যুদ্ধাপরাধের বিচার সরকার শুধু একা করছে না, আমরাও করছি। তাই এ ব্যাপারে সরকারকে সাহায্য করতে হবে। প্রতিমুহূর্তে এই একটি ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে থাকতে হবে। অন্য জায়গায় বিরোধিতা করতে পারি। সরকার যখন দুর্নীতি করবে, ভুল করবে; আমরা সক্রিয়ভাবে প্রতিবাদ করব। যুদ্ধাপরাধের বিচারের ব্যাপারে সরকারকে ক্রমাগত সাহায্য করতে হবে।’
নিজের ৬০তম জন্মদিনে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও জনপ্রিয় লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে এভাবেই নিজের মত জানালেন। একই সঙ্গে জানলেন, এই বিচারকাজের ফলাফলের জন্য তিনি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে রাজি আছেন।
জনপ্রিয় লেখক ও শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবালের জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে আজ সকাল ১০টার দিকে প্রথম আলোর সাংবাদিক গিয়েছিলেন। সেই আলাপচারিতা তুলে ধরা হলো প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য—
প্রথম আলো: এই জন্মদিনে মায়ের সঙ্গে কী কথা হয়েছে?
মুহম্মদ জাফর ইকবাল: আমাদের সব ভাইবোনের জন্মদিন হয় নভেম্বর, নইলে ডিসেম্বর। আমাদের বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ এ বছরই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। এবার তাই কেউই জন্মদিনের কোনো অনুষ্ঠান করছেন না। মায়ের সঙ্গে এখনো কথা হয়নি। দিনের কোনো একসময় কথা হবে। এ বছর জন্মদিন এলেই আমাদের মন খারাপ হয়, আমাদের মধ্যে কেউ একজন নেই।
প্রথম আলো: বাংলাদেশে বিজ্ঞান, গণিত, তথ্যপ্রযুক্তিকে জনপ্রিয় করতে আপনি সচেষ্ট। এ ব্যাপারে আপনার চাওয়া?
মুহম্মদ জাফর ইকবাল: অনেক বেশি চাওয়া, না অল্প? অনেক বেশি হলে, বাংলাদেশ এমন দেশ হবে যে ছোট ছোট দেশগুলোকে সাহায্য করবে। এখন যে বড় বড় দেশগুলো আছে, তারা একে অন্যকে দখল করে, অত্যাচার করে, সর্বনাশ করে ছেড়ে দেয়। বাংলাদেশ যেন তেমন দেশ না হয়, বাংলাদেশ যেন দায়িত্ব নেয়।
আর অল্প হলে, বাংলাদেশের সব ছেলেমেয়ে যেন পড়াশোনা করে। সকালে বাইরে তাকালে যেন দেখতে না হয় তারা ফুল বিক্রি করছে, পপকর্ন বিক্রি করছে, ইট ভাঙছে। সব বাচ্চা যেন স্কুলে যায়। তাহলে বাংলাদেশকে নিয়ে আলাদাভাবে চিন্তা করতে হবে না। তারা নিজেরাই নিজেদের সমস্যার সমাধান করবে।
প্রথম আলো: শিশু ও তরুণদের আদর্শ আপনি। তরুণ প্রজন্ম নিয়ে আপনার স্বপ্ন?
মুহম্মদ জাফর ইকবাল: তাদের নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখি। তারা দেশকে এত ভালোবাসে। এ নিয়ে আমাদের আলাদা করে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। আমি মনে করি, তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়। আমি সব সময় বলি, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ো। তাহলে দেশকে ভালোবাসবে। তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানে, দেশকে ভালোবাসে।
রামুর বৌদ্ধবিহারে হামলার ঘটনার পর ভেবেছিলাম, দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক ছেলেমেয়ে বিশালভাবে আন্দোলন করবে, রাগ-ক্ষোভ প্রকাশ করবে। বিষয়টা তাদের মাথায় রাখতে হবে। বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে মারার ঘটনায় অনেকে প্রতিবাদ করছে না। ছাত্রলীগ সরকারি দল, কাজেই ভয় করছে। প্রতিবাদ করলে না জানি কী হয়। তরুণদের সত্য কথা সাহসের সঙ্গে বলতে হবে।
প্রথম আলো: শিশু ও তরুণদের জন্য আপনার পরামর্শ?
মুহম্মদ জাফর ইকবাল: আমি পরামর্শ দিতে পছন্দ করি না। আমি চাই, শিশুরা আনন্দময় পরিবেশে পড়ুক। যারা স্কুলে যায় তারা কোচিং বন্ধ করুক। তারা যেন গাইড বই না পড়ে। তারা শিক্ষকদের বাধ্য করুক, স্কুলকে আনন্দময় করার জন্য। সবাইকে বলব, অনেক বেশি বই পড়তে। ছেলে বা মেয়ে কী শিখল, তার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি সে কল্পনা করতে পারে কি না। একটি বই পড়লে অনেক কিছু কল্পনা করতে পারা যায়। আরেকটি কথা বলব, তারা যেন টেলিভিশন কম দেখে। এতে কল্পনাশক্তি কমে যায়।
সবাই বই পড়ো। যত বেশি বই পড়বে, তত বেশি সৃজনশীলতা বাড়বে, দেশ, পৃথিবী ও সমাজকে অনেক বেশি দিতে পারবে।
প্রথম আলো: যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে আপনার প্রচেষ্টা ছিল, এখনো আছে। শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে আপনি কি যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়ার গতি নিয়ে সন্তুষ্ট?
মুহম্মদ জাফর ইকবাল: বিষয়টা অনেক জটিল। যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া থামানোর জন্য, যাদের বিচার করা হচ্ছে, তাদের দল জামায়াতে ইসলামী ও তাদের সংগঠনগুলো যেভাবে লেগেছে, যেভাবে সারা পৃথিবীতে টাকা-পয়সা খরচ করছে; আমাদের সবার যে দাবি, সেটি কঠিন করে দিচ্ছে। প্রমাণ পাই কীভাবে? যখন দেখি মার্কিন রাষ্ট্রদূত এসে এমন কথা বলেন, যে কথাগুলো শুনলে মনে হয় তিনি আমাদের দেশের ইতিহাস কিছু জানেন না বা যুদ্ধাপরাধের বিচার হোক সেটা চান না। শুধু তিনি নন, অন্যদের সঙ্গেও কথা বলেছি, বিশেষ করে বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে। তাঁদের কথা শুনলে আমার খুব বিরক্ত লাগে। ১৯৭১ সালে আমাদের দেশে যখন ঘটনাগুলো ঘটেছিল, তাঁরা একটি কথাও বলেননি। আমেরিকা, চীন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো পাকিস্তানের সঙ্গে ছিল। লাখ লাখ মানুষ মারা গেছে, একটিবারের জন্যও তারা নিন্দাসূচক কথা বলেনি।
এত দিন পর আমরা যখন বিচারকাজ শুরু করেছি, তখন বিচারপ্রক্রিয়াকে ব্যাহত করার জন্য, কঠিন করার জন্য, বন্ধ করার জন্য তারা সাহায্য করা শুরু করেছে। আমরা যদি সরকারকে শুধু বলি, তুমি কেন বিচার তাড়াতাড়ি করছ না? মনে রাখতে হবে, বিচার শুধু সরকার একা করছে না, আমরাও করছি। এ কাজে সরকারকে সাহায্য করতে হবে। প্রতিমুহূর্তে এই একটি ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে থাকতে হবে। অন্য জায়গায় বিরোধিতা করতে পারি। সরকার যখন দুর্নীতি করবে, ভুল করবে; আমরা সক্রিয়ভাবে প্রতিবাদ করব। যুদ্ধাপরাধের বিচারের ব্যাপারে সরকারকে ক্রমাগত সাহায্য করতে হবে। যুদ্ধাপরাধের বিচার আরও তাড়াতাড়ি করতে পারলে খুশি হতাম। তবে জানি, কাজটা তাদের জন্য কত কঠিন হচ্ছে। তাই আমি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে রাজি আছি।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো
ডিসেম্বর ২৩, ২০১২