রস ও রমণী
মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দরবারে রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র ‘বিদ্যাসুন্দর’ পাঠ শেষ করার পরে নাকি রসরাজ গোপাল ভাঁড় কবিকে বলেছিলেন, ‘পুঁথিটা কাত করে রাখবেন না, রস গড়িয়ে পড়ে যাবে।’
গোপাল ভাঁড় বিদ্যাসুন্দরের যে রসের কথা বলেছিলেন, দুঃখের বিষয় এই পড়ন্ত যৌবনে সেই আদিরসের আলোচনায় যাওয়ার আমার সাহস নেই; রসিকা পাঠিকা আশা করি এই সামান্য কারণে রাগ করবেন না।
আসলে এই নিবন্ধের নাম হওয়া উচিত ছিল রসিকতা ও স্ত্রীলোক। কিন্তু সে বড় কাঠখোট্টা ব্যাপার হত। তার চেয়ে ‘রস ও রমণী’ নিশ্চয়ই ভাল।
প্রথমেই বলে রাখি মহিলাদের রসবোধ বিষয়ে যাদের মনে ক্ষীণতম সন্দেহ আছে, আমি কোনও অর্থেই সে দলের নই। আমার অকিঞ্চিৎ হালকা লেখাগুলি যাদের ভরসায়, যাদের সহাস্য সতৃপ্ত মুখশ্রী কল্পনা করে রচনা করি সেই মাননীয়াদের সরসতা সম্পর্কে আমার ধারণা খুব উঁচু।
কিন্তু আমি তো পৃথিবীর একমাত্র লোক নই, আমার আগে-পরে আমার সমান বা আমার চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান লোক না জন্মে থাকুন, আমার কাছাকাছি বুদ্ধিমান ব্যক্তি কিছু কিছু জন্মেছেন। তাঁদের মধ্যে একজন খারাপ কথা বলেছিলেন, বলা বাহুল্য তিনি মহিলা নন এবং তিনি এদেশীয় নন।
খারাপ কথাটা হল, ‘রসবোধ? মহিলাদের?’ এই দুটি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নের পরে তিনি যোগ করেছিলেন, ‘বোধই নেই, আবার রসবোধ! শুধুমাত্র মহিলারাই কেনে টেকো সেলসম্যানের কাছ থেকে চুল ওঠা বন্ধ করার সালসা।’
আর হাতের কাছেই আমাদের রসিকরঞ্জন সভার সভাপতি প্রমদারঞ্জন বালা তাঁর স্ত্রী সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘ভাই, তোমাদের বউদি, আমার ভদ্রমহিলা, সত্যিই প্রতিভাবতী, এতটা নিরেস ইচ্ছে করলে হওয়া যায় না। জন্ম-জন্মান্তরের সাধনা প্রয়োজন।‘
আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কার সাধনা প্রয়োজন? স্বামীর না স্ত্রীর?’ তিনি থমকে গিয়ে বোকা হাসি হেসে বললেন, ‘দু’জনারই।’
সুদূর প্রবাসে আমার এক ফাজিল লেখকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তার কাজ ছিল মেয়েদের কাগজে হালকা তথ্য পরিবেশন করা। তার রচনায় দেখেছিলাম, সেই নাবালক প্রতিবেদক বিখ্যাত রমণীদের ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস চার অঙ্কে দেয়। যেমন ৪০-৪০-২০-৪০- অথবা ৪৮-৩৬-২২-৩২, এই মাপের শেষ তিনটি মোটামুটি চেনা, সংশয় হয়েছিল প্রথম সংখ্যাটি নিয়ে। ‘ওটা আবার কী, ওটা কি মাথার মাপ।’
সেই রিপোর্টার বলেছিল, ‘ঠিকই ধরেছেন, ওটা মাথারই মাপ। তবে ওটা একটু সূক্ষ্ম ব্যাপার, ফিতে দিয়ে মাথার ঘের মাপা নয়, ওটা হল ওই সব মহিলাদের আই-কিউ।’
ব্যাপারটা নিতান্তই মোটা দাগের ঠাট্টা, কারণ সাধারণ বুদ্ধির যে কোনও পুরুষ মহিলার আই-কিউ (বুদ্ধির মাপ) যেখানে একশো ও তার কাছাকাছি সেখানে প্রমত্তা যৌবনবতীদের বুদ্ধির দৌড় মাত্র চল্লিশ হতে যাবে কেন? আর রসবোধের সূত্রে বুদ্ধি ব্যাপারটা কি সরাসরি আসে? বেশি বুদ্ধির বা বেশি বিদ্যার সঙ্গে সত্যিই কি রসবোধের কোনও মিল আছে? বিদুষী এবং বুদ্ধিমতী অজস্র রমণী আছেন যারা কখনও হাসেন না, কোনওদিন কিছুতেই হাসার কারণ খুঁজে পান না।
এই রকম এক নিরেস বিদুষী ব্যবহারজীবিনীর জেরার ধাক্কায় আমাকে পড়তে হয়েছিল একদা। উকিল মহিলার চলন-বলন, ধারালো নাক-চোখ, শ্যাম্পুলাঞ্ছিত আতেল কেশসম্ভার, চমৎকার ইংরেজি বুকনি আদালতে তাঁকে দেখে আমার মনে হয়েছিল, ইনি নিশ্চয় আমারই কোনও পাঠিকা।
মামলাটা ছিল এক পথ দুর্ঘটনার, দৈবক্রমে আমি ছিলাম সরকার পক্ষের মানে পুলিশের অন্যতম সাক্ষী। রাসবিহারী অ্যাভিনিউতে পণ্ডিতিয়ার মোড়ের কাছে একটা মিনিবাস ফুটপাথে উঠে গিয়েছিল অন্য একটি মিনিবাসের সঙ্গে জীবনপণ দৌড়ে; ফলে বেশ কয়েকজন পথচারী আহত হন। একটি তাম্বুলবিপণী ধরাশায়ী হয়। ভাগ্যক্রমে কয়েক মুহূর্ত আগেই আমি ওই বিপণী থেকে তাম্বুল সেবন করে, ধীরেসুস্থে সামনে এগোচ্ছিলাম। একটু এদিক-ওদিক হলে আমারও অবস্থা কাহিল হত।
আদালতের কাঠগড়ায় কঠোর দৃষ্টি হেনে মাননীয়া ব্যবহারজীবিনী আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘মিনিবাসটা যেখানে ফুটপাথে উঠেছিল বলে বলা হচ্ছে সেখান থেকে আপনি কতদূরে ছিলেন?’
বলাবাহুল্য আমি এ প্রশ্নের জন্যে প্রস্তুত ছিলাম, সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলাম, ‘তিন গজ এক ফুট পৌনে আট ইঞ্চি অর্থাৎ দশমিক প্রথায় তিন মিটার পঁচিশ সেন্টিমিটার দূরে ছিলাম।’
ভদ্রমহিলা অতি কুটিল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন, আমি খোলসা করে বললাম, ‘মেমসাহেব, ব্যাপারটা যত জটিল মনে হচ্ছে তা নয়। আপনার আর আমার উচ্চতা যোগ করলে যা হবে, প্রায় ততটাই।’
মেমসাহেব একটুও হাসলেন না, কঠিন কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এত সূক্ষ্ম হিসেব পেলেন কোথায়?’
আমি হাতজোড় করে বিনীতভাবে বললাম, ‘আমি অনুমান করেছিলাম, আপনি ওই দূরত্বের প্রশ্নটা করবেন। তাই সামনের দর্জির দোকান থেকে ফিতে চেয়ে নিয়ে ঠিকঠাক মেপে নিয়েছি।’
আমার আশাভঙ্গ হল। ব্যবহারজীবিনী মহোদয়া বিন্দুমাত্র হাসলেন না। কঠিনতর ইস্পাতশীতল বদনে আমাকে বললেন, ‘ইয়ার্কি করবেন না। এটা আদালত, ইয়ার্কি করার জায়গা এটা নয়।’
এরই পাশাপাশি মনে পড়ছে আমার এক বান্ধবীর ছোটমাসিকে। বান্ধবীর সূত্রে আমিও তাকে ছোটমাসি বলতাম। সেই সুবাদেই ছোটমাসির বিয়েতে নেমন্তন্ন খেলাম। বছর দেড়েকের মাথায় ছোটমাসি হাসপাতালে গেলেন বাচ্চা হতে। আমার সেই প্রিয় বান্ধবীর সঙ্গে হাসপাতালেও গেলাম নবজাতককে দেখতে।
চমৎকার ফুটফুটে ছেলে হয়েছে। একমাথা কুচকুচে কালো চুল, চিকন ভুরু, আবছায়া নীল চোখ, রসুনের কোয়ার মতো স্বচ্ছ ঠোঁট।
ছোটমাসিকে বললাম, কী মিষ্টি ছেলে হয়েছে আপনার।’
ছোটমাসি মিটমিট করে হেসে বললেন, ‘আমার ছেলে মিষ্টি হবে না তো কার ছেলে মিষ্টি হবে। জানো, আমার আর নীলকান্তের, মানে তোমার মেসোমশাইয়ের, দু’জনেরই ডায়াবেটিস, রক্তে সুগার দুশো, আড়াইশো। আমাদের বাচ্চা সুইট হবে না তো কী হবে? মেয়ে হলে মিস ইন্ডিয়া হত।’
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ রমণীদের রসবোধ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে ছিলেন। অনবদ্য ‘পঞ্চভূত’ নিবন্ধমালার কৌতুকহাস্য রচনায় পঞ্চভূতের শেষ ভূত ব্যোম বলেছিলেন, ‘পুরুষ জাতিকে পক্ষপাতী বিধাতা বিনা কৌতুকে হাসিবার ক্ষমতা দেন নাই, কিন্তু মেয়েরা হাসে কী জন্য তাহা দেবা ন জানন্তি কুতো মনুষ্যা।…মেয়েরা অল্প কারণে কাঁদিতে জানে এবং বিনা কারণে হাসিতে পারে; কারণ ব্যতীত কার্য হয়না জগতের এই কড়া নিয়মটা কেবল পুরুষের পক্ষেই খাটে।
বিষয়টি হাস্যময় হলেও ব্যোমের এই বক্তব্যের যথেষ্ট গুরুত্ব আছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটা সত্যি। প্রায় সমস্ত রমণী কেন হাসেন, কী কারণে হাসেন তা যেমন বোঝা যায় না তেমনই, সন্দেহ হয়, হয়তো তাঁরা নিজেরাও কখনও কখনও জানেন না।
বহুকাল, বিশেষ করে যুবক বয়সে পা দেয়ার পর থেকে আমার নিজের কেমন যেন সব সময়েই খটকা লাগত এই ভেবে যে মেয়েরা কেন আমাকে দেখলেই হাসে। আমি সব সময়ে ভেবেছি যে আমার চেহারায়, চরিত্রে বা আচরণে এমন কী আছে যে মহিলারা আমাকে দেখে হাস্য সংবরণ করতে পারেন না।
সবাই যে হো হো করে হাসেন তা নয়। কেউ কেউ বেশ সংযমী এবং রুচিশীলা, তাঁরা ঠোঁট টিপে চোখের কোণে হাসেন, অন্যেরা হয়তো শাড়ির আঁচল চাপা দিয়ে হাসি গোপন করার চেষ্টা করেন।
অবশেষে অনেকদিন পরে এখন কেমন করে যেন বুঝে গেছি, আমি একা কোনও ব্যতিক্রম নই, ওঁরা সকলকে দেখেই হাসেন। আমি একটি বেগুনি রঙের ফুলপ্যান্ট পরে একদিন আডডায় গিয়েছিলাম, বান্ধবী এবং বন্ধুপত্নীরা আমার রুচি দেখে হাসাহাসি করলেন।
পরেরবারে সাদা প্যান্ট পরে গেলাম, তাঁরা আমি বেগুনি প্যান্টটা পরে আসিনি বলে হাসলেন। এটা আমার ক্ষেত্রে এঁরা যেমন করলেন, আরও দশ জনের ক্ষেত্রেও তাই করে থাকেন, এই ধারণা আমার মনে এখন বদ্ধমূল হচ্ছে।
আমার স্বৰ্গতা জননীও ছিলেন সদাহাস্যময়ী। তিনি সদাসর্বদা কারণে-অকারণে হাসতেন। অত্যন্ত সব তুচ্ছ কারণে আমাদের পুরনো বাড়ির খোলা বারান্দায় আমার পিসিদের সঙ্গে, পরে কাজের লোক অথবা প্রতিবেশিনীদের সঙ্গে হেসে গড়িয়ে পড়তেন। মাছের ঝোলে নুন দিতে ভুলে যাওয়ার মধ্যে অথবা নতুন গামছা ধোয়ার সময় সমস্ত রং উঠে গেলে এবং সেই রং গায়ে মুখে লেগে গেলে এত কী হাসির ব্যাপার ছিল, আজও ভাবি।
আমার এক বাল্যসখী নিরন্তর হেসে যাচ্ছেন। তাঁর জীবনে শোক-দুঃখ, ঝড়-ঝাপটা আর দশজনের চেয়ে কিছু বেশিই এসেছে। অনেক দুঃখের দুর্দিনে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, তিনি আর কিছু না হোক অন্তত ম্লান হেসেছেন।
এসব হাসির জাত আলাদা। আমাদের এই নাতিশীতোষ্ণ রচনায় এসব কথা কেন যে এল, বরং রমণীয় রসিকতায় ফিরে যাই।
সেই মহিলাটির কথা নিশ্চয় সবাই জানে, যিনি আয়নার সামনে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে ছিলেন, খুব সম্ভব নিজেরই রূপে মোহিত হয়ে, কিন্তু তাঁকে যখন জিজ্ঞাসা করা হল, ‘এটা কী করছেন?’ তিনি বিলোল হাস্যে জবাব দিয়েছিলেন, ‘ঘুমোলে আমাকে কেমন দেখায় তাই দেখছি।’
আর এক রমণীর কথা বলি। তিনি উত্তর কলকাতার হাতিবাগানের এক থিয়েটার হল থেকে নাটকের মধ্যপথে দ্বিতীয় অঙ্কের বিরতির পরে উঠে আসেন। সম্ভবত তাঁর ভাল লাগেনি নাটকটা। তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘এই দুর্মূল্যের বাজারে পনেরো টাকা দামের টিকিট, নাটকটা অর্ধেক দেখে উঠে এলে?’
তিনি বললেন, ‘আবার দু’সপ্তাহ পরে যাব!’
‘এই নাটক দেখতে আবার দু’সপ্তাহ পরে?’
আমি অবাক হলাম। তিনি মৃদু হাস্যে থিয়েটারের প্রোগ্রামটি এগিয়ে দিয়ে এক জায়গায় আঙুল দিয়ে দেখালেন, সেখানে বড় অক্ষরে লেখা আছে, ‘দ্বিতীয় অঙ্ক বিরতি। তৃতীয় অঙ্ক দুই সপ্তাই পরে।’
আর একটা বাজে গল্প বলি।
এক উত্তুঙ্গ নৈশ সমাহারে সেদিন গিয়েছিলাম। আজকাল এসব পার্টিতে ঘুরেফিরে একটি সোনালি দরজা এবং তার বাস্তুকার শ্রীযুক্ত বিক্রম শেঠ নামে এক যুবকের কথা ওঠে। দেখা যায় সবাই তাকে চেনে, সবাই তার বই পড়েছে।
প্রসঙ্গক্রমে, যেমন হয়, বিক্রম শেঠ থেকে আলোচনা ইঙ্গভারতে পৌঁছাল, তারপর সুড়সুড় করে সেই অপূর্ব অপশ্চিম কিপলিং সাহেবে।
আমাদের ঠিক পাশেই সেই সময় একদল মহিলা এবং পুরুষ কী সব উলটোপালটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলেন। পরে জেনেছিলাম তাঁরা ব্যায়াম, শরীরচর্চা, ওজন কমানো ইত্যাদি ঐহিক বিষয়ে তর্ক করছিলেন। এই পরবর্তী জটলায় এক মহিলা প্রক্ষিপ্ত হয়ে আমাদের মধ্যে প্রবেশ করেছিলেন। বেশ সুন্দরী, বুদ্ধিমতী চেহারা।
আমার অপরিচিতা তিনি, কিন্তু আমাদের মধ্যে এসে তিনি কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন, এতে আমার একটু অস্বস্তি হল, আমি তাঁকে আলাপে প্রবৃত্ত করার জন্যে সরলভাবে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কিপলিং আপনার কেমন লাগে?’
আগের আলোচনার সুইমিং, জগিং, স্কিপিং তখনও বোধহয় মহিলার মাথায় ছিল, নাকি আমার সঙ্গে তিনি চরম রসিকতা করলেন, আমাকে সুললিত ইংরেজিতে বললেন, ‘দুঃখিত। বলতে পারব না। আমি কোনওদিন কিপল করিনি। (I have never kippled)।’ আমি খুব হেসেছিলাম সেদিন, যদিও মহিলা সত্যি কী বলতে চেয়েছিলেন তা আজও জানি না।
পুনশ্চ: অনেকদিন আগে সেই চিন-ভারত সংঘর্ষের যুগে কোথায় যেন অন্য এক আড্ডায় কথায় কথায় এক পরমা সুন্দরীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘রেড চায়না (Red China, লাল চিন) সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?’ তিনি সুরঞ্জিত ওষ্ঠ কিঞ্চিৎ স্ফূরিত করে খুব ধীরে ধীরে বলেছিলেন, ‘তা খারাপ নয়। তবে টেবলক্লথটা সাদা না হলে বড় ক্যাটকেটে দেখায়।’