রাজপাট – ১২

১২ 

কানের ফুল বেইচ্যা মলুয়া
কার্তিক গোঁয়াইল। 
অঙ্গের যত সোনাদানা
সকলই বাঁধা দিল।.

হরিহরপাড়া থানার বাড়িটি আগে ছিল নীলকরদের কুঠি। এইসব অঞ্চলে ব্রিটিশরা নীলচাষ করেছে অধিক পরিমাণে। বাংলার অন্যান্য নীলচাষিদের থেকে মুর্শিদাবাদের নীলচাষিদের ভাগ্য পৃথক ছিল না। গঙ্গা ও মেঘনা নদীর দুই পাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে শুরু হয়েছিল নীলচাষ। নীলকর সাহেবরা চাষিদের বাধ্য করেছিল নীলচাষ করতে। সেইসঙ্গে দেশীয় জমিদাররাও ব্রিটিশ প্রভুদের পরিতোষ বিধানের জন্য অত্যাচারে সামিল হয়েছিল। লাঠিয়াল বাহিনীর সাহায্যে চাষিদের অমতে জোর করে জমিতে নীল বুনে দিত তারা। এই সময় নীলচাষের জন্য প্রতি বিঘেতে খরচ হত দশ টাকা পরিমাণ অর্থ। কিন্তু চাষিরা ফেরত পেত ছয় টাকা পরিমাণে। আসলে নীলকররাই নীলের দাম নিয়ন্ত্রণ করত। চাষির সেখানে কিছুই বলার ছিল না। এর ফলে চাষিদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়তে শুরু করেছিল। ইতিহাসে লেখা আছে তিতুমীরের নাম নীলকর ও দেশীয় জমিদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ করেছিলেন তিতুমীর। 

তিতুমীরের বিদ্রোহের মতো কোনও সংগঠিত বিদ্রোহ ঘটেনি জেলা মুর্শিদাবাদে। পঞ্চাননতলা ছিল নীলকুঠির মূল কেন্দ্র। কিন্তু নীলকরদের বিরুদ্ধে কিছু-বা প্ৰতিবাদ উঠেছিল ঔরঙ্গাবাদে। বানিয়া গ্রামের রায়তরা শুধু যে নীলকরদের দেওয়া নীলচাষের টাকা নিতে অস্বীকার করেছিল তা-ই নয়, তারা নীলকুঠি আক্রমণ করেছিল। এই আক্রমণের সাহস ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছিল চারপাশে। সমশেরগঞ্জ থানায় নীলকরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল বেশ কিছু গ্রামের চাষি। কিন্তু এই বিদ্রোহগুলি ছিল খুবই সাময়িক। ক্ষণস্থায়ী। এর কারণ হয়তো এই যে, যোগাযোগের অভাবে বিদ্রোহীরা সংগঠিত হতে পারেনি। 

সারা বাংলার বিভিন্ন জায়গায় নীলকরদের বহু কুঠি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। হরিহরপাড়ার ক্ষেত্রে তা হয়নি। কুঠি এবং কুঠি সংলগ্ন অনেকখানি জায়গা এই থানার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। দক্ষিণে একটি খোলা মাঠ, পূর্বে ছোট বন। উত্তরে ধানক্ষেত। পশ্চিমে প্ৰধান সড়ক। মাঠ পেরিয়ে বনের পাশ দিয়ে পথ গিয়েছে জনবসতির দিকে। বন সমেত থানাকে তিনদিক থেকে ঘিরে আছে জনবসতি। 

অমরেশ বিশ্বাস এবং তাঁর কয়েকজন পার্শ্বচর সমেত সিদ্ধার্থরা যখন থানায় পৌঁছল তখন সন্ধে নেমেছে। 

হরিহরপাড়া অঞ্চলে এখনও রাজ করছে কংগ্রেস। মেয়ে পাচার করার মতো ঘৃণ্য ও কদর্য ঘটনা দীর্ঘদিন এই হরিহরপাড়াতেই ঘটে চলেছে—এই বিষয় নিয়ে গড়ে উঠতে পারে বড় ধরনের রাজনৈতিক আন্দোলন। অমরেশ বিশ্বাস ব্যাপারটা লুফে নিয়েছেন। শুধুমাত্র ময়না বৈষ্ণবীর কথার ওপর নির্ভর করে এই সমস্ত পদক্ষেপগুলি নেওয়া বিষয়ে তাঁরও প্রাজ্ঞ মনে কিছু দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আছে। তবে সিদ্ধার্থর জোর ও বিশ্বাসের ওপর তিনি নির্ভর করেছেন। থানায় ফোন করে নিজেদের আগমনের কথা তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন বড়বাবুকে। কারণ এ শহরে তিনি এক পরিচিত নাম। বিরোধী দলনেতা তিনি। থানায় গিয়ে, বড়বাবু না থাকলে, আমজনতারই মতো প্রতীক্ষা করা তাঁকে শোভে না। অতএব বড়বাবুরও কিছু দায়িত্ব থেকে গিয়েছিল। বাইরে কিছু কাজ ছিল তাঁর। সেসব ফেলে তিনি অমরেশ বিশ্বাসের অপেক্ষা করছিলেন। তরুণতপন বসু নামের এই মানুষটিকে পুলিশ হিসেবে মানাচ্ছিল ভাল। দীর্ঘদেহী, ভুঁড়িদার, গমগমে স্বর। মাথায় কেশবিরলতা সমেত তিনি অমরেশ বিশ্বাসকে অভ্যর্থনা করলেন। সিদ্ধার্থ একবার বড়বাবুর ঘরের চারদিকে তাকাল। প্রশাসনিক ক্ষমতা সম্ভবত কেড়ে নেয় মানুষের যাবতীয় পরিচ্ছন্নতা ও নান্দনিক বোধ। কেন-না যে-কোনও থানায় গেলেই এই চিত্র চোখে পড়ে। যে-কোনও সরকারি দপ্তরে গেলেও। যেন শাসনের সঙ্গে আছে অঙ্গাঙ্গী আবর্জনা। 

জানালায় নোংরা পর্দা কাত হয়ে ঝুলছে। দেওয়াল বিবর্ণ। তাতে ছোপ-ছোপ ধরা পানের পিক জাতীয় খয়েরি হলুদ দাগ। আলোয় ঔজ্জ্বল্য নেই। একটি রং-চটা জং-ধরা স্টিলের আলমারি। দেওয়ালের উঁচু তাকে হলুদ হয়ে যাওয়া কাগজের বান্ডিল তোলা আছে। লাল শালুর পর্দা দিয়ে ঢাকা। লালের ওপর ময়লার পরত জমে জমে কালো ছোপ। কোথা থেকে ভেসে আসছে মুত্রের গন্ধ। 

সব মিলিয়ে, সিদ্ধার্থর মনে হল, এ এক বিকারগ্রস্ত ঘর। মহকুমা শহর বলেই সম্ভবত বহরমপুর পুলিশবাড়িতে এতখানি অপরিচ্ছন্নতা দেখেনি সিদ্ধার্থ। এ ছাড়া বাকি সব ছোট ছোট থানাতেই এক চিত্র। যদিও, সে ভেবে দেখল, হরিহরপাড়াকে খুব ছোট থানা বলা চলে না কিছুতেই। 

মূল বিষয় থেকে সরে গিয়েছিল তার মন। এই নোংরা পরিবেশে দিনের পর দিন কাজ করে যারা, তাদের মন ক্রমে হয়ে যায় নিষ্প্রদীপ। অনুজ্জ্বল। আস্তে আস্তে এই মন আর মানুষ থাকে না। সে বোর্ডে ঝুলিয়ে রাখা কয়েদির সংখ্যা ও অপরাধের বর্ণনা পড়ছিল। বড়বাবু গলা খাঁকারি দিয়ে শুরু করলেন—বলুন কী ব্যাপার? কী খাবেন, চা না কফি? 

অমরেশ বিশ্বাস চা-কফির প্রস্তাব বাতিল করে দিলেন। সরাসরি চলে গেলেন কাজের কথায়। গম্ভীরভাবে তিনি বললেন—আপনার এলাকায় এসব কী ঘটছে তরুণবাবু? 

—কী ঘটছে? 

—আপনার থানার কাছেই একটি বাড়ি থেকে মেয়ে পাচার করা হয়। মানে, বাইরে থেকে মেয়ে এনে রাখা হয় সেখানে। তারপর পাচার করা হয়। 

—কার মেয়ে? কে পাচার করল? খুলে বলুন তো। 

অমরেশ বিশ্বাস সিদ্ধার্থর দিকে তাকালেন। সিদ্ধার্থ ময়না বৈষ্ণবীর কাছে যা যেমন শুনেছিল বলল। তরুণতপন বসু কিছুক্ষণ নীরবে টেবিলে কাঠের কাগজ-চাপা ঠুকলেন। তারপর চোখ তুলে বললেন—সেই মহিলা কোথায়? তাকে এনেছেন? 

ময়না বৈষ্ণবী বাইরে অপেক্ষা করছিল। ডাক পেয়ে ভেতরে এল। কোনও সংকোচ নেই তার মধ্যে। বরং এক দৃঢ়তা। থানায় এই তার প্রথম আসা। হৃদয়ে কিছু-বা উত্তেজনার দুরু দুরু হয়ে থাকবে তার। কেউ তাকে বসতে দিল না। অতএব সে দাঁড়াল একপাশে। বড়বাবু বললেন—নাম কী তোমার? 

—ময়না। 

—ময়না কী? 

—আগে ছিলাম ময়নামতী হালদার। এখন বোষ্টুমি হয়েছি বাবা। 

—বাড়ি কোথায়? 

—বাড়ি ছিল সুতি থানার বাঁশুলি গ্রামে। এখন আর বাড়ি নাই। মঠে থাকি। ঘুরে বেড়াই। তরুণতপন বসু ময়না বৈষ্ণবীর আপাদমস্তক দেখলেন। তারপর বললেন—কোন মঠে থাকো? 

—ঘোষপাড়া মঠে। 

—কতদিন হল ওখানে? 

—পাঁচ বছর হয়ে গেছে বাবা। ছয় হতে চলল। 

সিদ্ধার্থ উঠে দাঁড়াল এবার। বড়বাবুর উলটোদিকে দুটিমাত্র চেয়ার তারা দু’জন দখল করে আছে। সে ময়না বৈষ্ণবীকে বলল— আপনি বসে কথা বলুন। 

ময়না বৈষ্ণবী বসল। বড়বাবু বললেন—এর আগে কোথায় ছিলে? বাঁশুলি গ্রামে? 

—না বাবা। এর আগে দশ বছর ছিলাম পঞ্চবুধুরি শ্রীপাটে। ভগবানগোলায়। 

—তা সেখান থেকে এখানে এলে কেন? 

—এমনিই বাবা। ঘুরে ঘুরে থাকা আর কী 

সিদ্ধার্থ দাঁড়িয়েছিল ময়না বৈষ্ণবীর পিছনেই। তার রাগ হচ্ছিল। এই লোকটা ময়না বৈষ্ণবীর ইতিহাস ঘাঁটছে। বড়বাবুর চোখমুখ রীতিমতো কুটিল এখন। তিনি বলছেন—ঠিক কী কী হয়েছিল বলো তো? 

ময়না বৈষ্ণবী আদ্যোপান্ত বর্ণনা করল আবার। বড়বাবু বললেন—প্রায়ই এরকম মেয়ে আসে? 

—হ্যাঁ। 

—তারপর তারা কোথায় যায়? 

—জানি না। বলে কলকাতার মঠে কাজ করতে যায়। 

—কোন মঠে? —জানি না। 

—যে-মেয়েটির সঙ্গে তোমার কথা হয়েছিল সে কি স্বেচ্ছায় এসেছিল, নাকি তাকে জোর করে আনা হয়েছে? 

—না বাবা। সে নিজের ইচ্ছেয় এসেছিল। বাড়িতে খাবার জোটে না, তাই কাজ খুঁজতে এসেছিল। 

বড়বাবু শ্রীতরুণতপন বসু পর্যায়ক্রমে সিদ্ধার্থ, অমরেশ বিশ্বাস, মোহনলাল ও অন্যদের দিকে তাকিয়ে বললেন—দেখুন, যাদের মেয়ে তারা কিংবা যে-মেয়ে যাচ্ছে সে যদি এসে কোনও অভিযোগ না করে তবে আমাদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব না। 

সিদ্ধার্থ ময়না বৈষ্ণবীকে বলল— পিসি, আপনি বাইরে বসুন। 

ময়না বৈষ্ণবী উঠে বাইরে গেল। মোহনলালও গেল তার সঙ্গে সঙ্গে। সিদ্ধার্থ বলল—কেন করা সম্ভব না? জনস্বার্থে আপনি অন্তত শংকর লোকটিকে ধরে এনে জেরা করতে পারেন। 

—দেখুন, নির্দিষ্ট অভিযোগ না পেলে আমি কারওকে ধরে এনে জেরা করতে পারি না।

অমরেশ বিশ্বাস বললেন—আমরা অভিযোগ করছি। 

—কীসের ভিত্তিতে? ওই মহিলা এইসব কথা রটিয়ে বেড়াচ্ছেন না তার প্রমাণ কী? 

সিদ্ধার্থ বলল-আমরা যদি প্রমাণসমেত সব করব, তা হলে আর আপনার কাজ রইল কী! আপনি দেখুন মহিলা মিথ্যে বলছেন কি না। 

—দেখুন ঘোষপাড়া মঠ একটি প্রাচীন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। কোনও নির্দিষ্ট বা প্রত্যক্ষ অভিযোগ না থাকলে পুলিশ সেখানে গিয়ে হামলা করতে পারে না। 

অমরেশ বিশ্বাস বললেন— পুলিশের কাছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আলাদা মর্যাদা পাবে কেন? আমি অভিযোগ করছি। আপনি ডায়রি করুন। 

—মাপ করবেন। যে-মেয়ে পাচার হয়েছে, একমাত্র তার অভিযোগ বা তার অভিভাবকের অভিযোগই আমি নিতে পারি। 

—তার মানে আপনি ডায়রি নিচ্ছেন না? 

—নেওয়া সম্ভব নয়। 

সিদ্ধার্থ বলল ঠিক আছে। আমরা তা হলে অন্য রাস্তা দেখব। 

—কী রাস্তা? 

—সেটা আপনি জানতেই পারবেন। চলুন অমরেশদা। এখানে আর থেকে লাভ নেই। এইসব চক্রের সঙ্গে পুলিশ জড়িত না থাকলে এত সহজে এসব কাজ হয় কী করে! 

লাল হয়ে উঠল তরুণতপন বসু বড়বাবুর মুখ। তিনি চেঁচালেন—দেখুন অমরেশবাবু, এ শহরে আপনি একজন মান্যগণ্য মানুষ। কিন্তু তাই বলে আপনার লোকেরা যা খুশি তাই বলবে তা কিন্তু আমি সহ্য করব না। আমাদের আইন মেনে কাজ করতে হয়। 

তরুণতপনের ওপর দিয়ে গলা চড়ান তখন অমরেশ —কীসের আইন দেখাচ্ছেন আপনি? আপনার নাকের ডগায় বছরের পর বছর ধরে এমন একটি কম্মো হচ্ছে আর আপনি ফক্কুরি করে ডায়রি অব্দি নিচ্ছেন না! আইন দেখাচ্ছেন। জনস্বার্থে আমি অভিযোগ করতে চাইছি। আপনি নেবেন না কোন আইনে? সিদ্ধার্থ ঠিক বলেছে। পুলিশের চরিত্র জানতে আমাদের বাকি নেই। মনে রাখবেন আপনি অভিযোগ নেননি। 

অমরেশ বিশ্বাস উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর মুখে গনগনে ক্রোধ। তিনি অপমানিত বোধ করেছেন। সিদ্ধার্থ হতমান বোধ করেনি কিন্তু তীব্র রাগ তাকে অস্থির করেছে। সে লক্ষ করছে, অল্প অল্প টলছে অমরেশ বিশ্বাসের পা। সে এগিয়ে গিয়ে তাঁর হাত ধরল। বলল-আমরা এর শেষ দেখে ছাড়ব। 

গনগনে আঁচ সরে গিয়ে এখন অমরেশ বিশ্বাসের মুখে অপমানের ফ্যাকাশে আস্তরণ শুধু। মনে মনে একরকম পরাজয় অনুভব করছেন তিনি। আজ যদি তাঁর জায়গায় ভবরঞ্জন বিশ্বাস আসতেন তা হলে লোকটা এককথায় অভিযোগ নিত। জ্বলন হল তাঁর অন্তরে। তিনি দৃঢ়চিত্ত হলেন। এই ঘটনার শেষ দেখে ছাড়বেন। এবং আগামী নির্বাচনে সম্পূর্ণ প্রস্তুত থাকবেন তিনি। যে-কোনও উপায়ের জন্য। রাজ্যে এখন তাঁদেরই দল অভিষিক্ত। কেন্দ্রে মোর্চা সরকার। কংগ্রেসের ওই লোকটাকে পরবর্তী নির্বাচনে তিনি হঠাবেন। হঠাবেনই। 

অমরেশ বিশ্বাস নিজের মনোভাব গোপন করতে করতে সিদ্ধার্থর দিকে তাকালেন। সিদ্ধার্থ বলল—চলুন। বেরুনো যাক। 

থানা চত্বরের বাইরে এসে গোল হয়ে দাঁড়াল সবাই। সিদ্ধার্থ বলল— আমাদের সবার আগে একটা বিষয়ে ভাবতে হবে অমরেশদা। 

—কী? 

সিদ্ধার্থ ময়না বৈষ্ণবীর দিকে তাকিয়ে বলল—ইনি এখন থাকবেন কোথায়? এরপরে আর ঘোষপাড়া মঠে ওঁর থাকা চলে না। 

তখন কথা বলল মোহনলাল —–পিসি আমাদের বাড়িতেই থাকবেন এখন। ঠাকুমাও সেরকমই বলে দিয়েছেন। 

ময়না বৈষ্ণবী হেসে বলল—আমাকে নিয়ে ভেবো না বাবারা। আমি ঘুরে ঘুরে বেড়াই। তা ছাড়া পঞ্চবুধুরি শ্রীপাটে আমার জায়গা পাকা। 

সিদ্ধার্থ বলল—আপনাকে এখন দরকার হবে আমাদের। আপনার কথার ওপর নির্ভর করে আমরা এতদূর এসেছি। একটা ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত আপনি না হয় মোহনের বাড়িতেই থাকুন। ঘোষপাড়া মঠে কি আপনার জিনিসপত্র আছে? 

—কিছু নেই বাবা। জিনিস দিয়ে আমার কী হবে! এই ঝুলিতেই আমার দুনিয়া ভরা। তোমরা যতদিন বলবে আমি থাকব বাবা। এই এলাকার বাইরে যাব না। 

অমরেশ বিশ্বাসের অপমান তাঁর সঙ্গের লোকেদের বিধেছিল। তারা উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। ঘোষপাড়া মঠের মতো জায়গা মেয়ে পাচারের কেন্দ্র হয়ে উঠবে—এও তারা মানতে পারছে না। তাদের চোখেমুখে ক্রোধ ও অসহিষ্ণুতা। তারা আরও লোকজন নিয়ে ঘোষপাড়া মঠ ঘেরাও করতে চায়। ঘটনার আছে এক নিজস্ব গতিপথ। অনেক সময় সেই গতি বিষয়ে নিশ্চেষ্ট থাকতে হয়। নির্বিকার। কারণ এই গতিপথই নিজস্ব স্বতঃস্ফূর্ততা দ্বারা কোনও কোনও সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে। অতএব সিদ্ধার্থ আপাত-নির্বিকার অনুসরণ করল জনমত। অমরেশ বিশ্বাস সকলকে নিয়ে পার্টি দপ্তরে গেলেন। আধ ঘণ্টার মধ্যে অন্তত ত্রিশজন চলে এল দপ্তরে। শুনল সব সরাসরি ঘোষপাড়া মঠ ঘেরাও করা হবে এবার। মানুষগুলি ফুঁসতে ফুঁসতে চলেছে। মঠ ঘেরাও হলে হল্লা-চিল্লা হবে। এলাকায় লোক জানাজানি হবে। আর কিছু না হলেও আশেপাশের লোক যদি সতর্ক হয়ে ওঠে তা হলেও মঠে পাপকর্ম করার কিছু অসুবিধা ঘটবে। 

নিস্তব্ধ ঘোষপাড়া। গৃহস্থ মানুষগুলি আপন আপন সংসারকর্মে ব্যস্ত। মঠে কী হল, কে এল, কে গেল—কে তার খবর রাখে। বিশেষত, মঠ সম্পর্কে কোনও অশ্রদ্ধেয় চিন্তাভাবনা সাধারণ মানুষের মনে আসে না। কিন্তু ঘোষপাড়া মঠ সম্পর্কে এলাকার মানুষের মিশ্র মনোভাব। একই মঠে নারী-পুরুষ বসবাস করে বলে, অনেকের কাছে এ মঠ লীলাক্ষেত্র। আবার অনেকে মেনে নেয় সাধন-ভজনের আছে বিচিত্র পদ্ধতি ও পন্থা। আলাদা মঠে থেকেও মানুষ অনাচার-অবিচার করতে পারে। কামনা, লালসা, হিংসা ধর্মাচারী মানুষকেও বশীভূত করতে পারে। বিশেষত শহরাঞ্চলে এখন ঘরে ঘরেই টেলিভিশন। দেশ-বিদেশের বহু অবিচারের খবর মানুষ জেনে যাচ্ছে সহজেই ওই দূরদর্শনে। তবে এই মঠ মেয়ে পাচারের কেন্দ্র তা কেউ ভাবে না। এখন এতজন লোকের একসঙ্গে পথ চলা ও সংক্ষুব্ধ কথার শব্দে কেউ কেউ পর্দা তুলল, কেউ বেরিয়ে এল বারান্দায়। কী হয়েছে? কোথায় যায় এতসব লোকজন? অমরেশ বিশ্বাস এক পরিচিত মানুষ, তিনিও আছেন এই দলে! অতএব লোকের মনে প্রত্যাশা জাগল, তারা কোনও মিছিল দেখবে বুঝি। কিন্তু অমরেশ বিশ্বাসের লোকজনের মধ্যে মিছিলের সুশৃঙ্খল পথচলা ছিল না। 

মঠ ঘেরাওয়ের ফলাফল কী হতে পারে অনুমান করার চেষ্টা করছিল সিদ্ধার্থ। খুব আশাপ্রদ কিছু হবে না বলেই মনে করছে সে। তবু, সতর্কীকরণের জন্য এর প্রয়োজন আছে। পরবর্তী পদক্ষেপ খুব ঠান্ডা মাথায় হিসেব করে ফেলতে হবে। 

মঠের দুয়ারে পৌঁছে থামল গোটা দল। অমরেশ বিশ্বাস তাঁর দলের একজনকে পাঠালেন ভেতরে বলরাম বাবাজিকে ডেকে আনার জন্য। মঠের উঠোন থেকে ফুলের গন্ধ আসছে। তার সঙ্গে মিশে আছে ধূপধুনোর গন্ধ। মাঝে মাঝে রান্নার গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে। সব মিলে এক স্বাভাবিক পরিবেশ যার মধ্যে মেয়ে পাচার করার অভিযোগ অবিশ্বাস্য লাগে। 

সিদ্ধার্থ ময়না বৈষ্ণবীকে বলল— আপনি বাইরে থাকুন। না ডাকলে আসবেন না। 

তখন ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন বলরাম বাবাজি। সঙ্গে মঠেরই আরও দু’জন। কপালে তিলক। ছোট করে ছাঁটা চুল। গোল ভুঁড়িসমেত বেঁটে ও কালো বলরাম বাবাজির পরিধানে ধুতি ও ফতুয়া। তাঁর সঙ্গের একজন শিবু, অন্যজন কেশব বাবাজি। মঠ পরিচালনায় তারা বলরাম বাবাজির পার্শ্বচর। লোকজন দেখে বলরাম বাবাজি থমকালেন, গম্ভীর হলেন এক মুহূর্তের জন্য। তারপরেই সামলে নিয়ে বললেন—আরে আসুন আসুন। কী সৌভাগ্য! 

অমরেশ বিশ্বাসকে দেখে গলা ঝেড়ে বললেন—আসুন আজ্ঞে। কথাবার্তা ভেতরে বসেই হোক। 

অমরেশ বিশ্বাস এদিক-ওদিক তাকালেন। ভেতরে যাওয়া ঠিক হবে, নাকি এখানেই সর্বসমক্ষে কথা বলা উচিত তিনি বুঝতে পারছিলেন না। তিনি ডাকলেন— সিদ্ধার্থ! 

সিদ্ধার্থ এগিয়ে আসছিল। এটা ঠিক যে অমরেশ বিশ্বাস বর্ষীয়ান নেতা হওয়া সত্ত্বেও কোনও একটি জায়গায় সিদ্ধার্থর ওপর নির্ভর করছিলেন। তার কারণ হতে পারে, নেতা হিসেবে অমরেশ বিশ্বাস যে-পর্যন্ত এসেছেন, সেটুকু আসতেই তাঁর আত্মবিশ্বাসের জোর ফুরিয়েছিল। নেতৃত্বের বিষয়ে তিনি মনে মনে কারও ওপর নির্ভর করতে অধিক স্বস্তিবোধ করছিলেন। কেন-না বিষয়টি নয় হাতে-নাতে চোর ধরে ফেলার মতো সহজ ও প্রত্যক্ষ, নয় বিরোধীদলের বোমাবাজি সন্ত্রাস। কিংবা, হতে পারে, সদা বহরমপুরের নেতৃত্বের অনুবর্তিতায় অভ্যস্ত এই মানুষ সিদ্ধার্থকেই মনে মনে বহরমপুরের কেন্দ্রীয় শক্তির প্রতিনিধি বলে মানছেন, যেমন মেনেছিলেন বরকত আলি। অথবা এসব কিছুই নয়। হয়তো সিদ্ধার্থের মধ্যেই আছে সেই বস্তু যা তাকে দিয়েছে সহজে নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা। তার উপস্থিতি দশজন মানুষের মধ্যে তাকেই নেতা নির্বাচিত করে। মানুষ তারই নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে। অর্থাৎ, মানুষ নেতৃত্বের স্বাভাবিক ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। সকল ব্যক্তির মধ্যেই এই গুণ বিদ্যমান থাকে না। রাজনীতি এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বও এক অভ্যাস যার দ্বারা কিছুদূর পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব। ওই উপায়ে মানুষের হৃদয়ের নায়ক হওয়া চলে না। 

সিদ্ধার্থ বুঝেছিল, অমরেশ বিশ্বাস ঠিক কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। অতএব সে বলল—অমরেশদা, আমরা যা বলার এখানেই বলব। সবার সামনে। 

অমরেশ বিশ্বাস বললেন—এসো। তুমি কথা বলো। তুমি জানো। 

পেছনে নিশ্চুপ ও ক্রুদ্ধ মানুষের সারি। মঠে এত লোককে আসতে দেখে পাড়ার বসবাসকারীরাও কৌতূহলী হয়েছেন। অমরেশ বিশ্বাসের লোকজনের পেছনে তাঁদের সারি। একে একে জমায়েত বাড়ছে। সিদ্ধার্থ একবার চারদিক তাকিয়ে গলা ছেড়ে বলল—কমলি নামের একটি মেয়ে এসেছিল আপনাদের মঠে। সে কোথায়? 

—কে কমলি? আমাদের মঠে তো কমলি বলে কেউ থাকে না। 

—দিন কয়েক আগে শংকর নামে একটি লোক দুটি মেয়েকে এই মঠে এনেছিল। তার মধ্যে একজন কমলি। সে কোথায়? 

বলরাম বাবাজির চোখ সরু হয়ে এল। চোয়াল দেখাল কিছু দৃঢ়। তিনি বললেন—আমাদের অতিথিশালায় অনেকেই আত্মীয়স্বজন নিয়ে এসে থাকেন। তাঁদের নাম জানা তো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এখান থেকে তাঁরা কোথায় গেলেন তাও বা আমি কী করে বলব? শংকরের সঙ্গে যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা শংকরের সঙ্গেই চলে গেছেন। 

সিদ্ধার্থ লোকটিকে বোঝার চেষ্টা করে। এবার বলে- শুধুমাত্র শংকর লোকটিই আপনাদের এখানে মেয়ে নিয়ে আসে। একজনকে কখনও দু’বার দেখা যায় না তার সঙ্গে। আমাদের কাছে পরিষ্কার খবর আছে। 

বলরাম বাবাজি হাতজোড় করেন –বাবারা, সাধন-ভজন নিয়ে থাকি। কে এল, কে গেল, তা দেখা কি আর আমার কাজ! মা জননীরা আসেন, থাকেন, কখনও কোনও গোলমাল হয়নি। 

—এই মঠ পরিচালনার দায়িত্ব আপনার। মা জননীরা কে, কেমন, তারা কেন আসে, কোথায় যায় আপনি জানেন না। আপনি এ-ও জানেন না যে তাদের কাজের লোভ দেখিয়ে আনা হয়। বলা হয় কলকাতার মঠে নিয়োগ করা হবে। আপনি এসবও কিছু জানেন না কেমন? 

—বাবারা, এভাবে কি কথা হয়? আপনারা আসুন ভেতরে। বসুন। প্রসাদ পান। তারপর ধীরে-সুস্থে কথা হবে। 

অমরেশ বিশ্বাস বললেন—আপনি প্রশ্নের উত্তর দিন। কোন মঠে আপনারা কাজ দেন? কে দেয়? কোথায়? আপনার অজান্তে এতসব হয় কী করে? 

—সংসার-বৈরাগী মানুষ সব। ধৰ্ম্মে-কম্মে জীবন কাটাবে বলে আসে। আমাদের ছোট মঠে জায়গা হয় না বলে অন্যান্য মঠে যায়। 

—কোথায় যায়? সেটাই তো আমরা জানতে চাইছি। আর এত লোক শুধু আপনাদের মঠেই আসে কেন দলে দলে? 

বলরাম বাবাজি সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। বললেন—এত কথার উত্তর আপনাদের কেন দেব আমি? আমি মঠের প্রধান। মঠের নিয়ম অনুযায়ী আমি কাজ করি। এখানে দাঁড়িয়ে আপনাদের এই কাজের কৈফিয়ত আমি দিতে পারব না। 

ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন চেঁচিয়ে উঠল— খানকির বাচ্চা! প্যাঁদালে ঠিক দিবি বে।

কয়েকজন বলল—মার শালাকে! মার, মার! 

সিদ্ধার্থ হাত তুলল। অমরেশ বিশ্বাসও হাত তুললেন। ক্রোধ মানুষের সংযম নাশ করে। সিদ্ধার্থ ঠিক এ ধরনের কথোপকথনই অনুমান করেছিল। কোনও স্বীকারোক্তি প্রত্যাশা করেনি। তবুও তার রাগ হচ্ছিল। সে চোয়াল শক্ত করে বলল—কমলি বলে যে-মেয়েটি এসেছিল, সে কিন্তু ধর্ম করতে আসেনি। দেখুন আপনি যদি সোজা কথার সোজা জবাব না দেন, তা হলে আমাকে আরও অনেক কথা বলতে হবে। এত লোক এখানে রয়েছেন। আমি সব বলব কি? 

—ক্কি? ক্কি বলবেন? মঠে এসে গুণ্ডামি করছেন আপনারা। আমি পুলিশ ডাকব। হ্যাঁ ডাকব।

ক্রুদ্ধ জনতার মধ্যে থেকে আওয়াজ ওঠে আবার—চোপ শালা। ধম্মের নামে মেয়ে পাচার করছিস, আবার পুলিশ দেখাচ্ছিস বে? 

শিবু নামের লোকটি বলল—দেখুন আপনারা মঠের শান্তি নষ্ট করছেন। মঠের একটা মর্যাদা আছে। কমলির কোনও ব্যাপার আমরা জানি না। 

সিদ্ধার্থ সারা শরীরে কাঁপন বোধ করে। মনে মনে দুর্বল হয়ে পড়ছে সে। ময়না বৈষ্ণবীর কথার ওপর সে এতবড় কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। এমনকী অমরেশ বিশ্বাসও তার ওপর নির্ভর করছেন। তদুপরি, এই এলাকা তার নিজের নয়। এখানকার সকলেই তাকে চেনে না। সে নিজের শক্তিকে সংহত করার চেষ্টা করে। সে কোনও স্বার্থ নিয়ে এ কাজ করছে না। আর বলরাম বাবাজির কথায় এটুকু অন্তত স্পষ্ট যে গোলমাল কিছু আছে। সে কঠিন স্বরে বলল—আমি যদি বলি কমলি নামের মেয়েটি আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে, আপনি তার সম্মান নষ্ট করেছেন। 

বলরাম বাবাজি দুলতে থাকেন—আমি? আমার বিরুদ্ধে? আমি মঠে পুজোকৰ্ম্ম নিয়ে থাকি। কোথায় সেই মেয়ে! তাকে আনুন। 

জনতা এবার প্রকৃতই অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছে। তারা এত শান্ত নিরুত্তাপ বাচালতায় বিশ্বাস করে না। লোকটাকে কয়েকটা ঘুষি ঝাড়তে পারলেই সত্যি কথা বলবে। তা হলে আর দেরি কেন! 

সিদ্ধার্থ তখন এক মুহূর্ত পরামর্শ করে অমরেশ বিশ্বাসের সঙ্গে এবং ময়না বৈষ্ণবীকে আহ্বান করে। ময়না বৈষ্ণবী সামনে এসে দাঁড়ায়। আর তাকে দেখে অবাক হয়ে যায় বলরাম বাবাজিসহ বাকি দু’জন। বলরাম বাবাজি কোনওক্রমে বলেন—বোষ্টুমি! 

সিদ্ধার্থ বলে–আপনি বলুন পিসি। 

ময়না সটান দাঁড়ায়। বলে কী আর বলব। মেয়েগুলো আসে আর এই লোকটা তাদের সর্বনাশ করে। কোথা থেকে লোভ দেখিয়ে আনে সব মেয়ে। বলে, মঠে কাজ দেবে। বাবারা, আপনারা খোঁজ করেন, তারপর মেয়েগুলি যায় কোথায়! কমলি খেতে পেত না। পেতনির চর থেকে এসেছিল। এ সবই আমি তার কাছে জেনেছি। 

বলরাম বাবাজি চিৎকার করছেন—সব মিথ্যে। সব বানানো। 

মারমুখী হল লোকজন। একজন লাফিয়ে পড়ল সামনে। তার মুখে গালিগালাজ —শালা বুড়ো ভাম। ইয়ারকি হচ্ছে! শিগগির বল শালা কোথায় মেয়েগুলোকে পাঠাস। মঠের নামে মাগি মারাচ্ছ শালা। 

কেশব বাবাজির গলা শোনা যায়—দেখুন, গাল পাড়বেন না। 

অমরেশ বিশ্বাস দু’ হাত তোলেন—শান্ত হও। সব শান্ত হও। 

তখন বলরাম বাবাজির কণ্ঠস্বর করুণ হয়ে পৌঁছয়—বিশ্বাস করুন, যার কথা শুনে আপনারা আমায় ধরেছেন, সেই বোষ্টুমির চরিত্র অতি খারাপ। কী হে কেশব? বলো ভায়া। তোমরাও এই বোষ্টুমির কীর্তি বলো। বাবারা এ নষ্ট চরিত্রের মানুষ। এর শয়নের-বসনের ঠিকঠিকানা নাই। দু’চারটে সৎ কথা বলি বলে এখন শোধ নিতে চায়। 

ক্রুর দেখায় বলরাম বাবাজির চোখমুখ। এবং মুহূর্তে একটি হিংস্র বৃত্ত রচিত হয়ে যায়। কয়েকজন থমকে যায়। তাদের মনে মুহূর্তকালের জন্য দেখা দেয় দ্বিধা ও সন্দেহ। হতে পারে। হতেই পারে। বোষ্টুমিদের চাল-চরিত্তির ঠিক থাকে না তারা শুনেছে। তা ছাড়া সে এমন নারী যার পরিবার-পরিজন নেই, বন্ধন-পিছুটান নেই, এমনকী নেই নির্দিষ্ট পুরুষ—তার চরিত্র ঠিক না থাকাই সহজ সম্ভাবনা। তারা বৈষ্ণবীর শরীর দেখে আপাদমস্তক। কী টান এখনও শরীর জুড়ে! কী জোয়ার! এমন আঁট-বাঁধুনি মেয়েমানুষের ছিনাল হতে কতক্ষণ! ভক্তিতে যে শরীর ভোলে তার কি অমন চোখ-টাটানো দেহ থাকে? আর নারীর চরিত্র এই বিংশ শতকের শেষ পর্বেও অতিমাত্রায় শুচিতা দাবি করে। অগ্নিপরীক্ষা দ্বারা প্রমাণের জন্য আজও অপেক্ষমাণ নারীজাতির সততা। 

এবং লোকের এই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব পাশে রেখে ময়না বৈষ্ণবী বিহ্বল তাকিয়ে আছে বলরাম বাবাজির দিকে। এই মঠের আশ্রয় হারাবেই সে জানত। কিন্তু আরও যে কিছু হারাবার থাকতে পারে তার, ভাবেনি। সে চারপাশে তাকাল। কোনও মুখ রাগী। কোনও মুখ বড় শঠতায় তার দিকে তাকিয়ে আছে। স্পষ্টত, অধিকাংশ লোকের চোখেই তার প্রতি অবিশ্বাস। সে নিশ্চিতই এই আক্রমণ প্রত্যাশা করেনি। বাস্তব জগতকে দেখার যে-মাত্রা, সেই মাত্রা তাকে একপক্ষে অভিজ্ঞ করেছে কিন্তু কূটনীতিক করেনি। তার হঠাৎ নিজেকে বিবস্ত্র মনে হতে থাকে এমনই লজ্জা। সে এমনকী বেদনায় ঈশ্বরকে স্মরণ করতেও ভুলে যায়। বরং তার মনে পড়ে স্বামীকে এবং বুকের ভেতরে দুমড়ে-মুচড়ে যায়। 

সিদ্ধার্থ ময়না বৈষ্ণবীর চোখের ভাষা পড়ে নেয় এবং মোহনলালকে ইশারা করে। মোহনলাল ময়না বৈষ্ণবীকে বাইরে নিয়ে যেতে থাকে। বলরাম বাবাজির শাণিত ও অতর্কিত অস্ত্রও সে স্পষ্ট দেখতে পায়। অভিযোগ আত্মরক্ষার অন্যতম উপায়। রাজনৈতিক জীবনেও নিরন্তর চলে এই চাপান-উতোর। ব্যক্তিগত জীবনে কাদা ছোড়াছুড়ির খেলা। সে অতএব এগিয়ে যায় বলরাম বাবাজির দিকে এবং তাঁকে অল্প ধাক্কা দিয়ে বসে। শীতল কণ্ঠ খাদে এনে বলে—হাজতে তোমাকে যেতেই হবে, বলে দিলাম। 

এবার সে ঘুরে দাঁড়ায়। পেছনের জনতাকে সম্বোধন করে বলে—আপনারা আমাকে চেনেন না। অমরেশদা চেনেন। অমরেশদা আমার অত্যন্ত প্রিয় এবং শ্রদ্ধাভাজন। আমি তাঁর অনুমতি নিয়ে বলছি—একটা কথা আমাদের ভাবা দরকার। মুর্শিদাবাদে মেয়ে পাচার চক্র সক্রিয়। নানা জায়গায়, দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে মেয়েদের প্রতারিত করা হচ্ছে। সংবাদপত্রগুলোয় এ নিয়ে লেখা হয়। আপনাদের এলাকায় এ ঘটনা ঘটছে। এখনই আমরা যদি সতর্ক হতে না পারি তা হলে আমাদের ঘরের মেয়েরাও প্রতারিত হবে। আপনারা লক্ষ রাখুন এখানে কারা আসে। কারা যায়। আমরা প্রথমে পুলিশের কাছে গিয়েছিলাম। পুলিশ অভিযোগ নিতে অস্বীকার করেছে। তা হলে এটাও ভেবে দেখা দরকার, পুলিশের ভূমিকা আসলে কী! এ নিয়ে আমাদের আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু তার জন্য চাই আপনাদের সহযোগিতা। আজ আমরা এখান থেকে চলে যাচ্ছি। দরকার হলে আবার আসব। 

কেউ ছিঁড়ে নিল গাছের পাতা। পাথর কুড়িয়ে ঢিল মারল কেউ। খোলা উদোম গালিগালাজ করতে করতে ফিরে যেতে থাকল জনতা। ময়না বৈষ্ণবী চলেছে টলতে টলতে। মাথা নিচু। কাঁধে ঝোলা। পায়ে শক্তি নেই তার। 

অমরেশ বিশ্বাস বারবার প্রতিজ্ঞা করছেন, এর শেষ দেখে ছাড়বেন। জনসভা করবেন। পথসভা। সিদ্ধার্থ কথা বলছিল না বিশেষ। তার গ্লানি আসছিল। তারা সকলেই জানত বলরাম বাবাজিকে যদি বলা হয়—বাবাজি, শুনলাম আপনি মেয়ে পাচার করেন। এই অভিযোগ কি সত্য? অমনি বলরাম বাবাজি অপূর্ব সততায় বলবেন—করি বাবা, করি। কত মেয়ে গেল এ হাত দিয়ে… এমনটি ঘটবে না। 

তারা সকলেই চেয়েছিল লোক জানাজানি। সেটা হয়েছে। কিন্তু ময়না বৈষ্ণবীর ওপর আক্রমণ আসতে পারে এটা তার ভাবা উচিত ছিল। কোনও কাজ করার আগে পূর্বাপর যতখানি সম্ভব ভেবে নেওয়া চাই, সে বিশ্বাস করে। কিন্তু সে বুঝতে পারছে, নিজের মধ্যে এই প্রক্রিয়া জারি রাখতে সে আজও সম্পূর্ণ সক্ষম নয়। সে ময়না বৈষ্ণবীর এই অপমানের জন্য মনে মনে নিজেকে দায়ী করে এবং স্থির করে গোটা ব্যাপারটা নিয়ে রাসুদার সঙ্গে কথা বলবে। সে অমরেশ বিশ্বাসকে বলে—আপনি এখানে লোকজনের সঙ্গে কথা বলুন। আমি কাল বহরমপুরে গিয়ে রাসুদার সঙ্গে আলোচনা করি। 

অমরেশ বিশ্বাস এই সিদ্ধান্ত সমর্থন করেন। সিদ্ধার্থ, মোহনলাল ও ময়না বৈষ্ণবী তেকোনা গ্রামে ফেরার জন্য ঘোড়ার গাড়িতে ওঠে। হারাধন ও রেজাউল সকালেই চলে গিয়েছিল পেতনির চরে। 

অন্ধকার চিরে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। নারকোেলমালার মধ্যে মোম বসিয়ে গাড়ির আলো। রাত্রি হয়েছে। গ্রামে এ বড় ঘন সময়। এই রাত্রি ন’টায় পথে কেউ আর ভ্রাম্যমাণ থাকে না। কেউ কোনও কথা বলছিল না। ময়না বৈষ্ণবীর দুই চোখ অন্ধকারে অশ্রুপাত করছিল। মোহনলাল তা টের পাচ্ছিল না। কিন্তু সিদ্ধার্থ ময়না বৈষ্ণবীর প্রতিটি অশ্রুবিন্দু অনুমান করতে পারছিল গভীরতম সমবেদনায়। সে ময়না বৈষ্ণবীর একটি হাত ধরল। কী আশ্চর্য উষ্ণতা ছিল তার হাতে, ময়না বৈষ্ণবী আঁকড়ে ধরল ওই ওম। তার শরীর কেঁপে উঠল। এ হাত, এই ভরসা, এই সমব্যথা তার চেনা। তার কতকালের চেনা। কতকাল আগে ছেড়ে যাওয়া এই স্পর্শ তাকে স্নেহশীতল রাখে অদ্যাবধি। তার মনে আবেগ ঘিরে আসে। সিদ্ধার্থ ডাকে তখন—পিসি। 

—বলো বাবা। 

ময়না বৈষ্ণবীর স্বরে অসহিষ্ণুতা নেই। অভিযোগ নেই। আছে কেবল কান্না-আঁকড়ানো বিকৃতি। মোহনলাল ঝুঁকে বসল। সিদ্ধার্থ বলল—আমরা এ অপমানের শোধ নেব। 

ময়না বৈষ্ণবী কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল—তোমরা আমাকে অবিশ্বাস করছ না তো বাবা! 

সিদ্ধার্থ ও মোহনলাল প্রায় একসঙ্গে বলে ওঠে—অসম্ভব। প্রশ্নই ওঠে না। 

—তা হলে আর আমার অপমান কী! ভগবান জানেন আমি কোনও অন্যায় করি নাই। তোমরা দেখো, যাতে আর কোনও মেয়ের সর্বনাশ ওরা না করে। 

—আপনি থাকবেন তো পিসি? আপনাকে আমাদের দরকার। 

—থাকব বাবা। নিশ্চয়ই থাকব। 

সিদ্ধার্থ ভাঙা গলায় বলল— মোহন, আজ ওঁকে মঠে নিয়ে যাওয়া উচিত হয়নি। আমার নিজেকে খুব অপরাধী লাগছে। 

মোহনলাল বলল—এতটা আমরা কেউ-ই ভাবিনি। 

ঘোড়ার গাড়ি ঠুক-ঠুক করে চলেছে। সিদ্ধার্থ গোটা ঘটনাটাই পরপর সাজাতে থাকল। হঠাৎ তার মনে হল, যারা কোনও প্রস্তুতি ছাড়াই এমন অভিযোগ করতে পারে, তারা কি আরও কিছু করতে পারে না? সে ময়না বৈষ্ণবীকে বলল—পিসি। একটা কথা। কিছুদিন একা একা এ গ্রাম ও গ্রাম করবেন না আপনি। মোহনদের গ্রাম ছেড়ে যাবেন না কোথাও। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *