যূথপতি
দরজায় বেলের শব্দ শুনে কয়েক মুহূর্ত উৎকর্ণ হয়ে রইলেন হেমকান্তি। কে দরজা খুলবে?
সাধারণত পরাণই খুলে দেয়। দ্বিতীয়বার বেল বাজবার পর হেমকান্তির মনে পড়ল পরাণ একটু আগে বাজারে গেছে। সে তো হেমকান্তিকে বলেই গেল। যখন বাড়িতে অন্য কেউ থাকে না, তখনই পোস্টম্যান কিংবা যত রাজ্যের ফেরিওয়ালা আসে, হেমকান্তিকে দরজা খুলতে যেতে হয়। আর পরাণটারও যখন-তখন বাজারে যাওয়া চাই!
খবরের কাগজ পড়ার মতন জরুরি কাজ ফেলে, চটি ফটফটিয়ে হেমকান্তি গেলেন সদর দরজার দিকে।
পোস্টম্যান কিংবা ফেরিওয়ালা নয়, মলয়।
সে একমুখ হেসে বলল, কেমন আছেন, মেসোমশাই! আপনার জ্বর হয়েছিল শুনেছিলাম।
হেমকান্তি বললেন, এখন ভালো আছি। জ্বর নেই আর।
মলয় আবার জিগ্যেস করল, রিঙ্কি নেই? ওর সঙ্গে একটা দরকার আছে।
হেমকান্তি বললেন, না, রিঙ্কি তো এখন বাড়িতে নেই!
—কোথায় গেছে? ফিরতে দেরি হবে?
—ওর মা আর ও গেছে একটা শ্ৰাদ্ধবাড়িতে, ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফিরবে বোধহয়…
হঠাৎ হেমকান্তির খেয়াল হল, তিনি মলয়কে দরজার বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন! তাঁর কি ভীমরতি হয়েছে? ছি-ছি, কী কাণ্ড!
তিনি তাড়াতাড়ি বললেন, ভেতরে এসো, ভেতরে এসো, রোদ্দুরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছ কেন?
মলয়ের হাতে একটা পলিথিনের ঝোলা। মুখখানা একেবারে ঘর্মাক্ত। অসম্ভব গরম পড়েছে সকাল থেকেই।
ভেতরে এসে, বসবার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মলয় হাঁক দিল, পরাণ! পরাণ শোন।
হেমকান্তি বললেন, পরাণও নেই, বাজারে গেল এক্ষুনি।
মলয় বলল, মোড়ের দোকানে সিঙাড়া ভাজছিল দেখলুম। বেশ ভালো সাইজ। কয়েকটা নিয়ে
এলুম।
একটু আগে পাখা ঘুরছিল, এরই মধ্যে লোডশেডিং হয়ে গেছে।
মলয় ভেতরে এসে ওপরের দিকে তাকিয়ে বলল, পাখা চলছে না?
হেমকান্তি এমন একটা মুখের ভাব করলেন, যেন লোডশেডিং হওয়াটা তারই অপরাধ। গরমের মধ্যে ঘেমে নেয়ে এসেছে মলয়, তাকে তিনি একটু বাতাস দিতে পারছেন না। বাড়িতে হাতপাখাও নেই।
খবরের কাগজটা ভাঁজ করে হাওয়া করতে-করতে মলয় বলল, ওরা আসুক, ততক্ষণ আপনি সিঙাড়া খান। গরম-গরম আছে, ঠান্ডা হলে তেমন ভালো লাগে না।
নিজেই সে ঠোঙা বার করে বলল, মেসোমশাই, এই নিন।
এখন মেলোমশাই বলে ডাকছে, আর কয়েকমাস বাদেই মলয় ওঁকে বাবা বলবে। রিঙ্কির সঙ্গে ওর বিয়ের কথা পাকা হয়ে আছে।
বাড়িতে আর কেউ নেই, এখন হবু-জামাইকে আপ্যায়ন করার ভার সব হেমকান্তির ওপর। আর কী করবেন ভেবে না পেয়ে হেমকান্তি জিগ্যেস করলেন, তুমি জল খাবে?
মলয় বলল, না। সিঙাড়ার সঙ্গে চা হলে জমে না। পরাণ আসুক।
পরাণ যদি আসতে দেরি করে, তা হলে কি হেমকান্তিরই চায়ের জল চাপানো উচিত? সত্যিই তো সিঙাড়ার সঙ্গে চা পেলেই ভালো লাগে। হেমকান্তি জীবনে কখনও বাড়ির এই সব কাজ করেননি। রান্নাঘরের কোথায় চা-চিনি থাকে, তিনি জানেনই না।
সিঙাড়া খেলেই তার অম্বল হয়। কিন্তু মলয় আগ্রহ করে দিচ্ছে, তাতে না বলা উচিত নয়। মলয় নিজেও খেতে শুরু করেছে। হেমকান্তিও দুটো খেয়ে নিলেন। একটু পরেই বুক জ্বালা করবে।
বাথরুমে হাত ধুতে গিয়েই বেরিয়ে এসে মলয় বলল, তোয়ালে নেই। না-না, আপনাকে উঠতে হবে না, বসুন, বসুন মেলোমশাই। আমি নিয়ে আসছি।
মলয় ভেতরের ঘরে চলে গেল, নিয়ে এল একটা তোয়ালে। এ-বাড়িতে কোথায় তোয়ালে রাখা থাকে, তাও মলয় জানে।
কতক্ষণের মধ্যে রিঙ্কি আর তার মা ফিরবে, তার ঠিক নেই। এতক্ষণ মলয়ের সঙ্গে তিনি কী যে। কথা বলবেন, ভেবেই পাচ্ছেন না। মলয়ের চাকরির কথা, বাড়ির কথা, সবই তাঁর জানা হয়ে গেছে।
নিজেরাই বিয়ে ঠিক করেছে, হেমকান্তিরা মেনে নিয়েছেন প্রথম থেকেই। না মানার কোনও কারণ নেই। মলয়ের চেহারা সুন্দর, স্বাস্থ্য ভালো, রেলের চাকরি করে। মলয়ের বাবা-মায়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছে, তাঁরাও বেশ সজ্জন, মোটামুটি অবস্থাপন্ন। সুতরাং পাত্র হিসাবে মলয় আদর্শ। জাতের অমিল আছে। কিন্তু হেমাকান্তি ওসব মানেন না।
মলয় তো যে-কোনওদিন বিয়ে করতে রাজি। কিন্তু রিঙ্কির মায়ের ইচ্ছে রেজিস্ট্রি-ফেজিস্ট্রি নয়, একটিমাত্র মেয়ে, তার ঘটা করে বিয়ে দিতে হবে। পুরোপুরি অনুষ্ঠান, শ-চারেক লোক খাওয়ানো। কিন্তু হেমকান্তির বড় শালক অনুপের হঠাৎ ক্যানসার ধরা পড়ল গত মাসে। হেমকান্তির স্ত্রী গায়ত্রী তাঁর এই দাদাকে খুব ভালোবাসে, দাদার এরকম অসুখের মধ্যে কি বাড়িতে একটা বিয়ে লাগানো যায়?
অনুপ অবশ্য বেশিদিন ভুগল না। চলে গেল। আজ তার শ্রাদ্ধ।
মামা মারা গেলে কালাশৌচ হয় না। দু-তিনমাস অপেক্ষা করার পরই বিয়েটা হতে পারবে। সামনের শীতকালেই একেবারে প্রথম দিকে। হেমকান্তিরা সেইরকম ভাবেই তৈরি হচ্ছেন। ততদিনে নতুন বাড়িটাও পাওয়া যাবে।
মলয় বলল, মেলোমশাই, আপনি শ্রাদ্ধবাড়িতে গেলেন না?
হেমকান্তি বললেন, কাল অনেকক্ষণ ছিলাম। আজ আবার বিকেলের দিকে যাব। শ্রাদ্ধের ওই যজ্ঞটজ্ঞ আমার ঠিক সহ্য হয় না!
মলয় বললে, রিঙ্কির জন্য একটা নতুন ক্যাসেট এনেছি। একটু শুনবেন? বাজাব?
হেমকান্তি বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, বাজাও না!
হেমকান্তিদের সি আই টি রোডের পৈতৃক বাড়িটা ভেঙে বড় ফ্ল্যাট বাড়ি উঠছে। নিজের দাদার সঙ্গে শেয়ারে বাড়ি ছিল, বিক্রি করে দেওয়ার পর হাতে কিছু টাকা এসেছে, নতুন বাড়িতে একখানা বড় ফ্ল্যাটও পাবেন। তিনটে বেডরুম, ততদিন এই একটা ছোট্ট ভাড়া বাড়িতে থাকতে হচ্ছে। নীচের তলা, একটা বেডরুম, একটা বসবার ঘর, আর রান্নাঘর, বাথরুম। এই বসবার ঘরেই রাত্তিরে হেমকান্তিকে শুতে হয়। রিঙ্কি থাকে তার মায়ের কাছে। ছেলে চাকরি পেয়েছে। দুর্গাপুরে, সে মাঝে-মাঝে যখন আসে, তখন আরও অসুবিধে।
বসবার ঘরটাতেই অনেক কিছু ঠাসা।
টু-ইন ওয়ানে ক্যাসেট ভরে চালিয়ে দিল মলয়। বিরাট একটা ঝনঝন শব্দ হল। ইংরেজি গান! মাইকেল জ্যাকসান নাকী যেন নাম গায়কের। শুনলেই হেমকান্তির পিত্তি জ্বলে যায়। এই সব গানে না আছে সুর, না আছে ছন্দ। শুধু চ্যাঁচামেচি। অথচ রিঙ্কিরা এই সব শুনতেই ভালোবাসে। ওরা রবীন্দ্রসঙ্গীত, পল্লীগীতির ধারও ধারে না।
এখন এই গান বসে-বসে শুনতে হবে? অন্য ঘরে উঠে যাওয়ারও উপায় নেই। গায়ত্রী ফিরে এসে যদি দেখে মলয়কে তিনি একা বসিয়ে রেখেছেন, তাহলে বকুনি দিয়ে মাথা খাবে।
হেমকান্তি হাসি-হাসি মুখ করে রইল, ভেতরটা তাঁর জ্বলছে!
তিনি নিজেই অবশ্য তাঁর মনের মতিগতির ঠিক হদিশ পান না।
তাঁর মেয়ে রিঙ্কিকে যে বিয়ে করেছে, সে তো বাড়ির ছেলের মতনই হয়ে যাবে। মলয় খুব প্র্যাকটিক্যাল, এর মধ্যে একদিন ফ্রিজটা সারাবার জন্য তোক ডেকে এনেছিল। ভবিষ্যতে ওকে দিয়ে গায়ত্রীর অনেক উপকার হবে। এরা আধুনিক ছেলেমেয়ে। বিয়ের আগে থেকেই যদি পরস্পরের বাড়ি যাতায়াত করে, একসঙ্গে বেড়াতে বা সিনেমা দেখতে যায়, তাতে আপত্তির কী আছে?
রিঙ্কিও প্রায়ই যায় মলয়দের বাড়িতে। মলয় এখানে এসে প্রায়ই সন্ধ্যে কাটায়, দু-একদিন রাত্তিরে খাবারও খেয়ে যায়। কয়েক মাস আগে আর পরে। বিয়ের পরে মলয় তো এ-বাড়িতে না হোক, নতুন ফ্ল্যাটে এসে থাকবেও মাঝে-মাঝে। বাকি জীবনটার জন্য মলয় তাদের সংসারের সঙ্গে গেঁথে গেল।
হেমকান্তির তাতে বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। রিঙ্কির পছন্দের ওপর তিনি কোনওখানে হস্তক্ষেপ করতে চান না। বরং তিনি একটা বিরাট ঝামেলা থেকে বাঁচলেন। মেয়ের বিয়ের জন্য কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে হত যদি, বারবার পাত্রপক্ষের সামনে মেয়ে দেখানো, তারপর বিয়ের জিনিসপত্র, সোনাদানা নিয়ে দরাদরি, এসব একদম পছন্দ করেন না হেমকান্তি। অথচ করতে বাধ্য হতেন। রিঙ্কি সেই গ্লানি থেকে তাঁকে বাঁচিয়েছে। গায়ত্রীও খুশি, মলয়কে তাঁর খুবই মনে ধরেছে।
এ-বাড়িতে যখন মলয় আসে, তখনি গায়ত্রী কেমন যেন বদলে যান। তখন তাঁর এবং হেমকান্তির, এমনকী পরাণেরও একমাত্র কর্তব্য শুধু মলয়কে খুশি করা। রিঙ্কিও এক এক সময় মাকে বকুনি দেয়, মা, তুমি ওকে নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করো কেন? বেশি পাত্তা দিও না তো! অত জামাই আদরের যুগ এখন আর নেই!
কোনওদিন একসঙ্গে খেতে বসলে গায়ত্রী হেমকান্তির তুলনায় মলয়কে বড় মাছভাজা দেবেনই। মলয়কে তিনি আরও একখানা দেওয়ার জন্য জোর করবেন, কিন্তু স্বামীর কথা তখন তাঁর মনেই থাকে না। রিঙ্কিই বলে, এ কী, বাবাকে আর-একটা দাও।
হেমকান্তি হাত গুটিয়ে বলেন, না, আমি আর খাব না রে! আমার বেশি খাওয়া ভালো নয়।
সন্ধের দিকে মাঝে-মাঝে মদ্যপানের অভ্যেস আছে হেমকান্তির। কখনও দু-একজন বন্ধুও আসে। কোনওদিন এসব ব্যাপার তিনি স্ত্রী-পুত্র-কন্যার কাছে গোপন করেননি, হবু-জামাইয়ের কাছেও গোপন করার কোনও মানে হয় না।
একদিন হেমকান্তি তাঁর বন্ধু দেবেশের সঙ্গে বসে রাম খেতে-খেতে পুরোনো আমলের গল্প করছিলেন, এমনসময় এসে পড়ল মলয়।
হেমকান্তি দেবেশের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। নিজেদের গল্প বন্ধ হয়ে গেল, অন্য কথাবার্তা শুরু হল। দেবেশই একসময় মলয়কে জিগ্যেস করল, তুমি খাও নাকি? নেবে?
মলয় হাসি মুখে তাকিয়ে ছিল হেমকান্তির দিকে।
হেমকান্তি অতিরিক্ত উৎসাহ দেখিয়ে বলেছিলেন, যদি অভ্যেস থাকে তোনাও! এই যে গেলাস! আমি এসব ব্যাপারে কিছু মনে করি না। আমার সামনে তুমি স্বচ্ছন্দে সিগারেটও খেতে পারো। আমাকে অতটা ওল্ড ফ্যাশানড মনে কোরো না।
মলয় দু-তিন পেগ খেল, একটুও বেচাল হল না, কথাবার্তাতেও বাচালতা প্রকাশ পেল না। এই তো বেশ। এতে আপত্তির কিছু নেই।
কিন্তু পরে একদিন মলয় নিজেই একটা হুইস্কির পাঁইট কিনে এনে বলল, মেসোমশাই, এটা আপনার জন্য।
সঙ্গে-সঙ্গে হেমকান্তির মনটা গুটিয়ে গেল। একেবারেই পছন্দ হল না তাঁর। হেমকান্তির কোনও বন্ধু সেদিন আসেনি, মলয়ের সঙ্গে বসে-বসে ড্রিংক করতে হবে, এই সম্ভাবনাতেই তাঁর পেটটা গুলিয়ে উঠল। আজকাল তো নাকি অনেক বাবা-ছেলেও একসঙ্গে খায়। আগেও ছিল, রাজনারায়ণ বসুর বাবা তাঁর ছেলেকে নিজের হাতে মদ ঢেলে দিতেন। তাহলে জামাইয়ের সঙ্গে বসে খেতেই বা আপত্তি কীসের? আরও অনেক লোক থাকলে তবু চলতে পারে, কিন্তু শুধু জামাইয়ের সঙ্গে বসে মদ্যপানের চিন্তাটাই হেমকান্তির অসহ্য বোধ হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, আজ শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে, আজ আর আমি খাব না।
এক-একদিন মলয় তার দু-একজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে আসে। তারা রিঙ্কিরও বন্ধু। তখন তাদের জন্যে বসবার ঘরটা ছেড়ে দিতে হয়। একালের ছেলেমেয়েদের বাড়ি ফেরার তাড়া থাকে না। এক-একদিন তারা রাত দশটা পর্যন্ত আড্ডা মারে। হেমকান্তি পাশের ঘরে চুপচাপ বসে থাকেন।
একদিন তিনি গায়ত্রীকে বলেছিলেন, রিঙ্কিকে ডেকে বলবে নাকি? এবার ওরা আচ্ছা বন্ধ করুক। আমি ওঘরে গিয়ে শোব না? আমার ঘুম পাচ্ছে।
গায়ত্রী চোখ কপালে তুলে ধমকে বলেছিলেন, তুমি কি আক্কেলের মাথা খেয়েছ নাকি? ময়লদের চলে যেতে বলবে? ওরা গান-বাজনা শুনছে। এমন কিছু দেরি হয়নি। একদিন একটু জেগে থাকতে পারো না? তোমার আবার বেশি-বেশি ঘুম!
আগে ইলিশ মাছের পেটির মধ্যেই ডিমগুলো থাকত। এখন সবটা ডিম বার করে নিয়ে ভাজা হয়। মলয় ইলিশের ডিমভাজা খেতে খুব ভালোবাসে। ঝোলের মাছের ফাঁকা পেটির মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে হেমকান্তি ঘোরাতে থাকেন। তিনি যে ঝোলের মাছেরই ডিম পছন্দ করতেন, তা গায়ত্রী ভুলে গেছে।
মলয়ের এক দিদি-জামাইবাবু থাকে সুইডেনে, তারা বেড়াতে এসেছে কলকাতায়। জামাইবাবুর অফিসের কিছু একটা কাজও আছে দিল্লিতে। এখন কলকাতায় এসে গেল, শীতকালে আবার মলয়-রিঙ্কির বিয়েতে আসতে পারবে না। ওরা একদিন রিঙ্কিকে খাওয়াতে নিয়ে গেল পার্ক স্ট্রিটে।
সে রাতে ফিরে এসে রিঙ্কি বলল, মা, মলয়ের দিদি কী চমৎকার মানুষ তুমি ভাবতে পারবে না। আর ওর জামাইবাবুও দারুণ ভালো। ওরা একদিন তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। মলয় তোমার এত প্রশংসা করেছে দিদি-জামাইবাবুর কাছে—
গায়ত্রী বলল, ঠিক আছে, ওদের একদিন আসতে বল।
শুধু আসতে বললেই তো হয় না, নেমন্তন্ন করতে হয়। বিয়ের সময় ওরা থাকবে না, সুতরাং ভালো করে খাওয়ানো উচিত।
হেমকান্তি এলাহি বাজার করে আনলেন।
দিদি-জামাইবাবু, তাদের দুটি ছেলেমেয়ে, সেই সঙ্গে মলয়ের ছোট বোনকেও বাদ দেওয়া যায় না। এইটুকু ফ্ল্যাটে এত লোকের জায়গা হওয়াই মুশকিল। মলয় অবশ্য দিদিকে অনেকবার জানিয়েছে যে রিঙ্কিরা শিগগিরই সি আই টি রোডের নিজস্ব বড় ফ্ল্যাটে উঠে যাবে।
বসবার ঘরে জামাইবাবু, রিঙ্কি, মলয়, আর দিদির ছেলেমেয়ে দুজন। শোওয়ার ঘরে মলয়ের দিদি আর ছোট বোন। মলয়ের দিদি সত্যি এক মিনিটে মানুষকে আপন করে নিতে পারে। বিদেশে থাকো বলে কোনও অহঙ্কার নেই। গায়ত্রীর সঙ্গে তার কত গল্প।
হেমকান্তি কিছুক্ষণ বসলেন বসবার ঘরে। প্রথম দিকে সবাই তাঁকে খুব খাতির করল। তারপর তারা এমন পারিবারিক গল্পে মেতে উঠল যে হেমকান্তি তাতে যোগ দিতে কোনও উৎসাহ বোধ করলেন না। তাঁর হাই উঠতে লাগল। রিঙ্কি আর দুদিন পরেই ও বাড়ির বউ হয়ে যাবে, সুতরাং মলয়দের বাড়ির একটা পোষা কুকুর কিংবা পুরোনো রান্নার লোক সম্পর্কে চুটকি শুনতে তার আগ্রহ হতে পারে, কিন্তু হেমকান্তি এসব কতক্ষণ ধরে শুনবেন?
তিনি উঠে এলেন পাশের ঘরে।
গায়ত্রী কী যেন একটা কথা নিয়ে খুব হাসাহাসি করছে অন্য দুই নারীর সঙ্গে। মলয়ের দিদি হেমকান্তিকে দেখে সম্ভ্রমের সঙ্গে বললেন, বসুন, মেসোমশাই বসুন।
গায়ত্রী বললেন, তুমি আবার এখানে এলে কেন? মেয়েদের কথা তুমি কী শুনবে? অন্য জায়গায় যাও না।
আর অন্য জায়গা কোথায়?
বাথরুমের কাছে চিলতে বারান্দা। হেমকান্তি সেখানে এসে দাঁড়ালেন, তাঁর মুখে একবার রাগ, একবার বিষণ্ণতা ঢেউ খেলে যাচ্ছে।
একদিন ছিলেন তিনি এই পরিবারের প্রধান ব্যক্তি। একমাত্র পুরুষ। তাঁর ইচ্ছে-অনিচ্ছের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করত, তাঁর ভালো-লাগা, মন্দলাগার মূল্য দিত অন্যরা। এখন থেকে মলয় সেই জায়গা নিয়ে নেবে। গায়ত্রীর কাছেও তাঁর আর মূল্য নেই।
মাত্র একষট্টি বছর বয়েস হয়েছে হেমকান্তির। শরীরে কোনও স্থায়ী রোগ নেই। গায়ে জোর আছে যথেষ্ট। তবু অন্য একজন ছোকরা এসে তাঁকে বুড়োদের দলে, বাতিলের দলে ফেলে দিচ্ছে। তিনি এখন আর হেমকান্তি নামে একটি ব্যক্তিত্ব নন, তিনি রিঙ্কির বাবা!
বুনো পশুদের মধ্যে একজন থাকে যূথপতি। তাকেই সবাই মানে। সে বুড়ো হয়ে গেলে অন্য একটা জোয়ান পশুর সঙ্গে তার লড়াই হয়, একদিন, জোয়ানটা জিতে গেলে সে-ই দলপতির জায়গা নেয়, বুড়োটা দল ছেড়ে চলে যায়। মানুষের সমাজেও যে অনেকটা সে রকমই, তা এতদিন খেয়াল করেননি হেমকান্তি। মলয় তাঁর জায়গা কেড়ে নিতে এসেছে।
কিন্তু লড়াই তো হল না। হেমকান্তির গায়ে এখনও যথেষ্ট শক্তি আছে ইচ্ছে করলে তিনিও আধ বোতল মদ উড়িয়ে দিতে পারেন, অন্য মেয়ের সঙ্গে প্রেমও করতে পারেন। মলয়কে তিনি এত সহজে জায়গা ছেড়ে দেবেন কেন?
পরের মুহূর্তেই হেমকান্তির লজ্জা হল। মলয় তাঁর অতি আদরের অতি স্নেহের মেয়ে রিঙ্কির স্বামী হতে যাচ্ছে। তার সঙ্গে লড়াইয়ের প্রশ্ন আসে কী করে? তিনি কি এত স্বার্থপর হতে পারেন? রিঙ্কির যাতে ভালো হয়, সে যাতে জীবনে সুখী হয়, তা তিনি চাইবেন না।
মানুষের সমাজেও লড়াই হয়, কিন্তু বাইরে থেকে বোঝা যায় না। মলয়ের সঙ্গে তাঁর লড়াই চলছিল অনেক দিন ধরেই, হেমকান্তি কখন যে হেরে বসে আছেন, তা তিনি টেরও পাননি।
তিনি বুক খালি করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।