে ফিরে গেলেন। সিদ্ধার্থ শিল বয়ে পৌঁছে দিল ওপরে। এতক্ষণ, ব্রত শোনার জন্য শিলনোড়া বারান্দাতেই রেখেছিল সে। ওপরে গিয়ে দেখল, বেরিয়ে গিয়েছে মোহনলাল। সে অবাক হল। তাকে না নিয়ে কোথায় চলে গেল মোহন! যদিও সে বেরুতে পারে একাই। খুঁজে নিতে পারে বরকত আলিকে। কিন্তু তার ইচ্ছে করল না। বহুদূর পথ হেঁটে এসেছে। এবং আসার পথে ময়না বৈষ্ণবীকে ভাবতে ভাবতেই এসেছে সে। যত ভেবেছে, অবাক হয়েছে তত। অতখানি প্রতিবাদ অন্তরে গড়ে তোলার শক্তি কোথায় পেয়েছিলেন তিনি। নিরক্ষর নন, তবু তো অশিক্ষিতই বলা চলে তাঁকে। সিদ্ধার্থ এত দুরাচার দেখছে প্রতিদিন, তবু তার মধ্যে সেই শক্তির স্ফুরণ কোথায়! 

গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে বেড়াতেন মহিলা। পায়ে হেঁটে। পায়ে হাওয়াই চটি। ক্ষয় লেগে যাওয়া। মেরামত করা। দারুণ রোদ্দুরে অল্প আঁচল তুলে দিতেন মাথায়। কী নেশা ছিল তাঁর? কী দেখতে তিনি বেরোতেন? যতদূর জেনেছে সে, মাধুকরীতে সামান্য সংগ্রহ হলেই তাঁর চলে যেত। তবে কি তাঁর ভ্রমণের নেশা ছিল? নাকি শুধুই জীবন দেখার নেশা? সারা পথ ময়না বৈষ্ণবীর অস্তিত্ব থেকে সে শক্তি নিতে নিতে এসেছে। শুধুমাত্র দলে থাকবার জন্য, শুধুমাত্র দলের শৃঙ্খলা ভাঙবে না এই আনুগত্যে বহু অন্যায় সে সয়ে আসছে নীরবে। অবশ্য না সয়ে কী-ই বা সে করতে পারে! প্রতিবাদ করতে গেলে লোকবল লাগে। দলে না থাকলে তার লোকবল কোথায়? আবার তার মনে হয়, ময়না বৈষ্ণবীর কী ছিল? সে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে একটি প্রতিবাদ গড়ে তুলতে পারছিল তো? 

মাঝে মাঝে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে ওঠে সে। সে কী করতে চায়? কী করতে পারে? সে চায় মানুষ পেয়ে যাক মানুষের অধিকার। কী অধিকার? মানুষ কেমন আছে? সে সারা পৃথিবীর কথা জানে না। সারা দেশের কথা জানে না। এই রাজ্যের কথাই কি জানে ঠিকমতো? এই জেলার! এই বাগড়ি অঞ্চলকেই কি সে জানতে পেরেছে পুরোপুরি? কীভাবে বেঁচে আছে মানুষ, কী তার চাহিদা, জানে কি সে? 

যেভাবে শহর বাঁচে, সেভাবে গ্রাম বাঁচে না। যেভাবে ধনী বাঁচে, সেভাবে গরিব বাঁচে না। এমনকী দরিদ্র পুরুষ যেভাবে বাঁচে, সম্বলহীনা নারী সেভাবে বাঁচে না। সে কী করবে! কতটুকু তার শক্তি! সে কি ময়না বৈষ্ণবীর মতো জানাতে জানাতে ফিরবে? কী জানাবে? এটুকু তো জানাতে পারে, এই তোমাদের অধিকার! তোমরা আলোয় এসো। আলোয়। অধিকার বুঝে নাও। 

অন্ধকারে অভ্যস্ত মানুষ অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে। সে কি এই বার্তাটুকুও পৌঁছে দিতে পারে না? তার আগে তাকে দেখতে হবে। জানতে হবে জীবন ও জগৎ। শহরের ওই ছোট গণ্ডির মধ্যে একজন বিধায়ক বা সাংসদ হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে সে বাঁচতে চায় না। তার স্বপ্নের কোনও নির্দিষ্ট রূপ নেই। কিন্তু সে অনুভব করে সে স্বপ্ন অনেক বড় অতিকায়। এবং মানুষের জন্য তার হিতৈষণা আকাশ পরিমাণ। সে স্থির করেছে ঘুরবে সে। ঘুরে ঘুরে দেখবে গ্রাম। গ্রামের মানুষ। তারপর? সময় বলে দেবে তাকে কী করণীয়! 

নয়াঠাকুমার গলা পেল সে। তাকে ডাকছেন তিনি। 

—সিধু। তোকে দেখবে বলে এসেছে দ্যাখ। 

—দেখবে বলে? 

সে বারান্দার লৌহজালিকার ফাঁকে মুখ রাখে। বাইরে বরকত আলি। সঙ্গে কয়েকজন। খেটে-খাওয়া। রুক্ষ চুলের মানুষ। তাদের কোথাও কোনও পারিপাট্য নেই। শরীরে নেই স্বাস্থ্যের দীপ্তি। সে নেমে আসে দ্রুত পায়ে। বলে চাচা, ভাল আছেন তো? কাল আপনার দাওয়াত নেব বলে এলাম। 

—আমার খুব আনন্দ যে আপনি এসেছেন। 

সে বরকত আলির হাত দুটি ধরে। বলে—চাচা, আগে যখন মোহনের সঙ্গে আসতাম, স্কুলে পড়তে, আপনার ছেলেদের সঙ্গে আমি খেলেছি। আমি এর আগেরবারও দেখেছি আপনি আমাকে আপনি-আপনি করছেন। আমার খারাপ লাগছে। আমি তো ছেলেরই বয়সি আপনার। 

বরকত আলি হাসেন। বলেন—তুমি বলব। শহরের মানুষের সঙ্গে আমরা বুঝে-শুনে কথা কই। এদিকে এসো। তোমাকে এরা দেখবে। 

—আমাকে দেখবে? কেন? 

—এখানে তোমাকে সবাই জানে। পুলিশ গুলি করেছিল তোমাকে। লোকে কী বলে জানো? নেতা হো তো অ্যায়সা। আরে হিন্দি ছবি দেখে তো ফাঁক পেলেই। গুলি খেয়ে ফিরে আসে এমন নেতাই সব চায়। আমাদের মতো ছা-পোষা লোক আবার নেতা নাকি? 

সিদ্ধার্থ বরকত আলির রসিকতায় হাসে। বলে—গুলি আপনারও লাগতে পারত।

—তাতে কী? লাগেনি তো? 

সে জনতার উদ্দেশে নত হয়ে হাত তুলে বলে—আস্ সালামু আলায়কুম। 

জনতা বলে—ওয়ালেকুম আস্ সালাম। 

বলে এবং দাঁড়িয়ে থাকে। বরকত আলি বলেন— আরে দাঁড়িয়ে রইলি কী! বল! কী বলবি বল!

তাদের একজন বলে—জি। নদী আমাদের জমিজমা খেয়ে লিচ্ছে। পাড়টা যদি গরমেন্টে বলে কয়ে বাঁধিয়ে দেন। 

—জি, হরিহরপাড়া পর্যন্ত যদি একটা মোরামের রাস্তাও হয়। কাঁচাপথে বড় কষ্ট। আপনের বড় ভরসা গো আমাদের। 

–জি, ইরিগেশনের ইঞ্জিনিয়ারবাবুরা এলেন, পঞ্চরস শুনে-টুনে গেলেন, বললেন কী সব সেচ প্রকল্প হবে, যন্ত্র-টন্ত্র বসবে। সে-ও তো হয়ে গেল কতগুলান মাস! যদি আপনে এট্টু কয়ে দ্যান! ইঞ্জিনিয়ারবাবুরা সাহেবলোগ, আমাদের মনে রাখেন না। 

সে লজ্জিত বোধ করে। বলে- প্রধানসাহেব তো তোমাদের সঙ্গেই আছেন। যা বলার তাঁকে বলো। 

—জি তিনিই তো বললেন। 

বরকত আলি হাসেন। বলেন—পঞ্চায়েতের টাকা নাই। 

—এ নিয়ে আমরা কথা বলব চাচা। 

—হ্যাঁ। তা তো বলবই। আমি নিজে যেতে পারি নাই তোমাকে দাওয়াত দিতে। কিছু মনে করো নাই তো? 

–কী যে বলেন? সন্ধ্যাবেলা যাব আপনার বাড়ি। 

–শুনলাম হরিহরপাড়া থেকে হেঁটে এসেছ? 

–হ্যাঁ। মোহনকে দেখেছেন নাকি? 

–সে তো গেল হরিহরপাড়া। 

–ও। 

ফিরে গেলেন বরকত আলি। সিদ্ধার্থও ওপরে চলে গেল। নদীর পাড় বাঁধানো নিয়ে সেও বরকত আলির সঙ্গে কথা বলতে চায়। 

স্নানের তাগিদ বোধ করছিল সে। স্নান সেরে এসে নয়াঠাকুমার পাশে বসল আবার। নয়াঠাকুমা বললেন—হ্যাঁ রে। বিয়ে করবি কবে? হারাধনের তো বিয়ে হয়ে গেল। এবার তোদের পাত্রী দেখি। নাকি প্রেম করছিস? 

সিদ্ধার্থ শব্দ করে হাসে। বলে—না না। প্রেমে আমি পড়িনি। একজনের প্রেমেই আমার দিন গেল। 

—কে সেই ভাগ্যবতী? 

—এই যে! আমার পাশে। রূপবতী, গুণবতী, আমার নয়াঠাকুমা 

—রাখ! তোর প্রেম কী আমি জানি না মনে করিস? 

—আপনি জানেন না তা হয়? কিন্তু কী জানেন সেটা শুনি!

— পার্টিপ্রেম। 

–হুঁ। 

—কিন্তু বিয়ে তো করতে হবে। 

—না ঠাকুমা। বিয়ে করতে পারব না আমি। 

অসম্ভব বেদনা ছিল তার কথায়। অসম্ভব বিষণ্ণতা। নয়াঠাকুমা স্তব্ধ হয়ে গেলেন। বুঝলেন, সিদ্ধার্থ আজও সেই গভীর কষ্ট হতে বেরুতে পারেনি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন-মোহনের বিয়ে দেব। সোম আর একা থাকতে পারে না বহরমপুরে। ঠাকুর চাকর নিয়ে দিন কাটে। নন্দিনীও এখানে আমার জন্য চিরকাল আটকা পড়ে আছে। দেখতে দেখতে কীরকম মনমরা হয়ে গেল মেয়েটা। মোহনের বিয়ে দিয়ে নাতি-নাতবউ নিয়ে থাকব আমি। নন্দিনীকে পাঠিয়ে দেব বহরমপুর। 

—খুব ভাল হবে ঠাকুমা। আমি রোজ গিয়ে কাকিমার হাতে পোস্তর বড়া খেয়ে আসব।

—হুঁ। পেটুক কোথাকার। আমার হাতে মোচাঘণ্ট খেয়েছিস? 

—খাওয়ালেন কোথায়? 

—খাওয়াব। কাল খাওয়াব। 

—ফাঁকি দিলে চলবে না ঠাকুমা। কাল আমার নিমন্ত্রণ। কাল দুপুরে গুরুভোজনে আমি রাজি নই। 

—বেশ তবে পরশু। 

—পরশু সকালে চলে যাব। এখানে ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকলে চলবে? 

—তা বিকেলে যেয়ো। সকালে তো উঠতে পারবে না। সারা রাত ছটফট করে ভোরে নিদ্রা যাবে। আমাদের মোহন যেমন যায়। রাতে তো ঘুমোয় না। 

—ঘুমোয় না? 

—হুঁ! বাইরে হাওয়া খেতে বেরোয়। আমার তো ঘুম পাতলা। তা ছাড়া, বলে না? বুড়ো মানুষের ঘুম, দেড় পলকের ধুম। এই চোখ লেগে এল, এই আর ঘুম নেই। তা সে বেরোয়। আমি সজাগ থাকি। যদি চোর-টোর আসে! নিজে তো অন্ধকারে বিভোর। মুনিষগুলো পাগলের মতো ঘুমায়। 

—বাইরে কোথায় যায়? 

—পথে ঘুরে-টুরে আসে। এই গ্রামদেশে তো আর হুরি-পরি ঘোরে না! তবে লোকে ভূত-পেত্নি দেখে। 

—পেত্নিদর্শনে যায় বলছেন? 

—যেতে পারে। যৌবনে পেত্নিকেও লাগে গোলাপের মতো। জানো না? 

নয়াঠাকুমা সিদ্ধার্থর চিবুক নেড়ে দেন। তাদের আড্ডা জমে ওঠে। নন্দিনীও আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এসে বসেন। নয়াঠাকুমা বলেন—নন্দিনী! আবার আঁচলে হাত মুছছ? তোমাকে বলে পারি না। তোয়ালে কোথায়? 

—ভুল হয়ে গেছে মা। 

—ছেলেটা সেই সকালে এসেছে। শুধু খেয়েছে দুটি ফল। ওকে দাও কিছু। 

—দিচ্ছি মা। 

নন্দিনী উঠে যেতে চান। সিদ্ধার্থ নন্দিনীর হাত ধরে ফেলে। বলে—তুমি বোসো তো কাকিমা। আমি এখন কিছুই খাব না। পেট খালি রাখছি। পোস্তর বড়া দিয়ে এই অ্যাত ভাত খাব। 

হাত দিয়ে পরিমাণ দেখায় সে। নন্দিনী হাসেন। অত ভাত সিদ্ধার্থ কখনও খেতে পারবে না। সে স্বল্পাহারী। নন্দিনী জানেন। সিদ্ধার্থ বলে—আচ্ছা! মোহনের নাম মোহনেশ্বর না হয়ে মোহনলাল হল কেন? মানে আপনাদের তো ঈশ্বরের বাড়ি! 

সে এই দুই মহিলার কাছে নিমেষে আদ্যন্ত ঘরোয়া হয়ে ওঠে। এমন হেলাফেলার সময় তার হাতে থাকে কদাচিৎ। নন্দিনী বলতে শুরু করেন—মোহন যখন হল, উনি এক জ্যোতিষ নিয়ে এলেন। 

নয়াঠাকুমা বাধা দিলেন—আঃ দাঁড়াও নন্দিনী। আমি বলি। 

নন্দিনী চুপ করে গেলেন। নয়াঠাকুমা শুরু করলেন—মোহন তো হল। কী যে সুন্দর ছিল ছোটবেলায়! ঘর আলো হয়ে থাকত। যেন নিমাই এলেন। সোম তো কোষ্ঠী করবে বলে জ্যোতিষ নিয়ে হাজির। তা জ্যোতিষের হাঁক-ডাক কী! পুরো রাস্তা তিনি এসেছিলেন ভাড়াগাড়িতে। এখন তো তবু সরকারি গাড়ি আসে বলে মাটির হলেও চওড়া পথ। বর্ষায় দেবে-দুবে যায়। কিন্তু অন্যসময় হেলে-দুলে হলেও গাড়ি পৌঁছে যাবে। এখনও অবশ্য তেমন চওড়া না। পাশে লোক দাঁড়িয়ে থাকলে তাকে জমিতে নামতে হয়। গাড়ি থেকে মনে হয় লোকের উঠোন দিয়ে চলছি। তা সেই জ্যোতিষ এলেন গাড়িতে। প্রায় লোকের উঠোন দিয়েই এলেন। এসে বাড়ি-ঘর ঘুরলেন। পূজা-পাঠ করলেন। তারপর কোষ্ঠীবিচার করে গুম হয়ে গেলেন। বললেন যা, শুনে তো আমার প্রাণ যায়। বললেন, সোমের নাকি নির্বংশ যোগ আছে। তাই এ-ছেলে আট বছরের বেশি আয়ু পাবে না। বাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে গেল। নন্দিনী তো অজ্ঞান হয়ে গেল শুনে। আমরা জ্যোতিষকে ধরে পড়লাম। কী করা যায়! বললেন—‘ছেলে বিক্রি করো। অন্য বংশের হলে ও বাঁচবে।’ নন্দিনীর বউদিদি ছিলেন এখানে তখন। নন্দিনীর অবস্থা দেখে তিনি ছেলে কিনে নিলেন এক আনি সোনা দিয়ে। তিনিই ছেলের নাম রাখলেন মোহনলাল। 

—বাবা! এ যে গল্প রীতিমতো। 

—হুঁ! এরকম অনেক গল্প আছে চাটুজ্যেবাড়িতে। বউমা, বসে রইলে কেন? স্নানটা করে নাও না। মোহন এলে তো খেতে চাইবে। তখন কি এমন আধবাসি খেতে দেবে নাকি! 

—আজ তো সকালেই স্নান করেছি মা। 

—হ্যাঁ। তো হলুদ-তেল লাগা কাপড়-টাপড় ছাড়ো। 

নন্দিনী উঠে গেলেন। সিদ্ধার্থর ভাল লাগছিল নন্দিনী থাকায়। নয়াঠাকুমা তাঁকে বারবার এমন তাড়া দিচ্ছেন বলে তার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। অন্যমনস্ক হয়ে বসে থাকল সে। নয়াঠাকুমা বললেন—ব্রতর কথা শুনতে চাইছিলি? খুব মজার ব্রত হল ভাদুলিব্রত। আমাদের তো চাষও আছে আবার ব্যবসাও আছে। তাই এ ব্রত করাতেন শাশুড়ি। 

সে বলল—হুঁ। 

—এইসব ব্রতপালনের মধ্যে কী লুকিয়ে থাকে জানিস? 

–কী? 

—ডিজায়ার। অভীপ্সা। একটা সমাজের ধরন বোঝা যায় এ থেকে। আশা-আকাঙ্ক্ষা বোঝা যায়। কত সাধারণ চাহিদা মানুষের। কিন্তু কত আন্তরিক। আর প্রত্যেক ব্রত সমাপন হচ্ছে কীভাবে? ধনদৌলত ও পুত্র প্রাপ্তির মধ্যে দিয়ে। বৈরাগ্যের জন্য মানুষের কোনও আকাঙ্ক্ষা কোনও কালেই ছিল না। আর কন্যাসন্তান প্রাপ্তির ইচ্ছা কোথাও লেখা নেই। মাইয়ার ছাতা! ঝাড়ে-বংশে আপনিই জন্মায়। 

নয়াঠাকুমা হাসেন। বলেন—ভাদুলিব্রত হয় ভাদ্রমাসে। এ-ব্রতের কামনা সামান্য আলাদা। তাই আমার ভাল লাগে। আমার শাশুড়ি আমাকে শিখিয়েছিলেন। আমি আমার বউমাদের শিখিয়েছি। নন্দিনী ছাড়া আর কেউ কিছু করে বলে তো মনে হয় না। আমি আর নন্দিনী দু’জনে নদীতে যাই। ব্রতকথা বলি। আমি মেয়ে সাজি। ও সাজে বউ। 

—এতে আবার সাজাসাজি আছে নাকি? 

—কী বলছি তবে? সমস্ত ব্রতপূজাই সাজা আর সাজিয়ে তোলার খেলা রে দাদাভাই!

দাঁড়া নন্দিনীকে ডাকি। শুনলে মনে হবে যেন নাটকের সংলাপ চলছে। 

তিনি নন্দিনীকে ডাকলেন। নন্দিনী এসে দাঁড়ালেন সামনে। 

—বলুন মা। 

তাঁর খোলা চুল কোমর ছাপিয়ে গেছে। কপালের সিঁদুর, সকালে দেওয়া হয়েছিল তেল-সিঁদুর, লেপটে গেছে লম্বা হয়ে। হাতে একখানি কুচনো শাড়ি। গরমে অল্প অল্প লালের আভা লেগে থাকা মুখ-সিদ্ধার্থর মনে হল সে সামনে দেখছে দেবীপ্রতিমা। এত এলোমেলো কখনও দেখেনি সে নন্দিনীকে। তার মনে হল মা দুগগা হাতে কুঁচনো শাড়ি নিয়ে নাইতে যাচ্ছেন ঘাটে। সব মানুষকে সবসময় একইরকম উজ্জ্বল লাগে না। সকলের জন্যই তুলে রাখা আছে কিছু বিশেষ মুহূর্ত। সিদ্ধার্থ নন্দিনীর এই অসামান্য মাতৃরূপ এঁকে নিল মনে। এ-চিত্র আজীবন সঙ্গে সঙ্গে থেকে যাবে তার। নন্দিনীকে দেখে নয়াঠাকুমা বললেন-স্নানে যাচ্ছ? 

—হ্যাঁ। 

—তা সকালে নেয়েছ বললে যে! 

—আর একবার স্নান করব। তখন তাড়াহুড়ো করেছিলাম। 

—কখন যে কী মতি হয় তোমার! তা এসো দেখি একবার। বোসো এখানে। 

—কেন মা? 

—বলছি বসতে। অত প্রশ্ন কোরো না বউমা। 

নন্দিনী লাল হয়ে ওঠেন। বসেন সঙ্গে-সঙ্গেই। সিদ্ধার্থ দিশেহারা বোধ করে। তার নিজের মাকে মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে আরও আরও সব ঘটনাবলী। সে একটি সিগারেট পান করার প্রয়োজন বোধ করে। তার মনে হয়, সম্পর্কগুলি কি হঠাৎ বদলে যাচ্ছে? নাকি তারই পালটে গেছে দেখার চোখ! নয়াঠাকুমা তার প্রিয়। কিন্তু নন্দিনী ততোধিক। একমাত্র নন্দিনীর সঙ্গেই কথা বলার সময় যে নয়াঠাকুমার সুর পাল্টে যায়, এতদিন সে লক্ষ করেনি তো! তার মধ্যে অকস্মাৎ কষ্ট পাক খায়। এ-কষ্টের অর্থ বোঝে না সে। এবং নন্দিনীর দিকে তাকাতে পারে না কী এক দুর্বোধ্য লজ্জায়! 

নয়াঠাকুমা বলেন—এসো তো, ওকে ভাদুলির ব্রত শোনাই। মোহন তো শুনতেই চায় না। ও চায়। মোহন বলে সব বন্ধ করে দাও। আমি কমিউনিস্ট। আমি মরলে দিস তখন তুলে! বলো নন্দিনী বলো! 

.

বাপভাই বাণিজ্যে গেছে। ভাদরের ভরা নদীতে নৌকার সারি। কলসিকাখে জল তুলতে যাচ্ছে মেয়ে, যাচ্ছে বউ। কোঁচড়ে ফুল। মেয়ে, বউ জলে ফুল ফেলছে। ফুল ভেসে যাচ্ছে হাসতে হাসতে। কোথায় চলে যাবে! কোথায় গিয়ে ডুবে যাবে! মেয়ে বলছে—নদী নদী কোথায় যাও? বাপ-ভায়ের বার্তা দাও। 

বউ বলে নদী নদী কোথায় যাও? সোয়ামি-শ্বশুরের বার্তা দাও। 

এই সময় বর্ষা নামল। বাংলায় ভাদরেও ভরা বর্ষা। তারা জলে-স্থলে ফুল ছিটিয়ে দিলে। 

মেয়ে ॥ নদীর জল বৃষ্টির জল যে-জল হও। 
আমার বাপ-ভাইয়ের সুসংবাদ কও। 

বউ ॥ নদীর জল বৃষ্টির জল যে-জল হও। 
আমার সোয়ামি-শ্বশুরের সুসংবাদ কও। 

বৃষ্টির জল নদীর জলে পড়ে জলের রেখায় আঁক ফুটিয়ে তুলল। সেই তার ভাষা! জলের ভাষা। বাপ-ভাইয়ের খবর তাতে ধরা আছে। 

শরতের বৃষ্টি। তাই নামল আর ধরল। সাদা ডানা মেলে উড়ে গেল বক। কাক ভেজা ডানা নিয়ে কা-কা করে ফিরছে। এবার রোদ্দুরে শুকিয়ে নেবে। 

মেয়ে ॥ কাগারে বগারে কার কপালে খাও? 
আমার বাপভাই গেছেন বাণিজ্যে কোথায় দেখলে নাও? 

কাক মুখ তুলে চাইল। নদীর চরায় গুগলি খুঁটছিল বুঝি। ঘাড় বাঁকিয়ে সে বলল— কাকা- কও-কও কি… তার ভাষায় সে দেয় খবর। মেয়ে বোঝে না। 

বউ নদীর চরাকে উদ্দেশ করে বললে—চরা চরা চেয়ে থেকো। 
আমার সোয়ামি-শ্বশুরের নাও দেখো। 

স্রোতের টানে নৌকা ভেসে যায়। ভেলা ভেসে যায়। চরায় শিহর লাগে। 

মেয়ে ॥ ভেলা ভেলা সমুদ্রে থেকো। 
আমার বাপ-ভাইকে মনে রেখো। 

বনে বাঘের গর্জন উঠল। 

বউ ॥ বনের বাঘ, বনের বাঘ 
নিয়ো না আমার সোয়ামি-শ্বশুরের দোষ 
তাদের তরে কুলুঙে রেখো তোমার মনের রোষ 
বাণিজ্যে গেছেন তাঁরা, যদি দেখ নাও,
দোষ না নিয়ো বনের বাঘ, পথ ছাড়িয়া দাও 

মেয়ে ॥ বাপ-ভাই গেছেন কোন ব্ৰজে?

বউ ॥ সোয়ামি-শ্বশুর গেছেন কোন ব্রজে?

মেয়ে ও বউ ॥ যে-জন চায় সে-জন খোঁজে। 
স্রোতে ভেসে যাওয়া স্রোতে আসা। 
ধনে-মানে সন্তানে ভরে বারো মাসা। 

নদীর পাড়ে এক ঢিপি। সে-ই তাদের উদয়গিরি। তারা উদয়গিরিকে ফুল দেয় আর বলে—

কাঁটার পর্বত, সোনার চূড়া, উদয়গিরি, 
তোমারে যে পূজিলাম সুমঙ্গলে, 
আসুন তাঁরা আপন বাড়ি। 

নদী মিশেছে গিয়ে সাগরে। সেই সাগরের উদ্দেশে বলা—

সাগর সাগর বন্দি
তোমার সঙ্গে সন্ধি
ভাই গেছেন বাণিজ্যে
বাপ গেছেন বাণিজ্যে
সোয়ামি গেছেন বাণিজ্যে 
ফিরে আসবেন আজ 
ফিরে আসবেন আজ 
ফিরে আসবেন আজ 

তখন বাবুই পাখি ডেকে উঠল টুই, টুই! চিক-চিক-চিক! আর এক পাখি, তৃষ্ণার্ত অনন্তকাল, সে হাঁকে, ফটি-ই-ই-ই-ক জল! জ-অ-অ-অ-ল! ফটি-ই-ই-ক। 

মেয়ে ও বউ ॥ পুঁটি পুঁটি উঠে চা 
ভাদুলিমায়ে বর দিল 
ঘাটে এল সপ্ত না। 

নৌকাবরণ হবে এবার। বরণের ডালা হাতে নিল মেয়ে-বউ। বলল— 

পড়শি লো পড়শি 
তাল তাল পরমায়ু, তালের আগে চোক 
ঘাটে এসে ডঙ্কা দেয় কোন বাড়ির লোক? 
আমার বাপের বাড়ির লোক! আমার বাপের বাড়ির লোক।
আমার শ্বশুরবাড়ির লোক। আমার শ্বশুরবাড়ির লোক। 

নৌকাবরণ হল। এ বড় পুণ্যের কাজ এয়োস্ত্রী ও পুণ্যবতী মেয়ের পক্ষে 

মেয়ে-বউ॥ এ-গলুইয়ে ও-গলুইয়ে চন্দন দিলাম।
বাপ পেলাম, বাপের নন্দন পেলাম।
এ-গলুইয়ে ও-গলুইয়ে সিঁদুর দিলাম। 
শ্বশুর পেলাম, সোয়ামি পেলাম।
কলার কাঁদি, কলার কাঁদি, কলার কাঁদি। 
তোমারে গঙ্গায় দিয়া আমরা গিয়া রান্ধি 

কলার কাঁদি বলে বটে, তবে দুটি দুটি দিলেই হয়। বাণিজ্য করে লক্ষ্মী নিয়ে এলেন বাপ-ভাই। এবার কৃষিকাজ করে তবে লক্ষ্মীর প্রতিষ্ঠা। 

হই হই করে উঠল সিদ্ধার্থ। মন ভরে গেছে তার। এ যেন এক নিপুণ নাটক অভিনীত হয়ে চলেছিল তার সামনে। একজন অশীতিপর বৃদ্ধা এবং এক মধ্যযৌবনা নারী তার কুশীলব। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *