1 of 2

রবিবার – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবিবার – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আমার গল্পের প্রধান মানুষটি প্রাচীন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত বংশের ছেলে। বিষয় ব্যাপারে বাপ ওকালতি ব্যবসায়ে আঁটি পর্যন্ত পাকা, ধর্মকর্মে শাক্ত আচারের তীব্র জারক রসে জারিত। এখন আদালতে আর প্র্যাকটিস করতে হয় না। একদিকে পূজা অর্চনা আরেকদিকে ঘরে বসে আইনের পরামর্শ দেওয়া এই দুটোকে পাশাপাশি রেখে তিনি ইহকাল পরকালের জোড় মিলিয়ে অতি সাবধানে চলেছেন। কোনোদিকেই একটু পা ফসকায় না। এই বকম নিরেট আচার-বাঁধা সনাতনী ঘরের ফাটল ফুঁড়ে যদি দৈবাৎ কাঁটাওয়ালা নাস্তিক ওঠে গজিয়ে, তাহলে তার ভিত-দেয়াল ভাঙা মন সাংঘাতিক শিকড়ের ঠেলা মারতে থাকে ইটকাঠের প্রাচীন গাঁথুনির উপরে। এই আচারনিষ্ঠ বৈদিক ব্রাহ্মণের বংশে দুর্দান্ত কালাপাহাড়ের অভ্যুদয় হোলো আমাদের নায়কটিকে নিয়ে। তার আসল নাম অভয়াচরণ। এই নামের মধ্যে কুলধর্মের যে ছাপ আছে সেটা দিল সে ঘষে উঠিয়ে। বদল ক’রে করলে অভীককুমার। তা ছাড়া ও জানে যে প্রচলিত নামুনার মানুষ ও নয়। ওর নামটা ভিড়ের নামের সঙ্গে হাট-বাজারে ঘেঁষাঘেঁষি করে ঘর্মাক্ত হবে সেটা ওর রুচিতে বাধে।

অভীকের চেহারাটা আশ্চর্য রকমের বিলিতি ছাঁদের। আঁট লম্বা দেহ গৌরবর্ণ, চোখ কটা, নাক তীক্ষ্ণ, চিবুকটা ঝুঁকেছে যেন কোনো প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভঙ্গিতে। আর ওর মুষ্টিযোগ ছিল অমোঘ, সহপাঠীরা যারা কদাচিৎ এর পাণিপীড়ন সহ্য করেছে তারা একে শতহস্ত দূরে বর্জনীয় ব’লে গণ্য করত।

ছেলের নাস্তিকতা নিয়ে বাপ অম্বিকাচরণ বিশেষ উদ্বিগ্ন ছিলেন না। মস্ত তাঁর নজির ছিল প্রসন্ন ন্যায়রত্ন, তাঁর আপন জ্যাঠামশায়। বৃদ্ধ ন্যায়রত্ন তর্কশাস্ত্রের গোলন্দাজ, চতুষ্পঠীর মাঝখানে বসে অনুস্বার-বিসর্গওয়ালা গোল দাগেন ঈশ্বরের অস্তিত্ববাদের উপরে। হিন্দু সমাজ হেসে বলে, “গোলা খা ডালা”, দাগ পড়ে না সমাজের পাকা প্রাচীরের উপরে। আচারধর্মের খাঁচাটাকে ঘরের দাওয়ায় দুলিয়ে রেখে ধর্মবিশ্বাসের পাখিটাকে শূন্য আকাশে উড়িয়ে দিলে সাম্প্রদায়িক অশান্তি ঘটে না। কিন্তু অভীক কথায় কথায় লোকাচারকে চালান দিত ভাঙা কুলোয় চড়িয়ে ছাইয়ের গাদার উদ্দেশে। ঘরের চারদিকে মোরগ-দম্পতিদের অপ্রতিহত সঞ্চরণ সর্বদাই মুখরধ্বনিতে প্রমাণ করত তাদের প্রতি বাড়ির বড়ো বাবুর আভ্যন্তরিক আকর্ষণ। এসমস্ত ম্লেচ্ছাচারের কথা ক্ষণে ক্ষণে বাপের কানে পৌঁছেছে, সে তিনি কানে তুলতেন না। এমন কি বন্ধুভাবে যে ব্যক্তি তাঁকে খবর দিতে আসত, সগর্জনে দেউড়ির অভিমুখে তার নির্গমন পথ দ্রুত নির্দেশ করা হোত। অপরাধ অত্যন্ত প্রত্যক্ষ না হোলে সমাজ নিজের গরজে তাকে পাশ কাটিয়ে যায়। কিন্তু অবশেষে অভীক একবার এত বাড়াবাড়ি করে বসল যে তার অপরাধ অস্বীকার করা অসম্ভব হোলো। ভদ্রকালী ওদের গৃহ-দেবতা, তাঁর খ্যাতি ছিল জাগ্রত ব’লে। অভীকের সতীর্থ বেচারা ভজু ভারি ভয় করত ঐ দেবতার অপ্রসন্নতা। তাই অসহিষ্ণু হয়ে তার ভক্তিকে অশ্রদ্ধেয় প্রমাণ করবার জন্যে পুজোর ঘরে অভীক এমন কিছু অনাচার করেছিল যাতে ওর বাপ আগুন হয়ে বলে উঠলেন—“বেরো আমার ঘর থেকে, তোর মুখ দেখব না।”এত বড়ো ক্ষিপ্রবেগের কঠোরতা নিয়মনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত বংশের চরিত্রেই সম্ভব।

ছেলে মাকে গিয়ে বললে,—“মা দেবতাকে অনেককাল ছেড়েছি, এমন অবস্থায় আমাকে দেবতার ছাড়াটা নেহাত বাহুল্য। কিন্তু জানি বেড়ার ফাঁকের মধ্য দিয়ে হাত বাড়ালে তোমার প্রসাদ মিলবেই। ঐখানে কোনো দেবতার দেবগিরি খাটে না, তা যত বড়ড়া জাগ্রত হোন না তিনি।”

মা চোখের জল মুছতে মুছতে আঁচল থেকে খুলে ওকে একখানি নোট দিতে গেলেন। ও বললে, “ঐ নোটখানায় যখন আমার অত্যন্ত বেশি দরকার আর থাকবে না তখনি তোমার হাত থেকে নেব। অলক্ষ্মীর সঙ্গে কারবার করতে জোর লাগে, ব্যাঙ্ক নোট হাতে নিয়ে তাল ঠোকা যায় না।”

অভীকের সম্বন্ধে আরো দুটো একটা কথা বলতে হবে। জীবনে ওর দুটি উলটো জাতের শখ ছিল, এক কলকারখানা জোড়াতাড়া দেওয়া, আর এক ছবি আঁকা। ওর বাপের ছিল তিনখানা মোটরগাড়ি, তাঁর মফস্বল অভিযানের বাহন। যন্ত্রবিদায় ওর হাতেখড়ি সেইগুলো নিয়ে। তা ছাড়া তার ক্লায়েন্টের ছিল মোটরের কারখানা, সেইখানে ও শখ করে বেগার খেটেছে, অনেকদিন।

অভীক ছবি আঁকা শিখতে গিয়েছিল সরকারি আর্টস্কুলে। কিছু কালের মধ্যেই ওর এই বিশ্বাস দৃঢ় হোলো যে, আর বেশিদিন শিখলে ওর হাত হবে কলে তৈরী, ওর মগজ হবে ছাঁচে ঢালা। ও যে আর্টিস্ট সেই কথাটা প্রমাণ করতে লাগল নিজের জোর আওয়াজে। প্রদর্শনী বের করলে ছবির, কাগজের বিজ্ঞাপনে তার পরিচয় বেরল আধুনিক ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ আর্টিস্ট অভীককুমার, বাঙালি টীশিয়ান। ও যতই গর্জন করে বললে আমি আর্টিস্ট, ততই তার প্রতিধ্বনি উঠতে থাকল একদল লোকের ফাঁকা মনের গুহায়, তারা অভিভূত হয়ে গেল। শিষ্য এবং তার চেয়ে বেশি সংখ্যক শিষ্যা জমল ওর পরিমণ্ডলীতে। তারা বিরুদ্ধদলকে আখ্যা দিল ফিলিস্টাইন। বলল বুর্জোয়া।

অবশেষে দুর্দিনের সময় অভীক আবিষ্কার করলে যে তার ধনী পিতার তহবিলের কেন্দ্র থেকে আর্টিস্টের নামের পরে যে রজতচ্ছটা বিচ্ছুরিত হোত তাবি দীপ্তিতে ছিল তার খ্যাতির অনেকখানি উজ্জ্বলতা। সঙ্গে সঙ্গে সে আরেকটি তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিল যে অর্থভাগ্যের বঞ্চনা উপলক্ষ্য করে মেয়েদের নিষ্ঠায় কোনো ইতরবিশেষ ঘটেনি। উপাসিকারা শেষ পর্যন্ত দুই চক্ষু বিাস্ফারিত করে উচ্চমধুর কণ্ঠে তাকে বলেছে আর্টিস্ট। কেবল নিজেদের মধ্যে পরস্পরকে সন্দেহ করেছে যে স্বয়ং তারা দুই একজন ছাড়া বাকি সবাই আর্টের বোঝে না কিছুই, ভণ্ডামি করে, গা জ্বলে যায়।

অভীকের জীবনে এর পরবর্তী ইতিহাস সুদীর্ঘ এবং অস্পষ্ট। ময়লা টুপি আর তেলাকালি মাখা নীল রঙের জামা ইজের পরে বার্ন কোম্পানির কারখানায় প্রথমে মিস্ত্রিগিরি ও পরে হেডমিস্ত্রির কাজ পর্য্যন্ত চালিয়ে দিয়েছে। মুসলমান খালাসিদের দলে মিশে চার পয়সার পরোটা আর তার চেয়ে কম দামের শাস্ত্রনিষিদ্ধ পশুমাংস খেয়ে ওর দিন কেটেছে সস্তায়। লোকে বলেছে, ও মুসলমান হয়েছে, ও বলেছে, মুসলমান কি নাস্তিকের চেয়েও বড়। হাতে যখন কিছু টাকা জমল তখন অজ্ঞাতবাস থেকে বেরিয়ে এসে আবার সে পূর্ণ পরিস্ফুট আর্টিস্টরূপে বোহেমিয়ানি করতে লেগে গেল। শিষ্য জুটল, শিষ্যা জুটল। চশমাপরা তরুণীরা তার স্টুডিয়োতে আধুনিক বেআব্রু রীতিতে যে সব নগ্ন মনস্তত্ত্বের আলাপ আলোচনা করতে লাগল, ঘন সিগারেটের ধোঁয়া জমল তার কালিমা আবৃত করে। পরস্পর পরস্পরের প্রতি কটাক্ষপাত ও অঙ্গুলিনির্দেশ করে বললে পজিটিভলি ভাল্‌গর।

বিভা ছিল এই দলের একেবারে বাইরে। কলেজের প্রথম ধাপের কাছেই অভীকের সঙ্গে ওর আলাপ শুরু। অভীকের বয়স তখন আঠারো, চেহারায় নবযৌবনের তেজ ঝকঝক করছে, আর তার নেতৃত্ব বড়ো বয়সের ছেলেরাও স্বভাবতই নিয়েছে স্বীকার করে।

ব্রাহ্ম সমাজে মানুষ হয়ে পুরুষদের সঙ্গে মেশবার সঙ্কোচ বিভার ছিল না। কিন্তু কলেজে বাধা ঘটল। তার প্রতি কোনো কোনো ছেলের অশিষ্টতা হাসিতে কটাক্ষে ইঙ্গিতে আভাসে স্ফুরিত হয়েছে। কিন্তু একদিন একটি শহুরে ছেলের অভদ্রতা বেশ একটু গায়ে-পড়া হয়ে প্রকাশ পেল। সেটা অভীকের চোখে পড়তেই সেই ছেলেটাকে বিভার কাছে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে এসে বললে, মাপ চাও। মাপ তাকে চাইতেই হোলো, নতশিরে আমতা আমতা করে। তারপর থেকে অভীক দায় নিল বিভার রক্ষাকর্তার। তা নিয়ে সে অনেক বক্রোক্তির লক্ষ্য হয়েছে, সমস্তই ঠিকরে পড়েছে তার চওড়া বুকের উপর থেকে। সে গ্রাহ্যই করেনি। বিভা লোকের কানাকানিতে অত্যন্ত সংকোচ বোধ করেছে কিন্তু সেই সঙ্গে তার মনে একটা রোমাঞ্চকর আনন্দও দিয়েছিল।

বিভার চেহারায় রূপের চেয়ে লাবণ্য বড়। কেমন করে মন টানে ব্যাখ্যা করে বলা যায় না। অভীক ওকে একদিন বলেছিল, “অনাহুতের ভোজে মিষ্টান্নমিতরে জনাঃ। কিন্তু তোমার সৌন্দর্য ইতর জনের মিষ্টান্ন নয়। ও কেবল আর্টিস্টের; লিওনার্ডো ডা ভিঞ্চির ছবির সঙ্গেই মেলে, ইনস্ক্রুটেবল।”

একদা কলেজের পরীক্ষায় বিভা অভীককে ডিঙিয়ে গিয়েছিল, তা নিয়ে তার অজস্র কান্না আর বিষম রাগ। এ যেন তার নিজের অসম্মান। বললে, “তুমি দিনরাত কেবল ছবি এঁকে এঁকে পরীক্ষায় পিছিয়ে পড়ো, আমার লজ্জা করে।”

কথাটা দৈবাৎ পাশের বারান্দা থেকে কানে যেতেই বিভার এক সখী চোখ টিপে বলেছিল, “মরি মরি, তোমারি গৱবে গরবিনী আমি, রূপসী তোমারি রূপে।”

অভীক বললে, “মুখস্থ বিদ্যার দিগ্‌গজেরা জানেই না আমি কোন্ মার্কাশূন্য পরীক্ষায় পাস করে চলেছি। আমার ছবি আঁকা নিয়ে তোমার চোখে জল পড়ে, আর তোমার শুকনো পণ্ডিতি দেখে আমার চোখের জল শুকিয়ে গেল। কিছুতেই বুঝবে না, কেননা তোমরা নামজাদা দলের পায়ের তলায় থাকো চোখ বুজে, আর আমরা থাকি বদনামী দলের শিরোমণি হয়ে।”

এই ছবির ব্যাপারে দুজনের মধ্যে তীব্র একটা দ্বন্দ্ব ছিল। বিভা অভীকের ছবি বুঝতেই পারত না সে কথা সত্যি।অন্য মেয়ে যখন ওর আঁকা যা-কিছু নিয়ে হইহই করত, সভা করে গলায় মালা পরাত, সেটাকে বিভা অশিক্ষিতের ন্যাকামি মনে করে লজ্জা পেত। কিন্তু তীব্র ক্ষোভে ছটফট করেছে অভীকের মন বিভার অভ্যর্থনা না পেয়ে। দেশের লোকে ওর ছবিকে পাগলামি বলে গণ্য করছে, বিভাও যে মনে মনে তাদেরি সঙ্গে যোগ দিতে পারলে এইটেই ওর কাছে অসহ্য। কেবলি এই কল্পনা ওর মনে জাগে যে, একদিন ও য়ুরোপে যাবে আর সেখানে যখন জয়ধ্বনি উঠবে তখন বিভাও বসবে জয়মাল্য গাঁথতে।

রবিবার সকালবেলা। ব্ৰহ্মমন্দিরে উপাসনা থেকে ফিরে এসেই বিভা দেখতে পেলে অভীক বসে আছে তার ঘরে। বইয়ের পার্সেলের ব্রাউন মোড়ক ছিল আবর্জনার ঝুড়িতে। সেইটে নিয়ে কালি কলমে একখানা আঁচড় কাটা ছবি আঁকছিল।

বিভা জিজ্ঞাসা করল, “হঠাৎ এখানে যে।” অভীক বললে, “সংগত কারণ দেখাতে পারি, কিন্তু সেটা হবে গৌণ, মুখ্য কারণটা খুলে বললে সেটা হয়তো সংগত হবে না। আর যাই হোক সন্দেহ কোরো না যে চুরি করতে এসেছি।”

বিভা তার ডেস্কের চৌকিতে গিয়ে বসল, বললে,—“দরকার যদি হয় না হয় চুরি করলে, পুলিসে খবর দেব না।”

অভীক বললে, “দরকারের হাঁ-করা মুখের সামনে তো নিত্যই আছি। পরের ধন হরণ করা অনেক ক্ষেত্রেই পুণ্যকর্ম, পারি নে পাছে অপবাদটা দাগা দেয় পবিত্র নাস্তিক মতকে। ধার্মিকদের চেয়ে আমাদের অনেক বেশি সাবধানে চলতে হয় আমাদের নেতি দেবতার ইজ্জৎ বাঁচাতে।”

“অনেকক্ষণ তুমি ব’সে আছ?’

“তা আছি, বসে বসে সাইকলজির একটা দুঃসাধ্য প্রব্লেম মনে মনে নাড়াচাড়া করছি যে তুমি পড়াশুনো করেছ, আর বাইরে থেকে দেখে মনে হয় বুদ্ধিশুদ্ধিও কিছু আছে, তবু ভগবানকে বিশ্বাস করো কী করে! এখনও সমাধান করতে পারিনি। বোধ হয় বার বার তোমার এই ঘরে এসে এই রিসর্চের কাজটা আমাকে সম্পূর্ণ করে নিতে হবে।”

“আবার বুঝি আমার ধর্মকে নিয়ে লাগলে।” |

“তার কারণ তোমার ধর্ম যে আমাকে নিয়ে লেগেছে। আমাদের মধ্যে যে বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে সেটা মর্মঘাতী। সে আমি ক্ষমা করতে পারি নে। তুমি আমাকে বিয়ে করতে পারো না যেহেতু তুমি যাকে বিশ্বাস করো আমি তাকে করি নে, বুদ্ধি আছে বলে। কিন্তু তোমাকে বিয়ে করতে আমার তো কোনো বাধা নেই তুমি অবুঝের মতো সত্য মিথ্যে যাই বিশ্বাস করো না কেন। তুমি তো নাস্তিকের জাত মারতে পারো না। আমার ধর্মের শ্রেষ্ঠতা এইখানে। সব দেবতার চেয়ে তুমি আমার কাছে প্রত্যক্ষ সত্য একথা ভুলিয়ে দেবার জন্যে একটি দেবতাও নেই আমার সামনে।”

বিভা চুপ করে বসে রইল। খানিক বাদে অভীক বলে উঠল, “তোমার ভগবান কি আমার বাবারই মতো। আমাকে ত্যাজ্যপুত্র করেছেন?”

“আঃ কি বকছ!”

অভীক জানে বিয়ে না করবার শক্ত কারণটা কোনখানে। কথাটা বিভাকে দিয়ে বলিয়ে নিতে চায়, বিভা চুপ করে থাকে।

জীবনের আরম্ভ থেকেই বিভা তার বাবারই মেয়ে সম্পূর্ণরূপে। এত ভালবাসা, এত ভক্তি সে আর কোনো মানুষকে দিতে পারেনি। তার বাপ সতীশও এই মেয়েটির উপরে তাঁর অজস্র স্নেহ ঢেলে দিয়েছেন। তাই নিয়ে ওর মার মনে একটু ঈর্ষা ছিল। বিভা হাঁস পুষেছিল, তিনি কেবল খিটখিট করে বলেছিলেন, “ওগুলো বড্ড বেশি ক্যাঁক ক্যাঁক্ করে।” বিভা আসমানি রঙের শাড়ি জ্যাকেট করিয়েছিল, মা বলেছিলেন, “এ কাপড় বিভার রঙে একটুও মানায় না।” বিভা তার মামাতো বোনকে খুব ভালবাসত। তার বিয়েতে যেতে চাইলেই মা বলে বসলেন, “সেখানে ম্যালেরিয়া।”

মায়ের কাছে থেকে পদে পদে বাধা পেয়ে পেয়ে বাপের উপরে বিভার নির্ভর আরো গভীর এবং মজ্জাগত হয়ে গিয়েছিল।

মার মৃত্যু হয় প্রথমেই। তারপরে ওর বাপের সেবা অনেকদিন পর্যন্ত ছিল বিভার জীবনের একমাত্র ব্রত। এই স্নেহশীল বাপের সমস্ত ইচ্ছাকে সে নিজের ইচ্ছা করে নিয়েছে। সতীশ তাঁর বিষয়সম্পত্তি দিয়ে গেছেন মেয়েকে। কিন্তু ট্রাস্টির হাতে। নিয়মিত মাসোহারা বরাদ্দ ছিল। মোট টাকাটা ছিল উপযুক্ত পাত্রের উদ্দেশে বিভার বিবাহের অপেক্ষায়। বাপের আদর্শে এই উপযুক্ত পাত্র কে তা বিভা জানত। অন্তত অনুপযুক্ত যে কে তাতে কোনো সন্দেহ ছিল না। একদিন অভীক এ কথা তুলেছিল, বলেছিল, “যাঁকে তুমি কষ্ট দিতে চাও না, তিনি তো নেই, আর কষ্ট যাকে নিষ্ঠুরভাবে বাজে, সেই লোকটাই আছে বেঁচে। হাওয়ায় তুমি ছুরি মারতে ব্যথা পাও, আর দরদ নেই এই রক্ত-মাংসের বুকের ’পরে।” শুনে বিভা কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল। অভীক বুঝেছিল, ভগবানকে নিয়ে তর্ক চলতে পারে, কিন্তু বাবাকে নিয়ে নয়।

বেলা প্রায় দশটা। বিভার ভাইঝি, সুস্মি এসে বললে,—“পিসিমা, বেলা হয়েছে।” বিভা তার হাতে চাবির গোছা ফেলে দিয়ে বললে, “তুই ভাঁড়ার বের করে দে। আমি এখুনি যাচ্ছি।”

বেকারদের কাজের বাঁধা সীমা না থাকাতেই কাজ বেড়ে যায়। বিভার সংসারও সেইরকম। সংসারের দায়িত্ব আত্মীয়পক্ষে হালকা ছিল বলেই অনাত্মীয়পক্ষে হয়েছে বহুবিস্তৃত। এই ওর আপন গড়া সংসারের কাজ নিজের হাতে করাই ওর অভ্যাস, চাকর-বাকর পাছে কাউকে অবজ্ঞা করে। অভীক বললে, “অন্যায় হবে তোমার এখনি যাওয়া, কেবল আমার ’পরে নয়, সুস্মির ’পরেও। ওকে স্বাধীন কর্তৃত্বের সময় দাও না কেন। ডোমিনিয়ন স্টাটাস, অন্তত আজকের মতো। তা ছাড়া আমি তোমাকে নিয়ে একটা পরীক্ষা করতে চাই, কখনো তোমাকে কাজের কথা বলিনি। আজ বলে দেখব। নতুন অভিজ্ঞতা হবে।”

বিভা বললে, “তাই হোক, বাকি থাকে কেন।”

পকেট থেকে অভীক চামড়ার কেস বের করে খুলে দেখালে। একটা কব্‌জি-ঘড়ি। ঘড়িটা প্লাটিনমের, সোনার মণিবন্ধ, হীরের টুকরোর ছিট দেওয়া। বললে, “তোমাকে বেচতে চাই।”

“অবাক করেছ, বেচবে?”

“হাঁ, বেচব, আশ্চর্য হও কেন।”

বিভা মুহূর্তকাল স্তব্ধ থেকে বললে, “এই ঘড়ি যে মনীষা তোমাকে জন্মদিনে দিয়েছিল। মনে হচ্ছে, তার বুকের ব্যথা এখনো ওর মধ্যে ধুকধুক করছে। জানো সে কত দুঃখ পেয়েছিল, কত নিন্দে সয়েছিল আর কত দুঃসাধ্য অপব্যয় করেছিল উপহারটাকে তোমার উপযুক্ত করবার জন্যে?”

অভীক বললে, “এ ঘড়ি সেই তো দিয়েছিল, কে দিয়েছে শেষ পর্যন্ত জানতেই দেয়নি। কিন্তু আমি তো পৌত্তলিক নই যে বুকের পকেটে এই জিনিসটার বেদী বাঁধিয়ে মনের মধ্যে দিনরাত শাঁখ ঘণ্টা বাজাতে থাকব।”

“আশ্চর্য করেছ তুমি। এই ক-মাস হোলো সে টাইফয়েড—”

“এখন সে তো সুখ-দুঃখের অতীত।”

“শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সে এই বিশ্বাস নিয়ে মরেছিল যে তুমি তাকে ভালবাসতে।”

“ভুল বিশ্বাস করে নি।”

“তবে?”

“তবে আবার কী। সে নেই, কিন্তু তার ভালবাসার দান আজো যদি আমাকে ফল দেয় তার চেয়ে আর কী হোতে পারে।”

বিভার মুখে অত্যন্ত একটা পীড়ার লক্ষণ দেখা দিল। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললে, “এত দেশ থাকতে আমার কাছে বেচতে এলে কেন।”

“কেননা জানি তুমি দর কষাকষি করবে না।”

“তার মানে কলকাতার বাজারে আমিই কেবল ঠকবার জন্যে তৈরি হয়ে আছি?”

“তার মানে ভালবাসা খুশি হয়ে ঠকে।”

এমন মানুষের পরে রাগ করা শক্ত, জোরের সঙ্গে বুক ফুলিয়ে ছেলেমানুষি। কিছুতে যে লজ্জার কারণ আছে তা যেন ও জানেই না। এই ওর অকৃত্রিম অবিবেক, এই যে উচিত অনুচিতের বেড়া অনায়াসে লাফ দিয়ে ডিঙিয়ে চলা, এতেই মেয়েদের স্নেহ ওকে এত করে টানে। ভর্ৎসনা করবার জোর পায় না। কর্তব্যবোধকে যারা অত্যন্ত সামলে চালে মেয়েরা তাদের পায়ের ধুলো নেয়। আর যেসব দুর্দাম দুরন্তের কোনো বালাই নেই ন্যায়-অন্যায়ের, মেয়েরা তাদের বাহুবন্ধনে বাঁধে।

ডেস্কের ব্লটিঙ কাগজটার উপর খানিকক্ষণ নীল পেনসিলের দাগ কাটাকাটি করে শেষকালে বিভা বললে, “আচ্ছা যদি আমার হাতে টাকা থাকে, তবে অমনি তোমাকে দেব। কিন্তু তোমার ঐ ঘড়ি আমি কিছুতেই কিনব না।”

উত্তেজিত কণ্ঠে অভীক বললে, “ভিক্ষা? তোমার সমান ধনী যদি হতুম, তাহলে তোমার দান নিতুম উপহার বলে, দিতুম প্রত্যুপহার সমান দামের। আচ্ছা পুরুষের কর্তব্য আমিই বরঞ্চ করছি। এই নাও এই ঘড়ি, এক পয়সাও নেব না।”

বিভা বললে, “মেয়েদের তো নেবারই সম্বন্ধ। তাতে কোনো লজ্জা নেই। তাই বলে এ ঘড়ি নয়। আচ্ছা শুনি, কেন তুমি ওটা বিক্রি করছ।”

“তবে শোনো, তুমি তো জানো, আমার অত্যন্ত বেহায়া একটা ফোর্ড গাড়ি আছে। সেটার চালচলনের টিলেমি অসহ্য। কেবল আমি বলেই ওর দশম দশা ঠেকিয়ে রেখেছি। আট শো টাকা দিলেই ওর বদলে ওর বাপদাদার বয়সী একটা পুরোনো ক্রাইসলার পাবার আশা আছে। তাকে নতুন করে তুলতে পারব আমার নিজের হাতের গুণে।”

“কী হবে ক্রাইসলারের গাড়িতে।”

“বিয়ে করতে যাব না।”

“এমন ভদ্র কাজ তুমি করবে, এ সম্ভব নয়।”

“ধরেছ ঠিক। তাহলে প্রথমে তোমাকে জিজ্ঞাসা করি, শীলাকে দেখেছ, কুলদা মিত্তিরের মেয়ে?”

“দেখেছি তোমারই পাশে যখন তখন যেখানে সেখানে।”

“আমার পাশেই ও বুক ফুলিয়ে জায়গা করে নিয়েছে, আরো পাঁচজনকে ঠেকিয়ে। ও যে প্রগতিশীলা। ভদ্র সম্প্রদায়ের পিলে চমকে যাবে এইটেতেই ওর আনন্দ।”

“শুধু কি তাই, মেয়ে সম্প্রদায়ের বুকে শেল বিঁধবে তাতেও আনন্দ কম নয়।”

“আমারও মনে ছিল ঐ কথাটা, তোমার মুখে শোনাল ভাল। আচ্ছা মন খুলে বলো, ঐ মেয়েটির সৌন্দর্য কি অন্যায় রকমের নয়, যাকে বলা যেতে পারে বিধাতার বাড়াবাড়ি।”

“সুন্দরী মেয়ের বেলাতেই বিধাতাকে মানো বুঝি?”

“নিন্দে করবার দরকার হোলে যেমন করে হোক একটা প্রতিপক্ষ খাড়া করতে হয়। দুঃখের দিনে যখন অভিমান করবার তাগিদ পড়েছিল, তখন রামপ্রসাদ মাকে খাড়া করে বলেছিলেন,—তোমাকে মা বলে আর ডাকব না। এতদিন ডেকে যা ফল হয়েছিল, না ডেকেও ফল তার চেয়ে বেশি হবে না, মাঝের থেকে নিন্দে করবার ঝাঁজটা ভক্তি মিটিয়ে নিলেন। আমিও নিন্দে করবার বেলায় বিধাতার নাম নিয়েছি।”

“নিন্দে কিসের।”

“বলছি। শীলাকে আমার গাড়িতে নিয়ে যাচ্ছিলুম ফুটবলের মাঠ থেকে খড়খড় শব্দ করতে করতে, পিছনের পদাতিকের নাসারন্ধ্রে ধোঁয়া ছেড়ে দিয়ে। এমন সময় পাকড়াশি গিন্নি—ওকে জানো তো, লম্বা গজের অত্যুক্তিতেও ওকে চলনসই বলতে গেলে বিষম খেতে হয়।—সে আসছিল কোথা থেকে তার নতুন একটা ফায়াট গাড়িতে। হাত তুলে আমাদের গাড়িটা থামিয়ে দিয়ে পথের মধ্যে খানিকক্ষণ হাঁ-ভাই-ও ভাই করে নিলে। আর ক্ষণে ক্ষণে আড়ে আড়ে তাকাতে লাগল আমার রং-চটে-যাওয়া গাড়ির হুড আর জরাজীর্ণ পা-দানটার দিকে। তোমাদের ভগবান যদি সাম্যবাদী হতেন, তাহলে মেয়েদের চেহারায় এত বেশি উঁচু নিচু ঘটিয়ে রাস্তায় ঘাটে এ রকম মনের আগুন জ্বালিয়ে দিতেন না।”

“তাই বুঝি তুমি—”

“হাঁ, তাই ঠিক করেছি, যত শিগ্‌গির পারি শীলাকে ক্রাইসলাবের গাড়িতে চড়িয়ে পাকড়াশি গিন্নির নাকের সামনে দিয়ে শিঙা বাজিয়ে চলে যাব। আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, সত্যি করে বলো তোমার মনে একটুখানি খোঁচা কি—”

“আমাকে এর মধ্যে টানো কেন। বিধাতা আমার রূপ নিয়ে তো খুব বেশি বাড়াবাড়ি করেন নি। আর আমার গাড়িখানাও তোমার গাড়িখানার উপর টেক্কা দেবার যোগ্য নয়।”

অভীক তাড়াতাড়ি চৌকি থেকে উঠে মেঝের উপর বিভার পায়ের কাছে বসে তার হাত চেপে ধরে বললে, “কার সঙ্গে কার তুলনা। আশ্চর্য, তুমি আশ্চর্য, আমি বলছি, তুমি আশ্চর্য। আমি তোমাকে দেখি আর আমার ভয় হয় কোনদিন ফস করে মেনে বসব তোমার ভগবানকে। শেষে কোনোকালে আর আমার পরিত্রাণ থাকবে না। তোমার ঈর্ষা আমি কিছুতেই জাগাতে পারলুম না। অন্তত সেটা জানতে দিলে না আমাকে। অথচ তুমি জানো—”

“চুপ করো। আমি কিছু জানি নে। কেবল জানি অদ্ভুত, তুমি অদ্ভুত, সৃষ্টিকর্তার তুমি অট্টহাসি।”

অভীক বললে, “আমাকে মুখ ফুটে বলবে না, কিন্তু নিশ্চিত বুঝতে পারি, শীলার সম্বন্ধে তুমি আমার সাইকলজি জানতে চাও। ওকে আমার ঘোরতর অভ্যেস হয়ে যাচ্ছে। তাল্পবয়সে যেমন করে সিগারেট অভ্যেস হয়েছিল। মাথা ঘুরত তবু ছাড়তুম না। মুখে লাগত তিতো, মনে লাগত গর্ব। ও জানে কী করে দিনে দিনে মৌতাত জমিয়ে তুলতে হয়। মেয়েদের ভালবাসায় যে মদটুকু আছে সেটাতে আমার ইনস্পিরেশন। আমি আর্টিস্ট। ও যে আমার পালের হাওয়া। ও নইলে আমার তুলি যায় আটকে বালির চরে। বুঝতে পারি আমার পাশে বসলে শীলার হৃৎপিণ্ডে একটা লালরঙের আগুন জ্বলতে থাকে, ডেনজার সিগনাল, তার তেজ প্রবেশ করে আমার শিরায় শিরায়।—দোষ নিয়ো না তপস্বিনী, ভাবছ সেটাতে আমার বিলাস, না গো না, সেটাতে আমার প্রয়োজন।”

“তাই তোমার এত প্রয়োজন ক্রাইসলারের গাড়িতে।”

“তা স্বীকার করব। শীলার মধ্যে যখন গর্ব জাগে তখন ওর ঝলক বাড়ে। মেয়েদের এত গয়না কাপড় জোগাতে হয়। সেই জন্যেই। আমরা চাই মেয়েদের মাধুর্য, ওরা চায় পুরুষের ঐশ্বর্য। তারি সোনালি পূর্ণতার উপরে ওদের প্রকাশের ব্যাকগ্রাউন্ড। প্রকৃতির এই ফন্দি পুরুষদের বড়ো ক’রে তোলবার জন্যে। সত্যি কি না বলো।”

“সত্যি হোতে পারে। কিন্তু কাকে বলে ঐশ্বর্য তাই নিয়ে তর্ক। ক্রাইসলারের গাড়িকে যারা ঐশ্বর্য বলে আমি তো বলি তারা পুরুষকে ছোটো করবার দিকে টানে।”

অভীক উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল, “জানি জানি, তুমি যাকে ঐশ্বর্য বলো তারি সর্বোচ্চ চূড়ায় তুমি আমাকে পৌঁছিয়ে দিতে পারতে। তোমার ভগবান মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন।”

অভীকের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বিভা বললে, “ঐ এক কথা বার বার বোলো না। আমি তো বরাবর উলটোই শুনেছি। বিয়েটা আর্টিস্টের পক্ষে গলার ফাঁস। ইনস্পিরেশনের দম বন্ধ করে দেয়। তোমাকে বড়ো করতে যদি আমি পারতুম, আমার যদি সে শক্তি থাকত তাহলে—

অভীক ঝেঁকে উঠে বললে, “পারতুম কী, পেরেছ। আমার এই দুঃখু যে আমার সেই ঐশ্বর্য তুমি চিনতে পারো নি। যদি পারতে তাহলে তোমার ধর্মকর্মের সব বাঁধন ছিঁড়ে আমার সঙ্গিনী হয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়াতে; কোনো বাধা মানতে না। তরী তীরে এসে পৌঁছয় তবু যাত্রী তীর্থে ওঠবার ঘাট খুঁজে পায় না। আমার হয়েছে সেই দশা। বী, আমার মধুকরী, কবে তুমি আমাকে সম্পূর্ণ করে আবিষ্কার করবে বলো।”

“যখন আমাকে তোমার আর দরকার হবে না।”

“ও সব অত্যন্ত ফাঁপা কথা। অনেকখানি মিথ্যের হাওয়া দিয়ে ফুলিয়ে তোলা। স্বীকার করো আমাকে না হোলে নয় বলে জেনেই উৎকণ্ঠিত তোমার সমস্ত দেহমন। সে কি আমার কাছে লুকোবে।”

“এ কথা বলেই বা কী হবে, লুকোবই বা কেন। মনে যাই থাক আমি কাঙালপনা করতে চাইনে।”

“আমি চাই, আমি কাঙাল। আমি দিনরাত বলব আমি চাই, আমি চাই, আমি তোমাকেই চাই।”

“আর সেই সঙ্গে বলবে আমি ক্রাইসলাৱের গাড়িও চাই।”

“ঐ তো, ওটা তো জেলাসি। পর্বতো বহ্নিমান্ ধূমাৎ। মাঝে মাঝে ঘনিয়ে উঠুক ধোঁয়া জেলাসির, প্রমাণ হোক ভালবাসার অন্তর্গূঢ় আগুন। নিবে যাওয়া ভলক্যানো নয় তোমার মন। তাজা ভিসুভিয়স।”

বলে দাঁড়িয়ে উঠে অভীক হাত তুলে বললে—“হুরে।”

“এ কী ছেলেমানুষি করছ। এইজন্যেই বুঝি আজ সকালবেলায় এসেছিলে আগে থাকতে প্ল্যান করে?”

“হাঁ এইজন্যেই। মানছি সে কথা। নইলে এমন মুগ্ধ কেউ কেউ জানা আছে যাকে এ ঘড়ি এখনি বেচতে পারি বিনা ওজরে, অন্যায় দামে। কিন্তু তোমার কাছে কেবল তো দাম চাইতে আসি নি, যেখানে তোমার ব্যথার উৎস সেখানে ঘা মেরে অঞ্জলি পাততে চেয়েছিলেন। কিন্তু হতভাগ্যর ভাগ্যে না হোলো এটা, না হোলো ওটা।”

“কেমন করে জানলে। ভাগ্য তো সব সময় দেখা-বিন্তি খেলে না। কিন্তু দেখো একটা কথা তোমাকে বলি—তুমি মাঝে মাঝে আমাকে জিগ্‌গেস করেছ তোমার লীলাখেলা দেখে আমার মনে খোঁচা লাগে কিনা। সত্যিকথা বলি, লাগে খোঁচা।”

অভীক উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল,—“এটা তো সুসংবাদ।”

বিভা বললে, “অত উৎফুল্ল হোয়ো না। এ জেলাসি নয়, এ অপমান। মেয়েদের নিয়ে তোমার এই গায়ে-পড়া সখ্য, এই অসভ্য অসংকোচ, এতে সমস্ত মেয়েজাতের প্রতি তোমার অশ্রদ্ধা প্রকাশ পায়। আমার ভালো লাগে না।”

“এ তোমার কী রকম কথা হোলো। শ্রদ্ধার ব্যক্তিগত বিশেষত্ব নেই? জাত-কে-জাত যেখানে যাকেই দেখব শ্রদ্ধা করে করে বেড়াব? মাল যাচাই নেই, একেবারে wholesale শ্রদ্ধা? একে বলে pro-tection, ব্যবসাদারিতে বাইরে থেকে কৃত্রিম মাসুল চাপিয়ে দর বাড়ানো।”

“মিথ্যে তর্ক কোরো না।”

“অর্থাৎ তুমি তর্ক করবে আমি করব না। একেই বলে, ‘দিন ভয়ংকর, মেয়েরা বাক্য কবে কিন্তু পুরুষরা রবে নিরুত্তর।’”

“অভী তুমি কেবলি কথা কাটাকাটি করবার অছিলা খুঁজছ। বেশ জানো আমি বলতে চাইছিলুম মেয়েদের থেকে স্বভাবত একটা দূরত্ব বাঁচিয়ে চলাই পুরুষের পক্ষে ভদ্রতা।”

“স্বভাবত দূরত্ব বাঁচানো, না অস্বভাবত। আমরা মডার্ন, মেকি ভদ্রতা মানিনে, খাঁটি স্বভাবকে মানি শীলাকে পাশে নিয়ে ঝাঁকানি দেওয়া ফোর্ড গাড়ি চালাই, স্বাভাবিকতা হচ্ছে তার পাশাপাশিটাই। ভদ্রতার খাতিরে মাঝখানে দেড়হাত জায়গা রাখলে অশ্রদ্ধা করা হোত স্বভাবকে।”

“অভী, তোমরা নিজের থেকে মেয়েদের বিশেষ মূল্য দিয়ে দামী করে তুলেছিলে, তাদের খেলো করোনি নিজের গরজেই। সেই দাম আজ যদি ফিরিয়ে নাও নিজের খুশিকেই করবে সস্তা, ফাঁকি দেবে নিজের পাওনাকেই। কিন্তু মিথ্যে বকছি, মডার্ন কালটাই খেলো।”

অভীক জবাব দিলে, “খেলো বলব না, বলব বেহায়া। সেকালের বুড়ো শিব চোখ বুজে বসেছেন ধ্যানে, এ কালের নন্দীভৃঙ্গী আয়না হাতে নিয়ে নিজেদের চেহারাকে ব্যঙ্গ করছে যাকে বলে debunk- ing। জন্মেছি এ কালে, বোম্ ভোলানাথের চ্যালা হয়ে কপালে চোখ তুলে বসে থাকতে পারব না; নন্দীভৃঙ্গির বিদঘুটে মুখভঙ্গীর নকল করতে পারলে আজকের দিনে নাম হবে।”

“আচ্ছা আচ্ছা যাও নাম করতে দশদিককে মুখ ভেঙচিয়ে। কিন্তু তার আগে আমাকে একটা কথা সত্যি করে বলো, তোমার কাছে আশকারা পেয়ে রাজ্যের যত মেয়ে তোমাকে নিয়ে এই যে টানাটানি করে এতে কি তোমার ভাললাগার ধার ভোঁতা হয়ে যায় না? তোমরা কথায় কথায় যাকে বলো thrill, ঠেলাঠেলিতে তাকে কি পায়ের নীচে দলে ফেলা হয় না?”

‘সত্যি কথাই বলি তবে বি, যাকে বলে thrill, যাকে বলে ecstacy. সে হোলো পয়লা নম্বরের জিনিস, ভাগ্যে দৈবাৎ মেলে। কিন্তু তুমি যাকে বলছ ভিড়ের মধ্যে টানাটানি, সে হোলো সেকেন্ডহ্যান্ড দোকানের মাল, কোথাও বা দাগী, কোথাও বা ছেঁড়া, কিন্তু বাজারে সেও বিকোয়, অল্প দামে। সেরা জিনিসের পুরো দাম দিতে পারে ক-জন ধনী।”

“তুমি পারো অভী, নিশ্চয়। পারো, পুরো মূল্য আছে তোমার হাতে। কিন্তু অদ্ভুত তোমার স্বভাব, ছেঁড়া জিনিসে ময়লা জিনিসে তোমাদের আর্টিস্টের একটা কৌতুক আছে, কৌতূহল আছে। সুসম্পূর্ণ জিনিস তোমাদের picturesque নয়। থাকগে এসব বৃথা তর্ক। আপাতত ক্রাইসলারের পালটা যতদূর সম্ভব এগিয়ে দেওয়া যাক।”

এই বলে চৌকি ছেড়ে বিভা পাশের ঘরে চলে গেল। ফিরে এসে অভীকের হাতে একতাড়া নোট দিয়ে বললে—“এই নাও তোমার ইনস্পিরেশন, কোম্পানি বাহাদুরের মার্কামারা। কিন্তু তাই বলে তোমার ঐ ঘড়ি আমাকে নিতে বোলো না।”

চৌকিতে মাথা রেখে অভীক মেঝের উপবে বসে রইল। বিভা দ্রুতপদে তার হাত টেনে নিয়ে বললে, “আমাকে ভুল বুঝো না। তোমার অভাব ঘটেছে। আমার অভাব নেই এমন সুযোগে—”

বিভাকে থামিয়ে দিয়ে অভীক বললে, “অভাব আছে আমার, দারুণ অভাব। তোমার হাতেই রয়েছে সুযোগ, তা পূরণ করবার। কী হবে টাকায়।”

বিভা অভীকের হাতের উপরে স্নিগ্ধ ভাবে হাত বুলোতে বুলোতে বললে, “যা পারিনে তার দুঃখ রইল আমার মনে চিরদিন। যতটুকু পারি তার সুখ থেকে কেন আমাকে বঞ্চিত করবে।”

“না না না কিছুতেই না। তোমারই কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে শীলাকে আমি গাড়ি চড়িয়ে বেড়াব? এ প্রস্তাবে ধিক্কার দেবে এই ভেবেছিলুম, রাগ করবে এই ছিল আশা।”

“রাগ করব কেন। তোমার দুষ্টুমি কতক্ষণের। এটা সাংঘাতিক শীলার পক্ষে, তোমার পক্ষে একটুও না এমন ছেলেমানুষি কতবার তোমার দেখেছি, মনে মনে হেসেছি। জানি কিছুদিনের মতো এ খেলা না হোলে তোমার চলে না। এও জানি স্থায়ী হোলে আরো অচল হয়। হয়তো তুমি কিছু পেতে চাও, কিন্তু তোমাকে কিছু পাবে এ সইতে পারো না।”

“বি, আমাকে তুমি অত্যন্ত বেশি জানো তাই এমন ঘোরতর নিশ্চিন্ত থাকো। জানতে পেরেছ আমার ভালো লাগে মেয়েদের কিন্তু সে ভালো লাগা নাস্তিকেরই, তাতে বাঁধন নেই। পাথরে গাঁথা মন্দিরে একঘেয়ে পূজাকে সে বন্দী করবে না। বান্ধবীদের সঙ্গে গলাগলির গদগদ দৃশ্য মাঝে মাঝে দেখেছি, সেই বিহ্বল স্ত্রৈণতায় আমার গা কেমন করে। কিন্তু মেয়েরা আমার কাছে নাস্তিকের দেবতা, অর্থাৎ আর্টিস্টের। আর্টিস্ট খাবি খেয়ে মরে না, সে সাঁতার দেয়, দিয়ে অনায়াসে পার হয়ে যায়। আমি লোভী নই, আমাকে নিয়ে যে মেয়ে ঈর্ষা করে সে লোভী। তুমি লোভী নও, তোমার নিরাসক্ত মনের সব চেয়ে বড়ো দান স্বাধীনতা।”

বিভা হেসে বললে—“তোমার স্তব এখন রাখো। আর্টিস্ট, তোমরা সাবালক শিশু, এবার যে খেলাটা ফেঁদেছ তার খেলনাটি না হয় আমার হাত থেকেই নেবে।”

“নৈব নৈব চ। আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। তোমার ট্রাস্টিদের মুঠো থেকে এ টাকা খসিয়ে নিলে কী করে।”

“খোলসা করে বললে হয়তো খুশি হবে না। তুমি জানো অমরবাবুর কাছে আমি ম্যাথমেটিকস শিখছি।”

“সব তাতেই আমাকে বহুদুরে এগিয়ে যেতে চাও, বিদ্যেতেও?”

“বোকোনা, শোনো। আমার ট্রাস্টিদের মধ্যে একজন আছেন আদিত্যমামা। নিজে তিনি গণিতে ফার্স্টক্লাস মেডালিস্ট। তাঁর বিশ্বাস, যথেষ্ট সুযোগ পেলে অমরবাবু দ্বিতীয় রামানুজন হবেন। ওঁর কষা একটুখানি প্রব্লেম আইনস্টাইনকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, যা উত্তর পেয়েছিলেন সেটা আমি দেখেছি। এমন লোককে সাহায্য করতে হোলে তাঁর মান বাঁচিয়ে করতে হয়। আমি তাই বললুম, ওঁর কাছে গণিত শিখব। মামা খুব খুশি। শিক্ষা খাতে ট্রাস্টফান্ড থেকে কিছু টাকা আমার হাতে রেখে দিয়েছেন। তারি থেকে আমি ওঁকে বৃত্তি দিই।”

অভীকের মুখ কেমন একরকম হয়ে গেল। একটু হাসবার চেষ্টা করে বললে, “এমন আর্টিস্টও হয়তো আছে যে উপযুক্ত সুযোগ পেলে মিকেলঅ্যাঞ্জোলোর অন্তত দাড়ির কাছটাতে পৌঁছতে পারত।”

“কোনো সুযোগ না পেলেও হয়তো পারবে পৌঁছতে। এখন বলো আমার কাছ থেকে টাকাটা নেবে কি না।”

“খেলনার দাম?”

“হাঁগো, আমরা তো চিরকাল তোমাদের খেলনার দামই দিয়ে থাকি। তাতে দোষ কী। তার পরে আছে আঁস্তাকুড়।”

“ক্রাইসলারের আজ শ্রাদ্ধ-শান্তি হোলো এইখানেই। প্রগতিশীলার প্রগতিবেগ ভাঙা ফোর্ডেই নড়নড় করতে করতে চলুক। এখন ওসব কথা আর ভালো লাগছে না। অমরবাবু শুনেছি টাকা জমাচ্ছেন বিলেতে যাবার জন্যে, সেখান থেকে প্রমাণ করে আসবেন তিনি সামান্য লোক নন।”

বিভা বললে, “একান্ত আশা করি, তাই যেন ঘটে। তাতে দেশের গৌরব।”

উচ্চকণ্ঠে বললে অভীক, “আমাকেও তাই প্রমাণ করতে হবে, তুমি আশা করো আর নাই করো। ওঁর প্রমাণ সহজ, লজিকের বাঁধা রাস্তায়, আর্টের প্রমাণ রুচির পথে, সে রসিক লোকের প্রাইভেট পথ। সে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড নয়। আমাদের এই চোখে ঠুলি পরা ঘানি ঘোরানোর দেশে আমার চলবে না। যাদের দেখবার স্বাধীন দৃষ্টি আছে, আমি যাবই তাদের দেশে। একদিন তোমার মামাকে যেন বলতে হয়, আমিও সামান্য লোক নই, আর তাঁর ভাগ্নীকেও—”।

“ভাগ্নীর কথা বোলো না। তুমি মিকেলআঞ্জেলোর সমান মাপের কি না তা জানবার জন্য তাকে সবুর করতে হয়নি। তার কাছে তুমি বিনা প্রমাণেই অসামান্য। এখন বললা তুমি যেতে চাও বিলেতে?”

“সে আমার দিনরাত্রির স্বপ্ন।”

“তাহলে নাও না আমার এই দান। প্রতিভার পায়ে এই সামান্য আমার রাজকর।”

“থাক্ থাক্, ও কথা থাক্; কানে ঠিক সুর লাগছে না। সার্থক হোক গণিত অধ্যাপকের মহিমা। আমার জন্যে এ যুগ না হোক পরযুগ আছে, অপেক্ষা করে থাকবে পস্টারিটি। এই আমি বলে দিচ্ছি, একদিন আসবে যেদিন অর্ধেক রাত্রে বালিশে মুখ গুঁজে তোমাকে বলতে হবে, নামের সঙ্গে নাম গাঁথা হোতে পারত চিরকালের মতো, কিন্তু হোলো না।”

“পস্টারিটির জন্যে অপেক্ষা করতে হবে না অভী, নিষ্ঠুর শাস্তি আমার আরম্ভ হয়েছে।”

“কোন্‌ শাস্তির কথা তুমি বলছ জানিনে, কিন্তু জানি তোমার সব চেয়ে বড়ো শাস্তি তুমি বুঝতে পারো নি আমার ছবি। এসেছে নতুন যুগ, সেই যুগের বরণসভায় আধুনিক বড় চৌকিটাতে আমার দেখা তোমার মিলল না।” বলেই অভীক উঠে চলল দরজার দিকে। বিভা বললে, “যাচ্ছ কোথায়।”

“মিটিং আছে।”

“কিসের মিটিং?”

“ছুটির সময়কার ছাত্রদের নিয়ে দুর্গাপূজা করব।”

“তুমি পুজো করবে?”

“আমিই করব। আমি যে কিছুই মানিনে। আমার সেই না-মানার ফাঁকার মধ্যে তেত্রিশ কোটি দেবতা আর অপদেবতার জায়গায় টানাটানি হবে না। বিশ্বসৃষ্টির সমস্ত ছেলেখেলা ধরাবার জন্যে আকাশ শূন্য হয়ে আছে।”

বিভা বুঝল বিভারই ভগবানের বিরুদ্ধে ওর ওই বিদ্রূপ। কোনো তর্ক না করে সে মাথা নিচু ক’রে চুপ ক’রে বসে রইল।

অভীক দরজার কাছে থেকে ফিরে এসে বললে—“দেখো বি, তুমি প্রচণ্ড ন্যাশনালিস্ট। ভারতবর্ষে ঐক্য স্থাপনের স্বপ্ন দেখো৷ কিন্তু যে দেশে দিন রাত্রি ধর্ম নিয়ে খুনোখুনি সে দেশে সব ধর্মকে মেলাবার পুণ্যব্রত আমার মতো নাস্তিকেরই। আমিই ভারতবর্ষের ত্রাণকর্তা।”

অভীকের নাস্তিকতা কেন যে এত হিংস্র হয়ে উঠেছে বিভা তা জানে না। তাই তার উপরে রাগ করতে পারে না। কিছুতে ভেবে পায় না কী হবে এর পরিণাম। বিভার আর যা-কিছু আছে সবই সে দিতে পারে কেবল ঠেকেছে ওর পিতার ইচ্ছায়। সেই ইচ্ছা তো মত নয়, বিশ্বাস নয়, তর্কের বিষয় নয়। সে ওর স্বভাবের অঙ্গ। তার প্রতিবাদ চলে না। বার বার মনে করেছে এই বাধা সে লঙঘন করবে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে কিছুতে তার পা সরতে চায় না।

বেহারা এসে খবর দিলে “অমরবাবু এসেছেন।” অভীক অবিলম্বে দুড়দাড় করে সিঁড়ি বেয়ে চলে গেল। বিভার বুকের মধ্যে মোচড়াতে লাগল। প্রথমটাতে ভাবলে অধ্যাপককে বলে পাঠাই, আজ পাঠ নেওয়া হবে না। পরক্ষণেই মনটাকে শক্ত করে বললে, “আচ্ছা এইখানে নিয়ে আয়। বসতে বল্। একটু বাদেই আসছি।”

শোবার ঘরে উপুড় হয়ে বিছানায় গিয়ে পড়ল। বালিশ আঁকড়ে ধরে কান্না। অনেকক্ষণ পরে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে মুখে চোখে জল দিয়ে হাসিমুখে ঘরে এসে বললে, “আজ মনে করেছিলুম ফাঁকি দেব।”

“শরীর ভালো নেই বুঝি।”

“না বেশ আছে। আসল কথা, কতকাল ধরে রবিবারের ছুটি রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে, থেকে থেকে তার প্রকোপ প্রবল হয়ে ওঠে।”

অধ্যাপক বললেন, “আমার রক্তে এ পর্যন্ত ছুটির মাইক্রোব ঢোকার সময় পায়নি। কিন্তু আমিও আজ ছুটি নেব। কারণটা বুঝিয়ে বলি। এ বছর কোপেনহেগেনে সার্বজাতিক ম্যাথমেটিকস কনফারেন্স হবে। আমার নাম কি করে ওদের নজরে পড়ল জানিনে। ভারতবর্ষের মধ্যে আমিই নিমন্ত্রণ পেয়েছি। এত বড় সুযোগ তো ব্যর্থ হোতে দিতে পারি নে।”

বিভা উৎসাহের সঙ্গে বললে, “নিশ্চয় আপনাকে যেতে হবে।”

অধ্যাপক একটুখানি হেসে বললেন, “আমার উপরওয়ালা যাঁরা আমাকে ডেপুটেশনে পাঠাতে পারতেন তাঁরা রাজি নন, পাছে আমার মাথা খারাপ হয়ে যায়। অতএব তাঁদের সেই উৎকণ্ঠা আমার ভালোর জন্যেই। তেমন কোনো বন্ধু যদি পাই যে-লোকটা খুব বেশি সেয়ানা নয় তারি সন্ধানে আজ বেরব। ধারের বদলে যা বন্ধক দেবার আশা দিতে পারি সেটাকে না পারব দাঁড়িপাল্লায় চড়াতে, না পারব কষ্টিপাথরে ঘষে দেখাতে। আমরা বিজ্ঞানীরা কিছু বিশ্বাস করবার পূর্বে প্রত্যক্ষ প্রমাণ খুঁজি, বিষয়বুদ্ধিওয়ালারাও খোঁজে—ঠকাবার জো নেই কাউকে।”

বিভা উত্তেজিত হয়ে বললে, “যেখান থেকে হোক বন্ধু একজনকে বের করবই, হয়তো সে খুব সেয়ানা নয়, সেজন্যে ভাববেন না।”

দু চার কথায় সমস্যার মীমাংসা হয়নি। সেদিনকার মতো একটা আধাখেঁচড়া নিষ্পত্তি হোলো।

অমরবাবু লোকটি মাঝারি সাইজের, শ্যামবর্ণ, দেহটি রোগা, কপাল চওড়া, মাথার সামনের দিককার চুল ফুরফুরে হয়ে এসেছে। মুখটি প্রিয়দর্শন, দেখে বোঝা যায় কারো সঙ্গে শত্রুতা করবার অবকাশ পাননি। চোখ দুটিতে ঠিক অন্যমনস্কতা নয়, যাকে বলা যেতে পারে দূরমনস্কতা,—অর্থাৎ রাস্তায় চলবার সময় ওঁকে নিরাপদ রাখবার দায়িত্ব বাইরের লোকদেরই। বন্ধু ওঁর খুব অল্পই, কিন্তু যে ক-জন আছে তারা ওঁর সম্বন্ধে খুবই উচ্চ আশা রাখে, আর বাকি যে সব চেনা লোক তারা নাক সিটকে ওঁকে বলে হাইব্রাউ। কথাবার্তা অল্প বলেন, সেটাকে লোকে মনে করে, হৃদ্যতারই স্বল্পতা। মোটের উপর ওঁর জীবনযাত্রায় জনতা খুব কম। তাঁর সাইকোলজির পক্ষে আরামের বিষয় এই যে, দশজনে ওঁকে কী ভাবে সে উনি জানেনই না।

অভীকের কাছে বিভা আজ তাড়াতাড়ি যে আটশো টাকা এনে দিয়েছিল সে একটা অন্ধ আবেগে মরিয়া হয়ে। বিভার নিয়মনিষ্ঠার প্রতি তার মামার বিশ্বাস অটল। কখনো তার ব্যত্যয় হয়নি। মেয়েদের জীবনে নিয়মের প্রবল ব্যতিক্রমের ঝটকা হঠাৎ কোনদিক থেকে এসে পড়ে তিনি বিষয়ী লোক সেটা কল্পনাও করতে পারেন নি। এই অকস্মাৎ অকাজের সমস্ত শাস্তি ও লজ্জা মনের মধ্যে স্পষ্ট করে দেখে নিয়েই এক মুহূর্তের ঝড়ের ঝাপটে বিভা উপস্থিত করেছিল তার উৎসর্গ অভীকের কাছে। প্রত্যাখ্যাত সেই দান আবার নিয়মের পিল্‌পেগাড়ির মধ্যে ফিরে এসেছে। বর্তমান ক্ষেত্রে ভালবাসার সেই স্পর্ধাবেগ তার মনে নেই। স্বাধিকার লঙ্ঘন করে কাউকে টাকা ধার দেবার কথা সে সাহস করে মনে আনতে পারলে না। তাই বিভা প্ল্যান করেছে, মায়ের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া দামি গয়না বেচে যা পাবে সেই টাকা অমরকে উপলক্ষ্য করে, দেবে আপন স্বদেশকে।

* * *

বিভার কাছে যে সব ছেলেমেয়ে মানুষ হচ্ছে, ও তাদের পড়ায় সাহায্য করে। আজ রবিবার। খাওয়ার পরে এতক্ষণ ওর ক্লাস বসেছিল। সকাল সকাল দিল ছুটি।

গয়নার বাক্স বের করে মেঝের উপর একখানা কাঁথা পেতে তাতে একে একে বিভা গয়না সাজাচ্ছিল। ওদের পরিবারের পরিচিত জহুরিকে ডেকে পাঠিয়েছে।

এমন সময় সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনতে পেল অভীকের। প্রথমেই গয়নাগুলো তাড়াতাড়ি লুকোবার ঝোঁক হোলো কিন্তু যেমন পাতা ছিল তেমনি রেখে দিলে। কোনো কারণেই অভীকের কাছে, কোনো কিছু চাপা দেবে সে ওর স্বভাবের বিরুদ্ধে।

অভীক ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল। বুঝল ব্যাপারখানা কী। বললে, “অসামান্যের পারানি কড়ি। আমার বেলায় তুমি মহামায়া, ভুলিয়ে রাখো, অধ্যাপকের বেলায় তুমি তারা, তরিয়ে দাও। অধ্যাপক জানেন কি অবলা নারী মৃণাল ভুজে তাঁকে পারে পাঠাবার উপায় করেছে?”

“না জানেন না।”

“জানলে কি এই বৈজ্ঞানিকের পৌরুষে ঘা লাগবে না।”

“ক্ষুদ্র লোকের শ্রদ্ধার দানে মহৎ লোকের অকুণ্ঠিত অধিকার, আমি তো এই জানি। এই অধিকার দিয়ে তাঁরা অনুগ্রহ করেন, দয়া করেন।”

“সে কথা বুঝলুম, কিন্তু মেয়েদের গায়ের গয়না আমাদেরই আনন্দ দেবার জন্যে, আমরা যত সামান্যই হই, কারো বিলেতে যাবার জন্যে নয়, তিনি যত বড়োই হোন না। আমাদের মতো পুরুষদের দৃষ্টিকে এ তোমরা প্রথম থেকেই উৎসর্গ করে রেখেছ। এই হারখানি চুনির সঙ্গে মুক্তোর মিল করা, এ আমি একদিন তোমার গলায় দেখেছিলাম, যখন আমাদের পরিচয় ছিল অল্প। সেই প্রথম পরিচয়ের স্মৃতিতে এই হারখানি এক হয়ে মিশিয়ে আছে। ঐ হার কি একলা তোমার, ও যে আমারো।”

“আচ্ছা ঐ হারটা না হয় তুমিই নিলে।”

“তোমার সত্তা থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হার একেবারেই যে নিরর্থক। সে যে হবে চুরি। তোমার সঙ্গে নেব ওকে সবসুদ্ধ, সেই প্রত্যাশা করেই বসে আছি। ইতিমধ্যে ঐ হার হস্তান্তর করো যদি তবে ফাঁকি দেবে আমাকে।”

“গয়নাগুলো মা দিয়ে গেছেন আমার ভাবী বিবাহের যৌতুক। বিবাহটা বাদ দিলে ও গয়নার কী সংজ্ঞা দেব। যাই হোক, কোনো শুভ কিংবা অশুভ লগ্নে এই কন্যাটির সালংকারা মূর্তি আশা কোরো না।”

“অন্যত্র পাত্র স্থির হয়ে গেছে বুঝি?”

“হয়েছে বৈতরণীর তীরে। বরঞ্চ এক কাজ করতে পারি, তুমি যাকে বিয়ে করবে সেই বধূর জন্যে আমার এই গয়না কিছু রেখে যাব।”

“আমার জন্যে বুঝি বৈতরণীর তীরে বধূর রাস্তা নেই।”

“ও কথা বোলো না। সজীব পাত্রী সব আঁকড়ে আছে তোমার কুষ্ঠি।”

“মিথ্যে কথা বলব না। কুষ্ঠির ইশারাটা একেবারে অসম্ভব নয়। শনির দশায় সঙ্গিনীর অভাব হঠাৎ মারাত্মক হয়ে উঠলে পুরুষের আসে ফাঁড়ার দিন।”

“তা হোতে পারে, কিন্তু তার কিছুকাল পরেই সঙ্গিনীর অবির্ভাবটাই হয় মারাত্মক। তখন ঐ ফাঁড়াটা হয়ে ওঠে মুশকিলের। যাকে বলে পরিস্থিতি।”

“ঐ যাকে বলে বাধ্যতামূলক উদ্বন্ধন। প্রসঙ্গটা যদিও হাইপথেটিক্যাল, তবু সম্ভাবনার এত কাছঘেঁসা যে এ নিয়ে তর্ক করা মিথ্যে। তাই বলছি একদিন যখন লাল চেলিপরা আমাকে হঠাৎ দেখবে পরহস্তগতং ধনং তখন—”

“আর ভয় দেখিয়ো না, তখন আমিও হঠাৎ আবিষ্কার করব, পরহস্তের অভাব নেই।”

“ছি ছি মধুকরী, কথাটাতে ভালো শোনালো না তোমার মুখে। পুরুষেরা তোমাদের দেবী ব’লে স্তুতি করে, কেননা তাদের অন্তর্ধান ঘটলে তোমরা শুকিয়ে মরতে রাজি থাকো। পুরুষদের ভুলেও কেউ দেবতা বলে না। কেননা অভাবে পড়লেই বুদ্ধিমানের মতো অভাব পূরণ করিয়ে নিতে তারা প্রস্তুত। সম্মানের মুশকিল তো ঐ। একনিষ্ঠতার পদবীটা বাঁচাতে গিয়ে তোমাদের প্রাণে মরতে হয়। সাইকোলজি এখন থাক, আমার প্রস্তাব এই, অমরবাবুর অমরত্বলাভের দায়িত্ব আমাদেরই উপরে দাও না, আমরা কি ওর মূল্য বুঝি নে? গয়না বেচে পুরুষকে লজ্জা দাও কেন।”

“ও কথা বোলো না। পুরুষদের যশ মেয়েদেরই সব চেয়ে বড়ো সম্পদ। যে দেশে তোমরা বড়ো সে দেশে আমরা ধন্য।”

“এ দেশ সেই দেশই হোক। তোমাদের দিকে তাকিয়ে সেই কথাই ভাবি প্রাণপণে। এ প্রসঙ্গে আমার কথাটা এখন থাক, অন্য এক সময় হবে। অমরবাবুর সফলতায় ঈর্ষা করে এমন খুদে লোক বাংলাদেশে অনেক আছে। এ দেশের মানুষেরা বড় লোকের মড়ক। কিন্তু দোহাই তোমার, আমাকে সেই বামনদের দলে ফেলো না। শোনো আমি কত বড়ো একটা ক্রিমিন্যাল পুণ্যকর্ম করেছি।—দুর্গাপূজার চাঁদার টাকা আমার হাতে ছিল। সে টাকা দিয়ে দিয়েছি অমরবাবুর বিলেতযাত্রার ফাণ্ডে। দিয়েছি কাউকে না বলে। যখন ফাঁস হবে, জীববলি খোঁজবার জন্যে মায়ের ভক্তদের বাজারে দৌড়তে হবে না। আমি নাস্তিক, আমি বুঝি সত্যকার পূজা কাকে বলে। ওরা ধর্মপ্রাণ, ওরা কী বুঝবে।”

“এ কী কাজ করলে অভীক। তুমি যাকে বলো তোমার পবিত্র নাস্তিকধর্ম এ কাজ কি তার যোগ্য, এ যে বিশ্বাসঘাতকতা।”

“মানি। কিন্তু আমার ধর্মের ভিত কিসে দুর্বল করে দিয়েছিল তা বলি। খুব ধুম ক’রে পুজো দেব ব’লে আমার চেলারা কোমর বেঁধেছিল। কিন্তু চাঁদার যে সামান্য টাকা উঠল সে যেমন হাস্যকর তেমনি শোকাবহ। তাতে ভোগের পাঁঠাদের মধ্যে বিয়োগান্ত নাট্য জমত না, পঞ্চমাঙ্কের লাল রংটা হোত ফিকে। আমার তাতে আপত্তি ছিল না। স্থির করেছিলেম নিজেরাই কাঠি হাতে ঢাকে ঢেলে বেতালা চাঁটি লাগাব অসহ্য উৎসাহে, আর লাউ কুমড়োর বক্ষ বিদীর্ণ করব স্বহস্তে খড়গাঘাতে। নাস্তিকের পক্ষে এই যথেষ্ট, কিন্তু ধর্মপ্রাণের পক্ষে নয়। কখন সন্ধ্যেবেলায় আমাকে না জানিয়ে ওদের একজন সাজল সাধুবাবা, পাঁচজন সাজল চেলা, কোনো একজন ধনী বিধবা বুড়িকে গিয়ে বললে, তার যে ছেলে রেঙ্গুনে কাজ করে, জগদম্বা স্বপ্ন দিয়েছেন, যথেষ্ট পাঁঠা আর পুরোবহরের পুজো না পেলে তাঁকে আস্ত খাবেন। তাঁর কাছ থেকে স্ক্রু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পাঁচ হাজার টাকা বের করেছে। যেদিন শুনলুম, সেইদিনই টাকাটার সৎকার করেছি। তাতে আমার জাত গেল। কিন্তু টাকাটার কলঙ্ক ঘুচল। এই তোমাকে করলুম আমার কনফেশনাল। পাপ কবুল করে পাপ ক্ষালন করে নেওয়া গেল। পাঁচ হাজার টাকার বাইরে আছে উনত্রিশটি মাত্র টাকা। সে রেখেছি কুমড়োর বাজারের দেনাশোধের জন্যে।”

* * *

সুস্মি এসে বললে, “বচ্চু বেহারার জ্বর বেড়েছে, সঙ্গে সঙ্গে কাশি, ডাক্তারবাবু কী লিখে দিয়ে গেছেন, দেখে দাও’সে।”

বিভার হাত চেপে ধরে অভীক বললে, “বিশ্বহিতৈষিণী, রোগতাপের তদবির করতেই দিনরাত ব্যস্ত আছ, আর যে সব হতভাগার শরীর অতি বিশ্রী রকমে সুস্থ তাদের মনে করবার সময় পাও না।”

“বিশ্বহিত নয় গো, কোনো একজন অতি সুস্থ হতভাগাকে ভুলে থাকবার জন্যেই এত করে কাজ বানাতে হয়। এখন ছাড়ো, আমি যাই, তুমি একটু বোসো, আমার গয়না সামলিয়ে রেখো।”

“আর আমার লোভ কে সামলাবে।”

“তোমার নাস্তিক ধর্ম।”

কিছুকাল দেখা নেই অভীকের। চিঠিপত্র কিছু পাওয়া যায় নি। বিভার মুখ শুকিয়ে গেছে। কোনো কাজ করতে মন যাচ্ছে না। তার ভাবনাগুলো গেছে ঘুলিয়ে। কী হয়েছে, কী হোতে পারে তার ঠিক পাচ্ছে না। দিনগুলো যাচ্ছে পাঁজর-ভেঙে-দেওয়া বোঝার মতন। ওর কেবলি মনে হচ্ছে অভীক ওর উপরেই অভিমান করে চলে গেছে। ও ঘরছাড়া ছেলে, ওর বাঁধন নেই, উধাও হয়ে চলে গেল; ও হয়তো আর ফিরবে না। ওর মন কেবলি বলতে লাগল, রাগ কোরো না, ফিরে এসো, আমি তোমাকে আর দুঃখ দেব না। অভীকের সমস্ত ছেলেমানুষি, ওর অবিবেচনা, ওর আবদার যতই মনে পড়তে লাগল, ততই জল পড়তে লাগল ওর দুই চক্ষু বেয়ে, কেবলি নিজেকে পাষাণী বলে ধিক্কার দিলে।

এমন সময়ে এল চিঠি স্টিমারের ছাপমারা।

অভীক লিখেছে:—জাহাজের স্টোকার হয়ে চলেছি বিলেতে। এঞ্জিনে কয়লা যোগাতে হবে। বলছি বটে ভাবা কোরো না, কিন্তু ভাবনা করছ মনে করে ভালো লাগে। তবু ব’লে রাখি এঞ্জিনের তাতে পোড়া আমার অভ্যেস আছে। জানি তুমি এই ব’লে রাগ করবে যে, কেন পাথেয় দাবি করিনি তোমার কাছ থেকে। একমাত্র কারণ এই যে, আমি যে আর্টিস্ট এ পরিচয়ে তোমার একটুও শ্রদ্ধা নেই। এ আমার চির দুঃখের কথা; কিন্তু এজন্যে তোমাকে দোষ দেব না। আমি নিশ্চয়ই জানি একদিন সেই রসজ্ঞ দেশের গুণী লোকেরা আমাকে স্বীকার করে নেবে যাদের স্বীকৃতির খাঁটি মূল্য আছে।

অনেক মূঢ় আমার ছবির অন্যায় প্রশংসা করেছে। আবার অনেক মিথ্যুক করেছে ছলনা। তুমি আমার মন ভোলানোর জন্যে কোনোদিন কৃত্রিম স্তব করোনি। যদিও তোমার জানা ছিল তোমার একটুখানি প্রশংসা আমার পক্ষে অমৃত। তোমার চরিত্রের অটল সত্য থেকে আমি অপরিমেয় দুঃখ পেয়েছি তবু সেই সত্যকে দিয়েছি আমি বড়ো মূল্য। একদিন বিশ্বের কাছে যখন সম্মান পাব তখন সব চেয়ে সত্য সম্মান আমাকে তুমিই দেবে, তার সঙ্গে হৃদয়ের সুধা মিশিয়ে। যতক্ষণ তোমার বিশ্বাস অসন্দিগ্ধ সত্যে না পৌঁছবে ততক্ষণ তুমি অপেক্ষা করবে। এই কথা মনে রেখে আজ দুঃসাধ্য সাধনার পথে চলেছি।

এতক্ষণে জানতে পেরেছ তোমার হারখানি গেছে চুরি৷ এ হার তুমি বাজারে বিক্রি করতে যাচ্ছ, এই ভাবনা আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলুম না। তুমি পাঁজর ভেঙে সিঁধ কাটতে যাচ্ছিলে আমার বুকের মধ্যে। তোমার ঐ হারের বদলে আমার একতাড়া ছবি তোমার গয়নার বাক্সের কাছে রেখে এসেছি। মনে মনে হেসো না। বাংলাদেশের কোথাও এই ছবিগুলো ছেঁড়া কাগজের বেশি দর পাবে না। অপেক্ষা কোরো, বি, আমার মধুকরী, তুমি ঠকবে না, কখনোই না। হঠাৎ যেমন কোদালের মুখে গুপ্তধন বেরিয়ে পড়ে আমি জাঁক করে বলছি, তেমনি আমার ছবিগুলির দুমূর্ল্য দীপ্তি হঠাৎ বেরিয়ে পড়বে। তার আগে পর্যন্ত হেসো, কেননা সব মেয়ের কাছেই সব পুরুষ ছেলেমানুষ যাদের তারা ভালবাসে। তোমার সেই স্নিগ্ধ কৌতুকের হাসি আমার কল্পনায় ভর্তি করে নিয়ে চললুম সমুদ্রের পারে। আর নিলুম তোমার সেই মধুময় ঘর থেকে একখানি মধুময় অপবাদ। দেখেছি তোমার ভগবানের কাছে তুমি কত দরবার নিয়ে প্রার্থনা করো, এবার থেকে এই প্রার্থনা কোরো, তোমার কাছ থেকে চলে আসার দারুণ দুঃখ যেন একদিন সার্থক হয়।

তুমি মনে মনে কখনো আমাকে ঈর্ষা করেছ কি না জানিনে। এ কথা সত্য, মেয়েদের আমি ভালবাসি। ঠিক ততটা না হোক মেয়েদের আমার ভালো লাগে। তারা আমাকে ভালবেসেছে, সেই ভালবাসা আমাকে কৃতজ্ঞ করে। কিন্তু নিশ্চয় তুমি জানো যে, তারা নীহারিকামণ্ডলী, তার মাঝখানে তুমি একটিমাত্র ধ্রুবনক্ষত্র। তারা আভাস, তুমি সত্য। এ সব কথা শোনাবে সেন্টিমেন্টাল। উপায় নেই, আমি কবি নই। আমার ভাষাটা কলার ভেলার মতো, ঢেউ লাগলেই বাড়াবাড়ি করে দোলা দিয়ে। জানি বেদনার যেখানে গভীরতা সেখানে গম্ভীর হওয়া চাই নইলে সত্যের মর্যাদা থাকে না। দুর্বলতা চঞ্চল, অনেকবার আমার দুর্বলতা দেখে হেসেছ। এই চিঠিতে তারই লক্ষণ দেখে একটু হেসে তুমি বলবে এই তো ঠিক তোমার অভীর মতোই ভাবখানা। কিন্তু এবার হয়তো তোমার মুখে হাসি আসবে না। তোমাকে পাই নি বলে অনেক খুঁতখুঁত করেছি, কিন্তু হৃদয়ের দানে তুমি যে কৃপণ তোমার পরে এতবড়ো অবিচার আর কিছু হোতে পারে না। আসলে এ জীবনে তোমার কাছে আমার সম্পূর্ণ প্রকাশ হোতে পারল না। হয়তো কখনো হোতে পারবে না। এই তীব্র অতৃপ্তি আমাকে এমন কাঙাল করে রেখেছে। সেই জন্যেই আর কিছু বিশ্বাস করি বা না করি হয়তো জন্মান্তরে বিশ্বাস করতে হবে। তুমি স্পষ্ট করে আমাকে তোমার ভালবাসা জানাও নি কিন্তু তোমার স্তব্ধতার গভীর থেকে প্রতিক্ষণে যা তুমি দান করেছ এই নাস্তিক তাকে কোনো সংজ্ঞা দিতে পারে নি, বলেছে, অলৌকিক। এরি আকর্ষণে কোনো এক ভাবে হয়তো তোমার সঙ্গে সঙ্গে তোমার ভগবানেরই কাছাকাছি ফিরেছি। ঠিক জানি নে। হয়তো সবই বানানো কথা। কিন্তু হৃদয়ের একটা গোপন জায়গা আছে আমাদের নিজেরই অগোচরে, সেখানে প্রবল ঘা লাগলে কথা আপনি বানিয়ে বানিয়ে ওঠে, হয়তো সে এমন কোনো সত্য যা এতদিনে নিজে জানতে পারি নি।

বি, আমার মধুকরী, জগতে সবচেয়ে ভালবেসেছি তোমাকে। সেই ভালবাসার কোনো একটা অসীম সত্যভূমিকা আছে যদি মনে করা যায়, আর তাকেই যদি বলো তোমাদের ঈশ্বর তাহলে তাঁর দুয়ার আর তোমার দুয়ার এক হয়ে রইল এই নাস্তিকের জন্যে। আবার আমি ফিরব, তখন আমার মত, আমার বিশ্বাস সমস্ত চোখ বুজে সমর্পণ করে দেব তোমার হাতে, তুমি তাকে পৌঁছিয়ে দিয়ে তোমার তীর্থপথের শেষ ঠিকানায়, যাতে বুদ্ধির বাধা নিয়ে তোমার সঙ্গে এক মুহূর্তের বিচ্ছেদ আর কখনো না ঘটে। তোমার কাছ থেকে আজ দূরে এসে ভালবাসার অভাবনীয়তা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে আমার মনের মধ্যে, যুক্তি তর্কের কাঁটার বেড়া পার করিয়ে দিয়েছে আমাকে—আমি দেখতে পাচ্ছি তোমাকে লোকাতীত মহিমায়। এতদিন বুঝতে চেয়েছিলুম বুদ্ধি দিয়ে, এবার পেতে চাই, আমার সমস্তকে দিয়ে।

তোমার নাস্তিক ভক্ত

অভীক।

শারদীয়া ১৩৪৬ (১৯৩৯)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *