১৬
আগন মাস সোনার মাস জমিতে লক্ষ্মীর বাসা।
সয়ারা চিন্তায় হক্কোল বেউশ বিয়ার নাই ভরসা।।
কার কথা কেবা মাতে কেবা কারে শুনে।
কেমনে সয়ারত ধান একথা রে ধুনে।।
ধনী গরিব ভেদ নাই হক্কোলোর ঘরে ধান।
এ মাসে না কেউ লয় বিয়ার বাক্যিখান।।
নামের গুণে চতুষ্কোনা হল তেকোনার বৈবাহিক। নামের মিল ছাড়া আর কোনও বিষয়েই এদের মিল পাওয়া যাবে না। আর মিল-অমিল খুঁজতে যাচ্ছেই বা কে! আসল কথা হল, নদীর ধারে বসত করে এমন সকল গাঁয়ের পরস্পরের একটাই মিল – নদীর আগ্রাসন থেকে তাদের জীবনের উপকরণগুলি সদাই আগলে চলতে হয়।
চতুষ্কোনা গ্রামের নাম চতুষ্কোনা কেন, তার কোনও উল্লেখ ইতিহাসে অথবা ভৌগোলিক অবস্থানে নেই। এর অবস্থিতি বহরমপুর থানার অন্তর্গত। ভাগীরথীর বুকে যেখানে পেতনির চর পড়েছে, তারই সমান্তরালে, ভাগীরথীর পূর্বপারে। বস্তুত, পেতনির চরে স্কুল না থাকায়, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা প্রাথমিক শিক্ষা নিতে আসে এ গাঁয়েই। দুটি স্থলের মধ্যে মাত্র এক পারাপারের ব্যবধান।
এই গ্রামকে ঘিরে আছে বিষ্টুপুর, বোয়ালিয়া, চালতিয়া ও চাঁদের বিল। গ্রাম ছাড়িয়ে পূর্বে, উত্তরে ও দক্ষিণে এগোলেই এইসব বিলের দেখা পাওয়া যাবে। আর বিষ্টুপুর বিলের শেষ প্রান্ত কেবল এই গ্রাম ছুঁয়ে যায়। এই বিলের অধিকাংশই বহরমপুর শহরে।
চতুষ্কোনা থেকে খানিক এগোলেই দক্ষিণপূর্ব মুখে ভাণ্ডারদহ বিল পাওয়া যাবে। অনেকে এই বিলকে আজও বলে গোবরনালা। বর্গিদের আক্রমণ থেকে রাজধানী রক্ষা করতে ভাণ্ডারদহ বিল ধরে গোবরনালা নামের পরিখাটি তয়ের করিয়েছিলেন নবাব আলিবর্দি খাঁ। আর এই ভাণ্ডারদহের আশেপাশেই আছে রামানা ও অঙ্গারমারি বিল। এইসব বিলের পাশ কাটিয়ে সোজা দক্ষিণ-পূর্বে গেলেই ভৈরব নদী ও তেকোনা গ্রাম।
চতুষ্কোনায় হিন্দু-মুসলমান ভাগাভাগি করে আছে। প্রচুর মৎস্যজীবী এ গ্রামে বসবাস করে। আর চাষের উর্বরা ভূমিও এখানে কম নেই। সম্প্রতি এ গ্রামের পাড় ভাঙছে ভাগীরথী। কাঁচা পাড়ে গোলাকৃতি ছেদন।
.
নদীপথ এক আশ্চর্য বিষয়। এক-এক জায়গায় তার এক-একরকম প্রবাহ এবং পৃথক গতি। মানবপ্রকৃতিতে যেমন শৈশবের, যৌবনের, বার্ধক্যের চরিত্র পালটে পালটে যায়, সেরকম নদীরও চরিত্র। পার্বত্য পথে সে একরকম। সমতলে তার চরিত্র আলাদা। শরীরের গড়ন অন্যরকম। ব-দ্বীপে তাকে লাগে অচেনা। যেন হঠাৎ কী করে বসে, কোথায় যায়! সমুদ্রসঙ্গমের আগে সে বড় বিক্ষিপ্ত। বড় উল্লোল।
নদীবিজ্ঞান নদীর প্রবাহকে মোটামুটি তিনভাগে ভাগ করেছে। উচ্চগতি বা পার্বত্য প্রবাহ, মধ্যগতি বা সমভূমি প্রবাহ এবং নিম্নগতি বা ব-দ্বীপ প্রবাহ। অধিকাংশ নদীরই উৎস পার্বত্য অঞ্চল। আর ঢালভূমিতে নদীর স্রোতধারা প্রবল ও দ্রুত। তীব্র ক্ষমতা ধারণ করে সে নেমে আসতে থাকে এবং ঘটিয়ে চলে ক্ষয়। স্রোতের প্রাবল্যে সে উপড়ে নেয় শিলাখণ্ড আর নিজের জলরাশিতে তাকে ভাসিয়ে ক্রীড়াকন্দুকের মতো লোফালুফি করে। এবং বড় বড় প্রস্তরখণ্ড, যার শরীরে নদী ঘষে চলে তার শরীর, কিন্তু বিপুল খণ্ডগুলি টলাতে পারে না বলে রুষ্ট হয়, আর তীব্র রোষে শিলা-প্রস্তরগুলির নিম্নভাগ ক্ষইয়ে দিতে থাকে, ক্ষইয়ে দিতে থাকে এক স্তরের পর অন্য স্তর আর তার প্রবাহপথে ভূগর্ভ চিরে যায়, সরু ও গভীর হয়ে যায় নদী উপত্যকা। এরপর দু’পাশের ভূমিতেও ক্ষয় লাগলে, ধস নামে শিলা, কঙ্কর, বালি ও মাটিমিশ্রিত স্থলভাগে। নদী তখন বিস্তার পেতে শুরু করে। আর স্রোতের সঙ্গে নেমে আসা শিলাখণ্ডগুলি ক্রীড়াবস্তুতে পরিণত হওয়ার অভিমানে নদীর বুকে মাথা খুঁড়ে খুঁড়ে গর্ত করে দেয়। আর পার্বত্যপথের শেষে সমতলে পৌঁছনোমাত্র নদী চরিত্র পালটায়। শিলাখণ্ডের খেলনাগুলির সামান্য কিছু মায়াভরে সঙ্গে নেয় সে, বাকি পরিত্যাগ করে, ভেসে আসা পলল পরিত্যাগ করে। সেইসব পলল, নুড়ি, শিলাখণ্ডগুলি পাহাড়ের পাদদেশে তৈরি করে গোলাকার অবক্ষেপ।
সমভূমিতে নদী ধীরা। মন্দগতি। নদীবিজ্ঞানীরা এই গতিকেই দু’ভাগে ভাগ করে বলছেন মধ্যগতি ও নিম্নগতি। সমভূমিতে নদীর ঢাল কম। তাই এই ভূমিতে নদীপ্রবাহের দ্রুতি কম। এই প্রবাহকালে এক নদীর সঙ্গে এসে মেলে অন্য উপনদী, নালা, খাল–আর নদী ক্রমশ জলপুষ্ট হয়। জলপুষ্ট হলে ধীর গম্ভীর নদী, সঙ্গে আনা মায়াময় শিলাখণ্ডগুলি একেবারেই ত্যাগ করে। শুধু ভাসিয়ে নেয় সূক্ষ্ম পলি ও বালি। শিলাখণ্ড ও নুড়িগুলি জমতে থাকে নদীগর্ভে। আর নদীর জলের ভার আঘাত করে তার প্রবাহপথের দুই পাশ। কেন না জলবতী নদী আরও বেশি বিস্তার চায়। আরও ছড়াতে চায় নিজেকে। তাই মধ্যগতিতে নিম্নক্ষয়ের চেয়ে পার্শ্বক্ষয় অধিক। এবং মন্দগামিনী এইসব নদী সামান্য বাধা পেলেই এঁকেবেঁকে যায়। আবার বাঁক খুব বেশি হয়ে গেলে একদিন বাঁক ছেড়ে আবার সোজা পথেই সে বইতে শুরু করে। ওই পরিত্যক্ত নদীখাত তখন হ্রদ বা বিলে পরিণত হয়।
সমভূমির শেষভাগে নদী-উপত্যকা বিশাল। সে তখন মোহনার কাছে। এখানে নদীর খাত অগভীর। দীর্ঘ পথ বয়ে আনা সূক্ষ্ম পলি ও বালি এই অগভীর খাতে পরিত্যক্ত হয়। এবং সেগুলি জমে জমে তৈরি করে চর ও দ্বীপ। ধীরে ধীরে এই দ্বীপগুলি জুড়ে গিয়ে মোহনার নিকট তৈরি হয় নতুন ভূখণ্ড। এই ভূখণ্ডের আকার হয় মাত্রাহারা ব-আকৃতির। তাই এর নাম ব-দ্বীপ। গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র মিলিতভাবে বঙ্গোপসাগরের মুখে যে ব-দ্বীপ সৃষ্টি করেছে তা পৃথিবীর মধ্যে বৃহত্তম। তবে পৃথিবীর সব ব-দ্বীপই একরকম দেখতে নয়। তেমনি, সব নদীই মোহনার বুকে দ্বীপ তৈরি করে না। সমুদ্র বা হ্রদ— যেখানে নদী এসে মিলিত হচ্ছে, তার তটভূমিতে যদি নদীর জলস্রোতের বেগ বেশি হতে পারে, তা হলে পলি বা বালির অবক্ষেপ পড়ে না। নদী সর্বসমেত সমুদ্রে ঝাঁপ দেয়।
প্রবাহপথের রূপ অনুসারেও নদী তিনভাগে চিহ্নিত। সরল। সর্পিল। বেণীবদ্ধ। তবে, নদীবিজ্ঞানীরা বলেন কোনও নদীই সমগ্র প্রবাহপথ জুড়ে সরল হতে পারে না। এমনকী আপাতরূপে সে সরল হলেও তার ভেতরের জলধারা প্রবাহিত হয় এঁকেবেঁকে। এবং এ-ও যেন এক মানবিক উপসংহার। শৈশব ও কৈশোরের সারল্য যেমন বাঁকা, সর্পিল অথবা জটিল আকার নেয় প্রাজ্ঞ ও পরিণত জীবনের অভিঘাতে!
নদীর গতিপথ সর্পিল হয় কেন, এ এক বিজ্ঞান-জিজ্ঞাসা। জলের প্রবাহধর্ম পরীক্ষা করে দেখা গেছে, সরল প্রবাহপথে কোনও জলস্রোতধারা জলের নির্দিষ্ট পরিমাণ ও গতিবেগ অতিক্রম করলেই জলকণাগুলি আবর্তিত হয়ে, পাক খেয়ে এগিয়ে যায়। এই আবর্তনের চাপে নিকটবর্তী স্থলখণ্ডে ভাঙন ধরে। ভাঙনের ফলে নদীর গভীরতম খাত এবং দ্রুততম জলস্রোত বাঁক ঘেষে প্রবাহিত হয়। নদীগর্ভকে তারা অতিক্রম করে আড়াআড়িভাবে। এক পারের বাঁক ঘেঁষে প্রবাহিত হয়ে তাদের গমন অন্য পারের বাঁকে। এই বাঁকে বাঁকে তৈরি হয় কেন্দ্রাতিগ বল। কেন্দ্রাতিগ—অর্থাৎ কেন্দ্র হতে দূরে গমনশীল বল। এই বল নদীবাঁকের বাইরের দিকে জলস্তর উঁচু করে তোলে এবং জলের চাপে নদীবাঁকের পাড় ভেঙে পড়ে। পাড়ের মাটি জলে মিশে নীচের দিকে নেমে জলকে ভারী করে তোলে। তখন জলের ওপরের স্তরের গতিবেগ নীচের স্তরের চেয়ে বেশি হয়। সুতরাং ওপরের জল বয়ে যায় সহজেই। কিন্তু নীচের স্তরের জল পাড়-ভাঙা কাদা-মাটির কণা বয়ে নিয়ে অপর পাড়ের বাঁকে গিয়ে ফেলে। এই মৃত্তিকা জমে জমেই তৈরি হয় নতুন চর। অর্থাৎ একপাড়ের ভাঙন, অন্যপাড়ের নতুন ডাঙা গড়ে। আর ক্রমাগত এই ভাঙন ও অবক্ষেপণ চলতে চলতে নদী হয়ে ওঠে সর্পিল।
সর্পিল প্রবাহপথ থেকেই তৈরি হয় বেণীবদ্ধ প্রবাহ। সর্পিল প্রবাহকালে সমস্ত ভাসমান পলি অপসারণ করতে না পারলে জলস্রোত তা বয়ে নিয়ে যায় নদীগর্ভে এবং গর্ভ ভরাট করে নদীপথের মাঝখানে চরা তৈরি করে। এই চরে বাধা পেয়ে জলস্রোত চরের দু’পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়। এই স্রোতঃপ্রক্রিয়া চলতে থাকে এবং অনেকগুলি চরা তৈরি হয়ে গেলে একটিই নদী অনেকগুলি শাখাপ্রশাখায় বিভাজিত হয়ে চলে। কিছুদূর এভাবেই প্রবাহিত হয়ে আবার শাখাগুলি পরস্পর মিলিত হয়। তখন ওই বহু শাখায় বিভক্ত নদীকে দেখায় বেণীবন্ধনেরই মতো।
মানবজীবনের মতো, কিংবা যে-কোনও প্রাণীরই জীবনধারার মতো নদীরও আছে যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব, বার্ধক্য। যৌবনে নদী খরস্রোতা। প্রৌঢ়ত্বে সে অর্জন করে ভারসাম্য। স্থিত হয়ে বসা সংসারী মানুষের মতোই তার আকৃতি, গর্ভের ঢাল, প্রস্থচ্ছেদ, বাহিত পলিকণা ও স্তরায়িত মৃত্তিকার মধ্যে একটি সামঞ্জস্য গড়ে তোলে। এই সামঞ্জস্যের মধ্যেই সে তৈরি করে ভারসাম্য। সুগৃহী বা সুগৃহিণী নদ-নদীগণ ভারসাম্য সুন্দর করে রাখেন। তাঁদের গর্ভে পলির অনুপ্রবেশ এবং নির্গমন চলে ছন্দে ছন্দে। তাঁদের ঢাল থাকে চমৎকার। আর নদী-অববাহিকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হলে নদী হয়ে ওঠে বিধ্বংসী, সংহারী, করাল।
.
এখন কার্তিক গিয়েছে, অগ্রহায়ণ এসেছে। এসময় সূর্য বৃশ্চিকরাশিতে অবস্থান করেন। অগ্র অর্থে শ্রেষ্ঠ বা প্রথম। অতি প্রাচীনকালে অগ্রহায়ণ মাসই ছিল বছরের প্রথম মাস। বাংলার ষড়ঋতুর মধ্যে এ মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ মাসে মাঠে মাঠে শস্যপ্রাচুর্য। এই প্রাচুর্য অতি সুন্দর, অতি মনোহর দৃশ্য রচনা করে শস্যের ক্ষেত্রগুলিতে। এবং মাসান্তে ভরে ওঠে ধানের গোলা। যখন গাঁয়ের ধান কলে ভাঙানো হত না, যখন ময়দানে, উঠোনে হত ঝাড়াই-মাড়াই আর ঢেঁকিতে ধান ভানা হত, তখন বাতাসে লেখা হত ধান ভানা গান। আজ আর সর্বত্র ঢেঁকিতে পা পড়ে না। কোথাও কোথাও সে কেবল প্রাচীন ধারার মতো রয়ে গেছে চাষির ঘরে। তবু লম্বা লম্বা ধানের শিষ যখন মাথা দোলায় তখন বাতাসে ভেসে আসে ধানভানার গান। সে যেন এক ওপার হতে আসে কোন এক অতীত কালের সুর হয়ে প্রাচীন ঢেঁকিবস্তুটির মতোই। কেন-না ফসলের কোনও কাল নেই। সেকাল থেকে একাল হয়ে ভবিষ্যে পৌঁছে তারা একইরকমভাবে মাথা দোলায় বাতাসে। দেয় একইরকম স্বাদ গন্ধ। আর এই বাংলায় ফসলের মধ্যে ফসল হল ধান। সেই ধানের গান বাতাস হয়ে বাতাসের অঙ্গে অঙ্গে ফেরে।
ধান কুটি পরিপাটি ধান আমাদের লক্ষীমা-টি
ধান কুটি ধান কুটি ধান কুটি
ধান ঝাড়িলে থাকে খড়, সেই খড়েতে ছাইব ঘর
গোয়াল ভরে সে খড় দিব গ্রহণ
সে ধান ঢেঁকি ঘরে যায়, বোঝাই করে সোনার নায়
ভিন গেরামে যায় রে সে ধান আঁটি।
যায় উড়ে যায় ধান নিয়া চড়াই পাখি, বনের টিয়া
রাত জেগে তাই ধান ভানতে এমন খাটাখাটি
লক্ষ্মী এল লক্ষ্মী এল লক্ষ্মী চিড়া পিঠা খেল
এমনি যেন সারা কাল, দেশেতে না হয় আকাল
লক্ষ্মী তোমায় গড় করি, তোমার দুটি চরণ ধরি
তোমার প্রসাদে সকল ঘর থাকে যেন এমনি পরিপাটি
ধান কুটি ধান কুটি ধান কুটি
এমন সব গান—আহা, তারা বাতাস হয়ে গেল। তবু মানুষের সঙ্গে মাটির সম্পর্ক এখনও তেমনি গভীর, তেমনই অনিবার্য।
.
হাত দিয়ে আল সংলগ্ন মাটি গুঁড়ো গুঁড়ো করছিলেন বলাই মণ্ডল। এ তাঁর অভ্যাস। মাটি ছুঁয়ে-ছেনে দেখা তাঁর তৃপ্তি। ভরা ফসলের মাঠে মাটি দেখাই যায় না খুব। তবু আল ঘেঁষে থাকা দু’-এক চাকলা মাটিকে তিনি নিষ্পেষিত করেন। নানান কারণে তাঁর মন ভাল নেই। তবু হাতের চাপে মাটিগুলি গুঁড়িয়ে দিতে আরাম বোধ হচ্ছিল তাঁর। মায়ার স্তনের কথা মনে পড়ছিল। দুটি কিশোর সন্তানের জননী মায়া আজও বড় নরম। মনোরমা।
শরীরের মতোই নরম মায়ার মন। রাগ করা তাঁর ধাতে নেই। কলহ তাঁর সয় না। অথচ ছোটভাই কানাইকে বিয়ে দেবার পর থেকে সংসারে নিত্য কলহ, নিত্য অশান্তি। কানাইয়ের বউ রানি বড় মুখরা। অসন্তোষী। কখন কীসে তার মেজাজে দাবানল ধরে যায়—কেউ তার নাগাল পায় না। সেদিন যেমন, কুটুম এসেছেন, রানিরই পিসিমা-পিসেমশাই, তাঁদের সন্তান-সন্ততি, ঘর ভরা। কুটুম্বের জন্য কিছু বেশি পদের আয়োজন করেছিলেন মায়া। কিন্তু সকাল থেকে রানি কুটোটি নাড়ল না। বাপের বাড়ির লোক এসেছেন, সে কি একটু প্রাণ খুলে কথা কইবে না? মায়া একা হাতে সামলাচ্ছেন। বেলা গড়িয়ে যায়। তখন এক ডাঁই ধোয়া-কাচা পড়ে আছে। মায়া রানিকে ডেকে বললেন—রানি, এবার একটু হেঁসেলে যাও বাপু। আগনের বেলা। টুক না বলতেই ফুরিয়ে যাবে। আমি ততক্ষণ কাপড়গুলো কেচে নিই।
রানি বলে বসল—রোজই তো হেঁসেল ঠেলি দিদি। পিসিরা এসেছেন, একটা দিন একটু কথা কইব না! নাকি আমার বাপের বাড়ির লোক বলে আমাকেই রেঁধে খাওয়াতে হবে! তা সেটা আগে বললেই পারতে।
মায়া আহত হলেন। কুটুম্বের সামনে অপমানিতও বোধ করলেন। বললেন- কোন কথায় কী কথা বলো? রান্না বলতে বাকি কেবল টক আর পোস্তর বড়া। ঠিক আছে। তোমাকে কিছু করতে হবে না। নেয়ে নাও। রান্না হলে ওঁদের খেতে দিয়ো। আমি তখন কাপড় কেচে নেয়ে আসব।
তখন পিসি বললেন—যা রানি। বড়জায়ের সঙ্গে হাত লাগা। বেলা হয়ে এল।
রানি গুম হয়ে গেল। তখন-তখন আর কিছু বলেনি। দুপুরে খেয়ে-দেয়ে পান মুখে দিয়ে পিসিরা বিদায় নিলেন আর রানি পড়ল মায়াকে নিয়ে।
— আমাকে এভাবে ছোট না করলেই কি চলছিল না তোমার দিদি?
—আমি কী করলাম?
— আমার বাপের বাড়ির লোকদের বোঝালে, আমি পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকি আর সব তুমিই করো।
আমি তো তেমন কিছুই বলিনি তোমাকে রানি।
— আড়ে বলনি, ধারে বলেছ। এত করি এ সংসারে। খেটে খেটে মুখে রক্ত উঠে গেল। তবু কী অপমান! ছার কপালে নোড়ার ঘা। সকালসন্ধে লাথি খা। এই তো আমার ভাগ্য!
মায়া কেঁদে ফেললেন এবার—অত মুখ কোরো না রানি। আমি ক্ষমা চাইছি তোমার কাছে। অন্যায় হয়ে গেছে আমার।
— ক্ষমা! ও রাস্তা তোমার খোলাই আছে দিদি। কিছু বললেই ক্ষমা
মায়া আর কথা বলেননি। রানি সারা সন্ধ্যা নিজের ঘরে দোর দিয়ে ছিল। রাতে খাবে না এই ঘোষণাও করে দিল একবার। মায়া আর সাধ্যসাধনা করেননি। কিন্তু রাত্রে কানাই ফিরলে রানি তার কাছে নালিশ ঠুকল দিদি তাকে কীভাবে অপমান করেছেন। কানাই ক্রুদ্ধ হল, তবে চেঁচামেচি করল না। মায়াকে বলল—বউদি, রানি ছেলেমানুষ। তুমি কি একটু মানিয়ে নিতে পারো না?
পাশের পাঁচকুড়া গ্রাম থেকে কানাই নিজেই পছন্দ করে এনেছিল রানিকে। জাতে-ধর্মে মিল ছিল, তাই আপত্তির কিছু ছিল না। অবশ্য মিল না থাকলেও বলাই আপত্তি করতেন না। জাতি-ধর্মের সংস্কার তাঁর নেই। মানুষের পরিচয় সে মানুষ—এমনই তাঁর বিশ্বাস। মাঝে-মাঝে ইতিহাসকে প্রত্যক্ষ করেন বলাই। যে-মানুষ ইতিহাসকে দেখে না, সে নিজেকে দেখবে কী করে! মানুষ ইতিহাসের উৎপাদন। এই বর্তমান ইতিহাসের উৎপাদন। এতকালের সকল সংস্কার, বিশ্বাস, বোধ ও অভিযোজনের পুরোভাগে আজকের এক-একজন মানুষ। মানুষ বিচ্ছিন্ন নয়। ভুঁইফোঁড় নয়।
ইতিহাসদর্শী বলাই জানেন, জাতি ধর্ম বিভেদ করে মানুষ কিছুই পায়নি। শুধু কিছু রক্তাক্ত সময় এবং ঘৃণার জমাট জগদ্দল প্রাচীর। তবু এই সবই তাঁর একান্ত বোধ। তাঁর আপন শিক্ষায় শিক্ষিত চেতনা। তিনি জানেন, সমাজে বাস করতে গেলে, সমাজের প্রচলিত মতামতকে উড়িয়ে দেওয়া চলে না। কিছু মেনে নিতেই হয়। তাই কানাই মণ্ডলের স্বজাতে বধূ নির্বাচনের ভূমিকায় তিনি স্বস্তি পেয়েছিলেন।
বলাই মণ্ডলের জমিজমা যা আছে, তাতে স্বচ্ছন্দে দিন চলে যায়। গোটা জমিতে ধান ও সোনামুগের চাষ করেন বলাই এই হৈমন্তী মরশুমে। ধানিজমির এক প্রান্তে একটুকরো জমি তিনি ছেড়ে দিয়েছেন সংসারের নিত্যকার সবজি ফলানোর জন্য। এখন তাতে কপি, বেগুন, মুলো, লঙ্কার চারা। আর এইসব জমিজমা ছাড়াও ভাগীরথীর পাড় ঘেঁষে আছে আমবাগান। এ সবেরই মালিক অবশ্য একা বলাই মণ্ডল নন, কানাই মণ্ডলও। বাপের সম্পত্তি দু’ভাই সমান পাবে, এ নিয়ে কোনও কথা উঠতে পারে না।
এখন বলাই মণ্ডলের সামনে দিগন্তছোঁয়া পরমান্নশালী ধানের ক্ষেত। ধানের সুগন্ধে বাতাস বড় পবিত্র মনে হয়। মাঠের এখানে-ওখানে কয়েকজন কৃষক। এই ভরা ধানের মাঠে এখন কাজ অল্প। তাই লোক কম। লোক লাগে ধান কাটার সময়, ধানগাছ রুইবার সময়, ভূমি তৈরির কাজে। গাছ ফলন্ত হলে কেবল নজর রাখা। পোকা লাগল কি না। পাখিতে খেল কি না।
তাঁর মাঠে কাজ করা লোকগুলি সব মুনিষ মজুর। জন-খাটা কৃষক। কৃষিকাজ জানে। সিদ্ধহস্ত। কিন্তু ভূমিহীন বলে পরের জমিতে শ্রম দেয়। দরিদ্র এইসব মুনিষদের প্রতি সহানুভূতি আছে বলাই মণ্ডলের। কারণ তিনি নিজেকেও ওদের সঙ্গে একই সূত্রে দেখেছেন। দেখা সম্ভব হয়েছে এ কারণেই যে জমির মালিক হিসেবে তিনি নিজে কখনও নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকেননি। মুনিষদের সঙ্গে হাত লাগিয়েছেন সমানভাবে।
আর কানাইকে তিনি দিয়েছেন আমবাগানের ভার। সেই আমবাগানের পাড় ঘেঁষে মাটি ফাটছে। এখনও বড় আকার নেয়নি। কিন্তু নিতে কতক্ষণ! ভয়ে বলাই মণ্ডলের বুক দুরু দুরু করে। মনে হয়, হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখবেন অনেকগুলি আমগাছ নেই!
নদী শাসন মানে না। তিনি জানেন। তবু ইদানীং পাড় বাঁধাবার ওপর ভরসা করতে ইচ্ছে করে তাঁর। মনে হয়, সেচ দপ্তরে বলে কয়ে স্পার বা বেড়বার করে নিতে পারলে যেন আর একটিও আমগাছের ক্ষতি হবে না। ভেতরে ভেতরে অসহায় বোধ করেন তিনি। বদরুদ্দিন চলে গিয়ে গ্রামের ক্ষতি হয়েছে। গ্রামের উন্নয়ন নিয়ে সে ভাবত। সে আসবে নিশ্চয়ই মাঝে-মধ্যে। কিন্তু গ্রামে না থাকলে কি তার টান কমে যাবে না? সে কি অনেক বেশি জড়িয়ে পড়বে না শহুরে রাজনীতির সঙ্গে? পঞ্চায়েতে যারা আছে, তারা বোঝে কেবল আপন ভাল। ভাগীরথীর পাড় সংলগ্ন জমি যাদের নেই, তাদের এই পাড় ভাঙার সূচনায় কোনও আক্ষেপ নেই। হায়! তারা জেনেও জানে না। বুঝেও বোঝে না। নদী পাড় ভাঙতে ভাঙতে কখন কার জমির কণ্ঠলগ্ন হয়ে যাবে কে বলতে পারে! জমি যখন গ্রাস করবে সে, তখন লোক চিনে চিনে করবে না।
বলাই মণ্ডল মনে মনে বদরুদ্দিনের সঙ্গে কথা বলেন। দুটি আলাপ-পরামর্শ করতে পারলেও মন শান্ত হয়। একটাই ভরসা, গ্রামের মাথা স্বয়ং সুকুমার পোদ্দারের আমবাগান আছে নদীর পাড়ে। বলাই মণ্ডলের বাগানের গা ঘেঁষেই তাঁর বাগান। অতএব বলাই মণ্ডল সুকুমার পোদ্দারের কাছে যাওয়াই স্থির করেছেন।
দিনের শেষে ঘরে ফিরে সাদা পাতার সামনে বসলে কেবল নদী এসে গ্রাস করে জগৎ চরাচর। আর কোনও চিত্র নয়। আর কোনও ভাবনা নয়।
এতকাল নদী তাঁকে কেবল মুগ্ধ করেছিল। আমবাগানে গিয়ে কতদিন অনিমেষ চেয়ে থেকেছেন নদীর দিকে। আর বুকের মধ্যে পুলক অনুভব করেছেন। গঙ্গা— মা মাগো— একান্তে উচ্চারণ করে দেখেছেন নিজেকে বড় পবিত্র লাগে। তিনি জানেন এই পবিত্র-বোধের মধ্যে আছে সহস্র বৎসরের বিশ্বাস ও সংস্কার। তিনি সেই সংস্কার গ্রহণ করেন। বিশ্বাস গ্রহণ করেন। নিজের রচিত গাথাগুলি স্মরণ করে হাত অঞ্জলিবদ্ধ করেন। নিরুচ্চারে বলেন –হে গঙ্গা, হে যমুনা, সরস্বতী, শতদ্রু ও পরুঞ্চি, তোমরা শোনো। তোমরা ভাগ করে নাও আমার স্তবগুলি, আমার গাথাগুলি, আমার কবিতা। সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে পর, তিনি সেই স্বর্গীয় শিশুদেহ বুকে করে এসে দাঁড়াতেন গঙ্গার পাড়ে। তাঁর চোখের সামনে দিয়ে ভেসে যেতেন অষ্টবসুগণ। তাঁর চোখের সামনে তখন গঙ্গা। তিনি, শিশুটির, আপন ঔরসজাত স্বর্গীয় শিশুটির, চোখে চোখ রেখে বলতেন—শোনো, ইনি গঙ্গা! সকল কলুষনাশিনী। ইনি গঙ্গা! ইনি আমাদের কল্যাণী মাতৃস্বরূপিণী! ইনি গঙ্গা! এঁর পবিত্র ক্রোড়ে আমরা জীবন লাভ করেছি।
কিন্তু এখন এই নদী ভাগীরথী তাঁকে দেয় দুঃস্বপ্ন। একা নিজের জন্য নয়। সকলের জন্য তাঁর হৃদয়ে আতঙ্ক উপস্থিত হয়। এ গাঁয়ে নদীর ধার ঘেঁষে যারা বসত করে তারা অধিকাংশই জেলে। হিন্দু-মুসলমান মিলিয়ে পাশাপাশি বাস। বলাই মণ্ডলের আশঙ্কা হয়, ধারার বেড়ার ভিটেমাটি—গরিব জেলেদের এই সম্পদ। সেইসবও তলিয়ে গেলে যাবে কোথায় সব! বন্যায় ক্ষয়-ক্ষতি হয় প্রায় বৎসর। কিন্তু বন্যা বাস্তুজমি নিয়ে চলে যায় না! ইদানীং তাঁর কবিতায় বড় গভীর হয়ে ঢুকে পড়ছে অজানা ভয়ের শব্দ। তিনি কী করবেন? মানুষ যতদিন বাঁচে ততদিন সুখে-সম্পদে পরিপূর্ণ হয়ে বাঁচতে চায়। নিরাপদে বাঁচতে চায়। দু’বেলা তৃপ্তির আহার, একটুকু আশ্রয়, সামান্য আহ্লাদের স্পর্শ আর দুধে-ভাতে থাকা সব সন্তানসন্ততি—সেদিক থেকে দেখলে ভারতবর্ষের অধিকাংশ মানুষের চাহিদা সামান্য। সেই সামান্যকেই বড় আকড়া হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে এখন।
এক ঝাঁক ফিঙে এসে বসল ফসলের ওপর। বলাই মণ্ডল তাড়িয়ে দিলেন না। একজন মুনিষ লাঠি হাতে দৌড়ে এসে উড়িয়ে দিল ফিঙেদের। বলাই মণ্ডল বারণও করলেন না তাকে। মুনিষ তার কর্তব্য করছে। তবে পাখিরা ফসলের ক্ষেতে এলে বলাই মণ্ডলের তাড়াতে ইচ্ছে করে না। একটু ক্ষতি করে ওরা। ধান ঠুকরে খায়। গাছ মুড়িয়ে ভাঙে। কিন্তু সে আর কত? মানুষের মতো ক্ষতি করার শক্তি তাদের নেই। নৃশংসতা সে কেবল মানুষের। এই যে লোকগুলো গুলি খেয়ে মরে গেল হরিহরপাড়ায়, এমনই সাধারণ ব্যবসায়ী কৃষক-মজুর সব, এমনই সাধারণ, তবু মরে গেল মানুষেরই নিষ্ঠুরতায়। এরকম হওয়ার কথা তো ছিল না। এ গ্রামেরই মইদুল বাদ- প্রতিবাদের উত্তেজনায় তার বড়ভাই আবদুলের মাথায় মেরে বসল কোপ আর ভারী দায়ের কোপে মাথা ফাঁক হয়ে গেল মানুষটার— এমন সব কাজ, এমন নির্মমতা পাখিদের নেই। ভার হয়ে থাকা বুকে তিনি ফসলের লালিত্য আশ্রয় করেন। পাখিদের ওড়াউড়ি আশ্রয় করেন। আজও তিনি ক্ষেতে কীটনাশক ব্যবহার করেননি। তাই তাঁর ক্ষেতে পোকামাকড়ের আক্রমণ বেশি। পাখির ওড়াউড়ি অধিক। ফসলের ক্ষতি হয়। ধানের পরিমাণে টান পড়ে। কিন্তু তাঁর মনে হয়, কীটনাশকে ওই পরমান্নশালী ধান তার স্বাদ-গন্ধ হারিয়ে ফেলবে বুঝিবা। বুড়ো মুনিষ তাজু মিঞা তাঁর বিশ্বাসে সম্মতি দেয়। বলে—হ্যাঁ, ধান কি ভোগের বস্তু? ধান ফলানো শিল্পীর কাজ। আদুরি ধান, ভাদুরি ধান, তার বড় অভিমান। কীটনাশকের বিষে ধানের বুকে অসুখ ঢুকে বসে গো!
কিন্তু তাজু মিঞার ছেলেগুলি এইসব মান্য করে না। টাটকা জোয়ান পুত্রেরা সব, বলে— যে কালের যেমন। এখন হল অধিক ফলনের কাল। গুণমানের দাম দেয় নাকি দুনিয়া? শিল্প আবার কী! লোকে ধান ফলায় পেটখোরাকির জন্য। যত বেশি উৎপাদন হবে, ততই না বাড়বে খাদ্যসম্ভার।
কানাই মণ্ডলের একই মত। তাজু মিঞার পুত্রদেরই মতো। সে বলে—সবাই যা করে, তোমার তা করতে ক্ষতি কী! জাল অন্তত লাগাও। তাতেও তো কিছু ফসল বাঁচে।
বলাই মণ্ডল বলেন- পাখি হল লক্ষ্মী। জাল লাগিয়ে তাদের বঞ্চিত করতে নেই।
—কত ভাল সার পাওয়া যায় এখন। ফসল দ্বিগুণ করে দেবে। সেসব লাগাও।
—কত কষ্ট করে পরমান্নশালীর বীজ রক্ষা করে আসছি এতকাল! এ অঞ্চলে কেউ তো আর এসব ধান ফলায় না। রাসায়নিক সার দিলে ওই ধানের বীজ আর রাখতে পারব না আমি। ধানের গুণ চলে যাবে রে কানাই।
—কী লাভ এই ধান করে? এই ধানের জন্য যে-দাম তুমি পাও, তার চেয়ে অনেক খারাপ চাল তিনগুণ দামে বিক্রি করে বড় বড় কোম্পানিগুলি। শুধু প্যাকেজিংয়ের জোরে। তা ছাড়া ভাল বাসমতী, কালোজিরে, মধুশালী ধান সব কম দামে কিনে নেয় আড়তদাররা। তারপর বেশি দামে বেচে। কত ধান চোরাপথে বিদেশে চলে যায়। ভাল দাম পাওয়া যায় সেখানে। তুমি তো সে-পথ নেবে না।
—আমাদের তো দিন থেমে থাকছে না কানাই। চলে তো যাচ্ছে। ফসল কি শুধু অর্থের জন্য। এ হল কৃষকের প্রাণের ধন। শিল্প। কী আশ্চর্য এইসব ধান।
—হ্যাঁ, তুমি ফলাবে সোনালি মুগ, পরমান্নশালী ধান। বছরে চারমাস জমি ফেলে রাখবে উর্বরতা আনার জন্য। আর অন্যরা শুধু সরকারি আই আর এইট মিনিকিট চাষ করে পাকা দালান তুলবে।
কানাইয়ের অসন্তোষ টের পান বলাই। বিপুল অর্থ কে-ই বা না চায়। তাঁর অর্থের মোহ নেই। কিন্তু কানাই তাঁরই মতো হবে, তার যুক্তি কী! ঈশ্বরের কাছে তিনি কখনও ধনভাণ্ডার চান না। চাইতে পারেন না। যখন তখন ইতিহাস তাঁর সামনে এসে দাঁড়ায়। সেই ইতিহাসে তিনি নিজেকে আবিষ্কার করেন যুগ-যুগান্তরের একজন কৃষক হিসেবেই। তিনি ছিলেন কজঙ্গল নগরীতে। ছিলেন গৌরে, কর্ণসুবর্ণে। ছিলেন মুর্শিদাবাদ নগরী পত্তনের সময়। চেহেল সুতুনের স্তম্ভ ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। এক বিস্মিত কৃষক। সুজাউদ্দিনের সময় খাজনা দিয়েছেন নিয়মিত। আলিবর্দী খাঁর সময় তাঁর স্ত্রীকে লুণ্ঠন করেছিল বর্গীরা। এবং তাঁরই সামনে লেখা হয়েছিল মহারাষ্ট্রপুরাণ। তাঁর অশ্রুতে কালির বড়ি ভিজিয়ে লেখা হয়েছিল।
তবে কোন কোন গ্রাম বরগি দিলা পোড়াইয়া।
সে সব গ্রামের নাম সুন মন দিয়া ॥
চন্দ্রকোনা মেদিনীপুর আর দিগনপুর।
খিরপাই পোড়ায় আর বর্দ্ধমান সহর ॥
নিমগাছি সেড়গা আর সিমইলা।
চণ্ডিপুর শ্যামপুর গ্রাম আনইলা ॥
এই মতে বৰ্দ্ধমান পোড়াএ চাইর ভিতে।
পুনরপি আইলা বরগি বন্দর হুগলিতে ॥
আর সিরাজদ্দৌলার সমসাময়িক এক দুর্ভাগা কৃষক তিনি। সিরাজদ্দৌলারই মতো দুর্ভাগা। কেন না খাজনা বকেয়া রাখার দায়ে জমিদার তাঁকে চাবুক মেরে রক্তাক্ত করেছেন পিঠ। অধিকার করেছেন জমিজমা ভিটে। নির্মম প্রহার করেছেন তাঁর সন্তানগুলিকে। তাঁর অস্থিসার স্ত্রীর বলাৎকার ঘটেনি। কিন্তু ভিটে ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাননি বলে জমিদারের পেয়াদা তাঁর চুল ধরে তাঁকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এসেছে আঙিনায়। আর তিনি, এক যুগযুগান্তরের কৃষক বলাই মণ্ডল দেখছেন সিরাজদ্দৌলাকে। বিনিদ্র সিরাজ। একাকী নির্জন পটমণ্ডপে বসে প্রহর গুনতে গুনতে রাত পার করে দিলেন। চিন্তাক্লিষ্ট, বিষণ্ণ নবাব ভোরের সামান্য আলোয় একাকী বসে আছেন। একটি চোর, নবাবের সামনে থেকে ফরশি তুলে নিয়ে চলে গেল। বস্তুটির জন্য সিরাজ চোরের পেছনে কিছুক্ষণ ছুটলেন। বাইরে এসে দেখলেন, তাঁর অনুচরেরা কে কোথায় চলে গিয়েছে! একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে তিনি বললেন— হায়! আমি না মরতেই এরা আমাকে মৃতের মধ্যে গণ্য করে নিয়েছে।
এই দীর্ঘশ্বাস, এই বেদনাময় আক্ষেপ, আজও ধ্বনিত হয় পাতার মর্মরে। ভাগীরথী ও জলঙ্গীর জলভাষায়। বাতাসে। এইসব তাঁকে কী প্রকারে লোভী করে? কী প্রকারে নিয়ে যায় পরমান্নশালী ধান হতে আই আর এইট মিনিকিটে? তিনি এক কৃষক আত্মা। ভূমি হতে উত্থিত হয়ে ভূমিতে লীন হয়ে যাবেন। ফের জন্ম হবে তাঁর। এই অস্তিবোধ তাঁকে লোভী করে কী প্রকারে!
আর কত আশ্চর্য সব ধানের চাষ হত তখন। কী সুন্দর নাম। গঙ্গাজল, কুসুমশালী, ডহরনাগরা, জটাগোটা, রাইমণি। সরু দানার কী চমৎকার স্বাদ। তার সামান্যই আছে এখন। বাঁশপাতা, চামরমণি, কালোজিরে, মধুশালী, কালালুনিয়া, গোবিন্দভোগ, আর পরমান্নশালী- তাঁর নিজের ধান। কিন্তু সে আর কত! দিকে দিকে কেবল আই আর ৩৬, ৪০৮৪, শ্বেতী স্বর্ণা, লালস্বর্ণা, পারিজাত, স্বর্ণলঘু ইত্যাদি উচ্চফলনশীল ধান।
বলাই মণ্ডলের ভাল লাগে না নম্বর দেওয়া নাম। ভাল লাগে না উচ্চফলনশীলতার আকাঙ্ক্ষা। তিনি তাঁর পরমান্নশালীর গায়ে হাত রাখেন। মার্গশীর্ষ অগ্রহায়ণে এরাই তাঁকে দেবে নবান্ন, দেবে জীবনের আশীর্বাণী। মায়া বলবেন— ধান এল ছালা ছালা। তা তুলতে গেল বেলা।
তাঁর মনে পড়ে—
মাস মধ্যে মার্গশীর্ষ আপনি ভগবান।
হাটে মাঠে গৃহে গোঠে সবাকার ধান॥
তাঁর গৃহে এই যা ধান উঠবে, তাতেই তিনি সুখী থাকবেন। এর বেশি আর কী চাই! আমবাগানের আয় ভাল। তাঁদের সংসারও কিছু বড় নয়। কানাই বলাই মণ্ডলের এই ভাবনাগুলিকে আড়ালে ব্যঙ্গ করে বলে—কবির বুদ্ধি।
তা বটে। এইসব বুদ্ধি খাঁটি সংসারী বুদ্ধি নয়। পাটোয়ারি বুদ্ধি নয়। এর মধ্যে আছে অশেষ কৌতুক। চাষার ঘরে, বলাই মণ্ডল নামে একজনের কবি হয়ে ওঠা অসঙ্গত। উচিৎ তো ছিল না এসব। তবু বলদের দেহের গন্ধে, কাদামাটির জোঁক, কেঁচো, কেন্নোর মধ্যে, ধান্যশীর্ষের দুধেল বিস্তারের আশীর্বাদে একদিন বলাই মণ্ডল লিখে ফেললেন কবিতা— নাকি ছুঁয়ে দিলেন কবিতা আর সারা গ্রাম তাঁর দিকে তাকাল বিস্ময়ের চোখে। কিছু-বা ব্যঙ্গের চোখেও। কবিতা বোঝে না কেউ এখানে। পড়ে না। শহরের সংলগ্ন গ্রাম বলে বলাই মণ্ডলের মতো স্কুল পাশ আছে কয়েকজন। তারা পঞ্চায়েত বোঝে, রাজনীতি বোঝে, জমির দর, দখল, ব্যবসা বোঝে। কিন্তু কবিতা বোঝে না। বোঝে একমাত্র বদরুদ্দিন। বলাই মণ্ডলের চেয়ে অনেক ছোট সে। তবু কাব্যরস এই দুই ব্যক্তির মধ্যে গড়ে দিয়েছে গভীর সম্বন্ধ। সারা গ্রামের মধ্যে একমাত্র এম এ পাশ বদরুদ্দিন বহরমপুরে চলে যাওয়ায় বলাই মণ্ডল একা বোধ করছেন। মাঝে মাঝে তাঁর ইচ্ছে করে, কানাইকে সামনে বসিয়ে পুরনো সব কথা বলেন। পুরনো কথা। ইতিহাসের কথা। কেমন ছিল পুরনো চাষের পদ্ধতি, চাষি বেঁচে থাকত কীভাবে! বর্গী আক্রমণে কীভাবে তারা সর্বস্বান্ত হল আর সিরাজদৌল্লার পতনের পর ক্রমে নীলকরের নখরের আঘাতে রক্তাক্ত হল! ধান্যশিল্পী হয়ে গেল নীলচাষি। রেশমশিল্পী হয়ে গেল নীলচাষি। তিল, তিসি, পাট, সরষে- সব হয়ে গেল নীলে নীল। ইচ্ছে করে, শোনান এইসব। সমুখে বসিয়ে বলেন। এইসব শুনলে হয়তো কৃষকের সন্তান কানাই মণ্ডল শুধু টাকা করার দিক থেকে মন তুলে ভূমির সঙ্গে মানুষের প্রকৃত সম্পর্ক অনুসন্ধান করত। কিন্তু কানাই সেসব শোনার মানুষ নয়। ইদানীং সে রাজনীতিতে ভিড়েছে। রাজনীতি না করলে কোনও সুবিধাই নাকি এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না। রাজনীতি করলেই কেরোসিন তেলের বিক্রয়স্বত্ব পাওয়া যায়। পথ-নির্মাণের বরাত পাওয়া যায়। পাড় বাঁধানোর জন্য প্রয়োজনীয় তারজালি, পাথর প্রভৃতি সরবরাহের বরাত পাওয়া যায়। এ ছাড়াও, সে যা করতে চায়, তার অনুমতিপত্র জুটিয়ে নেওয়া সহজ।
— তোর কী সুবিধে দরকার?
ভাইকে জিগ্যেস করেছিলেন বলাই মণ্ডল। সে বলেছিল— আছে, দরকার আছে। চাষা হয়ে থাকব নাকি চিরকাল? ব্যবসা করব।
—ব্যবসা তো করছিস।
—কী ব্যবসা করলাম?
—কেন, আমবাগানের ব্যবসা!
—ধুর! ওকে ব্যবসা বলে? তা হলে কী ব্যবসা করবি?
—সে দেখতে হবে।
—আমরা চিরকালের কৃষিজীবী মানুষ। পরিশ্রম করে খাই। আমাদের রাজনীতির দরকার কী!
কানাই পছন্দ করেনি এইসব সাবধানি বাক্য। বয়সে প্রায় পনেরো বছরের ছোট ভাইয়ের প্রতি প্রায় সন্তান-বাৎসল্য অনুভব করেন বলাই মণ্ডল। তাঁদের দু’জনের মধ্যে ছিল আরও দুই ভাই। একজন বছর পাঁচেক বয়সে সর্পদংশনে মারা যায়। ভরা বর্ষায় ধানক্ষেতে গিয়েছিল সে চিংড়ি ধরতে। এই সময় ক্ষেত-খামারে উঠে আসে কই মাগুর শিঙি আর চিংড়ির দল। এখন পরিমাণে কমে গিয়েছে। কিন্তু তিরিশ-চল্লিশ বছর আগে, পুকুর খাল বিল থেকে কুড়িয়ে বাড়িয়ে মাছ ধরা হত না যখন, উপচানো জলের সঙ্গে মাছেরা চলে আসত জমিতে। আর আসত সাপ। আসে এখনও। তবে কীটনাশক দ্বারা পরাস্ত হয়। তখনকার সকল অপরাজেয় সাপের মধ্যে একটি দংশন করেছিল বলাই মণ্ডলের ভাইকে। মুখে গ্যাজলা ওঠা, বিষে গাঢ় নীল দেহ তারা কলার ভেলায় করে ভাসিয়ে দিয়েছিল গঙ্গায়। সেই ভেসে যাওয়া ভাইটি কোনও দিন সুস্থ হয়ে ফিরে আসবে, এই প্রত্যাশা তিনি বহুদিন লালন করেছিলেন। আকৈশোর।
এই সর্পাঘাত ঘিরে গৃহে যে শোকাবহ রচিত হয়েছিল তার খানিক প্রশমন ঘটে আরও একটি শিশু এসে যাওয়ায়। মাস তিনেকের শিশুটিকে এক শীতের মধ্যাহ্নে তেল মাখিয়ে উঠোনে শুইয়ে রেখেছিলেন বলাই মণ্ডলের মা। সংসারের কর্ম তাঁকে সম্পন্ন করতে হত বেলাবেলি। দুপুরে এসে আহার করবে স্বামী-পুত্র। সেই ব্যস্ততায়, গৃহে আছেন শাশুড়ি-শ্বশুর, কারও না কারও নজরে তো শিশুটি থাকবে, এই ভরসায় তিনি রান্নায় মন দিয়েছিলেন। অকস্মাৎ একটি অর্ধোন্মাদ ষাঁড় উঠোনে ঢুকে পড়ে এবং নিতান্ত কাণ্ডজ্ঞানহীনের মতোই ভারী শরীরে শিশুটিকে মাড়িয়ে দিয়ে যায়। একটি তুলতুলে দেহের ফাটা পিষ্ট রক্তাক্ত দেহ গোটা পরিবারকেই করেছিল ভারসাম্যহীন। তার চূর্ণ পাঁজর, রক্তাক্ত মুখ ও থ্যাৎলানো হৃদপিণ্ড সকল পরিণত মানুষকে দিয়েছিল চরম অসহায়তা ও যন্ত্রণা। এবং এই দৃশ্যের পরবর্তী অনিবার্য অধ্যায়ে বলাই মণ্ডলের মা হয়ে পড়েন মনোরোগী। উঠোনের যেখানে শিশুটির দেহ লেগে ছিল, সেখানে বসে নখ দিয়ে মাটি আঁচড়াতেন যখন তখন। হয়তো ভাত বসিয়েছেন, ভুলে গিয়ে নখ দিয়ে তুলে ফেললেন মাটি। এমত উন্মাদ রোগের ঘোরেই একদিন সন্তানসম্ভাবিতা হলেন তিনি। বলাই মণ্ডলের তখন পনেরো বছর বয়স। এবং কানাইয়ের জন্ম মাকে অনেকখানি সুস্থ করে তুলেছিল। গোটা পরিবারকেই সুস্থ করেছিল বুঝি-বা। কানাইয়ের জন্মের কাছে তাঁরা সকলেই ঋণী।
তিনি জানেন, প্রবল স্নেহ এবং গুরুত্ব পেতে অভ্যস্ত কানাই বাৎসল্য বোঝে না। হয়তো নিজের সন্তান হলে বুঝতে পারবে। তিনি জানেন, কী অপার্থিব এর স্বাদ। কানাইয়ের মাধ্যমে জানেন। তাঁর নিজের প্রথম সন্তানের বয়স এখন পনেরো। সন্তানের মুখ কী অমল মহিমায় বুক ভরে দেয়। যদিও অধিক সন্তানের জনক তিনি নন। ছেলের পর একটি মেয়ে হয়েছে তাঁর। মেয়েটি এখন দশ। সন্তানদের দেখে, স্পর্শ করে বলাই মণ্ডলের পরম পরিতৃপ্তি বোধ হয়। সকল সত্তা জুড়ে এক অস্তির অনুভব। এই অস্তির সঙ্গে ব্যবসা নয়, জড়িয়ে আছে কৃষি।
.
নবাবি আমলের প্রভূত রেশম উৎপাদন ছাড়া, মুর্শিদাবাদ আগাগোড়াই কৃষিপ্রধান। নদ-নদী সমাকীর্ণ এই অঞ্চল। নদীর ভাঙনে পর্যুদস্ত এবং নদীর পলল দ্বারা সমৃদ্ধ। সিকোস্তি আর পয়োস্তি দুই-ই এখানকার আপন বস্তু। ভাঙনের বেদনা চরা-সৃষ্টির উল্লাসে ঢাকা পড়ে একদিন। লোকে মেনে নেয়, যা যায় তা যায়। জীবনের এই খেলা। এই রহস্য। মানুষই থাকে না, সেখানে আর সব তুচ্ছ! সাময়িকতাই মানবজীবনের অমোঘ এবং নিবিড়তর বেদনা! কিন্তু এই মেনে নেওয়া কি সহজ? এ কি সহজ? তাঁর বুকে ঘনিয়ে আসে ভয়। আমবাগানের কিনার ঘেঁষে ভাঙন লেগেছে। সকল খেলা, সকল রহস্যের জ্ঞান তাঁকে শান্ত রাখতে পারছে কই!
তিনি এক মাটির মানুষ। যুগ-যুগান্তরের কৃষক। তাঁর কবিতায় কৃষিজীবী মানুষের ঘাম পড়ে আছে ফোঁটা ফোঁটা। লেগে আছে সোনালি মুগের রং। আর পরমান্নশালী ধানের গন্ধ। এ জেলায় কৃষির ইতিহাসের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে তিনি চলেছেন। নবাবি আমলে এইসব স্থলভাগে চাষ হত নানারকম। তার পরেও, ব্রিটিশরা যে-অঞ্চলগুলিতে নীলচাষ করতে সক্ষম ছিল না, সেখানেও চাষ হয়েছে একই মহিমায়। সারা মুর্শিদাবাদের খুব সামান্য জমিই পড়ে থাকত কৃষিবহির্ভূত। বর্ষার বিল ও খালগুলি হেমন্তে-শীতে শুকিয়ে যেত যখন, হয়ে উঠত কৃষিজমি। বাগড়ির পূর্বভাগে শুকনো লঙ্কার চাষ হত প্রভূত পরিমাণে। গাছগাছালির অন্ত ছিল না এই বাগড়িতে। পেঁপে, কাঁঠাল, বেল, কৎবেল, তেঁতুল, জামুলগোটা। আর আমের জন্য তো সারা মুর্শিদাবাদই বিখ্যাত। শুকনো বিলে লাগানো হত বোরো ধান। মোটা, কর্কশ, লালচে চালের উৎপাদন। শুকনো নালা ও খালে ফলানো হত গম, সরষে ইত্যাদি শস্য। আর খুব উর্বর জমি পেলেই হত তুঁতের চাষ। তুঁত চাষের জমির আকাশছোঁয়া দাম ছিল তখন। এ জমির উর্বরতা নতুন করে তৈরি করতে হত এক বছর অন্তর। সারা জমিতে মাটি ঢেলে, সার দিয়ে ফিরিয়ে আনা হত প্রভূত উৎপাদনশীলতা। চারা তুঁতগাছগুলির গোড়ায় যাতে জল জমতে না পারে, তার জন্য ব্যবস্থা নিতে হত। আর তুঁতের জমির চেয়েও বেশি মূল্যবান ছিল পানচাষের জমি। উর্বরা ভূমি এবং নিখুঁত আবরণ প্রয়োজন পানের জন্য।
মুর্শিদাবাদে রেশম শিল্পের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে তুতগাছের চাহিদা বৃদ্ধি পেল যখন, তুলনামূলকভাবে নিচু ও অনুর্বর জমিও তুঁতচাষের জন্য ব্যবহৃত হতে শুরু করল। এই করতে গিয়ে ক্ষয়ক্ষতিও কম হয়নি। আঠারোশো ছাপ্পান্ন সালে নিচু জমিতে উৎপাদিত একরের পর একর তুঁতগাছ নষ্ট হয়ে গিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটিয়েছিল চাষিদের। দুর্ভাগ্য ও অনিশ্চয়তা কৃষকজীবনের সকল কাল ঘিরে আছে। অনাবৃষ্টির জন্য ফসল ফলল না যদি, পরের বৎসর অতিবৃষ্টিতে ভরা ধানের ক্ষেত ভেসে গেল। যদি-বা বৃষ্টিতে রইল সমতা আর লক্ষ্মীর আশীর্বাদে ফসল উঠল উপচে—তখন হয়তো আকাশ ঢেকে গেল পঙ্গপালের মেঘে। দিগন্ত জুড়ে ধেয়ে আসা পতঙ্গের দল একরের পর একর জমির সবুজ ফসল খেয়ে শূন্য করে দিল উৎকট জৈব নির্মমতায়।
সকল কৃষক তা জানেন। বলাই মণ্ডলও জানেন। তবু কৃষিই তাঁদের জীবন।
ভাগীরথী নদী যে মুর্শিদাবাদকে দু’ভাগে ভাগ করেছে, সেই বিভাজন এমনকী ভূমিগঠনেও ঘটিয়েছে তফাত। পূর্বপার নিচু হওয়ায় এপারে চিরকালই প্লাবন অধিক। সেকালেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। কিন্তু এপারে আউশ ধান ফলত চমৎকার। ওদিকে পশ্চিমে সমশেরগঞ্জ থানা বা সুতি থানার ভূমি উচ্চ হলেও অনেক বিল ও নদীতে ভরা। এপারে আমন ধানই ফলত বেশি।
ভাগীরথীর দুই পারের অবস্থানের পার্থক্যের জন্য প্রাকৃতিক প্রভাবও এই দুই জায়গায় ছিল দু’রকম। পূর্বপারে আউশ ধানের জন্য প্রয়োজন ছিল প্রাবর্ষা বারিপাত। এপ্রিল-মে মাসের বৃষ্টি এই ধানের জন্য উপযোগী। এরপর আগস্ট মাসে ধান কেটে ঘরে তোলার আগে পর্যন্ত এপারে আর খুব বেশি বর্ষণ প্রয়োজন ছিল না। শীতের ফসলের জন্য সামান্য বর্ষণের চাহিদা ছিল তখনও। খনার বচনে আছে—যদি বর্ষে মাঘের শেষ, ধন্যি রাজার পুণ্যি দেশ।
ভাগীরথীর পশ্চিমপারে প্রাবর্ষা বারিপাত প্রয়োজন ছিল না কোনও। অবশ্য এই বর্ষণ বীজবপনের আগে জমি তৈরিতে সাহায্য করত। কিন্তু ওই অংশে ধারাবর্ষণ প্রয়োজন ছিল জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবরের প্রথম দিক পর্যন্ত। এই বর্ষণের সময়ই বীজতলা থেকে চারা এনে বপন করা হত ক্ষেতে।
ধানই তখন ছিল মুর্শিদাবাদের প্রধান উৎপন্ন ফসল। সমগ্র পশ্চিমবঙ্গেই তার ব্যতিক্রম ছিল না। প্রধানত চারভাগে ভাগ করা হত বাংলা তথা মুর্শিদাবাদের ধানকে। আউশ, আমন, বোরো এবং জালি। ভাদ্রমাসে ফসল তোলা হত বলে আউশের আর এক নাম’ ভাদই। একটু মোটা এই ধানের চাল। সাধারণত দরিদ্র নিচু শ্রেণির লোকেরাই খেত এ চাল। শুকনো জমিতে এ ধানের চাষ সম্ভব। সেই সময়, চাষযোগ্য জমিতে কী আবাদ করা হবে তা সম্পূর্ণ নির্ভর করত সেচন ব্যবস্থার সুবিধা বিবেচনা করে। জমি শুকনো বা দোআঁশ যাই হোক না কেন, সেচের জন্য জল পাওয়া যাবে কি না, তা-ই ছিল মূল বিষয়। আউশের আরও একটি প্রকার চাষ হত তখন। সাধারণ আউশের থেকে তার পার্থক্য ছিল কিছুটা। ভাদই না বলে তাকে বলা হত কাৰ্তিকী। ঝাঁটি ধানও বলত কেউ।
হৈমন্তিক আমন ধান তখনও ছিল এ জেলার আদরের ফসল। প্রধান ফসল। ধনী গৃহস্থের ভোগের জন্য এই ধান, বিদেশে রপ্তানি করার জন্যও। জুলাই বা আগস্টে বপন করে এ ধান কাটা হত হেমন্তে। নভেম্বরের শেষাশেষি। এ ধানের জন্য প্রয়োজন ছিল প্রচুর জল। কর্দমাক্ত ভূমি। আমনের যে কত রকম তার কোনও গোনাগুনতি ছিল না। শস্যদানার আকার, গন্ধ ইত্যাদির চুলচেরা বিচারে ছিল তাদের নাম- ঘি কলা, গন্ধেশ্বরী, চিত্রাশালী, গন্ধমালতী, গঙ্গাজল, দুধরাজ, লঘু, বেনাফুলি, রাঁধুনি-পাগল, সুন্দর কলমা, পর্বত জিরা, কৃষ্ণ কলমা, ওরা, কনকচূড়, কুসুমশালী, সোনাশালী, পরমান্নশালী, ডহর নাগরা, ঝিঙাশালী, নোনা, বাঁশফুল, মেঘি, বনগোটা, রাঙ্গি, কুঞ্চিল, রামশাল, জটাগোটা, রাইমণি, দাদখানি, নিচা কলমা।
বোরো ধানও ছিল আউশের মতো মোটা। বোনা হত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে। ফসল তোলা হত মে-জুন মাসে।
জালি ধান বহু আবাদি ছিল না। এ ফসল বসন্তে বুনে কাটা হত বর্ষায়। নাবাল জমিতে হত এর চাষ।
নানান অবস্থায় ধান ও ধানগাছের ছিল নানান নাম। প্রথম বীজ। বীজ থেকে গাছ বেরলে অঙ্কুর। গাছ একটু বেড়ে উঠলে তার নাম জাবালি। প্রাপ্তবয়স্ক গাছটি গাছ-ধান। প্রথম শস্য মুকুলিত হলে তার নাম ছিল থোর। শস্য সামান্য ভরাট হলে, নাম তার ফুলা। এরপর কাটার আগে পর্যন্ত সে ধান। ধানের পর সে চাল। চালের পর অন্ন।
ধান। বীজ। অঙ্কুর। জাবালি। গাছ-ধান। থোর। ফুলা। ধান। চাল। অন্ন। কিছু কি পরিবর্তন হয়েছে আজ পর্যন্ত এর মধ্যে? বলাই মণ্ডলের মনে হয়, কিছু নয়। সামান্য যা, সে কেবল ওই আমনের বহু প্রকার আর চাষ হয় না এখন। লুপ্ত হয়ে গেছে সেইসব ধানের প্রজাতি। আর সেচনের সামান্য উন্নতি ঘটেছে। এখন সম্পন্ন চাষি ব্যবহার করতে পারে টুলু পাম্প। কিন্তু জলের উৎসের জন্য আজও প্রয়োজন নদী, নালা, খাল, বিলের সান্নিধ্য। বীজবপন এবং ফসল ঘরে তোলার কালও রয়েছে একই। যেন আবহমানের স্থির শস্যক্ষেত্রের ওপর আসা-যাওয়া চলছে কেবল বহু কালের কৃষকের।
কেমন ছিল নবাবি ও ব্রিটিশ আমলের কৃষক? গলা অবধি ঋণে ডোবা। অধিকাংশ ভূমিহীন। নামমাত্র মজুরি বা ফসলের বিনিময়ে পরের জমিতে ফসল ফলানো কৃষক। পরের জমি অর্থে জমিদারের জমি। খুব সামান্য সংখ্যক কৃষকই স্ব-অধিকৃত জমি ভোগ করত।
এই চিত্র কিছুটা পালটেছে তা স্বীকার করেন বলাই মণ্ডল। ভূমিহীন কৃষক, মজুর ও ভাগচাষির সংখ্যা এখনও প্রচুর। কিন্তু ভূম্যধিকারী কৃষকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষক আজও ডুবে যায় গলা অবধি ঋণে কারণ অধিকাংশ কৃষকেরই দিনগুজরানের পর উদ্বৃত্ত অর্থ থাকে না। একটি বলদ কিনতে গেলেও টাকা ধার করতে হয়। আগের চেয়ে কৃষকের সুযোগ-সুবিধা বেশি সারে সরকারি ভর্তুকি থাকায় সার কেনা যায়। প্রায় বিনি পয়সায় পাওয়া যায় বীজধান মিনিকিট। কৃষিজাত পণ্যের জন্য খাজনা প্রায় দিতে হয় না। তবু—এই তবুর ভিতর আজও ঢুকে আছে দারিদ্র্য। অপরিসীম দারিদ্র্য।