৩০
স্বতই বিমর্ষ হয়ে ভদ্রসাধারণ
চেয়ে দ্যাখে তবু সেই বিষাদের চেয়ে
আরো বেশি কালো কালো ছায়া
লঙ্গরখানার অন্ন খেয়ে
মধ্যবিত্ত মানুষের বেদনার নিরাশার হিসেব ডিঙিয়ে
নর্দমার থেকে শূন্য ওভারব্রিজে উঠে
নর্দমায় নেমে
ফুটপাত থেকে দূর নিরুত্তর ফুটপাতে গিয়ে
নক্ষত্রের জ্যোৎস্নায় ঘুমাতে বা ম’রে যেতে জানে।
আহত লোকটির নাম মহম্মদ খান। তাঁর ছেলে বসির খান। গোলামখানা অঞ্চলে একটি চায়ের দোকান আছে মহম্মদ খানের। আর বসির খান স্কুল পেরিয়ে একজন প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত গাইড। মুর্শিদাবাদ শহরের ভ্রমণার্থীদের সব ঘুরিয়ে দেখানো এবং ইতিহাস বিবৃত করা তার পেশা।
মুর্শিদকুলি খাঁর ব্যক্তিগত অনুচর হয়ে দিল্লি থেকে মুর্শিদাবাদে এসেছিলেন ওঁদের পূর্বপুরুষ। জাতিতে পাঠান ওঁরা। মুসলমান কিন্তু নিরামিষাশী। চুল রাখে কাঁধ পর্যন্ত। গলায় পরে কাঠের বা পাথরের মালা। ওঁদের দেহকাঠামো দীর্ঘ, দৃঢ়, চওড়া কাঁধ ও কব্জি শরীরের শক্তিকে জানায়।
ডা. কোঙারের নার্সিংহোমে বেশি কিছু করা সম্ভব হয়নি মহম্মদ খানের জন্য। প্রাথমিক শুশ্রূষার ভার ডা. কোঙারের হাতে দিয়ে সিদ্ধার্থ তার গোটা দলকে জমায়েত করেছিল নতুন সরকারি হাসপাতালে অভিযান করবে বলে। ভারপ্রাপ্ত ডাক্তার এতজনকে দেখে কেঁপে উঠেছিলেন। সে খুব শীতল গলায় বলেছিল—আপনি চিকিৎসা শুরু করুন। পুলিশের ব্যাপারটা আমরা দেখছি।
মহম্মদ খান এখনও চিকিৎসাধীন। এই দশদিনে সে প্রত্যহই একবার করে গিয়েছে ওঁকে দেখে আসতে। বাঁ চোখে পুরো ক্ষত নিয়ে শুয়ে থাকছেন মানুষটি। এ ক’দিনে বসির খান সারাক্ষণই তার পিতার সেবা-শুশ্রূষা করেছে। স্বাভাবিকভাবে সারাক্ষণ রোগীর বাড়ির লোকের থাকার নিয়ম নেই। কিন্তু সরকারি হাসপাতালগুলিতেই নিয়ম লঙ্ঘন হয় আগে। শেষ পর্যন্ত লঙ্ঘনই হয়ে ওঠে নিয়ম।
মহম্মদ খানের একটি চোখ চিরতরে বিনষ্ট হল। এমনকী চোখ প্রতিস্থাপিত করারও আর উপায় নেই। তাঁকে সারিয়ে তোলার জন্য যত ওষুধ এবং ইঞ্জেকশন বরাদ্দ হয়েছে, তা ক্ৰয় করতে গিয়ে বসির খান ঋণ করেছে বিস্তর। সিদ্ধার্থ তাকে কিছু অর্থ সাহায্য করেছে। বসির খান প্রথমে নিতে চায়নি। সিদ্ধার্থ তাকে এক অমোঘ বন্ধনে জড়িয়ে ফেলেছিল তখন। বলেছিল-আমাকে তোমার ভাই মনে কর বসির খান।
সে বিস্মিত হয়েছিল। বলেছিল- বাবু! অনেক করেছেন আপনি আমার জন্য।
দীর্ঘ, শক্তিমান দেহের ওপর বসানো যে-মুখ, তাতে নিরীহ প্রলেপ। দেহের সঙ্গে মুখের ওই পেলবতার বৈপরীত্য ঘটে। মহম্মদ খানের মুখে আছে দাড়ি, কিন্তু বসির খানের গোঁফ-দাড়ি পরিষ্কার করে কাটা থাকে সাধারণত। যদিও এই ক’দিনের দুর্যোগে খসখসে দাড়িতে ভরে গেছে তার মসৃণ গাল। সেই গাল থেকে প্রতিফলিত হচ্ছিল হৃদয় ছানিয়ে তোলা আলো। বিস্ময় এ কৃতজ্ঞতার ফাঁকে কখন ঢুকে পড়েছে ভালবাসা!
সিদ্ধার্থ বসির খানের পিঠে হাত রেখে বলেছিল —বাবু বোলো না। বাবু আবার কী! সিধুদা বলতে পারো। আর টাকাটা নাও।
বসির খানের চোখে জল এসেছিল। সে বলেছিল— আমি মনে রাখব সিধুদা। আপনি আমাকে ভাই ডেকেছেন।
বসির খানকে ভাই বলা খুব কঠিন ছিল না সিদ্ধার্থর পক্ষে। এক অবিচ্ছেদ্য ভ্রাতৃত্বই তো সে গড়ে তুলতে চায় সকলের সঙ্গে। সে চায় হৃদয়। সহস্র সহস্র মানুষের হৃদয়। তার মধ্যেকার ভালাবাসা সে ছড়িয়ে দিতে চায় মানুষের মধ্যে। আর যারা তার প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যে আছে তারা, যারা তার সহকর্মী, অনুচর—তাদেরও সে ভালবাসে বিনা প্রশ্নে। ভাল না বাসলে হৃদয় পাওয়া যায় না কোথাও। আর হৃদয় বিনা কোনও মঙ্গল কীভাবে গড়ে উঠবে। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ভিত্তিই হল হৃদয়ের বিনিময়ে পেয়ে যাওয়া এক হৃদয়। হৃদয়ের প্রসঙ্গ এলে বোধিসত্ত্ব বলেন—হৃদয় হল আগলে রাখার বস্তু। আড়ালে না রাখলে তা ক্ষয় হয়ে যায়। আর সাবধানে না রাখলে ভেঙে যায় অচিরেই।
হায়! সে এবং তার পিতামহ কতই সাবধানে রেখেছিল তাদের হৃদয়। অত তীব্র আঘাতেও ভেঙে যায়নি। পিতামহের হৃদশক্তির প্রতি সে নুইয়ে দেয় তার মস্তক। এবং সে অতি সন্তর্পণে রাখে তার হৃদয়কেও। এই বিশ্বাস তার আছে, তার হৃদয় ভাঙা সহজ নয়। কিন্তু ক্ষয় সম্পর্কে সে ভীত হয়ে থাকে। রাজনীতি তার হৃদয়কে ক্ষইয়ে দিতে পারে।
সেদিন, পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাতে বসির খানকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল সে। পথে যেতে যেতে সে অনেক প্রশ্ন করে জেনে গিয়েছিল সব। পুলিশের কাছে যাওয়ার বিষয়ে বসির খান তখন স্নায়বিক চাপে ভুগছিল নিশ্চিতই। সে সঙ্গে থেকে তাকে আশ্বস্ত করে এবং প্রশ্ন শুধিয়ে যায়। বসির খান, এক যুবক, তার কাছে সমর্পিত ছিল প্রায়। সে জিগ্যেস করেছিল- কে এ কাজ করেছে তুমি জান বসির?
—জানি। অনেকজন মিলে করেছে সিধুদা।
—কারা করেছে? কেনই-বা করল?
—অনেক কারণ আছে সিধুদা।
—কী কী কারণ?
—আমাদের বাড়ির পাশে কিছুটা ফাঁকা জমি আছে। বাবার অনেক কষ্টের জমি। রেখে দিয়েছেন মেয়েদের বিয়ের খরচ তুলবেন বলে। ওই জমিতে ওরা কালীপুজো, সরস্বতী পুজো সব করে। আমরা কোনওদিন কিছু বলিনি। এবার কালীপুজো শেষ হতেই প্যান্ডেলের জায়গাটায় সিমেন্ট ইট ফেলে ঘর তুলতে শুরু করল। ক্লাব করবে। বাবা আপত্তি করেছিলেন। সেই রাগ। আসলে বাবা রাগের মাথায় বলেছিলেন- রাতে ঘর ভেঙে দেব আমি।
—আরেকটা কারণ কী?
—বাবা ওদের একজনকে…মানে আমার বোন মেহেরকে বিয়ে করতে চেয়েছিল ওদের একজন। বাবা রাজি হননি।
—ওরা কারা?
—দীপেন হাজরার দল।
—তোমার বাড়ি কি ফিরিঙ্গি কলোনিতে, বসির?
—হ্যাঁ, বাবু
—ওরা, মানে দীপেন হাজরা তো আসলে…
সিদ্ধার্থ উচ্চারণ করতে পারছিল না। তৌফিকও তারই মতো স্তব্ধ ছিল। দলের আরও যে দু’ চারজন ছিল, তারাও তাকিয়েছিল সিদ্ধার্থর দিকেই। প্রত্যেকেই জানে দীপেন হাজরা কার লোক। সকলকে স্তব্ধ দেখে বসির খানই বলেছিল-মিহির রক্ষিতের লোক ওরা দাদা। আমি জানি।
সে সরাসরি তাকিয়েছিল বসির খানের দিকে। বলেছিল—মিহির রক্ষিত কে তুমি জানো?
—জানি।
—তা হলে তুমি আমার কাছে এলে কেন?
—আপনার মতো করে আমাদের কথা আর কে ভাববে সিধুদা?
সে তৌফিকের সঙ্গে পরামর্শ করেছিল। পুলিশের কাছে দীপেন হাজরার নাম বলে কোনও ফল হবে না। এমনকী তারাও দীপেন হাজরার বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারবে না আপাতত। মহম্মদ খান যখন আক্রান্ত হন তখন আর কেউ-ই ছিল না আশেপাশে। গলির মুখে তাঁর ওপর চড়াও হয়েছিল দুষ্কৃতীরা। বাড়ি থেকে বেরিয়ে তিনি দোকান অভিমুখে যাচ্ছিলেন তখন অতএব সে, যাবতীয় অসহায়তা সমেত বসির খানকে বলেছিল—তুমি অন্য কারও কাছে গেলে ভাল করতে বসির। আমি তো দীপেন হাজরার নামে বলার জন্য পুলিশের কাছে এখন যেতে পারব না।
বসির বলেছিল—দীপেন হাজরার নাম আমিও করব না সিধুদা। আমি জানি, করে লাভ নেই।
তারা গিয়েছিল। কারও নাম না করে পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ডায়রি করেছিল। আর নিজের অসহায়তার কথা ভেবে সেদিন রাত্রে ঘুমোতে পারেনি সিদ্ধার্থ। বসির খানের কাছে নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছিল সে।
যদি সে সরাসরি দীপেন হাজরার বিরুদ্ধে যেত তা হলে মিহির রক্ষিতের সঙ্গে তার বিরোধ প্রকাশ্য হত। নির্বাচনের আগে এইসব দলীয় দ্বন্দ্বকে সংগোপনে রাখাই বিধেয় বলে সে মনে করেছে। কিন্তু সে পুরোপুরি স্বীকার করে মহম্মদ খানের সঙ্গে চূড়ান্ত অন্যায় হয়েছে। তার প্রতিকার পাওয়া উচিত ছিল। মিহির রক্ষিতের প্রশ্রয়ে বেশ বড় একটি অশুভ শক্তি বহরমপুরে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সি পি আই এম পার্টির সঙ্গে তাদের নাম জড়িত। তার মতে, এই মুহূর্তে মিহির রক্ষিতকে সমাজবিরোধীদের আশ্রয় দেবার জন্য দল থেকে বহিষ্কার করা উচিত। কিন্তু এ কথা সে কাকে বলবে! সে মনে মনে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। সেদিন, সেই দারুণ ক্ষোভের মধ্যে সে সংকল্প করেছিল, কোনও দিন, হাতে আরও ক্ষমতা এলে, সে এইসব দীপেন হাজরাকে ধূলিসাৎ করবে। এবং সঙ্গে সঙ্গেই সে উপলব্ধি করেছিল, সে কতখানি শক্তিহীন। একাকী মানুষ মাত্রই শক্তিহীন। মানুষের শক্তির ধারক তার গোষ্ঠী, তার দল বা প্রতিষ্ঠান। আদিকাল থেকেই এ নিয়মের কোনও ব্যতিক্রম ঘটেনি। যার যত বড় দল সে তত জোর পায়। তবে সবসময় দলগত শক্তি সংখ্যাগরিষ্ঠের বিচারে হয় না। সংখ্যাল্প মানুষও মেধা ও দক্ষতার জোরে বিপুল বলশালী হতে পারে। কৌরবদের বিরুদ্ধে পাণ্ডবপক্ষীয়দের জয় তার নজির হয়ে আছে।
তা ছাড়া রাজনীতি সর্বদা অসৎ শক্তিকে পরিহার করতে পারে না। সমাজ যাকে সৎ বলে চিহ্নিত করে না, তাকে নিয়েও চলতে হয় একজন রাজনৈতিক মানুষকে। কারণ রাজনীতি অসৎ বাদ দিয়ে শুধু এক সৎ নিষ্কলঙ্ক পৃথিবীর বস্তু নয়। রাজনীতি স্বয়ং কলঙ্কিত। কারণ রাজনীতি নিরন্তর একপ্রকার যুদ্ধঘোষণাও। কোনও দলের বিরুদ্ধে, কোনও নীতির বিরুদ্ধে বা কোনও মতবাদের বিরুদ্ধে তার যুদ্ধ। ক্ষমতাকে আঁকড়ে থাকারও যুদ্ধ তার। এমনকী সংগঠন সুদৃঢ় রাখার যে কৌশল, তা-ও রণকৌশলের থেকে পৃথক কী!
তবু তারই মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করতে হয়। সেখানেই নেতৃত্বের জোর। সিদ্ধার্থ জানে, মির্জার ক্রিয়াকলাপ কখনও সামাজিক নয়। কিন্তু মির্জা নির্যাতকও নয়, মির্জা এই দীপেন হাজরার ভূমিকা নিলে সে মির্জাকে ত্যাগ করত।
একটি পরিচ্ছন্ন সুখী সমাজকেই করতে হয় রাজনীতির মূলধন। সমাজের কোণে কোণে জমে থাকা অন্ধকার বেড়ে উঠলে নেতৃত্বের গায়ে কালি পড়ে।
যেহেতু একাকী মানুষ শক্তিহীন সেহেতু নিজের অস্তিত্বের জন্য তাকে নির্ভর করতে হয় একটি দলের ওপর। এবং সেই দলের মধ্যেকার দুর্নীতিও সে মেনে নিতে বাধ্য হয় নির্বাচনী জয়-পরাজয়ের কথা ভেবে। নিজের প্রতি ধিক্কার এসেছিল তার। এবং সে স্বপ্ন রচনা করেছিল। এক বৃহতের স্বপ্ন। সে তৈরি করবে এমন নেতৃত্ব যা দুর্নীতির ধ্বজাধারী হবে না। তার জন্য সে কোনও প্রতিষ্ঠিত দলেরই আশ্রয় নেবে, নাকি গড়ে তুলবে নিজস্ব দল—সে জানে না। সে শুধু স্বপ্ন দেখে এবং স্বপ্নগুলির ওপর আস্থা রাখতে চায়।
মহম্মদ খানের বিষয় নিয়ে রাসুদার সঙ্গে কথা বলেছিল সে। দীপেন হাজরার মতো মানুষকে রাসুদাও পছন্দ করেন না। এবং একথা সিদ্ধার্থ স্বীকার করতে বাধ্য, এ শহরে কংগ্রেসের বা আর এস পি-র কোনও নেতাই মিহির রক্ষিতের মতো প্রকাশ্যে সমাজবিরোধীদের প্রশ্রয় দেন না। অবশ্য সমাজবিরোধী শব্দটির মধ্যেও আছে বিবিধ মাত্রা। সাধারণ মানুষকে লাঞ্ছিত করার মতো দল যারা গড়ে তোলে, প্রকৃত সমাজবিরোধী কি তারাই নয়? অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠার সঙ্গে, আভিজাত্যের সঙ্গে বা সামাজিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতেও সমাজবিরোধীর সংজ্ঞা পাল্টায় না। পাল্টানো উচিত নয়। সে মিহির রক্ষিতকে মনে মনে অভিযুক্ত করে। সমাজ কোনও প্রতিষ্ঠিত বিষয় নয়। ধারণামাত্র। সমাজের হিতকারী নিয়ম বা আইনও হিতকারক ধারণামাত্র। তার দ্বারা কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার লঙ্ঘনেও থাকে ক্ষতি। এই সকল নিয়েই রোজকার চলা। সে ভাবে। এবং টের পায়, রাসুদা মিহির রক্ষিতের শক্তির ওপর অনেকাংশে নির্ভর করেন। এ শহরে এবং এই জেলায় দলকে আসনে প্রতিষ্ঠিত না করে রাসুদা এমন কোনও পদক্ষেপ নেবেন না যাতে দল থেকে কেউ বহিষ্কৃত হয় বা দল ভেঙে কেউ বেরিয়ে যায়। ছোট শহরে প্রকাশ্য উপদল অনেক বেশি ক্ষতিকারক।
সংগঠনের স্বার্থে সে এই সমস্ত স্বীকার করে নেয় কিন্তু শান্তি পায় না। মিহির রক্ষিত ক্ৰমশ জোরের রাজনীতির দিকে ঝুঁকেছেন। পেশিশক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন দলকে। এর ফলাফল কখনও ভাল হতে পারে না বলে তার বিশ্বাস। কিছুদিন আগে কলেজ পড়ুয়া ছাত্র পরিষদের দুটি ছেলেকে প্রচণ্ড মেরেছে তাদেরই দলের কিছু ছেলে। সে খোঁজ নিয়ে জেনেছে, কাজটা করিয়েছেন মিহির রক্ষিত। এরকম মারধোর অত্যাচার আস্তে আস্তে বাড়ছে। এগুলো আর কিছুই নয়, মানুষকে ত্রাসের মধ্যে রাখা। সারাক্ষণ সকলকে ভাবতে শেখানো, দেখো, আমরা কত শক্তিমান। আমাদের ঘাঁটিয়ো না। বরং আমাদের দলভুক্ত হও।
এভাবে, মানুষের মনে ঘৃণাই সৃষ্টি হয় কেবল। এবং ঘৃণা দ্বারা কখনও ব্যাপক জয়লাভ করা সম্ভব নয়। কারণ ঘৃণা ঘৃণাকেই ডেকে আনে শেষ পর্যন্ত ॥
কিছুদিনের মধ্যেই তারা বহরমপুরের আশেপাশের ভাঙন-কবলিত গ্রামগুলিতে বাঁধ দেবার জন্য একটি লাগাতার আন্দোলন গড়ে তুলবে। মিছিল করে, সেচ দপ্তরের সামনে ধর্না দিয়ে জেলাশাসকের দপ্তরের সামনে অবস্থান করে তারা কেন্দ্রের ওপর বাঁধের টাকা দেবার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে চায়। কাজের কাজ কতদূর কী হবে সে জানে না। বাঁধা-ধরা এই পদ্ধতি। ইস্কুলের ঘণ্টা-বাঁধা সময়ের মতো। বাংলা ক্লাসের পর ইংরিজি, ইংরিজির পর ভূগোল। বক্তৃতার পর মিছিল, মিছিলের পর ধর্না, ধর্নার পর আবার মিছিল। আবার বক্তৃতা। এ সমস্তই নির্বাচনের আগে তাদের অস্তিত্ব প্রমাণের চেষ্টা। তার কেবলই মনে হচ্ছে, এই আন্দোলন উঠবে এবং কিছুদিনের মধ্যে তলিয়ে যাবে। নির্বাচনী প্রচারের সময় পেরিয়ে গেলেই উৎসাহে জল গড়িয়ে যাবে। যদি সত্যিকারের বাঁধ দেওয়াই লক্ষ্য হত, তা হলে কি আরও আগে শুরু করা যেত না এ আন্দোলন? মাঝে মাঝে এরকম এক-একটি দাবি ওঠে এবং থেমে যায়।
বিড়ি এবং কিছু পরিমাণে রেশম ছাড়া মুর্শিদাবাদে কোনও বৃহৎ শিল্প নেই, এ নিয়ে তারা একবার প্রচার ও আন্দোলন চালিয়েছিল। যদিও বিড়িকে রেশমের পর্যায়ভুক্ত শিল্প বলা চলে কি না এ নিয়ে সে ভাবিত ছিল, তবু জেলার প্রচুর লোক এই উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত বলে এবং গোটা আন্দোলনটাই রাজনৈতিক দলমত নির্বিশেষে মুর্শিদাবাদের দাবি হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল বলে সেও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। তাদের দাবি ছিল এই জেলায় বড় ধরনের শিল্প, কলকারখানা গড়ে তুলতে হবে। পরে তার মনে হয়েছে এ এক মেতে ওঠাই শুধু। সামান্য কয়েকদিনের আন্দোলনে কিছুই হয়নি। সে মনে করে আন্দোলন ব্যাপকতা পেলে তবেই ফলদায়ী হতে পারে। মুর্শিদাবাদে ভারী শিল্প বলতে একমাত্র ফরাক্কার তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। সে-ও তাদের আন্দোলনের অনেক আগে থেকে ছিল এবং গোটা জেলার চাহিদা মেটাবার পক্ষে তা আজও যথেষ্ট নয়। এমনকী যে বিড়িশিল্প বহু মানুষকে অন্ন জুগিয়ে চলছে তার কোনও কিছুই এ জেলায় উৎপাদিত হয় না। বিড়ির জন্য কেন্দুপাতা আসে ওড়িশা থেকে আর তামাক আসে গুজরাট থেকে। নিম্নতম পারিশ্রমিকে কর্মী পাওয়া যায় বলেই এ জেলায় পরপর বিড়িশিল্প তৈরি হয়েছে। অন্য কোনও জেলায় আরও কম পারিশ্রমিকে কর্মী পেলে গোটা শিল্পই সেখানে স্থানান্তরিত হতে পারে। আসলে বিড়িশিল্প হল অথৈ জলে কলার ভেলার মতো। কিছুক্ষণ বেঁচে থাকতে বা ভেসে থাকতে সাহায্য করে মাত্র।
সে প্রচলিত পদ্ধতির মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে যুক্ত কিন্তু এই ক্রিয়াকলাপ তার সন্তোষবিধান করতে পারছে না কোনওমতেই।
দলীয় দপ্তরে দুপুর বারোটা থেকে একটি জরুরি সভা আছে আজ। নির্বাচনের জন্য মিছিল, সভা বা পথসভা কোথায় কী হবে তা নির্ধারিত হবে এই সভায়। এ ছাড়া ভাঙন বিষয়ক আন্দোলনেরও রূপরেখা তৈরি হবে। এখন কিছুদিন অন্তর অন্তর এই সভা হতে থাকবে তাদের দপ্তরে। নির্ধারিত কর্মসূচি ঝালিয়ে নেওয়া হবে। এবং দরকার মতো পরিবর্তন করে নেওয়া। নতুন কোনও কিছু সংযোজিতও হতে পারে যদি তা সাফল্য ত্বরান্বিত করতে সহায়ক হয়। ভেবে ভেবে, আলোচনা করে, বিষয় তৈরি করতেই হয় তাদের। জনগণের কাছে নিরন্তর নিজেদের উপস্থিত রাখতে হয়। দেখাতে হয় সক্রিয়তা।
তৌফিককে সঙ্গে নিয়ে সে হেঁটে যাচ্ছিল দলীয় দপ্তরের দিকে। তৌফিক তাকে পৌঁছে দিয়ে অন্য কাজে চলে যাবে। সভায় থাকার অধিকার তৌফিক অর্জন করেনি এখনও। তবে করবে অচিরেই এ বিশ্বাস সিদ্ধার্থর আছে।
বাড়ি থেকে সরাসরি দলীয় দপ্তরে যেতে গেলে সাহেবপাড়ার এই পথটিই সিদ্ধার্থ নেয়। মাঝামাঝি এসে আজও সে পেল অনেকগুলি শিশুর কচি গলার স্বর। বছর দুয়েক হল বাচ্চাদের একটি স্কুল হয়েছে এখানে। খুব অভিজাত ও ধনীদের জন্য নয়। একেবারে নিম্নবিত্ত শিক্ষাগ্রহী পরিবারের বাচ্চারা এখানে পড়ে। নিবেদিতা বাগচী নামে যে-মেয়েটি স্কুলটি করেছে তাকে চেনে সিদ্ধার্থ। এই শহরেরই একটি উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক তার বাবা। যদিও সিদ্ধার্থ ওই স্কুলের ছাত্র নয়। নিবেদিতার সঙ্গে সে কখনও কথা বলেনি। বলার পরিস্থিতিও আসেনি। কিন্তু এই দু’বছরে নিবেদিতা বাগচী মোটামুটি পরিচিত নাম হয়ে উঠেছে সে জানে। সপ্তাহে তিনদিন মেথরবস্তিতে গিয়ে সে শিশুদের অবৈতনিক শিক্ষা দেয়। যদিও এই স্কুলটি করার সময় সে কংগ্রেসের সাহায্য নিয়েছিল এবং সাধুখাঁ পরিবারের খুবই ঘনিষ্ঠ তারা, তবু এই নিবেদিতা বাগচীর সমাজের জন্য কিছু করার আগ্রহ তাকে মুগ্ধ করেছে। নিজেদেরই দোতলা বাড়িকে সে ব্যবহার করছে স্কুল হিসেবে। একতলার পুরোটা এবং দোতলার একটিমাত্র ঘর নিয়ে ক্লাস হয়। একেবারে কচিকাঁচা পড়ুয়া সব। প্রাথমিক স্কুলের আগে মুকুলিত হওয়ার সময়কার পড়া হয় এখানে। আর সাহেবপাড়া পেরিয়ে রাস্তাটা যেখানে দক্ষিণে বাঁক নিয়েছে আর মিশেছে ছাপাখানা রোডে, সেখানে আছে আরও একটি স্কুল। ধনী ও অভিজাতদের জন্য নার্সারি ও কিন্ডারগার্টেন। তুলনামূলকভাবে এই স্কুলটি পুরনো। খুব ছোট করে এই স্কুল খুলেছিলেন রাসুদার স্ত্রী কেয়া এবং মিহির রক্ষিতের স্ত্রী মঞ্জুষা। কয়েক বছরের মধ্যে এই স্কুলটি বড় হয়েছে এবং সারা বহরমপুর শহর ও শহরতলিতে ছোটদের জন্য এর চেয়ে বেশি আভিজাত্যপূর্ণ স্কুল আর নেই।
এই স্কুল থেকেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায় একই রকমের কলরব, যা সিদ্ধার্থ শুনে আনন্দলাভ করে।
একেবারে কাছাকাছি এই নতুন স্কুলটি হওয়ার বিষয়ে তার মনে কিছু দ্বন্দ্ব ছিল। মনে হয়েছিল, এই স্কুল করার পেছনে কোনও প্রতিযোগী মনোভাব কাজ করছে। এ ভাবনা খুব অযৌক্তিকও নয় এমনই সে মনে করে। কারণ নিবেদিতা বাগচী আগে কেয়া ও মঞ্জুষার স্কুলে পড়াত। বছর দুয়েকের কাছাকাছি পড়িয়েছে বা তার কিছু বেশি। পরে ওই স্কুল থেকে বেরিয়ে নিজের স্কুল করার মধ্যে বিদ্রোহ আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু কেয়া-মঞ্জুষার স্কুলের সঙ্গে পেরে উঠবে না বলেই হয়তো সে নিজের স্কুলে টেনে নিয়েছে নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানদের। তার স্কুলে জৌলুশ কম। খরচও কম। এমনকী পোশাকের কড়াকড়িও সে করেনি এখনও। সে যে অবৈতনিক স্কুল করার জন্য বস্তিতে যায়, তারও কারণ হয়তো তার স্কুলের প্রচার। সেদিক থেকে দেখলে নিবেদিতা বাগচীর বুদ্ধিমত্তাকে সিদ্ধার্থ প্রশংসাই করে।
সে স্কুলের সামনে দিয়ে যেতে যেতে মন্থর করে নিল গতি। তৌফিক বলল— নামটা ভাল দিয়েছে না? ‘প্রথম পাঠ’।
সিদ্ধার্থ বলল—হ্যাঁ। ভাল নাম। ওই স্কুলের নামটাও ভাল। ‘কলকাকলি’।
—শুনলাম অনেকে নাকি ছেলেমেয়েকে ওই স্কুলে না দিয়ে এখানেই পাঠাচ্ছে।
—ওই স্কুলে না দিয়ে পাঠাচ্ছে কী করে বোঝা গেল?
—আমাদের পাড়াতেই আছে এরকম। বড় ছেলেকে ওই ‘কলকাকলি’তে দিয়েছিল। ছোটটাকে ‘প্রথম পাঠ’-এ দিয়েছে।
—এইসব প্রতিযোগিতা স্বাস্থ্যকর। ছাত্র ধরে রাখতে দুটো স্কুলই ভাল করে পড়াবে।
‘কলকাকলি’ পেরিয়ে জাজেস কোর্টের দিকে হাঁটতে লাগল তারা। তাদের সামনে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে গেল রত্নেশ্বর আগরওয়াল। তৌফিক অপসৃয়মাণ সাদা গাড়িটি দেখতে দেখতে বলল—এই লোকটাকে চিনলে তো সিধুদা?
—হ্যাঁ। চিনব না কেন?
—প্রোমোটিংয়ের ব্যবসায় নামছে।
—শুনেছি।
—কোথায় করবে জানো?
—শুনেছি। বিষ্ণুপুর বিলের খানিকটা বুজিয়ে বাড়ি করবে শুনলাম।
—অনেক বাড়ি হবে। ফ্ল্যাট। কলকাতার মতো হাউজিং এস্টেট হবে। কলকাতার একটি কোম্পানির সঙ্গে পার্টনারশিপে কাজটা করছে রত্নেশ্বর।
সিদ্ধার্থ চুপ করে থাকল। তার চোখের সামনেই শ্বেতা খাঁর বিল, চাতরা ও মোল্লাগেড়ের বিল কত ছোট হয়ে গেল। বিলের পাড় বুজিয়ে ক্রমশ বাড়ি উঠছে। ওসমানখালির বিল ঢেকে গেছে পুরোপুরি। সরকারি বাস টার্মিনাসটাই তৈরি হয়েছে ধোপঘাটি বিল বুজিয়ে। জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে। ছোট ছোট শহরগুলি দ্রুত বড় হয়ে উঠছে। আর শহর বড় হলেই তাকে ঘিরে ধরে দ্রুতি ও আধুনিকতার চাপ। রাস্তা চাই, বাড়ি চাই। গাড়ি চাই। গাড়ি রাখার জায়গা চাই। এই সমস্ত চাহিদা মেটাবার জন্য চাই অনেক অনেক ডাঙাজমি। পৃথিবী তো আকারে-আয়তনে ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে না যে চাহিদামতো ডাঙাজমি পরিবর্ধিত হবে! অতএব মানবজাতি নিজস্ব অস্তিত্বের সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি করলে জঙ্গল কাটে, আবাদি জমির ওপর বানায় বাসস্থান, নিৰ্মাণ করে কলকারখানা, নির্বিচারে খাল-বিল-পুকুর বুজিয়ে স্থলাভাব মেটায়। ইদানীং জল জমছে বহরমপুর শহরে। সামান্য বর্ষা হলেই নিম্নাঞ্চলগুলিতে জল দাঁড়াচ্ছে। কারণ জলেরও তো দাঁড়াবার জায়গা চাই। সিদ্ধার্থ স্থির করল, আজকের সভায় শুধু বাঁধের কথাই বলবে না, সে বিল ও নালা সংস্কারের জন্য আন্দোলন করার কথাও বলবে।