১০২
যদিও আমার চোখে ঢের নদী ছিলো একদিন
পুনরায় আমাদের দেশে ভোর হ’লে,
তবুও একটি নদী দেখা যেতো শুধু তারপর;
কেবল একটি নারী কুয়াশা ফুরোলে
নদীর রেখার পার লক্ষ্য ক’রে চলে।
সূর্যের সমস্ত গোল সোনার ভিতরে
মানুষের শরীরের স্থিরতর মর্যাদার মতো
তার সেই মূর্তি এসে পড়ে।
সূর্যের সম্পূর্ণ বড়ো বিভোর পরিধি
যেন তার নিজের জিনিস।
.
বৃষ্টি হয়ে গেছে গতরাতে। বিকেল হতে নেমে সারারাত সজল গম্ভীর বৃষ্টি। মৃত্তিকা হৃদিভরে শুষে নিয়েছে সেইসব। বৃক্ষপত্রগুলি সবুজের ঋজুতায় বিভাসিত। মানব এবং মানবেতর প্রাণীদের রুখু দেহে কী এক আরাম ওই বৃষ্টি হতে, কী এক জুড়িয়ে যাওয়া—আবালবৃদ্ধবনিতা ভিজেছিল বৃষ্টিতে। দু’হাত ছড়িয়ে মাথায় মুখে ঘাড়ে বুকে মেখেছিল বৃষ্টিজল। আঃ! বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি! কী সুন্দর! কী কল্যাণ! সকলের প্রাণের আবেগ তাতে মিশে যায়।
এসো এসো এসো বর্ষা, এসো মেঘ, দাও বর্ষণ দাও, দাও কৃষিজীবী মানুষেরে ফলনের আবাদের শ্যামল আশিস।
এবং মৃত্তিকা সে, শুষে নিল সব জল। একটানে শুষে নিল। নীরস রুক্ষ ঠোঁটে শুষে নিল, যেভাবে, বিরহশেষে, মিলনের নিবিড়তম কালে নর-নারী শুষে নয়, শুষে নেয়, চোষে, চোষণ করে পারস্পরিক অধর ও ওষ্ঠ পারাবার।
এই বৃষ্টিতে সিদ্ধার্থ গিয়েছিল ছাতে। ভিজছিল। ভেজার আহ্বান দিয়েছিলেন বোধিসত্ত্ব তাকে। শৈশব কৈশোর হতে যেমন সে সাড়া দেয়, দিয়েছিল।
—চলো ভিজি।
—চলো।
ছাতে এসেছিল তারা। দাঁড়িয়েছিল পাশাপাশি। সিদ্ধার্থ সে, তার শৈশবের চপলতা নেই, কিন্তু আনন্দ রয়েছে। রাশি রাশি মেঘপুঞ্জের দিকে তাকিয়ে সরল হাসছে সে! এবং বোধিসত্ত্ব হাসছেন। তাদের খোলা কাঁধ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জলবিন্দু। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে বোধিসত্ত্বের মাথাভর্তি সাদা চুল। আজ সিদ্ধার্থর ঘরে তিনি রেখেছেন রেকাবে ভরে একগুচ্ছ সাদা দোলনচাঁপা। তারই সুগন্ধ মিশে আছে মেঘমন্দ্রিত তরঙ্গরেখায়।
সাবিত্রী ছাতে এসে দাঁড়ালেন। কিছুটা তফাতে দাঁড়িয়ে তিনি ভিজছেন আপাদমস্তক। বৃষ্টি তাঁরও হৃদয়ে-মনে দিয়েছে তরঙ্গদোলা।
বোধিসত্ত্ব সাবিত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন—হে নারি! অয়ি রমণীরতন! তোমার সাহস
তো কম নয়!
সাবিত্রী সচকিত।
—কেন বড়বাবু!
বোধিসত্ত্ব বলছেন—আমরা বড়বাবু ছোটবাবু দুইপুরুষ এখানে দাঁড়িয়ে আছি! এই রোমান্টিক বর্ষণে! আর তুমি একাকিনী এসে দাঁড়িয়েছ!
সাবিত্রী ঝাঁঝিয়ে উঠছেন—তাতে কী! আমি দাঁড়াব না কেন? রোমান্টি বর্ষা কি আপনার একার?
সিদ্ধার্থ হাসছে। সে বুঝতে পারছে, শুরু হল বোধিসত্ত্বের রস-রসিকতা। দাদুর এই গুণ সে লাভ করেনি। বরং সে পিতারই মতো সদাই গভীর ভাবনতলে ডুবে থাকা। কলেজে তার বন্ধুরা তার নাম দিয়েছিল হুঁকো। কেজো বস্তু। রসে ভরা। কিন্তু সে রস হল তামাকের গন্ধ ভরা তিতকুটে জল। নারীকুল তার স্বাদ নিতে গেলে হতাশ হবে।
কোনও নারী আজও তাকে কাঙ্ক্ষী করেনি। চিত্ত পিপাসিত রে—এই আহ্বান চিত্ত হতে আজও আসেনি তার। রস নাই, রস নাই বলে কাঁদেনি এখনও তার দেহপারাবার। কৈশোর মুকুলিত হলে যে-উন্মোচনে নারী ভাল লাগে, সে-কালে সে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে দেখেছিল দল, রাজনীতি, ক্ষমতা। দেখেছিল দেশ।
আরও বহু তরুণের মতোই প্রেম আসেনি আজও তার।
বোধিসত্ত্ব বলছেন তখন—না বাপু। ‘রোমান্টি’ বর্ষা তোমারও। কিন্তু নারী তুমি, তোমার ওই সিক্তবসনা রূপে যদি আমাদের দাদু-নাতির চোখ আটকে যায় তা হলে আমাদের লাম্পট্য নিয়ে প্রশ্ন তুলো না।
—ওঃ বড়বাবু! আপনার শুধু ইয়ার্কি!
—তবে ভয়ের কিছু নেই।
—কী?
—তুমি গুরুশ্রোণী, পীনোদ্ধতা কিন্তু ক্ষীণকটি নও বলে সিক্তবসনে রূপ পুরোপুরি খুলবে না।
হাসির দমকে কাঁপছিল সিদ্ধার্থ। সাবিত্রী ভ্রূকুটি নিয়ে তাকিয়েছিলেন। সেই ভ্রূ-জটিলতার মধ্য দিয়ে নেমে আসছিল জলবিন্দু। ছদ্মকোপমাখা তাঁর প্রশ্রয়ের হাসিতে ছিল সুনিবিড় আনন্দসমারোহ। তিনি বলছেন—কী যে বলেন! বুঝি না ছাই! রোমান্টি বর্ষা আপনার মাথা খারাপ করেছে।
বোধিসত্ত্ব বললেন—হ্যাঁ। তার সঙ্গে বুড়ো হাড়ে শীতও ধরিয়েছে। প্রেয়সি! তুমি যদি নীচে গিয়ে আদ্রকযুক্ত চা করো, তা হলে এই রোমান্টিক বুড়োটার প্রাণ বাঁচে।
মাথা ঝাঁকিয়ে ‘মরণ’ বলে মুখে আঁচল চাপা দিলেন সাবিত্রী। আর বিদ্যুৎ ঝলসাল। সেই মুহূর্তে খোঁপা খুলে গেল তাঁর। মুহূর্তে কেজো মধ্যবয়সিনী সাবিত্রী শ্রীময়ী লাবণ্যবতী হয়ে উঠলেন। তাঁকে দেখাল অপরূপা। সেই রূপসী মুহূর্তের দিকে চেয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল দু’টি পুরুষ। বোধিসত্ত্ব ভাবলেন, আমার যদি মেয়েসন্তান থাকত একটি, সে এমনই হত। সিদ্ধার্থ ভাবল, যদি দিদি থাকত আমার একজন!
তাঁদের স্তম্ভিতই রেখে সাবিত্রী চলে গেলেন নীচে। আর বৃষ্টি ধরে এল। উথালি হাওয়ায় সরে যেতে লাগল মেঘ। সিদ্ধার্থ বলল— ঘরে যাও দাদু, ঠান্ডা লাগবে তোমার।
—না। ভাল লাগছে। পৃথিবীকে অনুভব করে নিই যতদিন পারি। দু’ফোঁটা ওষুধ না হয় খেয়ে নেওয়া যাবে।
সিদ্ধার্থ কিছু বলল না। বিষণ্ণ হয়ে গেল সে। বোধিসত্ত্বের কথায় মাঝে মাঝেই এসে যাচ্ছে শেষের আহ্বান। পালসেটিলা, কার্বো ভেজ, নাক্স ভমিকা, ব্রায়োনিয়া, সিমিসিফিউগা, আর্নিকার বিপুল মহৌষধি জগৎ তাঁর মৃত্যুচিন্তাকে দূরে রাখতে পারেনি। সে নিবিড় দেখছিল মানুষটাকে। শোকে দগ্ধ অথচ কী আশ্চর্য সজীব! আর বোধিসত্ত্ব উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন তখন। শিশুর মতো হাততালি দিয়ে উঠলেন। এই বর্ষণের বৈকালে পুব আকাশে ইন্দ্রধনুর ছটা। কালো মেঘের ওপর সেজে উঠেছে দু’টি বর্ণময় জোড়া ধনুক। অপরূপ লাগছে এ আকাশ। এই চরাচর। সিক্ত গাছগুলি যেন লেগে আছে মেঘের কিনারায়। বালিকার চুলভর্তি ঝাঁকড়া সৌন্দর্যে এঁটে বসা হেয়ারব্যান্ডের মতো গাছের ঝাঁকড়া চুলে রঙের ইন্দ্রধনুক।
বোধিসত্ত্ব বলছেন—দেখো জোড়া-রামধনু! সাবিত্রীকে ডাকো! কখন মিলিয়ে যায়!
সিদ্ধার্থ ডাকছে—সাবিত্রীদি, সাবিত্রীদি! এসো।
—কী কী কী হল?
সাবিত্রী ছুটে আসছেন।
—ইন্দ্ৰধনু দেখো! ইন্দ্ৰধনু!
সাবিত্রী দাঁড়িয়ে আছেন ওই বর্ণচ্ছটার পানে চেয়ে। বলছেন—আমার মেয়েটা রামধনু বড় ভালবাসত ছোটবেলায়। রামধনুকে বলত আমধনু। আমি তো অমন কথা বলি না। আমার শাশুড়ি বলত ওইরকম। রামকে আম। রাজাকে আজা।
বোধিসত্ত্ব বললেন—আর তোমার এই ছোটবাবু কী বলত জানো ছোটবেলায়?
—কী?
—বায়না করত, দাদুকেই তো সামলাতে হত বায়না সব, বলত, ‘ইন্দ্ৰধনু পেড়ে দাও। দাও। দিতেই হবে।’ আমি ওকে কোলে নিয়ে এই ছাতে আসতাম। বলতাম, ‘হাত বাড়াও। ইন্দ্রধনু ধরা দেবে।’ হাত বাড়িয়ে দিতাম দু’জনেই। সরল বিশ্বাসে ও চেয়ে থাকত। কখন ইন্দ্রধনু ধরা দেয়। এক সময় ইন্দ্রধনু ফুরিয়ে যেত। মিলিয়ে যেত আকাশের গায়ে। ও কাঁদত তখন। ‘কই! ধরা দিল না!’ আমি বলতাম, ‘দেবে।’ ও বায়না করত, ‘তা হলে বাজার থেকে এনে দাও।’
সাবিত্রী হাসছিলেন। বোধিসত্ত্ব তাকিয়েছিলেন সিদ্ধার্থর দিকে, স্নেহময়। সাবিত্রী বলছিলেন—পুবের ধনু ভাল।
সিদ্ধার্থ বলেছিল—কীরকম?
—জানো না? খনার বচন আছে। পশ্চিমের ধনু নিত্য খরা। পুবের ধনু বর্ষে ধারা।
সে জিগ্যেস করেছিল—তাই! আর কী জানো তুমি?
সাবিত্রী লজ্জা পেয়েছিলেন—ওমা! আমি একা নাকি? এ তো সকলে জানে।
—আমি তো জানি না।
—বেটাছেলে মানুষ তুমি, তাই জানো না। মেয়েছেলেরা জানে।
—বলো না দু’একটা।
বার দিয়ে সম্বৎসরের ফসল বোঝা যায়। যেমন—
মধুমাসে প্রথম দিনে হয় যেই বার।
রবি শোষে, মঙ্গল বর্ষে, দুর্ভিক্ষ বুধবার ॥
সোম শুক্র গুরু আর। পৃথ্বী সয় না শস্যের ভাগ ।।
পাঁচ শনি পায় মীনে। শকুনি মাংস খায় না ঘৃণে ॥
.
এমত অলস সময় বিরল তাদের। সে এবং বোধিসত্ত্ব, দু’জনেই যে-যার মতো ব্যস্ত। সংসার নিয়ে সাবিত্রীও কম ব্যস্ত নয়। অথচ এমন অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলি তাদের প্রত্যেকেরই বড় প্রিয়।
.
এখন, পেতনির চরের দিকে যেতে যেতে মুহূর্তকালের জন্য কালকের কথা তার মনে পড়ছিল। রাস্তায় কাদাভর্তি। ডিঙিনৌকোর মাঝির মুখে প্রসন্নতা। কারণ আসছে বর্ষাকাল, এমনই প্রত্যাশা। আবার ভরম্ভ হবে ভাগীরথী।
অনেক ভাবনা-চিন্তা করে তারা আজ পেতনির চরে যাচ্ছে। পেতনির চরের জন্য আরব্ধ কাজ সম্পন্ন করতে সে আগ্রহী। কিন্তু দলত্যাগ করেছে বলে পেতনির চরের মানুষ এই আন্দোলনে কতখানি সামিল হবে তা বোঝা দরকার। পেতনির চরের বিষয়টি এমনই অঞ্চলভিত্তিক যে, এই চরেরই অধিবাসী বিনা এ আন্দোলন করা সম্ভব নয়।
তৌফিক সঙ্গে তার। কিছু-বা প্রীত সে এখন। কারণ গতকালই, ওই মেঘপূর্ণ দিনে আদালতে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেয়েছে নিবেদিতা। বিশেষজ্ঞের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই আগুন লাগা দুর্ঘটনা মাত্র। হাফি এবং বাপি নামের লোক দু’টি তার চোর। তার-চুরির নজির বিরল তো নয়। তার-চুরি এবং দুর্ঘটনার জন্য পরোক্ষভাবে দায়ী, এই হিসেবে, তাদের জন্য বহাল থাকছে একটি পৃথক মামলা। পুলিশের দায় থাকছে তাদের গ্রেপ্তার করার। কিন্তু কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগ হতে মুক্তি পেয়েছে নিবেদিতা।
যদিও, এই সসম্মান মুক্তি সত্ত্বেও, নিবেদিতা নতুন করে স্কুল গড়ার কথা ভাবতেও পারবে না। তবে সে চেষ্টা করবে, স্কুলের বা কলেজের শিক্ষকতা পাবার জন্য।
তৌফিক প্রীত। মুক্তও কিছু-বা। নিবেদিতার আত্মপ্রতিষ্ঠার যোগ্যতা আছে। সে উপার্জনক্ষম হয়ে গেলে তৌফিকের পিছুটান কমে যাবে। যদি বিবাহ করে কখনও তারা, অন্তত স্ত্রীকে খাওয়ানোর দায় থেকে সে অব্যাহতি পাবে।
এই রায়ে সিদ্ধার্থ খুশি। কিন্তু প্রসন্ন নয়। নিবেদিতার অব্যাহতি তার কাম্য ছিল। কিন্তু তদুপরি সে চেয়েছিল ধরা পড়ুক হাফি আর বাপি। সে খোঁজ জারি রেখেছে অদ্যাবধি। পায়নি। তারই ভাবনার অনুরণনেই যেন, তৌফিক বলল— সিধুদা, নিবেদিতা একটা অদ্ভুত কথা বলছিল।
—কী?
—ওদের বাড়ির সামনে রাত্তিরে এসে বসে থাকে একটি পাগল।
—জানি।
—তুমি দেখেছ? কবে?
সিদ্ধার্থ সতর্ক হল। রাসুদা তার কাছে এসেছিলেন, সে কারওকে বলবে না কথা দিয়েছিল। সে বলল—সেদিন রাত্রে একা একা হাঁটছিলাম। তখন দেখেছি। আমাকে বলল, কোনও একটি গোপন কথা জানা আছে তার। বলতে চায়। আমি পাত্তা দিইনি।
তৌফিক বলল—হ্যাঁ হ্যাঁ! ওই একই কথা হেডস্যারকেও বলেছিল। নীচের সিঁড়ির ধাপে বসে কাঁদে। রাত্রে আসে। দিনে তাকে দেখা যায় না।
—সে তো হতেই পারে।
—নিবেদিতা বলছিল, পাগলটাকে ওর চেনা লাগে। কোনওদিন দেখেছিল। অনেক ভেবে
ওর মনে হয়েছে, এই পাগলটা সেই হাফি ও বাপির একজন হলেও হতে পারে।
—কী! নিবেদিতা ঠিক জানে!
—না। ঠিক জানে না। এর আগেও একে-ওকে দেখে ও বলেছে, ‘এ ঠিক ওই হাফি-বাপির মতো।’ আমি পাত্তা দিইনি। কারণ লোক দু’টো ওর মনে বিভীষিকা হয়ে আছে।
—কিন্তু তৌফিক, আমার মনে হচ্ছে, পাগলটাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার। ও কোনও গোপন কথা বলতে চায়।
পাড় এসে গিয়েছিল, তারা নামল নৌকা হতে। প্রথমে তারা যাবে হারাধনের বাড়ি। নারান মুদির হাতে কিছু টাকা দেবে সিদ্ধার্থ। তারপর যাবে হকসেদ মণ্ডলের কাছে। সেখানে সভা করবে। দুপুরের মধ্যে কাজ মিটে গেলে ফিরে যাবে বিকেল-বিকেল।
নিজের দোকানে উদাস হয়ে বসে ছিল নারান মুদি। দু’টি কোটরাগত চোখ। সমস্ত চুল সাদা। মুখে সাদা খোঁচা খোঁচা দাড়ি। তার বসে থাকার ভঙ্গিতে ক্লান্তি, নিরাসক্তি। সিদ্ধার্থকে দেখে সে-মুখে কোনও স্পন্দন লাগল না। সিদ্ধার্থ প্রণাম করতে চাইলে দু’হাঁটু বুকের কাছে জড়ো বাড়িয়ে দিল পা। তৌফিক এগিয়ে এলে, সে বলল—থাক, থাক
সিদ্ধার্থ কুশল জানতে চাইল—কেমন আছেন কাকা?
নারান মুদির নিরাসক্ত উত্তর—আছি।
সিদ্ধার্থ কালক্ষেপ করল না। কিছু টাকা হাতে নিয়ে বলল—এটা রাখুন।
—অ্যাঁ!
—সামান্য কিছু আছে। রাখুন।
নারান মুদি হাত বাড়াল।
—কে দিল? হারু?
—হ্যাঁ।
নারান মুদির চোখ দিয়ে জল পড়ছে। তোবড়ানো গাল বেয়ে, সাদা দাড়ি বেয়ে ঝরে পড়ছে দু’-চার ফোঁটা। সে বলছে—সুখ সইল না কপালে! বাঁচতে আর ভাল লাগে না!
মাথা নিচু করে রইল তারা। কী বলবে! কী বলা যায়! তবু জিগ্যেস করল—কাকিমা ভাল আছেন? নাড়ু, তারু সব?
—যাও বাড়িতে যাও। কাকিমা খুশি হবে।
তারা দোকান ছেড়ে বাড়ির দিকে গেল। আলতা ছাই দিয়ে বাসন মাজছিল উঠোনের কোণে বসে। তাদের দেখে উঠে এল। আরও শীর্ণ, আরও ফ্যাকাশে সে। চোখে ভাষা নেই কোনও সিদ্ধার্থর বুকে মোচড় দিয়ে উঠল তাকে দেখে। সে জিগ্যেস করল না—কেমন আছেন।
আলতা ঘরের শয্যায় বসাল তাদের। তারপর জিগ্যেস করল—আমার হারু কেমন আছে বাবা?
—ভাল আছে।
বলল সিদ্ধার্থ। আলতার দু’চোখে জল ভরে এল। বলল—জেলের মধ্যে আর ভাল কী থাকবে! কী জানি কী খায়! ওর কথা ভেবে আমার গলা দিয়ে ভাত নামে না বাবা! ওই ছোট মেয়েটা—সারাদিন বড়দাদা-বড়দাদা করে কেঁদে আকুল। এ আমাদের কী সর্বনাশ হল!
সিদ্ধার্থ আলতার বিলাপ থামাতে তৎপর হয়। বলে—শান্ত হোন। এখনও তো নিষ্পত্তি হয়নি। কেস চলছে।
আলতা কিছুক্ষণ মুখে আঁচল চেপে ফোঁপায়। সমস্ত শোক, দুর্ভাবনা, অসম্মান উপচে বেরোতে থাকে। ফ্যাকাশে কপাল সিঁদুরহীন। সিঁথিতে কাঁচা-পাকা চুলের মাঝে হালকা লালের আঁচড়। ওইটুকু ছাড়া পাথরচাপা ঘাসের মতো বিবর্ণ সব। তার শীর্ণ হাত সিদ্ধার্থ মুঠোয় নেয়। বলে—এখন শক্ত হওয়া দরকার কাকিমা।
—ভগবান নেয় না আমাকে। আর পারি না। আর কত যুদ্ধ করব? এত দুর্দশা গেছে। পেট ভরে খেতে পাইনি। তবু মনে হয় এমন দুর্দশা আগে কোনওদিন আসেনি। হারু আমাদের গর্বের ধন। সে কী করে এ কাজ…
সিদ্ধার্থ সময় দিতে চাইল আলতাকে। সে বুঝতে পারছে, এই মানুষটা কেঁদে হালকা হতে চায়। তৌফিক বাইরে গেল। আলতা বলল-বউমা কত ভাল মেয়ে। হারু কেন তাকে মারতে যাবে? লোকে ওর মাস্টারের বউকে জড়িয়ে কুকথা কইছে। সারা গ্রাম রাষ্ট্র হয়েছে। আমার বিশ্বাস হয় না। হারু কি আমার তেমন ছেলে? তবু কী অপমান! কী ছিছিক্কার! মেয়েটার বিয়ে হয়নি। কীভাবে ওই মেয়ে আমি পার করব?
মাথা নিচু করে রইল সিদ্ধার্থ। কচি এতক্ষণ কাছেই দাঁড়িয়ে নখ দিয়ে দেওয়াল খুঁটছিল। সরে গেল। তাকে দেখতে দেখতে বেতসলতা কথাটি মনে পড়ল সিদ্ধার্থর। কেন সে জানে না। সে বেতসলতা কোনওদিন দেখেনি।
আলতা বলল—ওকে কি খুব মারধোর করে?
সিদ্ধার্থ চমকে উঠল।
—মারধোর? কাকে?
—আমার হারুকে? মারে?
—না না। মারবে কেন?
ব্যাকুল নিবিড় দু’টি চোখ। মায়ের চোখ। সিদ্ধার্থর হৃদয় ব্যথিয়ে উঠল। সে নিজেও কিছু প্রাণনাশের জন্য দায়ী। তার জন্য কোনও অনুশোচনা নেই। বিনাশ জীবনের ধর্ম। সে আলতার দিকে তাকাল। তার কপালে স্বেদবিন্দু।
সে বলল—আমার ছেলে খুন করেনি।
চুপ করে রইল তারা। কী বলবে? কী বলার আছে?
—আমার ছেলে খুন করতে পারে না। আমি মা। আমি জানি। তুমি একটু পুলিশদের বলে দাও বাবা। তুমি বললে ওরা শুনবে।
সিদ্ধার্থ ম্লান হাসল। দুঃখের সে হাসি। অসহায়তার। বলল—সত্য প্রকাশ পাবে কাকিমা। ভাল উকিল দেওয়া হয়েছে হারাধনের জন্য।
—সত্যি বলছ? হারু ফিরে আসবে? চাকরিটা পাবে আবার?
—নির্দোষ প্রমাণিত হলে নিশ্চয়ই পাবে কাকিমা।
—ঠাকুর!
হাতজোড় করে কপালে ঠেকাল আলতা। বিড়বিড় করল—যেন হয়। যেন হয়।
সিদ্ধার্থ আনমনা হয়ে গেল। হারাধন হয়তো খুন করেনি। কিন্তু মৌসুমির ওপর অত্যাচার করেছিল! মৃত্যুর প্ররোচনা হিসেবে তার আচরণ দায়ভাগী। সে চায় না হারাধনের চরম শাস্তি হোক। কিন্তু এই মহিলা, হারাধনের মা আলতা যত নিষ্পাপ ভাবে ছেলেকে ততখানি তো নয় সো
আর আরেক মা, তিনি কী ভাবেন? কী করেন? সে আর যায়নি। সে জানে না। মৌসুমি একা-একা এ ঘর ও ঘর করেন। জানালার গ্রিলে গাল চেপে দাঁড়িয়ে ভাবেন সকল কথা। সকল ইতিহাস। ঘটনা। অস্বীকার। ভাবতে ভাবতে তাঁর কান্না পায়। তাঁর ক্রোধ জন্মায়। হতাশা জাগে। তিনি একা বিড়বিড় করেন—হারাধন, আমার হারাধন! কেন এমন হল? আমরা কি পাপ করলাম? পাপ?
তাঁদের সেই পরম প্রিয় শয্যায় গিয়ে গড়াগড়ি দেন তিনি। বালিশের গন্ধ শোঁকেন। চাদরের গন্ধ শোঁকেন। ওখানে, ওইখানে হারাধনের ঘ্রাণ লেগে আছে। একান্ত মুহূর্তগুলি তাঁকে দোলা দিয়ে যায়। শরীর পাগল-পাগল করে। তিনি বিড়বিড় করেন—কীসের পাপ? কীসের? ও তো আমার ছিল। আমারই। ও হারাধন! কেন এ কাজ করলি তুই? আমাকে পাবার জন্য? আমাকে পাবার জন্য তুই আমাকে হারালি?
তাঁর বুক ফেটে যেতে চায়। তবু স্বামীর কাছে, প্রতিবেশী পরিচিতের কাছে তিনি বলেন ওঃ! কী ভয়ানক ছেলে! দুধকলা দিয়ে কালসাপ পুষেছিলাম!
কালসাপ! ওই কালসাপের জন্য উন্মুখ তাঁর ইহকাল, পরকাল! কিন্তু কী করবেন তিনি নিরন্তর ভেবে চলা ছাড়া। তার পাশে দাঁড়ানো উচিত ছিল। কিন্তু দাঁড়ালে যে বিষের কলঙ্ক লাগত গায়ে। এই বয়সে, লোক জানাজানি হত যে! এখনও কানাঘুষো কম হচ্ছে না। তাকে আর কীভাবে তিনি ঠেকাতে পারতেন! অতএব অনিচ্ছাকৃত বিরুদ্ধাচারের গ্লানি তাঁকে তাড়া করে। পাপের ভয় তাঁকে তাড়া করে। মৌসুমির ক্রুদ্ধ মুখ দুঃস্বপ্নে দেখে তিনি জেগে ওঠেন। বিড়বিড় করেন—হারাধন, তোর পাপের ভাগী আমি। কলঙ্কের ভাগী হতে পারলাম না!
মাঝে মাঝে তিনি গঙ্গার পাড়ে চলে যান। জলে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন নিশ্চুপ। জ্বালা-পোড়া ধুয়ে দিক গঙ্গা এমনই অনুকম্পা তিনি প্রত্যাশা করেন! আর পাড়া-প্রতিবেশী, তাঁর বিমুখ কটূক্তি সত্ত্বেও বিবিধ কুকথা বলে আড়ালে। বিষের কলঙ্ক তাকে ঘিরে থাকে আপাদমস্তক। তিনি টেরও পান না।
—হারাধন তোকে আমার দেখতে ইচ্ছে করে।
বলেন তিনি।
—হারাধন, আয়, আবার আবার আমরা একসঙ্গে মরি আয়। বার বার মরি। কী করব আমি বল। কী করব। আমার যে ইচ্ছে করে!
বিড়বিড় করেন তিনি!
আবার ভয় করে তাঁর। আশঙ্কা হয়। যদি ফিরে আসে হারাধন! এ মুখ তিনি কী করে দেখাবেন! যদি সে বলে—মা! এই তোমার ভালবাসা!
—হারাধন! ও হারাধন! তুই আমার কে রে? তুই আমার কী কী কী!
—মা! আমি এক পুরুষ, তুমি এক নারীমাত্র!
এ সকলই অস্থিরতা একার। মৌসুমির একার। কারণ অসিতস্যার কঠিন চোখে দেখেছেন মৌসুমিকে। তাঁর দৃষ্টি আজও স্বাভাবিক হয়নি। সেই দৃষ্টিতে একটিই ভাষা—ছিঃ!
সেই ছিছিক্কারের কথা চার দেওয়ালের বাইরে আসে না। সিদ্ধার্থ জানে না তা। আলতা জানে না। আলতা কেবল ছেলে নিষ্পাপ ভেবে কাঁদে।
এবার সিদ্ধার্থর দিকে তাকাল সে। বলল—একটু সুখের মুখ দেখেছিলাম। জীবনে প্রথম। মেয়েটার জন্য সম্বন্ধ দেখছিলাম। সুপাত্র পেলে দিয়ে দেব। বাবা, তোমার তো কত জানাশোনা। নাডু-তারুকে কিছু করে দাও না। সংসারটা বাঁচে।
সিদ্ধার্থ ঠোঁট কামড়াল। এই পরিবারের জন্য কিছু করে দেওয়া সত্যি প্রয়োজন। কিন্তু হারাধনের ভাইয়েরা সেরকম লেখাপড়া শেখেনি। সে ভাবতে থাকল। আলতা বলল—চা করি?
—না। জল খাব।
তখন নাড়ু ঢুকল ঘরে। বলল—কেমন আছ সিদ্ধার্থদা?
—ভাল।
বসল সে। আলতা জল আনতে গেল। সিদ্ধার্থ বলল— কিছু করছ? কাজ-টাজ?
—নাঃ! কাজ কোথায়? গোটা বছর বৃষ্টি হয়নি। চাষও হয়নি। কোনও কাজ নেই।
—নাডু!
—বলো সিদ্ধার্থদা।
—যে-কোনও কাজ করতে তৈরি তোমরা?
—যে-কোনও মানে কী কাজ?
—যে-কোনও মানে যে-কোনও কাজ। দেখো, আমি মনে করি, যে-কোনও জীবিকাই সম্মানের, কারণ জীবিকা মানুষকে স্বনির্ভর করে। স্বাধীন করে।
—যে-কোনও কাজ করতে আমার আপত্তি নেই। তারুরও কোনও আপত্তি হবে না।
—তোমাদের দু’জনকে দু’টো রিকশার ব্যবস্থা করে দেব আমি। চালাবে?
—চালাব।
আলতা ফিরে এল জল নিয়ে। বলল—রিকশা চালাবে? তা কেন চালাবে না? ওরা তো হারুর মতো লেখাপড়া করল না। করলে বড় কাজ করতে পারত।
—কোনও কাজই ছোট নয় কাকিমা। নাড়ু, তোমরা এক সপ্তাহ পরে আমার বাড়িতে এসো।
—আচ্ছা।
আলতা বলল—বাবা, একটা কথা বলব?
—বলুন।
—একবার আমাকে জেলখানায় নিয়ে যাবে? হারুটাকে দেখতাম।
নাড়ু ধমক দিয়ে উঠল।
—তোমার যাবার কী আছে ওসব জায়গায়?
—ছেলেটাকে দেখব।
সিদ্ধার্থ দেখল, আলতার চোখে অসহায় আর্তি কী সুগভীর। তার মনে পড়ল মৌসুমির কথা হারাধন তার মৌসুমি মাকে দেখতে চেয়েছিল।
সে বলল—আমি নিয়ে যাব আপনাকে। নাড়ু, তোমরা মাকে সঙ্গে নিয়ো।
আলতার চোখে জল এল আবার। তাঁর মনে হল, এই ছেলে, এমন মহৎ প্রাণ, এ কি পারে না তার কচিকে পায়ে স্থান দিতে?