রাজপাট – ১১০

১১০ 

চির-ক্রন্দনময়ী গঙ্গে! 
কুলু কুলু কল কল প্রবাহিত আঁখি-জল 
দেব-মানবের একসঙ্গে! 
বিশ্বের ক্রন্দনে বিচলিত নারায়ণ 
আঁখি তাঁর অশ্রুতে ভরিল, —
গোলোকে হল না ঠাঁই, শিবজটা বহি তাই 
শতধারা ধরণীতে ঝরিল। 
হিমগিরি-নির্ঝরে তোমার জীবন গড়ে—
মিথ্যা মা মিথ্যা এ কাহিনী; 
যুগে যুগে নর-নারী অফুরান-আঁখিবারি 
পুষ্ট করিছে তব বাহিনী। 

.

পতিতপাবনী গঙ্গা মর্ত্যে অবতরণের আগে ভগীরথকে প্রশ্ন করেছিলেন – ধরিত্রীর সকল কলুষ আমাকে প্রদান করিয়া লোকে পাপমুক্ত হইবে, কিন্তু সেই পাপের মহাভার আমি কোথায় স্খালন করিব ভগীরথ? 

ভগীরথ বলেছিলেন—মা গো, তুমি পূতপবিত্রা। তোমার স্পর্শে কলুষ নাশ হয়। তুমি স্বয়ং শুদ্ধা। পাপ তোমাতে লাগে না। মা, তদুপরি যদি তোমার দুর্ভাবনা উপস্থিত হয়, তাহার প্রশমনের জন্য কহিতেছি, ধরণীতে এরূপ পুণ্যাত্মা আছেন, যাঁহাদের স্পর্শে তোমার সকল মালিন্য তমুহূর্তে বিদূরিত হইবে। নারায়ণ নবরূপে যুগে যুগে ভূতলে আবির্ভূত হন। মহাদেবী নারীরূপে সেই সকল নরগণের পার্শ্ববর্তিনী থাকেন। স্বয়ং ঈশ্বর তাঁহাদের হৃদয়ে নিত্য অবস্থান করেন। 

হায়! বিপুল এ পৃথিবীর বিপুলতর কলুষভারের তুল্য নয় কতিপয় মহাত্মার সঞ্চিত পুণ্যধন।

মানুষের পাপ এত বড়, এত বৃহৎ, এমনই গভীর ও গুরুভার, পুণ্যাত্মাগণের পুণ্য এবং গঙ্গার আত্মশুদ্ধির ক্ষমতা সত্ত্বেও জলের কলুষ সম্পূর্ণ বিদুরিত হয় না। 

মাগো, মা গঙ্গা, সহস্র সহস্র বৎসরের সকল পাপ, সকল বিষ, সকল কলুষ ধারণ করতে করতে, বহন করতে করতে, তাঁর দেহ জ্বালাপোড়া করে। বিষের তীব্র দাহনে, মাগো, অই মাতৃদেহ জ্বালাপোড়া করে। তিনি তখন হয়ে ওঠেন উন্মাদিনী। পাগলিনী। কল্যাণী মাতৃদেবী, তাপাতপ-দূরকারিণী তিনি হয়ে ওঠেন নাশিনী, ধ্বংসা, প্রলাপময়ী, কাতরা। সকল সৃষ্টিকে তিনি আছড়ে আছড়ে ভাঙেন। গ্রাস করেন। আছাড়ি-পিছাড়ি খেতে খেতে এক পথ হতে অন্যতর পথ ধরে প্রবাহিত হয়ে যান। যেন, ভূমির সঙ্গে সংঘর্ষে কিছু-বা কমে যন্ত্রণা, কিছু-বা কমে দাহ। অতঃপর তিনি পুনর্বার হয়ে ওঠেন শাস্তা। প্রসন্না। কল্যাণী। আশীর্বাদের হাত প্রসারিত করে দেন ধরিত্রীর ওপর। 

তব তীর-ধীর-বায়ু হরিল কত-না আয়ু, 
কত আলো স্রোতোজলে মিলালো!
ভরি তব ভাঙা পাড় কত কোটি হাহাকার 
ভাঙা বুক রাঙা আঁখি ঘুমালো!
ভরা কোল করি খালি জননীরা আনে ডালি
যুগে যুগে মাগো তোরি অঙ্কে,— 
কত-না বালুর চর সে ব্যথায় উর্বর 
বলি-অঙ্কিত তট-পঙ্কে! 
অশ্রুপূত ও জল, পূত তব তটতল 
লুপ্ত করিয়া কত কীর্তি 
কত-না চিতার ছাই মিশাইয়া আছে, তাই 
পবিত্র তব তট-মৃত্তি। 

গঙ্গার ভৌগোলিক উৎপত্তি মধ্য-হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে। এই হিমবাহের পূর্বদিক থেকে এসেছে অলকানন্দার স্রোত, পশ্চিম থেকে এসেছে ভাগীরথী। দেবপ্রয়াগে দুই স্রোতধারা মিলিত হয়ে নাম নিয়েছে গঙ্গা।

গোমুখ সদৃশ গুহামুখ হতে গলিত তুষারধারা হিসেবে নেমে এসেছে ভাগীরথী। গোমুখ থেকে প্রায় আঠাশ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে তিব্বত হতে এসে ভাগীরথীর সঙ্গে মিলেছে জাড়গঙ্গা বা জাহ্নবী। এই মিলিত জলধারা বন্দরপুঞ্চ ও শ্রীকণ্ঠ গিরিখাতের ভিতর দিয়ে এসে মিশেছে কেদার হতে প্রবাহিত মন্দাকিনীর সঙ্গে। এই মিলনস্থল হল রুদ্রপ্রয়াগ। 

গঙ্গোত্রী থেকে বদরিনাথ পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে ভগীরথ, খড়গ এবং সতোপন্থ হিমবাহ উত্তর-পশ্চিমে প্রসারিত হিমবাহ ভগীরথের অবস্থান বর্তমানে গোমুখে, ইদানীং গোমুখ থেকেও তা সরে যাচ্ছে দূরে। একসময় এই হিমবাহ গঙ্গোত্রী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। 

গোমুখের নিকটে আছে একটি শিলাখণ্ড। তার নাম ভগীরথ শিলা। গঙ্গাবতরণের জন্য ওই শিলাখণ্ডে বসে তপস্যা করেছিলেন ভগীরথ। গঙ্গাকে স্তোক দিয়েছিলেন। পুণ্যাত্মার স্পর্শে, গঙ্গার দেহে থাকে যদি-বা কিছু কলুষ, দূর হবে। 

গোমুখের নিকটে আছে আরও একটি ছোট হিমবাহ। রক্তবর্ণ তার নাম। রক্তবর্ণ মিলিত হয়েছে গঙ্গোত্রী হিমবাহের সঙ্গে। গঙ্গোত্রী হিমবাহের দু’পাশে আছে মন্থনী, স্বচ্ছন্দ, গহন ও কীর্ণত হিমবাহ। এরপর নন্দনবনের কাছে, উত্তর-পূর্ব হতে এসে মিলেছে চতুরঙ্গী। 

এতসব পর্বতচূড়া এবং হিমবাহের জটিল বন্ধনী কোনও বিরাট পুরুষের জটাজুটেরই মতো লাগে। এই জটাজালের মধ্য হতেই শত পথে, শত ধারায় নেমে এসে গঙ্গা সহস্র নদীর সঙ্গে মিলিত হতে হতে চলেছে সাগর অভিমুখে। 

গঙ্গা গড়েছে ইতিহাস। গঙ্গা ইতিহাস গ্রাস করেছে। সে ভাঙে। সে গড়ে। সে ভাসায়। কত শোকাশ্রু ভরা তার দেহে। কত শোককাহিনি। আষাঢ় পেরিয়ে শ্রাবণ পড়েছে। দু’কূল ভরেছে তার। কোন রূপ ধরবে সে? কোন রূপ? 

রূপ যা-ই হোক, মানবহৃদয়ে গঙ্গা মাতৃস্বরূপিণী। মা যে সন্তানকে মারে, শাসন করে, শাস্তি দেয়—তার জন্য কি সন্তান মায়ের গলা জড়িয়ে ঘুমোয় না? তার গালে লেগে থাকে মায়ের দেওয়া শাস্তির জন্য অশ্ৰুদাগ। কিন্তু ঠোঁটে লেগে থাকে মাকে জড়িয়ে থাকা নিশ্চিন্ত ঘুমের প্রশান্তি। গঙ্গা তিনি, এক বিরাট শিশুর শাশ্বত মাতা। তিনি ত্রাণে আছেন। বিনাশে আছেন। এক হাতে সিকস্তি তুলে, অপর হাতে দিচ্ছেন পয়োস্তি। 

তাই আনি তব মাটি গড়ি নিজ দেবতাটি 
তোমারি সলিলে যবে পূজি মা! 
যুগে যুগে যত ব্যথা মানব পেয়েছে হেথা
তারি পূজা করি যে তা বুঝি না। 
তাই গাহি তব তীরে, তাই নাহি তব নীরে,
তাই চাহি ঘুমাতে ও কোলে মা! 
কল-কল কুলু-কুল্ এ ধারার কোথা মূল
কোথা কূল দিস যদি বলে মা!
বন্দি ত্রিকালজয়ী গঙ্গে মূর্তিময়ী—
অনন্ত-জীব-ব্যথা-প্রবাহ! 
অনাদি ও-ক্রন্দনে মিশাইনু ক্ৰন্দন এ,
বুঝে নে মা এ প্রাণের কী দাহ! 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *