রাজপাট – ১৪

১৪

ঘুমাতে চাও কি তুমি?
অন্ধকারে ঘুমাতে কি চাই?—
ঢেউয়ের গানের শব্দ 
সেখানে ফেনার গন্ধ নাই? 
কেহ নাই,—আঙুলের হাতের পরশ 
সেইখানে নাই আর,—
রূপ যেই স্বপ্ন আনে, স্বপ্নে বুকে জাগায় যে-রস 
সেইখানে নাই তাহা কিছু 
ঢেউয়ের গানের শব্দ 
যেখানে ফেনার গন্ধ নাই- 
ঘুমাতে চাও কি তুমি? 
সেই অন্ধকারে আমি ঘুমাতে কি চাই! 

দলীয় কার্যালয়ে বসেই সন্ধেবেলায় খবরটা পেল সিদ্ধার্থ। মোহনলাল ফোন করেছিল। মোহনলালের কথা শুনে আপাদমস্তক কেঁপে উঠেছিল তার। সে ভেবেছিল রাসুদার সঙ্গে গোটা ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলবে এবং রাসুদা আজ রাত্রি সাড়ে আটটায় তাকে সময় দিয়েছিলেন। এমন নয় যে রাসুদার সঙ্গে কথা বলার জন্য সবসময়ই তাকে আগে থেকে সময় স্থির করে নেবার আবেদন জানাতে হয়। রাসুদার কাছে তার গমনাগমন সম্পূর্ণ স্বাধীন। তার পেয়ে যাওয়া এই অধিকার অনেকেই দেখে মাৎসর্যে। কিন্তু সে পরোয়া করে না। এবং এই অধিকারকে যথেচ্ছ ব্যবহারও করে না। রাসুদা ব্যস্ত মানুষ। কোনও বিষয়ে সময় নিয়ে আলোচনা করতে চাইলে আগে থেকে সময় নিয়ে রাখা সমীচীন। রাসুদা নিজে থেকে কোনও আলোচনার জন্য তাকে ডেকে নিলে অন্য কথা। তার এই পরিমিতিবোধের জন্য সে অবাঞ্ছিত হয়ে পড়ে না কোথাও। 

রাসুদার সঙ্গে কথা বলা জরুরি ছিল। এক আরব্ধ কাজ সে ফেলে এসেছে এমন, যার গতিপ্রকৃতি কেমন হতে পারে সে বিষয়ে তার কোনও ধারণা নেই। কিন্তু ফোন পেয়ে সে সিদ্ধান্ত নিল এখনই চলে যাবে হরিহরপাড়ায়। পরে রাসুদাকে যা বলার বলবে। তৌফিক নামে ছেলেটি যেতে চাইছিল তার সঙ্গে। সে নিরস্ত করল। বরং সে চলে গেল স্টেশনের দিকে। কাবুল মির্জাকে পেলে তার মোটরবাইকে বা অন্য গাড়িতে চলে যাবে হরিহরপাড়া। কিন্তু মুশকিল হল খবর দেওয়া না থাকলে মির্জাকে পাওয়া সহজ নয়। 

মির্জার খবরাখবর রাখে যে হকার ছেলেটি, পত্র-পত্রিকা নিয়ে স্টেশনে ঢোকার মুখে বসে, তার কাছে গিয়ে দাঁড়াল সিদ্ধার্থ। বলল-মির্জাকে এখন কোথায় পাওয়া যাবে? 

ছেলেটি উঠে দাঁড়াল। বলল-বাসস্ট্যান্ডের ওদিকে আছে মনে হয়। দেখব? 

—আমি শিবমন্দিরের সামনে আছি। দশ মিনিটের মধ্যে না পেলে জানিয়ে যাবে। আর পেলে বলবে বাইক নিয়ে আসতে। 

সে আর দাঁড়াল না। তার অস্থির লাগছে। ক্রোধ নয়, ঘৃণা নয়, কেবল এক কষ্ট। দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে থাকছে সে। তৌফিককে নিয়ে আসতে পারত, কিন্তু সে জানে না রাতে ফিরতে পারবে কি না। এখন দ্রুত যাবার জন্য তার মির্জাকে দরকার। মির্জা তারই মতো অনর্গল মানুষ। রাতে ফেরা, না-ফেরা, দেরি করে ফেরার জন্য তাদের কোনও জবাবদিহি নেই। 

দশ মিনিট সময়কে এক অনন্তকালের মতো ধরে দাঁড়িয়ে রইল সে। আর কষ্ট থেকে তার মন পুড়তে লাগল অনুশোচনায়। কেন সে খোলাখুলি বলে বারণ করে এল না! কেন তার আশঙ্কা ও অনুমান সে চেপে রাখল একা নিজেরই ভেতর! যদিও এই নৃশংসতা তার কল্পনার বাইরে ছিল। কিন্তু চরম কোনও আক্রমণের কথা সে তো ভেবেছিল আগেই। নিজের মধ্যে অনুমান সক্রিয় রাখতে সফল ছিল সে, অথচ কাজে লাগাতে পারল না! তার গলা টনটন করছিল! এমন নির্মম! এমন নির্মম প্রাপ্তি ওই মানুষের! হায়! 

তখন মোটরবাইক এসে দাঁড়াল তার সামনে। মির্জা। বলল—ডাকছিলে? 

সে তাকাল। কিছু বা বিমূঢ়। চোখে এক বহু দূরের দৃষ্টি। মির্জা সেই দৃষ্টি ছুঁতে পারছে না। এই ছেলেটিকে সে গভীর ভালবাসে। কারণ সে নিজে, বহু গর্হিত কর্ম করা সত্ত্বেও আপন হৃদয় হারিয়ে ফেলেনি। সেই সহৃদয়তা দ্বারা সে সিদ্ধার্থর সহৃদয়তা টের পায়। এবং কৃতজ্ঞ সে। তাদের এক চরম পারিবারিক অবমাননার মধ্যে থেকে উদ্ধার করেছিল সিদ্ধার্থ একদা। এমনকী, তার অসৎ ব্যবসায়ের পথ কিছু বা সিদ্ধার্থর দ্বারা সুরক্ষিত হয়। যার কাছে উপকৃত, তার জন্য মির্জা প্রাণও দিতে পারে, এই তার ধর্ম। অতএব সে বলল— খারাপ কিছু হয়েছে নাকি সিধুভাই? সিদ্ধার্থ মাথা নাড়ে। খারাপ। তারপর বলে—আমার সঙ্গে যেতে পারবে একবার? আজ রাতে ফিরব কি না জানি না। 

—চলো কোথায় যেতে হবে। কিছু সঙ্গে নেব? 

—না। হরিহরপাড়া চলো। 

মির্জা একবার পকেট চাপড়ায়। শূন্য হাতে কোথাও যাওয়া তার অভ্যেস নয়। সামান্য দু-একটি অস্ত্র তার সঙ্গে আছে। আগ্নেয়াস্ত্র সে নেয় কেবল বড় ধরনের কাজের সময়। আপাতত সিদ্ধার্থ তা নিতে বারণ করেছে। সে বাইকের বাক্স খুলে একটি বায়ু প্রতিরোধক পরে নেয়া। সিদ্ধার্থ তার পিছনে উঠে বসে। শব্দ করে চলতে থাকে বাইক। বহরমপুরের সীমানা পেরোতেই ফাঁকা রাস্তা। মির্জা বাইকের গতি চূড়ান্তপ্রায় করে আর হাওয়ার ঝাপটা লাগে সিদ্ধার্থর চোখেমুখে। বায়ুর ছলনায় অবারিত করে দেয় সে নিজেকে। কাঁদে। জলধারা বাসি দাড়িসমেত তার গাল ভিজিয়ে দেয়। চোখ মোছার চেষ্টা করেনি সে। কেননা কান্না বিষয়ে তার কোনও সংস্কার নেই। কান্না মানবিক অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ মাত্র। অতএব সে কাঁদে এবং কান্নার আড়ালে ভাবতে ভাবতে যায়। কী করা উচিত এবার। হয়তো রাসুদার সঙ্গে কথা বলে আসতে পারলে ভাল হত। কিন্তু সে আর অপেক্ষা করতে পারছিল না। মোহনলাল হরিহরপাড়ায় এসেছে এবং সেখানে সবাই সিদ্ধার্থর জন্য অপেক্ষা করছে। সে ভাবছিল, পুলিশ এবার তদন্ত করবে। দায়সারা তদন্ত। কোনও সমাধান পাওয়া যাবে না সেখানে। সহায়সম্বলহীন, মাধুকরী করে ফেরা, আত্মীয়বিবর্জিত মানুষ ময়না বৈষ্ণবীর জন্য পুলিশ প্রাণপাত করবে না। এবং তার অনুমান যদি নির্ভুল হয় যে, হরিহরপাড়া থানার বাবুদের সঙ্গে ওই চক্রের যোগ আছে, তা হলে ময়না বৈষ্ণবীর এই দুঃসহ পরিণতি চক্রটিকে একটি সুবিধাজনক অবস্থায় পৌঁছে দেয়। তারা কী করতে পারে এক্ষেত্রে? ঘোষপাড়া মঠের বলরাম বাবাজিকে গ্রেপ্তার করার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে পারে। দাঁতে দাঁত চেপে বসে তার এবং চোয়াল শক্ত হয়। সে স্থির করে, এ কাজ তাকে করতেই হবে। 

হরিহরপাড়া পৌঁছে একটি ছোট পানের দোকানের সামনে মির্জাকে দাঁড়াতে বলল সে। সিগারেট কিনল। ধরাল। তারপর দোকান থেকে সরে এসে মির্জাকে বলল কী হয়েছিল। হতবাক হয়ে বসে রইল মির্জা কিছুক্ষণ। সিগারেটে ঘনঘন টান দিয়ে ছুড়ে দিল দুরে। ঘোরের গলায় বলল—বলরাম বাবাজি লোকটাকে কাঁচি করে দিলে হয় না? 

—হয়। তবে অন্যরা তাতে পার পেয়ে যাবে। তা ছাড়া সোজা রাস্তায় চেষ্টা করতে হবে মির্জা। 

—সোজা রাস্তা? সোজা রাস্তা বলে কিছু নেই সিধুভাই। এটা তুমি একদিন বুঝতে পারবে। 

বাইকে বসল তারা আবার। তারপর সোজা দলীয় দপ্তরে গেল যেখানে অমরেশ বিশ্বাস মোহনলাল ইত্যাদিকে নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তাঁরা প্রত্যেকেই থমকে আছেন। ভার হয়ে আছেন অপমানে। ময়না বৈষ্ণবী তাদেরই একজন হয়ে উঠেছিল কোন অলক্ষ্যে। 

মৃতদেহ তুলে আনা ছাড়া আর কিছুই করেনি পুলিশ এখনও। সেই দেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে বহরমপুর। সিদ্ধার্থ চমকে উঠল। আশ্চর্য! এতক্ষণ বহরমপুরে ছিল সে। জানল না সেখানে ময়না বৈষ্ণবীর মৃতদেহ পৌঁছে গেছে! অস্থির লাগছিল তার। সে, অমরেশ বিশ্বাসের অনুমতি নিয়ে বেরিয়ে এল বাইরে। সিগারেট ধরাল। তাকাল আকাশের দিকে। কার্তিকের তারায় ভরা আকাশ। শৈশবে সবার মতো সে-ও জেনেছিল মৃত মানুষেরা তারা হয়ে যায়। সেইসময় মারা গিয়েছিলেন ঠাকুরমা, পিতামহী। সে যখন জীবনের প্রথম চিরবিচ্ছেদ-বেদনায় কাতর তখন তাকে কোলে নিয়ে আকাশের তারা দেখিয়েছিলেন তার পিতামহ। বোধিসত্ত্ব। পিতামহীর মৃতদেহ তখন শ্মশানযাত্রার জন্য অপেক্ষা করছিল। এবং হয়তো বোধিসত্ত্বেরও প্রয়োজন ছিল কিছু একাকিত্বর। কেন-না তাঁরও হৃদয় নিশ্চিতভাবেই ছিল কাতর ও যন্ত্রণাময়। তিনি শিশু সিদ্ধার্থকে বুকে করে ছাতে এসেছিলেন। ওই বিরাট বিস্তারের দিকে আঙুল তুলে বলেছিলেন-দেখো, কত তারা! মানুষ মরে গেলে তারা হয়ে যায়। এ জগতে কিছুই হারিয়ে যায় না জেনো। 

আজ সে জানে সব কল্পনা। সব শোক পারাপারের কৌশল। তবু সে ওই তারাদের দিকে তাকায় এবং বিশ্বাস করার বাসনা প্রকাশ করে—ওখানে আছে। সকল প্রাণ। সকল মৃত ব্যক্তি। হঠাৎ একটি তারা তার দৃষ্টিতে ধকধক করে জ্বলে। তার মনে হয়, ওখানে আছে ময়না বৈষ্ণবী। অপমৃত্যুর তারাগুলি বড় বেশি ধকধকে। বেশি অস্থির। 

সে সিগারেটের শেষ অংশটুকু পায়ের তলায় পিষে ফেলে প্রশমিত করে নেয় নিজেকে। তারপর দপ্তরে ফিরে যায়। আলোচনা শুরু করে তারা। এবং লোক সংগ্রহ করে, আগের দিনের অভিযোগ না নেবার প্রতিবাদ এবং বলরাম বাবাজির গ্রেপ্তারের দাবিতে থানা ঘেরাও করার সংকল্প হয়। আগামিকাল দুপুর দুটোয় যে যার লোক নিয়ে পৌঁছে যাবে এই দপ্তরের সামনে। দলমত নির্বিশেষে জনগণকে অনুরোধ করা হবে এই ঘেরাওয়ে সামিল হওয়ার জন্য। হরিহরপাড়া ও তৎসংলগ্ন এলাকার মানুষকে এক জায়গায় করার দায়িত্ব অমরেশ বিশ্বাসের। তেকোনা, মরালী প্রভৃতি গ্রাম থেকে লোক আনার জন্য সিদ্ধার্থ স্থির করল, সে ও মোহনলাল, বরকত আলির শরণাপন্ন হবে। এমনকী দরকার হলে সে অর্জুন সেনের কাছে ও যেতে পারে। 

হরিহরপাড়া থেকে যখন তেকোনায় এসে তারা পৌঁছল, তখন দেখল, এই গ্রাম তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা হারিয়েছে। এখানে-ওখানে জটলা। এ গ্রামের ঘোড়ার গাড়ি চালায় যে কাদের মিঞা, সে-ই ঊর্ধ্বশ্বাসে ঘোড়া ছুটিয়ে পৌঁছে দিয়েছিল খবরটা। মোহনলালের বাড়িতে বসে আবার সব শুনল সিদ্ধার্থ। নয়াঠাকুমা কাঁদছিলেন। নন্দিনী তাঁকে জড়িয়ে ধরে বসেছিলেন। বরকত আলির বিবি চোখে আঁচলচাপা দিয়ে নিথর। তাঁকে আঁকড়ে কাঁদছিল ফিরোজা। মোমের আলোয়, লণ্ঠনের আলোয়, সকলের শোকতপ্ত, ক্রন্দনরত মুখগুলি দেখাচ্ছে ভৌতিক ও কালিমাময়। মোহনলাল বর্ণনা করছিল। ছেঁড়াখোঁড়া সেই দেহে পিঁপড়ে লেগেছিল আর আকাশপথে উড়ছিল শকুন। এখন শকুন বিরল হয়ে গেছে। তবু কোথা হতে গন্ধ পেয়ে বুঝি এসেছিল তারা। গোমুন্ডি গ্রামের যত পথকুক্কুর গন্ধ শুঁকে শুঁকে পৌঁছেছিল সেখানে এবং লুব্ধ শকুনগুলির হাত থেকে দেহটিকে রক্ষা করেছিল। সেইসব কুক্কুরের চিৎকার প্রকৃতপক্ষেই ছিল করুণ রোদন যা গ্রামস্থ ব্যক্তিবর্গকে বিচলিত করেছিল। 

কালান্তর এক জনবিরল অঞ্চল। তবু কুকুরগুলির রোদন শুনে এবং শকুনের উড়ন্ত ডানার ছায়া দেখে গোমুন্ডি গ্রামের সৎ-অসৎ মানুষেরা সন্ধানে এসেছিল পায়ে পায়ে। কোনও মানবদেহ তারা প্রত্যাশা করেনি, বরং ভেবেছিল কারও মূল্যবান গোরু-মোষ ষণ্ড বুঝি-বা। প্রথমে কোনও কিছুই খুঁজে না পেয়ে তারা ফিরে যাবার উপক্রম করছিল। তখন কুকুরগুলির রোদনই তাদের নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দিয়েছিল। নির্যাতিত ধর্ষিত দেহটি তাদের মধ্যে ত্রাস ও বেদনার সঞ্চার করেছিল। দেহটির দুটি পা বেঁকে গিয়েছিল। শরীরে লেগেছিল চাপ চাপ রক্ত। চোখ আধখোলা। মুখে বাঁধা ছিল কাপড়। হাতদুটিও বন্ধনমুক্ত ছিল না। সব মিলে এক বীভৎস।

চাষিরা প্রথমে তাকে চিনতে পারেনি। কেননা মুখ বাঁধা, রক্তাক্ত, অনাবৃত কোনও শরীর চেনা সহজ নয়। তা ছাড়া তাকে কেউ ওই কারুণ্যে, ওই বীভৎসতায় প্রত্যাশা করেনি। শেষ পর্যন্ত, তাদেরই একজন তাকে চিনতে পারে। সে জানত, এই মানুষটি মাঝে মাঝে এইসব জলাভূমিতে ঘুরে বেড়ায়। সে চিনতে পেরেছিল এবং চিৎকার করেছিল। কোমরে বাঁধা গামছাটি সে ওই খোলা দেহে ফেলে দেয় যেখানে মাছি ও পিঁপড়ের ঘোরাঘুরি। তার ব্লাউজের হাতাগুলি আটকে ছিল বাহুতে এবং শাড়ি তার দেহের তলায়। সেইসব স্পর্শ করার সাধ্য কারও ছিল না। অতএব অন্য একজনও তার কোমরের জড়ানো গামছা খুলে বাকি অংশ ঢেকে দিয়েছিল। আর এভাবেই আত্মীয়-পরিজনহীন নারী বহু আত্মীয় লাভ করেছিল। গ্রামে গ্রামে ছিল তার অতি আপনার জন। লোকে তার গান ভালবাসত। তার কথা ভালবাসত। এই বাগড়ি অঞ্চলের কালান্তরে, দিয়াড়ে সর্বত্র সে হয়ে উঠছিল জীবনযাপনের এক অঙ্গ। 

সিদ্ধার্থ স্তব্ধ হয়ে শুনছিল। মির্জা তার পাশে ছিল। সে বহরমপুরে ফিরেও যেতে পারত কিন্তু সিদ্ধার্থর সঙ্গে আগামীকালের ঘেরাও-পর্ব পর্যন্ত সে থাকতে চায়। 

বরকত আলি এসে সিদ্ধার্থর মুখোমুখি বসলেন। পাঁচজনের একটি দল সংগঠিত হয়েছে। তারা ভোর ভোর বেরিয়ে থানা ঘেরাওয়ের বিষয়ে প্রচার করবে এবং লোক সংগ্রহ করবে। নয়াঠাকুমা তখনও বিলাপ করছিলেন। বিলাপ তাঁর স্বভাবসম্মত নয়। তবু এমতাবস্থা তাঁকে শোকগ্রস্ত বিলাপে নিরত করেছে। তিনি বলে চলেছেন—কেন তাকে যেতে দিলাম! আমি বারণ করলে সে তো যেত না। পাঁচটা টাকা চেয়ে নিয়ে গেল। সব জিনিস ফেলে রেখে গেল। সে আর ফিরল না। আহা, এমন মানুষ, এমন নির্লোভ মায়াময় মানুষ! আহা, কেন আমি তাকে যেতে দিলাম! 

এবং সকালে পাঁচগাঁয়ে চলে গেল পাঁচজন। সকাল দশটার মধ্যে তিনশো লোক এসে জড়ো হল তেকোনা গ্রামে। তারা রাজি। তারা থানা ঘেরাও করতে রাজি। কেউ সাইকেলে, কেউ বাইকে, কেউ ঘোড়ার গাড়িতে রওয়ানা হল হরিহরপাড়ার দিকে। কেননা থানা সম্পর্কে তাদের সকলেরই আছে কোনও-না-কোনও অভিযোগ। চোরাচালানের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে এই অঞ্চল। খুন-খারাপিও ব্যাপকতর হয়েছে। পুলিশ জনগণের সহায়ক থাকেনি কখনও বরং গ্রামের মধ্যে মধ্যে রাখা ফাঁড়িগুলিতে মোতায়েন পুলিশ গ্রামবাসীদের কাছ থেকে চাল, ডাল, সবজি সিধে নিতে অভ্যস্ত। কথা বলে তারা এমন যেন তারাই গ্রামগুলির মালিক। তারাই জমিদার। অতএব থানা তাদের অন্তরে প্রতিবাদ তুলেছিল আগেই। এখন তাতে ইন্ধন পড়েছে। তা ছাড়া আছে দলীয় শক্তির চাপ। সব চাপ, সব ইচ্ছা মিলে গিয়ে লোক হয়েছে পাঁচ শতাধিক। 

এই আন্দোলন অমরেশ বিশ্বাস একা গড়ে তুলতে পারতেন। এবং গড়ে তুললেও অন্তত সিদ্ধার্থর তাতে কোনও আপত্তি ছিল না। কিন্তু সে এখন এই আন্দোলনের পক্ষে অবিচ্ছদ্য হয়ে উঠেছে। এবং মির্জা তার সঙ্গে সঙ্গে আছে। মির্জা, রাস্তা ও বাঁধের ঠিকাদারদের থেকে তোলা আদায় করা মানুষ। গোপন ব্যবসা করা ব্যক্তি। সেও এখন এই আন্দোলনে অবিচ্ছেদ্য হয়েছে। আর এই এলাকা, এ তো সিদ্ধার্থর নয়। এ অমরেশ বিশ্বাসের এলাকা। সৎ ও শান্ত এই মানুষ এই এলাকায় শ্রদ্ধেয়। তাঁকে বাদ দিয়ে এই আন্দোলন কীভাবেই বা হয়। বরকত আলি গ্রামাঞ্চলের নেতা। আর মোহনলাল— সেও আদি থেকে এই আন্দোলনের শরিক। 

দুটি লাইন করা হয়েছে পাশাপাশি। কোনও উত্তেজনা নেই। বিশৃঙ্খলা নেই। মৌন এ মিছিল। থানায় পৌঁছে ভাঙা হবে এই মৌনতা। পুরোভাগে আছেন অমরেশ বিশ্বাস ও বরকত আলি। তাঁদের পেছনে সিদ্ধার্থ ও মোহনলাল। কোনও পতাকা নেই। প্রদর্শন নেই। জনগণের এ এক স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল। নৃশংসতার বিরুদ্ধে দীর্ঘ পদযাত্রা। এই যাত্রার নীরবতা প্রাচীরের মতো ঘিরে আছে ময়না বৈষ্ণবীর সম্মান। কমলির মর্যাদা। আপাতত তিনটি দাবি তাদের। তারা ময়না বৈষ্ণবীর দেহ ফিরে পেতে চায়। পঞ্চবুধুরি মঠের কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তারা ওই দেহের যথাবিধি সৎকার করবে। এ ছাড়া তারা বলরাম বাবাজি ও শংকরের গ্রেপ্তার চায়। এবং পুরো ঘটনার যথাযথ তদন্তের প্রতিশ্রুতি। 

থানার সামনে গিয়ে তারা থামল। উঁচু ভিতের বাড়িটির সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে চারজন কনস্টেবল। তাদের হাতে উদ্যত লাঠি। 

কোনও শ্লোগান নয়, কোনও উত্তেজনাও নয়। অমরেশ বিশ্বাস ও সিদ্ধার্থ শুধু প্রতিকারপ্রার্থী জনতাকে হাজির করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ তাঁদের যেতে দিল না ভেতরে। প্রতিরোধ থেকে জেগে উঠছিল উত্তেজনা। জনতা সরব হতে থাকছিল। সিদ্ধার্থ বলল— অমরেশদা, বড়বাবু আমাদের সঙ্গে কথা বলতে বাধ্য। 

অমরেশ পুলিশের উদ্দেশে বললেন— আমাদের কয়েকজনকে ভেতরে যেতে দিন। আপনারা আমাদের থানায় ঢুকতে বাধা দিতে পারেন না। 

একজন বলল—বড়বাবু এখন ব্যস্ত আছেন। আপনাদের ফিরে যেতে বলা হয়েছে। পরে সময় চেয়ে আসবেন। 

—ওঁকে কথা বলতে হবে। আমরা ফিরে যাব না। 

সিদ্ধার্থ বলল—অমরেশদা, প্রথমে শ্লোগান দিতে হবে। তারপর ভেতরে যেতে না দিলে আমরা জোর করে ঢুকব। 

অমরেশ বিশ্বাস জনতার দিকে ফিরলেন। বললেন—ঘৃণ্য নারীপাচার চক্রকে গ্রেপ্তার করতে হবে, করতে হবে। 

জনতা গর্জে উঠল—করতে হবে। করতে হবে। 

—ময়না বৈষ্ণবীর হত্যাকারীকে ধরতে হবে, ধরতে হবে। 

—ধরতে হবে, ধরতে হবে। 

—অসামাজিক দুষ্কৃতিচক্র ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও। 

—ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও।— ইনকেলাব জিন্দাবাদ। 

—জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ। 

মুষ্টিবদ্ধ হাতগুলি উঠছে ও নামছে। এবার শ্লোগানের দায়িত্ব নিল মোহনলাল। সিদ্ধার্থ, অমরেশ বিশ্বাস ও বরকত আলি কনস্টেবলগুলিকে অগ্রাহ্য করে ভেতরে যাবার চেষ্টা করছেন। একজন পুলিশ অমরেশ বিশ্বাসকে লাঠি দিয়ে ঠেলে দিল পিছনে। অমরেশ বিশ্বাস টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে গেলেন। বরকত আলি ছুটে গেলেন তাঁর কাছে। অমরেশ বিশ্বাসকে ধরে তুলছেন। তাঁর হাতে রক্তধারা। চশমা ছিটকে গেছে। মাথা ফেটে গেছে সম্ভবত। তিনি বলছেন–ঢুকে যাও। সিদ্ধার্থ ঢোকো। 

সিদ্ধার্থ এক লাফে উঠে দাঁড়াচ্ছে সিঁড়িতে। দু’জন পুলিশ তাকে জাপটে ধরেছে। এবং সে শুনতে পাচ্ছে উন্মত্ত চিৎকার। ঢিল পড়ে ভেঙে যাচ্ছে কাচের জানালা। একজন পুলিশের মাথায় লাগল। সে মাথা ধরে বসে পড়ল মাটিতে। বরকত আলি ও মোহনলাল অমরেশ বিশ্বাসকে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন ভিড়ের বাইরে। সিদ্ধার্থ বদ্ধ অবস্থায় চিৎকার করছে—আপনারা শান্ত হোন, ঢিল ছোড়া বন্ধ করুন। 

কয়েকজন ঝাঁপিয়ে পড়ছে পুলিশের ওপর। পুলিশের লাঠি নিয়েই তারা ভেঙে ফেলছে পুলিশের গাড়ির কাচ। সিদ্ধার্থ মুক্ত হয়েছে কিন্তু তার শার্ট ছেঁড়া। ঠোঁট ফুলে গেছে। সে চিৎকার করে শান্ত হওয়ার আবেদন জানাচ্ছে। কিন্তু একটু আগেকার শান্ত জনতা এখন উন্মত্ত। তারা বলছে—আগুন, আগুন লাগাও। 

তখন আরও চারজন পুলিশ এল লাঠি হাতে আর তরুণতপন বসু বড়বাবু বললেন-চার্জ! এলোপাথাড়ি লাঠি চালাল তারা। কিন্তু ছ’শো মানুষ ছড়ানো ছেটানো। উন্মত্ত ও অস্থির। একদল লাঠি খেয়ে পিছু হঠতে না হঠতে উপচে উঠছে অন্য দল। দুই হাত তুলে, জনতাকে শান্ত করতে সে ছুটে গেল ভিড়ের মধ্যে। তখন নিজের আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলি ছুঁড়লেন বড়বাবু শূন্যে। আর দাউদাউ জ্বলে উঠল পুলিশের জিপ। গুলির শব্দ হল আবার। সিদ্ধার্থ তীব্র যন্ত্রণা টের পেল কাঁধে। তার মাথা ঘুরে গেল। পরপর কয়েকটি শব্দ পেল সে। পড়ে যেতে যেতে সে দেখল তাকে জড়িয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ছে একজন আর তার পিঠের ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে মানুষ। তার হাত মাড়িয়ে দিল একজন। পা মাড়িয়ে দিল। চেতনার শেষ সীমায় পৌঁছে সে শুনল—সিধু, সিধু, সিধুভাই, কোনও ভয় নেই। কোনও ভয় নেই। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *