২১
আগন মাসে ফতেমা গো
সবে খায় নয়া।
দুধ দই সর ননি পিঠা পুলি
সবে খায় মেওয়া।
রান্ধিয়া বাড়িয়া অনাথ
কার বা পাতে ঢালি।
কে ডাকিব মা বলিয়া
এই না দুঃখ ফালি ॥
মরি হায় হায় রে—
ক্ষেত্রপূজার সকল উপচার সাজিয়ে বসেছিল শিখারানি। যদিও তার না আছে জমি, না আছে সন্তান। কিছুই নেই, তবু তাকে সকল ব্রত চালিয়ে যেতে হয়। এই তার রুজি-রোজগার। তার থাকার মধ্যে আছে কেবল এই ভিটে এবং সংলগ্ন সতীমায়ের প্রাচীন মন্দির। প্রায় আড়াইশো বছর আগে এই পরিবারে সতী হয়েছিলেন একজন। এক অষ্টাদশী ব্রাহ্মণী। পবিত্র ছিলেন তিনি। দেবীর অংশ। শোনা যায়, স্বামীর চিতায় যখন উঠে বসলেন তিনি, অগ্নিধূম আকাশ অধিকার করেছিল, তখন ওই কটুগন্ধ অথচ পবিত্র ধোঁয়ার ভিতর থেকে উঠে এসেছিল স্নিগ্ধ আলোর শিখা। সেই শিখায় চেপে, গ্রামের মানুষ সবিস্ময়ে দেখেছিল, স্বর্গে চলে যাচ্ছেন মা ভগবতী। জীবন্ত পুড়ে যাবার করুণ ক্রন্দনধ্বনি কিংবা পোড়া বিকৃত মাংস ত্বক দেখা যায়নি দেবীর শরীরে। কেন-না দেবী ছিলেন ব্রাহ্মণীর আত্মায়। আর আত্মার কোনও দহন নেই। বিকার নেই। ধ্বংস নেই।
সেই থেকে লোকে সতীর এই থানে পুজো দিতে আসে। নড়বড়ে মন্দিরের ওপর ঝুঁকে পড়া শিউলিগাছে সুতো বেঁধে দিয়ে যায়। মানত করে।
তবে এই সুদীর্ঘ আড়াইশো বৎসরপ্রায় ধরে সতীর মহিমা ক্ষয় হতে হতে ঠেকেছে তলানিতে। লোকে আর তেমন আস্থা রাখছে না তাঁর ওপর। এমনিতেই ভক্তকে ভাগাভাগি করে নিয়েছেন বহু ঈশ্বর। তার ওপর এই সময়কালে কত অবতারের জন্ম হল। তাঁরা কত ধর্মকথা শোনালেন। কত আশ্রম, কত গুরুকুল প্রতিষ্ঠিত হল। সতীমায়ের থানের কথা লোকে আর বিশেষভাবে স্মরণ করে না। গ্রামদেশ বলে আজও বিস্মৃত হয়নি। কিন্তু কত দেবতা, কত মন্দির জঙ্গলে হারিয়ে গেছে, তার কোনও লেখাজোখা নেই। সতীমন্দিরের সেই পুরনো রমরমাও নেই। আগে প্রতি শ্রাবণী অমাবস্যায় এখানে ঢাকঢোল পিটিয়ে, ছাগ বলি দিয়ে পূজাপাঠ হত। ব্রাহ্মণী ওইদিনই দেহত্যাগ করেছিলেন। এখন সে-সব কিছুই হয় না। এমনকী সকল পূজাই বন্ধ হয়ে মন্দিরটি উৎসন্নে যেতে বসেছিল। তা ছাড়া, দেব-দেবী ঘিরে যতক্ষণ শোরগোল, আড়ম্বর—ততক্ষণই তার মহিমা। ভক্ত বাড়ালেই দেবতা বৃদ্ধি পান। কিন্তু ব্রাহ্মণীর পরিবারের এই নিঃস্ব প্রজন্ম পূজা ভুলে বসেছিল আজ কত বৎসর!
কোনও মূর্তি নেই মন্দিরে। আছে কেবল শিলনোড়া আকারের একটি পাথর। দেখলে মনে হয় চ্যাপ্টা শিলের ওপর শান্ত নোড়াটি। স্থাপিত হয়ে আছে পেষণের অপেক্ষায়। কিন্তু শিলখানি আসলে অনড়। শোনা যায়, এই শিলে আছে বধূটির দু’খানি পদচ্ছাপ আর নোড়ায় পায়ের দশ আঙুলের দশটি ফোঁটা। চিতায় ওঠার আগে ব্রাহ্মণী যখন শেষবারের মতো ধরণীতে পা রেখেছিলেন, তখন তাঁর পায়ের তলায় ছিল এই পাথর। যে সতী সে কখনও সাধারণ মানবী হতে পারে না। সতী মানেই ঈশ্বরীর অংশ। অতএব ব্রাহ্মণী ইহত্যাগ করার পূর্বে তাঁর অস্তিত্বের বিপুল ভার চিহ্নিত করেছিলেন পাথরে। শিখারানি প্রতিদিন পাথরে খুঁজে ফেরে ওই পদচ্ছাপ। পায় না। আড়াইশো বছর ধরে ক্ষয়ে গেছে বুঝি। সে আবার এই মন্দিরে নিত্যপূজার প্রচলন করেছে। এমনকী ধীরে ধীরে জমিয়ে তুলেছে দেব-দেবীর ছবি। মূর্তি, লিঙ্গ।
শিখারানির স্বামী অমর ঘোষাল ছিলেন চতুষ্কোনার প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক। জমি-জমা কিছু ছিল। এখন আর নেই। শিখারানির যখন বিয়ে হয় তখন শ্বশুর গত। শাশুড়ি বেঁচে ছিলেন। এখন তাঁরও স্বর্গপ্রাপ্তি ঘটেছে। থাকার মধ্যে আছে দুই দেওর। অলক, অশোক।
এই নড়বড়ে ভিটে এবং সামান্য জমিজমার সংসারে শিখারানির বিবাহ হয়েছিল দুটি কারণে। এক, সে ছিল হতদরিদ্র পরিবারের কালো মেয়ে। দুই, অমর ঘোষালের ইস্কুল মাস্টারির ভরসা। কিন্তু কপাল খারাপ শিখারানির। চোখের সামনে পালটে গেলেন অমর ঘোষাল।
কম কথা বলা এক গম্ভীর মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁকে ভালবাসা সহজ ছিল না। তবু, স্বামীকে ভালবাসা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না বলেই শিখারানি বিশ্বাস করত সে স্বামীকে ভালবাসে। সঙ্গে শয়ন করে। ক্রীড়াদি ঘটায়। স্বামীর কল্যাণকামনায় সিঁদুর পরে রোজ। হাতে শাঁখা, পলা, নোয়া—ভালবাসার সকল আয়োজন তার সর্বাঙ্গে।
শিখারানি জানে, ভালবাসা নামের বস্তুটি ভগবান সব মানুষকেই সঙ্গে দিয়ে পাঠান। দরকার সেই ভালবাসা অর্পণ করার যোগ্য পাত্র। শিখারানি এক মেয়ে। গরিব, সাধারণ, ইস্কুলের শিক্ষাবিহীন। তার উপযুক্ত পাত্রাপাত্র বিচার করার সুযোগ কোথায়? উপায় কী? যার সঙ্গে মালা বদল, বিয়ে কবুল হবে যার সঙ্গে, তাকেই উপযুক্ত ভাবতে হয়। ভালবাসতে হয়। আর অমর ঘোষাল শিখারানিকে ভালবেসেছিলেন কি না, তা বোঝার আগেই তিনি পাগল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যান। প্রথম প্রথম সে তার পাগল স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকত আর তার চোখ জলে ভরে যেত। অজ্ঞাত ঈশ্বরের পায়ে মাথা খুঁড়ত সে—কেন এমন হল ঠাকুর! আমি তো কোনও পাপ করিনি।
পাপ! এই শব্দটি সম্পর্কে সে বোধরহিত হয়েছে এখন। কী পাপ? কীসের পাপ? ঠাকুর যাকে যা দিয়ে পাঠান। সে কী করবে? ওই পরিস্থিতির জন্য সে তো দায়ী নয়।
কথা কম বলতেন মানুষটি। অমর ঘোষাল। অভাবের সংসারে ওই চাকুরির দ্বারা তিনি কেবল দু’বেলা আহারের স্বাচ্ছন্দ্য আনতে পারছিলেন। নির্ভরযোগ্যতায় তার মূল্য কম ছিল না। মাঝে মাঝে তিনি ক্রোধী হয়ে উঠতেন এমন, যাকে উন্মত্ততা ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। তখন তিনি কাটারি নিয়ে ছুটে আসতেন মাকে কাটবেন বলে। কেরোসিন তেলের বোতল নিয়ে ঘরে আগুন দেবার চেষ্টা করতেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর আগুন লাগত না। মায়ের মাথা বিচ্ছিন্ন হত না ধড় হতে। লোকে বলত —রাগ না চণ্ডাল। ও আপনি শুধরে যাবে। কারও কারও হয় এমন।
আর ছেলের মা কাটারির কোপ হতে প্রাণ ফিরিয়ে নিয়েও বলতেন—সে ভাল। ব্যাটাছেলের রাগ থাকা ভাল।
এইসব রাগের পর্বে তিনি গুম হয়ে থাকতেন। সাতদিন আটদিন। শিখারানিকে স্পর্শ করতেন না। কৃষ্ণবর্ণ মুখের ওপর বসানো ঘোলাটে দৃষ্টি কেবল অপলক থেমে থাকত শূন্যে।
একদিন তিনি ভাত খেয়ে স্কুলে যাবেন। শিখারানি তাঁর ভাত বেড়ে বাটিতে করে এনে দিল ডাল। কড়া হতে সদ্য নামানো। গরম। ডালের বাটিতে হাত দিয়ে প্রায় ছ্যাঁকা খেলেন তিনি আর ব্যাঘ্রবৎ লম্ফনে এঁটো হাতেই শিখারানির টুটি টিপে ধরলেন। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল শিখারানির। জিভ বেরিয়ে এসেছিল। ছিটকে বেরুতে চাইছিল অক্ষিগোলক। অজগর সাপের ধরা অসহায় ছাগলের মতো দাপাচ্ছিল সে। দুই দেবর ছিল, তারা এসে জোর করে তার স্বামীকে ছাড়িয়ে নেয়। সে প্রায় হতচেতন, প্রায় মরণকালের মতো নাভিশ্বাস তুলছে, আঁচল গড়িয়ে পড়েছে মাটিতে আর গলায় অসহ্য যন্ত্রণা। তখন ক্রোধী অমর ঘোষাল গরম ডালের বাটি ঢেলে দিলেন তার মাথায়। নুন লঙ্কায় জারিত ডাল অসহ্য জ্বালা ধরিয়ে দিল চোখে ঢুকে পড়ে। হায়! সেই জ্বালা-যন্ত্রণা সে আজও অনুভব করে এক-এক সময়। তার গলায় কালশিটে পড়েছিল। চোখ লাল হয়ে উঠেছিল। গলার ব্যথায় কথা বলতে পারছিল না সে। এবং তার মনে ভয় ঢুকেছিল। স্বামী কি তাকে খুন করে ফেলতেও পারেন!
নিজের পক্ষে যিনি হত্যাকারী হয়ে উঠতে পারেন, তাঁকেও ভালবাসতে গেলে মানুষ অসহায়।
কিছুদিনের জন্য বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিল শিখারানি। কিন্তু গরিবের বাড়িতে বিবাহিতা মেয়ের প্রত্যাগমন বড় বালাই। তার দাদারা অকারণেই রাগারাগি করছিল। বউদিদিরা ভর সন্ধেয় চুল এলো করে শুয়ে থাকছিল মেঝেয়। কারণ নেই, অকারণ নেই রাগ ঝাঁঝ করছিল। পড়শিকে শুনিয়ে বলছিল— ওমনি কি কপাল করেছিলাম। সুখের মুখ দেখতে পেলাম না কোনও দিন, তার ওপর গলগ্রহ নিয়ে বাঁচতে হবে।
মা সুযোগ পেলেই বলছিল—শোন শিখা। বিয়ে হলে বাপের ঘর হল পর। তা আপন শ্বশুরঘর থাকতে পরঘরি পাত্তামারি হয়ে থাকা কি সাজে? কথায় বলে, পতির পায়ে থাকে মতি, তারে তবে বলি সতী। মন দিয়ে শোন শিখা। মা বাপ ভাত দেয় গুনতি করে। স্বামীর তুল্য ভাত আর কেউ দিতে নারে।
অতএব সে ফিরে এসেছিল। এবং ফিরে এসেছিল এক সংকল্প নিয়ে। যাই হোক, সে আর বাপের বাড়ির প্রত্যাশী হবে না। তাই এখন তাকে পূজাপালন করতে হয়। ব্রত করতে হয়। ভর পড়তে হয়। ভূত তাড়ানোর জল-পড়া দিতে হয়। পরিধান করতে হয় লালপাড়ের সাদা শাড়ি। ইদানীং তার চুলে জটার আভাস। ধীরে ধীরে এই জটা বৃদ্ধি পেলে তার অলৌকিকত্ব হয়ে উঠবে বৰ্ণময়।
সে ভর পড়লে গ্রাম-গ্রামান্তরের দারিদ্রপীড়িত জীবনলাঞ্ছিত মানুষ তার কাছে আসে ভবিষ্য জানতে। আসে এমনিতেও। স্বপ্নাদ্য ওষুধ নিয়ে যায়। সে সকলকে দেয় এক টুকরো নিমের ডাল। নিমগাছ আছে তাদেরই ভিটের পশ্চিমে। ডালের অভাব হয় না। মন্ত্রেরও। মন্ত্রচিকিৎসাই তার সার। সে তবু কিছু-বা ঔষধও দেয়। ছোটবেলায় বিশে গুণিনের নাতনি ছিল তার খেলুড়ি। বিশে গুণিনের পসার ছিল না তখন, তার কারণ বহু কঠিন অসুখ পৃথিবীতে নেমে এসেছে যার চিকিৎসা বিশে গুণিনের শাস্ত্রান্তর্গত ছিল না। গুণিনের নিজেরও শক্তি হরণ করেছিল বার্ধক্য। সে তখন দুটি বালিকাকে সামনে বসিয়ে বলত তার গুণিনবিদ্যা। তার মন্ত্র। তার জ্ঞান। দন্তহীন মুখবিবরে সে রাখত সারাক্ষণ হরিতকীর টুকরো, আর থুতু ছিটকোতে ছিটকোতে বলত—নে নে। তোরাই নে। কেউ তো নিল না। তোরাই নে।
ছড়া বলত। সাপের ছড়া। ভূত তাড়ানোর ছড়া। আর বলত ঔষধ। দাঁতের অভাবে লালচে মাড়িতে জিভ ঠেকিয়ে বলত—যষ্টিমধু, দই, চিনি, মধু এবং আলোচালের জল মিশিয়ে খাওয়ালে কী সারবে?
শিখারানি আর তার বন্ধু পুতুল বলত —কী সারবে?
—আমাশা। এই যে তোরা মাঝে-মধ্যে পুতুর পুতুর হাগিস, তোদের পেট কামড়ায় আর দিনের মধ্যে চোদ্দোবার মাঠ করতে যাওয়া, সব বন্ধ হয়ে যাবে।
তারা শুনত আর হেসে গড়িয়ে পড়ত এ ওর গায়ে। সমস্বরে আবদার করত—ভূত তাড়ানোর মন্তর বলো দাদু।
বিশে গুণিন বলত—কাছে আয়। তোরাই শুধু শুনবি। শোন, এই মন্ত্র পড়লে ভূত পালিয়ে যাবেই। ভাল করে শোন
আমার নাম বিশে গুণিন
শুইন্য মন দিয়া।
আমার নামে ভূত পেত্নি
সবারই কাঁপে হিয়া ॥
শেখ ফরিদের নাম লইয়া
যদি মন্তর ঝাড়ি।
হাজার গণ্ডা ভূত-পেত্নি
ভেল্টাইবার পারি ॥
হ্যাঁরে হাঁই হুম হাঁই হুম হুম হাঁই
হ্যাঁরে হাঁই হুম হাঁই হুম হুম হাঁই
তোমার লিগ্যা বইস্যা আছি
কও হে তোমার নাম।
কিবা জাত, কিবা গোত
কোনখানেতে ধাম?
হ্যাঁরে হাঁই হুম হাঁই হুম হুম হাঁই
হ্যাঁরে হাঁই হুম হাঁই হুম হুম হাঁই
এই মন্ত্র শুনে তাদেরই ভয় করত না মোটে, তা হলে ভূত কী করে ভয় পাবে তারা বুঝতে পারত না। তবে এইসব ছড়া আজ তার সম্বল। যেমন সাপের বিষ ঝাড়ার ছড়াগুলি।
হাতে বাটা, মুখে গোটা, মরুবকের বাণ।
শিষ আকন্দের মূলে আছে কালনাগিনীর প্রাণ।
কন্টিকারী, কাঁচরা, হিজর, শাঁইবাবলার কাঁটা।
নাগকেশরের পায়ে লোটে চৌসাপেরই বেটা॥
সাপের বেটা মাথা মোটা ঢোঁড়ার পিসা বোড়া।
খলখলিয়ার পাতায় করে হরিণ বোরার খোঁড়া ॥
মেষশৃঙ্গীর মূলে আছে চন্দ্রবোড়ার জান।
ভুঁই খাকসার পুষ্পে আছে নাগবাসুকির মান ॥
ইদানীং তার খ্যাতি বাড়ছে। যত দারিদ্র্য, যত অস্বাচ্ছন্দ্য, যত অসুখী হয়ে ওঠে মানুষের জীবন, তত বাড়ে অলৌকিকের প্রতি আস্থা। যাদের জীবনে অনিশ্চয়তা নেই, ধন যাদের উদ্বৃত্ত, তারাও অলৌকিকের প্রতি ধাবিত হয় আরও সমৃদ্ধির লোভে। মানুষের কামনা শেষ হয় না, অতৃপ্তি ফুরোয় না। অলৌকিকত্বও ভাগ হয়ে যায় ধনী-দরিদ্রের জন্য আলাদা আলাদা। ধনীর অলৌকিক পরামর্শদাতাকেও তাই হতে হয় কিছু ধনবান। অতএব হতদরিদ্র শিখারানি সতীদেবীর অংশী হলেও তার দুয়ারে আজও ধনীর পা পড়েনি। তবে সে আশা রাখে, কোনওদিন এসে যাবেন সুকুমার পোদ্দারের স্ত্রী! ধনীর গৃহিণী!
সে জানে সে ঠকাচ্ছে। ঠকাচ্ছে অন্যদের। কী করবে সে! নিজের অস্তিত্বের সংকট বলেই এই প্রতারণার পথ। মাঝে মাঝে তার ক্লান্ত লাগে। মাঝে মাঝে হৃদয় অবরোধ করে পাপবোধ। দীর্ঘ অভ্যাসে এই বোধগুলি আর পৃথক করে বোঝে না সে। নিত্য জীবনে আছে নিত্য গ্লানি। এমনই সহজ এইসব অনুভূতি। শুধু যা সহজ হয় না, তা হল একটি শিশুকে বুকে চেপে ধরার আকাঙ্ক্ষা। মাতৃত্বের জন্য তার অন্তস্তল উথালিপাথালি করে।
পূজার আয়োজন করতে করতে সে ভাবছিল। আজ এই ক্ষেত্রপূজার জন্য যত ভূমিহীন ও প্রান্তিক চাষিবধুরা আসবে তার কাছে। সামান্য সিধে, সামান্য দক্ষিণা দেবে। এই সামান্যগুলিই একত্রিত করলে তার উপার্জন।
পূজার কাজে শিখারানিকে সাহায্য করছিল অলক। ইদানীং অলক লক্ষ্মীপূজা সরস্বতীপূজায় পুরুতগিরি করছে। শহরে গিয়ে কিনে এনেছে সংক্ষিপ্ত পূজাপদ্ধতি। বছরে দু’বার হলেও তার থেকে যা আয়, তাকে লক্ষ্মীজ্ঞানেই ধরে তারা। কিন্তু অলকের তুষ্টি নেই। সে চায় অনেক অনেক টাকা। ভাঙাবাড়ির ঘুপচি ঘরে শুয়ে সে স্বপ্নে বুনে দেয় লক্ষ টাকার বীজ। শিখারানির লোভ তীব্র নয়। সে চায় পেটভরা খাবার। নিরাপদ বসবাস আর শিশু। অন্তত একটি সন্তান যদি থাকত তার।
এই ভর পড়া, চুলে জটা বাঁধানো—সকল বুদ্ধিই তাকে দিয়েছিল অলক। এখনও অলকই তার প্রধান সহায়।
তার স্বামী এখন বসে আছেন হয়তো-বা দাওয়ায়। উদাস। নির্বাক। একদিন এমনই উদাস ভঙ্গিতে তিনি স্কুলে গেলেন। আর সব উল্টেপাল্টে গেল। সব তছনছ করে এখন তিনি বসে আছেন ভোলা মহেশ্বর। ইটের দেওয়াল আর টালির চাল দেওয়া ঘরের দাওয়ায়। দাওয়ার মেঝে মাটির। অন্যান্য ঘরের মেঝেও। সিমেন্টের বদলে, ইটের দেওয়ালে মাটির প্রলেপ। তিনি কর্মক্ষম থাকলে হয়তো এ দেওয়ালে সিমেন্ট পড়ত কখনও। কিন্তু কী যে হল তাঁর সেদিন স্কুলে যাবার পর! পড়া করে আসেনি বলে দ্বিতীয় শ্রেণির মেয়েটিকে দিলেন এমন প্রহার যে তার নাক থেকে রক্ত পড়তে লাগল। তখনও তিনি ক্ষান্ত হলেন না। কী উন্মত্ততায় তাকে ফেলে দিলেন মাটিতে আর স্কেল দিয়ে মারলেন অবিশ্রান্ত। মেয়েটি জ্ঞান হারাল। অন্য ছেলেমেয়েরা ওই প্রহার দেখে ভয়ে চিৎকার করেছিল। জেলেপাড়ার দিপু হালদার যাচ্ছিল পথ দিয়ে। সে ছুটে এসে জাপটে ধরেছিল তাঁকে। তিনি তখন দিপু হালদারের কানে বসিয়ে দেন এক মোক্ষম কামড় আর কান থেকে রক্ত গড়িয়ে নামে। ছেলেমেয়েরা তখন ছুটে মাঠ হতে ডেকে এনেছিল পুরুষদের এবং স্কুলের অপর শিক্ষক, বদরুদ্দিনের বৃদ্ধ পিতা হবিবুর আলি মণ্ডল উপস্থিত হলে তিনি উন্মাদ আক্রমণে হবিবুর আলি মণ্ডলের গলা টিপে ধরেন।
পুরুষেরা প্রথমে চেপে ধরেছিল অমর ঘোষালকে এবং মারধোর করে শুইয়ে ফেলেছিল। তারপর তাঁকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়। তাঁর চোখ তখন রক্তবর্ণ। ধকধকে। মুখে গ্যাঁজলা। শিখারানি ও অমর ঘোষালের ভাই দুটি সংবাদ পেয়েই ছুটেছিল। অমর ঘোষালের তখন বাহ্যজ্ঞান নেই। গ্রামের লোক ভেঙে পড়েছিল স্কুলে। তাঁকে পুলিশে দেওয়া হবে এই সিদ্ধান্ত হতে থাকায় শিখারানি সুকুমার পোদ্দারের পায়ে পড়েছিল। তখন সুকুমার পোদ্দার নারীজাতির প্রতি মায়াবশত নারীজাতির স্বামীকে পুলিশের হাতে যাবার শাস্তি থেকে অব্যাহতি দেন। কিন্তু এ নিয়ে পঞ্চায়েতের একটি সভা বসেছিল। সেখানে সর্বসম্মতিক্রমে এই সিদ্ধান্ত হয় যে, অমর ঘোষাল এক উন্মাদরোগগ্রস্ত, তাঁর দ্বারা পড়ানোর কাজ চলতে পারে না। এবং শহরের চিকিৎসক অমর ঘোষালের ওই একই রোগলক্ষণ ঘোষণা করলে তাঁর শিক্ষকতার কাজটি সম্পূর্ণ হারিয়ে যায়। বিনিময়ে তাঁকে চিকিৎসক দিলেন কিছু ঔষধ, যা মূল্যবান। তারা সেইসব বেশিদিন খাওয়াতে অপারগ হওয়ায় তিনি দিলেন কিছু ওষুধ, যাতে কড়া ঘুমের ঘোর।
অমর ঘোষালের জায়গায় তাঁর স্ত্রী বা ভাইয়েরা কাজটা পেতে পারত। কিন্তু শিখারানি নিরক্ষর। অলক ও অশোক প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে আর পড়েনি এ গ্রামের অধিকাংশ ছেলের মতোই। অশোক এখন ব্যবসা করছে। কী ব্যবসা শিখারানি জানে না। তবে সে মাঝে মাঝে একটি তালা-চাবি দেওয়া বাক্স এনে লুকিয়ে রেখে দেয়। দিনকতক কোথাও যায় না। সামান্য টাকাপয়সা শিখারানির হাতে দেয়। আবার এমনও হয়, দশদিন সে বাড়িতেই আসে না। এই ছন্নছাড়া সংসারে কে কার খবর রাখে! তবে অলকের ধারণা অশোক ব্যবসা করে বড়লোক হয়েছে। তাদের কাছে গোপন করে সব।
প্রহৃত স্বামীকে বাড়িতে এনে শিখারানি তাঁর পরিচর্যা করেছিল। যদিও অমর ঘোষালের হাত দুটি বেঁধে রেখেছিল তারা। এবং যেহেতু ছাত্রীটি বেঁচে গিয়েছিল এবং বৃদ্ধ হবিবুর আলি মণ্ডলেরও প্রাণহানি হয়নি, অতএব তাঁকে খুনের দায়ে পড়তে হয়নি।
চিকিৎসাধীন হওয়ার পর অমর ঘোষাল একজন ঝিম-ধরা নির্বাক মানুষ। বছরে এক-আধবার তাঁর উন্মত্ততা প্রকাশ পায়। অলক দুটি কুকুর বাঁধার চেন কিনে এনেছে। তাই দিয়ে তাঁকে বেঁধে রাখা হয় তখন।
এখন লোকে বলাবলি করে, ঈশ্বর অলৌকিক ক্ষমতা দেন যে পরিবারে, সে পরিবারে দেন বিবিধ রোগব্যাধি। অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষের ব্যক্তিগত জীবন সুখের হয় না, এ তারা বহু উদাহরণসহ উপস্থিত করে।
অমর ঘোষালের চাকরি চলে যাবার পর প্রথম মাসে তারা সামান্য সঞ্চিত অর্থ ভাঙিয়ে খেয়েছিল। দ্বিতীয় মাসে ভিটে সংলগ্ন কিছু জমি তারা বিক্রয় করে দেয়। সেই সময় শিখারানি কেবলই কাঁদত এবং তার অফুরন্ত চোখের পানি বালিশ ভিজিয়ে ফেলত। ডাক্তার তাকে স্বামীর সঙ্গে শয়ন না করার পরামর্শ দিয়েছিলেন কারণ কখন তিনি উন্মত্ত ও দুর্বার হয়ে ওঠেন আর তখন তাঁর প্রিয়-অপ্রিয় হিতাহিত জ্ঞান থাকে না তা সত্য। অতএব তিনখানি ঘরের একটিতে অমর ঘোষাল একা আজও শয়ন করেন। একটিতে শিখারানি। অপর ঘরখানি অলক এবং অশোকের।
এক দুপুরে, যখন অমর ঘোষাল ঘুমিয়ে ছিলেন তাঁর ঘরে, আর শিখারানি পরের মাস কীভাবে চলবে এই দুর্ভাবনায় এবং আপন দুর্ভাগ্যকে ধিক্কার দিতে দিতে বিছানায় শুয়ে রোদন করছিল, তখন তার ঘরে চুপিসাড়ে এসেছিল অলক এবং বিছানায় শিখারানির পাশে শুয়ে তার পেটের ওপর হাত রেখে প্রশ্ন করেছিল— কাঁদছ কেন?
শিখারানি, হয়তো-বা সেই বিহ্বল মুহূর্তে হাত পেটে এসে পড়ার ব্যঞ্জনা ধরতে পারেনি কারণ স্বামীসহবাস-বঞ্চিত ক্লান্ত মেয়েটি তখন অসহায় অবস্থা থেকে মুক্তির পথ খুঁজছিল। কিংবা সে আকাঙ্ক্ষা করছিল এমন কোনও হাত, যা তার অবলম্বন হতে পারে। সে অতএব সেই হাতকেই আঁকড়ে ধরে বলেছিল—আমাদের কী হবে বলো তো অলক?
অলক সেদিন ঘনিষ্ঠতর হয়নি। হাতখানি শরীরে রাখার মধ্যে সে প্রথম আড় ভেঙেছিল। বলেছিল—উপায় করতে হবে।
—কী উপায়?
—সতীর মন্দিরটাকে আবার ভালভাবে কাজে লাগাতে হবে। ঠাকুরদা বেঁচে থাকতে ওখানে বেশ বড় করে পুজো হত। খুব ছোটবেলায় দেখেছি আমি। শাড়ি পাওয়া যেত, ধুতি পাওয়া যেত, কাঁচা টাকা, ফল। ঠাকুরদা মারা গেল। আমাদের ছোট-ছোট রেখে বাবাও মারা গেল হঠাৎ।
—সাপ কামড়েছিল, না?
—হুঁ। কী সাপ আমরা জানতেও পারিনি। মাঠে কাজ করছিল। তার দুদিন আগে বাবা বিজলি দৌড়তে দেখেছিল।
ক্রমশ নরম হয়ে আসতে থাকা সময় গৃহের অভ্যন্তরকে করেছিল ছায়াময়। অতীতচারণায় ভারী হয়ে আসছিল বায়বীয় স্তর। কাক-শালিক ব্যস্ত হয়ে উঠছিল শেষবেলার খাবার খুঁজতে। শিখারানির চোখ নিঃসৃত পানি বালিশের তুলো আঁকড়েও শেষপর্যন্ত হারিয়ে ফেলছিল সিক্ততা। শিখারানি তখন পাশ ফিরে, অলক চিত শয়নের মধ্যে অতীত হতে আহরণ করছিল বর্তমানের জিয়ন সন্ধান। আর অতীতে একবার প্রবেশ করলে যা হয়, কামড়ে ধরে আহত সময়।
শিখারানি অবাক জিজ্ঞাসা করেছিল— বিজলি দৌড়তে? সে কেমন?
—রাত্রি করে ফিরছিল বাবা। বৃষ্টি পড়ছিল। খুব জোর আলো ঝলসাল আর বাবা দেখল তিন হাত দূর দিয়ে ছুটে চলে যাচ্ছে আগুন। বাবার উলটোদিকে না গিয়ে যদি বাবার দিকেই আসত সেই আগুন তবে সেদিনই বাবার মৃত্যু হত। হল না। কিন্তু ঠাকুমা শুনে ডুকরে উঠেছিল। বিজলি দৌড়তে দেখা নাকি খুব অমঙ্গলের। তাই হল। দু’দিন পর সাপের কামড়ে বাবা চলে গেল।
—কোনও গুণিন ছিল না?
—আনা হয়েছিল একজনকে। জাতসাপের কামড়, গুণিনে কী করবে! বাবা বেঁচে থাকলে এ দশা হত না আমাদের।
আবার তারা ফিরে এসেছিল বর্তমানে। কী হবে তাদের! কেমন করে চলবে!
অলক বলেছিল—তুমি ভরে পড়ো। আমি রটিয়ে দেব তোমার ওপর সতীর স্বপ্নাদেশ হয়েছে। প্রতি অমাবস্যায় একাদশীতে বা বিশেষ বিশেষ তিথিতে সতীদেবী আশ্রয় করবেন তোমাকে। তোমার ভর হবে। ভরে পড়লে তুমি ওষুধ দিলে রোগ সারবে। ভবিষ্যদ্বাণী করলে তা সফল হবে।
সে আর্তনাদ করেছিল—বলো কী! ওসব তো কিছুই হবে না। সত্যি ভর হলে কথা ছিল।
অলক হেসেছিল—সত্যি ভর? তুমি কি বিশ্বাস করো নাকি সত্যি ভর কারও হয়?
—হয় না?
—না। সবটাই ভান। লোক বুঝে উত্তর দেবার কৌশল। প্রশ্ন শুনে তোমাকে বুঝতে হবে
লোকে কোন উত্তর চাইছে। তা ছাড়া ঘাবড়াচ্ছ কেন? সব মেয়েছেলেই সতীর অংশ। আর তোমার মতো ডাঁটো সতী হাতে তুলে যা দেবে তাই অমৃত!
—যাঃ! কী যে বলো!
—ঠিকই বলি। তুমি দেখবে সতীর ভর হয় কেবল যুবতী অঙ্গে। তারা যা করে, যেভাবে ওষুধ দেয়, তুমিও দেবে।
—আমি তা পারব কেন? তা ছাড়া কী বলতে কী ওষুধ দেব। অসুখ না সারলে আমাকে মারুক আর কী!
—দেবে তো জল। সামান্য চন্দন মেশানো, চিনি মেশানো। রোগ সারার প্রথম শর্তই হবে ভক্তি ও বিশ্বাস। এই দুটোর একটু কোথাও কম পড়লে রোগও সারবে না, ভবিষ্যৎও মিলবে না।
—আমি পারব না অলক।
—পারবে। আমি তোমার সঙ্গে থাকব। মন্দিরে আবার ছোট করে পুজো করব।
তার চোখে স্বপ্ন দেখা দিয়েছিল। ভবিষ্যতের সুন্দর চলচ্ছবি। উপার্জনের পথ, জীবনের নিশ্চয়তা। নিজের ভিতরকার সেই স্বপ্নকে নেড়ে চেড়ে দেখেছিল শিখারানি। প্রথমে দ্বিধা ছিল তার। ভয় ছিল। সে কি পারবে? প্রায়ই তারা মেতে উঠত আলোচনায়। এবং এভাবেই, বেঁচে থাকার উপায় বার করতে গিয়ে তারা কাছাকাছি এসে যাচ্ছিল ক্রমে। শিখারানি টের পাচ্ছিল তার মনের কালো জমাট মেঘ উড়ে যাচ্ছে, সরে যাচ্ছে ক্রমশ এই অন্তরঙ্গতায়। সে-খুশি বড় সহজে ধরা দিচ্ছে এখন। কাণ্ডজ্ঞান ন্যায়-অন্যায় বিবর্জিত সে শুধু অলকের দিকে ধাবিত হয়েছিল তখন। সে ভাবেনি কোনও পরিণতি, কোনও ফলাফলের কথা। বেঁচে থাকার টানে, আনন্দের রসসঞ্চারে সে সকলই ভুলেছে। ভুলে থাকতে চায় আজও। শুধু মাঝে-মাঝে সন্তানের আকাঙ্ক্ষায় তার বুকে টান পড়ে। দারিদ্র্য ঘোচেনি। কিন্তু অনাহারে থাকছে না তারা। এর মধ্যে একটি শিশু কি পালন করা যেত না? উন্মাদ স্বামীর সহবাস-বঞ্চিত সে। তার কী করে সন্তান হতে পারে!
সে চাষিদের ঘর থেকে দিয়ে যাওয়া নতুন ধানের চালগুলি নাড়াচাড়া করে। আর ভাবে। তাদের সেই প্রথম ঘনিষ্ঠতার দিনগুলি। খোলা উঠোনের প্রান্তে, একটুখানি ঘেরা স্নানের জায়গায় তোলা জলে স্নান করত যখন সে, দাওয়ার কোণ থেকে তাকে অপলক দেখত অলক। মোমে জলের ছিটে পড়লে যেমন ছিরছির করে জ্বলে, সেরকম জ্বলত তার চোখ। সে তখনও শারীরিক অন্তরঙ্গতার কথা ভাবতেও পারত না। শরীরের শুচিতা বিষয়ে সে ছিল পূর্ণ সচেতন। অলকের দৃষ্টির সমুখে সে ভেজা শাড়িটি দিয়ে শরীর ঢাকত বারবার। আর কোন মন্ত্রবলে দক্ষিণ স্তন আবৃত করলে উন্মুক্ত হয়ে যেত বাম স্তন। তার লজ্জা ছাপিয়ে সেই শক্তিমান মন্ত্র তাকে করে দিত নিরাবরণা। এবং অলক দৃষ্টি দ্বারা তার শরীরকে স্পর্শ করলে সে যে-শিহরণ বোধ করেছে, সেরকম আগে হয়নি। তখন যেন এক অনন্ত খেলা চলছিল তাদের। সব শোক সব কষ্টের ঊর্ধ্বে, সব দারিদ্র্য সব জঠরজ্বালার ঊর্ধ্বে এক উন্মাদনার খেলা। আর সে-খেলা চলতে চলতে একদিন সে স্নানের শেষে ভিজে কাপড়ে ঘরে গিয়ে দরজায় আগল তুলল না। হয়তো সেই মন্ত্রের শক্তিতে ঘটে গেল ভুল। যখন তার ভেজা শাড়ি স্খলিত, শতছিন্ন সায়া সে গলিয়ে দিচ্ছে মাথা দিয়ে, তখন অলক এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছিল তাকে। সে তার প্রথম প্রতিক্রিয়ায় বাধা দেয়নি, আপত্তি করেনি, শুধু বলেছিল-তোমার দাদা কোথায়?
—ও ঘরে ঘুমোচ্ছে।
গলায় শ্লেষ্মা নিয়ে বলেছিল অলক। সে জোর করে অলককে ছাড়িয়ে দিতে পারছিল না। শুধু বলেছিল—ছাড়ো আমাকে! ছাড়ো! কী করছ!
সে টের পাচ্ছিল তার সদ্যস্নাত শরীরের ওপর অলকের শরীরের উত্তাপ। অলক তাকে পেষণ করতে করতে বলেছিল—এত শরীর তোমার, এত ভরাট শরীর, এ নিয়ে তুমি কী করবে শিখারানি?
সে আত্মসমর্পণ করেছিল। যেন সত্যিই স্বামী উন্মাদ হলে নারী তার ভরাট শরীর নিয়ে কী করে! স্নান করতে করতে সে অসহায় দর্শনীয় হয়ে যায়। এমনই অসহায়তা, অপর পুরুষেরা, তার ভরাট শরীরের ভাবনায় শুকিয়ে মরে আর ভাল করে মরণ ঘনিয়ে এলে ওই শরীরেই ঝাঁপ দেয়। তখন মরতে হয় দু’জনকেই। অসহায়তা আষ্টে-পৃষ্ঠে বাঁধলে তবেই না হয় মরণঝাঁপ, তবেই না ভরাট নারী সমর্পণ দেয়। এবং সেই সমর্পণের আড়ালে শিখারানি টের পাচ্ছিল অলক বড় কর্কশ। বড় নির্মম।
সেদিন বহুকালের ক্ষুধার্ত শরীর সেই নির্মমতা গ্রহণ করেছিল। কিন্তু যখন আরও অনেক সঙ্গমের দিন তাকে পেরোতে হল, সে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। অলক আসে তার যখন ইচ্ছে এবং শিখারানির প্রস্তুতির পরোয়া না করেই শুকনো খটখটে যোনিতে লিঙ্গ প্রবেশ করিয়ে দেয়। নখ বসিয়ে দেয় দেহে এবং স্তন দংশন করে রক্তাক্ত করে দেয়। শিখারানি ছটফট করে। যন্ত্রণায় তার দমবন্ধ হয়ে আসে। সঙ্গমের স্পৃহা বায়বীয় হয়ে উড়ে যায়। অলক তাকে বিপুল শক্তিতে চেপে রাখে তখন। তার চোখ বিস্ফারিত হয়ে যায়। মুখ দিয়ে লালা পড়ে। সেই লালা ফোঁটা ফোঁটা এসে পড়ে শিখারানির মুখে। তার ঘেন্না করে। এই ঘৃণা, অভ্যাস দ্বারা, আজও স্তিমিত হল না কারণ শিখারানির মনে হয়, ওই সময় অলক অমর ঘোষালের মতোই উন্মাদ। তার ভয় করে। তবু অলককে প্রত্যাখ্যান করতে ইচ্ছে করে না। স্খলিত শিথিল আগ্রহের মধ্যে তার মনে হয়, এই বুঝি অলক তার নখর থাবায় স্তনের বদলে গলা টিপে ধরবে। মরতে মরতে বাঁচে যে মানুষ তারও মরণভয় যায় না। আর এই সমস্ত কথাই তার বুকের মধ্যে চাপ হয়ে থাকে। কাকে বলবে! কারওকে বলা যায় না। কারওকে বলা যায় না যে এক রাত্রে অশোক এসে ঢুকল তার ঘরে। সে বলেছিল—ছিঃ! অশোক বলেছিল—ছি কীসের অ্যাঁ? ছি! সতী সাজছ সাজো। কিন্তু তুমি কী সতী আমি জানি না?
প্রতিহত করতে চেয়েছিল সে অশোককে। বলেছিল—কী জানো তুমি? আমি কিন্তু চিৎকার করব অশোক।
—কে আসবে? তোমার বর? সে এখন জাগবে না। অলক আসবে না। পাড়ার লোক? আসুক। আমি বলব অলকের সঙ্গে তুমি…
—অশোক!
—অলককে যা দিয়েছ, তা আমাকে দিতে দোষ কী! তোলো। শাড়ি তোলো। তোমার যা শরীর-অলকের ওই চিমড়ে শরীরে তার খাঁই মেটে নাকি?
সে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। অশোক জানল কী করে? অলক বলেছে? অলক কী বলেছে? কান্না পেয়ে গিয়েছিল তার। জীবনের নিরাপত্তার জন্য সতী সাজছে সে! সতী!
.
আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল সে। তিনজন পুরুষের মধ্যবর্তী থাকতে থাকতে তাকেই মেনে নিয়েছিল স্বাভাবিক। বরং অশোকের আগমন সে পছন্দই করতে শুরু করেছিল। কারণ সে দাঁত ও নখরযুক্ত হয়ে ওঠে না। উন্মত্ত হয়ে ওঠে না সে। আসামাত্র ঝাঁপ দেয় না যোনিতে। ধীরগামী সে। অপেক্ষা করে। দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্যে একসময় প্রবিষ্ট হয়। এবং সে বারবার শিখারানির মুখচুম্বন করে। এই বস্তুটির প্রতি শিখারানির অসীম দুর্বলতা। অমর ঘোষাল কখনও তাকে চুম্বন করেননি। অলকও নয়।
অশোক প্রায়ই বাইরে থাকে বলে আসে কম। কিন্তু অলকের প্রাত্যহিক আগমন। মাঝে মাঝে সকল স্বাভাবিককেই তার লাগে অস্বাভাবিক। তার মনে হয়, আর পারছে না। এ জীবন আর সইতে পারছে না। ইচ্ছে করে, ছেড়েছুড়ে চলে যায় কোথাও। প্রায় বেশ্যা জীবন যাপনের গ্লানি আসে তার। ঘটনাচক্রে তিন ভাইয়ের ভোগ্য রমণী হয়ে ওঠা শিখারানি পরিত্রাণ পেতে চায়। কিন্তু কোথায় যাবে? ঘরে দু’জন ভক্ষক। কিন্তু বাইরে হাজার।
তিনজন পুরুষ তার মধ্যে গমন করেছে, কিন্তু একবারের জন্যও মাতৃত্বলক্ষণ আসেনি তার দেহে। সে বুঝেছে, সে বন্ধ্যা। ঈশ্বর সকল দিকেই তাকে মেরেছেন। নিজেকে যখন তার পাপী লাগে তখন ঈশ্বরকে সে অভিসম্পাত দেয়। বলে—তুমি মরো। সপ্নের টঙে বসে করছটা কী? নাকি তুমিও এক আস্ত হাড়হাভাতে পাগলা জগাই! হামলে পড়ছ কে কলাটা চালটা দিল, সিকি দুয়ানি দিল, তার লোভে!
আদ্যন্ত অসৎ, আদ্যন্ত পাপী, আগাগোড়া এক ঝুটো মানুষ সে। তবু মাঝে মাঝে হৃদয়ের দু’ কূল ছাপিয়ে কান্না আসে তার। বুক ভেঙে যায়! শরীরে জ্বালা করে। জ্বালা নির্বাপণের জন্য সে স্নান করে বারংবার।
অনেক পরিকল্পনার পর অলক তার প্রশিক্ষণ শুরু করেছিল। কীভাবে চুল এলো রাখতে হবে, কীভাবে দুলতে হবে, ভরে পড়লে কেমন উন্মাদের চোখে তাকাতে হবে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের দিকে। মন্ত্রোচ্চারণের ভঙ্গিতে কীভাবে নাড়তে হবে ঠোঁট!
প্রায় একমাসকাল সে অভ্যাস করেছিল। আর এই একমাস ধরে অলক প্রচার করছিল সারা গ্রাম। শিখারানির স্বপ্নে প্রত্যেকদিন দেখা দিয়ে যাচ্ছেন সতীমা। তিনি আসছেন। আশ্রয় করছেন শিখারানিকে।
সেই থেকে সতীমায়ের ভর সে দিয়ে আসছে অদ্যাবধি। তা হলও প্রায় পাঁচ বৎসর। এখন এমন হয়েছে, একাদশী বা অমাবস্যার রাতে আপনিই পরিবর্তন আসে তার মধ্যে। সে দোলে। হাসে-কাঁদে। লাল চোখ মেলে চায়। উপস্থিত আতুর মানুষজনকে স্পর্শ করে স্নেহে। এমনকী তার দেওয়া মন্ত্রপূত ওষুধে ভাল হয়েছে কতজনা। কত লোকের ভবিষ্যদ্বাণী সে করেছিল এবং তা ফলেছে। অতএব শিখারানি হয়তো-বা এই দিনে নিজেই নিজেকে বিশ্বাস করছে এক অলৌকিক বলে। এবং তখন দৈহিক ভোগসুখেও তার মন লাগছে না। অলক তখন এমনকী মন্দিরের মধ্যেও, সেঁটে ধরে তাকে, আর বলে—তুমি কি সত্যিকারের সতী হয়ে যাচ্ছ নাকি শিখারানি?
বলে আর হাসে। হাসে আর শাড়ি তুলে কফ-থুতু-শ্লেষ্মা বিজড়িত সঙ্গম সেরে নেয়।