রাজপাট – ৩৯

৩৯ 

ফাগুন মাসে কুকিল বলে
দুলা মিঞা কই। 
চলিলাম গো ফতেমা 
সিন্নি লইয়াঅই ॥ 
মদিনা বিছড়াইয়া মাগো 
শা মর্তুজা আলি 
মালখানা ঘরেতে দেখি 
জোরে পালং খালি 
হায় হায় রে—

.

অলসভাবে পা ছড়িয়ে দাওয়ায় বসে ছিল মাসুদা। তার কপাল ভাল, ক’দিন হল ইদরিশ কাজে যাচ্ছে রোজ। মাঠে মাঠে এখন ডালশস্য উৎপাদনের প্রস্তুতি। ধানের মতো ডালের চারা রোয়ার কোনও প্রয়োজন হয় না। মাটি প্রস্তুত করে ছড়িয়ে দিতে হয় ডালের বীজ। 

বরকত আলির জমিতেই এখন কাজ করছে ইদরিশ। মাসুদার ইচ্ছে করছিল ইদরিশের কাছে চলে যেতে। দু’জনে একসঙ্গে মাঠে কাজ করতে পারত যদি! কাজ করার খুব ইচ্ছা মাসুদার। কিন্তু কী করবে? ছোট উঠোন, দু’বার ঝাঁট দিলেই তকতকে। রান্নারও তরিবত নেই তাদের। মেয়ে যখন শিশু ছিল, তখনও তার কাজ ছিল অনেক বেশি। এখন মেয়ে সকাল হতে পাড়া বেড়াতে যায়। আরও সব বাচ্চাকাচ্চার সঙ্গে মিলেমিশে খেলে। তাকে সময়মতো নাইয়ে-খাইয়ে দিলেই কাজ শেষ। সে ভাবল একবার নিমপাতা সংগ্রহে যাবে কি না। দক্ষিণপাড়ার দু’-চার বাড়িতে বসন্ত লেগেছে। দু’-চার বাড়িতে হওয়া মানেই গোটা গ্রামে ছড়িয়ে যাবে এবার। ঘরে নিমের ডাল রাখলে বসন্ত রোগ ঢোকে না। সে উঠবে-উঠবে করছিল। তখন তার বাড়ির কাছ দিয়ে পেরিয়ে গেল দলটা। এ-গ্রামেরই যুবক কয়েকজন। কালু মিঞা, মফিজ মিঞা, সমীরুদ্দিন, মাতিন শেখ। এরা কেউ চাষের কাজ করে না। এদের বাপ-দাদারা সব তিন-চার বিঘে জমির মালিক। জমি তারাই চষে। এরা ঘুরে বেড়ায়। আকাম-কুকাম করে। মাঝখানে মফিজ আর সমীরুদ্দিন কোন এজেন্সিতে নাম লিখিয়ে অসমের চা-বাগানে সিকিউরিটির কাজ করতে গিয়েছিল। টিকতে পারেনি। পালিয়ে এসেছে। আসার সময় নিজেরাই চুরি করে এনেছিল অনেকগুলি চায়ের প্যাকেট। গ্রামে বিলিয়েছিল সেইসব। এখন বেকার। তবু যেন বেকার নয় ওরা। মাঝে মাঝে ওরা কাজে বেরোয়। এবং কাজ করে ভাল পয়সা কামিয়ে ফেরে। কিন্তু পয়সা ধরে রাখতে পারে না। দু’দিনে নিঃস্ব হয়ে যায়। কারণ কামানো অর্থে ওরা কেনে চাকচিক্যময় পোশাক। মাংস খায় নিত্য। লুকিয়েচুরিয়ে ক্রয় করে অন্যান্য বিলাসিতা। কী কাজ করে ওরা? অত উপার্জন করে কী উপায়ে? উপার্জনে ধারাবাহিকতা থাকে না তাদের কেন? ইদরিশ বলে ও পয়সা থাকে না। পাপের পয়সা। 

–পাপের পয়সা? কী করে ওরা? 

জিগ্যেস করেছিল মাসুদা। তার জানার আগ্রহ ছিল কারণ সে এই প্রস্তাব করেছিল, ইদরিশও তো ওদের সঙ্গে গিয়ে কিছু বাড়তি উপার্জন করতে পারে। ইদরিশ বলেছিল— পাখি মারে। 

মাসুদা অবাক হয়ে বলেছিল— পাখি মেরে এত টাকা পায়? এত পাখি পায় কোথায়? 

–ধুর। এ পাখি মারা সে পাখি মারা নয়। 

–তবে? 

— ও তুমি বুঝবে না। 

— বুঝিয়ে বললেই বুঝি। 

ইদরিশ প্রথমে বলতে চায়নি। কিন্তু মাসুদা নাছোড় হয়েছিল। বলতেই হবে। ইদরিশ বুঝিয়ে বলেছিল তখন— চোরাচালান করে ওরা। 

–চোরাচালান? কীসের? 

–যখন যা পায়। চাল। সিল্কের কাপড়। আর ড্রাগ নিয়ে আসে। 

–ড্রাগ কী গো? 

–নেশার বস্তু। 

–কোথায় পাওয়া যায় এ-সব? 

সীমান্তে। বর্ডারে। ওখানে ওরা চাল, সিল্কের কাপড়-এইসব পাচার করে। আবার ওদেশ থেকে ড্রাগ আনে এ-দেশে। বিদেশি জামাকাপড় আনে। সাবান, সেন্ট কত কী! কখনও- কখনও বন্দুক-পিস্তলও আসে এই পথে। তবে এই সমীরুদ্দিনরা করে খুচরো কাজ। 

–কিন্তু বর্ডারে তো পুলিশ আছে। ধরে না? 

— পুলিশকে ফাঁকি দেওয়া শিখতে হয়। তা ছাড়া পুলিশের মধ্যেও ওদের লোক থাকে। 

–যদি ধরা পড়ে! 

–বর্ডারেই গুলি খেয়ে মরে যেতে পারে যে-কোনও দিন। তা ছাড়া ধরা পড়লে জেল হয়ে যাবে। 

–মাগো! এ-সব করছে কেন ওরা? 

ইদরিশ চুপ করে ছিল কিছুক্ষণ। তারপর বলেছিল— এটাকে দু’ভাবে দেখা যায়। এক হল, যা করছে, ঠিক করছে। 

–কেন? 

–মাতিন শেখের কথাই ধরো। ওদের জমি-টমি নেই। আমাদের মতোই। মাতিনের আব্বা গোরু চড়িয়ে দিন কাটায়। তা মাতিন কী করবে? গ্রামে মজুর খাটার লোকের তো অভাব নেই। লেখাপড়াও শেখেনি। ও কী করবে? 

— শহরে যেতে পারে। কাজ করতে পারে। কদম মণ্ডল যেমন রাজমিস্ত্রির কাজ করে। 

–কিন্তু মাতিন তো কোনও কাজই জানে না। তা ছাড়া শহরে মাতিনের মতো এরকম হাজার ছেলে আছে। 

— কিন্তু তাই বলে এইসব? এ তো চুরি-ডাকাতির মতো। তারপর মরে যেতে পারে। জেলে যেতে পারে। 

–হ্যাঁ। এটা হল আরেকভাবে দেখা। যা করছে, ঠিক করছে না। এর চেয়ে যে-কোনও একটা কাজ, সে যা-ই হোক, যেমন ওরা গিয়েছিল সিকিউরিটির কাজ করতে, করতে পারত। আসলে কেউ হয়তো প্রথমে গেল অভাবের তাড়নায়। তারপর কাঁচাটাকা হাতে পেয়ে লোভে পড়ে গেল। লোভ এমনই বস্তু মাসুদা, যার তাড়নায় লোকে জীবন-মরণ খেলে। 

মাসুদা শিউরে উঠেছিল ইদরিশকে সীমান্তে কল্পনা করে। গুলি খেয়ে পড়ে আছে ইদরিশ। কিংবা পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে তাকে! সে ভেবেছিল, তার এই ভাল। অভাবের সংসার। তবু অপরাধের অশান্তি নেই তার। তা ছাড়া ইদরিশ ঠিকই বলেছে। পাপের পয়সা পাখনা মেলে উড়ে যায়। থাকে না। যদি থাকত তা হলে ওদের অভাব ঘোচে না কেন? ওদের বিবিগুলির সব রোগা-ক্যাংটা চেহারা। বাচ্চাগুলোর সারা বছর নাকে সর্দি। পেটে ক্রিমি। তারা জন্মায়। মরে যায়। আবার জন্মায়। বিবিরা সব ফ্যাকাশে মুখ, রক্তহীন, তবু প্রতি বছর ভারী পেট নিয়ে পড়ে থাকে। মাসুদার কপাল ভাল, ইদরিশের বহু সন্তানের আকাঙ্ক্ষা নেই। শহরে-গ্রামে ঘুরে, পঞ্চরসের গান গেয়ে তার মধ্যে তৈরি হয়েছে এক আধুনিক-মনস্কতা। নিয়মিত রোজগার করে না এই ইদরিশের দোষ। কিন্তু মাসুদা জানে, ইদরিশের মতো মানুষ গ্রামে বিরল। ইদরিশের কথা ভেবে ভালবাসায় তার বুক টনটন করে। ইদরিশ তাকে প্রথম জ্ঞানী করেছে নিরোধ বিষয়ে। শহর থেকে কিনে আনা বেলুনের মতো বস্তুগুলি। মিলনকালে ইদরিশ পরে নেয় সে-বস্তু এবং তাদের সন্তান আসে না। এবং এই বেলুনগুলি তাদের দাম্পত্যের গোপন ক্রীড়াবস্তু। ইদরিশ সাবধান করেছিল তাকে। বারবার বলেছিল— কারওকে বোলো না এর কথা। কোনও মেয়েছেলেকে না। 

সে বলেনি। কারণ সে জানে দারিদ্র্যের কামড়। সে জানে জন্মনিরোধকের ব্যবহার অনেকে হারাম মনে করে। তাদের এই আধবেলা না খেয়ে কাটিয়ে দেওয়া সংসারে আরও সন্তান এলে উপবাসেই তারা মারা পড়বে। জেনেশুনে সন্তানের প্রাণ নেবার অধিকার তাদের নেই। পাঁচ পির ক্ষুব্ধ হবেন না কি তা হলে? সে অতএব অতি সন্তর্পণে মাটি খুঁড়ে পুঁতে দেয় ব্যবহৃত নিরোধ। ইদরিশ তার সামান্য আয়ের কিছু অংশ শুধু যৌনকল্যাণে ব্যয় করে বলে তার কোনও অভিযোগ নেই। কারা যেন বিনামূল্যেও বিলি করে এ-সব 

তার বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে যেতে সমীরুদ্দিন বলল— কী ভাবি? ইদরিশভাই কোথায়?

চোরাচালান করে জানার পর এই ছেলেগুলোকে পছন্দ করতে পারে না মাসুদা। সে বিশ্বাস করে, পাপের পথে একবার পা বাড়ালে আরও গূঢ় পাপ তাকে দোজখ অবধি টেনে নিয়ে যায়। সে এই দোজখ-অভিমুখী ছেলেগুলির দিকে কড়া চোখে তাকায়। বলে— মাঠে গেছে তোমাদের ইদরিশ ভাই। 

— মাঠে? গান গাইছে নাকি মাঠে? 

তারা সমস্বরে হাসে। মাসুদা ঝটকা দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। বলে— গাইছে তো। শুনতে পাচ্ছ না? কানে কালা নাকি তোমরা? 

তারা আবার হাসে। এ ওর পিঠে চাপড় মারে। এগিয়ে যায়। 

–হারামজাদা। 

মনে মনে গালি দেয় মাসুদা। কেন তার এত রাগ হচ্ছে, সে জানে না। সমীরুদ্দিনরা তাদের কোনও ক্ষতি করেনি। তবু সে ক্রুদ্ধ হয়ে ফুঁসতে থাকছে। ইদরিশের গান নিয়ে মশকরা মাথায় আগুন জ্বেলে দিয়েছে তার। সে অকারণেই তুলে নিল ঝাঁটা আর পরিষ্কার উঠোন ঝাড়ু দিতে থাকল ফের। ছর্ ছর্র্ শব্দের সঙ্গে সঙ্গে সে বকে চলল আপন মনে— হারামজাদা। ইদরিশভাই গান গাইছে! তোর বাপ গাইছে দ্যাখগে যা। তোর মাকে ফুঁড়ে গাইছে। 

সহসা তার মনে পড়ে যায় ময়না বৈষ্ণবীকে। এরকমই একদিন রাগ করে উঠোনে ঝাঁট দিচ্ছিল সে। আর ময়না বৈষ্ণবী এসেছিল। তার শেষ আসা। মন ভারী হয়ে গেল মাসুদার। ক্রোধ প্রশমিত হল। এক কোণে ঝাঁটা ফেলে দিয়ে দাওয়ার খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসল সে। তার মনে পড়ল, একদিন ময়না বৈষ্ণবী বলেছিল— আমি একখানি গান বেঁধেছি। শুনবে? 

মাসুদা খুশি হয়ে উঠেছিল— তুমি গান বেঁধেছ? তুমি? 

–হুঁ! বাঁধি তো। বাঁধি। ভুলে যাই। সে-সব রাধাকিষ্টের গান। এ-গান অন্যরকম। শুনবে?

–শোনাও। 

ময়না বৈষ্ণবী গেয়েছিল—

যিনি রাম তিনি রহিম 
তিনি সে ঈশ্বর। 
আল্লার নাম লয়ে করো 
ভুবন সফর! 
সফর করিলে মিলে 
পির নবি গুরু। 
তাঁহাদের নাম লয়ে 
নামগান শুরু ॥ 
বলো আল্লা হে আল্লা বলো 
হরি বলো হরি। 
তোমার চরণে প্রভু 
আমি যেন মরি ॥ 

সে অবাক হয়েছিল। বলেছিল— কী সুন্দর গান বেঁধেছ দিদি। 

ময়না বৈষ্ণবী হেসেছিল। বলেছিল যে আল্লা সে হরি। এ আমি বুঝেছি মাসুদা। তোমরা এক নামে ডাকো, আমরা আরেক নামে। তফাৎ কিছু নাই। 

চোখে জল এসে গেল মাসুদার। কীভাবে চলে গেল সে! কীভাবে মরে গেল! এভাবে যাবার কথা ছিল না তো তার! সে ছিল এক আশ্চর্য মানুষ। ঘুরে ঘুরে আসত। দুটি কথা বলে দু’দণ্ডের শান্তি দিয়ে যেত। আঁচলে চোখ মুছল মাসুদা। তখন হাঁক শুনল সে। উড়ান যাবে হে-এ-এ-এ-এ। সকল বসন্ত রো-ও-গ, সকল কলে-রা-আ, হামজ্ব-অ-র, উড়ান যাবে— এ-এ-এ। ঢোল বাজল সঙ্গে সঙ্গে। টিকিরি টিকিরি টিকিরি। কাটা তাক কাটা তাক। ধাঁই ধাঁই ধাঁই। সে দেখল, জিকির করতে এসেছে সাত-আটজন। প্রতি বছর আসে। জিকির করে রোগ তাড়িয়ে দিয়ে যায়। একজনের মাথায় লাল কাপড়ে মোড়া লৌহদণ্ড। তার ওপর ফুলের মালা। একজনের হাতে পাখা। একজন বহন করছে ভরা কলস। মন্ত্রপূত এই জল সে বিলোবে গৃহস্থের ঘরে। নিশিন্দার ডাল জলে চুবিয়ে ছড়িয়ে দিতে হবে উঠোনময়। রোগবালাই দূর হবে তা হলে। বিনিময়ে দু’-চার টাকা নেবে তারা। পুরনো শাড়ি কাপড় নেবে। বড়বাড়িতে চাইবে চাদর, চাল, নতুন শাড়ি। এরাও দাফালি। মাসুদার স্বজাতি। কিন্তু মাসুদারা মাগনবৃত্তি থেকে সরে এসেছে অনেককাল। 

দলটি মাসুদার গৃহের কাছে এসে থামল। একটি মেয়ে হাঁকল— ‘জল লিয়ে যাও গো বিবিরানি।’ উঠোনে লৌহদণ্ড নামাল তারা। পাখার বাতাস দিল চারদিকে। একজন মন্ত্রপূত ধুলো ছড়াল। মাসুদা একটি টাকা ও টোলখাওয়া পুরনো কাঁসার ঘটি নিয়ে এল জল নিতে। জল তারা দেবে দু’ফোঁটা। তার সঙ্গে অন্য জল মিশিয়ে ছিটিয়ে দিতে হবে। এবং একটি টাকা সে দিল বড় বেদনায়। তাদের ঘরে এক টাকাও বড় সম্বল। 

জল দিয়ে ঢোল বাজাতে বাজাতে এগিয়ে গেল দল। এখানে ওরা ছড়া কাটল না। একটি টাকা পেয়েছে। তার বিনিময়ে জল যে দিয়েছে এই ঢের। সে কলস থেকে ঘটিতে জল ঢেলে সেই জলের ছড়া দিতে থাকল। আর মনে মনে আওড়াল বহুবার শোনা ছড়া। 

ফাল্গুমাসের দিনে বসন্তের বাও, 
আগডাল ভরসা করি কোকিলায় কাড়ে রাও। 
হে কালো হে দিন নাই মনুরা ব্যাপারির
মহাজনের চিন্তার অখোন পারানি নায় থির।
বছর ঘুরিয়া আইল যাইবার পড়িল সারা,
হক্কলে চলিয়া যায় সঙ্গী যারা যারা!
কেউ উনা কেউ দুনা কেউ খালি নায়,
যার হইছে দোনা বেপার দইড়ে দাপড়ে যায়।
হক্কলের যাওয়া দেখি মনুরায় কান্দে,
হয় ঘড়ি মনোডর কোন খানেনি বান্দে। 

এ ছড়ার সঙ্গে মা শীতলার সংযোগ নেই। নেই কোনও জিকিরির সংযোগ। এ কেবল বর্ষশেষের মনোবেদনার গান। তার মা বলত, এ-ছড়ার ধ্বনিতে বসন্তের কু-হাওয়া পলায়। কেন-না বসন্তের নিজেরই আছে ব্যাকুল মনোবেদনা। সেই বেদনাই রোগ-মহামারী হয়ে ফুটে ওঠে জনপদে। সে বলে চলে 

কেউ যায় আস্তে ধীরে কেউ যায় লড়ে।
কেউ যায় বাদাম তুইলে, কেউ যায় দাড়ে,
কেউরুর বইঠার বাড়িয়ে দরিয়ার মুর লাড়ে।
কেউ কয় আল্লা আল্লা, কেউ কয় হরি
ফ্যালফ্যালাইয়া চাইয়া থাকে মনুরা ব্যাপারি।
হকল ব্যাপারি গ্যালা এক এক কইরা, 
মনুরা ব্যাপারি কান্দে নদীয়ার কূলে বইয়া ॥ 

তাম্রাভ হয়ে আসা ঘটিখানি মাজবে বলে কৌটোয় রাখা পাকা তেঁতুলের সন্ধান করল সে। পেল না। নিশ্চয়ই চুরি করে নিয়েছে ফরিদা। তেঁতুলের ওপর সাংঘাতিক লোভ মেয়ের। তা নিবি তো নে অল্প-স্বল্প নে। বেদে-বাড়ি থেকে চেয়ে-চিন্তে আনা পুরো ডেলাটাই নিয়ে গেছে। মাটি দিয়ে ঘটি মাজতে বসল সে। আজ ফিরুক, কষে মার লাগাবে। 

বাড়ির অদূরেই নদীর ঘাটে তাদের খেলা। স্তিমিত ভৈরবের পাড়ে কাদা-মাটি দিয়ে গড়া যায় বিপুল সংসার। জলে নেমে ধরা যায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাছের বাচ্চা। হাতের তেলোয় জলের সঙ্গে খাবলে ধরে তাদের। আবার ছেড়ে দেয়। নীলডানার মাছরাঙা এসে ছোঁ মারে জলে। তারা হাততালি দেয়। জল ছেটায় পরস্পরের গায়ে হাঁটু অবধি কাদা মাখা বালক-বালিকার দল। তাদের নিয়ে শঙ্কা নেই কোনও। কারণ পাড়ে সারাক্ষণই লোক। কাপড় কাচে কেউ। স্নান করে। 

অতখানি তেঁতুল একেবারে খেয়ে ফেলা সুসাধ্য ছিল না ফরিদার পক্ষে। সে ইজেরের ইলাসটিক সুতোর ভাঁজে রেখে দিয়েছিল সেগুলি। খাচ্ছিল অল্প অল্প করে। গায়ে জামা নেই। রুক্ষ চুল কাঁধ বেয়ে নেমে এসেছে বুকে। হাত-মুখ ময়লা ও তেঁতুলে চিটচিটে। দাপাদাপি করা বালক-বালিকাগুলির কাছে দাঁড়িয়ে মনোযোগী ছিল সে তেঁতুল চেটে খাওয়ায়। 

তহমিনা অনেকক্ষণ ধরে ঘুর ঘুর করছিল ফরিদার আশেপাশে। একটুখানি তেঁতুলের লোভে তার নোলা সকসক করছিল। এই নিয়ে প্রায় চোদ্দোবার বলল সে— দে না। ফরি, দে না এট্টু। ফরিদা নারাজ হয়ে আছে। তার সারাক্ষণের খিদে। তার নিত্যকার ভোজনলোভ। সেই তার পরমানন্দ। কোনওভাবে কিছু মুখে পুরে দিতে পারা। অতএব সে বার বার তহমিনার আবেদন নাকচ করে দিচ্ছে। 

— ইঃ। কেন দিব? তুই দিস আমারে কিছু? 

–এইবার থিকে দিব। ঠিক দিব দেখিস। 

–না। আমার লাগে না। 

–এট্টু দে না। এই দ্যাখ লোভ দিলাম। পেট ফুলবে তোর ফরি।

–ফুলুক। তোর কী! 

–লাখি খা। 

–তুই খা। 

অন্যরা মগ্ন খেলায়, আর তারা বিবাদে লিপ্ত। তহমিনা ছাড়বার পাত্রী নয় সহজে। বলে- আর লাখি দিব না তোকে। এট্টু দে ফরি। এই এট্টু। 

ফরিদা এবার কথার জবাব দিল না কোনও। তেঁতুলের ছড়া চাটতে চাটতে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে তহমিনার দিকে। তহমিনা ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইল তার ওপর। ইজেরের লুকোনো প্রকোষ্ঠ থেকে কেড়ে নিতে চাইল আত্মগোপনকারী তেঁতুল। ফরিদা ছুটল। দেবে না সে। দেবে না কিছুতেই। ও তো সব দেখিয়ে দেখিয়ে খায়। কোনও দিন দেয় কিছু? জলের ওপর দাঁড়িয়ে অবশিষ্ট তেঁতুল ইজের থেকে বার করে সে ছুড়ে দিল জলে। তহমিনা ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর— হারামজাদি! ফিক্কা ফালাইয়া দিলি, তাও আমারে দিলি না। দ্যাখ কেমুন লাগে। দ্যাখ দ্যাখ। 

চুলের মুঠি ধরে সে শুইয়ে দিল ফরিদাকে জলকাদায়, আর সর্বশক্তি দিয়ে তার মুখ ঠেসে ধরল জলে। পা ছুড়ছিল ফরিদা। হাত ছুড়ছিল। বাতাস পায় না গো। শিশু সে বাতাস পায় না। তার বুক ফাটে। পা দাপায়। হাত দাপায়। আর তহমিনা তার হাড়সর্বস্ব শরীরের চাপ ক্রমশ বাড়াচ্ছিল তার ওপর। তাকে মাথা তুলতে দিচ্ছিল না। 

বাচ্চারা নিজের খেলা ভুলে বিবদমান দুটি বোনের সামনে দাঁড়িয়ে লাফাচ্ছিল এতক্ষণ হাততালি দিচ্ছিল। পাড়ে স্নান করছিল যারা, নজর করল যখন, ছুটে এল চিৎকার করতে করতে— ছাড় ছাড়। মাইরা ফালাইল। মাইরা ফালাইল। 

ত্রস্ত হয়ে গেল তহমিনা। উঠে দাঁড়াল সে। বোকার মতো তাকাল চারপাশে। চিৎকার শুনে ছুটে এসেছে আরও অনেকে। কাছেই ছিল সমীরুদ্দিনের দলটি। তাদেরই কালুমিঞা এসে ঝাঁপিয়ে তুলল ফরিদার শরীর। কাদামাটি মাখা দেহটি শুইয়ে দিল পাড়ে। বুকের ওপর কান পাতল সে। নেই। স্পন্দন নেই। মরে গেছে ফরিদা। 

ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তহমিনা। পালিয়ে যাচ্ছে না। কেঁদে ফেলছে না। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কেবল। 

কেউ ছুটে গেল মাঠে ইদরিশকে খবর দিতে। কেউ গেল মাসুদার কাছে। কেউ গেল আমিনার বাড়ি। ওগো, দেখে যাওঁ গো, কী সর্বনাশ হল! কী সর্বনাশ! মেরে ফেলেছে মেয়েটাকে। খুন করে ফেলেছে। দৌড়ে আসছে আমিনা আর মাসুদা। দৌড়ে আসছে সারা গ্রাম। ইদরিশ আসছে। মাসুদা এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল কাদামাখা মেয়েটির ওপর। আর আমিনা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকল চিৎকার করে— কী করলি তহমিনা! এডা তুই কি করলি! 

এবার তহমিনা ফুঁসে উঠে বলল— আমারে তেঁতুল দিল না ক্যান? 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *