রাজপাট – ২৬

২৬ 

লাড়িতে চাড়িতে ধান
পউষের আধা যায়।
বিয়ার আলাপ কে করিত 
তার দিশাদারা না পায়॥
আট মাস মেনোথ করি
তবে লইছে ঘর। 
বিয়াশাদির নাম করিতে 
কে এমুন অফসর॥
পউষ মাস মেঘ করিলে 
ধানঘর হয় তুষ। 
এর লাগি এ মাসো নাই
বিয়ার সন্তুষ ॥

নদীর ওপর কুয়াশা কাটে দেরিতে। আজ যখন ন’টা বেজে গেলেও কুয়াশা কাটল না তখন আকবর আলি বুঝল কুয়াশার আড়ালে মেঘ জমে আছে। পৌষের বৃষ্টি চাষিদের পক্ষে ক্ষতিকর। সে আকাশকে বুঝতে চেষ্টা করল। থম মেরে আছে কালচে মেঘের দল। নড়ছে না, চড়ছে না। সে-মেঘের কালো ছায়া পড়েছে জলে আর নদীকেও করে তুলেছে বিষণ্ণ। তার সঙ্গে বিষাদে ভরে গেছে আকবর আলিরও মন। আজ প্রথম খেপের জালে ভাল মাছ পড়েনি। দ্বিতীয়বার জাল ফেলে অপেক্ষা করছে তারা। এর মধ্যে বৃষ্টি নামলে তাড়াতাড়ি জাল গুটিয়ে ফিরতে হবে। পৌষের বৃষ্টিতে ভিজলে সকলের নিউমোনিয়া হয়ে যাবে একেবারে। 

হতে পারে এই মেঘ বৃষ্টি নামাবে না। কেবল শীত বাড়াবে। সে মনে মনে প্রার্থনা করে তা-ই যেন হয়। 

লগার সঙ্গে জাল বেঁধে দেওয়া আছে। হালে বসে আছে প্রকাশ। গুনগুন করে গান গাইছে। চমৎকার গলা ওর। তা ছাড়া গান বিনা ও থাকতে পারে না। গুনগুনানি শুনতে শুনতে আকবর আলি পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে লুঙ্গি তুলে প্রস্রাব করতে করতে বলে— তুই কি হাগতে হাগতেও গান গাস নাকি রে প্রকাশ? 

প্রকাশ দাঁত বার করে হাসে। নৌ-চালনায় দক্ষ সে। সে মাছ ধরায় যেমন, তেমনি নৌ-চালনায়ও আকবর আলির সঙ্গী। বাইচের জন্য সে একজন গুরুত্বপূর্ণ লোক। তাদের সঙ্গে আছে যে ইসমাইল সে বয়সে প্রকাশ ও আকবর আলির চেয়ে ছোট। তবু বিড়ির নেশা বা রসালাপের সঙ্গী হওয়ার অধিকার তার আছে। 

প্রকাশের হাসি দেখে আকবর আলি বলল— তুই কি মাগকে ইয়ে করতে করতেও গাস?

প্রকাশ একইভাবে হাসল। বলল—না। ইয়ে করার আগে গাই। তখন তো মুখে অন্য জিনিস। 

এ মন্তব্যে তিনজনই হা-হা করে হাসে। হাসি থামিয়ে আকবর আলি বলে – বাব্বা! কী আওয়াজ! হাসির চোটে মাছ পালাবে। ইসমাইল বিড়ি বার কর। 

ইসমাইল গেঁজে থেকে বিড়ি আর দেশলাই বার করে আকবর আলিকে দিল। আকবর আলি বলল— তা গান শুনে তোর বিবির গা গরম হয় তো? 

—তা হয়। তোমার বিবিকে শুনিয়ে আসব একদিন, দেখবে। 

আকবর আলি কপট ক্রোধ দেখায়। বলে শালা! মারব পাছায় লাথি। 

ইসমাইল খিক খিক করে হাসে। আকবর আলি তাকে গালি পাড়ে। প্রকাশ বলে—আকাশটা ছিমড়ে আছে কেন বলো দেখি! এ যেন শাশুড়ির মুখে ঝাল পান। 

আকবর আলি বলে—শাশুড়িদের মুখ চিরকালই এমনি থাকে। বউকে সোনায় মুড়ে দিলেও পৃথিবীর সব শাশুড়ি বলবে, মেয়ে আমার কী দুখী! তা প্রকাশ, তুই শাশুড়িকে গান শোনাস? 

—শোনাই। 

—কী শোনাস? বউকে যে গান গেয়ে গরম করিস সে গানই শাশুড়ির জন্যও গাস নাকি?

—তা বলতে পারো। আমার শাশুড়ির জোয়ানি আছে এখনও। 

—শোনা না দেখি কী গান। গলা খোল। এ শালার ভ্যাটকা আকাশ মন খারাপ করে দিচ্ছে। বাতাস দিচ্ছে দেখো। 

তাদের রসালাপের মানা নেই। নিজের মা-বোন বাদ দিয়ে পৃথিবীর যে কোনও সম্পর্কিতা তাদের রসালাপের বস্তু। মা-বোন তোলে তারা ক্রুদ্ধ হলে। সে নিয়ে হাতাহাতি হয়। লাঠালাঠি অবধি গড়ায় মা-বোন তোলা গালির উপসংহার। 

ইসমাইল বলল—আরে প্রকাশভাই গান করবে কী! এই হাওয়ায় তো দাঁতে খটাখটি লেগে যাবে। 

—আরে শীতে গান গাইলে গা গরম হয়। তা ছাড়া ও তো গাইবে ওর বিবি গরম করা গান। শুনলে তোর ল্যাওরা খাড়া হয়ে যাবে শালা। 

তীব্র পচা গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে গেল তখন। অদূরে ভেসে চলেছে গলিত গাভীর শব। কয়েকটি কাক উড়ে উড়ে তার উপর বসছে আর খুবলে নিচ্ছে মাংস। খানিকক্ষণ ওই শবের ওপরেই বসে ভেসে চলেছে। এই মুহূর্তে শবই তাদের খাদ্য, শবই অবলম্বন। আকবর আলি আকাশের দিকে তাকাল। কোনও বিন্দু নেই। আজকাল আর শব ভক্ষণ করার জন্য শকুন নেমে আসে না। এলেও দেখা যায় কালে-ভদ্রে। আগে নদীপাড়ে এক-একটা গাছ ভরে থাকত শকুনে শকুন মেরে তাই দিয়ে যৌনতা বৃদ্ধির তেল বানাত বেদেরা। ধনী বৃদ্ধেরা কিনত সেই তেল বহু মূল্য দিয়ে। 

দুর্গন্ধ অগ্রাহ্য করার আগে প্রকাশ মুখভর্তি থুতু ফেলল জলে। তারপর জোর গলায় ধরল গান। এই শীতে মুখ-মাথা চাদরে জড়ানো। মুখের চাদর সরিয়ে নিল সে। 

চান্দের সমান মুখ করে ঝলমল।
সিন্দুর রাঙিয়া ঠোঁটে তেলাকুচা ফল ॥
জিনিয়া অপরাজিতা শোভে দুই আঁখি।
ভ্রমর উড়িয়া আসে সেই রূপ দেখি॥
আষাঢ় মাইস্যা বাঁশের কেরুল মাটি ফাইট্যা উঠে।
সেইমতো পাও দু’খানি গজন্দমে হাঁটে॥ 
শ্রাবণ মাসেতে যেন কাল মেঘ সাজে।
দাগল দীঘল কেশ মাথাতে বিরাজে॥
হিরামোতি জ্বলে কন্যা যখন যখন হাসে।
সুজাতি বর্ষার জলে যেমন পদ্মফুল ভাসে॥
পদ্মের সমান কন্যার যেমন মুখখানি।
চক্ষু দুইটি দেখি ভাল নাচয় খঞ্জনি ॥ 

কেয়াবাত বলল তারা। বাহবা জানাল। তারা জাল টানল এবার। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাছেরা রোদ পোহাতে উঠে আসে ওপরের দিকে। কিন্তু আজ রোদ্দুর ওঠেনি। তা ছাড়া মাছ আর এমন কোন তলানিতে লুকোবে! পলি পড়ে পড়ে ভাগীরথীর নাব্যতা যে কতখানি কমে এসেছে, তা জানে জেলেরা। শীতে এমনও হতে পারে যে তাদের নৌকা জলের আড়ালে লুকনো চরায় আটকে গেল। 

কয়েকটি কুচো মাছ ছাড়া জালে পড়েনি কিছু। আকবর আলির ভাগ্য আজ প্রসন্ন নয়। মনে জেদ চেপে বসছে তার। এ প্রায় খালি হাতে ফিরে যাবার সমান। কিন্তু সে আবার চেষ্টা করবে। ভাটির সময় হয়ে এসেছে প্রায়। সে আগ ভাটিতে জাল ফেলবে। ভাটিতে জাল ফেললে জালের ক্ষতি হয়। স্রোতের শক্তি চাপ বাড়ায় জালে। জাল ছিঁড়ে যায়। তবু সে শূন্য হাতে ফিরতে চাইল না ঘরে। দক্ষিণে নৌকা টানতে বলে দিল প্রকাশকে। দূরে দূরে আরও নৌকা আবছা হয়ে আছে। হু-হু হাওয়াকে পরোয়া না করে তারা দাঁড়ে বসল। সেচ দপ্তরের লঞ্চ চলে গেল একটা পাশ কাটিয়ে। জল দুলে উঠল। নৌকাও হল টালমাটাল। এসব তার অভ্যাস। কুশলী হাতে তারা সামলে নেয় সমস্ত দুলুনি। বর্ষায় ঝোড়ো হাওয়ায় ঢেউ ওঠে যখন, তা-ও তারা সামলে নেয়। মৎস্যজীবীর জীবনে ঝঞ্ঝার সম্ভাবনা সবসময় থাকে। কারণ ঝড় খুব বেশি পূর্বাভাস দিয়ে আসে না। অভিজ্ঞ মাঝি ঝড়ের মেঘ চিনে নেয় ঠিকই কিন্তু মাঝদরিয়ায় থাকলে সে-চেনা আর না-চেনায় তফাৎ কী! 

বর্ষায় তারা সাধারণত বেতারে বলা আবহাওয়ার খবর শোনার চেষ্টা করে। কিন্তু বেতারের খবর মূলত সমুদ্রকেন্দ্রিক। অবশ্য আবহাওয়া ভেবে জলে নামার মতো অবস্থা আকবর আলির মতো জেলের নেই। দরিদ্র, ঋণী মৎস্যজীবী সব। একদিন মাছ না উঠলে খোরাকিতে টান পড়ে। তা ছাড়া আছে ঋণের জ্বালা। নৌকা মেরামতের ঋণ, জাল কেনার ঋণ, সংসারে কারও বিয়ে-সাদি লাগলে ঋণ। ঋণের আর শেষ নেই। মাছ ধরে জেব এমন ভর-ভরতি হয় না যে বাড়তি খরচের ধাক্কা ঋণ না নিয়েও সামলে দেওয়া যায়। তার ওপরে আছে ঋণের সুদ। চড়া হারে সুদ দেবার লোক গ্রামে ঘোরাফেরা করে। সুকুমার পোদ্দারের ঋণে সুদের হার কম। ব্যাঙ্কের হারে তিনি সুদ টানেন। সেদিক থেকে কুসীদজীবী বলা যাবে না তাঁকে। এইসব দরিদ্র জেলেরা ঋণ পায় না ব্যাঙ্ক থেকে। তিনি এ গ্রামে ব্যাঙ্কার হয়ে আছেন। তবে সারা গ্রামের ঋণের চাহিদা মেটাবেন, তাঁর সাধ্য কী! অতএব ঋণ দেবার আগে তিনি বাছ-বিচার করেন। পাত্রের যোগ্যতা বিচার করে নেন অভিজ্ঞ চোখে। যাঁরা তাঁর এই পবিত্র সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়, তাদের মহাজন ভরসা। 

কুড়ি-পঁচিশ বছর আগেও কাবুলিওয়ালারা গ্রামে সুদে ধার দিত। এখন তাদের জায়গা নিয়েছে দেশিরাই। ঘরের লক্ষ্মী পরকে দেওয়া কেন! নৌকার মহাজন, মাছের আড়তদার- যে- কেউ হতে পারে ঋণদাতা। 

আড়তদারকে জেলেরা বলে নিকারি। নিকারিরা পয়সাওয়ালা। তারা নাকি সোনা দিয়ে দাঁত বাঁধায়। তারা জেলেদের মারে দু’ভাবে। মাছের দামে আধখানা মারে, ঋণ দিয়ে সুদ টেনে মারে আরও আধখানা। 

জেলেরা বলে— এ আর নতুন কী! চিরকালের এ নিয়ম। 

সরকারি সমবায় মৎস্যচাষ প্রকল্প ছাড়া, প্রকল্পের বাইরের মৎস্যজীবীর জীবন এমনই। তারা বলে— 

জেলের পোঁদে টেনা। 
নিকারির দাঁতে সোনা ॥

সুতরাং তাদের নির্ভর করতে হয় মা-বোন-বিবির রোজগারের ওপর। এভাবে নির্ভরশীল হতে হতে এমনকী অলস হয়ে যায় কোনও কোনও পরিবারের পুরুষ। 

আলস্য ঘৃণা করে আকবর আলি। তা ছাড়া তার অলস হওয়ার কোনও উপায় নেই। তার আছে পোদ্দারবাবুর থেকে নেওয়া ঋণের দায়। আছে নতুন একটি নৌকার স্বপ্নের দায়। এবং দায় তার সংসারের প্রতি। সে বুঝতে পারছে, আফসানা রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ছে বিড়ি বাঁধতে গিয়ে। কিন্তু সে কিছুই করতে পারছে না। তার ওপর পাড় ভাঙছে চতুষ্কোনার প্রাপ্ত জুড়ে। নদীর ভাঙাগড়ায় আপাতচক্ষে মৎস্যজীবীর কোনও হিস্যা নেই। সে জলের প্রাণী। জলই তার জীবিকা। কিন্তু তলিয়ে দেখলে জল তার সম্পূর্ণ জীবন নয়। জলচর মানুষেরও থাকে ডাঙার প্রতি টান। কারণ তার জীবন বাঁধা থাকে সেখানেই। কাজের অবসরে যে-ঘরে তারা ফেরে, যেখানে থাকে তাদের সন্ততি, প্রিয়া। সেই ভিটের আনাচে-কানাচেই তাদের প্রাণভোমরা ঘুরপাক খায়। ডাঙায় ওই টানের জায়গাটি থাকে বলেই জলে যাবার তাগিদ থাকে তাদের। পাড় ভাঙলে ভিটে তলিয়ে যাবার ভয় থাকে। একবার ঘর গেলে, জমি গেলে, তারা মাথা গুঁজবে কোথায়? 

নৌকা চতুষ্কোনার সীমা পেরিয়ে গেছে। আকবর আলি এক জায়গার জল লক্ষ করে জাল ফেলার তোড়জোড় করল। আকাশে মেঘ। তবু এ মেঘ বর্ষার নয়। আহা! বর্ষায় মাছ ধরে যত সুখ তত সুখ আর কিছুতে নেই। তখন ধরা পড়বে কত ইলিশ! সেসব মহাজনেরা কিনে নেবে। কিনে নেবে আড়তদার। তার কিছু বেচবে। কিছু তুলে রাখবে হিমঘরে। ইলিশের মরশুম ফুরোলে হিমঘর থেকে বার করবে জ্যান্ত লাশের মতো ইলিশ। বিক্রি করবে চড়া দামে। সে দামের কণামাত্র পৌঁছবে না জেলের ঘরে। 

আকবর আলি শুনেছে, আগে ধরা পড়ত যত ইলিশ, এখনকার তুলনায় তা অনেকগুণ বেশি। তখন তার বাপ মহম্মদ আলিরও জন্ম হয়নি। এত ইলিশ উঠত তখন যে, ইলিশ খেয়ে খেয়ে কলেরা ধরে যেত গ্রামে-গঞ্জে। সরকার তখন বাজারের সব ইলিশ বাজেয়াপ্ত করে মাটির তলায় পুঁতে ফেলত। সমুদ্র উপকূলের জেলেরা রাশি রাশি তৈরি করত নোনা ইলিশ। কোথায় গেল সেইসব দিন! ইলিশের সংখ্যা কমেছে? নাকি খাবার মুখ বেড়েছে? লোকসংখ্যা তখনকার কালে ছিল একালের অর্ধেকেরও কম। এই গ্রামেই দেখতে দেখতে কত লোক বেড়ে গেল। গ্রাম ক্রমশ জনবহুল হয়ে উঠছে। সীমান্ত পেরিয়ে আসা কত লোক বসত গড়ছে তার হিসেব নেই। আকবর আলি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এ কালে ওই পরিমাণ ইলিশ পেলেও কিছুই পড়ে থাকত না। সব চালান হয়ে যেত ভাল দামে। 

মেঘ কিছু ফিকে হয়েছে এতক্ষণে। মেঘ সরে গেলেই হাওয়া আরও কনকনে হয়ে বিঁধবে। এখন তাদের অপেক্ষা করতে হবে ঘণ্টা আড়াই। ইসমাইল হাতে হাত ঘষছে। বলছে—মনে হয়, বাঘা শীতে মাছগুলা বরফ হয়ে গেছে। 

আকবর আলি মেঘ নিরিখ করে। রোদ্দুর আর একটু তীব্র হলেই মাছ পাবার আশা বাড়বে। তার মন প্রসন্ন হয়ে আসতে থাকল। ক্ষিদে অনুভব করল সে। অন্য সবার পেটেও তাত লেগেছে নিশ্চয়ই। সে বলল— চল এইবেলা খেয়ে নিই। 

খাবার কথায় সকলেরই মনে স্ফুর্তি আসে। একে একে যে-যার পাত্র খুলে, ছাঁদা খুলে ভাত খেতে বসে। জলভাত। ভাতের সঙ্গে পেঁয়াজ পোড়া কিংবা শুঁটকির তরকারি। আকবর আলির সঙ্গে আছে মাছ-ভাজা। তারা খাচ্ছে, এমন সময়ই রোদ্দুর উঠল তেজি হয়ে। আকবর আলি বলল— আর একটা গান কর প্রকাশ। রোদ্দুরটা জমুক আরও। 

প্রকাশ বলল— তোমাকে কি আজ গানে পেল আকবর ভাই?

— কথা না বলে গান কর। ফিল্মের গান নয়। তোর গান। 

—নিজের গান আর কোথায়? সবই শেষ। 

—এ বড় আশ্চর্য বটে প্রকাশ। 

—কী আকবর ভাই? 

—এত গান তুই শিখলি কোথায়? একসঙ্গেই তো বড় হলাম সব। এত গান কখন তোর মধ্যে ঢুকে পড়ল বল দেখি! 

—আমার বাপ আলকাপের দলে ছিল জানো তো? গান গাইত।

—তা জানি। 

—সংসার দেখত না। খালি ওই ছিল নেশা। 

প্রকাশ উদাস হয়ে রইল কিছুক্ষণ। সম্ভবত পিতৃস্মৃতি ভারাক্রান্ত করেছে তাকে। গান গাইত আর মদ খেত লোকটা। সংসার সম্পর্কে ছিল সম্পূর্ণ উদাসীন। অথচ প্রকাশকে খুব ভালবাসত। তার মা ঢেঁকি পাড় দিয়ে, মুড়ি ভেজে রোজগার করত। এখন বর্ধিষ্ণু গ্রামগুলিতে ঢেঁকি নেই বললেই চলে। ভিতরের গ্রামে তবু পাওয়া যায়। যোগাযোগ ব্যবস্থা যেখানে অনুন্নত, জমির আল ছাড়া কোনও পথ নেই, সেখানে ধানের বস্তা ঘাড়ে করে লোকে আর কোন চালকলে ধান ভানতে যাবে। সেসব জায়গায় আজও ঢেঁকি সম্বল। গ্রামে ঢেঁকি আছে মাত্র সুকুমার পোদ্দারের বাড়ি। সেখানে নিয়ম করে ধান ভানা হয়। ব্যবসায়ের ধান। শহরের বাজারে ঢেঁকি-ছাঁটা চালের কদর এখন আভিজাত্যের পর্যায়ে চলে গেছে। 

প্রকাশের মায়ের এখন আর ঢেঁকিতে পাড় দেবার শক্তি নেই। কিন্তু সে মুড়ি ভাজে এখনও। খই ভাজে। 

আকবর আলি প্রকাশের উদাসী হওয়া লক্ষ করে বলে—চাচার গলাটা ছিল মিঠা। আমার মনে আছে! সব গান চাচার থেকেই শিখলি? 

—না। সব না। কিছু। তা ছাড়া যেখানে যেমন শুনি, তুলে নিই। 

—গা একখানা গা। 

উত্তুরে হাওয়ার চাপে নৌকা ধীরে দক্ষিণমুখী সরে সরে যায়। আকবর আলি ডাকে— ইসমাইল। 

—জি। 

—নৌকা লাগা ভাল করে। 

—জি। 

প্রকাশ একটা বিড়িতে সুখটান দেয়। বলে- বোকার গান শুনেছ কখনও? 

—বোকার গান? সে কীরকম? 

সে শুরু করে— 

বোকার মধ্যে বোকা বলো বোকা হল এক।
বামুনকুলে জন্ম লিয়া যেজন লিল ভেক॥
বোকার মধ্যে বোকা বলো বোকা হল দুই।
সমস্ত ঘর ছাইয়া যেজন ঘরের না মারে টুই॥
বোকার মধ্যে বোকা বলো বোকা হল তিন।
নিজের টাকা দিয়া যেজন পরের করে ঋণ॥
বোকার মধ্যে বোকা বলো বোকা হল চার।
নিজে না করে উপায় বউয়ের উপায় খায়॥
বোকার মধ্যে বোকা বলো বোকা হল পাঁচ।
পরের পুকুর যেজন ভাগে ছাড়া দেয় মাছ॥
বোকার মধ্যে বোকা বলো বোকা হল ছয়।
নিজের টাকা লিয়া যেজন পরের বাড়ি থোয়॥ 
বোকার মধ্যে বোকা বলো বোকা হল সাত।
নিজের বাপরে ভাত দেয় না শ্বশুররে দেয় ভাত॥
বোকার মধ্যে বোকা বলো বোকা হল আট।
স্বামী বর্তমানে মাগি করা দেয় হাট ॥ 
বোকার মধ্যে বোকা বলো বোকা হল নয়।
বউ মারা গ্যালেও যেজন শ্বশুরবাড়ি রয়॥
বোকার মধ্যে বোকা বলো বোকা হল দশ।
নিজের জমি থুইয়া যে দেয় পরের জমি চাষ॥
বোকার মধ্যে বোকা বলো বোকা হল এগারো-
এগারো নম্বর বোকা রে ভাই তার কিবা দশা। 
দুই মাস দুই জনার চলত দশমাস খায় বস্যা॥

সমবেত হাসির দমকে দুলে উঠল নৌকা। আকবর বলল—যা একখান শুনাইলি প্রকাশ, অখন চুতমারানি মিঞা ছায়েরা ভাবতে বইব কে কুন লম্বরের বুকা! 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *