রাজপাট – ২৩

২৩ 

আগন মাসে মাগন নাই 
মাঠে সুনার ধান।
গোলার ঘরে ইন্দুরে লয় 
ধানের সন্ধান॥ 
ভরা ধানের লাখান মাইয়া 
পথ চাইয়া রয়। 
রাঙ্গা জামাই ধইরা আনো 
ভাইরে গিয়া কয় ॥
ভাই কইসে যামু গো বুইন
ধান না তুলি আগে।
রাঙ্গা জামাই আনতে ম্যালা 
কড়ি ফেলন লাগে ॥ 

কেঁপে উঠল তুলতুলি। হালকা লালের আভা পড়ল তার গালে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে সে অনির্বাণকে ঠেলে দিয়ে বলল— অসভ্য! কেউ দেখলে কী হবে! 

—কে দেখবে? 

—ওই দেখো। বসে আছে। ঠিক দেখেছে। ইস্! তুমি যে কী করো! 

—ও তো মোবারক আলি। জেলেপাড়ায় থাকে। চেনো না? 

—দেখেছি। নাম জানি না। কিন্তু মোবারক আলি কি চোখে দেখতে পায় না? 

—পায় তো? 

—তা হলে? 

—তা হলে কী? আমার বউকে আমি যা খুশি করব। কার কী? 

—বউ হইনি এখনও অনুদা। 

—হওনি। হবে। 

তুলতুলি উদাসী হয়ে যায়। মুখের লালিমা মুছে গিয়ে আশঙ্কার বিবর্ণতা জাগে। বাতাসের শিরশিরানি তার মেরুদাড়া সম্বল করে বয়ে যেতে চায়। বাইরের শান্ত ভাবের তলায় তলায় সে পাগল-পাগল অস্থির-অস্থির! যত দিন যাচ্ছে, তত সে শঙ্কিত, ত্রস্ত। সে বলে—কী জানি! হব কি না! 

অনির্বাণ আহত হয় এ কথায়। তার মুখের তারল্য অন্তর্হিত হয়। সে গম্ভীর গলায় বলে— আমাকে বিশ্বাস করিস না? তুলতুলি? 

—ছিঃ! বিশ্বাস করব না কেন? 

—তা হলে যে বললি? 

—তোমাকে বিশ্বাস না করলে পৃথিবীতে আর কাকে বিশ্বাস করব বলো তো! 

সে অনির্বাণের হাত নিজের হাতে নেয়। চাপ দিয়ে ছেড়ে দেয় আবার। ছাড়তে তার ইচ্ছে করে না। কিন্তু কেউ যদি দেখে ফেলে! গ্রামে অনির্বাণের সঙ্গে দেখা করতে তার ভয় লাগে। কিন্তু অনির্বাণ চাইলে না করতে পারে না। আর অনির্বাণ তার অস্বস্তি জেনেও গ্রামের মধ্যেই তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে চায়। হাত ছেড়ে দিয়ে সে বলে—আসলে সবকিছু তো আমাদের হাতে থাকে না অনুদা। 

— তা ঠিক। 

—অনুদা। 

—বল। 

—এখানে আমাদের বসা ঠিক হচ্ছে না। 

—বড্ড ভয় পাস তুই তুলি। 

—পাই তো। সেদিন বলাইকাকা আমাদের দেখে ফেললেন। কী ভাবলেন বলো তো! অনির্বাণ শব্দ করে হাসে। বলে—কী আবার ভাববেন! ভাববেন আজকালকার ছেলেমেয়েগুলো কী পাকা! আমরা এরকম ছিলাম না। অথচ দেখ তুলি, আগেকার দিনের মানুষেরা কত তাড়াতাড়ি বিয়ে করতেন! ইস! কেন যে রেওয়াজটা চলে গেল! এতদিনে তিন ছেলের বাবা হয়ে যেতাম। 

ধুর! তোমার খালি ফাজলামো! শোন অনুদা, কেউ যদি দেখে আমার বাবাকে বলে দেয়, আমি কিন্তু পিটুনি খাব। 

—ইস! আমার বউয়ের গায়ে হাত তুলুক তো দেখি! 

—কী করবে? 

—তোকে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করব। 

বিয়ের প্রসঙ্গে তুলি উদাস হয়ে গেল আবার। অনির্বাণ তার একখানি হাত নিজের হাতে তুলে নিল। তুলতুলি শাড়ির আঁচল অন্য হাতে নিয়ে খেলতে খেলতে বলল— হুঁ! বিয়ে! মা আমার সম্বন্ধ দেখছে অনুদা। তুমি যদি তাড়াতাড়ি কিছু না করো, অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে যাবে আমার। 

অনির্বাণ তুলির হাত ছেড়ে দিল। অগ্রহায়ণের শান্ত নদীও বুঝি উদাসী হল তাদের সংলাপ শ্রবণ করে। এমন কত সংলাপ সে শুনে আসছে জীবনভর। তার পাড়ে পাড়ে কত জনপদে রচিত হয়েছে এমনই প্রেমকাহিনি। কখনও প্রেমিকযুগল মিলিত হয়েছে, কখনও নিদারুণ বিচ্ছেদযন্ত্রণা সয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে ভেসে গেছে দু’দিকে দু’জন। কতজন আত্মাহুতি দিয়েছে এই নদীতেই। নদী আর কী বলে! সে তার নিজের ভাষায় বাতাসে বাতাসে ছড়িয়ে দিল আশীর্বাদ। মঙ্গল হোক। ওদের মঙ্গল হোক। অনির্বাণের বুকে তার পরশ পৌঁছল না। সে বলল—আমাকে ছাড়া অন্য কারওকে বিয়ে করতে পারবে তুমি তুলি? 

তুলতুলি মুখ ঢাকল দু’হাতে। অনির্বাণ দেখল তার নুয়ে পড়া শরীর। বেঁকে-চুরে যাওয়া পিঠ। সেই পিঠে লম্বা বিনুনি। ঘাড়ের কাছে নরম কুচো কুচো চুল। তার কানে সোনার ক্ষুদ্র বলয় লতিতে ঠেকে গেছে। ছোটবেলায় পরা গয়না। পরনের শাড়িখানি তার অতি সাধারণ। সুতির ওপর ফুলছাপা। গভীর মায়ায় টনটন করছিল অনির্বাণের বুক। এই মেয়েটি, এই নরম শান্ত মধুরা মেয়েটি তাকেই অবলম্বন করে স্বপ্নে ভরিয়েছে মন। সমস্ত প্রেম সাজিয়ে নিবেদন করেছে তাকেই। সেও তার সকল প্রেমে, পরিপূর্ণ ভালবাসায় এই মেয়েটিকে সিক্ত করে দিতে চায়। সে উপলব্ধি করছে। তার কিছু করা দরকার। যদিও পৈতৃক ব্যবসার দেখাশোনাই তার ভবিতব্য বলে সে জেনেছে, কিছু শুরুও করেছে সে কাজ। বহরমপুরে চালের আড়ত দেখাশোনা করে সে এখন। মাঝে মাঝে সে যায় চালকলে। চাকরির ভাবনা তার কল্পনাতেও আসে না। সুকুমার পোদ্দারের একমাত্র সন্তান সে। পৈতৃক সম্পদ আরও সমৃদ্ধ করাই তার কাজ। 

তুলতুলি চেয়েছিল অনির্বাণ একটা চাকরি খুঁজে নিক। বাবার ব্যবসার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হতে গেলে সময় লাগে। তাদের মিলনের পক্ষে সেই দীর্ঘ সময় বড় বাধা-ব্যবধান। কিন্তু চাকরি কি চাইলেই পাওয়া যায়? সাধারণ স্নাতক সে। কোনও মতে পেরিয়েছে শেষ পরীক্ষা! পড়াশোনা করে প্রতিযোগিতায় নেমে চাকরি অর্জনের কোনও উৎসাহই তার নেই, কারণ তার প্রয়োজনও নেই। 

যদিও তুলতুলির এই ইচ্ছার পেছনে আড়াল করা আছে অনেকগুলি বাস্তব সমস্যা। তুলতুলির বাবা সহদেব দাস একজন সাধারণ কৃষক। সুকুমার পোদ্দারের পক্ষে তুলতুলিকে বধূ হিসেবে মেনে নেওয়া কঠিন। অনির্বাণ বাবার ওপর নির্ভরশীল থাকলে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেবে কী করে! আর স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা না থাকলে অনির্বাণের সঙ্গে তুলতুলি মিলিত হতে পারবে না কিছুতেই। 

অনির্বাণের বুক মুচড়ে ওঠে। এই মেয়েটিকে ছাড়া নিজের জীবন কাটানোর কথা ভাবতেও পারে না সে। কীভাবে বাবার কাছে তুলতুলির কথা বলবে সে জানে না। আর জানে না বলেই ইদানীং গ্রামের মধ্যেই সে তুলতুলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা প্রদর্শন করছে। সে চাইছে কেউ গিয়ে এই ঘনিষ্ঠতার কথা তার বাবাকে বলুক এবং সুকুমার পোদ্দার নিজে এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করুন। নিজে থেকে এ বিষয়ে তার বাবাকে কিছু বলার কথা সে ভাবতেও পারে না। তাকে জিগ্যেস করলে সে বলবে। নিশ্চয়ই বলবে। কিন্তু কী বলবে? ‘আমি তুলতুলিকে ভালবাসি। আর ওকেই বিয়ে করব।’ একথা কি সুকুমার পোদ্দারকে বলা যায়? 

তুলতুলির থেকে চোখ ফেরাচ্ছিল না সে। মায়াময় হৃদয় হতে সে চাইছিল তুলতুলিকে ভরসা দিতে। পিষে ফেলতে বুকের সঙ্গে। কিন্তু মোবারক আলি এখনও এদিকেই তাকিয়ে বসে আছে। সে জোর করে তুলে দিল তুলতুলির মাথা। দেখল, তার গাল ভিজে গেছে। নাকের ডগা লাল। আঠা লাগানো ছোট নীল টিপ স্থানচ্যুত হয়ে নেমে এসেছে। সেই নীলাভ নাসিকার লালাভার ওপর যেন রামধনু রচনা করছে। বড় অসহায়, অভিমানী লাগছে তুলতুলিকে। কিন্তু বড় আদরণীয়াও লাগছে। এই অসহায়তাই তুলতুলির চূড়ান্ত সমর্পণের অভিব্যক্তি। সে তুলতুলির হাতখানি হাতে নিয়ে ধরা গলায় বলল—এই, কাঁদিস না তুলি। তুই কাঁদলে আমার খুব খারাপ লাগে! 

তুলতুলি ভরসা পেতে পারে, এরকম কোনও কথা সে গুছিয়ে বলতে পারল না। তুলতুলি বলল—তোমাকে ছেড়ে থাকার কথা আমি ভাবতে পারি না অনুদা। আমার যদি অন্য কোথাও বিয়ে হয়, আমি ঠিক মরে যাব। 

বুকের মধ্যে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করল অনির্বাণ। দাঁতে দাঁত চাপল সে। চোখের জলের সঙ্গে মৃত্যুকামনা মিশিয়ে ফেলেছে মেয়েটা। সে লঘুভাবে তা উড়িয়ে দিতে পারে না। কোনও কিছুকেই পারে না তাচ্ছিল্য করতে। নিজেকে অসহায় ও অক্ষম লাগে তার। রাগ হয় নিজের ওপর। কেন সে বাবাকে বা মাকে বলতে পারছে না? কেন এই সাহস নেই তার? সে তো কোনও অন্যায় দাবি করছে না। 

তবু, তবু সে হেরে যেতে থাকল নিজের ভেতর। সকল প্রস্তাবসহ পিতার মুখোমুখি হওয়ার সাহস তার নেই। তার অন্তরের অন্ধকারে কঠিন প্রশ্ন নিয়ে এসে দাঁড়াচ্ছে কেউ। বলছে— কীসের ভয় তোমার অনির্বাণ? 

জানি না। 

তিনি হয় হ্যাঁ বলবেন, নয়তো না বলবেন। তার বেশি তো কিছু হবে না। 

জানি তো। 

তা হলে? 

জানি না। জানি না। 

তুমি কি মনে করো, ওই প্রস্তাব উত্থাপন করলে সুকুমার পোদ্দার তোমাকে সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করবেন? 

সম্পত্তি? না না। সম্পত্তি নিয়ে আমি ভাবিনি। 

তা হলে? তুমি কি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে? 

না! না! 

নাকি তোমার মধ্যে সেই ব্যক্তিত্বের অভাব যা নিজস্ব সিদ্ধান্ত নিতে বাধা দেয়! 

ওঃ! ভগবান! 

তুলতুলিকে কতখানি চাও? 

চাই! চাই! চাই! 

মানবহৃদয়ে প্রেম যুক্তি বিচার করে উৎসারিত হয় না কখনও। পাত্র বিচার করেও হয় না। সাহসী পুরুষই প্রেমিক নয় শুধু। বরং এমন হয়ে থাকে, প্রেম কাপুরুষের সাহস সঞ্চার করে। নারীও তার ব্যতিক্রম নয়। পাত্রাপাত্র ভেদ নেই বলেই, সম্পদশালীর সঙ্গে কপর্দকহীনের প্রেমও ভালরকম জমে ওঠে, ধর্মাধর্ম ভেদ ঘুচিয়ে জমে ওঠে, রূপ-গুণের বিচারও প্রেমের সয় না। এবং এমত ধর্মের জন্যই প্রেমের একই কাহিনি এ জগতে পুনর্নির্মিত হয়। 

এই অসহায় সমস্যাকে বুঝে যদি অনির্বাণ বা তুলতুলি তাদের প্রেম বিনিময় করতে বসত, তা হলে বিনিময় ঘটার আগেই তাদের জাগ্রত বোধ তাদের নিরস্ত করত। পৃথিবীর সকল প্রেমিক যুগলের ক্ষেত্রেই ঘটত এমন এবং প্রেম এমনই বর্ণময় হয়ে, বেদনাতুর কিন্তু বৈপ্লবিক হয়ে জীবনকে করে তুলত না মধুর। মানবহৃদয় হত না সেই মধুর অভিলাষী। 

মিলন নয়, বিচ্ছেদ নয়, প্রেমের সৌকুমার্য তার সঞ্চারে। এর স্পর্শেই রক্ত-মাংসের হৃদকমল প্রাণভরে আলোর দল মেলে। 

সে তুলতুলির নাকে নেমে আসা ছোট্ট টিপ আঙুলে চেপে তুলে দিল যথাস্থানে। তারপর ফিরে তাকাল। মোবারক বসে আছে আগের মতোই। সে তাকাল জলের দিকে। ভাগীরথীর জল নেমে এসেছে। স্পষ্ট হয়ে উঠেছে পেতনির চর। এ নদী এতদিন তাদের পালন-পোষণ করেছে। দিয়েছে শস্য। দিয়েছে ফল। মাছ। দিয়েছে শীতল বায়ু। এখন সে পাড় ভাঙছে। সে জানে তাদের আমবাগান বাঁচানোর চেষ্টা হচ্ছে খুব। বাবার দুশ্চিন্তা সে অনুমান করতে পারে। নদী এখন ভাঙছে অল্পে অল্পে। কিন্তু কখন কতদূর সে গ্রাস করে নেয়—তার ঠিক কী! এই সময় বাবাকে সে বিবাহের কথা কী করে বলতে পারে! 

সে কোনও উপায় খুঁজে পাবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে। এবং পেয়ে যায়। যদি কাগজে-কলমে বিয়েটা সেরে রাখে তারা তা হলে সংসার শুরু করার কোনও ব্যস্ততা থাকে না। তারা নিশ্চিন্তে কিছুটা গুছিয়ে নিতে পারে। সে উজ্জ্বল চোখে তুলতুলির দিকে তাকায়। তৎক্ষণাৎ বুকের মধ্যে যে মর্মর জাগে, তাকে সে চিনতে পারছিল ভালবাসা বলে। এই মেয়েটিকে সত্যিই সে বড় ভালবাসে! তুলতুলির হাতে চাপ দিয়ে সে বলল-তুলি, রেজিস্ট্রি বিয়ে করবি? 

তুলতুলি হাঁ করে তাকিয়ে রইল অনির্বাণের দিকে। এই প্রস্তাব হৃদয়ঙ্গম করতে কিছুক্ষণ সময় নিল সে। তারপর বলল—রেজিস্ট্রি? কেউ যদি জানতে পারে? 

—কী করে জানবে? আমরা বহরমপুরে রেজিস্ট্রি করে নেব। 

—বহরমপুরে জেঠুর কত চেনা লোক। 

—সবাই তো চেনা নয়। 

—আমার ভয় করে অনুদা। বাবা-মায়ের আশীর্বাদ না নিয়ে বিয়ে করলে সে বিয়ে সুখের হয় না জানো? 

—কিছু তো একটা করতে হবে তুলি? আশীর্বাদ পরে পাব আমরা। তা ছাড়া অত ভাবলে কি চলে? 

—তাই বলে লুকিয়ে চোরের মতো বিয়ে করতে হবে? 

—এ ছাড়া আর কী পথ আছে? 

—তুমি সরাসরি জেঠুকে বলো। যা হবার হবে। আমি আর ভাবতে পারছি না। 

—তুই কলেজটা পাশ করে নে তুলি। সহদেবকাকা এটুকু সময় কি তোকে দেবেন না? 

—কেন দেবেন? আমাদের মতো ঘরে ভাল সম্বন্ধ এলে কেউ ছাড়ে বলো? তা ছাড়া আমার পড়ার পেছনে কত খরচ! রোজ বাসে যাওয়া-আসা! বই-খাতা! বাবা আর পারছেন না আমি বুঝি। 

—রেজিস্ট্রি করা ছাড়া কোনও পথ নেই তুলি। 

—রেজিস্ট্রিটাও কোনও পথ নয়। আমাদের কলেজে পড়ে ময়ূরীর দিদির রেজিস্ট্রি করা বিয়েটাও ভেঙে দেওয়া হয়েছে। একটি মুসলমান ছেলের সঙ্গে ওর দিদি রেজিস্ট্রি বিয়ে করেছিল এই ভেবেই, যদি বিয়েটা কারও বাড়িতে মেনে না নেয়। শেষ পর্যন্ত মানেনি তা বটেই, ওদের ডিভোর্স করিয়ে ছেড়েছে। এরকম হলে আমবাগানে গলায় দড়ি দেওয়া বা গঙ্গায় ডুবে মরা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে আমার? বলো? 

—তুলি! 

অনির্বাণ মুখ ফেরাল। দু’জন লোক হেঁটে আসছে এদিকেই। সে লক্ষ করল, মোবারক আলির মুখও ওদিকে ফেরানো। হঠাৎ মোবারক আলি হাত-ইশারা করল তাদের। যেন চলে যেতে বলছে সে। অনির্বাণ দেখল, দু’জনের মধ্যে একজন তুলতুলির বাবা সহদেব দাস। সে উত্তেজিতভাবে বলল—তুলি! তোর বাবা! 

—বাবা! 

এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল তুলি। এ সময় তার বাবা কলাবাগানের দিকে কেন আসছেন সে বুঝতে পারল না। অনির্বাণ বলল—চল, কলাবাগানের ওপাশ দিয়ে নয়াকলোনির রাস্তা ধরি। 

দ্রুত অদৃশ্য হল তারা। তুলতুলি কাঁপা গলায় বলল—তোমার কি মনে হয়, বাবা দেখতে পেয়েছেন? 

—দেখতে পাবার কথা। 

নয়াকলোনির মধ্যে এসে আলাদা হয়ে গেল দু’জনে। দুশ্চিন্তা নিয়ে বাড়ি ফিরল তুলি। খুব লজ্জাও করছিল তার। সরাসরি বাবার মুখোমুখি পড়ে যাবার লজ্জায় গরম হয়ে যাচ্ছিল তার কর্ণমূল। বাবার চেয়ে মার্কেই তার বেশি ভয়। সে একটি ভীত পাখির মতো এসে বসে রইল ঘরের কোণে। হাতে নিল তর্কশাস্ত্রের বই। ভাব করল যেন কত পড়ছে। কিন্তু একটি বর্ণও তার মাথায় ঢুকছিল না। 

আর ভয়মিশ্রিত আনন্দ হল অনির্বাণের। সে যা চাইছিল তা হতে চলেছে। যদি সহদেব দাস তাদের দেখে থাকেন তা হলে তার উদ্দেশ্য সফল হতে পারে। সুকুমার পোদ্দারের সঙ্গে তুলির বিষয়ে কথা বলার একটি পথ তৈরি হলেও হতে পারে এবার। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *