১১৭
এ যুগে এখন ঢের কম আলো সব দিকে, তবে।
আমরা এ পৃথিবীর বহুদিনকার
কথা কাজ ব্যথা ভুল সংকল্প চিন্তার
মর্যাদায় গড়া কাহিনীর মূল্য নিংড়ে এখন
সঞ্চয় করেছি বাক্য শব্দ ভাষা অনুপম বাচনের রীতি।
.
শ্মশানের কাছে পড়েছিল দেহ তার। নলি কাটা। ওই অপরূপ সুদর্শনে প্রহারের চাকা চাকা দাগ। এমনকী পেটেও আমূল বদ্ধ ছুরি। ঊর্ধ্বাঙ্গে পোশাক ছিল না কোনও।
বাড়িতে থেকেই সে এ খবর পেয়েছিল। বাড়িতে থেকেই, কেননা বোধিসত্ত্ব শয্যা নিয়েছেন। শয্যাপার্শ্ব হতে সে উঠছিল না একেবারে। আজ অবধি তারও দেহে লেগে আছে প্রহারের চাকা চাকা দাগ। কিন্তু নওয়াজের বিরুদ্ধে তার অভিযোগ ছিল না কোনও। সে স্বীকার করে, ওইভাবে হঠকারী আক্রমণ করা উচিত হয়নি তার! ক্রোধ জমিয়ে রাখতে হয়। সে জানে। ক্রোধ থেকে বেরিয়ে আসে সূক্ষ্মতর কর্তব্যের পথ। কিন্তু সে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল। সংযম হারিয়ে ফেলেছিল। এমনকী মিহির রক্ষিত তাকে পুলিশে সমর্পণ করতে পারতেন। বলতে পারতেন সে হত্যা করতে উদ্যোগী হয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে তিনি করেননি তেমন। বলেছেন—ছেড়ে দিন। সিধু আবেগপ্রবণ। মানুষের কষ্ট দেখে মাথা ঠিক রাখতে পারেনি। নওয়াজ, সিদ্ধার্থ—সবার তরুণ রক্ত! গরম মস্তিষ্ক! সহজেই ভুল করে।
মিহির রক্ষিতকে এত মহান সে কখনও দেখেনি! বরং সে মনে করছে, এর আড়ালে কিছু আছে। কোনও উদ্দেশ্য, স্বার্থ কোনও, যার নাগাল সে পাচ্ছে না! হ্যাঁ, নওয়াজের ওপর তার রাগ আছে। কিন্তু সে নিজের জন্য নয়। তৌফিকের জন্য। নওয়াজ তৌফিককে লাথি মেরেছিল, এ তার সহ্য হয়নি। যতবার ওই দৃশ্য তাকে তাড়া করেছিল, সে, দাঁতে দাঁত চেপে শোধ তুলবার কথা চূড়ান্ত ভেবেছে। কিন্তু মৃত্যু সে কামনা করেনি। নওয়াজের মৃত্যু সে কামনা করেনি। এভাবে কে মারল তাকে? কেন মারল?
সে যায়নি দেখতে। যায়নি কেন না বোধিসত্ত্বকে ছেড়ে সে এখন যাবে না কোথাও! যদিও বোধিসত্ত্ব বলছেন—তোমার জন্য পড়ে আছে হাজার কাজ! তুমি কাজ না করলে কষ্ট পাব আমি!
তবুও যায়নি সে। তার কাছে তৌফিক এসেছিল। মির্জা এসেছিল। বসির খান। এসেছিল দুলুক্ষ্যাপা তেকোনার সমস্ত সংবাদ নিয়ে। তেকোনায় যাওয়া হয়নি কতদিন!
একটি নির্দিষ্ট সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে সে। এবার তার বহু কাজ। বহু বহু কাজ। কিন্তু ফোন পেয়ে সে স্তব্ধ হয়ে গেল। ফোন করেছিলেন রাসুদা!
এখন ভাবছে সে। রাসুদার কথাগুলি নিয়ে দ্রুত ভাবছে। নওয়াজের মৃত্যুর অভিযোগ তার দিকে। তার জন্য এসে গেছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। সে স্তম্ভিত হয়ে আছে। তার মনে হচ্ছে অঙ্কের শেষটুকু মিলে এল প্রায়। কী নিদারুণ পরিকল্পনা! কী জঘন্য চক্রান্ত! হাজার হাজার লোক সাক্ষী আছে নওয়াজ সিদ্ধার্থকে মেরেছিল! এ জন্যই মিহির রক্ষিত ক্ষমা করেছিল তাকে। ধৈর্য ধরেছিল। রাজনীতির স্বতঃসিদ্ধ চাল। নির্ভুল ঐতিহাসিক চক্রান্ত!
এত রাতে একমাত্র মির্জাকেই খবর দিয়েছে সে। দিতে পেরেছে। কারণ অন্য কারও ফোন নেই। সে সফিকে পাঠিয়েছে মির্জার কাছে। আর এই মুহূর্তে রাসুদা তাকে বেরুতে বারণ করেছেন। সে, মির্জা আসার আগে, কথাগুলো ভেবে নিচ্ছে। কী করবে সে? কী করবে?
বোধিসত্ত্ব বলছেন—আমাকে বলো! কী হয়েছে!
সে বিহ্বল হয়ে যাচ্ছে। বলছে— দাদু! তুমি সুস্থ নও!
বোধিসত্ত্ব বলছেন—আমি বেঁচে আছি দাদুভাই। আমার প্রাণকে অস্বীকার কোরো না। আমার চেতনাকে অসম্মান কোরো না।
—না দাদু না!
—তা হলে বলো!
তখন মির্জা এসে যাচ্ছে তার দরজায়। সে মির্জাকে এবং বোধিসত্ত্বকে বলছে সব। যা বলেছেন রাসুদা। সবটুকু! চাপাস্বরে, ধীরে, জোর দিয়ে দিয়ে—সিধু! যা বলছি মন দিয়ে শোন!
—বলুন রাসুদা!
—নওয়াজের খুনের জন্য তোকে দায়ী করা হয়েছে। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা এসে গেছে। সাক্ষীসাবুদ সমস্ত তৈরি। তোকে পালাতে হবে!
সে বিস্মিত বলেছে—পালাতে হবে? কোথায়?
—তোকে ঠিক করতে হবে সেটা! তার মানে একা একা এখুনি বেরিয়ে পড়িস না! তোর বাড়ির আশেপাশে গুন্ডা রাখা আছে। খুন হয়ে যাবি।
—রাসুদা!
—যা বলছি শোন! ভালভাবে পরিকল্পনা করে নে। কোথায় যাবি, কার সাহায্যে যাবি। আমি বেশি কিছু করতে পারব না রে!
—রাসুদা! আমি পালাব কেন? আমি খুন করিনি তো!
—আমি জানি! কিন্তু একবার পুলিশের খপ্পরে গেলে তোর ওপর একটার পর একটা কেস দেবে। দোকানে হামলা চালানো, আড়তে লুঠপাট, মারামারি, খুন! তুই বেরুতেই পারবি না। তোর অনেক শক্তি! তোর সামনে অনেক কাজ! এভাবে নষ্ট করবি?
—পালিয়ে কী করব আমি?
—এখানে থাকলে তুই হয় খুন হয়ে যাবি, নয়তো জেলে পচবি। তুই বুঝতে পারছিস না কেন, তোকে সরাতে পারলে অনেকের লাভ! পালাতে হবেই তোকে। দূরে গিয়ে সময় নে। আত্মগোপন করে ধীরে ধীরে নিজেকে তৈরি কর।
—রাসুদা! দাদু অসুস্থ! যে কোনওদিন…
তার স্বর কেঁপে গিয়েছিল। কণ্ঠ কামড়ে ধরেছিল কঠিন যন্ত্রণা!
রাসুদা বলেছিলেন—সিধু! রাজনৈতিক মানুষের কোনও ব্যক্তিজীবন নেই! দাদুর অসুস্থতা দুঃখজনক। কিন্তু অনিবার্য। আমি ছাড়ছি। সময় নেই রে! ভাল থাকিস। আমাকে ভুল বুঝিস না!
সাবিত্রী বসেছিলেন বোধিসত্ত্বের পায়ের কাছে। বোধিসত্ত্ব বললেন – সাবিত্রী! আলমারি খোলো! দেখো একটা নীল ব্যাগ আছে। দাও।
আলমারি খুলে নীল ব্যাগ এনে দিলেন সাবিত্রী। বোধিসত্ত্ব সেই ব্যাগ সিদ্ধার্থর হাতে দিয়ে বললেন—রাখো!
সিদ্ধার্থ জিগ্যেস করল— কী? দাদু?
—কিছু টাকা আছে। সামান্যই। আর ব্যাঙ্কের বই। দরকার মতো তুলে নেবে। সব তোমার-আমার নামে আছে।
—দাদু! কী বলছ!
—বেরিয়ে পড়ো দাদুভাই! বেরিয়ে পড়ো! আমার কথা ভেবো না।
—অসম্ভব!
—আমি থাকব দাদুভাই! তোমার কাছে-কাছে। তুমি চাইলেই আমাকে দেখতে পাবে।
সাবিত্রী ফুঁপিয়ে উঠলেন। সিদ্ধার্থ বোধিসত্ত্বের হাত চেপে ধরল। মির্জা বলল— উনি ঠিকই বলেছেন। সিধুভাই। এখুনি তোমাকে এই জায়গা ছাড়তে হবে। তুমি কোথায় যেতে চাও বলো!
সিদ্ধার্থ দাঁতে দাঁত চাপছে। স্থির হওয়ার চেষ্টা করছে সে! শান্ত হওয়ার চেষ্টা করছে। সে বুঝতে পারছে, পালানো ছাড়া তার উপায় নেই! একটি সুন্দর দেশ, এক সমৃদ্ধ স্বয়ংসম্পূর্ণ ভারতবর্ষ গড়ার স্বপ্ন নইলে অধুরা থেকে যাবে। পচে মরবে জেলে। খুন হয়ে যাবে।
চোখ বন্ধ করল সে। তার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে! বোধিসত্ত্বের জন্য গঙ্গারই মতো আগ্রাসী হয়ে উঠছে যন্ত্রণা তার। সে চোখ বন্ধ রেখে এই বিশাল বিপুল পৃথিবীতে খুঁজছে আপনার নিরাপদ স্থান! সেই বন্ধ চোখের পাতায় একের পর এক ভেসে উঠছে গ্রাম—সরাল, তেকোনা, পেতনির চর, গোমুণ্ডি, বাঘান, ধুলামাটি, ধুলামাটির বিকলাঙ্গ মানুষগুলি, রেজাউলের মৃত সন্তান, আধা-সৎ আধা-অসৎ বাঁচা অগণিত মানুষের অশেষ মিছিল! সেই মিছিলের শেষ মানুষ, এখন, মুস্তাকিম। মৃত সন্তানকে বুকে নিয়ে সিদ্ধার্থ যার অভিন্নহৃদয় বান্ধব!
মির্জা কাঁধে হাত রাখছে তার। বলছে—দাদুর জন্য আমরা রইলাম। ভেবো না সিধুভাই।
সিদ্ধার্থ তাকাচ্ছে মির্জার দিকে। বলছে—ধুলামাটি গ্রাম। ওখানেই আপাতত
—বেশ।
.
বোধিসত্ত্বর পাশে বসল সিদ্ধার্থ। বোধিসত্ত্ব হাসলেন। শান্ত, মধুর হাসি। শুধু তাঁর চোখের জ্যোতি ঠিকরে উঠল। তিনি বললেন—অনেক বড় হবে তুমি। তোমার জন্য প্রতীক্ষা করে আছে দেশ। জাতি। সমস্ত ভারতের মন-প্রাণ-হৃদি-আত্মা! ঈশ্বর এই ছোট শহর থেকে তোমাকে বের করে নেবার জন্য এই ছলনা করলেন।
— দাদু!
—সিরাজদ্দৌলা! সিরাজদ্দৌলা!
—দাদু!
—সকলেই তাঁকে ছেড়ে গিয়েছিল। রায়দুর্লভ, ইয়ার লুফ খাঁ, মীরজাফর দাঁড়িয়ে আছে পুতুলের মতো। ওই দেখা যাচ্ছে পলাশি গ্রাম! মীরজাফরের কুষ্ঠ হয়েছিল! মিরণ বজ্রাঘাতে মারা গিয়েছিল! স্ক্রাফটন মরেছিল জাহাজডুবি হয়ে। ওয়াটসের অসম্মান হয়েছিল কোম্পানির হাতেই। আর ক্লাইভ, রবার্ট ক্লাইভ, কোম্পানির একান্ত আস্থাভাজন, বাংলার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, মারা গেলেন, আত্মহত্যা করলেন গলায় ক্ষুর চালিয়ে। ক্ষমা নেই। কারও ক্ষমা নেই। তোমাকে যারা সপ্তরথে আক্রমণ করেছে তাদের অভিশাপ লেগে যাবে। গঙ্গা! গঙ্গার শাপ!
ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে সিদ্ধার্থর চোখ থেকে। জলে ভরে উঠছে বোধিসত্ত্বের দু’চোখের কোল। তিনি বলছেন—এসো! কখন কী হয়ে যায়! তোমার পাশে এখন কোনও পার্টি নেই। কিন্তু তুমি জয়যুক্ত হবে। হবেই। আমি বলছি, মনে রেখো।
— দাদু! ও দাদু!
সিদ্ধার্থ বোধিসত্ত্বের বুকে মুখ ঘষে। শিশুবেলাকার মতো অশ্রু নিঃসরণে বুক ভিজিয়ে দেয়। বোধিসত্ত্ব মাথায় হাত রাখেন। বলেন—এসো! এ মায়ার তল নেই! এ এমনি করেই টানে!
সে উঠে দাঁড়ায়। কী মনে হয় তার, সাবিত্রীকে প্রণাম করে। সাবিত্রী ডুকরে কাঁদেন আবার। বলেন—আর জন্মে আমার ছেলে ছিলে তুমি। তোমার সব রইল। ফিরে এসো।
সে ম্লান হাসে। দাদুর চোখে চোখ রাখে একবার। তারপর বেরিয়ে যায়। পিছু ফিরে তাকায় না আর। মির্জার গাড়িতে ওঠে। বীরা আর সফি তাকে ঘিরে রাখে। তাদের হাতে উদ্যত অস্ত্র। কেউ এলে তারা লড়ে যাবে। মির্জা জানালার কাচ তুলে দেয়। সে বলে – মোল্লাগেড়ের বস্তিতে চলো আগে।
মির্জা বলে—কেন?
—তৌফিককে নিতে হবে। আমাকে না পেলে ওকে খুন করে ফেলবে সব।
পথে যেতে যেতে মির্জা বলে-তোমার সঙ্গে দেখা করবে একজন।
—কে?
—নীলমাধব। গণসংঘ পার্টির নেতা।
সিদ্ধার্থর ভ্রূ কুঁচকে গেল। সে বলল— তুমি তাকে চেনো?
মির্জা বলল—চিনেছি। আট-নয় মাস হল।
—কী করে?
—তুমি তো জানো আমার ব্যবসা।
—ওই জিনিস অত আর কে নেয়! ডাকাত গুণ্ডারা হল খুচরো ক্রেতা। বড় বড় কেনে ওরাই। ওদের মতো দল।
সিদ্ধার্থ অন্যমনস্ক হয়ে গেল। নীলমাধব তার সঙ্গে দেখা করবে। সে সম্মুখে দেখতে পাচ্ছে অন্য দিগন্ত এক। অচেনা। অনচ্ছ।
সে বলল—আগে তো বলোনি?
—বলতাম। আজ-কাল। তুমি দল ছাড়ার পর থেকেই ওরা চাইছিল।
—সিধুভাই!
—বলো।
—নীলমাধব লোক খাঁটি। তুমি আমাকে বিশ্বাস করো তো?
—করি।
মির্জা একটি ঠান্ডা ধাতব বস্তু গুঁজে দিল তার হাতে। সে কোনও কথা বলল না। নীল ব্যাগ খুলে চালান করে দিল। মির্জার হাত হাতে নিয়ে বলল— সাবধানে থেকো। তেকোনা গ্রামে আছেন দুলু বাউল। বৈরাগী ঠাকুর। তিনি যোগাযোগ রাখতে পারবেন। আর বসির খান রইল। দেখো তাদের। সবাইকে দেখো। নিজের খেয়াল রেখো। মির্জা, জেনো, তোমার এ সিধুভাই তোমার ওপর নির্ভর করে।
মির্জা সিদ্ধার্থকে আলিঙ্গন করল। বলল—আমি আছি। থাকব। তোমাকে আমরা চাই।