রাজপাট – ১১২

১১২ 

শ্রাবণে বরষণ ধারা
পড়িছে ঝরিয়া। 
হায় হায় ফতেমা কান্দে 
আরশি ধরিয়া। 
হায় হায় ফতেমা কান্দে
ফতেমারই গায়ে পড়িয়া।
ইমাম উছেন অইছে শহীদ
কারবালাতে গিয়া। 
ফতেমার বলত ইমাম উছেন 
দোনোকে ছাইড়াছে। 
চান্দমুখে জোয়ার নাই 
মা বলিব কে? 

.

ট্রাকের পর ট্রাক বোল্ডার এসে যাচ্ছে। বৃষ্টি ধরেছে কিছু। তবু মেঘ-থমথমে আকাশ। ভরা নদী উপচে পায়ের গোছ ডোবা জল পেতনির চরায়। চতুষ্কোনার ক্ষেতগুলি জলে ডুবে আছে। ভাগীরথী ভয়ঙ্করী এখন। তেমনই ভয়ঙ্কর রূপ ভৈরবের। যেন ভৈরব ও ভৈরবী মিলে ঘটাবে প্রলয়। তেকোনার মানুষও নিশ্চিন্তে নিরুপদ্রবে নেই। সদা শঙ্কা। সদা ভয়। গ্রামে গ্রামে একই চিত্র। তবু আশা, শেষ পর্যন্ত বন্যা হবে না নিশ্চয়! 

ট্রাকের পর ট্রাক বোল্ডার এসে যাচ্ছে। কিন্তু সমস্যা এক, নদীর কিনারে রাখার জায়গা নেই। ক্ষেতে জলে ডুবে আছে ধানের গাছ। অথচ বোল্ডার রাখার জন্য চাই বড় পরিসর। চিন্তায় পড়ে গেছে অনির্বাণ পোদ্দার। ক্ষেতের ফসল নষ্ট করে বোল্ডার ফেলতে আগ্রহী সে নয়। কারণ, নদীর ধারে ধারে তাদেরই জমিজমা বিস্তর। কিছু আছে বলাই মণ্ডলের। তবে মূল কাজ যেখানে, আমবাগান বরাবর নদীর যেখানে প্রবেশ-প্রবণতা, তারই কাছাকাছি বোল্ডার ফেলা চাই। 

বোল্ডার। বড় বড় পাথরের চাঁই। পাকুড় হতে আসা। পাকুড়ের পাথরের খনি। তার থেকে তোলা। নির্দিষ্ট ওজনের। নির্দিষ্ট মাপের। কী মাপ, কী ওজন পি দত্ত বলে দিয়েছেন। সদলবলে দেখে যাবেন তিনি। ওজন নিয়ে পরীক্ষা করে যাবেন ঠিক মাপ এল কি না। কতগুলি পাথর লাগবে তারও আছে আঙ্কিক হিসেব। হাজার হাজার পাথরের চাঁইয়ের জন্য হাজার কোটি টাকা। বন্যার স্রোত রুদ্ধ করার জন্য বানের স্রোতেরই ন্যায় অর্থের প্রবাহ। 

কোটি কোটি টাকার প্রকল্প এই। কোটি কোটি। 

অনির্বাণ পোদ্দারের উদ্ধারণে এগিয়ে এল মোবারক আলি স্বয়ং। তার আব্বা মহম্মদ আলির জমিটুকু এখুনি নদীগর্ভে যাবার মতো নয়। ভাঙনে এগিয়ে এসেছে নদী। কিন্তু এখনও মহম্মদ আলির জমিটুকু অটুট রয়েছে। আর ওই স্থান বোল্ডার রাখার পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত হবে। 

মনে মনে চতুর হাসিটি সে হেসে নেয়। সবুজে সবুজ ওই জমিটুকুর লকলকে নধর গাছপালা সব বোল্ডারে চেপ্টে-চুপ্টে যাবে। আরাম হবে তার। বহুৎ আরাম হবে। ইদানীং সুকুমার পোদ্দারের গৃহেরই এক কোণে সে থাকার জায়গা একখানি বরাদ্দ পেয়েছে। অনির্বাণের কাজেও সুবিধা হয়। বহু গোপনীয় হিসেব-নিকেশ করে নিতে পারা যায় একান্ত নির্জনতায়। যদিও বেশিদিন নয়, বেশিদিন থাকবে না এখানে সে। নিকটে অজস্র টাকার হাতছানি। বোল্ডার বোল্ডার! বোল্ডারের পরিবর্তে, চোখ বুজলেই মোবারক আলি দেখতে পায়, টাকার স্তুপ। স্তূপীকৃত টাকা, রাশি রাশি, রাখা আছে পাড় বরাবর। ওই টাকা কার? 

কার? 

ভাগাভাগি হয়ে যাবে। 

টাকা ভাগাভাগি হয়ে যাবে। 

কার কার কার মধ্যে? 

মোবারক আলি সে। সুকুমার পোদ্দারের ছেলে অনির্বাণ পোদ্দারের ডানহাত ঘটনাচক্রে। সে ঠোঁট চেপে থাকে। কথাটি কয় না। ভাগাভাগি হোক না শালা যার সঙ্গে খুশি। তার কী! অনির্বাণ পোদ্দার যা ভাগ পাবে, তার থেকে ছিটেফোঁটা যা দেবে মোবারক আলিকে, তা ঢের, ঢের পরিমাণ। বহু মুদ্রা দেনমোহর দিয়ে সে আনবে আসমানি চাঁদের মতো বিবি। বিবিকে দাঁড়িপাল্লায় বসিয়ে চাঁদি ওজন করে দেবে। ঘর করবে। তাতে থাকবে পৃথক স্নানাগার। তার বিবি খোলা গায়ে, আঃ, খোলা গায়ে, স্নান করবে সেখানে। সুন্দরী বিবি তার স্নান করবে। 

সুন্দরী বিবি? সুন্দরী? মায়মুনার মতো সুন্দরী কি কেউ? ভাবতে ভাবতে সে বিবশ হয়ে যায়। তার ক্রোধ ফুটে ওঠে। চোখে মুখে ক্রোধ ফুটে ওঠে। প্রতিহিংসা প্রতিহিংসা! বুকে আগুন জ্বলে তার। তার চোখে যে মায়মুনার চেয়ে সুন্দরী আর কেউ নেই! কেন মায়মুনা তার হল না? কার জন্য হল না? এত লালচ শালাদের! হারামখোর লোভী লুচ্চা! সে থুথু ফেলে বাপ— ভাইয়ের উদ্দেশে। অকথ্য গালাজ ছুঁড়ে দেয়। লকলকে সবুজে সমৃদ্ধ বাগান তার দু’চোখের মণিকে পীড়ন করে অত্যন্ত নিষ্ঠুরে। 

হ্যাঁ হ্যাঁ! ওইখানেই রাখবে সে। বোল্ডার রাখবে ওইখানেই। সম্বৎসরের সবজি দেওয়া বাগানের গাছপালা দুমড়ে-মুচড়ে দেবে। 

খুব মাছ ধরছে আর বেচছে আকবর আলি এখন। খুব কামাচ্ছে শালা সুপুত্তুর। মনে মনে ছক কষে মোবারক আলি। কী করে আকবর আলিকে জব্দ করা যায়? ওর নৌকাটা যদি…নৌকা…ওর একমাত্র সম্বল… 

.

অনির্বাণের মনে ধরল মোবারকের প্রস্তাব। স্মরণ করতে পারল সে বাগানটিকে। অতএব বাইকের পিছনে মোবারককে বসিয়ে সে সোজা চলে গেল মহম্মদ আলির বাড়ি। 

মহম্মদ আলি ব্যস্ত হয়ে উঠলেন অনির্বাণকে দেখে। কোথা বসতে দেন। কী বসতে দেন। কিন্তু ছেলের দিকে ফিরেও তাকালেন না তিনি। 

দুয়ার পেরোয়নি মোবারক আলি নিজেও। খোলা আঙিনার বাহির সীমানায় দাঁড়িয়েছে সটান। অনির্বাণ পোদ্দারের সঙ্গে বাইকে চেপে সসম্মানে এসেছে সে আজ। বাহিরে উগ্র উদ্ধত সে, কিন্তু হৃদয়ে উত্তাল। তার সতৃষ্ণ দৃষ্টি ছুঁয়ে যাচ্ছে আনাচ-কানাচ। বুকের গভীরে এক সতৃষ্ণ খোঁজ জারি আছে। সে কোথায়? কোথায়? একবারও কি বাইরে আসবে না? দাওয়ার কোনায় বসবে না বিড়ির সম্ভার নিয়ে? বসেনি কেন সে? কোথায় গিয়েছে? সে দেখছে দাওয়ায় খালেদাকে। দেখছে রোগা ভোগা কিন্তু সেরে উঠতে থাকা আফসানা, তাকেও। কেউ-ই তার দিকে চাইছে না একবারের তরেও। যেন আফসানা কোনও দিন তার ভাবি ছিল না। খালেদা কোনও দিন পেটে ধরেননি তাকে। যেন মোবারক আলি বলে কেউ কোনও দিন ছিলই না এ বাড়িতে। 

না তাকাক। না তাকাক। সে কেউ নয়। কারও নয়। তার বুকে ফুলে ওঠে অভিমান। ফুঁসে ওঠে ক্রোধ। তবু নয়ন মানে না। সে খোঁজে। খুঁজে যায়। সতৃষ্ণ সকাতর দৃষ্টি তার। সকাতর হৃদয়। ইচ্ছে করে, প্রত্যাশা হয়, খালেদা এসে হাত রাখবেন গায়ে, বলবেন—ভাল আছ বাপজান? আমাদের থুয়ে ভাল আছ? 

এই কল্পনায় তার চোখের কোণে জল এসে গেল। 

তখন, অনির্বাণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দিলেন মহম্মদ আলি। জোড়হাতে বললেন- আপনাদের কাছে আমাদের অনেক ঋণ। কিন্তু ওই বাগানের ভরসায় আমার সংসার চলে। অন্নের সঙ্গে সামান্য ব্যঞ্জন শিশুদের মুখে দিতে পারি। সে নষ্ট করতে পারব না। 

অনির্বাণ পোদ্দার, এই মাত্র দিন কয়েক আগেও ছিল নরম প্রেমিক, এখন সফল ঠিকাদার একজন, সুকুমার পোদ্দারের সুযোগ্য সন্তান, তার কান ঝাঁ-ঝাঁ করে। প্রত্যাখ্যানের অপমানে কান ঝাঁ-ঝাঁ করে। এই গ্রামে পোদ্দার বাড়ির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার শক্তি কারও আছে দেখে বিস্ময়ে সে হতবাক হয়ে যায়। দাঁতে দাঁত চাপে সে। বলে—হিসেব করুন। 

মহম্মদ আলি তার মুখের দিকে তাকিয়ে ভয় পান। ঢোঁক গিলে বলেন—কীসের হিসেব ছোটবাবু? 

অসহায় লাগে তাঁর। মনে হয়, ভুল করে ফেললেন কিছু? আকবর আলি উপস্থিত থাকলে বড় ভাল হত। অনুভব করেন তিনি। মনে মনে হাতড়ে চলেন শক্ত অবলম্বন কোনও। 

সুকুমার পোদ্দারের ছেলে, ঠিকেদার হয়ে ওঠা অনির্বাণ পোদ্দার বলে—সারা বছর কত টাকার সবজি লাগে আপনার পরিবারে। তার হিসেব। 

মহম্মদ আলির চোখে জল এসে যায়। তিনি বলেন—বাবু, শুধু টাকার জন্য না। ওইসব গাছ আমার পরিশ্রমের ফল। চোখের সামনে চাপা পড়ে মরবে। বড় কষ্ট হয়। 

অনির্বাণ দাঁতে দাঁত চাপে। বলে—নৌকার ঋণ শোধ হয়ে গেছে? 

—না বাবু। হচ্ছে। গেল বৎসর খরা হল। মাছ পড়ে নাই। এইবার দেব।

—জায়গাটা চাই আমার। 

—অ্যাঁ? 

—জায়গাটা চাই। 

জেদি লাগে মহম্মদ আলিকে। অনমনীয় লাগে। তিনি ঘাড় শক্ত করে থাকেন। তথাপি টের পান, ওই জায়গা না দিয়ে উপায় নেই। শেষ মরিয়া চেষ্টার মতো বলেন—দশ হাজার টাকা দিলে… 

—দশ হাজার? 

অনির্বাণ বাইকের ইঞ্জিন চালু করে সশব্দে। দাঁতে দাঁত চাপে। চোয়াল টাটিয়ে ওঠে তার। মোবারককে নিয়ে অন্য জায়গার সন্ধানে সে যায়। নিজেদের জমির মধ্যেই অগত্যা বেছে নেয় একাংশ। বোল্ডার পড়ে। থরে থরে বোল্ডার পড়ে। বহু লোক কাজে লেগে যায়। সামরিক তৎপরতায় গড়ে ওঠে পাথর— প্রাচীর। দ্রুত। অতি দ্রুত। থমথমে মেঘ তা চেয়ে দেখে। রোষে। গম্ভীর নদী তা চেয়ে দেখে। ফুঁসে ওঠে আক্রোশে। ভাঙনের ছক কষে বুঝি। 

আর ছক কষে তারা। অনির্বাণ মোবারক। মোবারক তাতায়। অনির্বাণ স্ফুটনাঙ্কে পৌঁছয়। মোবারক বলে আপনাকে না বলে দিল? 

অনির্বাণ দাঁতে দাঁত চেপে বলে—হুম্‌ম! 

—ছেড়ে দেবেন এমনি? 

—কী করব? 

—কী করতে চান? 

—তোমার তো বাপ-ভাই! 

—আমাকে ভাই বলে, ছেলে বলে মানে? নিজের লোক আমি মাত্র একজনকেই জানি।

—কে? 

—আপনি। 

তোষণে দেবতা তুষ্ট। অনির্বাণ পোদ্দার কেন নয়? এই লোকটি বিশ্বস্ত। নির্ভরযোগ্য। তার অপমানবোধ হতে জেগে ওঠা প্রতিহিংসা এই লোকটি তৃপ্ত করতে পারে। সে বলে—তুমি আমার ভাইয়ের মতো। 

—আমি আপনার গোলাম। আপনার নুন খাচ্ছি। 

—আমি তোমার পাশে আছি। 

—আমি প্রাণ দিয়ে আপনার সেবা করব। 

—ব্যবস্থা কিছু করতে পারবে? সাহস বাড়তে দিতে নেই। 

—আপনি একবার বলে দেন। আমি আপনাকে নিয়ে গেছি। আপনার অপমান আমি সহ্য করব না। মুচড়ে ছেড়ে দেব, না ভেঙে দেব? 

—ভাঙো, ভাঙো! 

—একবারে, না তিলে তিলে? 

—একবারে লোকে সন্দেহ করবে। 

—ব্যস! আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে যান। 

—দেখো! কেউ টের না পায়। বাবা বলছিল এখন শুধু জনকল্যাণের কাজ করতে হবে। এরপর পঞ্চায়েতের ভোট। 

অনির্বাণ ইশারা দেয়। মোবারক আলি তা পালনে উদ্যত। 

সরকারি লোকজন মেপেজুপে গেছে। গুণে গেঁথে গেছে সব পাথর পরিমাণ। কাজ হয়ে গেছে শুরু! কাজের সময় আর একবার গোনা-গাঁথা হয় কই! অতএব শেষ তক, পূর্তবিদের আঙ্কিক হিসেবে গোলমাল দেখা দেয়। সকল মূল্যাবধারণ, সকল প্রাককলন কম হয়ে গিয়ে ব্যয়ের হিসাব হয়ে যায় ঊর্ধ্ব-পরিমাণ! পূর্তবিদের দেওয়া চারশো টন পাথরের পরিবর্তে লেগে যায় ছশো টন। লেগে যায়। নিখুঁত অঙ্কের জ্ঞানও ব্যর্থ হয়ে যায়। কী প্রকারে? কী প্রকারে? 

.

রাত্রি গভীর হলে বিশ্বস্ত কয়েকজনকে সঙ্গে নিল মোবারক। রোজকার এ কাজ। বৃষ্টি নেমেছে পুনরায়। এ এক সুবিধা। চমৎকার সুবিধা এই বজ্র-বিদ্যুৎ। 

পায়ে পায়ে তারা গেল স্তূপ করা পাথরের কাছে। ধরাধরি করে একেকটি পাথর ফেলে দিতে থাকল ভরন্ত নদীর জলে। শব্দ উঠল ঝপ্, ঝপ্, ঝপ্। সেই শব্দে জেগে উঠল না কেউ। 

শিলা কোনও কালে জলে ভাসে নাই। অতএব মুক প্রস্তরের খণ্ড খণ্ড ভার জলে চলে গেল নীরবে, বিনা প্রতিবাদে, এমনকী চিহ্ন কোনও না রেখে ডুবে গেল। 

ঠিকাদারির এই দস্তুর। কাজ হবে বর্ষায়, যাতে অসমাপ্ত থাকে কাজ, অপূর্ণ থাকে। যাতে দুর্বল হয়। দুর্বল না হলে, শক্ত-পোক্ত হয়ে গেলে, বৎসরান্তে একবার ফাটিয়ে-টুটিয়ে না দিলে, কী প্রকারে পায় তারা পৌনঃপুনিক কাজের বরাত? তাই বস্তুগুলির গুণমান নিম্নমুখী। তাই এমন পাথর ফেলে দেওয়া। মরুক মরুক সব জনপ্রাণী, জনসাধারণ। লাভের অগণন কড়ি ভাগাভাগি হয়ে যাক ক্ষমতাশালী বলশালী লোকে-লোকান্তরে। 

গোটা কুড়ি পাথর জলে ফেলে হাঁপাতে হাঁপাতে ক্ষান্ত হল তারা। এক দিনের পক্ষে এই ঢের। বেশি হলে চোখে পড়ে যাবে। বলা তো যায় না, কখন এসে যাবেন কোনও এক পরিদর্শক, সততা ন্যায়-নিষ্ঠার পরাকাষ্ঠা, ধরে ফেলবেন যত নীরব শিলার ইতিহাস। তাই ভাল। সাবধানতা ভাল। 

মোবারক আলি সে, নিজে তো পাথর ফেলে না। তদারকি করে। দলবল নিয়ে সে জেলেপাড়ার দিকে যায়। খোঁজ নিয়ে রেখেছিল আগেই। ভোর পাঁচটায় গাঙে যাত্রা করবে সব। 

কাজটা সহজ নয়। এই বৃষ্টিতে কাজটা সহজ নয়। তবু, সে সমগ্র প্রস্তুত। কোনও কোনও নৌকায় ছইয়ের তলে শুয়ে থাকে লোক। পাহারাদারি করে। গায়ে গায়ে লেগে থাকা নৌকাগুলি নজরে নজরে রাখে। এ ভরা বরষায় কে আছে পাহারাদার? মোবারক জানে, খবর নিয়েছে, আজ রাতে আছে বুড়ো নিজামত মাঝি এবং হারুন মিঞা। সে সঙ্গীদের দেখে নেয় অন্ধকারে। লুঙ্গির ভাঁজে হাত চালায়। গলায় মধু ঢেলে বলে—এই ঘোর বাদলায় তোদিগের বড় অসুবিধা যাচ্ছে কী বল দিলীপ? মকবুল? 

দিলীপ মাথা চুলকায়। মকবুল হেঁ-হেঁ করে। বলে-জি, মোবারকভাই আমাদিগে এট্টু দেখো। 

—তা তো দেখবই। তোরা হলি গিয়ে আমার শাগরেদ। 

—জি। 

—এই নে। রাখ। 

সে ক’টি বড় নোট এদের মুঠোয় গুঁজে দেয়। এরা আপ্লুত হয়ে ওঠে। 

তারা চুপি-চুপি হাঁটতে থাকল অতএব। ভিজে-ভিজে হাঁটতে থাকল। বৃষ্টি তাদের সহায়। 

বৃষ্টি তাদের সকলের সহায়। 

মোবারক আলি ডাকল— মকবুল। 

—জি। 

—পারবি তো? 

—জি। 

—দিলীপ? 

—হ্যাঁ, মোবারকদা। 

— তৈরি?

—তৈরি! 

খুঁজে খুঁজে সিরাজ নৌকার কাছে দাঁড়াল তারা। চারিদিকে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। তবু, গলুইয়ে ময়ূর তোলা আকবর আলির সিরাজকে চিনে নেওয়া যায়। নৌকার গায়ে লেগে নদীর জল ছলাৎ শব্দ তোলে। তারা একে একে উঠে পড়ে নৌকায়। লিয়াকত বলে একজন, দক্ষ নৌচালনায়, সে কাছি খুলে নেয়। পাড় বরাবর নৌকা ভাসিয়ে চলে তারা। উজানে বেয়ে যায়। মকবুল ও দিলীপ কাজ শুরু করে। ধারাল ধাতব অস্ত্রের আঘাতে আঘাতে ফালা ফালা করতে থাকে সিরাজের শরীর। পাটাতনের কাঠ সরিয়ে তলায় ছ্যাঁদা করতে থাকে। প্রতিটি আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে মোবারকের উল্লাস ফিনকি দিয়ে ওঠে। প্রতিশোধ, প্রতিশোধ, প্রতিশোধ নিয়েছে সে। সমস্ত অপমান-লাঞ্ছনার প্রতিশোধ নিয়েছে সে। আজ সে তৃপ্ত, তৃপ্ত, সুখী! 

জল উঠতে থাকল নৌকায় এবার। তারা একে একে নেমে পড়ল জলে। সামান্য সাঁতরে ডাঙায় উঠে এল। দেখল দাঁড়িয়ে। সিরাজ টলে টলে চলেছে, ঘুরতে ঘুরতে চলেছে নিয়ন্ত্রণহীন। দূরে যাচ্ছে। ডুবে যাচ্ছে। অন্ধকারে আরও একখণ্ড অন্ধকার। মিলিয়ে যাচ্ছে। মিলিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। 

হঠাৎ মায়মুনার করুণ মুখ মনে পড়ল মোবারক আলির। সর্বনাশ সে আকবর আলির একারই করল না। মায়মুনারও করল। মায়মুনা মায়মুনা। বুকের মধ্যে গুঙিয়ে উঠল কে! মোবারক আলি শক্ত হাতে টিপে ধরল তার গলা। মায়মুনা তার কে? 

কেউ না। কেউ না। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *