রাজপাট – ১১৪

১১৪ 

শাউন মাসে ফতেমা গো 
জ্বরে কম্পমান। 
আসমানে বিজুলিবালা 
নদীতে সাম্পান। 
সাম্পান ভাসিল জলে 
কূল হারায়ে ফিরে। 
বানের জলে ভাইসা আইছে
ঠারাইব কুন তীরে।।

.

জল জল জল। যতদূর চোখ যায় জল জলই শুধু। একতলা ডোবানো জল। জলই কেবল। নৌকা নিয়ে যেতে যেতে তার মনে হচ্ছিল সে অপার অকুল সমুদ্রে ভেসে গেছে। 

বন্যা সে দেখেছে আগেও। ত্রাণের সামগ্রী নিয়ে গিয়েছে গ্রামে গ্রামে। নিয়ে গেছে চিকিৎসা পরিষেবার দল। কিন্তু এভাবে, সরাসরি উদ্ধারকার্যে নেমে পড়া এই তার প্রথম। 

সে জানে না, কেমন আছে তেকোনা, সরাল, গোমুণ্ডি, বাঘান। কেমন আছে ধুলামাটি গ্রাম। জানে না সে। আরও কত গ্রাম, চেনা লোক কত, কেমন আছে তারা, তাদের ভাবনায় তার হৃদয় উতলা হতে চায়। তবু সে রয়েছে লক্ষ্যে অবিচল। কর্তব্যে স্থির। গোটা জেলা ঘুরে কাজ করা এ মুহূর্তে সম্ভব নয় তার পক্ষে। আগেকার লোকবল কোথায়? যারা তাকে ঘিরে থাকত, তাদের অনেকেই দেখলে মুখ ফিরিয়ে নেয়। শত্রুতা এবং মিত্রতার সহজ শর্ত মানুষের মন ঘিরে আছে। অধিকাংশ সম্পর্কই ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সংযোগ নয়। বন্ধন হয়ে থাকে শিবির। এক প্রতীকের বাহক হিসেবে তারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এতকাল কাজ করেছে। যে শিবির ত্যাগ করে, প্রতীক নামিয়ে রাখে, সে এক অজানা বিপজ্জনক মানুষ। এ-ও এক বীক্ষা। এ-ও এক অভিজ্ঞতা জীবনের। এবং এ-ও এক প্রাপ্তি যে এ সব সত্ত্বেও আজও তার পাশে আছে অনেক মানুষ। সেই নিয়েই তার ধর্মাচরণ! যতটুকু সে পারে, তারই মধ্যে একনিষ্ঠ নিবিড় কর্তব্যপরায়ণ হতে হবে তাকে। আপাতত জলে-ডোবা চতুষ্কোনা, পেতনির চর, পঞ্চগ্রাম হতে লোকের উদ্ধার কাজ। এরপর যেতে হবে দূরে। বন্যায় ভেসে যাওয়া মানুষের কাছে যেতে হবে তাকে। 

ইতিমধ্যে ত্রাণকাজের জন্য সে সংগঠিত করেছে ইচ্ছুক যুবকদের। সকলেই আছে একযোগে। কেউ প্রাণ দিয়ে করে, কেউ করে না। এমন দুর্যোগেও আছে দলাদলি। আছে ভবিষ্যতের সূক্ষ্ম প্রস্তাবের মতো স্বার্থ নকশা। 

সে মানেনি এসব। গ্রহণ করেনি। তেমনই অপেক্ষা করেনি সরকারি ত্রাণ-পরিকাঠামোর জন্য। ত্রাণকর্মে যোগ দিতে যারা চেয়েছিল, তাদের নিয়ে নৌকা সংগ্রহ করে সে চলে এসেছে এতদূর। ট্রাকে নৌকা নিয়ে সড়কপথে যতদূর আসা যায় সে এসেছে। তারপর নৌকা নামিয়ে জলে ভাসান দিয়েছে। 

চারখানি নৌকা নিয়ে এসেছে তারা। যথেষ্ট নয়। সে জানে। কিন্তু এর চেয়ে বড় আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। তবে ভরসা আছে। আরও কিছু উদ্ধারকারী দল এসে যাচ্ছে পরপর। বন্যায় ডুবে গিয়েছে চতুষ্কোনা, পেতনির চর, পঞ্চগ্রাম—খবর পেয়েও প্রথম তিনদিন কিছুই তারা করতে পারেনি। কারণ বহরমপুর শহরেও জল জমেছিল বিস্তর। সেই জল যে সম্পূর্ণ নিষ্কাশিত হয়েছে, তা বলা যাবে না। কিন্তু আঘাত সইয়ে নিতে মানুষের যা সময় লাগে, তা গ্রহণ করা ছাড়া তার গত্যন্তর ছিল না। 

চতুষ্কোনা বা পেতনির চরের মানুষ ছিল বন্যায় আত্মরক্ষা করতে অভ্যস্ত। গ্রাম ও চরা জলে ডুবে গেলে তারা প্লাস্টিকের অস্থায়ী ছাউনিতে বসবাস করেছে উঁচু সড়কের আস্তানায়। কিন্তু এবার বন্যা এসেছিল অতর্কিতে। 

বন্যার সম্ভাবনাকে তারা মেনে নিয়েছিল, কেননা অনর্গল বারিপাতে উপচে উঠেছিল ভাগীরথী। তৎকালে তারা দেখতে পায় মা গঙ্গার ক্রোধকুটিল ভ্রূ, বক্র দৃষ্টিপাত এবং সৰ্পিনী চুলের বিভঙ্গ সহস্রে। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে কেউ কেউ বাজিয়েছিল শঙ্খ, গঙ্গার ক্রোধশম প্রার্থনায় এবং পূজা অঙ্গীকার করেছিল যাতে ভাসানিয়া রূপের আঘাত না পেতে হয়! 

তখন ক’দিন, থেমে গেল বারিপাত, যদিও মেঘ নড়ল না। লোকে জিনিসপত্র বাঁধা-ছাদা করেও, অস্থায়ী আস্তানার দিকে যাবে ভাবলেও গেল না শেষ অবধি এবং একথাও ঠিক যে, দ্রুত গড়ে উঠতে থাকা বোল্ডারের বাঁধ তাদের মনে ভরসা জাগিয়েছিল। 

বরং পেতনির চর হতে কেউ কেউ নিয়েছিল অগ্রিম সতর্কতা। চতুষ্কোনা সংলগ্ন সড়কের ওপর তারা ছাউনি তুলেছিল। সেইসব ভেসে গেছে এইবার। ভেসে গেছে, কারণ এই বন্যা শুধুমাত্র ভাগীরথীর উপচানো জল নয়, গঙ্গার উচ্ছ্বসিত জলই নয় শুধু। তিলপাড়া ও ম্যাসাঞ্জোর জলাধার থেকে ছাড়া হয়েছিল লক্ষ লক্ষ কিউসেক জল আর সেই সমস্ত ভাগীরথীর আত্মস্ফীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে ভাসিয়েছিল দু’কূল। বিশেষত পূর্বদিকে ধেয়ে যাওয়া দু’কূলপ্লাবী জল ভেঙেছে বাড়ি, স্কুল, আমবাগান, রেলপথ, সড়কপথ। ভাসিয়েছে মাঠ, ক্ষেত, মানুষ ও পশুপাখি। 

এখন, নৌকায় ভেসে যেতে যেতে তারা দেখছে এখানে-ওখানে আটকে থাকা মৃত পশুদেহ। দুর্গন্ধে ছেয়ে গেছে দিক ও দিগন্ত। তারা পরোয়াও করছে না। তারা মানুষ খুঁজছে, বিপন্ন মানুষ।

তাদের অনুসরণ করে ক্রমাগত এসে যাচ্ছে আরও আরও নৌকা সব। আসছে রেডক্রসের নৌকা, আসছে এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, ভারত সেবাশ্রম সংঘ, রামকৃষ্ণ মিশন। 

দুর্গত মানুষের তরে, বানভাসি মানুষের উদ্ধারকর্মে বহুজন আত্মনিয়োগ করে জলে ভেসেছেন। বারিপাত থেমে নেই। দুর্যোগ এখনও সমান। উদ্ধারের কাজে যাঁরা এসেছেন, তাঁদেরও জীবন দুটি হাতের মুঠোয়। 

তবু মানুষ দাঁড়ায় মানুষের তরে। তারা পরস্পরকে হত্যা করে, প্রবঞ্চিত করে, যন্ত্রণা দেয়— তবুও দাঁড়ায়। বিপন্নতার পাশে দাঁড়ায় আবেগপ্রবণ হাত। কিন্তু সে কতদিন? কতদিনের এ ত্যাগ? কর্তব্য পরিস্থিতি প্রলম্বিত হলে, আবার ঘনিয়ে আসে স্বার্থ, লোভ, বঞ্চনা, ঈর্ষা ও অকরুণ নির্দয়া। 

জেলাশাসক এখনও বড় দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছেন। উদ্ধারের কর্মে সেনা নামানোর মতো পরিস্থিতি কি হয়েছে? তবে ইতিমধ্যে, তিনি নির্দ্বিধ ঘোষণা করেছেন—প্রাকৃতিক সঙ্কটের সুযোগে কোনও অসাধু ব্যবসায়ী দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

কেউ গাছে আশ্রয় নিয়েছে। কেউ সামান্য জেগে থাকা টিনের চালায়। তারা একে একে তুলে নিচ্ছে লোক। সিদ্ধার্থ নির্দেশ দিয়েছিল, তার পরিচালনার চারখানি নৌকা যেন কাছাকাছি থাকে। যাতে, এই দুর্যোগে, উদ্ধারকারী নৌকা বিপন্ন হলে অন্যরা সাহায্য-সহায়তা দিতে পারে। 

ইতিমধ্যে তাদের নৌকাগুলিতে লোক হয়েছে বেশ। একজন, গাছে আশ্রয় নিয়েছিল। তাকে নামানো মাত্র অজ্ঞান হয়ে গেছে। তার সকল শক্তি দিয়ে সে আশ্রয় করেছিল যে-শাখা, তাতেই জড়িয়ে ছিল কালসর্প একজন। এই তিনদিন তিনরাত্রির প্রতিটি মুহূর্ত সে ঠায় চেয়েছিল সাপটির দিকে। লক্ষ করেছিল তার গতিবিধি। এমনকী একসময় তার মনে হয়েছিল, ঝাঁপ দেয় জলে! কিন্তু এই মহাপ্লাবনে কালসর্পও বুঝি কুটিলতা ভুলেছিল। হিংসা হারিয়েছিল। ইচ্ছা হয়নি তার নিজেরই মতো আর্ত ও বিপন্নকে দংশন করবার। 

বড় বড় নৌকাগুলি ঘুরে ঘুরে চলে যাচ্ছে পেতনির চরের দিকে। আর আলাদা করে চেনা যায় না নদী। তবু নদীখাতে উদ্দাম ভয়াবহতা। শ্রাবণের দু’কূল ভাসানো এই নদী পারাপারে সিদ্ধার্থর শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আছে। ভরসা একটাই, উপচানো জল ছড়িয়ে যাওয়ায় নদী কিছু স্থৈর্যশীল। বৃষ্টি থেকে গেলেও, উথালি হাওয়ার দাপট থেমেছে। ঢেউ নেই তাই। থেমেছে বজ্ৰ- বিদ্যুতের কড়া শাসানি-তর্জানি। আকাশের দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে জমাট মেঘের স্তরে ধরেছে ফাটল। বোঝা যাচ্ছে, গুরুভার লাঘব হয়েছে তার। 

তবুও, বড় বিপন্নতায় তারা চলে যাচ্ছে পেতনির চরের দিকে। দক্ষ মাঝি তারা, ভরসাও দিয়ে চলেছে—ভয় নাই। আর ভয় নাই। 

ডুবে যাওয়া চরা হতে ভেসে আসছে আর্ত চিৎকার। জলের দাপটে, চরার ভরসাস্থল হকসেদ মণ্ডলের বাড়ি ধসে গেছে। উৎকণ্ঠায় ছেয়ে গেছে সিদ্ধার্থর বুক। সকল বিপন্নের জন্য তার সীমাহীন সহৃদয়তা। তবু মানুষ বিশেষের জন্য বিশেষ করে ভাবে। ভেবে ফেলে। সেই তার স্বভাব। সিদ্ধার্থ ভাবছে—রেজাউল কেমন আছে! ওর পরিবার কেমন আছে! আর নারান মুদি তারা? ভাল আছে তো? আছে তো? 

এই জলে সে ঠাহর করতে চাইছে হকসেদ মণ্ডলের গৃহ। পথে যেতে যেতে, লোক তুলতে তুলতে, তারা আটকে যাচ্ছে উঁচু হয়ে জেগে থাকা এক ঘরের চালে। সে-চালের ওপর ঝুঁকে পড়েছে ঝাঁকড়া কাঁঠালগাছ। সে দেখতে পাচ্ছে, ঘরের উঁচু চাল হতে হাত নাড়ছে লোক! কত লোক! এমনকী গাছের ডালে ডালে লোক বসে আছে পাখ-পাখালির মতো। লোকগুলি হাত তুলছে। চিৎকার করছে। তাদের বাঁচার আকুতি বিদ্ধ করছে কান, বিদ্ধ করছে হৃদয়। সিদ্ধার্থ সে, তার ভয় করছে, এতগুলি লোক উঠেছে চালে, ভেঙে না পড়ে যায়! নৌকায় উদ্ধারের জনতা, তারাও অপর উদ্ধারের তরে উন্মুখ এখন। সকলেই বলছে—ওই দিকে! ওই দিকে! 

চারটি নৌকায় লোক তোলা হচ্ছে যখন, সিদ্ধার্থ অনুমান করে, এরা আশ্রয়ের তরে এসেছিল হকসেদ মণ্ডলের বাড়ি, সে বাড়িও ধ্বসে পড়ে গেছে, সে খুঁজতে থাকল রেজাউলকে। রেজাউল! রেজাউল! সে দেখতে পেল রওশনকে। রেজাউলের বিবি রওশন। তার শাশুড়ি, হকসেদ মণ্ডলের বিবি, তাকে বুকে জড়িয়ে আছে। ত্রাস ও বেদনার গাঢ় আঁকিবুকি ভরা মুখ। সে খুঁজছে, রেজাউল! রেজাউল! তখন হকসেদ মণ্ডল দেখালেন ওপরের দিকে। নারানমুদির গোটা পরিবার, দেখল তারাও। ওই সে। ওই ওই ওই! কোথায়? কোথায়? 

গবাদি পশুর শবের গন্ধ হতে মুখ ঘুরিয়ে, মন ফিরিয়ে সিদ্ধার্থ তাকাল। ঝাঁকড়া ঝুপসি কাঁঠালগাছটির উপরের দিকের এক ডালে রেজাউল বসে আছে মুহ্যমান। দুই কোলে দুটি সন্তান। তবু বাহ্যজ্ঞান নেই। 

সিদ্ধার্থ ডাকছে—রেজাউল! নেমে আয় 

তার মনে পড়ছে, হকসেদ মণ্ডল বলেছিলেন, রেজাউল ছোটবেলায় কোনও কুকর্ম করলেই মারের ভয়ে চলে যেত ওই গাছটার মগডালে। কিংবা কোনও বায়না করে পেত না যখন, তার প্রগাঢ় বিষণ্ণতা এবং দুঃখাতিপাতের মুহূর্তও সে যাপন করত ওই গাছের পাতাদের নিবিড় ঘন সান্নিধ্যরেখায়। 

সিদ্ধার্থ ডাকছে। রেজাউল আসছে না। হকসেদ মণ্ডল ডাকছেন। আসছে না রেজাউল। ডাকছে সকল লোক—আয়রে, নেমে আয়রে, আয়। 

সিদ্ধার্থর সন্দেহ জাগছে। বিপুল সন্দেহ। সে হকসেদ মণ্ডলকে বলছে—কী হয়েছে? কী হয়েছে ওর? 

হকসেদ মণ্ডলের মুখ বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। অসহ্য যন্ত্রণা দলা পাকিয়ে ওঠা—তাকে ঠেলে, এই পরিস্থিতি সামাল দেবার শক্তি অর্জনের জন্য তিনি দুই হাতে মুঠো পাকাচ্ছেন। 

সিদ্ধার্থ বলছে—তৌফিক, আমি গাছে উঠছি। 

তৌফিক চিৎকার করছে—না না! গাছ ভেজা! সিধুদা তোমার অভ্যাস নেই। 

সফি বলছে—আপনার কিছু হয়ে গেলে, সিধুদা, মির্জাভাইয়ের কাছে মুখ দেখাতে পারব না আমি। আপনি যাবেন না। আমি উঠছি। 

সিদ্ধার্থ দৃঢ় চোখে তাকাচ্ছে। দৃঢ়স্বরে কথা বলছে। তার সহজ, সুমিত ব্যক্তিত্বের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসেছে এক ঋজু ও দুর্ভেদী সত্তা। সে বলছে—না। সফি। রেজাউলের কাছে আমার যাবার দরকার আছে। 

সে গাছের ডাল ধরেছে। চূড়ান্ত মনোনিবেশে পা রাখছে প্রশাখায়। নাড়ু তারু বলছে- আমরা আসব সিধুদা! 

—আয়! 

তিনজনে উঠছে তারা। উঠছে। নীচে সতর্ক দাঁড়িয়ে আছে সফি, তৌফিক। পেছল ডালে হাত রেখে, পা রেখে ওঠা সহজ কাজ নয়। ভেজা শরীরে সাড় কমছে। সিদ্ধার্থ বুক ঘষটে উঠছে। গাছে ওঠার স্মৃতি আছে তার। সে তো সকলই আরোহণ করত। বাগানের যত গাছ। সহসা কনককে মনে পড়ছে তার। কনক, কনক! সে দেখছে—ডুবে যাচ্ছে কনক! 

দাঁতে দাঁত চেপে সে এসে গেছে রেজাউলের নাগালে—নাড়ু তারু তার নীচের ডালেই অপেক্ষমাণ। সে ডাকছে—চল, রেজাউল। দেরি হয়ে যাচ্ছে। লোকে অসুস্থ। 

রেজাউল তাকাচ্ছে তার দিকে। শূন্য সে দৃষ্টি। বোবা। সিদ্ধার্থর বুক মুচড়ে উঠছে। সে বলছে—চল রেজাউল! বাচ্চাগুলো অসুস্থ হয়ে পড়েছে। 

রেজাউল বলছে—সিধু! একটু মাটি দিবি হ্যাঁ? একটু মাটি পাব না? 

—মাটি? 

—সব মাটি জলের তলায় সিধু? সব মাটি? 

সিদ্ধার্থ হাত বাড়াচ্ছে। বলছে—দে ওদের! 

রেজাউল দিয়ে দিচ্ছে। প্রিয় বন্ধুর হাতে তুলে দিচ্ছে সন্তান। ঠান্ডা, শক্ত, মৃত। 

সিদ্ধার্থ টলে যাচ্ছে। এ কী! এ কী! দাঁতে ঠোঁট চেপে আছে সে। শিশুগুলির মাথার পেছনে রক্ত চাপ চাপ। দেহ পুষ্ট নয়। ফোলা। পচন ধরেছে। নাড়ু চিৎকার করছে—সিধুদা সামলে! 

সে দুই ভাইয়ের হাতে তুলে দিচ্ছে শিশু। তারা নেমে যাচ্ছে। সিদ্ধার্থ ডাকছে— আয় রেজাউল। আসবি না? 

কান্না চাপতে পারছে না সে। তার চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। সে ডাকছে—আয় রেজাউল!

রেজাউল নেমে আসছে। বলছে—একটু মাটি দিবি তো? কবর দিতে পারব না ওদের সিধু?

সিদ্ধার্থ বিকৃত গলায় বলছে—পারবি, চল রেজাউল। 

কাঁদছে চার নৌকা ভর্তি লোক। কাঁদছে। সিদ্ধার্থ দেখছে আরও সব উদ্ধারের নৌকা দুরে দূরে। সে বলছে—ফিরে চলো। 

ফিরে যাচ্ছে তারা। কাঁদতে কাঁদতে ফিরে যাচ্ছে। কত না শোকের চাপে রোরুদ্যমান অসহায় অস্থায়ী জীবন। এ শোকও বন্যাস্বরূপিণী। কূল নেই, কিনারা নেই। শুশ্রূষা নেই, নেই নিরাময়। বেঁচে থাকা সম্বল করে আবার নতুন করে শুরু! জীবনকে যন্ত্রণা মনে হয়। 

কিন্তু এ জীবন, বড় বিচিত্র সে। শোকেরও সময় সে দেয় না অধিক। সূক্ষ্ম মিহি জালে সে জড়িয়ে ফেলে অন্যতর জটিল আবর্তনে। মায়া, মায়া তার নাম। 

এখন, এ শোকার্ত নৌবহর, তারা শুনতে পেল অনাদি চিৎকার! এর অর্থ জানে সকলেই। অতএব স্ত্রীকণ্ঠের এ চিৎকার লক্ষ করে তারা ধাবমান হয়। দেখতে পায়, একটি আমডাল হতে কোনও ক্রমে ঝুলে আছে গর্ভবতী নারী। চিৎকার করছে সে। চিৎকার করছে তার প্রসববেদনা। তার পুরুষ তাকে সবলে জড়িয়ে আছে প্রেতলোক হতে আসা আত্মীয়ের মতো। 

সিদ্ধার্থর দল সযত্নে নামিয়ে আনল সে নারী ও পুরুষ! নৌকার পাটাতনে জায়গা করে দিল। নারীটির যোনি তখন ব্রহ্মাণ্ডবৎ। বিশাল বিপুল ব্যাপ্তিতে সে এনে দিচ্ছে ভবিষ্য পৃথিবী! তার যন্ত্রণা কম নয়। সৃষ্টির অসহ্য কষ্ট আছড়ে মারছে তাকে। 

সিদ্ধার্থ দেখছে, তৎপর হয়ে উঠেছে শোকার্ত রেজাউল। এক নতুন জন্মদানকে স্বাগত জানাচ্ছে সে। তার মা হাত পেতে দিল ওই যোনিতটে। আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করে দিল রক্তাক্ত শিশুর নাড়িছেঁড়া বিজয়-সন্তাষ! 

সিদ্ধার্থ নিষ্ক্রিয় দাঁড়িয়ে দেখছে এ জগতের অপূর্ব মহিমা! রেজাউলকে দেখছে সে! এ জন্মদান হতে পারে আশীর্বাদের মতো! বিমূঢ় স্বামীটির পাশে সে ব্যস্ত হয়ে আছে, আর্ত জিগ্যেস করছে—মা! মা! নাড়ি কাটবে কী দিয়ে মাগো! মা! 

মা তাকে ধমকে দিচ্ছেন। 

—চুপ যা। এখন নাড়ি কাটলে ছোঁয়াছুঁয়ি হবে। ঘা হবে। এভাবেই থাকুক। ভরা মাসের বাচ্চা। মায়ের নাড়ির বন্ধনে তার উপকারই হবে। 

তিনি তাকাচ্ছেন সিদ্ধার্থর দিকে। বলছেন—বাবা! তাড়াতাড়ি হাসপাতাল চলো! 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *