রাজপাট – ৩৩

৩৩ 

মৃত্যুরে বন্ধুর মতো ডেকেছি তো,— প্রিয়ার মতন!—
চকিত শিশুর মতো তার কোলে লুকায়েছি মুখ;
রোগীর জ্বরের মতো পৃথিবীর পথের জীবন;
অসুস্থ চোখের পরে অনিদ্রার মতন অসুখ;
তাই আমি প্রিয়তম; প্রিয়া বলে জড়ায়েছি বুক,—
ছায়ার মতন আমি হয়েছি তোমার পাশে গিয়া!— 
যে ধূপ নিভিয়া যায় তার ধোঁয়া আঁধারে মিশুক,—
যে ধোঁয়া মিলায়ে যায় তারে তুমি বুকে তুলে নিয়া 
ঘুমনো গন্ধের মতো স্বপ্ন হয়ে তার ঠোঁটে চুমো দিয়ো, প্রিয়া! 

.

ঘাটে নেমে কুয়াশার মধ্যে দিয়ে সে চলেছে। আর তাকে জড়িয়ে জড়িয়ে চলেছেন মা। মৌসুমি। এত ঘন করে জড়িয়ে থাকে সে ওই মাকে যে সারাক্ষণ তারা সঙ্গে সঙ্গে যায়। এ ওকে ছাড়ে না। ছায়ার মতো। যত দিন যাচ্ছে, এই ছায়া প্রগাঢ় হয়ে উঠছে। কোনও দিন পেয়ে যাবে অবয়ব, তখন হারাধনকে কিংবা তার মা মৌসুমীকে আর আলাদা করা যাবে না। সেদিন সে মায়ের কথা শুনে বলেছিল—আমি তো বিয়ে করব না। 

—করবি। 

—মানে! 

—তোকে খুব শিগগির বিয়ে করতে হবে হারাধন। 

—অসম্ভব। 

—আমাকে যদি সত্যি ভালবাসিস তুই, তা হলে শিগগির বিয়ে কর। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। 

—মা! 

—আমাকে ভালবাসিস না তুই? 

—আমার পক্ষে অন্য কারওকে ভালবাসা সম্ভব নয়। তুমি জানো না? 

—জানি। তবু বিয়ে করে নে তুই। 

—কেন বলছ? তোমার কথা আমি ফেলতে পারব না জানো! 

—বিয়ে না করলে ভীষণ সর্বনাশ হবে রে। 

—কী সর্বনাশ মা! 

—তুই বুঝতে পারছিস না কেন? 

—বিয়ে করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে তো? 

—হবে। 

—তোমার তো বিয়ে হয়ে গেছে কবেই। 

—আমি জানি না। তবু, কাল থেকেই পাত্রীর সন্ধান কর তুই। 

—তুমি করো না, তোমার যখন এত ইচ্ছে। 

—না। তোকেই খুঁজে নিতে হবে। আমার দেখা পাত্রী যদি ভাল না হয়, সারাজীবন তুই আমাকে দোষ দিবি। বলবি মা চায়নি আমি সুখী হই। 

সে ওষ্ঠে-অধরে ‘মা’ শব্দটি নড়াচড়া করায়। দুই ঠোঁটের বিবিধ বিচিত্র ক্রিয়াকলাপের মধ্যে সেটি প্রশ্নচিহ্ন হয়ে লেগে থাকে। থেকে যাবে হয়তো-বা সারাটা জীবন। বহু বোধ ও নিষেধ পেরিয়ে, বহু মুগ্ধতা, সম্ভ্রম ও ভালবাসা পেরিয়ে, যত দিন যায়, আর কোনও সংস্কারও নয়, কিন্তু সংস্কারের চেয়েও গাঢ় অন্ধকারে তাদের সম্পর্ক এখন। সম্বোধন, সে তো এক ঘটনা মাত্ৰ। তারপর এতগুলি বছর ধরে ক্রমশ ক্রমশ কাছে আসা যে-সম্পর্ক নির্ধারণ করে দিল, তাকে শুধু ওই সম্বোধনের সত্যে রাখা অসম্ভব কারণ সম্পর্ক সম্বোধনের চেয়ে বড় হয়ে থাকে। অনেক অনেক বড়। 

সে পায়ে পায়ে মাটি মেখে চলে। আশৈশব তাকে জড়িয়ে থাকা মাটি। অথচ এ মাটি কত অনিশ্চিতের। তার দু’পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ভাগীরথী। যে-কোনও দিন সে তার জলডানা ছড়িয়ে দেবে এই চরের ওপর আর ঘরবাড়ি, আবাদ, মানুষ, গবাদি পশুসহ ডুবে যাবে। ভেসে যাবে কোথায়! তার মেরুদণ্ডে ভয় ঢুকে পড়ে। যদি এখনই এমন হয়! এখনই কোনও প্লাবন ধাবিত হয় তার দিকে আর হিমবন্ত জল তাকে ডুবিয়ে মারে! হায়! কী এক আশ্চর্য জীবনের স্বাদ সে পেতে চলেছে এখন। এই চাকরি পাওয়া তার, তাকে মুক্ত করেছে অনুগ্রহের থেকে। এবং সে এক রমণীকে সঙ্গী করে পাড়ি দেবে আয়ুর বিরাট সাগর। সে এখন মরবে না। এইসব স্বাদ সে নিতে চায় আরও। 

সে, হারাধন নামের অনুগ্রহে পুষ্ট ছেলে, সে জানে না জীবনের এইসব স্বাদের আকাঙ্ক্ষা ফুরোয় না কখনও। কোনও শর্ত হাতে রেখে সে হয় না সাময়িক। সকল শোক ও যন্ত্রণার মধ্যেও সে জেগে থাকে প্রধানতম হয়ে। 

এবং সহসা হারাধন চমকে ওঠে। রমণী! কোনও এক রমণীকে মনে হল কেন তার। সে কি তবে সাগ্রহে লুফে নিয়েছে মৌসুমির দেওয়া বিবাহের আদেশ! তার সকল অস্তিত্ব এক নারীর অপেক্ষায় উন্মুখ হয়ে উঠল কবে! সে অন্তরে জ্বালা বোধ করে। সে-জ্বালা ক্রমশ শরীরে ছড়িয়ে যায়। কর্ণমূল উষ্ণ করে তোলে। এই শীতেও গরম নির্গত হয় নিশ্বাস। তার ইচ্ছে করে, এখুনি ফিরে যায় মৌসুমির কাছে আর তাঁর খোলা স্তন মুঠো করে ধরে। 

ছোট ছোট বাঁশের বাড়িগুলির পাশ দিয়ে সে যায়। টুকরো টুকরো কথা হয়ে ধরা পড়ে ঘর-গেরস্থালি। গাভীগুলি জাবর কাটার আয়োজন করছে। ধুনোর মধুর গন্ধে বুক ভরে যায়। হিন্দুর ঘরে তুলসীতলায় জ্বলছে পিদিম। সরকারিভাবে এ-চরে মানুষ বসবাস করে না তবু জীবনের সকল মাঙ্গলিক এখানে অধিষ্ঠিত। এই চরার জীবন সে চায় না জেনেও তার বুক ভরে উঠল বেদনায়। দারিদ্রে ভরা এ গ্রাম, গ্রামের মানুষ, তারা কেন এমন অপাংক্তেয় হয়ে পড়ে থাকবে বছরের পর বছর! 

সিদ্ধার্থর কথা মনে পড়ে তার। এবং সে সংকল্প করে, এই পেতনির চরকে সরকারি স্বীকৃতি দেবার জন্য যা-কিছু করার, সে সিদ্ধার্থকে করতে অনুরোধ করবে। কেন সিদ্ধার্থ, কেন আর কোনও বড় নেতা নয় সে জানে না। সে কেবল সিদ্ধার্থকে ভরসা করতে পারে। আস্থা রাখতে পারে তার নেতৃত্ব-ক্ষমতায়। সে দেখেছে, কলেজে বিরোধীদলের অনেক ছেলেকে শুধু কথা বলে নিজের দলে টেনে এনেছিল সিদ্ধার্থ। তার মধ্যে এমন কিছু আছে, যা মানুষের মনে আস্থা গড়ে দিতে পারে। তখন কমলি নামের মেয়েটির কথা মনে পড়ল তার। পেতনির চরের এক সাধারণ মেয়ে কমলি— সে কোথায় চলে গেল! জানতেও পারল না তার জন্য প্রাণ পর্যন্ত চলে গেল কতগুলি লোকের। সম্পূর্ণ তারই জন্য নয়। তবে তাকে কেন্দ্র করে এক বিশ্রী ঘৃণ্য অপরাধচক্রের বিরুদ্ধে গিয়েছিল কতজন! আর তার কেন্দ্রে ছিল সিদ্ধার্থ। যদিও কেন্দ্রে সিদ্ধার্থ ছিল, না ওই ময়না বৈষ্ণবী নামের মহিলা- সে স্থির করতে পারে না। দুজনেই ছিল দু’রকমের ভূমিকায়। কিন্তু সেদিনের থানা ঘেরাও ও গুলিচালনার পর সিদ্ধার্থ এই বাগড়ি অঞ্চলে, এই চরে বড় শ্রদ্ধেয় নাম। 

বাড়ির কাছে পৌঁছে গেল সে। ছোট দোকানে সামান্য তৈজসপত্র নিয়ে এখনও বসে আছে নারান মুদি। তাকে অন্ধকারে রেখে মৃদুভাবে লন্ঠন জ্বলে যাচ্ছে। সে দাঁড়াল নারান মুদির মুখোমুখি আর লক্ষ করল নারান মুদি ঝিমোচ্ছে। সে ডাকল— বাবা! 

নারান মুদি চমকে চাইল। বসে-যাওয়া গাল ও কোটরাগত চোখের এক শীর্ণ মানুষ। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। হারাধনকে দেখে সেই চোখ উজ্জ্বল হল। হারাধন বলল— দোকানে বসে ঝিমোচ্ছেন কেন? বন্ধ করে বাড়ি চলে যান। 

–এই তো। বেশ আছি। দোকানে বাড়িতে তফাৎ কী! তা তুই আজ আসবি একটু খবর দিলে একটু মাছ-টাছ… 

–মাছের দরকার নেই। এটা রাখুন। 

–কী? 

–দু‘হাজার টাকা আছে। 

–অ। দে। 

সে টাকাগুলো দিয়ে দিল। তার মনে হল নারান মুদি ঠিক খুশি হল না টাকা পেয়ে। কেন? সে কি আরও বেশি পরিমাণ অর্থ প্রত্যাশা করেছিল? সে যা বেতন পায় তাতে মেস নিয়ে থাকলে এ টাকা প্রতি মাসে দিয়ে যেতে তার কোনও অসুবিধে হবে না। কিন্তু সে যদি সত্যি বিয়ে করে তা হলে একটা বাড়ি ভাড়া করতে হবে, তখন… 

সে নিজেকে শাসন করতে চায়। মাত্র সাতদিনে তার মধ্যে বিয়ের ভাবনা এত তীব্র হয়ে উঠেছে যে, সুযোগ পেলেই সে ওই প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছে। সে বাড়ির ভিতরে যাবার জন্য পা বাড়াল। একবার তাকিয়ে দেখল নারান মুদি টাকাগুলো পকেটে রাখছে। এই চরের জীবনে মাসে দু’হাজার টাকা যথেষ্ট। নারান মুদি একটু রয়ে-সয়ে খরচ করলে ক্রমে ভিটের ওপর একটা টিনের চালাও দিয়ে নিতে পারবে। দেওয়ালে ইট দেবার জন্য হারাধন বাড়তি কিছু সাহায্য করতে পারে। যে-লোক ত্রিশ বছর বাঁশের বেড়া দেওয়া মাটির বাড়িতে কাটাল, তার এর চেয়ে বেশি আর কী লাগে! 

উঠোনের অন্ধকারে বসে বাসন মাজছিল কচি। হারাধনের ছোট বোন। হারাধনকে দেখেই সে ছুটে এল— মা! মা! দাদা এসেছে। 

এইসময় ভাইগুলি বাড়িতে নেই। শীর্ণ ও নুয়ে পড়া শরীর নিয়ে এসে দাঁড়াল তার মা আলতা। ছোটবেলায় এই মহিলার গায়ের রং ছিল দুধে-আলতায়। তাই আলতা। অথচ এখন, দারিদ্র্যে ও পাঁচ সন্তানের জননী হওয়ার ধকলে সে ফ্যাকাশে। বিবর্ণ। এই বিবর্ণতা অন্ধকারেও জ্বলে উঠল নির্মল মাতৃহৃদয়ের আলোয়। সে জানে না কী হল তার। নিচু হয়ে সে প্রণাম করল মাকে। আলতা, নারান মুদির স্ত্রী, ছেলেকে চোখ বন্ধ করে আশীর্বাদ করতেই চোখে জল এল। আঁচলে চোখ মুছে নিল সে। বলল— তোর জন্য তো কিছুই করতে পারিনি আমরা। তুই ভাল থাক। 

সে জানে না, কোন রহস্য থেকে তারও গলায় উঠে আসছিল কান্না। কারণ এই কান্নার জন্য প্রস্তুত ছিল না সে। তুমুল আবেগে সে তাড়িত এখন। তার মনে হল এই পরিবার, এই তার জনক-জননী, ভাই-বোন— সবার জন্য সে এক উপশম হয়ে উঠতে পারে। সবার জন্য নিরাময়। 

সে ঘরে এল। বহুবার দেখা ঘর, তবু মনে হল কী ভীষণ মলিন! সেই মালিন্যে তার ভয় করতে লাগল। কী করবে এ সংসারে সে? কয়েক মুহূর্ত আগেকার আবেগ উলটোস্রোতে ক্রমশ দূরে সরে যেতে থাকল তার থেকে। নারান মুদি তার অন্য তিন ছেলেকেও দিয়েছিল স্কুলে। কোনও মেধার চিহ্ন না রেখেই হারাধনের সেই তিনটি ভাই তৃতীয় শ্রেণির পর পড়ায় ইস্তফা দিয়েছিল। দাদাকে দেখে তারা কিঞ্চিন্মাত্র অনুপ্রাণিত হয়নি। বাল্য হতেই তারা কিছু চাষ শিখে, কিছু মাছ-ধরা শিখে উপায়ের পথ দেখে। কিন্তু অনিয়মিত সে-উপায়। অনিশ্চিত। এইসব মোটা-সোটা তিনটি অশিক্ষিত তরুণের জন্য মাত্র দেড়মাস চাকরিতে বহাল হওয়া হারাধন কী করতে পারে! সে ভয়ার্ত চোখে চারপাশে তাকায়। দূরে বহুদূরে পালিয়ে যেতে চায় তার মন। দিশেহারা বোধ করতে থাকে সে! একটু ভাল থাকতে চাওয়া তার। শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত জীবনের ছিমছাম আবেশ! সে কি পাবে না? পাবে না কি? 

কচি একটি গ্লাস নিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে। জল এনেছে। আলতা বলছে— যা তো কচি, উমাদের বাড়ি থেকে হাঁসের ডিম নিয়ে আয় 

–ক’টা আনব? 

–চারটে আন। আর তোর বাবাকে বলিস দোকান থেকে যেন একটু পেঁয়াজ-আদা আনে।

কচি চলে গেল। হারাধনের মনে পড়ল তাদেরও ছিল কিছু হাঁস। তারা কি ডিম দেয় না? সে জিগ্যেস করল এ-কথা। আলতা বলল— দেয় তো। তোর বাবা সব হাসান মিঞাকে বেচে দেয়। শহরে এখন হাঁসের ডিমের খুব ভাল দাম পায় নাকি হাসান মিঞা। তোর বাবা তো বলছিল, হারু যদি একটা ছোট পোলট্রি করে দেয় তা হলে তো নাড়ু, তারু দু’জনেই দেখাশোনা করতে পারে। শহরেও তো আজকাল অনেকে পোলট্রি করছে। না? 

সে মাথা নেড়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়। তার দম বন্ধ হয়ে আসে। সে চাকরি পেতে না-পেতেই এরা অনেককিছু ভেবে ফেলেছে। শহরে পোলট্রি করার কথা তুলল কেন আলতা? সে নির্বিকার হতে চেষ্টা করল। আলতা বলল— হ্যাঁ রে, তুই কত টাকা মাইনে পাস? 

–কেন? 

–তাই বলছিলাম। কচিটা বড় হচ্ছে। ওর জন্য কিছু গয়না গড়ানো দরকার। বিয়ে তো দিতে হবে! 

সে উঠে বসে। বিয়ে! তার মনের মধ্যে এসে ধাক্কা লাগে। বিয়ে! বিয়ে! কচির বিয়ে! সে সতর্ক হয়ে যায়। বোনের বিয়ে দেবার দায়িত্বও তবে তারই জন্য তোলা আছে? সে মনে মনে নারান মুদির সম্পর্কে বিষোদ্গার করে এবং উপলব্ধি করে, যদি বিয়ে করে সে, এবং করবে যত শীঘ্র সম্ভব, আগে থাকতে এদের কিছু জানাবে না। 

বিয়ের কথা ভাবতেই তার মুখ স্বাদু লালায় ভরে যায়, কারণ, বিয়ে হলে তার পৃথক সংসারের দায়ে সে এই পরিবারের ভার কিছু ঝেড়ে ফেলতে পারবে। বস্তুত তার সকল যুক্তি, সকল পরিস্থিতি তার সত্বর বিবাহের পক্ষ সমর্থন করে। তখন আলতা তার কাছে এসে দাঁড়ায়। বলে— হারু। তুই মানুষ হয়েছিস, আমাদের কত ভরসা। তুই তো নিজের চেষ্টাতেই সব করলি। মানুষটা সবসময় একথা বলে। তোর জন্য কিছু করতে পারল না বলে মরমে মরে আছে সবসময় ওকে দেখিস বাবা। ওর পাশে দাঁড়াস। সংসার টানতে টানতে লোকটা শেষ হয়ে গেল। 

তীব্র রাগ হয় হারাধনের। সে ঘরে পা দিয়েছে আধাঘণ্টাও হয়নি। এরই মধ্যে সমস্ত কর্তব্যাকর্তব্য তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে! মা এখন বাবার হয়ে ওকালতি করছে। আলতা ওকালতি করছে নারান মুদির জন্য। তার মধ্যে ঘৃণার ভাব জাগে। সংসার টানতে টানতে শেষ হয়ে গেল— কার সংসার? লোকটা নিজের রসদ বোঝেনি, একটার পর একটা সন্তানের জন্ম দিয়েছে। এখন সে-দায় তার কাঁধে ফেলে দিতে চাইছে সবাই। 

সে নেমে এল বিছানা থেকে। এখন ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। আলতা আরও সব প্রয়োজনীয়তা দাখিল করবে তার কাছে। সে জানে, এখন, এই বাড়ির সকলেই আরও সব প্রাপ্তির কল্পনায় মশগুল। আলতা চা নিয়ে ঢোকে তখন। বলে— বেরুচ্ছিস বাবা? 

–হুঁ। 

–এতদিন বাদে এলি। এই সন্ধ্যায় আবার কোথায় যাচ্ছিস? 

–যাই। রেজাউলের সঙ্গে দেখা করে আসি। 

–চা খেয়ে যা। করলাম। 

সে নিঃশব্দে চায়ের কাপ হাতে নেয় এবং পান করে। আলতা বলে— নতুন চাকরি পাবার পর এলি। ছোটবোনের জন্য একটা শাড়ি আনতে পারতিস। 

সে মায়ের দিকে তাকায়। নিজের প্যান্টের পকেট থেকে পার্স বার করে নেয়। লজ্জিত গলায় বলে— শাড়িটাড়ি আমি বুঝি না মা। তুমি কিনে দিয়ো। তোমার জন্যও কিনে নিয়ো। 

সে গুনে গুনে চারটি একশো টাকার নোট আলতার হাতে দেয়। আলতার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। শাড়ি কেনার জন্য এত টাকা সে কখনও হাতে পায়নি। এমনকী এর চেয়ে কম টাকায় সে সংসার পর্যন্ত চালায়। সে বলল— এখান থেকেই কিনব। উমার ছেলেটা কী সুন্দর তাঁত বুনতে শিখেছে জানিস। বাপ-ছেলেতে নানা নকশা দিয়ে শাড়ি বোনে। শহর থেকে লোক আসছে এখন। আগে ওরাই হাটে হাটে যেত না? 

সে ছোট্ট করে হুম শব্দ করে। তার চা খাওয়া হয়ে গেছে। সে বেরুতে চায়। আর তার হুম অনুসরণ করে আলতা বলে— এখন আর যাস না। 

–বেরোই মা। 

–আর একটু বস না।

–না। আসি। 

–ভাইদের জন্য কিছু দিবি না? ছোট ভাইগুলো আশা করবে। 

সে পার্স বের করে। বলে— দেখো! আর পঞ্চাশ টাকা আছে। পরশু ফিরতে হবে। নাকি ভাবছি কাল বিকেলেই ফিরব। 

–না, না। কাল থাক। কাল না হয় এই টাকা থেকেই একটু মাংস আনাব। নাড়ু-তারু মাংস-মাংস করছিল। 

—বাবার হাতে দু’ হাজার টাকা দিয়েছি মা। ওখান থেকে ওদের কিছু দিয়ো। 

–দু’হা-জা-র? হ্যাঁ রে হারু, তুই কত টাকার বেতন পাস বল না? 

সে জবাব না দিয়ে পা বাড়ায়। অন্ধকারে তাকে তাড়িয়ে ফেরে- কত টাকা বেতন পাস? হারু হারু হারু! তুই কত টাকা বেতন পাস? কত টাকা? 

কিছুক্ষণ আগে একতাল ক্রোধ ও ঘৃণা তার মধ্যে পাক খাচ্ছিল। সেইসব প্রশমিত হয়েছে বোন ও মায়ের জন্য শাড়ি না আনার লজ্জাবোধে। এখন তার আবার অস্বস্তি হচ্ছে। তার ঘর ভাল লাগছে না। সে ভেবেছিল থেকে যাবে রবিবার। এখন মনে হচ্ছে চলে যাবে। হঠাৎ গিয়ে চমকে দেবে মৌসুমিকে। হয়তো, সম্ভব হলে, সে এই রাতেও চলে যেতে পারত। কিন্তু এখন আর পারাপারের নৌকা পাবে না। 

অনেকদিন আগে মৌসুমি তাকে বলেছিলেন— বাড়িতে যখন যাবি তখন মা আর বোনের শাড়ি নিয়ে যাস। নিতে হয়। 

সে ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু সেদিন সে জিগ্যেস করেছিল- আর তোমাকে? তোমাকে কী দেব মা বলো? 

মৌসুমি তাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন আলমারির কাছে। খুলে দিয়ে বলেছিলেন— কত শাড়ি দেখেছিস? তোর দেওয়া শাড়িগুলো একবার করে পরে তুলে রেখে দিয়েছি। আর পরি না। 

–কেন? 

–যদি ছিঁড়ে যায়? তোর দেওয়া না? 

সে কলেজে পড়ার সময় টিউশন করত আর তার থেকে টাকা জমিয়ে শাড়ি কিনেছিল মৌসুমির জন্য। পূজায় দিয়েছিল। এখন তো দেবেই। 

আলতা আর কচির জন্য শাড়ি না আনায় আবার লজ্জিত হল সে। রেজাউলের বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে সে সব ঝেড়ে ফেলে দিল। টাকা তো দিয়েই দিয়েছে। শাড়ির চেয়েও হাতে টাকা পেয়ে আলতা অনেক বেশি খুশি। আজ রাত্রে সে খাবে গোটা হাঁসের ডিম। অন্যরা অর্ধেক। বরাবরই সে পেয়ে এসেছে এই যত্ন। এখন এই যত্নেরই বিনিময় হিসেবে গোটা সংসার তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। 

এ চরায় রেজাউলের বাড়িটাই সবচেয়ে বড়। ইটের দেওয়ালের গায়ে মাটি লেপা। মাথায় টিনের চাল। বাড়িটার মাথার ওপর অর্ধেক আকাশ আগলে দাঁড়িয়ে আছে একটি ঝাঁকড়া কাঁঠাল গাছ। এ বাড়িকে রোদ-বৃষ্টি-বজ্রপাত হতে আগলে রাখাই এই মহাবৃক্ষের কাজ। এ ছাড়া সে দেয় বেশ কিছু বৃহদাকার কাঁঠাল—সম্বৎসর। কাঁঠালগাছ তো কত বাড়িতেই আছে! কিন্তু বিশালতায় এবং ফলনে এ গাছ ব্যতিক্রম। রেজাউল যখন ছোট ছিল, কোনও দুঃখের কারণ ঘটলেই এই গাছকে আশ্রয় করত সে। ডাল-পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকত। 

উঁচু ভিতের ওপর গড়া এই বাড়ি বহু বর্ষায় গ্রামের আশ্রয়স্থল হয়েছে। শিশু ও মেয়েদের ওই বাড়ির মধ্যে রেখে তারা ভেসে ভেসে বেরিয়েছে নৌকায়। সালতিতে। এখনও এই অবস্থা বলবৎ আছে। প্রতি বর্ষাতেই যে চরা ডোবে এমন নয়। মাঝে মধ্যে চরা আর বাসযোগ্যই থাকে না যখন, তারা নৌকায় চেপে চতুষ্কোণায় চলে যায়। চতুষ্কোনাও তখন জলে ডুবে থাকে কারণ বাগড়ির ঢালু জমিতে গড়িয়ে আসে ভাগীরথীর উদ্বৃত্ত জল। তখন চতুষ্কোনা গ্রাম ও পেতনির চরের ঘরডোবা মানুষগুলি গ্রামের প্রান্তে উঁচু পাকা সড়কের ধারে আশ্রয় নেয়। জল নামলে আবার ভাঙা ঘর মেরামত করে বসবাস। হারাধন নিজেও এমনকী থেকেছে সড়কের ধারের প্লাস্টিকের ছাউনিতে। কিন্তু যখন বহরমপুরের হাইস্কুলে গেল তখন গোটা বর্ষা সে আর বাড়ি ফিরত না। থেকে যেত কোনও বন্ধুর বাড়ি। কোনও শিক্ষকের বাড়ি। 

শীত পড়েছে খুব। সেইসঙ্গে নদীর হাওয়া। একটি চাদরের অভাব বোধ করল সে। তখনই হকসেদ মণ্ডলের গলা পেল। হকসেদ মণ্ডল রেজাউলের পিতা। ন্যায়নিষ্ঠ ধার্মিক মানুষ। এগিয়ে গেল সে। বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছিল না। এখন দেখল হকসেদ মণ্ডলকে ঘিরে বসে আছে বেশ কয়েকজন। সে দাঁড়াতে হকসেদ বললেন- কে? হারু না? আসো বাজান আসো। রেজাউল, আয়। কেমন আছ বাজান? ভাল তো? 

কুশল বিনিময় করে সে ভিতরে যায়। এ বাড়িতে তার জন্য কোনও বিধি-নিষেধ নেই। রেজাউলের স্ত্রী রওশন তাকে দাদা বলে মান্য করে। ছেলে কোলে করে সামনে দাঁড়াল রেজাউল। সে এখন দুই সন্তানের পিতা। তার ছোটভাই সফিকুলেরও বিয়ে হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। আর যেহেতু বন্ধুত্ব মনের সকল ভার ধুয়ে-মুছে দিতে সক্ষম সেহেতু হারাধনের মনের একটু আগেকার নানাধর্মী অসন্তোষ চলে গেল ছেলে-কোলে রেজাউল সন্দর্শনে। একান্তে কথা বিনিময় করল তারা। পরস্পরের কাছে কিছুই প্রায় লুকোবার নেই, এমনই এই সম্পর্ক। হারাধন বলল—মা বলছিল খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করে নিতে। 

–মা? 

–বহরমপুরের। 

হাসল রেজাউল। লণ্ঠনের আলোয় তাকে দেখাচ্ছে আবছায়া দেবপুরুষের মতো। সে সুন্দর। নিখুঁত নির্ভুল এক মানুষ সে। হারাধন রেজাউলকে ভালবাসে। রেজাউলের সৌন্দর্যকেও ভাল না বেসে পারে না। ঈশ্বর তাকে গড়েছেন মধ্যম ও বিশেষত্বহীন করে। যে-কোনও সুন্দরের কাছে সে ম্লান। সে জিগ্যেস করল— তোর কী মনে হয়? 

—করে ফেল বিয়ে। 

–এখানে আমার ওপর সবার অনেক প্রত্যাশা। আমি এখন বিয়ে করতে চাইলে বাড়িতে মত দেবে না। 

–কেন? মত দেবে না কেন? চাকরি করছিস। তুই বিয়ে করতে চাইলে আপত্তি কোথায়? আমরা তো দু’ভাই এই জমিজমার ভরসাতেই বিয়ে করলাম, নাকি? কাজটা তো করতেই হবে আজ না হোক কাল। 

–সবাই এভাবে চিন্তা করে না। বোনের বিয়ে না হলে আমার বিয়ে করা মুশকিল। কিন্তু মা বললে আমি না শুনে পারি না তুই জানিস তো। 

–জানিস তো, আমার আব্বাজি একটা কথা বলে। যখন কোনও সংকটে পড়বে, সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না, তখন নিজের হৃদয়ের দিকে তাকাও। সে কী চায়! তাকে ঠকিয়ে কিছুই হয় না। যে নিজেকে ঠকায় সে সারা দুনিয়াকেই ঠকায় আসলে। 

–ঠিক কথা।

–তোর কী ইচ্ছা? 

–মায়ের কথা রাখতে চাই। 

—তবে আর কী! বিয়ে কর। খুব তাড়াতাড়ি বাবা হয়ে যা হারু। দেখবি দুনিয়াটা কীরকম পালটে যায়। 

–কীরকম? 

–আমি এখন যা-কিছু করি, মনে হয় বাচ্চাগুলোর জন্য করছি। আমি কিছু না। ওরাই সব। ভাল লাগে খুব। কিন্তু আজকার্ল ভয় করে। আগে এরকম ছিল না। মনে হত, যা হবে, দেখা যাবে। এখন মনে হয়, বাচ্চারা যখন বড় হবে তখনও যদি এই চর সরকারি স্বীকৃতি না পায়। কী হবে! কিংবা ধর, নদী একদিন ভাসিয়ে দিল সব। ডুবে গেল এই চরা। হয়তো কোনও গভীর রাত্রে— যখন বাচ্চাদের নিয়ে ঘুমিয়ে আছি আমরা! 

হারাধন কিছু বলতে পারল না। এমনই ভাবনা তার মাথায় এসেছিল কিছুক্ষণ আগেই। তবে সে ভেবেছিল নিজের জন্য। হয়তো তারও সন্তান হলে সে-ও রেজাউলের মতো ভাববে। তখন রেজাউল বলতে থাকল— আব্বাজি যখন বলত এইসব, রাত্রি হলে বড় ভয় করে রে রেজাউল— কখন ডুবে যাবে চরা! কখন জল ফুঁসে উঠবে! নাকি নদী তলায় তলায় খেয়ে ফেলবে মাটি আর একদিন ভুস করে গোটা চরাটাই চলে যাবে জলের তলায়! ঘুমের মধ্যে কখন কী ঘটে যায়, কে বলতে পারে! বর্ষা নামলেই আব্বাজি ভীত হয়ে থাকে। সন্ত্রস্ত। মাঝরাতে উঠে বলে— চল বাবু, দেখে আসি চারদিক। আমি লন্ঠন নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে যাই। ফিরে এসেও আব্বাজি বিছানায় ছটফট করে। আমি ভাবতাম, বেশি ভয়। কোনও মানে হয় না এসবের। গত ত্রিশ বছরে যখন ডুবে গেল না, ভেসে গেল না এ চরা, তখন আজই-বা ডুববে কেন! আব্বাজি ছটফট করত আর আমি রাত্রে ঘুমোতাম নিশ্চিন্তে। কিন্তু এখন আমিও ছটফট করি আর বুঝতে পারি আব্বাজির কষ্ট। আজ রাত্রে আছি, কাল ভোরে আর থাকব কি না জানি না— এ ভাবনা নিজের জন্য সয়। বাচ্চাদের জন্য সয় না। ফুটফুটে শিশুগুলি! ওঃ! ওরা তো কিছুই বোঝে না এ জীবনের। 

হারাধন তন্ময় হয়ে শুনছিল সব। আর ভাবছিল, কত কথা বলছে রেজাউল। সাধারণত ও কম কথার মানুষ। জীবন ওকে নানান অভিজ্ঞতার মধ্যে টেনে আনছে আর ও কথা বলে উঠছে। এবার সে বলল—তা ছাড়া আমাদের তো কোনও পরিচয়ই নেই। চরের ঠিকানাকে গ্রহণ করা হয় না কোথাও। বর্ষায় কতবার চরা ভেসে গেলে আমরা পাকা সড়কে গিয়ে থেকেছি। আমাদের জন্য কখনও সরকারি ত্রাণ আসে না। আসবেও না যতক্ষণ না সরকারি অনুমোদন পাচ্ছে এই চরা। আমি ভাবছি সিদ্ধার্থকে বলব এটা নিয়ে কিছু করতে। 

–হ্যাঁ। ও চাইলে করতে পারে কিছু। বৈষ্ণবীর ব্যাপারটা নিয়ে যা করল! ও যদি এ নিয়ে কিছু করে তা হলে আমি থাকব ওর সঙ্গে। 

—আমিও থাকব। 

উঠে পড়ল সে। গ্রাম শান্ত হয়ে গেছে নিশুতি রাতের মতো। রেজাউল একটি লন্ঠন নিয়ে তার সঙ্গে সঙ্গে এল। তাদের দেখে হালকা স্বরে ডেকে উঠল দু’-চারটি শীতার্ত কুকুর। এবং তারপরে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়তে তৎপর হল। এর ওর বাড়ির খোলা দাওয়ার কোণ খুঁজে সেঁধিয়ে গেল তারা। আর হারাধনকে বাড়ির কাছে পৌঁছে দিয়ে ফিরে গেল রেজাউল। 

নারান মুদি ছেলের জন্য অপেক্ষা করছিল। তার ভাইগুলি বরাবর দূরে দূরে। যদিও তারা চার ভাই ও বাবা আজ একত্রে খাবে, সে জানে। সে ঘরে আসতেই পেঁয়াজ-রসুনের ঝাঁঝাল গন্ধ পেল। নারান মুদি বলল— আয়। বস। খিদে পেয়েছে? কচি, তোর মাকে বল রান্না তাড়াতাড়ি সারতে। 

উঠোন থেকে হাত-মুখ ধুয়ে ফিরল সে। তোলা জলে কাজ। সারা চরায় টিউকল আছে চারখানা। পাড়া ভাগ করে গ্রামের মানুষেরই চাঁদায় বসানো কল। এই চাঁদায় হকসেদ মণ্ডলের ভাগই বেশি। এ চরায় তাঁরই জমির পরিমাণ সর্বাধিক। 

সারাদিনের ব্যবহৃত পোশাকও সে বদলে নিল ঘরে এসে। নারান মুদি বিড়ি খাচ্ছিল বিছানায় বসে। বলল— তা বহরমপুরে বাড়িভাড়া-টাড়া কত খোঁজ নিয়েছিস? 

সে চমকে উঠল। বাড়িভাড়ার কথা-কেন? তা হলে কি নারান মুদিও তার বিবাহ দিতে চায়? না। অসম্ভব। সে এই সম্ভাবনা বাতিল করে দিয়ে বলল—কেন? 

–না, তাই বলছিলাম। হকসেদ মণ্ডলের সঙ্গে কথা বলে রেখেছি। এখানে তো জমির কোনও দলিল-পাট্টা নেই। দখলের চর, দখলেই সীমানা। তবু হকসেদ মণ্ডল দর খারাপ দেবে না। 

–আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। 

নারান মুদির কোটরাগত চোখ জ্বল জ্বল করে। সে নিঃশব্দে হাসে আকর্ণবিস্তৃত আর অল্প অল্প দোলে। পুত্রের জিজ্ঞাসু মুখের দিকে তাকিয়ে সে বলে— হারু, তুই চাকরি পেয়েছিস, এল আই সি-র চাকরি তো খুব ভাল, না? সবাই জানে আমরা এবার বহরমপুর চলে যাব। এই ভিটেবাড়ি আর দোকানের জন্য দশ হাজার টাকা পর্যন্ত দেবে হকসেদ মিঞা। তা কম কী! শহরে গেলে নাড়ু-তারুর জন্য যদি একটা পোলট্রি করে দিস তুই। কচিটার বিয়ে দিতে হবে। ওঃ! কতরাত যে ভাল করে ঘুমোইনি! বহরমপুরে বাসা নিলে প্রথমে সাতদিন ভাল করে ঘুমোব। না, না। সাতদিনই কেন, একমাস দু’মাস। ঘুম হয় না। ঘুম হয় না রে এখানে। জমি-জিরেত ছিল না, সামান্য ভিটেবাড়িও চলে গেছিল সেবারের বন্যায়। আজকের কথা নাকি? তিরিশ বছর। চরায় যেই কাশফুল ফুটল, আর সবার সঙ্গে আমিও দখল নিতে ছুটলাম। ওঃ কী মারামারি! তবু যা হোক মাথা গোঁজার ঠাই একটা হল। কিন্তু বড় কিছু হল না। আমি আসার আগেই জুটে গেছিল আরও বড় দখলদার। সরকারি বাবুরা সব দেখে-শুনে বললেন, এ-চরা ধরবে না। ডুবে যাবে। এ-চরায় লোক বসবাস মানে প্রাণ নিয়ে খেলা। যে-কোনও বর্ষায় সবসুদ্ধু তলিয়ে যাবে একদিন। আজ তিরিশ বৎসর। প্রতি রাত্রে মনে হয়, এই বুঝি ডুবে গেল চরা। এই বুঝি ঘর-বাড়ি ডুবিয়ে দিয়ে দুই শাখা একাকার হয়ে গেল! ঘুমোলে দুঃস্বপ্ন দেখি। দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠলে মনে হয়— ওই ওই ওই তো জল, হ্যাঁ জল, ঢুকে পড়ল, ঢুকে পড়ল! এ চরার লোক মরতে মরতে বাঁচে রোজ। পায়ের তলার মাটিতে যার বিশ্বাস নেই, তার বাঁচা কি একটা বাঁচা হারু? কতদিনের স্বপ্ন আমার, একটু বাঁচার মতো বাঁচব। একটা ঠিকানা থাকবে। সেই ঠিকানায় চিঠি আসবে। রেশনের কার্ড হবে আমাদের নামে। রাতে ঘুমোতে যাবার আগে মনে হবে না— এই কি শেষ ঘুম? কাল ভোরে উঠব তো? দেখতে পাব তো সূর্যোদয়? বহরমপুরে গেলে আমিও কি বসে থাকব রে বাবা? একটা ছোট-মোট মুদি দোকান দিতে পারলে আমি চালিয়ে দেব ঠিক। শহরে বিক্রি-বাটাও কত বেশি। হ্যাঁ রে, বহরমপুরে বাড়ি ভাড়া-টাড়া কেমন? 

–বাবা… 

হারাধন কথা বলতে গিয়ে থেমে যায়। তার গলায় জমে আছে একদলা গয়ের। নারান মুদির এইসব কথা, জমি দখলের এই ইতিবৃত্ত, সে শুনেছে কতবার! শুনতে শুনতে শুনতে শুনতে সে নিরাসক্ত হয়ে গেছে। ছোটবেলায় মনে হত নারান মুদি বীর, নারান মুদি বিরাট। হাতে বাঁশ নিয়ে লাফিয়ে পড়ছে নৌকা থেকে। দখলের জমির ওপর পেশি ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে বলছে—এ জমি আমার! কার এত সাহস এ জমিতে দখল দেয়! 

আজ নারান মুদিকে তার লাগে ব্যর্থ। ক্লীব। ধূলিকণার তুল্য পুরুষ। সে গলা ঝাড়ে। একটি চিনচিনে ক্রুদ্ধ ব্যথা ছড়িয়ে যাচ্ছে মাথাময়। বুকে ঝড় তুলছে প্রতিবাদ। তুমি কে আমার, নারান মুদি? জনক ছাড়া কিছু নও। আর তুমি আলতা, তুমিও আমাকে জন্ম দিয়েছ মাত্র। পর পর জন্ম দিয়েছ। তোমার সন্তান-সম্ভাবিত পেট দেখতে দেখতে বড় হয়েছি আমি। তোমার ছেলেমেয়ের গু-মুতের গন্ধে আগাছার মতো বড় হয়েছি। হ্যাঁ, স্কুলে ভাল ছেলে হয়ে ওঠার পর আমার যত্ন বেড়েছিল। হ্যাঁ, বেড়েছিল। কিন্তু সে ভালবাসায় নয়। আমি তখন থেকেই হয়ে গিয়েছিলাম তোমাদের ভবিষ্যতের আমানত। হাঃ। আমি তা হতে দেব না। আমারও অধিকার আছে স্বাধীনমতো, নিজের খুশিমতো বাঁচবার! 

সে, নারান মুদির চোখের দিকে না তাকিয়ে, তার জননী আলতার দিকে না তাকিয়ে, বাঁশের চাঁচের দিকে তাকায়। এবং বলে— বাবা, আমি যা মাইনে পাই তাতে শহরে বাড়ি ভাড়া করে থেকে এত বড় সংসার টানা সম্ভব নয়। 

–অ্যাঁ? 

নারান মুদির চোখ বিস্ফারিত হয়ে যায়। হারাধন দেখতে পায় মা-ভাই-বোন ছায়ামূর্তির মতো মিশে যাচ্ছে বাঁশের বেড়ার দেওয়ালে। ঘরে ঘন হয়ে আসছে অন্ধকার। তার হৃদয় দ্বিধাবিভক্ত হতে চায়। শোণিত সম্পর্কের গভীর টান তাকে জড়িয়ে ফেলতে চায় নারান মুদির স্বপনের সঙ্গে। কিন্তু সে, যেমন মুরগির গলা কাটার পর ফিনকি রক্তের বিরুদ্ধে হাত চেপে ধরে ছিন্ন কন্ঠনালী, তেমনই শক্ত করে চাপা দেয় উছলে ওঠা আবেগ উচ্ছ্বাস। দাঁতে দাঁত চাপে সে। বলে— মাত্র দেড়মাস আমি চাকরি করছি। এখনই আপনারা নাড়ু-তারুর জন্য পোলট্রি চাইছেন, কচির বিয়ের গয়না চাইছেন। 

–অ্যাঁ? কচি? অ্যাঁ? 

নারান মুদি হাঁসফাঁস করে। আলতা কোনও অন্ধকার পায়ের তলায় সেঁধোয়। হারাধন বলে চলে— এখন আপনাদের বহরমপুর নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। একটু গুছিয়ে নিই। তা ছাড়া… 

–হ্যাঁ, হ্যাঁ গুছিয়ে নে না। আরে গ্রামদেশে জমি বাড়ি আজ বললেই কাল বিক্রি হয় নাকি? এখন থেকে চেষ্টা না করলে… 

নারান মুদি যেন ভিক্ষাপাত্র হাতে মরিয়া চেষ্টা করে শেষ বার। তাকে থামিয়ে হারাধন বলে— আমার কথা এখনও শেষ হয়নি। 

–হ্যাঁ, হ্যাঁ। 

–আমি বিয়ে করছি খুব শিগগির। 

–অ্যাঁ! 

আলতার নড়বড়ে কুঁজো হয়ে যাওয়া শরীরে খটখট শব্দ হয় এবার। প্রতিবাদের পুঁটুলি হয়ে ওঠার চেষ্টা করে সে। বলে— কী বলছিস কী তুই হারু? ঘরে বয়স্থা বোন! তাকে পার না করে তুই বড়দাদা, তুই বিয়ে করে নিবি? 

হারাধন নিরুত্তর থাকে তখন। রিয়াজুল বলেছিল, বিয়ে করতে অসুবিধে কোথায়? 

এই পরিবেশ অসহনীয় লাগে তার। ইচ্ছে করে ছুটে চলে যায় এখনই। আলতার কথার পর এক দীর্ঘ নীরবতা। তার মনে হয়, তারা সবাই একটি চুক্তিপত্র ঘিরে বসে আছে। সে আর তার জনক-জননী। আর তার ভাইবোনগুলি~~ নাড়ু, তারু, সারু ও কচি, চুক্তির এক-একটি শর্ত। যেমন তার জন্মও একটি শর্ত ছিল কোনও কালে। 

নারান মুদির গলা পাওয়া গেল তখন— কই গো, কচির মা, ভাত-টাত বাড়ো। রাত হল। কচিকে সঙ্গে নিয়ে আলতা আহারের আয়োজন করতে থাকে। মেঝেতে মাদুর পেতে নেয়। জলের ছিটে দিয়ে থালা রাখে মাদুরের সামনে। খাদ্যবস্তুগুলি সাজায়। নারান মুদি বলে— তা বিয়ে করবি, তারও তো একটা খরচ-পত্ৰ আছে। 

–খরচ? 

হারাধন থমকায় এক মুহূর্ত। তারপর অনায়াসে বলে, যা সে এক মুহূর্ত আগেও ভাবেনি— আয়োজন অনুষ্ঠান কিছু হবে না বিয়েতে। কাগজে সই করে নেব। 

নারান মুদি নীরব হয়ে যায়। আর হারাধন নিজেরই মিথ্যাচারের পারদর্শিতায় বিস্ময়বোধ করে। কীভাবে বিয়ে হবে সে কখনও ভাবেনি, অথচ এই মুহূর্তে বলে ফেলল কেমন। যেন তারই ভিতরে বসে আছে অন্য হারাধন, যে তাকে সদা প্রস্তুত রাখছে। 

আলতা ভাত বাড়ছে। শীর্ণ হাতে ঝলমল করছে শুধু শাঁখা আর পলা। এই শীতেও দু’খানি নগ্ন পা। গায়ের চাদরখানায় শতেক ছিন্নতা। কুঁজো পিঠের ওপর ঘাড়ের কাছে শীর্ণ কবরী জেগে আছে বিষণ্ণ স্মৃতির মতো। ঘরে একটিমাত্র লণ্ঠন যাবতীয় অন্ধকারের সঙ্গে লড়াই করছে একা। ভাইগুলি আলোর বিপরীতে সেঁধিয়ে আছে। তাদেরও স্বপ্নের বুনোট ছিঁড়ে যাচ্ছে ক্রমশ। বড়দার থেকে বরাবরই তারা দূরের। কিন্তু হৃদয়ে আত্মীয়তাবোধের অভাব ছিল না। বড়দাকে নিয়ে দেখা স্বপ্নগুলির মধ্যে তারা ছিল সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। এখন অন্ধকার তাদের দিশেহারা অভিব্যক্তি আড়াল করে আছে। বড়দা বিয়ে করতে চায় এবং এই বিয়ে যেন-বা তাদের পরিবারের পক্ষে এক অশনিসংকেত। কেননা বিবাহ করলে বড়দা এক পৃথক সংসারের অধিকারী হয়ে যাবে। পৃথক দায়িত্ব। তারা প্রত্যেকেই মনে মনে এই প্রশ্ন অনুচ্চারিত রাখে, বড়দা এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করবে কেন? তা হলে কি কোনও মেয়ে ঠিক হয়ে আছে? বড়দা তা হলে প্রণয়ে আবদ্ধ? 

প্রশ্নটা পরদিন সকালে তাকে করল আলতা। 

–হারু, মেয়েটা স্বজাতি তো? 

—কোন মেয়েটা? 

–যার সঙ্গে তোর ভাব? 

মায়ের ধারণা মুহূর্তে বুঝে নিল হারাধন। এবং এই ধারণাকে সে অতি চাতুর্যে জিইয়ে রাখতে চাইল। বিবাহের পাত্রী স্থির হয়ে আছে জানলে মা আর আপত্তি তুলবে না। যদিও এই আত্মবিশ্বাস তার আছে, সে কিছু করতে চাইলে আপত্তি করার মতো জোর এই পরিবারের নেই। কিন্তু বাধা বা অসম্মতিও তিক্ত করে দেয় মন। এই মুহূর্তে এইসব তিক্ততা সে চায় না। তার চিত্ত এখনও দোলায়িত। বিয়ে করার প্রয়োজনীয়তা নেই, এই ধারণা থেকে সে ক্রমশ বিবাহে উপনীত হচ্ছে এবং কোনও ভাবনারই ওপর স্থির হয়ে বসতে পারছে না। এই রোদ্দুরের মধ্যে সে আরও অস্থির। তার ইচ্ছে করছে, এখুনি চলে যায় বহরমপুরের মায়ের কাছে। মায়ের কোলে মুখ গুঁজে বসে থাকে। কিংবা টেনে নেয় বুকের গন্ধ। ওই প্রত্যুষেই দুটি ভরাট স্তন তাকে পীড়ন করতে থাকলে সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। একটি সম্পূর্ণ নারী-শরীরের পিপাসায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। 

তখন তার চোখ পড়ে নারান মুদির দোকানের ওপর। চাদরমুড়ি দিয়ে বসে আছে তার জন্মদাতা। একটা বাতাসাও তার বিক্রি হয়নি তখনও। সে বসে আছে গালে হাত দিয়ে। কোটরাগত চোখ দুটি ভাষাহীন। কাল রাত্রে হারাধন ওই লোকটার স্বপ্ন ভেঙে-চুরে দিয়েছে। এখন নারান মুদির চোখের তলায় ভাঙা স্বপ্নের দাগ। হারাধন সহ্য করতে পারে না সেই দৃশ্য। সে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ভাবতে থাকে, তারই মতো যৌন তাড়না ছিল নারান মুদির। চাল নেই, চুলো নেই, বিয়ে করেছিল লোকটা। এবং ওই তাড়নাবশতই নিধিরাম সর্দার পাঁচটি সন্তানের জন্ম দিয়ে ন্যাজেগোবরে হয়ে আছে। সে টের পায়, কী অসহায় মানুষ, যৌন তাড়নার কাছে কী অসহায়! 

সে ঘরে ফিরে আসে। পোশাক বদলায়। আর তাকে পোশাক বদলাতে দেখে ছুটে আসে আলতা— কোথায় যাচ্ছিস হারু? 

–বহরমপুর। 

–সে কী! বললি যে আজ থাকবি। 

–কাল তো থাকলাম। আজ ফিরে যাই। কাজ আছে। 

–তুই ভালবাসিস বলে তোর জন্য কলমি দিয়ে শুঁটকি রান্না করব ভাবলাম আজ দুপুরে। এ বেলাটা থেকে যা অন্তত। 

আলতা তার বাহু স্পর্শ করে। মৃতদেহের মতো শীতল তার হাত। সকাল থেকে জল ঘাঁটছে। গরিবের সংসারে মেয়েদের কাজ পাহাড় হয়ে ওঠে। 

হারাধন মায়ের দিকে তাকায়। কী ব্যাকুল মুখ! আরও ওই শীতল স্পর্শে তার শরীর জুড়িয়ে যায়। তার মনে পড়ে, খুব ছোটবেলায়, ঘন বর্ষা নামলে বজ্রবিদ্যুতের শব্দে ভয় পেয়ে সে মায়ের বুকে ঢুকে পড়ত। সব ভয় কেটে যেত তখন। সে আর্দ্র হয়ে যায়। বিশ্বাস করে, ওই মুখে শুধু স্বার্থের তাড়না নেই, অর্থের কামনা নেই। তার বাইরেও এক স্নেহ আছে। মমতা আছে। সে বলে— আচ্ছা, বিকেলেই যাব তা হলে। 

উদ্ভাসিত হয়ে যায় আলতার মুখ। হারাধন পোশাক পরিবর্তন না করেই শুয়ে পড়ে বিছানায় আলতা তার শিয়রে বসে চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে— কচি তোর জন্য চিতই পিঠে করছে। একটু নলেন গুড় আছে, তাই দিয়ে খাস। 

হারাধনের ভাল লাগছিল। সে চোখ বন্ধ করে বলল— হুঁ। 

আলতা বলে চলল— দেখেশুনে বিয়ে করছিস তো বাবা? আমি আর কী দেব বউকে! একফোঁটা সোনাও তো নেই। আর কী! আশীর্বাদ দেব। সুখে থাকো। পুত্রবতী হও। শাশুড়ির আশীর্বাদ কখনও বিফল হয় না। হারু 

— হুঁ। 

—ভাইদের দেখিস বাবা। তুই ছাড়া আর কে ওদের দেখবে বল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *