৩৫
কোথাও রয়েছ, জানি—তোমারে তবুও আমি ফেলেছি হারায়ে;
পথ চলি—ঢেউ ভেজে পায়ে;
রাতের বাতাস ভেসে আসে,
আকাশে আকাশে
নক্ষত্রের ’পরে
এই হাওয়া যেন হা-হা করে!
হু-হু ক’রে ওঠে অন্ধকার!
অবসাদ বোধ করছিল সে। আবেগ প্রশমিত হয়ে যাবার পর আসে এই অবসন্ন প্রহর। আর আবেগ, জোয়ারের মতো আসে। চলে যায়। ফের আসে। আসা আর যাওয়ার মধ্যে থাকে কিছু নিষ্ক্রিয় সময়। কিংবা অননুভূত সময়। কারণ গাঢ়ভাবে দেখলে, এ জগতে কোনও সময়ই নিষ্ক্রিয় নয়। গোপন ক্রিয়ায় সে যৌবনের মস্তকে প্রবেশ করিয়ে দেয় পক্ককেশ। বর্তমানকে লোলচর্ম করে অতীতে ঠেলে দেয়। প্রবল দেহে নিঃশব্দে মারা যায় লক্ষ লক্ষ কোষ এবং আকাশে ঝরে কত অজানিত বিদগ্ধ আলোকপিণ্ড।
মানুষ কেবলই আপনাতে নিমগ্ন, এইসব টের পায় না। পায় না, সে বরং ভাল। যদি বোঝা যেত, যদি মনে রাখা যেত, প্রতি মুহূর্তের ক্ষয়, যদি এই কথা ভেবে ফেলা হত প্রতিটি পদক্ষেপ যে, মানুষ জন্মায় আসলে মৃত্যুর জন্য—এবং শুধু মানুষই নয়, সকল জড় ও জীব, সমস্ত কণা কণা কণামাত্র প্রাণী, সবেরই ওই-ওই-ওই পরিণতি-তা হলে—হায়—কী দুঃসহ এ বেঁচে থাকা!
অতএব, নিষ্ক্রিয় সময়ের ভাবনা থাকা ভাল, অমৃতের বিশ্বাস থাকা ভাল, ভাল ছোট-ছোট স্বার্থবোধে জড়িয়ে-মরিয়ে থাকা। যেমন হারাধন যুবকটি। সে কলম হাতে নিয়ে বসে ছিল উদাস। অনুগ্রহে বড় হয়ে ওঠা মানুষ সে, সংশয়ে দ্রব। নিজের জীবন সে সাজাতে বসেছে এইবার। কিন্তু তার মধ্যে শর্তের শতেক কাটাকাটি। এর পরিণতি সে জানে না। কী হবে! দেহ সমর্পণ করবে বলে সে এক অনিশ্চিতকে করেছে আহ্বান। স্বামী-পরিত্যক্তা নারীর কন্যাকে সে গ্রহণ করতে চলেছে স্ত্রী হিসেবে। ঔদার্যময়, তবু অস্বাভাবিক এই সিদ্ধান্ত। তার নিজের পরিস্থিতিও কি অস্বাভাবিক নয়? পেতনির চরে তার শিকড় ভাসমান। গৃহে বাঁশের চাঁচ দ্বারা নির্মিত দেওয়াল ছিদ্রময়। সেইসব ছিদ্র দ্বারা নিরন্তর প্রবেশ করে নিরাপত্তাহীন অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। শীতল। হতোদ্যম। মৌসুমি নামের অনূঢ়া মেয়েটি মেলাবে কি ওখানে জীবন? সে তো বলেনি কিছুই। এখনও। সততার দায় তারও কিছু থাকে। যতই আপনার হোক, অসিত স্যারের বাড়ি সে দেখাতে পারে না নিজের বাড়ি বলে। লোকে তাতে খুঁজে পাবে মিথ্যাচার। প্রবঞ্চনা। হৃদয়ের নিরিখে নয়। সমাজ সম্পর্ক যাচাই করে সমাজের নিরিখেই। অতএব সে ধীর পায়ে নিখিলেশের কাছে গেল। বলল— কিছু কথা ছিল নিখিলেশদা।
নিখিলেশ তাকালেন তার দিকে। বললেন— বাইরে যাবি?
—হ্যাঁ। চলো।
তাদের দপ্তরে কোনও নির্জনতা নেই। গোটা এলাকাই এখানে ব্যস্ততম। মুখর। পুরনো এই এলাকা দোকান-পাট দ্বারা সবচেয়ে ঘিঞ্জি কিন্তু সমৃদ্ধ। জীবনযাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুই এখানে পাওয়া যায়। নিখিলেশ বললেন—চল, মহম্মদের দোকানে বসি। ওখানে ডিম-পাউরুটিও খেয়ে নেওয়া যাবে।
—চলো।
তাদের দপ্তর থেকে মহম্মদ খানের দোকান পর্যন্ত আসতে লাগে পাঁচ মিনিট। সেখানে তারা গেল এই কারণে, মহম্মদ খানের চা ভাল এবং অনেকক্ষণ বসে কথা বলা যায় ওখানে। কিছুদিন আগে কোনও দুষ্কৃতী মহম্মদ খানের চোখ উপড়ে নিয়েছিল। উপড়ানো চোখে আর দৃষ্টিশক্তি নেই। কিন্তু ক্ষত নিরাময় লাভ করছে। মহম্মদ খান এখনও রয়েছেন এক আতঙ্কের মধ্যে। সামান্য শব্দেও চমকে ওঠেন। রাত্রে দুঃস্বপ্ন দেখে চিৎকার করেন।
মহম্মদ খানের ছেলে ছিল দোকানে। নিখিলেশদা বললেন- তোমার বাবা ভাল আছেন তো বসির?
—হ্যাঁ বাবু! আপনাদের আশীর্বাদে ভাল আছেন। মাঝে মাঝে দোকানে আসার কথা বলেন এখন।
—বাঃ! খুব ভাল।
নিখিলেশ হারাধনের দিকে ফেরেন। বলেন— ওকে চিনিস? ও হল বসির খান। মুর্শিদাবাদের গাইড। নবাবি আমলের ইতিহাস ওর কণ্ঠস্থ।
বসির খান বিনীত হাসে। বলে-আপনাকে আমি চিনি।
—আমাকে?
—আপনি তো সিধুদার বন্ধু, না?
—হ্যাঁ। সিদ্ধার্থ আমার বন্ধু।
বসির খান হাতজোড় করল। বলল— ওঁর মতো লোক হয় না। বসুন। আপনারা বসুন। কী খাবেন? ঘুঘনি আছে। ডিম। টোস্ট। রুটি। আলুর দম।
নিখিলেশ বললেন- ডিমটোস্ট দাও দুটো। আর চা।
একটি টেবিলের কোণের দিকে বসল তারা। আর একটু পরেই ভিড় হতে শুরু করবে। খেতে আসবে কুলি, মজুর, বাবু, দোকানি। বসির খানের ঘুঘনি, আলুর দম শেষ হয়ে যাবে। হারাধন বসির খানকে দেখছিল। দীর্ঘদেহী সে। নির্মেদ সুন্দর স্বাস্থ্য। চোখ-মুখ নিখুঁত। মাথার চুল টেনে বাঁধা। বাঁধন ছাড়া হলে কাঁধ ছাড়িয়ে তা নেমে আসবে ঘন ও দিঘল! হাসলে বসির খান সুন্দরতর। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল একবার। ঈশ্বর এক-একজনের মধ্যে অবহেলায় অতুল রূপ ভরেন।
নিখিলেশ বললেন —তুই খুব জরুরি কিছু বলতে চাস মনে হচ্ছে।
হারাধনের রূপের ঘোর ভাঙল না তবু। তার মনে হল রেজাউল সুপুরুষ, মোহনলাল অসম্ভব সুদর্শন, শুধু সে কেন এমন! কদাকার নয়। কিন্তু অতি সাধারণের কুশ্রীতা। সিদ্ধার্থর কথা মনে পড়ল তার। কী বলা যায় সিদ্ধার্থকে? সুন্দর? বিশ্রী? সাধারণ? না। এর কোনওটাই সে নয়। সে আকর্ষণীয়। কী সেই আকর্ষণ তা পৃথক করে বলা যাবে না। সে এটুকু বলতে পারে, রূপবান রেজাউল, মোহনলাল, বসির খানের মধ্যে এই আকর্ষণ নেই।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে নিখিলেশ ফের বললেন—এত গভীরভাবে কী ভাবছিস? কী বলবি তুই? বলবি এখন?
—হ্যাঁ।
–কী? মত পালটেছিস?
—কীসের?
সে টের পেল, নিখিলেশ এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না তার সিদ্ধান্ত। কিংবা সকল বিশ্বাসের অন্তরালেই থাকে অবিশ্বাসের প্রস্তুতি। সে নিখিলেশকে দোষ দিতে পারল না। সে তো নিজেও অনিশ্চিত। তাদের দারিদ্রের সংবাদে নিখিলেশ পিছিয়ে যেতে পারেন।
নিখিলেশ বললেন—তুই বল কী বলবি!
সে বলল— নিখিলেশদা। আমার মনে হয় আমাদের পারিবারিক অবস্থার বিষয়ে সব খুলে বলা উচিত। কারণ এটা সারা জীবনের ব্যাপার।
—কী বলবি? বল।
সে তখন, থেমে থেমে বলতে থাকল তার পারিবারিক অবস্থার কথা। তার নারান মুদি বাপ। আলতা মা। প্রায় বেকার ভাইগুলি এবং অবিবাহিতা বোনটির কথা। এবং একথা জানাতেও ভুলল না সে বিবাহের পর স্ত্রীকে নিয়ে পেতনির চরে বসবাস করবে না এমনই সংকল্প তার। সকল বক্তব্যের শেষে সে বলল— অনেকের অনুগ্রহ পেয়েছি। না হলে আমার পড়া হত না। কিন্তু অসিত স্যার ও তাঁর স্ত্রীর কাছে আমি ঋণী। তাঁদের মা-বাবা বলেই জানি আমি। মা-বাবা বলেই ডাকি। তাঁরা আমার পরমাত্মীয়।
নিখিলেশ এতক্ষণ একটি কথাও বলেননি। হারাধনের বলা শেষ হলে তিনি একবার কাশলেন। বললেন—দ্যাখ, আমি তোকে দেখেই এই সম্বন্ধ এনেছিলাম। তোর পরিবার দেখে নয়। ভবিষ্যতে অনেক উন্নতির পথ তোর সামনে খোলা আছে। তোকে দেখে আমার অসৎ বা কান্ডজ্ঞানহীন মনে হয়নি। বিবাহ মানে আজকাল আর বৃহৎ পরিবার গণ্য নয়। একজন পুরুষ এবং নারী তারা সহবাস করবে এবং নিজের জীবন গড়ে তুলবে। ব্যস! ফুরিয়ে গেল। তা ছাড়া, পরিবারের বিচার করতে বসলে আমারই বা মুখ থাকে কী করে!
—তবু, আমি তো অনুগ্রহে বড় হওয়া ছেলে। বন্ধুদের প্যান্ট-জামা-বই, স্যারেদের দেওয়া জ্ঞান এবং পরীক্ষার ফিজ, আশ্রয়…এই সব নিয়ে আমি।
—হারাধন, এই পৃথিবীটা নোংরা হয়ে গেছে, অসততায় ভরে গেছে, কুটিল ও নিশ্ছিদ্র স্বার্থপরতায় ঢেকে গেছে আকাশ। তবু জীবন থেমে থাকেনি। থাকবে না। কারণ কী জানিস?
–কী?
—কারণ মানুষ শেষ পর্যন্ত ভালবাসতে চায়। তোর পাওয়া সব অনুগ্রহ এই ভালবাসার প্রকাশ। তুই দরিদ্র ছিলি, কিন্তু তোর পাওয়া সম্পদের তুলনা নেই।
হারাধন বলল— কিন্তু আমার তো পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতা আছে। একসঙ্গে না থাকলেও আমাকে সাহায্য করতে হবে।
—সে তো করবিই। আর পরিবারের প্রতি তোর দায়িত্ববোধ আমাকে মৌয়ের বিষয়ে আরও নিশ্চিন্ত করবে। দ্যাখ, মানুদি আর মৌকে আমরা, ওর মামা মেসোরাই দেখেশুনে রেখেছি এতকাল। অভিভাবক হিসেবে তোর পারিবারিক অবস্থার জন্য আমার কোনও আপত্তি নেই। আর পৈতৃক অবস্থাই যদি আমাদের বিবেচ্য হয় তবে তোকে কী করে বলব মৌকে বিয়ে করার জন্য? ওই দারিদ্র্য তুই নিজেই একদিন ঘুচিয়ে দিতে পারবি। কিন্তু মৌ? তুই যে সব জেনে-শুনে ওকে বিয়ে করেছিস তার জন্যই আমরা তোর কাছে ঋণী।
—ওর কোনও আপত্তি হবে না তো?
—কার? মৌয়ের? না। ও খুব ভাল মেয়ে। আমরা ওর জন্য যা করব, ও তাই-ই মেনে নেবে। আমার শুধু একটাই অনুরোধ, মেয়েটাকে সুখে রাখিস। আমাদের মতো সংসারে অভাব-অভিযোগ থাকেই। তাতে কী? মনের শান্তিই আসল।
—কিন্তু, কিন্তু আমার অবস্থা তো বললাম। বিয়ের আচার-অনুষ্ঠান করার ক্ষমতাই আমার নেই। তা ছাড়া আমি ওগুলো চাই-ও না। আমি, মানে রেজিস্ট্রি বিয়ে করতে চাই।
—বিয়ের অনুষ্ঠান করার অসুবিধে তো আমাদেরও আছে। পাত্রীর বাবার উপস্থিতি সেখানে দরকার হবে।
—হ্যাঁ, আমি চাই না কোনও কথা আমার তরফে কেউ জানুক।
—হ্যাঁ,
—তুই না চাইলে কেউ জানবে না। কিন্তু পরে যদি জানাজানি হয়?
—সে পরে দেখা যাবে।
—কিন্তু এ তো মিথ্যাচার হয়। অন্তত তোর বাবা-মাকে জানানো দরকার।
—জেনে ওঁরা যদি আমাকে পিছিয়ে যেতে বাধ্য করেন? নিখিলেশদা? এভাবে বার-বার মেয়েটির সমস্ত ইতিহাস আপনারা কতবার বলবেন? আজ আমি, কাল আরেকজন, পরশু অন্য আরেক। সিধু একটা কথা বলে…
—সিধু? সি পি এম করে?
—হ্যাঁ। ও-ই। ও বলে, ‘যে-সিদ্ধান্ত আমি নিজের তাগিদে নিয়ে থাকি, কারওকে প্রভাবিত করার জন্য নয়, খুশি করার জন্য নয়, যে-সিদ্ধান্ত কেবল আমার ইচ্ছার ফসল, তা কখনও ভুল হতে পারে না। তার জন্য বহু কঠিন পরিণতির মধ্যে দিয়ে যেতে হতে পারে। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত নেবার স্বাধীনতা অমূল্য। তাকে স্বীকার করতেই হবে।’
—বাঃ!
—সিধু অনেক বৃহৎ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেয়। নেবে। কিন্তু আমার জীবনেও ওর এই কথাগুলোর গুরুত্ব আছে। আপনাদের মিথ্যাচার নেই কারণ আপনারা আমাকে সব বলেছেন। এবং আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
এরপর নিখিলেশ যে-চোখে তাকিয়েছিলেন হারাধনের দিকে, সেই চোখের ভাষা হারাধনকে তৃপ্ত করেছিল। নিজেকে হঠাৎ ভাল লাগছিল তার।
সে তার ইচ্ছাশক্তি দ্বারাই যেন চালিত করছে সবকিছু। নতুন কলোনির দিকে শস্তায় একটি বাড়ি ভাড়া নিয়েছে। নিখিলেশই বাড়ির ব্যবস্থা করেছেন। প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র দ্বারা তাঁরাই ব্যবস্থিত করেছেন ঘর। খাট, আলমারি, খাবার টেবিল, বেতের চেয়ার ও আয়নায় ঘর ভরা। মৌসুমি কিনে এনেছেন বাসনপত্র। তোয়ালে। প্রসাধনী। উৎসাহী হাতে তিনি গুছিয়ে দিচ্ছেন হারাধনের সংসার। রান্নাঘরে চাল, ডাল, চিনি, নুন, বিবিধ মশলা অবধি এনে রেখেছেন। নতুন বউ আসবে, আর যেমন সুইচ টিপলেই যন্ত্রাদি চলা শুরু করে, তেমনি করে চালিয়ে নেবে সংসার।
বিয়ের ঠিক তিনদিন আগে অনুঢ়ান্নের আয়োজন করলেন মৌসুমি। এর মধ্যে হারাধন যতবার তাঁর কোলে মুখ ডুবিয়ে দিয়েছে, ততবার তিনি কাঠ হয়ে গেছেন। কাছে টানেননি তাকে। সে বিস্ময়াহত চোখে তাকিয়েছে। কোনও কোনও সন্ধ্যায় আসেনি অভিমান করে। কোনও দিন বলেছে—আমি কী করেছি? আমাকে আদর করছ না কেন মা? কাছে টানছ না কেন?
তিনি বলেছেন—এখন আর মায়ের আদর খাওয়া ভাল নয় হারাধন। এখন তোমার বউ আসবে।
—তার জন্য তুমি আমাকে সরিয়ে দেবে কেন? বিয়ে তো তুমিই আমাকে করতে বলেছ।
—তুই এখন যা হারাধন, আমি পারছি না আর। ভাল লাগছে না।
চোখে জল এসে গেছে তার। সে ফিরে গেছে। আবার এসেছে। আবার ফিরে গেছে। আজ সে আসবে। সারা বিকেল মৌসুমি তার জন্য প্রিয় পদগুলি রান্না করেছেন। রান্না করতে করতে বুকের তলায় ব্যথার মোচড় টের পেয়েছেন তিনি। ভেবেছেন— সে তো আমার। আমার চিরকালের। কিন্তু বউ এসে গেলে তাকে তো আর সম্পূর্ণ পাব না আমি। কোনও অধিকারই থাকবে না যেমন আছে এখন। তবু এই ভাল। এতেই কল্যাণ। আত্মীয়-স্বজন বড় চোখ ঠারে। এমনকী আমারও যে কখনও কখনও কেমন এক ভয়…
.
এখন তিনি বসে আছেন। অপেক্ষা করছেন। সে আসবে। এসে কোলে মুখ গুঁজে দেবে। তিনি কী করবেন তখন? ফাল্গুনের হাওয়া লাগছে গায়ে। ত্বক জ্বালা করছে। আঃ! এই জ্বালা কী রকম পাগল-পাগল করে দেয়। সে যে বিবাহ করছে, তা কি ভাল নয়? ভাল ভাল। এই ভাল। বাঁধের ফাটল দিয়ে ঢুকে পড়েছে ধারাজল। এ ছাড়া, প্লাবন রোধ করার কী-ই বা পথ ছিল!
অসিত চলে গেছেন দাবা খেলতে। যাবেনই। যেতেই হয় ওঁকে। মৌসুমির মনে হয়, ওই সাদা-কালো ছক আর ঘুঁটিগুলির জন্য অসিত জীবন ধারণ করে আছেন। তাঁর নিজের ছক কেবল সাদায় সাদা। তাঁর ঘুঁটি, বহুকাল ছিলেন তিনি নিজে। এখন তাঁরা দু’জন। সে আর তিনি। এবং সে। সে। সে। সে তাঁর অস্তিত্বময়।
দরজাঘণ্টি বাজল। সে এসেছে। এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালেন তিনি। আঃ! কোমরে টান লাগল। আঃ! এই উপসর্গগুলি শুরু হয়েছে ইদানীং। জানুসন্ধিতে, কোমরে ব্যথার টান। চিবুকের তলায় অতি সন্তর্পণে মুখ তোলে চার-পাঁচটি চুল। তিনি তুলে ফেলেন। চিবুক ও কণ্ঠের মধ্যে নতুনতর ভাঁজ, এক দ্বিতীয় চিবুক। গোপনে রুপোলি হয়ে উঠছে কেশরাশি। আয়নার কাছে দাঁড়ালে মুখে কয়েকটি অনিবার্য আঁচড়। সেদিন এমনকী স্নানঘরে, নিজেকে ঘষে— মেজে পরিচ্ছন্ন করার সময় হাতে উঠে এল সাদা যৌনকেশ। যেন বিপক্ষীয় সৈন্য-সামন্ত সব এই যুদ্ধে তিনি পিছু হঠছেন। হেরে যাচ্ছেন ক্রমশ।
তবু, থেকে যেতে ইচ্ছে হয়। জয়লাভ করতে ইচ্ছে হয়। কোনও পথ নেই?
তিনি দরজা খুললেন। সে দাঁড়িয়ে আছে। বিষণ্ন। গম্ভীর। তিনি সরে দাঁড়ালেন। সে ঘরে এল। ওঃ! দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে ফাল্গুনের বাতাস এভাবে ঝাঁপ দিল কেন? শরীর স্পর্শ করল কেন? জাগিয়ে তুলল কেন?
তিনি দরজা বন্ধ করলেন। সে চেয়ারে বসেছে। দু’হাত জড়ো করে তার ওপর রাখা মুখ। চোখ বন্ধ। তিনি দেখছেন। চওড়া কাঁধ। পুরু ঠোঁট। উঁচু কপাল। দু’দিন দাড়ি কাটেনি সে। সে একজন পুরুষ। যুবক। যুবাপুরুষ। দারুণ কিছু আকর্ষণীয় নয়। বরং সাদামাটা। তবু কী অমোঘ আকর্ষণ!
তিনি মেঝেতে বসলেন। যেমন হারাধন বসে অন্যদিন। কোমরে তীক্ষ্ম হয়ে লাগছে যন্ত্রণা। হাঁটুতে লাগছে। কবরীর অন্তরালে কোথাও দংশাচ্ছে পাকাচুল। খেয়ালখুশিমতো বসা, ওঠা, হাঁটার ছন্দ—সব হয়ে যাচ্ছে পরাধীন। হায়! এ কী পরাজয়! এ কী হার! কিছুই হল না যে কিছুই পাওয়া গেল না যে। হারাধন, হারাধন, আমার সকল অপূর্ণতা তুই পূর্ণ করে দিস…! তিনি হারাধনের কোলে মুখ গুঁজে দিচ্ছেন, যেমন সে দেয় রোজ। আর সে চমকে উঠছে। সাপটে নিচ্ছে মায়ের মুখ—মা, মা, মা। ওঠো। লক্ষ্মী মা আমার, ওঠো।
সে জড়িয়ে ধরছে মাকে। তুলে নিচ্ছে। শুইয়ে দিচ্ছে বিছানায়। মৌসুমি বলছেন—আমাকে ছেড়ে যাবি না তো হারাধন? বল। বল আমাকে!
—তোমাকে ছেড়ে কোথায় যাব মা? তা হলে তো মরে যেতে হয় আমাকে
—না না না।
মৌসুমি বুকে জড়িয়ে নিচ্ছেন হারাধনের তপ্ত মুখ। হারাধন মুখ ঘষছে। বলছে—মা, ওমা, ওমা…!