২২
আঘনে নবান্ন করে
নূতন তণ্ডুলে।
অন্নজল ছাড়ি মুক্তি
ভাসি এ অকুলে ॥
আঘন মাসে রাঙ্গা ধান
জমিনে ফলে সোনা।
রাঙ্গা জামাই ঘরে আনতে
বাপের হইল মানা ।
যখন থেকে এই গ্রাম চতুষ্কোনার পত্তন, সেই হয়তো-বা তিনশো বছর আগে, সেদিন থেকেই নদীর ধার ঘেঁষে বসত করেছে জেলেপাড়া। এর মধ্যে ভাগীরথী নাম্নী মা গঙ্গা কূল ডুবিয়েছে কূল ভাসিয়েছে কতবার, তবু জেলেপাড়া অটুট আছে। জলে যারা বসত করে, জল তাদের নেশা। অন্য কোনও কিছুতে তাদের মন লাগে না। জলই যদি তাদের ঘরবাড়ি ভেঙে দিয়ে যায়, তবু নতুন ঘর বাঁধতে তারা স্মরণ নেবে জলের।
এই জেলা মুর্শিদাবাদে জলচরদের ভূমিকা প্রাচীন। আর ওই প্রাচীন ভূমিকায় চতুষ্কোনার অংশ ছিল নিশ্চয়ই। কোনও প্রমাণ নেই তার। কেন-না ইতিহাস যা লেখা হয়, সব রাজা-রাজড়ার ইতিহাস। গ্রামেরও নয়। জনগণেরও নয়।
চতুষ্কোনায় প্রাচীনতার একমাত্র সাক্ষ্য হতে পারত ওই সতীমন্দির। সতীর পদচ্ছাপ সম্বলিত পাথর পরখ করে দেখা যেতে পারত তার বয়স আড়াইশো-তিনশো বছর কি না। কিন্তু এখানেও প্রশ্ন থেকেই যায়। পাথরের বয়স তিনশো হলেই কি তা গ্রামের প্রাচীনতা প্রমাণ করে? সেখানে কোনও লিপি তো খোদিত নেই!
তবে শোনা যায়, চতুষ্কোনায় ছিলেন সেইসব নৌ-বীর যাঁরা চতুরঙ্গ বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
পাল ও সেন রাজাদের আমলে তাঁদের চতুরঙ্গ বলের প্রধান ছিল নৌবাহিনী। পালরাজ কুমারপালদেবের প্রধান সেনাপতি বৈদ্যদেব দক্ষিণবঙ্গে এক নৌযুদ্ধে বিরাট সাফল্য লাভ করেছিলেন। সেই যুদ্ধে বিরুদ্ধপক্ষীয় যারা পলায়ন করেনি, তাদের বীর ভাবার কোনও কারণ ছিল না। পলায়ন করেনি তার কারণ পালাবার কোনও জায়গা ছিল না। শোনা যায়, নৌবাহিনীর দাঁড়ের সঞ্চালনে যে জলকণা উৎক্ষিপ্ত হয়েছিল, তা যদি আকাশে স্থৈর্য পেত তবে চাঁদের কলঙ্ক অবধি তারা ধুয়ে দিতে পারত।
সেই বিশাল নৌবাহিনীতে চতুষ্কোনার একজনও ছিল না তা মনে করার কোনও কারণ নেই। শরতে যখন ভাগীরথীর বুকে নৌকা বাইচ হয়, আর সেই বাইচে জয়লাভ করে ফেরে রমেশ হালদার, হারুন রশিদ বা আকবর আলির নৌকা তখন একথা লোকের বিশ্বাস করতে ইচ্ছা যায় যে, এই গ্রাম তার মাটিতে শুধু ফসলের গুণই ধরে রাখেনি, রেখেছে নৌচালনার গুণও।
কিন্তু চতুষ্কোনা গ্রামে সবচেয়ে দরিদ্র ও অপরিচ্ছন্ন বসত এই জেলেপাড়ায়। কারণ মুনিষ খাটে যারা, সেই ভূমিহীন ও ভূমিহারা কৃষক সব বসবাস করে জেলেপাড়া ঘেঁষে। তারই মধ্যে আছে বেদে ও বাজিকরদের গোষ্ঠী। তেকোনা গ্রামের মতোই প্রাচীন ভ্রাম্যমাণ জীবনযাপন থেকে সরে এসে তারা কয়েক ঘর এখন কৃষিজীবী। কিন্তু সাপধরা ও নানাবিধ টোটকা ওষুধের কারবার আজও বজায় আছে তাদের। সাপের বিষ তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে যায় শহরের লোক। তার জন্য সরকারি অনুমোদনপত্র আছে।
অপরিচ্ছন্নতা একপ্রকার অভ্যাস। দারিদ্র্য এবং অশিক্ষা তাকে প্রতিষ্ঠিত করে। জেলেপাড়া এবং জেলেপাড়া ছাড়িয়ে যে দীর্ঘ ঘিঞ্জি বসত, তার সর্বাঙ্গে এই সকল লক্ষণ লেগে আছে। দিন দিন এই বসত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ এই নয় যে জেলেদের বা ভূমিহীন কৃষকগোষ্ঠীর সন্তানসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে অগুনতি হয়ে। প্রচুর সরকারি প্রচার সত্ত্বেও জন্মহার বৃদ্ধি পাচ্ছে ঠিকই। তবে ঘরে ঘরে ছ’-সাতটি সন্তানের মধ্যে মরে-হেজে চার-পাঁচখানা বাঁচে। বসত তাতে বাড়ে বটে, কিন্তু সীমান্ত পেরিয়ে আসা লোক ওই বর্ধিত আয়তনকে করে দেয় দ্বিগুণ।
দালালের সাহায্যে, অর্থের বিনিময়ে, তারা গোপনে সীমান্ত পেরিয়ে যায়। কেউ কেউ ধরা পড়ে জেলে যায়। যারা ধরা পড়ে না তারা কোনও পরিচিতি বা সম্পর্কসূত্রে প্রথমে অতিথি হয়ে থাকে। আস্তে আস্তে সেই আতিথ্য নাগরিকতার দাবি নিয়ে ভারতের মাটি কামড়ে ধরে। জল, হাওয়া, খাদ্য ও বিবিধ পরিষেবার ভাগ নিতে চায়।
গত কয়েক বছরে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সীমান্ত পেরিয়ে আসা বেশ কয়েকটি পরিবারকে গ্রামে স্থায়িত্ব দিয়েছেন সুকুমার পোদ্দার। এরা কেউ মৎস্যজীবী, কেউ মুনিষ। কিন্তু নির্বাচনের সময় সকলেই নির্বাচক।
এই পঞ্চায়েতে পরপর দুটি নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন সুকুমার পোদ্দার। অল্প বয়সে তিনি আর এস পি করতেন। এখন সি পি আই এম-এর সদস্য। শেষ নির্বাচনে তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন কংগ্রেসের রমেশ হালদার। তিনি নিজে মৎস্যজীবী বলে ভেবেছিলেন জেলেপাড়ার পুরো ভোট পাবেন। তা ছাড়া, দরিদ্রের বন্ধু দরিদ্র, এই যুক্তিতে তাঁর দারিদ্র্য আমানত করে ভেবেছিলেন দারিদ্র্যপীড়িত মানুষ হিসেবে ভূমিহীন বা প্রান্তিক চাষিদের ভোটও তাঁর ঝুলি পূর্ণ করবে। কিন্তু বাস্তবিক তা হয়নি। সুকুমার পোদ্দারের কাছে অনেকেই নানাভাবে ঋণী। তা ছাড়া, গ্রামের সাধারণ নিরক্ষর মানুষ বোঝে ব্যক্তিমানুষের ক্ষমতা। সুকুমার পোদ্দার অর্থবান মানুষ। লোকবলে, দলের শক্তিতে বলীয়ান। তাঁর উপকার করার ক্ষমতা আছে। অপকার করারও। মানুষ উপকার করার ক্ষমতায় আকৃষ্ট হয়, অপকার করার ক্ষমতায় ভীত হয়। আকর্ষণ এবং ভীতি দ্বারা মানুষের বন্ধন গড়া সহজ। আর অপকার করার ক্ষমতা রাখে, এমন লোককেই মানুষ দেয় অধিক গুরুত্ব। রমেশ হালদারকে নির্বাচনে জয়যুক্ত করিয়ে দিয়ে লাভ কী হত এ গ্রামের! পঞ্চায়েত যতখানি সুবিধা দেয়, তার হিসেবের ওপর নির্ভর করে জীবন অঙ্কের মতো চলে না। প্রয়োজনে গিয়ে হাত পাততেই হত সুকুমার পোদ্দারের কাছে।
গত নির্বাচনে জয়লাভ করার পর, চতুষ্কোনা সংলগ্ন বিলগুলিতে, সরকারি মৎস্যচাষ প্রকল্পের সদস্যপদ পাইয়ে দিয়েছেন কয়েকজনকে সুকুমার পোদ্দার। পঞ্চায়েত প্ৰধান এই তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়। তাঁর হাত আরও সুদূরে পৌঁছয় কারণ পার্টির খোঁজখবর যারা রাখে তারা জানে, বহরমপুরের মিহির রক্ষিত ও রাসুদার অতি ঘনিষ্ঠ এই পোদ্দার।
জেলেপাড়া সংলগ্ন বসত যে কলেবরে বেড়ে উঠছে ক্রমশ তা সুকুমার পোদ্দারের দাক্ষিণ্যেই। কারণ এ গ্রাম ও আশেপাশের গ্রামের যোজনবিস্তৃত ভূমির অধিকারী সুকুমার পোদ্দার। নামে-বেনামে তাঁর কারবার। যে-সব সরকারি আধিকারিক বেনামি ও উদ্বৃত্ত জমি অধিগ্রহণ করে বর্গাদার বা ভূমিহীনদের মধ্যে ভাগ করে দেবার দায়িত্বে ছিলেন তাঁরা সুকুমার পোদ্দারের বেনামি জমির সন্ধান কখনও পাননি।
সরকারি সমবায় মৎস্যচাষের সদস্যপদ যারা পেয়েছে তাদের উপার্জন ও জীবন অনেক বেশি নিশ্চিত। কারণ বিল ও ঝিলগুলির মৎস্য চাষ সরকারি মৎস্য চাষ উন্নয়নের কবলিত হওয়ায় নানাবিধ নিবিড় প্রকল্প চলতেই থাকে। শুধুমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্যোৎপাদনের ওপর জেলেদের নির্ভর করতে হয় না। কিন্তু সেই সুবিধাপ্রাপ্ত জেলের সংখ্যা হাতে গোনা। আশেপাশের আরও গ্রামের আরও অনেক অনুগত মৎস্যজীবী তার অংশীদার। এর বাইরেও আছে বৃহৎ সংখ্যক জেলে, তারা স্বাধীন বৃত্তি গ্রহণ করেছে। আকবর আলি ও মোবারক আলির বাবা মহম্মদ আলির ছিল এই বৃত্তি। রাজানুগত্যের চেয়ে পরিশ্রমই তাঁর কাছে অনেক বেশি সহজসাধ্য বিবেচিত হয়েছিল। পিতৃচরিত্র হুবহু পেয়েছে আকবর আলি। কিন্তু মোবারক আলি অন্য ধারার। পরিশ্রমবিমুখ সে। কিন্তু অর্থবান হওয়ার স্বপ্নে বিলাসী। সে চায় হঠাৎ পেয়ে যাওয়া অনেক টাকা। ছোটবেলায় এক বছর কোনওক্রমে মাদ্রাসা শিক্ষা লাভ করার পর আর সে কেতাবে হাত দেয়নি। মোবারক আলি তার দাদার মতো মাছ ধরতেও যায় না। বাপ-ভাইয়ের কাছ হতে চেয়ে-চিন্তে কিছু অর্থ সংগ্রহ করতে পারলেই সে শহরে গিয়ে সিনেমা দেখে আসে। সম্প্রতি কানাই মণ্ডল এবং অশোক ঘোষাল, তার দুই বন্ধু, তাকে ব্যবসার অংশীদার করে নেবে বলেছে। সে তাতে উৎসাহী। কিন্তু অংশীদার হতে গেলে কিছু মূলধন বিনিয়োগ করা চাই। কানাই তার ভাগের জমিজমা আমবাগান বিক্রি করে সেই টাকায় শহরে কাপড়ের দোকান ও রূপকেন্দ্র খুলবে। অশোকের কিছু ভাগ থাকবে তাতে। এ ছাড়াও অশোকের আছে অন্য ব্যবসা। সে নিজে বলে আমদানি-রফতানি। কী আমদানি, কী রফতানি, কোথায় এসব এখনও বলেনি খোলসা করে। কিন্তু এই ভরসা দিয়েছে, ব্যবসা আরও একটু দাঁড়িয়ে গেলেই তাকে অংশীদার করে নেবে।
—কত টাকা লাগবে?
সে জিগ্যেস করেছিল। অশোক বলেছিল- টাকা লাগবে না। আমি যা বলব, তা করলেই হবে।
সে করতে রাজি আছে। তবে অশোক এখনও বলেইনি কী করতে হবে। তার এখন অর্থের প্রয়োজন। রোজগার না করলে বাড়িতে কেউ তার বিবাহের কথা তুলছে না। বিয়ে মানেই তো এক পেট বাড়া নয়, দু-চার বৎসরের মধ্যে আরও অন্তত তিন মাথা বৃদ্ধি পাবে। সেদিক থেকে মোবারক আলির সামর্থ্য সন্দেহাতীত। কিন্তু তার বিবাহের বা বিবাহোত্তর পরিণতির দায়ভার নিতে মোটে রাজি নয় তার বাপ-দাদা। অথচ তার বয়সে আকবর আলির বাবা হতেও বাকি ছিল না। সে মাছ ধরতে গেলে, তার বাড়ির লোক খুশি হত। কিন্তু অত পরিশ্রম করে ওই জীবন! ফুঃ! তার পোষাবে না। তার চোখে লেগে আছে ফিল্মে দেখা ঝকঝকে জীবন। সে হবে বড় কারবারের মালিক। প্রচুর পয়সা হবে। চকচকে দামি গাড়ি থেকে নামবে সে। প্রাসাদোপম বাড়িতে থরে-বিথরে তার জন্য সাজানো থাকবে আরাম। সে স্বপ্ন দেখে।
হতে পারে। এই সবই সফল হতে পারে যদি ব্যবসাগুলো দাঁড়িয়ে যায়। কানাই আর অশোক তাকে এই ভরসা দেয়। কিন্তু কানাইয়ের ব্যবসায় গেলে টাকা দিতে হবে। অন্তত পঁচিশ হাজার টাকা। এ টাকা সে পাবে কোথায়? তার বাপ এখনও মরেনি যে, বড়ভাইকে বলবে সম্পত্তি ভাগ করে দেবার কথা। আর ভাগ করলেই-বা কী! তাদের পৈতৃকসূত্রে পাওয়া ভিটে ও পুরনো নৌকো বিক্রি করলে ত্রিশ হাজার টাকাও পাওয়া যাবে না। আর পেলেই-বা বিক্রি করছে কে! ওই বৃদ্ধ মহম্মদ আলি সব আগলে দাঁড়িয়ে আছে পর্বতের মতো। মাঝে মাঝে সে ভেবেছে টাকাটা আকবর আলির কাছেই চাইবে। কিন্তু তার পরেই সে হতাশ হয়েছে। আকবর আলি অত টাকা পাবে কোথায়? মহম্মদ আলির পুরনো নৌকা নতুন করে সারিয়ে তোলার জন্য সুকুমার পোদ্দারের কাছ থেকে মোটা টাকা ঋণ নিয়েছিল আকবর আলি। সে টাকা এখনও সে শুধে চলেছে। কতখানি শোধ হয়েছে মোবারক আলি জানে না। জানার চেষ্টাও সে করে না। বাড়িতে সে পেয়ে যাচ্ছে আহার ও বাসস্থান। চাহিদামতো না হলেও সামান্য হাতখরচ। সংসার কীভাবে চলছে তা জানার দরকার কী!
এখন, শরীরে কামবীজ দাপাদাপি করলে তার মনে হয়, সংসারে মনোযোগী হয়ে বাপ ও বড়ভাইয়ের মন জোগানো তার উচিত ছিল। তা হলে অন্তত একজন বিবি পাওয়া যেত ইতিমধ্যে। সে ভেবে মুখ বিকৃত করে। শালা! কত লোকের দুটি-তিনটি বিবি। সবগুলোই আধপেটা খেয়ে কাটিয়ে দিচ্ছে দিন, আর তার এখনও একটি বিবি নেই!
মাঝে-মাঝে সে ভাববার চেষ্টা করে, কীভাবে বাপ-ভাইকে খুশি করা যায়! মাছ ধরতে গিয়ে। আর না গিয়ে কীভাবে খুশি করা যায়? টাকা দিয়ে। টাকা পাওয়া যায় কীভাবে?
অন্যদিকে আবার মোবারক আলি একটা বড় ভুল আগেই করে বসে আছে। গেল ভোটেও রমেশ হালদারের শাকরেদি করেছে সে। রমেশ হালদার জিতলে কিছু সুবিধে আদায় করে নিতে পারত অনায়াসেই। কী সুবিধে তা তার কাছে স্পষ্ট ছিল না। কিন্তু নির্বাচনের যুদ্ধে যারা সৈন্য-সামন্তর কাজ করে, তারা প্রত্যেকেই ভবিষ্যতে কিছু ফলপ্রাপ্তির আশাতেই গলা ফাটায়। যদিও রমেশ হালদারের সঙ্গে তার ভিড়ে যাওয়াকে ভাল চোখে দেখেনি আকবর আলি। সুকুমার পোদ্দারের কাছে সে ঋণী, অথচ ভাই তাঁর বিরুদ্ধ দলের হয়ে প্রচার করছে, এ বিসদৃশ ঠেকেছিল তার চোখে। মোবারক আলি জানে যে, তার কৃতকর্মের জন্য সুকুমার পোদ্দারের কাছে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে ক্ষমা চেয়ে এসেছে আকবর আলি। সে জানে না সুকুমার পোদ্দার কী বলেছিলেন! তবে এখন সে পোদ্দারের দলেই ভিড়ে যেতে চায়। যে-দলের জোর বেশি, তার মধ্যে থাকাই ভাল। কত লোকই তো দল বদল করছে। সে আর এমন কে! তা ছাড়া আপনি বাঁচলে বাপের নাম। তার এখন টাকার দরকার। টাকার জন্য সে যে-কোনও দলের হয়ে কাজ করতে পারে। কিন্তু শুরুটা কীভাবে করা যায় সে বুঝতে পারছে না। সরাসরি গিয়ে সুকুমার পোদ্দারের পায়ে পড়ে যাবে? নাঃ! সেটা হাস্যকর। আর পায়ে পড়লেই যে সুকুমার পোদ্দার তাকে বুকে তুলে নেবেন, এমন তো নয়। অতএব, আপাতত আকবর আলিই তার ভরসা। আকবর আলিকে তুষ্ট করে তার সঙ্গেই সে পৌঁছবে সুকুমার পোদ্দার পর্যন্ত। আবার এক ঢিলে দুই পাখিই মারা হয়ে যাবে। আকবর আলির সঙ্গে জলে গেলে পরিবারের সকলেই তুষ্ট হবে। তখন হয়তো-বা মহম্মদ আলি খুশি হয়ে তার বিয়ে-সাদি পাকা করে বসবেন!
বড় ভয় পায় সে মানুষটিকে। তার বৃদ্ধ পিতা মহম্মদ আলিকে। পাঁচ ওয়ক্ত নমাজ পড়া দায়িত্বশীল সৎ লোক। মৎস্যজীবিকার কল্যাণেই চারটি কন্যা পার করেছেন। তারা এখন বেশ রসে-বশেই আছে। পরিশ্রমী মানুষ তিনি, সংসার বেচাল হতে দেননি। বয়সের ভারে কিছু নুয়ে পড়া মহম্মদ আলি আজও সমান পরিশ্রমী। আকবর আলি তাঁকে নদীতে যেতে দেয় না ঠিকই। কিন্তু তিনি আছেনই সারাক্ষণ কোনও-না-কোনও কাজে। গৃহ সংলগ্ন সামান্য জমিতে ফলাচ্ছেন সম্বৎসরের সবজি। আকবর আলির জাল মেরামত করছেন। নদীর পাড়ে গিয়ে খ্যাপলা বা কুঁড়ো জাল ফেলে মাছ ধরে হেঁটে হেঁটে বেচে আসছেন গ্রামে। আকবর আলির ছোট ছোট তিনটি ছেলে-মেয়ে সোৎসাহে এ কাজে সাহায্য করে মহম্মদ আলিকে। অতএব মহম্মদ আলি বেকাম আড্ডাবাজ লোক পছন্দ করবেন না, তা খুবই স্বাভাবিক। তিনি মোবারক আলিকে সম্বোধন করেন লবাবপুত্তুর বা লবাবজাদা বলে। মোবারক গায়ে মাখে না। বরং হাসে। মনে মনে বলে—আমি লবাবপুত্তুর হলে তুমি আব্বাজান লবাব সিরাজদ্দৌলা।
তবে এটা মোবারক আলি ভাল করেই জানে যে, আকবর আলি তার কোনও কাজ আব্বাজানের পরামর্শ ছাড়া করে না। অতএব উদ্দেশ্য হাসিল করতে গেলে ওই বৃদ্ধ লোকটাকেও মোবারক আলির হিসেবে ধরতে হবে।
জেলেপাড়া ছাড়িয়ে, কৃষাণপল্লি ছাড়িয়ে যেখানে ফসলের জমি সেখানে নদীর দিকে তাকিয়ে মোবারক আলি ভাবছিল এত কথা। আর বিড়ি ফুঁকছিল। এ বিড়ি অবশ্য তাকে পয়সা দিয়ে কিনতে হয়নি। তার ভাবি আর মা সারাদিন বসে বিড়ি বাঁধছে। জেলেপাড়ার বা কিষান-মুনিষদের পাড়ার সব মেয়ে-বউরাই এ কাজ করে। এমনকী এমন পুরুষও বিরল নয় যে মেয়ে-বউয়ের রোজগারে অলস হয়ে উঠেছে, বসে খায়। কিংবা নেশা করে ফুঁকে দেয় বউয়ের রোজগার। বহু পরিবারে এই নিয়ে স্বামী-স্ত্রীতে মারামারি বা নিত্যকলহ লেগে থাকে। মোবারক আলি ভাবে, তার দুটি বিবি থাকলে বিড়ি-বাঁধার রোজগারেই কি তার সংসার তরিয়ে যেত না? ইচ্ছে করে, নিজেই কোথাও বিয়ে সেরে নেয়। কিন্তু মেয়ের বাপগুলো সব একবগ্গা। বেরোজগেরে লোককে মেয়ে দেবে না এমন ছকু। তার বাবা-দাদা রোজগেরে, তবু তার ভাবি ও মাকে বিড়ি বাঁধতে হচ্ছে তো! সেই বসতে হচ্ছে তো বান্ডিল নিয়ে। মোবারক আলি সেই বাঁধা বিড়ি থেকে দু’-চারটে তুলে ট্যাকে গুঁজে নেয়। মা এবং ভাবি দু’জনেই হাঁ-হাঁ করে। গালাগালি দেয়—বেকম্মা, বজ্জাত।
মোবারক আলি জবাব দেয় না। মনে মনে বলে—আমি বজ্জাত হলে বদ কে হল শুনি? তুমি না আমি?
শুধু বেকম্মা বলে গালি দিয়ে ঝাল মেটে না মহম্মদ আলির বিবি খালেদার। নিষ্কর্মা পুত্তুরের উদ্দেশে ছড়া কাটেন তিনি নানারকম—
অনেক কালের ছিল-পাপ।
ছেলে হল সতীনের বাপ॥
বাছার আমার কী বা রূপ
ঘুঁটে ছাইয়ের নৈবিদ্যি, খ্যাংড়াকাটির ধূপ ॥
বাছার কী বা মুখের হাঁই।
তবু হলুদ মাখেন নাই॥
বাছা আমার ভরমের টাটি।
কাঁকালে পাঁচ-ছয় চাবিকাঠি॥
বাছা আমার বাঁচলে বাঁচি।
বাছার আমার দুধে অরুচি॥
এইসব শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গেছে মোবারক আলির। অভ্যাসও হয়ে গেছে। তবু মাঝে মাঝে ছিড়িক ছিড়িক আগুন জ্বলে। ইচ্ছে করে টাকার তাড়া এনে মায়ের মুখের ওপর ফেলে দিতে। টাকা পেলেই এই মা, এই ভাবি তার কত আদর-যত্ন শুরু করবে সে এখনই বলে দিতে পারে! পা দাবিয়ে দেবে এমনকী। চাঁদপানা বিবি এনে দেবার জন্য হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দেবে। দুনিয়া হল টাকার বশ। টাকা, টাকা! টাকা ছাড়া আর কী হয়!
ভাবতে ভাবতে তার চোখ চলে গেল দূরের সীমানায়। নদী ওখানে সামান্য পুবে বাঁক নিয়েছে। সেই বাঁকের মুখে ছোট একটি কলাবাগান করেছে জাভেদ বিশ্বাস। কলাক্ষেতের পাশে দেখা যাচ্ছে, কথা বলছে পাশাপাশি দু’জন। তারা বসে আছে শক্ত আলে। নদীর দিকে মুখ মোবারক আলি চিনতে পারছে তাদের। সুকুমার পোদ্দারের ছেলে অনু আর সহদেব দাসের মেয়ে তুলতুলি। সারা গ্রামে এদের নিয়ে ঢিটি পড়ে গেছে। আপন মনে ওদের উদ্দেশে গালাগালি দেয় মোবারক আলি—শালা হারামি। নিলাজ বেশরম। মেয়েটা তো খানকি বেশ্যা। গ্রামের মধ্যেই কীরকম ঢলাঢলি করছে দেখো। শালাদের বাপ-দাদার ভয়ও নেই! সুকুমার পোদ্দারের ছেলে বলে এত বুকের পাটা। অন্য কেউ এত ঢলাঢলি করলে গ্রামের লোক দু’দিনে ধরে বিয়ে দিয়ে দিত।
সহসা তার মনের কোণে একটি নতুন ভাবনা উদয় হল। অনির্বাণ। অনু। সুকুমার পোদ্দারের ঘনিষ্ঠ হওয়ার জন্য অনু একটি ঘোড়া হতে পারে।
টাকার স্বপ্নে বুঁদ হয়ে থাকা মোবারক আলি অনির্বাণের ঘনিষ্ঠ হওয়া যায় কী করে তাই ভাবতে থাকল বসে বসে। আর এদিক-ওদিক তাকিয়ে, মোবারক আলির অবস্থান উপেক্ষা করে হঠাৎ তুলতুলির গালে একটা চুমু খেয়ে বসল অনির্বাণ। সে-দৃশ্য দেখে দাঁতে দাঁত পিষল মোবারক আলি। হায় আল্লা! তার একখানা আস্ত পূর্ণাঙ্গ মেয়েও জোটে না!