যদি
বড় দুশ্চিন্তায় আছি মশাই! মেয়ের বিয়ে দিতে হবে? আপনি বলবেন, এতে আবার দুশ্চিন্তার কি পেলেন? ট্যাঁকের জোর বুঝে, ‘গ্রুম মার্কেট’ থেকে তুড়ুম ঠুকে পছন্দসই পাত্র কিনে এনে পাত্রীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে সুখের সংসার সাজিয়ে দাও। সবই তো টাকার খেলা, ভাই।
ঠিকই। দুনিয়া টাকার চাকায় বাঁধা! টাকার চাকা গড়ায়, কিন্তু কোন দিকে? সুখের দিকে, না দু:খের দিকে? ধরা যাক, ভিটে মাটি চাঁটি করে লাখে উঠে লক্ষ্মীমন্ত একটি বাবাজী আমি ধরে নিয়ে এলুম। বেশ দাপটের চাকরি, কিম্বা প্রাোফেসান। খুব শিক্ষিত। দেখতে শুনতে ভালো। ঘর সাজিয়ে দেওয়াথোয়া করলুম। কোনও কৃপণতা হল না। খুব সানাই বাজালুম। খুব লোক খাওয়ালুম। তারপর! আমার মেয়ে সুখী হবে তো!
মানুষের বাইরেটা দেখা যায়। ভেতরটা যে দেখা যায় না! প্রথম রাতের হাসি, প্রথম রাতের সদাচার রাত না পোহাতেই যদি কান্না আর কদাচারে কদর্য হয়ে ওঠে! বলতে পারেন, যদির কথা নদীর জলে। যদির ভয়ে আতঙ্কিত হবার কোনও মানে হয় না। কিন্তু যদিই যে আজকাল বড় বেশি সত্য হয়ে উঠছে। মন বলে মানুষের যে আজকাল কিছুই নেই। পুরনো মন ভেঙেচুরে তাল তুবড়ে গেছে। নতুন মন নতুন আদর্শ নতুন বিশ্বাস তৈরি করছে। কাকে কতটা বিশ্বাস করা যায় এই নয়া জমানায়!
কারুর হাতে একটা জীবনের দায়িত্ব তুলে দিতে বড় ভয় করে। দায়িত্বশীল মানুষের সংখ্যা ক্রমশই কমছে। বলবেন, মেয়েরা মানিয়ে নিতে জানে, সহ্য করতে পারে। বিয়ে তো আপনার নয়, আপনার কন্যার। যেখানে গিয়েই পড়ুক না কেন, ঠিক গুছিয়ে নেবে।
গুছোবার প্রশ্ন আসছে কেন? মানাবার কথা উঠছে কেন। যথোচিত মূল্যে আমি যখন একটি পাত্র কিনছি তখন সে তো অনেকটা কেনা জুতো, কেনা জামার মতোই। খুঁত-খুঁত করে মেনে নেবার প্রশ্ন আসে কি করে? কেউ তো দয়া করে আমার মেয়েটিকে নেবে না, নাক দেখবে, চোখ দেখবে, চলন দেখবে, বলন দেখবে, কালচার দেখবে, চুল দেখবে, নখ দেখবে। তারপর মেয়ের বাপকে দেখবে। বেশ ভালো করেই দেখবে। দেখার পর ভদ্রলোক দেউলে হবে। তারপর অনবরতই দেখতে থাকবে। লিভার তখন বাবাজীর হাতে।
জানা ছিল না। বাবাজীর একটা মুদ্রাদোষ আছে। শনিবার-শনিবার ওই ময়দানের ওপাশে বড় মাঠে যান। ভিকটোরিয়ার টানে নয়। হ্রেষাকর্ষণ কেশাকর্ষণ করে নিয়ে যায়। ঘোড়া ছুটিয়ে বাবাজী কিঞ্চিৎ বিদেশি আনন্দ আহরণ করেন। পূর্ণ প্রাণে গিয়ে শূন্য প্রাণে ফিরে আসেন। আসার সময় সেই শূন্যতায় কিঞ্চিৎ আরক ঢালেন, দুই, তিন, চার। জীবন বড় যন্ত্রণা রে বাপ! ফিরে এসে তিনি স্ত্রীর ওপর তবলা সাধেন। দূরে দাঁড়িয়ে তার গর্ভধারিণী দেখেন। সোনার চাঁদ ছেলে পরের মেয়ের ওপর তাড়া-ফাঁক-তাল অভ্যাস করছেন। গর্বে বুক দশ হাত, বাপকা বেটা। বাবাজীর আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। শ্বশুরকে হতে হবে ব্যাংকার। লিভারে চাপ মারলেই টাকা ছাড়তে হবে। নয় তো মেয়েটাকে ধামসে শেষ করে দেবে।
সকালবেলা বোঝে কার বাপের সাধ্য! স্যুটেড, বুটেড, ফুলকো টেরি, ব্রিফ কেস, মন-কেমন করানো পারফিউম। মুখে ইন্টারন্যাশনাল বুলি। সমাজ-চেতনা, বিশ্ব-চেতনা, স্পোর্টস, পলিটিক্স। সূর্য ডুবলেই ফ্রাসট্রেসান। যোগ্যতার পুরস্কার মিলল না। প্রতিভাকে কেউ চিনল না। এক পালকের আর একটি পাখি বললে, ইয়েপ। দুই ইয়ারে পার্কস্ট্রিটের বারে বসে চাঙ্গায়িনী সুধা পান করে, সখি আমায় ধরোধরো অবস্থায় বাড়ি ফিরলেন। আমার পঞ্চাশ হাজারে কেনা হীরের টুকরো।
আমার প্রতিবেশীর কাহিনি শুনে ভয়ে মরি। বেশ শাঁসালো ঘরে একমাত্র মেয়েকে পাত্রস্থ করেছিলেন। পয়সার অভাব নেই, কিন্তু কুচুটে স্বভাব। বাবাজী বায়না ধরলেন, একটি স্কুটার চাই। মেয়ের বিয়ে দিয়ে ভদ্রলোক সর্বস্বান্ত। একটু দম নিতে চেয়েছিলেন। মেয়েটি কিন্তু বেদম হয়ে গেল। দিন কতক কম্বল ধোলাই চলল। তাতেও যখন শ্বশুরমশাই স্কুটার প্রসব করলেন না, তখন এক শিশি কীটনাশক দিয়ে বলা হল, খেয়ে নাও তো মা। তুমি মরলে দ্বিতীয় পক্ষ স্কুটার চেপে এসে পড়বে। মেয়ে আপত্তি করায় বলা হল, বঙ্গললনা, স্বামীর অবাধ্য হতে নেই, বাপ-মায়ের বদনাম হবে, মা। তুমি কেমন বাপের মেয়ে! মৃত্যুটা আত্মহত্যা বলে বেমালুম চলে গেল। যেমন দেশ তার তেমন নিয়ম।
আবার এমন ছেলেও আছে, যে বিশ্ব-প্রেমিক। বিয়ের পরেও যার প্রেমে ভাঁটা পড়ে না। জোয়ারের স্রোত বইতে থাকে। একবার একে ধরে টানে, একবার ওকে ধরে টানে। সাতপাকের আসল বাঁধন শিথিল হয়ে আসে। বলতে থাকে ঘরকা মুরগি ডাল বরাব্বর। পাখি অমনি উড়তে শুরু করল। ঘরেরটি রইল ঠোকর মারার জন্যে। বাইরেরটি রইল প্রেমের জন্যে। বলবেন, পলিগ্যামি ইজ এ টেনডেনসি ইন ম্যান। পূর্বপুরুষের ইতিহাস নাড়াচড়া করে দেখুন, কি সব ইতিহাস ছেড়ে রেখে গেছে! সাজ, পোশাক, জীবিকা পালটেছে। শিক্ষার ধারা পালটেছে। মন তো সেই একই আছে। জরু আর গরুকে একই সারিতে ফেলে রাখা হয়েছে। কেতাদুরস্ত বৈঠকখানা, আলমারি ঠাসা বই, দাঁতনের বদলে টুথপেস্ট, কয়লার বদলে গ্যাস, স্টিরিও, টিভি, ফ্রিজ, ফোন, সংবিধান, ডেমোক্রেসি, শীততাপনিয়ন্ত্রিত অফিস, মুরগি-মটন-ফ্রায়েড রাইস, গ্রহান্তরে মানুষের বিজয় বার্তা, এদিকে বাঙালির ঘরে-ঘরে বঙ্গললনা চোলাই হচ্ছে, ধোলাই হচ্ছে, পুড়ে মরছে, ঝুলে মরছে। ঘরে-ঘরে যেন আড়ং ধোলাইয়ের ধোবিখানা বসে গেছে। সানাইয়ের সুরে পুত্রবধু এনে কান্নার সুরে নির্বাসন। বাবাজীবনকে এ ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য তাঁর গর্ভধারিণী, পিতা, ভ্রাতা, ভগিনী সবাই প্রস্তুত। বারান্দা থেকে ঠেলে ফেলে দাও, কেরোসিনে চুবিয়ে কাঠি মেরে দাও। সাধ করে কে মশাই মেয়েকে কসাইখানায় পাঠাতে চায়, তবু পাঠাতে হয়!
আমি কি সেই বোকা, যে যদির কথা ভেবে এত কাতর! গল্পটা তা হলে শুনুন। ভোর বেলা কুয়োতলায় জল তুলতে গিয়ে কর্তা হাপুস নয়নে কাঁদছেন। গৃহিণী ছুটে এলেন—কি হল কি তোমার?
কর্তা বললেন, ওই সাংঘাতিক কুয়ো, কি ভীষণ গভীর! ওগো কি হবে গো! তোমার মেয়ের একটি ছেলে হয়েছে। সেই নাতিটি একদিন বড় হবে, একদিন আমাদের বাড়ি বেড়াতে আসবে, তারপর খেলতে-খেলতে চলে আসবে এই কুয়োর পাড়ে, তারপর সে ঝুঁকে দেখতে যাবে কত জল, তারপর হঠাৎ পা ফসকে যদি উলটে পড়ে যায়, ওগো, তখন কি হবে গো!
গৃহিণী সঙ্গে-সঙ্গে সুর ধরলেন, ওগো কি হবে গো!
আমিও কি সেই গল্পের বোকা, যদির আতঙ্কে যন্ত্রণা পাচ্ছি!