রাজপাট – ৩৪

৩৪ 

তোমার নিকট থেকে সর্বদাই বিদায়ের কথা ছিল
সবচেয়ে আগে; জানি আমি। 
সে-দিনও তোমার সাথে মুখ-চেনা হয় নাই। 
তুমি যে এ-পৃথিবীতে রয়ে গেছো 
আমাকে বলেনি কেউ। 

.

তৃষ্ণা সত্ত্বেও সে প্রতীক্ষা করেছিল। যদি বিবাহের আদেশ খামখেয়াল হয় মৌসুমির, যদি তিনি ভুলে যান বা প্রত্যাহার করেন। কিন্তু সে হয়নি। মৌসুমি অনড়। উন্মত্ত আবেগে ভেসে যেতে যেতে এবং চূড়ান্ত উৎকর্ষে পৌঁছবার মুহূর্তে সংযতাপ্রবাহিনী হয়ে প্রতিদিন বলছেন তাকে— তুই বিয়ে কর। তাড়াতাড়ি বিয়ে কর। 

সে পাত্রী খুঁজছে তাই। কীভাবে খুঁজবে, কী করে খুঁজতে হয়, সে জানে না। এখানে তার বন্ধু সিদ্ধার্থ। তারও এসব বিষয়ে কোনও ধারণা নেই। সে অতএব, তার বয়ঃজ্যেষ্ঠ সহকর্মী নিখিলেশকেই বলল একদিন—বাড়ি থেকে চাপ দিচ্ছে খুব বিয়ের জন্য। 

নিখিলেশ অবাক। বললেন— এখনই? মাত্র তো তিন মাস হল যোগ দিয়েছিস। 

সে বলল—একা থাকি তো। বাবা-মা’র ইচ্ছে নয়। 

আবারও প্রত্যুৎপন্নমতি হয়ে উঠল সে। সত্যের সম্পূর্ণ বিপরীত বিবৃতি কোনও প্রস্তুতি ছাড়াই দিয়ে ফেলল। 

নিখিলেশ বললেন—তা কেমন পাত্রী চাও? 

সে হাসল। বলল—এমনভাবে বলছেন নিখিলেশদা যেন নানারকম পাত্রী আপনার তৈরি আছে। 

—তা তো আছেই। অনেক না হোক, একজন আছে। তাকে তোমার অপছন্দও হবে না। কিন্তু আগে জানতে হবে তুমি কী চাও। 

—কী চাই আমি নিজেও তো জানি না। তবে বাড়িতে স্বজাতি না হলে আপত্তি করবে। 

—জাতে মিলবে। আর? 

—আর কী! একটু শিক্ষিত, মানে….

—গ্র্যাজুয়েট চলবে? 

–চলবে। 

—তা হলে দিন ঠিক করো। দেখতে নিয়ে যাব। 

—কোথায়? 

—ধুলিয়ান। 

—বেশ। কবে যাবেন বলুন। 

—তুমি বলো। এসব বিষয়ে পাত্রপক্ষের অগ্রাধিকার। সঙ্গে মা-বাবা-ভাই-বোন কাকে নিয়ে যাবি, বলিস। 

—আরে ধুর। কী যে বলেন! আপনি বলুন নিখিলেশদা। যে-কোনও দিন যাব আমি। একাই যাব। 

নিখিলেশদা বললেন— সে কী রে! এরকম তো দস্তুর নয়! দস্তুরমতো প্রথমে আসবেন পাত্রের বাবা, মা, কাকা। পরের কিস্তিতে মামা, মামি, বোন। তার পরের কিস্তিতে দিদি-জামাইবাবু, দাদা-বউদি। এতগুলো কিস্তি পার হলে শেষবার পাত্র একবার আসতে চাইবে বন্ধুদের নিয়ে। এখানেই কিস্তিমাত পর্ব! 

হারাধন হাসছিল। এবার বলল— না, না। আমাদের বাড়িতে সেরকম কিছু নেই। আমার পছন্দই সবার পছন্দ হবে। 

নিখিলেশদা খুশি। বললেন— ভালই বলতে হবে। 

দপ্তরে নিখিলেশদা জনপ্রিয়। উৎসাহী এবং বন্ধুবৎসল মানুষ তিনি। যে-কথা নিখিলেশদাকে বলতে পেরেছে সে, সে-কথা এত সহজে অন্য কারওকে বলতে পারত না। নিজের জন্য পাত্রী দেখার কথা বলা সহজ নয়। এমনকী এই এক বছর আগেও সে কখনও ভাবেনি বিবাহ ইত্যাদি বিষয়ে সে উদ্যোগী হবে। এখন রীতিমতো ভাবনা-চিন্তা করছে। করছে কারণ মৌসুমিকে সে মান্য করছে মাত্র। যদিও নিজের কাছে এ আড়াল আর নেই যে, সে চায় এক সম্পূর্ণ নারী। সে শরীরীভাবে চায়। আর কিছু নয়। এই আকাঙ্ক্ষা সে এমনকী পূর্ণ করতে পারত কোনও বেশ্যালয়ে গিয়েও। কিন্তু সেখানে যাবার সাহস তার নেই। প্রবৃত্তি নেই, তা সে জোর দিয়ে বলতে পারছে না। বর্ধমানে থাকাকালীন তার বন্ধুদের অনেকেই নিয়মিত বেশ্যালয়ে যেত। যাবার গভীর তাড়না থাকলেও তার একমাত্র বাধা ছিল সাহস। সে নীলছবি দেখেছে এবং দেখে হস্তমৈথুন করেছে, যৌনপত্রিকা দেখে চোখ ফেরাতে পারেনি, কিন্তু সে তবু এক সম্পূর্ণ পুরুষ হওয়ার জন্য প্রতীক্ষা করছে বিবাহের। 

সে মৌসুমি-মাকে কখনও বলেনি সে দেখেছে নীলছবি বা যৌনপ্রক্রিয়া। বলেনি কেন-না যৌনতা বিষয়ে কোনও কথাই তাদের হয় না। শুধু মাকে জড়িয়ে গভীর আশ্লেষে পড়ে থাকার সময় তার ইচ্ছে হয়েছে নগ্ন পিঠ দেখার। নগ্ন জানু জঙ্ঘা যোনি শ্রোণী দেখার। সেইসব ইচ্ছে সে প্রকাশ করেনি। ঠেলে দিয়েছে ভিতরে। ইদানীং সে প্রত্যহ উন্মুক্ত করছিল মায়ের বুক এবং বৃত্তে ঠোঁট রেখেও অতৃপ্ত হয়ে থাকছিল পূর্বাপর। গত সপ্তাহে মা তাকে জামা খুলতে দেননি। কেন সে বোঝেনি। সে তার সকল চাঞ্চল্য সমেত শুধু ছুটে ছুটে গেছে। মা তাকে টানেন এবং ঠেলে দেন। চরম উন্মত্ত করে বেঁধে ফেলেন শাসনে। সে মায়ের দ্বারা পীড়িত হয়, শাস্তিও লাভ করে। অর্ধ-উন্মোচিত তাদের এ সম্পর্কের সমূহ উদ্দামতা তাকে ক্রমশ ঠেলে দিচ্ছে বিবাহ- পরিণতির দিকে। সে সম্মোহিতের মতো মৌসুমি-মায়ের শর্ত পালন করছে কোনও পরিণতি না জেনেই। কিংবা, হতে পারে, মৌসুমির আদেশকে আশ্রয় করে আছে তারই উন্মাদ জৈব তাড়না! 

কাল শনিবার। অর্ধেক দিনের কাজ। ছুটির পর সে নিখিলেশের সঙ্গে পাত্রী দেখতে যাবে। সে কাজ করছিল। নিখিলেশ সামনে এসে বললেন—কাজ শেষ হলেই পালিয়ো না। কথা আছে। 

সে থেকে গেল তাই ছুটির পরেও। তাদের কাজ কখনও ফুরোয় না। যদি সারাদিন সারারাত জেগে কাজ করা যায় তবুও ফুরোয় না কোনও দিন। সে দেখল একটি একটি করে খালি হয়ে যাচ্ছে চেয়ার। সে একা হয়ে গেল যখন, নিখিলেশ এলেন। বললেন—তোর সঙ্গে একটা জরুরি কথা আছে। মানে ভেবেছিলাম পরে বলব। কিন্তু আমার শ্যালিকা অর্থাৎ মেয়ের মা… 

—তোমার শ্যালিকা? 

–হুঁ! আমার স্ত্রীর পিসতুতো দিদি হলেন পাত্রীর মা। তা তিনি বললেন সব জানিয়ে তবেই পাত্রী দেখানো দরকার। 

নিখিলেশ সিগারেট ধরালেন। ধোঁয়া ছাড়লেন লম্বা করে। ভ্রূ কোঁচকানো। বড় বড় দুটি চিন্তামগ্ন চোখ। পুরো মাথায় কেশবিচ্ছেদ ঘটেছে তবু নিখিলেশকে দেখায় আকর্ষণীয়। হারাধন অপেক্ষা করছিল। সে বুঝতে পারছিল না কী এমন কথা হতে পারে। তখন নিখিলেশ বললেন—হারাধন, যা বলার পরিষ্কার বলে নেওয়া ভাল। আমার শ্যালিকা মানুদি স্বামী-পরিত্যক্তা। 

নিখিলেশের দিকে অপলক তাকিয়েছিল হারাধন। কী বলতে হয় এ ক্ষেত্রে, সে বুঝতে পারছিল না। একটু থেমে নিখিলেশ আবার শুরু করলেন—মানুদি প্রাইমারি স্কুলে পড়ান। কষ্ট করে মেয়েকে মানুষ করেছেন। কিন্তু একটা লোকের অন্যায়ের বোঝা এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন। কোনও কিছু গোপন করে মেয়ের সম্বন্ধ করতে উনি রাজি নন। 

হারাধন চুপ করে বসে রইল কিছুক্ষণ। সে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছিল না। সে কি না বলে দেবে? সে নিখিলেশের মুখের দিকে তাকাল। নিখিলেশ তীব্রভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। তার মুখে না এল না। না তো পরেও বলা যায়। বলা যায় পাত্রী পছন্দ হয়নি। কিন্তু এই মুহূর্তে না বলে দিলে যে ভীরুতা, যে অনৌদার্য প্রকাশ পাবে, তাতে তার মাথা নত হয়ে যাবে নিখিলেশদার কাছে। যে-নারীকে স্বামী পরিত্যাগ করেছে, সে-নারী কষ্ট করে সন্তানকে লালন-পালন করেছেন, তিনি মহীয়সী। তাঁর দোষ কোথায়? সে বলল—কাল যখন যাব বলেছি, যাই। 

নিখিলেশ সিগারেট ফেললেন মেঝেয়। পা দিয়ে ডলে বললেন—বেশ। তুমি সিদ্ধান্ত নিতে সময় নাও। সেটাই ভাল। 

বেরিয়ে এল তারা। নিখিলেশ চলে গেলেন। সে এলোমেলো হাঁটল কিছুক্ষণ। আজ সে মায়ের কাছে যাবে না। অতিথি এসেছে সেখানে। যদিও ও-বাড়ির আত্মীয়স্বজনের কাছে সে পরিচিত, তবু মাকে একান্তে না পেলে তার মন খারাপ হয়ে যায় বলে সে যাওয়া স্থগিত রাখছে। অথচ নিখিলেশদার কথাগুলো নিয়ে মায়ের সঙ্গে আলোচনা করতে পারলে ভাল হত। সিদ্ধার্থের কথাও মনে হল তার। কিন্তু সিদ্ধার্থ ব্যস্ত হয়ে উঠেছে এখন। নির্বাচন এগিয়ে আসছে। সে অতএব একা একাই লালদিঘির পাড়ে একটি বেঞ্চে এসে বসল। নতুন করে উল্টে-পাল্টে দেখল কিছুক্ষণ আগেকার ভাবনা। তখনকার ভাবনা ছিল তাৎক্ষণিক। জলের তলা হতে উঠে আসা বুদ্বুদেরই মতো। এখন ভাবনাটি হাতে নিয়ে সে নেড়ে চেড়ে দেখতে চাইল। 

নিখিলেশের মানুদি স্বামী-পরিত্যক্তা। একজন স্বামী-পরিত্যক্তা মহিলার মেয়েকে বিয়ে করা অনৈতিক নয়। বরং ঔদার্যের সঙ্গেই তা করা উচিত। কিন্তু এ-ধরনের পারিবারিক জটিলতার মধ্যে জেনেশুনে ঢুকে পড়ার মধ্যে মূর্খামিও আছে। সে কি এতখানি মূর্খামি করবে? সে বিবাহের সম্বন্ধ তৈরি করছে। সেই সম্বন্ধ নিটোল হওয়াই বাঞ্ছনীয়। আজ যদি সে হত কোনও স্বামী-পরিত্যক্তার সন্তান, তা হলে কি নিখিলেশদা তার সঙ্গে আত্মীয়ার বিবাহ দিতে চাইতেন? তা ছাড়া, সে ভাবতে থাকে, ওই মানুদিকে তাঁর স্বামী কেন ছেড়ে দিয়েছিলেন তা সে জানে না। সৌজন্যবশত সে নিখিলেশদাকে এ প্রশ্ন করতেও পারবে না কখনও। সে যদি ধরেও নেয়, ভদ্রলোকই অপরাধী, তবু, তাঁদের কন্যাটিকে গ্রহণ করতে সে বাধ্য থাকে না। 

সে নিজের ভিতরকার অনুদারতাকে অনায়াসে প্রশ্রয় দিয়ে ফেলে। কিন্তু ভাবতে ভাবতে তার মনে হয়, মাকে নিখিলেশদার দিদির কথা বলা তার উচিত হবে না। সে শুধু বিবাহেছু বলেই একটি পরিবারের গোপন যন্ত্রণার কথা জেনে ফেলেছে। যেহেতু সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ওই মেয়েটির সঙ্গে সম্বন্ধ না-ই ঘটাবার, সেহেতু সে কোনও আলোচনার সুযোগই রাখতে চাইল না। স্থির করল, নিখিলেশের সঙ্গে যাবে সে এবং ফিরে এসে জানাবে, পাত্রী পছন্দ হয়নি। হয়তো নিখিলেশও এমনই প্রত্যাশা করছেন। 

সে তার মেসে ফিরে আসে এবং রাত্রি বইয়ে দেয়। সকালে কোনও অতিরিক্ত পারিপাট্যের মধ্যে গেল না সে। যেখানে সে অসম্মতই হবে, সেখানে বিশেষ আয়োজন বাহুল্য মাত্র। অতএব দাড়ি কাটল না, ধোপদুরস্ত হল না, অন্যান্য দিনের মতোই বেরিয়ে এল। বেরিয়ে একটিবার মায়ের কাছে যাবার জন্য অস্থির হল মন। কখনও কখনও এই অস্থিরতা অপ্রতিরোধ্য হয়ে যায়। একটি রিকশা নিল সে। মায়ের বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে তৃষ্ণার্ত চোখে দেখল বাড়িটিকে। কিন্তু ভিতরে গেল না। রিকশা ঘুরিয়ে চলে গেল কর্মক্ষেত্রে। 

ছুটি হওয়ার একটু আগে-আগেই বেরিয়ে পড়ল তারা। এবং ধুলিয়ানে মানুদির বাড়ি পৌঁছতে বিকেল গড়িয়ে গেল। ছোট স্যাঁতসেঁতে পুরনো বাড়ি। তবু, হারাধনের মনে হল, তার পেতনির চরের বাড়ি থেকে তো ভাল। অনেক সমৃদ্ধ। অন্তত দেওয়াল ইটের। ছাতে ঢালাই। তাদের বাঁশের বেড়ার বাড়িতে থাকা বাবা-মা এই বাড়ি পেলেই ধন্য হয়ে যেত। সে নিখিলেশের সঙ্গে বারান্দায় দাঁড়াল। দরজা খুলে দিলেন যে-ভদ্রমহিলা তাঁর পরিধানে চওড়া সবুজ পাড়ের সাদাখোল তাঁতের শাড়ি। চোখে চশমা। গড়ন সামান্য ভারীর দিকে। হারাধন দেখল, তাঁর সিঁথির কোনায় সামান্য নির্লিপ্ত সিঁদুর। 

ভদ্রমহিলা অভ্যর্থনা জানাতে তারা ঘরে এল। সাদামাটা একখানি ঘর। তাতে দুটি কাঠের চেয়ার, একখানি টেবিল। কোণের দিকে নিচু টেবিলে একটি টেলিভিশন সেট। ছোট। এবং একপ্রান্তে একটি ছোট শয্যা পাতা। সাধারণ কিন্তু পরিপাটি ঘর। এবং এই ভদ্রমহিলাই মানুদি। নিখিলেশ পরিচয় করিয়ে দেবার পর জানতে পারল সে। প্রণাম করল। এবার ঘরে এলেন আরও তিনজন। একজন বৃদ্ধা। তিনি মানুদির মা। এবং আর দু’জন মানুদির দাদা ও বউদি। 

এতজনের উপস্থিতি আশা করেনি হারাধন। যদিও কেন আশা করেনি তা-ও তার কাছে স্পষ্ট নয়। সে কি ভেবেছিল মা ও মেয়েই থাকবে শুধু, তাদের জীবনযাত্রার মতোই নির্বান্ধব? তার ভুল হয়েছিল। এখন বুঝতে পারছে সে। পাত্রী দেখাবার আয়োজনে আত্মীয়-পরিজনের উপস্থিতি অনেক বেশি যুক্তিসঙ্গত। সে কিছু স্নায়ুদুর্বল হল। কিছু বিপন্ন। গোপন অসম্মতি নিয়ে সে এসেছিল। সেই অসম্মতি লজ্জিত করছে তাকে। 

নিখিলেশ কথা বলছিলেন। সে চুপ করে ছিল। টুকিটাকি প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিল মাঝে-মধ্যে। নিখিলেশদা বললেন-দিদি, আমাদের ফিরতে হবে কিন্তু। 

—হ্যাঁ, হ্যাঁ এই তো। 

ব্যস্ত পায়ে ভেতরে গেলেন মহিলারা। সে টের পেল তার হৃৎস্পন্দন দ্রুততর হয়ে উঠেছে। করতল স্বেদযুক্ত। গলা শুকিয়ে উঠছে। মনে মনে খারিজ করে দেওয়া একটি মেয়েকে দেখতে এসে, যাকে দেখেনি তারই সন্দর্শন-সম্ভাবনায় স্বাভাবিকের চেয়ে অধিকতর স্নায়ুদৌর্বল্য অনুভব করছিল সে। 

তখন ঘরে ঢুকল মেয়েটি। শাড়ি-পরা। হাতে মিষ্টির পাত্র সাজানো। সে দেখল। গোল মুখ। গোলগাল শরীর। বড় বড় দুটি চোখ। মাজা রং। শান্ত। শ্রীময়ী। মেয়েটিকে বসতে বলা হল। মুখ নিচু করে বসল সে। হারাধন লক্ষ করল মেয়েটির হাত কাঁপছে। সে নিখিলেশের দিকে তাকাল। নিখিলেশ বললেন—নে। কিছু কথা বল। দিদি, দিদি… 

ডাকতে ডাকতে উঠে গেলেন নিখিলেশ। উঠে গেলেন মানুদির দাদা ভদ্রলোক। হারাধন একটু জল খেল। মেয়েটি মুখ নিচু করে বসে আছে। আঙুলে জড়াচ্ছে শাড়ির কোণ। হারাধন কী বলবে ভেবে পেল না। তার সামনে বসে আছে এক খারিজ হয়ে যাওয়া মেয়ে। কতবার খারিজ হয়ে যাওয়া? কতবার মিষ্টির পাত্র নিয়ে এভাবে এসে বসেছে সে? অনেকবার? নাকি এই প্রথম? কত গ্লানি, কত অপমান মাখা আছে প্রতিবার সেজেগুজে নিজেকে দেখানোর মধ্যে! সম্বন্ধ স্থির করার এই পদ্ধতির প্রতি বিদ্বিষ্ট হয়ে উঠল হারাধনের মন। সে, একটু সহজ হওয়ার ইচ্ছেয় জিগ্যেস করল—উনি বুঝি আপনার মামা? 

মাথা নাড়ল মেয়েটি। মুখ তুলল না। হারাধন বলল—আমার নাম হারাধন। হারাধন বসাক। আপনার নাম কী? 

—মৌসুমি। মৌসুমি দত্ত। 

—কী! কী নাম বললেন! 

একটু বেশিই উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল সে। বেশিই প্রকাশ করেছিল বিস্ময়। মেয়েটি মুখ তুলে তাকাল তার দিকে। বলল— মৌসুমি দত্ত। 

সারা শরীরে কাঁপন লাগল তার। বুকের মধ্যে তোলপাড় করা কষ্ট। এমন কেন হল! কেন হয়! তার প্রথম সম্বন্ধের পাত্রীটি, তার মনে মনে খারিজ করে রাখা পাত্রীটিরই নাম মৌসুমি হয় কেন? হায়! এই নামের মধ্যে যে তার সকল শ্রদ্ধা, সকল ভালবাসা নিবেদিত। এই নামকে সে কীভাবে প্রত্যাখ্যান করবে? 

তার বুকের তলায় উঠে এল সেই প্রিয় মুখ। তার মা। তার মৌসুমি। মধ্যচল্লিশের এক অপূর্ব রমণী। যে তাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসে। উন্মাদিনীর মতো ভালবাসে। এবং যাকে সেও ভালবেসে পাগল হয়ে যায়। এত এত এত ভালবাসা তাদের দুটি হৃদয়ে ছাড়া আর কোথাও নেই। 

সে মনস্থির করে ফেলল। যা হয় হবে। সে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে পারবে না। নিখিলেশ এলেন তখন। দরাজ কণ্ঠে বললেন—কী? আলাপ পরিচয় হল? 

সে তাকাল নিখিলেশের দিকে। বলল—আমরা এবার উঠব তো নিখিলেশদা? 

—হ্যাঁ। মৌ তা হলে আসুক এবার? 

—হ্যাঁ, হ্যাঁ নিশ্চয়ই। 

মৌসুমি নামের মেয়েটি উঠে দাঁড়াল তখন। নমস্কার জানিয়ে ভেতরে চলে গেল। সপরিবারে মানুদি প্রবেশ করলেন আবার। মিষ্টি খাওয়ালেন অনুরোধ-উপরোধ করে। উঠে পড়ল তারা। পথে বেরিয়ে হারাধন বলল— নিখিলেশদা, আমি এখানেই বিয়ে করতে চাই। এবার আপনারা জেনেশুনে নিন। 

—হারাধন! 

পথেই তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন নিখিলেশ। 

—আমি জানতাম ওটা তোর কাছে কোনও ব্যাপার হবে না। অনেক বড় তোর হৃদয়। মেয়েটা বড় ভাল রে। 

গলা ধরে এল নিখিলেশদার। কিছুক্ষণ নীরবে পথ চলল তারা। একসময় হারাধন বলল—বহরমপুরে একবার ফোন করব নিখিলেশদা। 

—করবি? আচ্ছা বাসস্ট্যান্ডের দিকে চল। এখন তো পাবলিক বুথ হচ্ছে চারদিকে। নিশ্চয়ই পেয়ে যাব। 

পেয়েও গেল তারা। একটি মিষ্টির দোকানের সংলগ্ন বুথ। সে ফোন করার ছোট্ট ঘেরাটোপে দাঁড়াল। সামান্য কাচ, যা এক আঘাতে চূর্ণ হয়ে যায়, আড়াল করে দাঁড়াল তাকে। ডায়াল করছে সে। বুক কাঁপছে তার। হাত কাঁপছে। গ্রাহকযন্ত্র তুলে নিচ্ছে সে। ওপারে মৌসুমির স্বর। সে গাঢ় গলায় বলল— আমি বলছি মা। 

—তুই কাল আসিসনি কেন? হারাধন? আমি যে আর থাকতে পারছি না। 

—আমারও কষ্ট হচ্ছে মা। খুব কষ্ট হচ্ছে। 

সে জানে না কেন তার গলা ধরে আসছে। চোখ ভরে যাচ্ছে জলে। দুর্বোধ্য আবেগ তাকে ভাসিয়ে দিতে চায়। সে ঠোঁট চেপে ধরছে ঠোঁটে। মৌসুমি বলছেন—চলে আয়। আমার কাছে চলে আয় তুই। 

—মা। আমি ধুলিয়ানে। 

—ও। দেখতে গিয়েছিলি না? 

—হ্যাঁ। মা। আমি পছন্দ করেছি। 

–করেছিস? বাঃ! খুব ভাল! 

–কেন পছন্দ করলাম জানতে চাইবে না মা? 

—ও খুব সুন্দর? 

—ভাল। কিন্তু তার জন্য নয়। 

—তবে? 

—ও যদি কুৎসিত কদাকার হত, পঙ্গু হত, প্রতিবন্ধী হত, তা হলেও ওকে প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব হত না মা আমার পক্ষে। 

—কেন হারাধন? 

—মা। ওর নাম মৌসুমি। তোমার নাম মা। ওর নামের মধ্যে যে তোমাকেই খুঁজব আমি। তোমাকেই পাব। তোমাকে আমি, তোমাকে আমি… 

—হারাধন! 

—মা! 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *