রমণীর মন – সরোজকুমার রায়চৌধুরী
পঞ্জাব মেল আসানসোল স্টেশনে যখন থামল, তাতে তিল ধরবার জায়গা নেই। সুরেশ্বর মিথ্যে ছুটোছুটি করতে লাগল। তৃতীয় এবং মধ্যম শ্রেণীর যাত্রীরা হাঁফাচ্ছে। যারা বসে আছে তাদের অবস্থাও যেমন, যারা দাঁড়িয়ে আছে তাদেরও তেমনি।
তখন ভোর হতে দু’তিন ঘণ্টা দেরি। অনিদ্রায় এবং সারারাত্রির ধকলে সবাই ধুঁকছে। চোখ ছোট হয়ে এসেছে। গাড়ির দরজা পর্যন্ত লোকের ঠাসাঠাসি।
সুরেশ্বর করুণ কণ্ঠে আবেদন জানাল: আমাকে একটু ঢুকতে দিন। এ গাড়িতে না যেতে পারলে আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে।
কিন্তু সে আবেদন কারও কানে গেল বলে মনে হল না। অধিকাংশই নির্বিকার। নিজেকে সামলাতেই ব্যস্ত। অন্যের সর্বনাশের কথাও ভাববার সময় নেই। যাদের কানে আবেদন পৌঁছুল, তারা সর্বনাশের কথাটা বিশ্বাসই করলে না। ভিড়ের সময় ট্রেনে ওঠবার জন্যে অনেকেই অনেক সর্বনাশের দোহাই দেয়। তাদের অধিকাংশই মুখ ফিরিয়ে হাসল। কেউ-বা না-শোনার ভান করল। কেউবা মুখ ফুটেই মন্তব্য করল : এত যদি তাড়া, আগের ট্রেনে যাননি কেন? সুরেশ্বর তারও হয়তো একটা জবাব দিলে, কিন্তু সে কেউ শুনলে বলে মনে হল না।
অবশ্য সকলেই কিছু নির্মম লোক নয়। যাদের কিছু দয়া-মায়া আছে, সুরেশ্বরের আবেদনের উত্তরে তারাও করুণভাবে হাত জোড় করে জানালে, দরজাটা যে খুলি এমন জায়গাও খালি নেই।
কথাটা সত্যি। এবং সুরেশ্বরের সর্বনাশের কথাটাও মিথ্যে নয়। সুরেশ্বর তখন মরিয়া। প্রথম অথবা দ্বিতীয় শ্রেণীতে ওঠা ছাড়া তার উপায় নেই। কিন্তু সেখানেই বা প্রবেশের পথ কোথায়? উচ্চ শ্রেণীর যাত্রীরা ভিতর থেকে দরজা-জানালা বন্ধ করে সুখসুপ্ত।
সুরেশ্বর কয়েকটা দরজাতেই জোরে জোরে ধাক্কা দিলে। কিন্তু কেউ সাড়া দিলে না। হতাশভাবে ফিরে এসে আবার একটা দরজায় ধাক্কা দিতে মনে হল কে যেন দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। একটা জানালার খড়খড়ি যেন নেমে গেল।
—কে? কি চান?
রমণীর কণ্ঠস্বর।
সুরেশ্বর জানালার সামনে এসে দাঁড়াল। সকাতরে বললে, আমি অত্যন্ত বিপন্ন। এ গাড়িতে না যেতে পারলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। একটুখানি জায়গা চাই।
মহিলাটি নিঃশব্দে ওর দিকে চেয়ে রইল। জিজ্ঞাসা করলে, কত দূর যাবেন?
ব্যগ্রভাবে সুরেশ্বর উত্তর দিলে, কলকাতা। মানে হাওড়া।
—সঙ্গে আর কেউ আছে?
—আজ্ঞে না। আমি একলা।
সুরেশ্বর অস্থির হয়ে উঠেছে। ট্রেন ছাড়তে আর দেরি নেই। এক্ষুনি গার্ড হুইস্ল্ দেবে এবং মেল ট্রেন সঙ্গে সঙ্গে ছুটতে আরম্ভ করবে। তার সমস্ত দেহ চঞ্চল। যেন এক জায়গায় দাঁড়িয়েই ছুটছে।
মহিলাটি আরও কয়েক মুহুর্ত নিঃশব্দে তার দিকে চেয়ে রইল। সুরেশ্বরের চঞ্চল কাতর দৃষ্টি একবার গার্ডের গাড়ির দিকে একবার ড্রাইভারের এঞ্জিনের দিকে এবং আর একবার মহিলাটির দিকে ছুটোছুটি করছে।
মহিলাটি কি যেন ভাবলে। তারপরে দরজাটা খুলে দিলে। সঙ্গে সঙ্গে সুরেশ্বর বিদ্যুদ্বেগে ভিতরে ঢুকে পড়ল।
দুশ্চিন্তা এবং উদ্বেগে এই ভোরেও সুরেশ্বর ঘেমে উঠেছিল। বেঞ্চে বসে রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে এতক্ষণে সে ঘরের চারিদিকে চেয়ে দেখবার অবসর পেল।
যে বেঞ্চে সে বসেছে সেই বেঞ্চে একটি বছর ষোল-সতেরোর ছেলে। ফর্সা রং, ছিপছিপে লম্বা চেহারা। পরিধানে চমৎকার স্যুট। দিব্যি স্মার্ট দেখতে।
ওদিকের বেঞ্চে আর একটি ছেলে। বছর এগারো-বারো বয়স হতে পারে। সেটিও স্যুট-পরা। দাদার মতোই সুন্দর দেখতে। মায়ের গা ঘেঁষে বসে একদৃষ্টে আগন্তুকের দিকে চেয়ে আছে। তার চোখে কিছুটা কৌতূহল, কিছুটা বিস্ময়, কিছুটা বিরক্তি।
তারপরে মহিলাটি।
তার দিকে চেয়ে সুরেশ্বর থমকে গেল।
মহিলাটি অপলক তার দিকে চেয়ে রয়েছে। কৌতুকে চোখের তারা দুটি নাচছে। চোখের তারা সকল মেয়ের নাচে না। তার জন্যে চাই সূক্ষ্মাগ্র তির্যক ভ্রু , দীর্ঘপক্ষ্ম এবং আবেশ-বিহ্বল টানা চোখ।
সুরেশ্বর অনেক মেয়ে দেখেছে। কৌতুকে চোখের তারা কারও নাচত না। বাদে একজন। কিন্তু—
মহিলাটির ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি না?
সুরেশ্বর এবার লাফিয়ে উঠল : অমিতা না?
—চিনতে পেরেছ?
—না পারারই কথা। আজকের ব্যাপার তো নয়!
সুরেশ্বরের মুখে এবং কণ্ঠস্বরে অনেকখানি খুশি এবং অনেকখানি লজ্জা খেলে বেড়াতে লাগল।
অমিতা বললে, তোমার গলার স্বর শুনেই তোমাকে চিনেছি। দরজা খুলে দেখি, মূর্তিমান তুমি! কিন্তু তোমার তখন কারও দিকে দৃষ্টি দেবার সময় নয়। একটু বসতে পেলে বাঁচ।
লজ্জিত কণ্ঠে সুরেশ্বর বললে, যা বলেছ! কোথাও একফোঁটা জায়গা নেই। অথচ—
—অথচ বিপদটা কি!
সুরেশ্বরের মুখ হঠাৎ করুণ হয়ে গেল। বললে, আমার মেজ ছেলেটি, তাকে বোধ হয় দেখনি, যক্ষ্মা হাসপাতালে। রাত বারোটায় টেলিগ্রাম পেলাম, তার অবস্থা ভালো নয়।
—ও
সমবেদনায় অমিতার মুখও বিষন্ন হয়ে উঠল।
বললে, সুনীতিদিকে আনলে না?
—সে তো নেই। সে তো অনেকদিন হল নেই।
—তাই নাকি?
—হ্যাঁ।
—কি হয়েছিল?
সুরেশ্বরের মুখের উপর একটা কালো ছায়া খেলে গেল, যেটা অমিতার ভালো লাগল না। প্রসঙ্গটাকে এড়াবার জন্যে বললে, সে অনেক কথা অমিতা। আবার যদি কখনও দেখা হয় বলব।
ওর মনের ভাব অমিতা বুঝলে। একে সে অনেক দুঃখের বিনিময়ে খুব ভালো করেই চিনেছে। সুতরাং কিছুটা অনুমানও করতে পারলে। জেদ না করে তাই সে চুপ করে রইল।
একটু পরে সুরেশ্বর জিজ্ঞাসা করলে, তুমি কোথা থেকে আসছ এখন?
অমিতা হাসলে। বললে, অমৃতসর থেকে।
—এ দু’টি?
সুরেশ্বর ছেলে দুটির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে।
—আমার ছেলে।
উত্তর দিতে গিয়ে সুরেশ্বরের বিস্ময়বিমূঢ় চোখের দিকে চেয়ে অমিতার গাল দুটি আরক্তিম হয়ে উঠল।
ছেলে দুটির জন্যেই সুরেশ্বর নিজেকে সামলে নিল। সহজ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলে, আর কি খবর বল?
হেসে অমিতা জবাব দিলে, খবর তো অনেক। আবার দেখা হলে বলব
একটু চিন্তা করে সুরেশ্বর বললে, দেখা হবে। তুমি কোথায় উঠবে?
—প্রথমে ভেবেছিলাম, কোনো একটা হোটেলে উঠব।
—তারপরে?
—উনি বললেন, মাসখানেক থাকতে হতে পারে। তখন একটা বাড়ি ঠিক করাই ভালো। তাই থিয়েটার রোডের কাছাকাছি একটা বাড়ি ঠিক হয়েছে।
অমিতা রাস্তার নাম এবং নাম্বারটা বলে জিজ্ঞাসা করলে, তুমি তো নিজের বাড়িতেই উঠবে? কোথায় যেন সেটা?
সুরেশ্বর হাসলে। অত্যন্ত ম্লান হাসি। বললে, না, সেখানে উঠব না।
—কেন?
—সেটা বিক্রি হয়ে গেছে। সেও অনেক দিনের কথা। যাই হোক, ছেলেকে দেখে একদিন তোমার ওখানে নিশ্চয়ই যাব।
—নিশ্চয় এস। ভারি খুশি হব।
—সত্যি?
—সত্যি।
—অণ্ডাল এসে গেল। এবারে নামতে হবে। দেখি যদি কোথাও থার্ড ক্লাসে একটা দাঁড়াবার জায়গা পাই। হাওড়া স্টেশনে আবার দেখা হবে।
অমিতা কিছু বলবার আগেই সুরেশ্বর নেমে গেল।
সুরেশ্বরের চেহারা, সাজ-পোশাক এবং কথাবার্তায় অমিতা বুঝেছিল, খুব দুঃখের মধ্যেই তার দিন কাটছে। তৃতীয় শ্রেণীতে সুরেশ্বর ভ্রমণ করতে পারে এটা অচিন্তনীয়। তার কলকাতার বাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে। আছে এখন আসানসোলের বাড়িতে। আগে বছরে ছ’ মাস আসানসোলে আর ছ’ মাস কলকাতার বাড়িতে থাকত।
ধনী পিতামাতার একমাত্র সন্তান সুরেশ্বর। এই অবস্থায় অতিরিক্ত আদরে যা হয় সুরেশ্বরেরও তাই হয়েছিল। তার বিলাস-ব্যসন এবং বদখেয়ালের অন্ত ছিল না।
তার ঐশ্বর্যের চমকে বিভ্রান্ত হয়ে প্রথম যৌবনে অমিতা একদিন তার বদখেয়ালের স্রোতে কুটোর মতো ভেসে গিয়েছিল।
কুটোর মতো।
কী যে অমিতার হয়েছিল, নিজের বলে কিছুই যেন তার ছিল না। বাপ-মা, সঙ্গীসাথী, লেখাপড়া কিছুই তাকে বাঁধতে পারেনি। সে যেন একটা নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল। সে কি ভালোবাসায়, না ওর ঐশ্বর্যের চমকে, না ওর রূপে?
হ্যাঁ, রূপ বটে!
পুরুষের এত রূপ সে কখনও দেখেনি। দীর্ঘচ্ছন্দ বলিষ্ঠ চেহারা। প্রশস্ত ললাট, বড় বড় রক্তোৎপলের মতো চোখ আর কাঁচা সোনার মতো রং!
আর তেমনি অতুলনীয় অমিতব্যয়িতা। টাকা যেন হাতের ময়লা! বিন্দুমাত্র মমতা নেই তার উপর।
মমতা নেই নিজে ছাড়া আর কারও উপর, কিছুরই উপর। টাকা আসে অনভিনন্দিত, যায়ও তেমনি। মধ্যে যে আনন্দলোক সৃষ্টি হয় তার নিজের জন্যে সেইটেই বড় কথা।
নইলে একান্তভাবে তারই উপর নির্ভরশীল অসহায় কোনো মেয়েকে নিশ্চিন্তে হাওড়া স্টেশনে কেউ ফেলে যেতে পারে! শুধু সুরেশ্বরই পারে।
এবং পঞ্জাব মেল এক সময় সেই হাওড়া স্টেশনেই অমিতাদের নামিয়ে দিলে।
অমিতা চেয়ে দেখতে লাগল।
কত কাল পরে সেই হাওড়া স্টেশনে ফিরে এল সে! বড় ছেলের দিকে চেয়ে মনে-মনে হিসাব করে দেখলে আঠারো বৎসর। তখন তার বয়সও ছিল আঠারো। আজ ছত্রিশ।
কত পরিবর্তন হয়েছে হাওড়া স্টেশনের। না কি তার নিজের চোখেরই পরিবর্তন হল? আঠারো বছর বয়সের চোখ আর ছত্রিশ বছর বয়সের চোখ এক নয়। সেদিন আর এদিনও এক নয়। যেন দুটি পৃথক জন্মের দুটি দিন!
অমিতা চারিদিকে চেয়ে চেয়ে মনে করবার চেষ্টা করতে লাগল, ডাঃ অখিল নন্দীর সঙ্গে কোথায় দেখা হল। ওইখানে কি? যেখানে একটি বৃদ্ধ দম্পতি কতকগুলি ট্রাঙ্ক এবং বস্তা নামিয়ে কার জন্যে যেন অপেক্ষা করছেন?
হয়তো এ প্ল্যাটফর্মেই নয়। অন্য কোন প্ল্যাটফর্মে কে জানে! আঠারো বছর আগে কোন্ একটা অজ্ঞাত ট্রেন কোন্ প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়ত, আজ আর কাউকে জিজ্ঞাসা করেও জানবার উপায় নেই। অখিলের নিজেরই মনে নেই খুব সম্ভবত।
অথচ জানতে পারলে মনটা বড় ভালো হত। সেই জায়গাটিই তার বর্তমান জন্মের সূতিকাগার। সেইখানে নতুন করে অমিতার জন্ম হয়।
সূতিকাগার এবং সেই সঙ্গে শ্মশানও।
সেইখানে মরে গেল অমিতা মুখুয্যে। পুড়ে ছাই হয়ে গেল জন্ম নিলে অমিতা নন্দী। ছেলে দুটির দিকে চেয়ে তার মন যেন আরও জোর পেলে। হ্যাঁ, অমিতা নন্দী, মুখুয্যে নয়।
অথচ সে বুঝতে পারলে না, যে মেয়েটি নিজের শ্মশান নিজের চোখে দেখতে চায় সে অমিতা নন্দী নয়, মুখুয্যেই। অনেক কাল পরে তার বুকের মধ্যে আঠারো বছর বয়সের রক্ত টগবগ করে উঠেছে।
কিন্তু নিজের শ্মশান নিজের চোখে দেখার কি জো আছে! এই পৃথিবী যেন কী! নদীর স্রোতের মতো, মরুভূমির মতো। দাগ কেটে, চিহ্নিত করে কিছুই রেখে যাওয়া যায় না।
—চল মা।—বড় ছেলেটি তাগাদা দিলে।
—হ্যাঁ যাই।
অমিতার চোখ চারিদিকে কি যেন তখনও খুঁজছে।
সুরেশ্বর হন্তদন্ত হয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলে, সব নেমেছে? আর কিছু নেই তো?
গাড়ির ভিতর উঁকি দিয়ে উপর-নিচে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে সুরেশ্বর আশ্বস্তভাবে বললে, না। আর কিছুই নেই। চল এখন। এই কুলি!
কুলির মাথায় মোট চাপিয়ে আবার বললে, চল। একটা ট্যাক্সি ডেকে দিতে হবে তো?
অমিতা তথাপি নড়ে না।
—কি খুঁজছ? কিছু হারাল নাকি?—সুরেশ্বর এবার রীতিমত তাড়া দিলে।
নিশ্চল দাঁড়িয়ে অমিতা বললে, সেই জায়গাটা খুঁজছি।
—কোন জায়গাটা?
—অমিতা মুখুয্যে যেখানে মারা গেল।
কথাটা বুঝতেই সুরেশ্বরের এক মিনিট গেল। একঝলক কালো রক্ত মুখের উপর ছড়িয়ে পড়ল। বললে, সে কি আর মনে আছে?
ব্যগ্রভাবে অমিতা বললে, আমার মনে আছে। সে জায়গার প্রত্যেকটি বিন্দু আমার মনে গাঁথা আছে। দেখতে পেলেই চিনতে পারি।
কিন্তু চেনা দূরের কথা, কিছুই যে দ্বিতীয়বার দেখা যায় না, অমিতা মুখুয্যেকে সে কথা বোঝায় কে?
সুরেশ্বর দারুভূত। ছেলেটি অপরিচিত মহানগরীতে এসে হতভম্ব। তাড়া দিলে কুলিরা :
—চলিয়ে না। কেৎনা ঘড়ি খাড়া রহেগা?
হ্যাঁ। দাঁড়িয়ে থাকার জো নেই। চলতে হবে। ওরাও নিঃশব্দে চলতে লাগল।
১৩৬৫ (১৯৫৮)