ময়নার বোন
ময়না আর বুধনি খুন হওয়ার পরে কেটে গেছে দেড় মাস। এই জোড়া খুনের কোনও কিনারাও হয়নি, কেউ ধরাও পড়েনি। কে খুন করেছে তা সবাই জানে, পুলিশও জানে নিশ্চয়ই, কিন্তু পুলিশের খাতায় খুনের উল্লেখই নেই। লেখা আছে, অজ্ঞাত কারণে মৃত্যু।
দুজন মানুষ, বিশেষত দুটি যুবতী মেয়ে খুন হলে পুলিশ কত রকম তদন্ত করে, কুকুর আনে, ডিটেকটিভরা গোপন অনুসন্ধানে লেগে যায়, এ সব থাকে গল্পের বইতে। কিংবা শহরে ও রকম হয় বোধহয়। গ্রামের গরিব ঘরের দুটি মেয়ে কেন মরল, কীভাবে মরল, তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। দু-চারদিন পর সবাই ভুলে যায়।
অসুখে ভুগে মৃত্যু হলে তবু বাড়ির লোকেরা কয়েকদিন কাঁদে। কিন্তু খুন-টুনের ব্যাপার হলে বাড়ির লোকরা জোরে শোক প্রকাশ করতেও ভয় পায়। কেন না, খুনীরা তখনও নজর রাখে সে বাড়ির ওপর।
শুধু মিলন সমিতির লোকজনেরাই সে মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি। সে সমিতির পরিচালক জীবনদা থানায় ঘোরাঘুরি করেছেন কয়েকবার, এস ডি ও-র কাছেও সুবিচার চেয়েছেন।
এস ডি ও কিংবা থানার দারোগা কেউই খারাপ ব্যবহার করেন না জীবনদার সঙ্গে। খাতির করে বসতে বলেন, চা খাওয়াতে চান। এস ডি ও ভদ্রলোকের ব্যবহার খুব সুহৃদয়, তিনি বলেন, এর মধ্যে ফাউল প্লে আছে বুঝতেই পারছি। কিন্তু থানার রিপোর্ট না পেলে আমি কিছু করতে পারি না। এস ডি পি ও সাহেবকে খোঁজ নিতে বলেছি।
থানার দারোগার নাম সুকোমল নন্দী। নিশ্চয়ই বাবা-মা অনেক আশা করে এই নাম রেখেছিলেন। এরকম নিষ্ঠুর মানুষ কদাচিৎ দেখা যায়। ব্যবহারে অবশ্য তা বোঝার উপায়টি নেই। নিজে চায়ের কাপ নিয়ে এসে রাখেন জীবনদার সামনে, টেবিলের ওপর।
সুকোমল নন্দীর একটাই কথা, খুনের প্রমাণ কোথায় বলুন!
ময়না আর বুধনির বাড়ি ছিল প্রায় পাশাপাশি। মাঝখানে শুধু কয়েকটা খেজুর গাছ। ময়না বিয়ের দু-বছরের মধ্যেই বিধবা, বুধনির বিয়েই হয়নি। ওরা দুজনেই তাঁত বোনা শিখছিল মিলন সমিতিতে।
একদিন ভোরবেলা দেখা গেল, একটা জলার ধারে পড়ে আছে ওদের মৃতদেহ। দীনু নামে একজন জেলে সেই সাতসকালে মাছ ধরতে গিয়ে ওদের দেখতে পায়। কারুর শরীরেই কোনও গুলির দাগ বা ছোরাছুরির ক্ষত নেই।
দারোগা বললেন, আত্মহত্যা, বুঝলেন স্যার, আত্মহত্যা ছাড়া আর কী হবে বলুন!
জীবনদা বললেন, আত্মহত্যা? দুজনে একসঙ্গে? আমাদের সমিতিতে আসতো, বেশ ভালোই কাজ শিখেছিল, সকলের সঙ্গে হেসে কথা বলত, খামোখা হঠাৎ আত্মহত্যা করতে যাবে কেন বলুন?
দারোগা বললেন, মানুষ কেন যে আত্মহত্যা করে, তা অনেক ক্ষেত্রেই জানা যায় না। হয়তো ওদের প্রেমঘটিত কোনও ব্যাপার ছিল।
প্রেম শব্দটা শুনে জীবনদা ভুরু কুঁচকে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। ময়না আর বুধনির জীবনে প্রেমের । মতন শৌখিন ব্যাপার একেবারেই অবাস্তব। দুজনেরই তেমন রূপ বা স্বাস্থ্য ছিল না।
জীবনদা বললেন, আত্মহত্যা, শেষরাতে একটা জলার ধারে এসে আত্মহত্যা করবে কেন? এর কোনও যুক্তি আছে।
একগাল হেসে দারোগা বললেন, এই দেখুন, আবার যুক্তির কথা বলছেন। মেয়েরা কখন কী করে, কেন করে, তা বোঝা শিবের বাপেরও অসাধ্য। ওরা কেন বিছানায় শুয়ে আত্মহত্যা করেনি, কেন গলায় দড়ি দিয়ে ঝোলেনি কিংবা গায়ে আগুন দেয়নি তা বোঝার আর কোনও উপায়ই নেই। হয়তো ওদের বাড়ির লোকদের ঝামেলায় ফেলতে চায়নি। সারা শরীরে কোনও ইনজুরি নেই, কী করে খুনের কেস বলব বলুন!
—ইনজুরি না থাকলেও খুন হতে পারে না? গলা টিপে মারতে পারে।
—গলায় সেরকম কোনও দাগ ছিল না। রিপোর্টে কিছু লেখা নেই।
—যিনি রিপোর্ট লিখেছেন, তিনি না দেখতে পারেন। কিংবা দেখলেও ইচ্ছে করে না লিখতে।
—আমি নিজে গেসলাম ইনস্পেকশানে। গলায় কোনও হাতের ছাপ দেখিনি।
—আরও অনেক রকমভাবে খুন করা যেতে পারে। বিষ খাইয়ে, মুখে বালিশ চাপা দিয়ে…। পোস্ট মর্টেমেরও কোনও ব্যবস্থা হল না।
—এটা কি মশাই বিলেত-আমেরিকা পেয়েছেন?
দারোগাবাবু বোঝালেন যে, গ্রামদেশে সে রকম ব্যবস্থাই নেই। ডেডবডি রাখার জন্য মর্গ নেই। প্রচণ্ড গরমে বডি পরদিনই পচতে শুরু করেছিল। পোস্ট মর্টেমের জন্য জেলা শহর কিংবা কলকাতায় পাঠাতে হয়। পুরো বডি না পাঠিয়ে ভিসেরা নামে একটা প্রত্যঙ্গ পাঠালেও চলে। শহর থেকে তার রিপোর্ট আসতে কত বছর লাগবে তার ঠিক নেই। অনেক সময় রিপোর্ট আসেই না। ডোমদের বলা হয়েছিল, তারা ভিসেরার ব্যাপারটা বুঝতেই পারেনি, দুটো বডিই পুড়িয়ে দিয়েছে।
জীবনদা উত্তেজিতভাবে বললেন, এসব আপনি যাই-ই বলুন বড়বাবু, আপনিও জানেন, আমিও জানি, মেয়ে দুটো খুন হয়েছে!
দারোগাবাবু হাতের পেন্সিল দিয়ে টেবিলে টক-টক শব্দ করতে-করতে শান্ত গলায় বললেন, আপনি জানতে পারেন, কিন্তু আমি জানি না। খুনের মোটিভ কী? দুটো অবলা মেয়েছেলে, গায়ে গয়নাগাঁটিও ছিল না, তাদের কেন খুন করা হবে বলুন। কার দায় পড়েছে!
জীবনদা বললেন, তার কারণ আমাদের সমিতিতে যোগ দেওয়ার আগে ওরা দুজনে মদ বিক্রি করত। জেলেপাড়ায় চুল্লুর ঠেকে বসত!
দারোগাবাবু ভুরু তুলে সবিস্ময়ে বললেন, তাই নাকি?
জীবনদা বললেন, আপনি এটা জানতেন না। এখানে চুন্নুর ঠেক যেন দিন-দিন বাড়ছে, তা জানেন আশা করি?
—তা জানি। আমরা মাঝে-মাঝেই রেড করি। ব্যাটাদের ধাওয়া করে দূর করে দিই।
—না, ওদের দূর করে দ্যান না। এক জায়গা থেকে সরে অন্য জায়গায় বসতে বলেন। ওদের কারবার ঠিকই চলছে।
—এ তো হল অন্য কথা। আগে বলুন, মেয়ে দুটো চুলু বিক্রি করত বলেই খুন হল কেন? আমি তো এর মানে বুঝতে পারছি না। তাও একজন নয়, দুজনে এক সঙ্গে।
—এর মানে খুবই সোজা। চুল্লু বিক্রি করলে ওরা খুন হত না। আরও তো কত মেয়ে চুল্ল বেচে। শুধু এই দুজন চুন্নুর ঠেক ছেড়ে দিয়ে যোগ দিয়েছিল আমাদের সমিতিতে। ওই নোংরা কাজের মধ্যে জড়িত না থেকে ওরা সৎ হতে চেয়েছিল। তাঁতের শাড়ি বোনা শিখে নিজেরা উপার্জন করতে পারত।
—তা বেশ তো। আপনাদের সমিতির ওপর যাতে কখনও হামলা না হয়, আমরা সেদিকে নজর রাখি।
—সে কথা হচ্ছে না। আমাদের সমিতির ওপর হামলা করার সাহস কারুর নেই। যাতে চুন্নুর ঠেক ছেড়ে আর কোনও মেয়ে আমাদের সমিতিতে আসতে না চায়, সৎপথে ফিরে যেতে না চায়, তাই ওই দুটি মেয়েকে খুন করে অন্যদের ভয় দেখানো হল।
—এসব, দাদা আপনি গপ্পো বানাচ্ছেন। প্রথমত খুনেরই কোনও প্রমাণ নেই।
—সে প্রমাণ আপনারাই লোপ করেছেন। কারা খুন করেছে, তাও আপনি ভালো জানেন!
—বটে! আপনিই বলে দিন না।
—যারা চুল্লুর ব্যাবসা চালায়। কার্তিক আর দুলাল যাদের পাণ্ডা! দুলালের সঙ্গে আপনার খুবই দহরম মহরম আছে শুনেছি।
—শুনেছেন? বেশ করেছেন। এ বার আমার নামে রিপোর্ট করুন ওপরওয়ালার কাছে। লিখুন যে, আমি ঘুষ খাই! লিখুন, লিখুন, ভালো করে লিখুন! তবে, একটা কথা আপনাকে বলে দিই দাদা। আপনি কার্তিক আর দুলালের নাম করলেন, ওদের আড়ালে কে-কে আছেন, তা কি জানেন? জানেন, চুল্লুর ব্যাবসা মানে কত কোটি টাকার ব্যাবসা? এসব জানার চেষ্টা করুন।
২
মিলন সমিতিতে যোগ দিয়ে ময়না আর বুধনি তাঁতের কাজ শিখে কিছু হাত খরচ পেতে শুরু করেছিল। চুন্নুর ঠেকের রোজগারের চেয়ে তা কিছু কম হলেও এই উপার্জনে তার আনন্দ ছিল বেশি। চুন্নুর ঠেকে বসবার সময় তাকে অনেক অপমান সহ্য করতে হত, নেশার ঝোঁকে কেউ কেউ তার হাত ধরে টানত। মিলন সমিতিতে চমকার হাসি খুশি পরিবেশ, কাজের সঙ্গে-সঙ্গে গান গাওয়া হত।
এই উপার্জনের টাকায় ময়না তার ভাই-বোনের জন্য নতুন জামা কিনে দিয়েছে। কখনও কিনে আনত পাটালি গুড়, ফুলকপি। চাল-ডাল কিনেও সংসারের সাহায্য করত, একবার শখ করে। বেশি দাম দিয়ে কিনে এনেছিল মুগের ডাল। এর আগে, এ-বাড়িতে কখনও মুগের ডাল রান্না হয়নি।
ময়নারা চার ভাই বোন, তার মধ্যে বড় দাদা আসানসোলে কিছু একটা কাজ নিয়ে চলে গেছে, এ-বাড়ির সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখে না। অন্য ভাই-বোন দুটি ছোটো। মা নেই। নিজস্ব জমি জিরেও নেই, বাবা অন্যের জমিতে মজুরি করে। ময়নার মৃত্যুতে শোক করার চেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা হল অভাব নিয়ে। ময়নার উপার্জনটুকু বন্ধ হয়ে গেল, সেই অভাবটা ভরাট হবে কী করে?
বুধনিদের সংসারে অনেক লোক, তিনটি বাচ্চাকে নিয়ে এগারোজন, সেই জন্য এক জনের চলে যাওয়াটা বেশি টের পাওয়া যায় না। কিন্তু ময়নার অভাবে তাদের বাড়িটা যেন ফাঁকা হয়ে গেছে।
ময়নার পরের বোনের নাম সতী, সবে মাত্র সে সতেরোয় পা দিয়েছে। সতী ইস্কুলে পাঁচ ক্লাস । পর্যন্ত পড়েছে, তারপর পড়া ছেড়ে দিতে হয়েছে, কারণ বড়ো ইস্কুল অনেকটা দূরে, হেঁটে যাওয়া যায় না। বাসে কিংবা ভ্যান গাড়িতে চেপে ইস্কুলে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। সে এখন বাড়িতে বসেই বড়ি দেয়, ঘুটে দেয়, তার উপার্জন যৎসামান্য।
জীবনদা মাঝে-মাঝে আসেন এ-বাড়িতে। একটা সাইকেল নিয়ে তিনি গ্রামে-গ্রামে ঘুরে বেড়ান, ভয় ওর কিছু নেই। আশ্চর্য ব্যাপার, আজ পর্যন্ত কেউ তাঁর গায়ে হাত তুলতে সাহস পায়নি। রাজনীতির ছেলেরাও তাঁকে সমীহ করে। কারণ, তিনি কোনও দলেই নেই। মিলন সমিতি তাঁর ধ্যানজ্ঞান, এই সমিতির এমনই সুনাম হয়েছে যে খবরের কাগজের লোকেরা প্রায়ই সেই সমিতির কাজকর্ম দেখতে আসে।
জীবনদার ইচ্ছে, সতীকে তিনি তাঁদের সমিতির কাজে লাগিয়ে দেবেন। সে-ও সেখানে নানারকম হাতের কাজ শিখে স্বাধীনভাবে উপার্জন করতে পারবে। শেখার সময়ও সে পাবে হাত খরচ।
সতীর বাবা তাতে কিছুতেই রাজি নয়। আবার এই বিপদের ঝুঁকি নেওয়া যায়? ময়নাকে যারা মেরেছে, তাদের কোনও শাস্তিই হল না। এরপর তারা যদি সতীকেও মারে?
জীবনদা বললেন, ওইসব গুন্ডা-বদমাশদের কাছে হার স্বীকার করতে নেই। তাতে ওরা আরও বেড়ে যায়। আমাদের সমিতির লোক সতীকে নিয়ে যাবে আবার বাড়ি পৌঁছে দেবে। ভয়ের কিছু নেই।
ময়নার বাবার নাম ফটিক। তার চেহারাটা বড়, কিন্তু বুকে হাঁপানির রোগ আছে। শীতকালেও সে গায়ে কোনও জামা রাখতে পারে না। মেজাজটা সবসময় খিটখিটে হয়ে থাকে।
সে বলল, আমারে মাপ করেন দাদা। আপনি ভালো কাজ করতেছেন তা জানি। কিন্তু ওসব আমাদের সহ্য হবে না। যেমন করে পারি, এ-মেয়েরে আমি বিয়ে দিয়ে পার করে দেব!
জীবনদা ধমক দিয়ে বললেন, মেয়ে কি কুকুর-বেড়াল নাকি যে পার করে দেবে? সতীকে বরং ডাকো, জিগ্যেস করে দেখি, ও কী চায়। ও যদি রাজি থাকে—
সতী মেয়েটি আরও অল্প বয়েস থেকেই চুপচাপ স্বভাবের। তার কোনও চাহিদা নেই, দাবি নেই। এতদিন ভেঁড়াখোঁড়া ফ্রক পরে থাকত, এখন শরীর বাড়ন্ত হয়েছে, শাড়ি না পরলে চলে না। মিলন সমিতি থেকে টাকা পেয়ে ময়না শখ করে নিজের জন্যেও একটা শাড়ি কিনেছিল, খুন। হওয়ার রাতে ভাগ্যিস সে শাড়িটা তার পরনে ছিল না। এখন সতী সেই শাড়ি পরে বাইরের লোকের সামনে বেরোয়।
পাঁচ ক্লাস পর্যন্ত পড়ার ফলে এখন সে যে-কোনও ছাপা অক্ষর দেখলেই পড়তে চায়। ঠোঙার কাগজ পর্যন্ত। বাড়িতে কোনও বই নেই, পঞ্চাননতলায় সপ্তাহে দু-দিন হাট বসে, সেই হাট ভেঙে গেলে অনেক ছেড়া খবরের কাগজ পড়ে থাকে, সতী সেগুলো কুড়িয়ে আনে।
জীবনদার প্রশ্ন শুনে সে উত্তর দিতে চায় না। অনেকবার পীড়াপীড়ির পর বলে, জানি না!
জীবনদা বিরক্ত হয়ে ওঠেন। এই ন্যাকামির জন্যই মেয়েরা কিছু করতে পারে না। একটা। সতেরো বছরের মেয়ে নিজের ভালো মন্দ বুঝবে না? পয়সা কড়ির এত টানাটানি, বিক্রি করার মতন জমিও নেই, তা হলে এ-মেয়ের বিয়ে হবে কী করে?
সেদিনের মতন জীবনদা চলে গেলেন। তার পরের দিনই, বৃষ্টি পড়ছে টিপটিপ করে, পিছল হয়ে গেছে উঠোন, মাটি খুঁড়ে উঠে আসছে কেঁচো, তারই মধ্যে ভিজতে ভিজতে হাজির হল এক আগন্তুক।
লোকটির পরনে পাজামা আর ছাই রঙা শার্ট। তার গলায় একটা রুমাল বাঁধা। গলায় কেন রুমাল বাঁধে কেউ-কেউ? রুমাল তো পোশাক নয়, এখন শীতকালও নয় যে মাফলারের মতন কাজ করবে। তবু কিছু লোক গলায় রুমাল বাঁধে বোধহয় শুধু এটুকুই বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য যে সে বিশেষ কিছু শক্তির অধিকারী।
দাওয়ায় বসে বিড়ি টানছিল ফটিক, সে জিগ্যেস করল, কে?
লোকটি নিজের পরিচয় না দিয়ে বলল, আমায় দুলালদা পাঠিয়েছে।
বৃষ্টির দিনে ফটিকের হাঁপানি বাড়ে, তাতে আরও মেজাজ খারাপ হয়। বৃষ্টির জন্য মাঠের কাজও বন্ধ।
সে বলল, কোথাকার দুলাল?
লোকটি সেই দুলালেরও পরিচয় না দিয়ে বলল, আমি কালকেপুর থেকে আসছি। আপনার মেয়ে হঠাৎ মারা গেছে শুনেছি? সে কিছুদিন দুলালদার বিজনেসে কাজ করেছে। তা দরুণ কিছু টাকা পাওনা আছে। সামনের হপ্তায় পেয়ে যাবেন। আর আপনার আর একখানা মেয়ে আছে, তাকে। দুলালদা কাজ দেবে বলেছে। আমার সঙ্গে যদি যায়—
টাকা পাওয়ার কথা শুনে প্রথমে একটু উৎসাহিত হলেও পরের কথাটায় চমকে উঠল।
—আমার মেয়ে তোমার সঙ্গে যাবে? কোথায় যাবে?
—ওই যে বললুম, দুলালদা তাকে কাজ দেবে বলেছে। শুধু-শুধু বাড়িতে বসে থাকবে কেন?
–কাজ দেবে? চুন্নুর ঠেকে বসবে? রাত বিরেতে বাইরে থাকবে? না যাবে না। যাবে না, যাবে না, যাবে না! আমার টাকার দরকার নেই। আমার মেয়ে বাড়িতে বসে থাকবে, তাতে তার কী?
ফটিক নিজে খুব চুল্লুর নেশা করত একসময়। রোজগারের বেশিরভাগ অংশই বাড়িতে আনতে পারত না।
ময়নার মৃত্যুর পর সে আর চুলু ছোঁয়নি। তার মনে হয়, ওই চুলুর মধ্যে মিশে আছে তার মেয়ের রক্ত।
লোকটি বলল, ওখানে না। দুলালদা নিজের বাড়িতে কাজ দেবে।
কোথা থেকে দারুণ সাহস পেয়ে গেল ফটিক তা কে জানে। সে হঠাৎ চেঁচিয়ে বলল, নিকাল। আমার বাড়ি সে নিকাল। আমার মেয়ে কারুর বাড়িতে কাজ করতে যাবে না। ওকে আমি মিলন সমিতিতে পাঠাব। হ্যাঁ, পাঠাবোই তো!
গলায় রুমাল-বাঁধা লোকটি একটুও উত্তেজিত না হয়ে, আরও কাছে এগিয়ে এসে বলল, শুধুমুধু চ্যাঁচাচ্ছেন কেন? দুলালদা আপনাদের ভালোর জন্যই বলেছে। আপনার মেয়ে কাজ করলে টাকা পাবে। আপনি পাঠাতে না চান, পাঠাবেন না! তবে আর একটা কথা জেনে রাখুন, ওই
মিলন সমিতি-ফমিতি টিকবে না। উঠে যাবে! একটা কথা শুনুন, মেয়েটা আমার সঙ্গে চলুক, ওখানে গিয়ে দেখুক, কাজটা তার পছন্দ কি না। পছন্দ না হলে ফিরে আসবে! দুলালদা ওকে নিয়ে যেতে বলেছে।
ফটিক কিছুতেই পাঠাতে রাজি নয়। সে আরও চ্যাঁচামেচি শুরু করল।
এর মধ্যে বেরিয়ে এল সতী। আর হাতে একটা পুঁটুলি। পরনে ময়নার সেই শাড়ি।
সে মৃদু গলায় বলল, বাবা, আমি যাব। আমি কাজ করব।
স্তম্ভিত ফটিক প্রথমে কোনও কথা বলতে পারল না। তারপর সে মেয়ের হাত ধরে আটকাবার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না ধরে রাখতে।
সতী চলে গেল।
৩
দুলালের বাড়ি একটা নয়। সে তিন জায়গায় থাকে। সে যখন যেখানে যায়, সতীকেও সঙ্গে যেতে হয়। প্রত্যেকটা বাড়িতেই বেশ কিছু নারী-পুরুষ থাকে, সকলেই কী সব কাজে ব্যস্ত, তা সতী ঠিক বোঝে না।
তবে, একটা ব্যাপার সে বোঝে, এই সব নারী-পুরুষরা তার গ্রামের চেনাশুনো মানুষদের মতন নয়। এদের খাওয়া দাওয়ার সময়ের ঠিক নেই, ঘুমোবার সময়ের ঠিক নেই। কখনও খাওয়া হয়। রাত দুপুরে, সারারাতে কেউ বিছানায় যায় না। আবার দিনের বেলা ঘুমোয়। এরা কেউ কারুর স্বামী বা স্ত্রী নয়, অথচ সেরকমই ব্যবহার করে মাঝে-মাঝে।
দুলাল প্রথম থেকেই পছন্দ করেছে সতীকে। সে বলে দিয়েছে, তুই সব সময় আমার সঙ্গে থাকবি। অন্য কেউ গায়ে হাত দিতে এলে আমাকে বলে দিবি, তার হাত ভেঙে দেব!
দুলালের কাছে সতী তার কুমারীত্ব বিসর্জন দিল বিনা আপত্তিতে। সে যেন বুঝে গেছে, এটাই তাঁর বেচে থাকার একমাত্র উপায়। মিলন সমিতিতে যোগ দিলে এরা তাকে ছাড়ত না। তারও অবস্থা হত দিদির মতন।
চুন্নুর ঠেকে অবশ্য তাকে বসতে হয়নি এখনও।
মাসের পর মাস কেটে গেল, সতী আর নিজের বাড়িতেও যায়নি একবারও। একজনের হাত দিয়ে মাঝে-মাঝে কিছু টাকা পাঠায়। তার বাবাও এখন সব বুঝেছে, টাকা নিতে আপত্তি করে না।
এর মধ্যে একদিন একটা ঘটনা ঘটল।
দুলালের প্রধান জুড়ি কার্তিককে দেখা যায় মাঝে-মাঝে। দু-জনে অনেক রাত জেগে নানারকম শলাপরামর্শ করে। সেইসঙ্গে মদ্যপানও চলে। এরা নিজেরা অবশ্য চুল্লু খায় না।
দুলাল অনেক মদ খেয়েও তেমন বেচাল হয় না। কিন্তু কার্তিক যেন মাতাল হতেই ভালোবাসে। মাতাল হয়ে সে হল্লা করে, নাচে, মেয়েদের ধরে টানাটানি করে।
ওদের মদ্যপানের সময় সতীকে পাশে বসতে হয়। সে টুকটাক খাবার এনে দেয়। গেলাসে মদ ঢেলে কতখানি জল মেশাতে হয়, তাও সে শিখে গেছে।
সে রাতে প্রচুর মদ খাওয়ার পর, কার্তিককে থেকে যেতে বলা হলেও সে শুনল না, জরুরি কাজের নাম করে চলে গেল। তার জিপ গাড়ি আছে, নিজেই চালায়। কোনওদিন অ্যাকসিডেন্ট করেনি। সে রাতেও কার্তিকের জিপ ঠিকই চলছিল, হঠাৎ তার বমি পেয়ে গেল। একটা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে রাস্তা। বমি পাচ্ছে কিন্তু বমি বেরুচ্ছে না, প্রবলভাবে ওয়াক-ওয়াক শব্দ করতে-করতে সে গাড়ি থামাতে বাধ্য হল। নীচে নামতে গিয়ে সে পড়ে গেল ধপাস করে। দু-এক মিনিট ছটফটিয়েই একেবারে স্থির।
পরদিন কী করে যেন রটে গেল, কার্তিককে মাঝ রাত্তিরে জঙ্গলের মধ্যে ভূতে মেরে ফেলেছে। এর আগে কত বেশি মদ খেয়েছে সে। এমনভাবে কেন মরতে যাবে?
পূর্ণিমা নামের একটি মেয়ে চুপিচুপি সতীকে বলল, বেশ হয়েছে, ঠিক হয়েছে। ওই কার্তিক হারামজাদাটাকে মেরেছে ময়না আর বুধনির ভূত। ওদের তো কার্তিকটাই গলা টিপেছিল।
পূর্ণিমা তিনটে চুল্লুর ঠেক চালায়। নিজেও খুব নেশা করে, সে নাকি দুলালের ডানহাত। কিন্তু সে মনে-মনে এদের এত ঘেন্না করে তা সতী কল্পনাও করেনি।
কার্তিকের মৃত্যুসংবাদ শুনে খুব ভয় পেয়ে গেল দুলাল। তিনদিন সে বেরুলোই না ঘর থেকে। সত্যি কার্তিককে ভূতে মেরেছে? ময়না-বুধনির ভূত এসে প্রতিহিংসা নিচ্ছে? কার্তিক ওদের গলা টিপে ধরেছিল আর দুলাল একটা বালিশ চাপা দিয়েছিল ওদের মুখে।
তিনদিন পর একটু ঠিক হলেও সন্ধের পর আর একা কোথাও যায় না দুলাল। বেরুলেও তাড়াতাড়ি ফিরে আসে। সতীকে নিয়ে ঘরে খিল দেয়। মনে-মনে তার ধারণা হয়েছে, সতী কাছে থাকলে ময়না এদিকে এগোবে না।
আরও কয়েক মাস পরে সতী একদিন বমি করল। সে মদ খায় না। এ অন্যরকম বমি।
পূর্ণিমা বলল, এই রে! পেট বাধিয়েছিস! খসাতে গিয়ে মরে না যাস দেখিস!
সতীর খুব মরার ভয়। সে বেঁচে থাকতে চায়, যে-কোনও উপায়ে।
পূর্ণিমার কাছ থেকেই সে জানল, এখানে বাচ্চাকাচ্চা কেউ পছন্দ করে না, তাতে অনেক ঝামেলা। এক ডাক্তারবাবুর সঙ্গে পেট খসাবার ব্যবস্থা করা আছে, তবে পান্তু নামে একটি মেয়ে এই করতে গিয়ে মারা গিয়েছিল।
আর যদি সতী তার সন্তানকে নষ্ট করতে না চায়? সে বাপের বাড়ি ফিরে যাবে।
পূর্ণিমা বলল, পাগল নাকি? এখানে একবার ঢুকলে আর বেরুনো যায় না, জানিস না? দ্যাখ না, দুলাল তোকে বড়জোর আর বছরখানেক পেয়ার করবে, তারপর তোকে পাঠিয়ে দেবে অন্য একটা ডেরায়।
সতী তার পায়ে ধরে অনুরোধ করল, এখুনি যেন পূর্ণিমা তার গর্ভের অবস্থা অন্য কারুকে না বলে।
এক রাত্তিরে সতী খুব নরমভাবে দুলালকে জিগ্যেস করল, তোমার বাবা হতে ইচ্ছে করে না? নিজের ছেলে কিংবা মেয়েকে কোলে বসিয়ে আদর করতে ইচ্ছে করে না?
সতীর থুতনি ধরে দুলাল বলল, তোর বুঝি বউ হওয়ার খুব শখ হয়েছে? ল্যাংড়াকে বিয়ে করবি তো বল, ব্যবস্থা করি। আমি ওসব ঝুট ঝামেলার মধ্যে নেই।
দুলালের মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল সতী।
তার কয়েকদিন পরেই সে চুপিচুপি পালাল দুলালের ডেরা থেকে। কোথায় যাবে সে? বাড়িতে ফিরলে দুলালের লোকজন ঠিক আবার ধরে আনবে?
মাঝ রাত্তিরে জানলায় টকটক শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল জীবনদার। জানলা খুলে দেখলেন, ছায়ার মতন দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। সঙ্গে আর কোনও লোক নেই।
সতীকে তিনি একবার মাত্র দেখেছেন, তাই চিনতে পারলেন না।
সতী বলল, আমি ময়নার বোন।
জীবনদার খুব রাগ এসে গেলেও অনেকটা সামলে নিয়ে বললেন, সেই এলি এখানে। এত দেরি করে? আমি যখন আনতে গিয়েছিলাম, তখন মুখ দিয়ে একটা কথা বেরোয়নি।
সতী বলল, আমি এখানে বেশিদিনের জন্য থাকতে আসিনি। আজকের রাতটা। তারপর আপনি আমায় থানায় পৌঁছে দেবেন?
জীবনটা বললেন, থানায়? থানায় গিয়ে কী হবে?
যে-সতী এমনিতে কথাই বলতে চায় না, সে এখন স্পষ্ট করে বলল, থানায় দুলালের নামে নালিশ করব। আমার পেটে দুলালের সন্তান। আমার দিদিকে ওরা খুন করেছে, তা প্রমাণ করা যায়নি, কিন্তু আমার এ-অবস্থার জন্য ও শাস্তি পাবে না? আইন আছে তো!
জীবনদা বললেন, ভেতরে এসে এখন শুয়ে থাক। পরে ওসব কথা হবে, তোর পেটে যে দুলালের সন্তান তার প্রমাণ হবে কী করে?
সতী বলল, রক্ত পরীক্ষাতেই বোঝা যাবে। আর একটা কী আছে না, ডি এন এ।
জীবনদা বললেন, কী বললি? কী বললি? তুই এসব জানলি কী করে?
সতী বলল, আমি তো খবরের কাগজ পড়ি। মুখস্ত করে রেখেছি। এখন তো সহজেই জানা যায়।
পরের দিন সতীকে রেখে দেওয়া হল পাহারা দিয়ে।
এর মধ্যে জীবনদা যোগাযোগ করলেন তাঁর এক সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে। প্রতুল দাস নামে এক উকিলকেও ডাকা হল। তারপর সদলবলে গেলেন থানায়।
দারোগাবাবু এ বার আর কথার মারপ্যাঁচে জিততে পারলেন না।
কোনও মেয়েকে গর্ভবতী করে তাকে স্ত্রীর স্বীকৃতি না দেওয়াটা দণ্ডনীয় অপরাধ। আদালত থেকে একরকম নির্দেশ দেওয়া আছে কঠোরভাবে। সমস্ত ঘটনাটা ফলাও করে ছাপা হবে কলকাতার একটা বড় কাগজে। পরের দিনই উকিলবাবুটি আবেদন করবেন আদালতে।
দারোগাবাবু একটু সময়ের জন্য উঠে গেলেন। তাঁর অফিসের ওপরওয়ালা আর অফিসের বাইরের ওপরওয়ালাদের সঙ্গে কী কথা হল কে জানে। ফিরে এসে অন্য মূর্তি ধরলেন।
জীবনদাকে বললেন, আপনি তো ঠিক কথাই বলেছেন। ডি এন এ টেস্টে যদি প্রমাণ হয়, তা । হলে ওই শুয়োরের বাচ্চা দুলালকে দশ বছর জেল খাটাব। আপনারা এফ আই আর দিন। আমি ওকে পিছ মোড়া করে বেঁধে আনব। বেগড়বাই করলে মেরে হাড় গোড় ভেঙে দেব!
দুলাল নিজেই এসে ধরা দিল। সে দেখল এই সময়ে তার পাশে কেউ নেই। যাদের নামে সে ত্রাসের রাজত্ব চালায়, তারাও তাকে ত্যাগ করেছে।
শেষপর্যন্ত আর আদালতে যেতে হল না। তাকে প্রস্তাব দেওয়া হল, সে জেল খাটতে চায় না, সতীকে বিয়ে করতে রাজি আছে। জেলের গরাদের বদলে বিয়ের ফাঁসটাই বেছে নিল সে। থানার কম্পাউন্ডেই রীতিমতন মন্ত্র পড়ে বিয়ে হয়ে গেল দুজনের। নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সমিতির দুজন সদস্যাও সেখানে উপস্থিত।
দুলালকে বলে দেওয়া হল, তার ওপর সবসময় নজর রাখা হবে। এরপর যদি সে তার স্ত্রীকে অবহেলা বা অত্যাচার করে, তাহলে আবার টেনে আনা হবে থানায়।
নববধূর সাজে সতী চলে গেলে দুলালের জিপ গাড়িতে।
ডেরায় এসে নিজের ঘরে বসে বোতলে দু-চুমুক দিয়ে খানিকটা ধাতস্থ হল সে। তারপর সতীকে বলল, তোর পেটে-পেটে এত ছিল?
সতী বলল, আমার পেটে তোমার বাচ্চা, সে-ই আমাকে এই বুদ্ধি দিয়েছে।
একটু থেমে সে শান্ত গলায় বলল, কার্তিককে আমি খুন করেছি। তার মদে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিলাম। তোমাকেও আমি একদিন ওইভাবে মারতাম, কিন্তু এর মধ্যে আমার পেটে সন্তান। এসে গেল যে! আমার সন্তানের বাবাকে আমি মারব কী করে?
দুলাল চেঁচিয়ে হঠাৎ কান্না মেশানো গলায় চেঁচিয়ে বলে উঠল, তোর দিদিকে আমি মারতে চাইনি, বিশ্বাস কর, একটা ওয়ার্নিং দিয়ে ছেড়ে দিতাম, কিন্তু ওই হারামজাদা কেতোটাই…তুই বিশ্বাস কর!
সতী বলল, বিশ্বাস করলাম। এই দ্যাখো, আমার পেটে তোমার সন্তান সব শুনছে। ও নড়ছে, হাত দিয়ে দ্যাখো–
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে অনেকে। তাদের মধ্যে থেকে পূর্ণিমা জোরে বলে উঠল, কি গো, বিয়ে হল, ফুলশয্যা হবে না? এই যে ফুল এনেছি, বিছানায় ছড়িয়ে দে সতী!
জানলা দিয়ে কেউ এক গুচ্ছ ফুল ছুড়ে দিল খাটের ওপর।