রাজপাট – ৪০

৪০

ফাগুন-চৈত দুই মাস আইল 
কাল বসন্তের জ্বালা। 
একে তো দারুণ বসন্ত তাতে 
আমার শরীর করলাম কালা রে! 
ফাঁকি দিয়া বন্ধু আমার 
কোথায় লুকাইল রে—

বিষ-নিশ্বাসের মতো এসেছিল ফরিদার মৃত্যু। স্তব্ধ করে দিয়েছিল গ্রাম। পূর্ণবয়স্ক মানুষেরা যদি খুনোখুনি মারামারি করে, তবে জন্মায় ক্রোধ। আসে ঘৃণা। কিন্তু শিশুরাই খুনোখুনি করলে স্বর্গ কল্পনার আর অবকাশ মেলে না! 

হায়! তহমিনাকে যে আর শিশু বলা যাচ্ছিল না কোনওমতেই। বালিকা মাত্র না। পনেরো পার করে ষোলোয় পা দিয়েছিল সে। অনুভিন্ন শরীর ছিল বলে খুকি সেজে থাকত। কিন্তু গ্রামদেশে কে কার বয়স লুকোবে! পুলিশ তাকে নিয়ে গেছে। বহরমপুরের জেলে আছে সে। তার বিচার চলছে এখন। কেউ বলছে, ফাঁসি হয়ে যাবে তহমিনার। কেউ বলছে, এত ছোট মেয়ের ফাঁসি হয় না। তার যাবজ্জীবনের কারাদণ্ড হবে। অনেকে বলছে, কোনও সাজাই হবে না তার। সে তো প্রাপ্তবয়স্ক নয়। তাকে মুক্তি দেওয়া হবে। 

তহমিনার যাই হোক না কেন, ফরিদা আর ফিরে আসবে না। ইদরিশ ও মাসুদার দুর্ভাগ্যে গ্রামের প্রাণ কাঁদে। কে তাদের কী সান্ত্বনা দেবে! এই শোকের কোনও সান্ত্বনা হয় না। ফরিদার জামাকাপড়গুলি নিয়ে বসে থাকে মাসুদা। নাড়েচাড়ে। দুঃখে তার বুক ফেটে যেতে চায়। ওই তেঁতুল নিয়েছিল বলে সে তাকে প্রহার করবে স্থির করেছিল। হায়! এখন সে চলে গেছে কোথায়! সকল প্রহার, সকল ধমকের বাইরে। এই জগৎসংসার বিস্বাদ হয়ে গেছে ইদরিশ ও মাসুদার। সে যদি বসন্ত হয়ে মরত, যদি কলেরা হত তার— তা হলে যেন এতখানি শোক হত না! আহা! দাপিয়ে মরল সে। দাপিয়ে। এতগুলি লোক ছিল পাড়ে, কেউ একটু নজর করল না! মাসুদার দু’চোখ উপচে জল পড়ে। 

শোক আসে। শোক বিভ্রস্ত করে দেয় গোটা গ্রামের পরিপাটি জীবন। কিন্তু জীবন থেমে থাকে না। কৃষিকাজে মন দেয় কৃষক। জেলে মাছ ধরতে যায়। গৃহিণী রান্না বসায় আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে। যার সর্বোচ্চ শোক, সেও একদিন স্থবিরতা ভেঙে নড়ে বসে। 

.

বসন্তের বাতাস গায়ে মেখে দাওয়ায় বসে ছিল বুড়িয়া। সারা শরীর উথাল-পাথাল করছিল তার। অনেক দিন পর আজ বাইরে গিয়েছে দুলুক্ষ্যাপা। সে যেতে চেয়েছিল। দুলুক্ষ্যাপা রাজি হয়নি। বলেছিল, যাক আর ক’দিন। বুড়িয়া বুঝতে পারছিল, বুবুলদিদির ঘটনাটা দুলুক্ষ্যাপাকে বেজেছে। কেন বাজল? সে আসার পর থেকে দুলুক্ষ্যাপার বাইরে টান নেই। সে জানে কেন। সে দুলুক্ষ্যাপার চোখে ঘোর দেখেছে। তার কেমন লেগেছে বুবুলদিদির আচরণ? নোনা, নোনা! আকণ্ঠ নোনা! সমুদ্রজল পান করার মতো। কিন্তু দেখল সে। দেখে নিল সমাজ, সংস্কার! তার কিছু একটা পায়। হাসি-কান্না মেশানো গয়ের। দুলুক্ষ্যাপার কী হয়? দুলুক্ষ্যাপা। দুলেন্দ্র। নিজের জিহ্বায় তারিয়ে তারিয়ে সে উপভোগ করল নামটা। সেদিন আসরে গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিল সে। রূপেও মুগ্ধ হয়েছিল। কিন্তু সেটা কোনও বড় কথা নয়। তার মন মুগ্ধ হওয়ার জন্য সদাই প্রস্তুত। সে মুগ্ধতার গভীরে হাবুডুবু খায় কিছুদিন এবং তৃপ্ত হয়ে ফিরে আসে। এ পর্যন্ত সে বহুতর পুরুষে মুগ্ধ হয়েছে এবং মুগ্ধতা ভেঙে ফিরে এসেছে। তার মনে কোনও রেশ থাকে না। সে মনে করে, এ তার স্বাধীন শিল্পীস্বভাব। সেই স্বভাবে সে গানে ও রূপে মুগ্ধ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সঙ্গে যাবার সংকল্প নিয়েছিল নাম শোনার পর। দুলু বাউল। দুলেন্দ্ৰ। 

সে কী চায় শেষ পর্যন্ত? সে কি দুলুক্ষ্যাপাকে চায়? নাকি এক বাউল জীবন? 

বাউল জীবনের প্রতি তার আকর্ষণ ছিল। একরকম মোহবিদ্ধতা। কী রকম স্বাধীন ওরা! কীরকম গান গেয়ে কাটায় খোলামেলা জীবন! বন্ধন সে পছন্দ করে না। কোনও বন্ধন। নারায়ণমূর্তির কথা তার মনে পড়ে। রিচার্ড নারায়ণমূর্তি। সে ডাকত রিচ। সে প্রায় অজ্ঞাতবাস করছে এখানে। তাকে একেবারে না পেয়ে কী করছে রিচ ওখানে? রিচ তাকে বিয়ে করতে চায়। সে বিবাহ চায় না। তবে রিচকে চায়। কিংবা রিচার্ডকেও চায় না। আসলে রিচার্ডের সরল শর্তনিরপেক্ষ চাওয়ার কাছে সে স্তব্ধ হয়ে থাকে। শুধু ওই হাত প্রসারিত করে দিয়ে যে-চাওয়া, তার কাছে সে সম্মোহিত। 

সে বলেছিল— আমি বন্ধনে বিশ্বাস করি না রিচ। 

রিচার্ড জিগ্যেস করেছিল— কী রকম বন্ধন? 

— কোনও সম্পর্কের বন্ধন। বিশুদ্ধতার বন্ধন। 

— বিশুদ্ধতার বন্ধন কী? 

–ধরো, আমি তোমাকে ভালবাসি, তাই অন্য কারওকে আর ভালবাসতে পারব না, এসবে বিশ্বাস করি না আমি। শারীরিক শুদ্ধতায়ও আমার বিশ্বাস নেই। মনকে আমি রেখে দিতে চাই মুক্ত। অনর্গল। মন যা চাইবে, আমি তেমন করেই চলব। 

— দেখো- সে বলেছিল- বিশুদ্ধতা এক বোধ। নারী-পুরুষের সম্পর্ক এমন জায়গায় পৌঁছতে পারে, যেখানে শুদ্ধতার আর্তি আপনি আসে। এই বোধ কারও ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না। তোমার মধ্যেও যদি আসে তো আপনি আসবে। তখন মনে মনেও তুমি দ্বিতীয় কারওকে কামনা করবে না। যে সম্পর্ক তোমার বন্ধন বলে মনে হয়, তা তোমার অবলম্বন হয়ে উঠবে। ওই সম্পর্কের জন্যই শতায়ু হতে ইচ্ছে করবে তোমার। কিন্তু এর কোনওটাই জোর করে হয় না। জোর করাই তো অশুদ্ধতা। তোমাকে আমি কখনও জোর করব না বুড়িয়া। আমি চাই তুমি আমার সঙ্গে থাকো। সারাজীবন। কিন্তু তুমিও যদি চাও, তবেই তা সম্ভব হবে। 

—আমি দেখব। 

–কী? 

—কতখানি চাও আমাকে তুমি। আমার সমস্ত স্বাধীন বিচরণের কথা জেনেও তুমি আমাকে গ্রহণ করো কি না। 

—বুড়িয়া! আমি তোমাকে গ্রহণ করেছি বলেই তোমাকে চাই। আর তোমার স্বাধীন বিচরণকে তুমিই মনে মনে অশ্রদ্ধা কোরো না। আমার তো কোনও শর্ত নেই। তুমি চাইলেই আমরা একসঙ্গে থাকব। 

কোনওদিন জোর করেনি সে। কখনও। অতখানি আকাঙ্ক্ষা নিয়ে অতখানি নির্বিকার থাকা কী করে সম্ভব সে জানে না। রিচার্ডের কথার মানে বুঝতে তার সময় লেগেছিল। নিজের স্বাধীন বিচরণকে নিজেই অশ্রদ্ধা করা মানে কী! মানে এই— নিজেই নিজেকে তুলাদণ্ডে দাঁড় করিয়ে দেওয়া নয়? সমাজ নির্ধারিত নৈতিক দাবি যদি অগ্রাহ্য করতে হয়, সর্বাংশে করতে হবে। কোনও পাপবোধ থাকলে চলবে না। অস্বীকার করার শক্তি চাই। লঙ্ঘন এবং অস্বীকার নয়। অনুশাসন যারা লঙ্ঘন করে তারা পাপ এবং অপরাধ বোধে আক্রান্ত হয়। যারা সম্পূর্ণ অস্বীকার করে তাদের পবিত্রতা অক্ষুণ্ণ। কিন্তু তার বিপুল শক্তি থাকা চাই। রিচ সেই শক্তিকে শ্রদ্ধা করে। রিচ অন্য মানুষ। চলতি ও চেনা ধাঁচে তাকে ফেলা চলে না এই স্বীকারের কাছে বুড়িয়া সমর্পিত। সে রিচার্ড নারায়ণমূর্তিকে না জানিয়ে চলে এসেছে। কী করছে সে? তার ইচ্ছে করল, ছুটে চলে যায় এখুনি। এইসব ফেলে। 

.

দুলুক্ষ্যাপা। দুলেন্দ্র। এই নামটুকুর জন্য সে এসেছে এতদূর। কিছুদিন হল লোকটার সঙ্গে শারীরিক মিলন ঘটিয়েছে সে। অভ্যাস করেছে আপন রসপান। দুলুক্ষ্যাপা শেখাচ্ছে তাকে প্রলম্বিত সঙ্গম। দেখাচ্ছে বজোলি মুদ্রা। যদিও বিফল হয়েছে বারংবার। প্রত্যহই, বুড়িয়ার অভ্যন্তরে প্রবেশ করা মাত্র স্খলন হয়ে গেছে তার। তখন, ওই সুন্দর বৃহৎ পুরুষ সর্বস্বান্ত মানুষের মতো ভেঙে পড়েছে। যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে গেছে তার মুখ। দুলুক্ষ্যাপা জানিয়েছে তাকে। বহুকাল আগে এক নারী এসেছিল তার জীবনে। চলে গেছে। তারপর সে আর সঙ্গম করেনি। বুড়িয়া বিশ্বাস করেছে এ কথা। বিশ্বাস না করার কোনও কারণ নেই। কপট সততার ছলনা করার কোনও প্রয়োজন তাদের নেই। এই অনভ্যাস দুলেন্দ্রকে করেছে দীর্ঘসঙ্গমের অনুপযুক্ত। এবং হয়তো তার মধ্যচল্লিশে পৌঁছে যাওয়া, হয়তো গঞ্জিকা সেবনের প্রভাব। তবু দুলু ক্ষ্যাপা তাকে শেখাতে চেষ্টা করছে সব। যা সে জানে। সে জানছে, যেমন করে জানে গুরুমুখী বিদ্যার শিক্ষার্থী। জানছে তাত্ত্বিকভাবে। 

এ কি জানা ছিল না তার? নতুন কোনও রহস্যের ঘোরে কি আনন্দ মন্থন করছে? না। তার কাছে কোনও রহস্য নেই বাউলের। কারণ বাউলতত্ত্ব নিয়ে বহু বই লেখা হয়ে গেছে। সকল রহস্যই সেখানে উন্মোচিত। সে শুধু, হঠাৎ সিদ্ধান্তে, সঙ্গ পেতে এসেছিল। দুলেন্দ্রর সঙ্গ পেতে এসেছিল। কিন্তু সে জানে, সে প্রতারিত করছে। সর্বাংশে প্রতারিত করছে লোকটাকে। প্রায় দশমাসের মতো গর্ভনিরোধক পিল এনেছে সে। বাউল আত্মসংযমের মধ্যে গর্ভনিয়ন্ত্রণে বিশ্বাস করে, গর্ভনিরোধক তার কাছে অধর্ম। কিন্তু সে কোনও ঝুঁকি নিতে পারে না। 

কতদিন থাকবে সে এখানে? সে জানে না। এই জায়গা তার ভাল লাগছে না। ভাল লাগছে না এই আখড়া। তার অসুবিধে হচ্ছে নদীপাড়ে মলত্যাগ করতে। অসুবিধে হচ্ছে পাড়ে মলত্যাগ করে ওই নদীতেই গা ডুবিয়ে স্নান করতে। অসুবিধে হচ্ছে সকল অপরিচ্ছন্নতায়। এমনকী লিঙ্গ শোষণ করতে গা ঘুলিয়ে উঠছে তার কারণ দুলুক্ষ্যাপা নয় আদ্যন্ত পরিচ্ছন্ন এবং তার লিঙ্গস্থানে, উপস্থে কটু গন্ধ। তবু সে রয়েছে আপাত স্বাভাবিক। নিজেকে প্রকাশ করা চলবে না। তা হলে সকলই জলে যাবে। এ তো তার নিজেকেও পরীক্ষা করা। তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে তার অসুবিধা হচ্ছে। সে পারে। সে চূড়ান্ত সরলতা পারে। চূড়ান্ত অভিনয়ও পারে। আসলে অভিনয়কে অভিনয় ভাবে না সে। ভাবে সত্য। সেই সত্যের প্রভায় তার সকল আচরণ বিশ্বাস্য হয়ে ওঠে। 

রাত্রে গণি মিঞার ঘরঘরে নিশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায়। দিনে জাহিরার তীব্র দৃষ্টি বিদ্ধ করে তাকে। সে একপ্রকার নির্বান্ধব জীবন যাপন করছে এখানে। আর কতদিন? আর কতদিন? দীক্ষা নেওয়া পর্যন্ত। দীক্ষা সম্পর্কে সে যা জেনেছে, তা কি সত্য? সে দেখতে চায়। তার জন্য তাকে থাকতে হবে আরও তিনমাস। জ্যৈষ্ঠে গুরু আসবেন। 

কোকিল ডাকছে কোথাও। সে পলাশগাছের দিকে তাকাল। অপরূপ হয়ে ফুটে আছে পলাশ। হঠাৎ কোন এক কবিতার দুটি পংক্তি মনে পড়ল তার— উতল হাওয়া ক্ষণে ক্ষণে, মুকুল ছাওয়া বকুল বনে, দোল দিয়ে যায় পাতায় পাতায়, ঘটায় পরমাদ। 

কী পরমাদ? সে জীবনের কোনও কিছুকেই প্রমাদ মনে করে না। জীবন কতকগুলি ঘটনার সমষ্টি। সেই ঘটনাসমূহকে চয়ন করে গেঁথে তুললে জীবন হয়ে দাঁড়ায় প্রাণহীন। মেকি। 

তার হঠাৎ মনে পড়ে সেই শিশুটির কথা, যে ক’দিন আগে, এই ভৈরবের বুকেই বীভৎস মৃত্যু মরেছে। জাহিরা, পারুলবালা, দুলুক্ষ্যাপা——সকলেই ছুটে গিয়েছিল তাকে দেখতে। সে যায়নি। যেতে পারেনি। জীবনের কোণে কোণে ওঁৎ পেতে থাকে বীভৎস। তাকে দেখার জন্য আগ্রহী হয়ে কী লাভ! কোনও কিছুই স্থায়ী হয় না তার মধ্যে। মৃত্যু আর বিচ্ছেদ তার ওপর দিয়ে হেঁটে গিয়েছে। সে শিশুটির জন্য দুঃখ বোধ করে এবং বসন্তবিলাসে উম্মাদ হতে চায়। তার মনে পড়ে শান্তিনিকেতন। মনে পড়ে দোল উৎসব। আনমনা হয় সে। তার নাকে এসে পৌঁছয় আমের বউলের গন্ধ। এ গ্রামে অনেক আমগাছ। বউলে ভরে উঠেছে সব। ওরা সব বসন্তের বাণ। যোদ্ধাবেশে এসেছেন বসন্ত আর আম্রমুকুলের বাণে কামিনীহৃদয় বিদ্ধ করছেন। কোকিল কোকিলার মুখচুম্বন করছে। ভ্রমর আলিঙ্গন করছে ভ্রমরীকে। সে কাকে আলিঙ্গন করবে? কাকে? সে চোখ বন্ধ করল। তার নয়নজুড়ে রিচার্ড। আশ্চর্য! আজ রিচার্ডের কথা বড় বেশি মনে পড়ছে তার। সে ঘরে গেল। একটি খাতা বের করে লিখল-রিচ, তুমি কোথায়? লিখল আর কেটে দিল। আবার লিখল-রিচ, তুমি আমার মায়ের নাম জানতে চেয়ো না। আমি এখন… 

আবার লিখল। আবার কেটে দিল। 

সন্ধে পার করে পৌঁছল দুলুক্ষ্যাপা। রাত্রে যখন তারা স্নান করে যার যার দেহরস পান করে পরস্পরকে প্রণাম করল তখন দুলুক্ষ্যাপা বলল—আপনি কেন এসেছেন বুড়িয়া? 

সে বিস্মিত হল। সন্দিগ্ধও। একথা কেন? দুলুক্ষ্যাপা বলল—আমি ভেবে দেখেছি। আপনার মন আজও আমার মনে মেলেনি। সে তো আপনি চলে যাবেন বলেই। আপনি পারছেন না। আমি জানতাম। আমি জানতাম বুড়িয়া। বাউলচর্চা সহজ নয়। এই যেমন আমি ও ব্যর্থ হচ্ছি প্রতিদিন। 

কাতর দেখাচ্ছিল দুলুবাউলকে। সুন্দর দেহ কাঠামোর অন্তরালে এক ভেঙে পড়া মানুষ। এমন হয়। সে জানে। প্রেম হৃদয় অধিকার করলে এমন হয়। তার মায়া হল। সে তো দেখতে এসেছে আসলে। দুলেন্দ্রকে। দুলু বাউলকে। স্বাদ নিতে এসেছে। সে বলল—কেন এমন বলছেন? আপনি যা যা বলছেন, যেভাবে বলছেন, আমি তো করে চলেছি। 

–করছেন। কিন্তু আমি জানি। আপনি হৃদয় রেখেছেন অন্য কোথাও। কেন এলেন বুড়িয়া? আপনি আমার জীবনে কেন এলেন? আমি তো একা একা ভাল ছিলাম। 

তার দেহবোধ জাগছিল। বসন্তের উন্মাদ হাওয়ায় প্রবল যৌনাকাঙ্খী সে। খুলে ফেলল আবরণ। লণ্ঠনের স্তিমিত আলোক তার দেহে। দুলুক্ষ্যাপা এই নগ্নতায় স্তব্ধ হয়ে যায়। বুড়িয়া এগিয়ে আসে। দুলুক্ষ্যাপার হাত রাখে নিজের দক্ষিণ স্তনে। সে এখন বিলাসী। কামিনী। 

নারীর দক্ষিণ স্তন বিলাসের। বাম স্তন সন্তান পালনের জন্য নির্দিষ্ট। 

সে দুলুক্ষ্যাপার বামস্তনে মুখ রাখে। মধ্যচল্লিশের ঈষৎ পুষ্ট স্তনবৃন্ত শক্ত হয়ে ওঠে সেই স্পর্শে। সুখে আর্তনাদ করে দুলুক্ষ্যাপা আর বুড়িয়া শোষণ করে চলে স্তন। 

কৃষ্ণ তাঁর কামিনী গোপীদের স্তন পান করতেন। সমুদ্র মন্থনের বিষে জর্জরিত শিব পার্বতীর ভরাট, দুগ্ধবতী, পবিত্র সুধাভাণ্ডের মতো স্তন পানে সুস্থ হয়েছিলেন। স্তন পানে সাধকের নারীর প্রতি মাতৃভাব আসে। সন্তানহীনা বা কুমারীর স্তন রজঃকালে শোষণ করলে ছ-সাত মাসের মধ্যে স্তনরস অবিরল ধারায় বর্ষিত হয়। এই রসের নাম সুধা। এমনকী বাউলতত্ত্ব বলে পুরুষের স্তন নিয়মিত শোষণ করলে রস দান করে। সে রসকে কী বলে? বুড়িয়া জানে না। 

.

সকল সমাপ্ত হলে একটি মাটির ভাঁড়ে শুক্রকণা সংগ্রহ করল দুলুক্ষ্যাপা। তার অস্থির চিত্ত শান্ত হয়েছে। গভীর ঘুমের পর প্রাতঃকালে চারিচন্দ্রের এক চন্দ্র ওই শুক্রকণা তেলের সঙ্গে মিশিয়ে গায়ে মেখে সে মাঠ করতে গেল। মাঠ শেষে স্নান করে ফিরে শুক্রকণা জলে মিশিয়ে পান করে চালজল সমাপ্ত করল সে। প্রভাত সূর্যের দিকে তাকিয়ে শুরু করল সূর্যপ্রণাম—

উঠ উঠ স্বামী হে রক্তের বরণ।
তোমাকে সাধিলে কারো না হয় মরণ।।
তুমি কেন জিহ মুর্শিদ আমি কেন মরি।
পুরাপুরি করো দয়া 
তোমার কৃপায় যেন যুগে যুগে তরি!
যে রং তোমার স্বামী সে রং আমার
সেই রং জগতেরি। 
ভরে পারাবার 
ঊনকোটি মহামন্ত্র-গুরু তুমি স্বামী।।
তোমারে প্রণমি ওগো তোমারেই নমি 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *