রাজপাট – ১১৩

১১৩ 

শাউন মাসে ভরা নদী
উপুর-ছুপুর জলে।
ত্যানা কানি পরিয়া লুকে 
হারা উদ্দেশে চলে।।
শাউনে ভাইস্যাছে দ্যাশ 
ডুবাডুবি ঘর। 
সকলই খাইছ শাউন
কী রহিল মোর ॥ 

.

বৃষ্টির জলে টইটম্বুর নদী। হঠাৎই আলাদা করে ঠাহর হয় না এমনই জলময় ক্ষেত-খামার। ভয়ঙ্করের সম্ভাবনা বুকে করে হাঁটুজলে কোমরজলে ডুবে তবু দৈনন্দিন কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিল তারা। নানারকম খবর নিত্য ভেসে আসছে। কোথা থেকে আসছে, কেউ জানে না। হতে পারে হরিহরপাড়া হতে মোহনবাবুই এইসব খবর সংগ্রহ করছে। গত দু’দিন হল সেও আর পথঘাটের জলকাদা ভেঙে হরিহরপাড়া যেতে পারছে না। ঘরে বন্দি হয়ে আছে। সীমান্তে ঘুরে ফিরে যারা জীবিকার্জন করে, তারাও গৃহান্তরীণ হয়ে আছে বিরস মুখ করে। 

খবর তবুও আসে। এসে যায়। ললিতাকুড়ির বাঁধে ফাটল ধরেছে। বিপদসীমা অতিক্রম করেছে গঙ্গার জল। একেবারে ভরে গেছে ময়ূরাক্ষী সমেত সমস্ত নদ-নদী। জলাধারগুলির জল আর ধরে রাখা যাচ্ছে না। 

জলাধারের জল আর ধরে রাখা যাচ্ছে না, এর চেয়ে বেশি বিপদজড়ানো খবর আর কিছু হতে পারে না। সম্পূর্ণ বিরামহীন এ বর্ষা ঘন কালো হয়ে ছেয়ে আছে চারপাশ। আকাশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে ঘোর লেগে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে চূড়ান্ত ধ্বংসের দিন বুঝি এল। সব ভেসে যাবে। সব ডুবে যাবে। এ ধরণী পুরোপুরি চলে যাবে জলের তলায়। 

চাপা গোঙানির মতো গুমগুমে শব্দ সেই এল আগ দুপুরের বেলা। লোকে ইতস্তত ছড়ানো ছেটানো। সামান্য ঢিলেঢালা। স্যাঁতসেঁতে মাটিতে ভেজা উনুন ফুঁইয়ে ফুঁইয়ে চলেছে ভাত রাঁধবার পালা। দুর্যোগ যতই আসুক, আহারের ব্যবস্থা না করলে চলে না। 

এবং ভাতের প্রতি মনোযোগ থাকায়, জলবৃদ্ধির সূক্ষ্ম তফাতে কারও দৃকপাত নেই। কেন না ঘন মেঘ ঠেলে এসে যাওয়া আলো তবু কিছু ভরসা জাগায়। 

ভাত রাঁধছিলেন সেনবাড়ির বড় বউ যুধিষ্ঠির সেনের স্ত্রী। গুমগুম চাপা শব্দে উৎকর্ণ হলেন তিনি! তাঁদের পাকঘরের পিঠ ঘেঁষে বয়ে যাচ্ছে ভৈরব বহুদিন হল! ভাঙতে ভাঙতে এতদূর গড়িয়েছে। কতবার হল এমন? কতবার সেনবাড়ি চলে গেল ভৈরবের পেটে? 

তিনি ভাতের হাতা সমেত দাঁড়ালেন। আতঙ্কে সাদা হল তাঁর মুখ। কেন না, মনে হচ্ছে তাঁর, পায়ের নীচে মেঝে কাঁপছে। তিনি কাঁপা গলায় ডাকলেন—মেজ! 

মেজবউ বাসন-কোসন ধুচ্ছিলেন পাকঘরের দাওয়ায়। তিনি উঠে এলেন—কী দিদি?

বড়বউ বললেন—শোন! 

দু’জনে কান পাতলেন। শোনা যায়, শোনা যায় গুম গুম ধ্বনি! আর তা যেন বড় হচ্ছে, বড় হচ্ছে, বাড়ছে, বাড়ছে, এ কী, এ কী, রান্নাঘরের দেওয়াল ফাটিয়ে ঢুকে আসছে জল। ঢুকে আসছে! মেজ চিৎকার করছেন— দিদি পালাও। 

দুই বধূ জড়াজড়ি পালাচ্ছেন। আর্ত চিৎকার করছেন—বাঁচাও! বাঁচাও! 

হুড়মুড় খসে পড়ছে রান্নাঘর, ভাতের হাঁড়ি ও যাবতীয় রন্ধনাদি সমেত। সেনভাইরা এসে দাঁড়িয়েছেন দাওয়ায়। বিমূঢ়। অসহায়! এই ছিল রান্নাঘর! এই নেই! সেখানে আবর্তিত হয়ে চলেছে জল। ঘোলা জল। ভৈরবের জটার মতো পাক খেয়ে খেয়ে ঢুকে আসছে ক্রমশ। আঙিনায় জল বেড়ে উঠছে! কতক্ষণ! আর কতক্ষণ! 

সহসা তৎপর হলেন যুধিষ্ঠির সেন। জলের এ গতি-প্রকৃতি ভাল ঠেকছে না! ওই বৃষ্টির তলে ওই ঘূর্ণি জলের, ওই আগ্রাসন, গুমগুম ধ্বনি ও ক্রমশ বৃহদাকার হয়ে ওঠা—এসব ভাল নয়! লক্ষণ ভাল নয়! 

তখন ধ্বনি উঠেছে বাইরেও। বাঁচাও বাঁচাও, পালাও পালাও, জল বাড়ছে, জল বাড়ছে।

যুধিষ্ঠির সেন বললেন—বড় বউ তোমাদের গয়নাগাটি টাকাপয়সা যা আছে, তাড়াতাড়ি বেঁধে নাও। ভীম, অর্জুন, মাকে তোল। ও বাড়ি যেতে হবে। এ যা দেখছি, কিছুক্ষণের মধ্যেই জল ঢুকবে ঘরে! 

সময় নেই! সময় নেই! সাধারণ লোকের কোমর অবধি উঠে এসেছে জল। একতলা বাড়িগুলিতে ঢুকছে। 

কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরিয়ে এলেন সেন পরিবার। বউদের আর ছেলেমেয়েগুলির হাতে পোঁটলা। তিন ছেলে চাদরে ঝুলিয়ে নিয়ে চলেছেন তাঁদের মাকে। যতখানি সম্ভব উঁচু করে ধরেছেন তাঁরা চাদরের প্রান্ত। তবু জল চলকে ভিজিয়ে দিচ্ছে অথর্ব বৃদ্ধাকে। 

বৃষ্টি পড়ছে অবিরাম। মেঘ ডাকছে। ঝলসাল বিদ্যুৎ। হাওয়ার দাপটে উথালি-পাথালি। সামান্য মনুষ্যদেহ ঠেলে ফেলে দিতে চায়। 

যুধিষ্ঠির সেন বলছেন—অর্জুন, তুই মায়ের ওপর ছাতা ধর। আমি আর ভীম চাদর ধরি। অর্জুন ছাতা ধরেছেন। খোলা ছাতা উল্টে বেঁকে যাচ্ছে বারবার। সামান্য পথ। তবু জল ঠেলে ঠেলে চলেছেন তাঁরা সহস্র ক্রোশ। 

চলেছে আরও বহুজন। শিশু কোলে করে, ছোট ছোট সন্তান কাঁধে নিয়ে। স্ত্রীলোকের মাথায় পোঁটলা, পুরুষের কাঁধে সন্তান। সকলের চোখে-মুখে ত্রাস। আতঙ্ক। কী হবে? এ নদী ভাসাবেই। কিন্তু কতখানি? কতদূর? 

চাটুজ্যেবাড়িতে নেবে আশ্রয়। বরকত আলির বাড়িতে নেবে। অধিকাংশ চলে যাবে মসজিদবাড়িতে। আশ্রয় চাই! আশ্রয়, আশ্ৰয়! 

.

দ্রুত দ্রুত দ্রুত ঢুকে আসছে জল। বাউলের আখড়ার মেঝে ডুবে গেল। চৌকির পায়া ডুবে যাচ্ছে নিমেষেই। থালা ঘটি বাটি ভাসে জলে, পরস্পর ধাক্কাও লাগায়। বাউল মানুষ তারা, আতঙ্কিত হয়ে যাচ্ছে! কী করে! কোথায় যায়! তাদের বিশ্বাস ছিল, শেষ অবধি উপচানো ভৈরব ছোট-খাটো বান ডেকে মেঝে ডুবিয়ে দেবে। এমনতরো দেখেছে তারা কতবার! এমনকী বিপুল বন্যার স্মৃতি, সে-ও ধরা আছে। তখন, ঘরের চালে উঠে বসেছিল তারা। কিন্তু এবারে জলের গতি-প্রকৃতি ভাল নয়। এই উদ্দাম বৃহৎ হয়ে ওঠা—এ ভাল নয়। কে জানে, ঘরের চালও ডুবিয়ে দেবে কি না! তা হলে তারা কোথায় যায়? 

চাটুজ্যেবাড়ি, চাটুজ্যেবাড়ি। এই বাড়িতে মিলে যাবে একটুকুন আশ্রয়। সেখানে একতলার উঁচু বারান্দা এখনও ডোবেনি। কিন্তু ক্রমাগত জলের ছাঁট লেগে বিবর্ণ হয়ে গেছেন মা দুর্গা। এখন তিনি গলে-গলে পড়ছেন। কে জানে, এই বন্যার বিপুলতা তাঁরই ভাসানকল্পে কি না! আপাতত দুর্গামূর্তি অসহায় সপরিবারে। মানুষের আশ্রয় নেবার জায়গা নেই। উপায় নেই। বৃহৎ মাটির মূর্তি কে বা আগলায়! 

বাউলজন তারা সকল ফেলে ঝোলা কাঁধে বেরিয়ে পড়ে। জল ঠেলছে তাদের। বায়ু ঠেলছে। অনেকখানি পথ। পা টেনে টেনে চলেছে তারা। কোমর ছাপানো জল ঠেলে ঠেলে চলেছে। ভয় করছে। বড় ভয় করছে। চাটুজ্যেদের বাড়ি অবধি পৌঁছতে কি পারবে? তার আগেই জল তাদের ডুবিয়ে ভাসিয়ে দেবে না তো! 

জসিমবাউল পারুলবালার কাঁধ জড়িয়ে হাঁটছে। যেন জলের টান তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে না যায়। ওসমান বাউল তারাকে সাপটে নিয়েছে নিজের সঙ্গে। জলের হাতে সঁপে দেবে না সে সঙ্গিনী। যদি মরে, যদি ডোবে, যদি ভেসে যায়—যাবে একসঙ্গে। একত্রে। জল ঠেলে ঠেলে তারা চলেছে। হাঁটছে। হাঁটছে সাবধানে। চারিদিকে জল, জল! দিক ভুলে না চলে যায় ভৈরবের অববাহিকায়। গর্ভে। তা হলে আর জীবন খুঁজে পাওয়া যাবে না। জলে আছে স্রোত! আছে ঘূর্ণি! আছে অতল গভীরতা! পাকা সাঁতারুও অসহায় হয়ে যাবে। 

এই সকলই সামলে, কেবল তারা চলেছে বিচ্ছিন্ন। পৃথক। দুলুক্ষ্যাপা আর জাহিরা। পথে এত লোক, তাদের মতো একলা আর কেউ নয়। কেউ-ই নয়। 

দুলুক্ষ্যাপা নারীবিহীন, জড়ায়নি কারওকেই। জাহিরার পুরুষ—সে দিনের আলোয় ধরা দেবার পাত্র নয়। জাহিরা, এই জল ঠেলে ঠেলে, স্রোতে সাঁতরে, ঘুর্ণি এড়িয়ে কি তারই ক্রোড়ে আশ্রয় পেতে চলেছে? তারই ক্রোড়ে? 

হায়! তার ফিনফিনে ডানা গুঁড়ো-গুঁড়ো হয়ে গেছে। পরি-জীবনের অবসানে আজ জাহিরার এই যাওয়া বড় অপমানের। সে যখন অভিসারিকা, তখন স্বাধীনা। দয়িতের নিকট সে কেমনে যাবে আশ্রয়প্রার্থিনী হয়ে, ভিখারিণী হয়ে দীন হীন? 

যদি সে আসত একবার, যদি খোঁজ নিত, এই জলে কেমনে বাঁচে পরি, কেমনে জিন্দা থাকে সকল ঘূর্ণাবর্ত বুকে ঢেলে—তবে এ অপমান তাকে বাজত না। কিন্তু আসে নাই সে স্বরূপ জিইয়ে। তারই দোরে কেমনে সে যায়? 

সে ধুঁকতে ধুঁকতে চলে। হো-হো রব, হা-হা রব, শুনতে শুনতে চলেছে আপনাকে আপনি সামাল সামাল! ছোটখাটো মানুষ সে, জল তার ভরাট বুকের সমান। শরীরের ভারসাম্য রাখতে সে দু’ হাত ওপরে তুলে দেয়। হঠাৎই এক স্রোতের ধাক্কা প্রবল ঠেলায় ফেলে দিতে চায় তাকে। সে হাঁকপাঁক করে। কিছু ঘোলা জল ঢুকে যায় তার মুখে। যে-যার পরিবার নিয়ে ব্যস্ত কেউ ফিরে দেখে না। সে ত্রাসে চ্যাঁচায়—বাঁচাও গো-ও-ও-ও! 

এক শক্ত বাহুডোর, যা সে প্রত্যাশা করেছে কতকাল, এক শক্ত বাহুডোর তাকে জড়িয়ে ধরল আর দ্রিমি দ্রিমি বাজল মেঘের গগনে। অম্বর ঘিরে বিদ্যুৎ যেন-বা কেশাগ্র ছুঁয়ে যায়। জাহিরা প্রাণপণ আঁকড়ে ধরল দুলু বাউলের শরীর। দুলু বাউলও তাকে সাপটে রয়েছে আপন শরীরে বুঝি এই প্রত্যয়ে জাহিরাই তার প্রিয়তমাসু বাকি জীবনের তরে। অবলম্বন তার। নারী বিনে সাধন হয় না। নারী, ওগো নারী! ময়নামতী আমার! দুলু বাউল এই মরণের মুখেও ময়না বৈষ্ণবীকে স্মরণ করে নিত্যানন্দে মজে। ময়না গাইত, 

শ্রীরূপের পদে যার নিষ্ঠা হল 
মানুষের করণ সেই সেধে গেল।
শ্রীরূপের পেল সিদ্ধি 
শাস্ত্রদেবতা দুষে গেল।।

সে গাইত শ্রীরাধা ও কৃষ্ণ ভজে। দুলুবাউল গায় বীজ আর হ্লাদিনীর ভজনা। 

আছে রূপের দরজায় 
শ্রীরূপ মহাশয় 
রূপের তালা ছোড়ান 
তার হাতে সদাই। 
যে জন শ্রীরূপ গত হবে 
তালা ছোড়ান পাবে। 

‘ওগো ময়নামতী দেখা দাও! তোমা বিনে প্রাণ ভেসে যায়!’ যতখানি তার সম্ভব, সে জোরে হাঁটছে। জাহিরাকে প্রায় ভাসিয়েই নিয়ে চলেছে। আর জাহিরা, তার শরীরের সঙ্গে মিশে, প্ৰাণ বিপন্ন পরিস্থিতিতে ভাবছে, এই দেহ, এই স্বপ্নের দেহ, যাকে ছুঁতে চাওয়ার কাতর ইচ্ছায় রাতের পর রাত ঘুমোতে পারেনি, দিনের পর দিন শান্তি পায়নি, তাকে, ওই দেহকে, এমনি করে পেতে হয়? জীবন থাকে কি না থাকে এমন সময়ে পেতে হয়? অপমানবোধ আর তাড়া করে না তাকে। মোহনলাল, তার গোপন প্রেমিক, তার প্রকাশ্য আশ্রয়দাতা—তার কাছে যেতে আর তার সংকোচ হয় না। কারণ, দুলুক্ষ্যাপার স্পর্শ পাওয়ামাত্র এক অভিসারিকা জলপরির অবসান হয়ে, তারই সত্তা হতে জন্ম নিয়েছে এক প্রেমা মানবী! উন্মাদনা হতে নিবিড় শমে পৌঁছচ্ছে সে। সে বিস্মৃত হচ্ছে, এই ঘোর দুর্বিপাকে সে মারাও যেতে পারে। এই গোটা গ্রাম ভৈরবের পুরু বালি ও পলিমাটির তলায় চাপা পড়ে গেলেও কিছু বলার থাকে না। আজ সকল পাওয়া সাঙ্গ হল। কিছুতেই কিছু যায় আসে না। 

সে কাঁদে! হু হু করে কাঁদে! দুলু বাউলের আলিঙ্গনের মধ্যে বলে—ক্ষ্যাপা! আমি মরে যাব গো! মরে যাব আমি! 

দুলুক্ষ্যাপা আরও শক্ত করে ধরল তাকে। ধমকাল। বলল— চুপ! কথা না! সাবধানে চলো! আর একটু! 

জাহিরা কাতরাতে থাকল। ওগো! ওগো! আঃ আঃ আঃ! ভাষাহারা সে, বোধহারা সে, অনুভূতিহারা! সে এখন কোন এক সর্বনাশে বুঁদ। 

দুলুক্ষ্যাপা দেখতে পেল তখন, তার আগে আগে চলেছে, ও কে? ও কে? ও কে গো? বড় চেনা ওই ভঙ্গি। বড় চেনা যে! সে ডাকে—বোষ্টুমি! 

ময়না বৈষ্ণবী ফিরে দাঁড়ায়। হাসে। বলে-ধরো বাউল ধরো। ছেড়ো না হে, ছেড়ো না!

দুলু বাউল গোঙায়—বোষ্টুমি! ধরা দাও গো! ধরা দাও গো! একবারটি ধরা দাও! 

ময়না বৈষ্ণবী তার শরীরে জাগায় সুনিবিড় এক ভাষা। আর ভেসে যায়। দূর হতে দূরে ভেসে যায়। বলতে বলতে যায়—হে চিরসখা! চিরসখা হে! ছেড়ো না গো! ছেড়ো না! ছেড়ো না! 

.

দশদিন হল ইদরিশ নেই ঘরে। ছোট দুই সন্তান নিয়ে কীভাবে কাটছে মাসুদার, সে খবর রাখে না কেউ। সন্তানগুলি পেয়ে কিছু শান্ত হয়েছিল মাসুদা আর ইদরিশ তার পাগলপনায় ভেসে গিয়েছিল! ইদানীং মনে হচ্ছিল মাসুদার, ওই সন্তানহারা অবস্থাই ভাল ছিল তার পক্ষে। তখন ইদরিশকে সে পেয়েছিল অনেকখানি। 

এখন, অনাহারে-অর্ধাহারে জলে ভাসা অবস্থায় বাচ্চাগুলি বুকে সাপটে বসে আছে সে। ইদরিশের ওপর তার রাগ-অভিমান হচ্ছে, আবার ভয়ও করছে খুব। নানাবিধ আশঙ্কা তার। কোথায় রইল মানুষটা! কোনও বিপদে পড়ল না তো! এই বর্ষায় যখন চতুর্দিকে জল বাড়ছে, তখন ইদরিশ নিশ্চয়ই গ্রামে আসার চেষ্টা করেছে! যতই বাউন্ডুলে হোক, এই বিপদে স্ত্রী ও সন্তানদের একলা ফেলে দেবার লোক নয় সে। 

বাইরে জলের শব্দ শুনতে পাচ্ছে মাসুদা। লোকে ছোটাছুটি করছে। পালাচ্ছে। সেও যাবে। সেও যেতে চায়। কিন্তু দুটি সন্তান কোলে নিয়ে এই জলে সে যায় কোথায়? কী প্রকারে যায়?

তারই ঘরের সামনে দিয়ে লোক চলে যাচ্ছে। সে ডাকছে—বাঁচাও! কে আছ! আমি বড় একা গো! 

কেউ শোনে না! কেউ জানে না! শুনলেও আপনি বাঁচতে আপনি ছোটে! 

হায়! দুলুবাউলের কানে এ ডাক পৌঁছত যদি, সে বুঝি এগিয়ে আসত ত্রাণে। কিন্তু সে কোথায়! কোথায়! 

জল ঢুকছে ঘরে। জলের শক্তি ধাক্কা মারছে দেওয়ালে। এই বুঝি ধসে পড়ল। ভেঙে পড়ল মাথার ওপর! কী করে সে! কার কাছে যায়! একবার ভাবে, চিৎকার করে দাদার সাহায্য চাইবে কি না! পরক্ষণেই মন ভেঙে যায়! না! যাবে না সে! সাহায্য চাইবে না! খুনি! ওরা খুনি! ওদের সঙ্গে সকল সম্পর্ক চুকে-বুকে গেছে! এই এতদিনের মধ্যে দাদা কি একবার এসে খোঁজ নিয়েছে তার? বড়ভাইয়ের কর্তব্য কি করেছে সে কোনওদিন? কখনও এসে দুটি চোখের জল ফেলে কি বলেছে—মাসুদা, আমার জন্যই তোর সন্তান বাঁচল না রে, আমার মেয়ের জন্যই! 

বলেনি, কোনওদিন বলেনি। বলত যদি, মাসুদা কেঁদে পড়ত বড়ভাইয়ের কোলে। বলত- আমরা দু’জনেই দু’ প্রকারে সন্তানহারা হলাম! 

সে দাঁতে দাঁত চাপে। না না, ওদের কথা আর নয়। ওরা তার কেউ নয়। সে মরুক-বাঁচুক, ওদের কী! ওরা মরলেও তার কিছু এসে যায় না। 

তার মনে পড়ল ইদরিশের টিনের ডোঙা তোলা আছে চালে। ওই ডোঙাই একমাত্র ভরসা জাগাল তাকে। যদি কোনও ক্রমে ডোঙাটা নামিয়ে নিতে পারে! কোনওমতে সে বেয়ে বেয়ে চলে যাবে চাটুজ্যেবাড়ি! 

কিন্তু বাচ্চাগুলি? এদের সে কোথায় রেখে যায়? চৌকি থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে জলে পড়ে যায় যদি! হায় হায়! সে কী করে! 

এদিক-ওদিক তাকাল সে। ভাবল। একগোছা নারকেলের রসি জড়ো করে রাখা বাঁশের খাঁজে। মড়মড় শব্দ উঠছে ঘরে। ভেঙে পড়বে নাকি ঘর? ভেঙে পড়বে? 

সে বাচ্চাদুটি কোলে করে চৌকি হতে নামল। দুটিকেই এক কাঁখে চেপে দড়ি পাড়ল। আর দেরি করা যায় না এতটুকু। বৃষ্টির তোড় বেড়েছে আরও। জল ঢুকছে। তার হাঁটু ছাড়িয়েছে ঘরেই। এখন চৌকির সমান সমান জল। জলের ওপর সামান্য ভেসে উঠেছে চৌকি। সে বাচ্চাদের শোয়াল চৌকিতে আর দু’পাক নারকেল রসি দিয়ে বেঁধে দিল চৌকির সঙ্গে! যাক! পড়ে যাবে না অন্তত।

দাওয়ায় এল সে। বৃষ্টির ছাঁটে তার দৃষ্টি হারিয়ে গেল। এই দুপুরেই যেন রাত্রির ঘন আঁধার নেমেছে। সে ধাপ খুঁজে খুঁজে নামল আঙিনায় আর জলের ঝাপটা তাকে মাটিতে ফেলে দিল। হাঁকপাঁক করে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল সে। সাঁতরাবার চেষ্টা করল! হায়! তার পায়ে জড়িয়েছে কী! বিষাক্ত বন্ধন কষে দিয়েছে কোন দড়ি? কোন সাপ? স্রোতের টান তাকে ঠেলে দিল। সে, ডুবল, ভাসল, ডুবল, ভাসল, ডুবল, ভাসল, ডুবল, ভাসল…. 

.

আব্বা ডেকেছিল তাকে—চল। সময় থাকতে মসজিদে যাই। তোর তো কাছের লোক মোহনবাবু। চল চাটুজ্যেবাড়িতেই যাই। 

—না। 

সে বলেছে—না। 

বাইক ফেলে নড়বে না এক পাও সে। অতএব তার মা কাঁদতে কাঁদতে রয়ে গিয়েছে তার সঙ্গে। বলেছে—সুনা, মটরসাইকেল গেলে আবার হবে। প্রাণ গেলে আর আসবে না! 

সে রাগ করেছে। বলেছে—যাও তোমরা! যাও! 

তার আব্বা রেগে-মেগে আপনি বাঁচাতে চলে গেছে। ‘থাক, তোরা! ডুবে মর!’ বলে গর্জাতে গর্জাতে চলে গেছে। মা যায়নি। তারই সঙ্গে থেকে গিনগিন করে কাঁদছে। প্রাণ যাবে, প্রাণ যাবে! 

হাঃ! প্রাণ! এই বাইক তার প্রাণ নয়? সে আশা করেছিল, জল আর বাড়বে না। বাড়লেও তার নিজের ঘরের উঁচু ভিত। সে কি ডুববে নাকি? ডুববে না। এখন তার ঘরেও জল ঢুকছে। বাপের সাহায্যে বাইক সে নিয়ে তুলেছিল এই ঘরেই। বিছানা তার। বিছানার পাশে বাইক। 

বিছানার নিকট হল জল। গুমগুম শব্দ আর কাঁপন! এবার তার ভয় করল। ঘর ভেঙে পড়বে না তো? ইটের পরে ইট সাজানো এই ঠাঁই তেমন পোক্ত নয়। হো-হো শব্দ ভেসে এল বাহির হতে। হা হা শব্দ ভেসে এল। গুম গুম ধ্বনির ভিতর দ্রিমি দ্রিমি বজ্রবিদ্যুৎ। 

আনারবিবি, তার মা, বলল চল পালাই। সুনা আমার! এইবার চল! সময় আছে!

সে বলল—বাইক নিয়ে যাব মা! না হলে তুমি একলা যাও। 

ছলছল শব্দ করে জল, খলখল শব্দে থাকে শয়তানির ইচ্ছা! সে বাইক ধরে। ঠান্ডা! নিষ্প্রাণ! আনারবিবি বলে—বেশ! নিয়ে চল। কিন্তু নিবি কী করে এই জলে? 

—তুমি একদিকে ধরো। এইখানে। আমি ধরব একদিকে। 

আনারবিবি ত্রাসে তাকায়। হায় হায়! এ কী হল! এ কি পাগল হয়ে গেল! না বেরুলে এই ঘরে দম বন্ধ হয়ে মরবে। এখনই দেওয়াল বেয়ে উঠে আসছে কীট। কোণে কোণে বাসা নিয়েছে সাপ। কখন লাফিয়ে পড়ে ঘাড়ে আর কামড়ে দেয়! সে শিউরে ওঠে। তার ঘরে মরণ, বাইরে মরণ! 

মাতিন শেখ বাইক নড়াতে চায়। পারে না। আনারবিবি বাইকের হাতল ধরে টানে এমন যেন আবাল্য চেনা গাভীটির শিং ধরে টানাটানির খেলা! মা-ছেলেতে এক অসম্ভব প্রচেষ্টা করে আর জল বাড়ে। জল উত্তরোত্তর বাড়ে। ছেলে বিবির লাখান বাইক ছাড়া যাবে না, মা প্রাণের পুত্তলি ছেলেকে ছাড়া যাবে না। এমনই সব অচ্ছেদ্য সম্পর্কের বন্ধনে ঘূর্ণি ওঠে জলের আর চিৎকার শোনা যায়! 

.

তস্কর নিসার বিবি রাবেয়া আর বাচ্চাদের নিয়ে চলেছিল পথ বেয়ে। স্রোতধারায় বাচ্চাগুলিকে কোলে-কাঁখে নিয়েছে সে। বিবিকে আগলে আগলে চলেছে। বিবির চোখে ত্রাস। প্রাণে শঙ্কা। সে জীবনকে পরিপূর্ণ পাবার তাগিদে চলেছে নিরাপত্তার সন্ধানে। নিসারের ত্রাস নেই। শঙ্কা নেই। তার অন্য সন্ধান। সে ভাবছে, এই দায় তার নয়। যে মধ্যরাতে আসে, দায় তার। সে কেন অন্যের দায় বহন করবে? এই সুযোগ! এই সুযোগ! কোথায় যাবে সে? কী করবে? 

চারিদিকে জল জল! দিক ঠাহর হয় না। রাবেয়া কাতরায়- ওগো শুনছ! 

—কী! 

—কোনদিকে চলেছ? আমি যে বুঝি না কিছু! 

জল তার মুখে চোখে ঢোকে। নিসার বলে—আমি তো আছি। ভয় কী? 

রাবেয়া নিসারকে আঁকড়ে ধরে। আর নিসার দাঁতে দাঁত পেষে। রাতে যে আসে সে কই? অ্যাঁ? সে কই? চলতে চলতে আস্তে আস্তে পূর্বদিকে সরতে সরতে যায় সে। চুপিসাড়ে এগিয়ে যায় ভৈরবের দিকে। রাবেয়া টের পায় না। কিছুই টের পায় না। সম্পূর্ণ নির্ভরতায় সেও যায় নিসারের সঙ্গে সঙ্গে ভৈরবের অতল অববাহিকার দিকে। এবং চিৎকার করে ওঠে সহসা! ওই ওই ওই! কী ভেসে যায়! কী! 

টালমাটাল টালমাটাল ডুবতে ডুবতে ভাসতে ভাসতে চলেছে ও কী বীভৎস! হায় হায়! এ সহ্য হয় না! সহ্য হয় না! তারা চিৎকার করে! আশ্রয়ের দিকে যেতে থাকা রাবেয়া গোপন প্রেমিক ভুলে বাড়ায় চিৎকার। সপরিবার হত্যার দিকে চুপিসাড়ে যেতে থাকা নিসার জড়ায় চিৎকার। এবং ভুলে যায় সংকল্প হত্যার। সহসা জীবন এক অমূল্য তাৎপর্য আনে তার কাছে। সে জান্তব গোঙায়। এমনকী শিশুসন্তানগুলি পর্যন্ত আতঙ্কে উন্মাদিত শব্দ করে মুখে। ও কী! ওই ওই ওই! কী ভেসে যায়! কী! হায় আল্লা… আল্লা… আ-আ-আ-আ-আ … 

একটি কাঠের চৌকি। তার ওপর দুটি শিশু পাশাপাশি বাঁধা। তারা ডুবছে আর ভাসছে। ডুবছে আর ভাসছে। ভাসছে ভাসছে। ভেসে যাচ্ছে কোথায়…! 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *