2 of 2

ম্যাকবেথ – শেখর সেনগুপ্ত

ম্যাকবেথ – শেখর সেনগুপ্ত

কাঠমান্ডু হয়েছে সরস,
নিয়ে প্রচুর গাঁজা চরস।

না, নেপালের রাজধানীকে নিয়ে এটা কোনও ছড়াকারের ছড়া নয়। অনুত্তমের তুড়ি বাজানো নিরেট ভণিতা। আবেগটা বুকের কোণে লালিত হচ্ছিল অনেকক্ষণ, হঠাৎ ছড়াকারে বেরিয়ে এসেছিল। আঁখি ঠোঁট উলটে বলেছিল, ‘বাহ! তুমি কি প্রেমেন মিত্তিরের কবি-গোয়েন্দা পরাশর বর্মা হয়ে গেলে নাকি?’

অনুত্তম জিভ বের করে বলে, ‘না, না, কদাচ নয়। কার সঙ্গে কার তুলনা! ব্যোমকেশ—পরাশর—ফেলু মিত্তিরের পাশে অনুত্তম চৌধুরী! হিমালয়ের মুখোমুখি অযোধ্যা পাহাড়! তবে কী জানো—।’

কথা শেষ না করে অনুত্তম সিগারেটে লম্বা টান দেয়। আঁখি, যার টানা-টানা চোখ তার মুখের ওপর, ফ্রেমে আটকানো বিলকুল রমণীয় ছবি, অনুত্তম ওর ঠোঁটের গড়ন দেখে তৃপ্ত হয়।

আঁখিসম প্রিয়াপ্রসঙ্গ নিয়ে সে মশগুল থাকতে পারে চিরাচরিত আচরিত জীবনের শর্তগুলি ভাঙতে-ভাঙতে। পরিচিত ও পরিজনরা প্রায়শই উসখুস করে, তোদের বিয়েটা কবে হচ্ছে? এমন মাখামাখি করছিস, চোখে দেখা যায় না মাইরি! …বিয়ে? দরকার আছে? আঁখি যদি কখনও জননী হতে চায়, তখন বংশধরের পরিচয়ের সুরাহায় ব্যাপারটা চুকিয়ে নেওয়া যাবে। আপাতত সেই অনুষ্ঠানের মূল্য আমাদের কাছে কানাকড়ি। মনের মিল যতদিন আছে, দেহমিলনেও যুক্তিগ্রাহ্য কোনও বাধা নেই। বদনাম বাতাসে উড়ছে, উড়ুক, আঁখি-অনুত্তম তো জোড় বেঁধে বেড়িয়ে এল কাঠমান্ডু।

নাকে-মুখে ধোঁয়া ছেড়ে অনুত্তম বলেছিল, ‘তবে কী জানো, কাঠমান্ডুতে পা দিয়েই আমার কেমন যেন মনে হয়েছিল, এখানকার মাটি কুয়াশা-কুয়াশা অস্পষ্ট হংকং-এর মতন। অর্থাৎ, বহুত ধান্দাবাজের দল ঘুরঘুর করছে এবং হিপি-হিপিনিদের আখড়াগুলিকে ধর্তব্যের মধ্যে না এনেও বলা যায়, এখানকার বাতাস কেবলই চরস-গাঁজা-চন্ডুতে ম-ম।’

আঁখি কৃত্রিম ক্ষোভের সঙ্গে বলেছিল, ‘সি আই ডি ইন্সপেক্টর তো, তাই সব জায়গাতেই কেবল ধান্দাবাজ আর চরস-চন্ডুর গন্ধ খুঁজে পাও।’

অনুত্তম নিজের কপাল চাপড়ে আবেগে বলেছিল, ‘সত্যি, কী দুর্ভাগ্য! গোয়েন্দাজীবন কেবল যে কুসুমাস্তীর্ণ হল না তা নয়, হরেক রকম বুদ্ধির মারপ্যাঁচ, সন্দেহ এবং তাড়াহুড়ো হিংস্রতায় আমার কবি-মনটাও খতম হয়ে যাচ্ছে। না হলে, আঁখি, তুমি আমার পাশে, আর সামনে এমন অবারিত সৌন্দর্য! আহ—আহ…!’

অনুত্তমের ভরাট গলায় কিন্তু জাদু আছে। আঁখির মনে দোলা লাগে। সে তখন সত্যি হিমালয় ও তার সন্তানদের রূপমহিমা নিয়ে মনে-মনে বেশ উত্তেজিত। কপালের ওপর চূর্ণকুন্তল সরাল, মুক্তো-সেটিং আংটিসমেত পাতলা অনামিকা কিছুক্ষণ ঈষৎ কেঁপেছিল। কাঠমান্ডু তো আধা-আধুনিক—সেই হেতু যেমন-তেমন। কিন্তু পারিপার্শ্বিক পার্বত্য অধিত্যকায় হাঁটতে-হাঁটতে প্রাণ-স্পন্দনের নতুনতর হিল্লোল আঁখি অনুভব করেছে। পাহাড়ের ওপর দিয়ে, ঝরনার ধারে-ধারে রকমারি পাখির মেলা বসেছে—লালমুনিয়া, ভৃগুরাজ, তিতিরবট, মায় সারস অবধি সব বর্ণ-বিচিত্র পাখি। কোথাও-কোথাও ধস নামার চিহ্ন, পাহাড়িরা সেখানে গাছে-গাছে বেঁধে রেখেছে মোটা-মোটা লতা, ওই লতা কোমরে জড়িয়ে পেন্ডুলামের মতন দুলতে পারে মানুষ, আচমকা পাতালে তলিয়ে যাওয়ার হাত থেকে আত্মরক্ষার ওই একটিমাত্র উপায়।

এইসব বলগাহীন নিসর্গ বৈচিত্র্য যার মনে নাড়া দেয়, ঝড়ও তোলে, তার নাম আঁখি। যদিও অনুত্তমকে অনেক রহস্যভেদে সে বেসরকারিভাবে নিশ্চিত সহায়তা করেছে, মনের দিক থেকে তাকে ঠিক নিরেট সন্দেহপরায়ণা বলা চলে না। মানুষের মনের জটিলতা এবং পারিপার্শ্বিক ধোঁয়াশা নিয়ে সে অন্তত এখানে ভাবতে রাজি ছিল না। কিন্তু রেহাই দিল না দোসর অনুত্তম। গম্ভীর পর্বতমালা বা সমুন্নত বৃক্ষরাজি দেখে-দেখে শিথিল হওয়ার পরিবর্তে কাঠমান্ডুর অপরাধ জগতের সন্ধানে সে বিলকুল টান-টান, একেবারে বেমানান।

 সেই বেমানান কাণ্ডকারখানার সূত্র ধরেই দুজনে এখন এয়ারপোর্টে। দিল্লিগামী ফ্লাইটে উঠব-উঠব।

অনুত্তমের পরনে সাদা পলিয়েস্টারের বেলবটস, গায়ে টাওয়েলের টকটকে লাল রং গেঞ্জি, —পোশাকের চাকচিক্যে বয়সটাকে পাঁচবছর পিছনে ঠেলে দেওয়া হয়েছে যেন। পোশাকে আঁখি সম্পূর্ণ বাঙালি। কটকি তাঁতের শাড়ি, মাঝামাঝি সিঁথি এবং চুল ফুলে-ফেঁপে নাগফণার মতো এক মস্ত খোঁপা, ঠোঁটে হালকা রং, বাঁ-হাতে সরু রিস্টওয়াচ, চুড়ি-টুড়ির বালাই নেই।

আপাতভাবে তারা একজোড়া নিরীহ ভ্রমণলিপ্সু, যারা দিন-তিনেক কাঠমান্ডু এবং এর চারপাশ চষে বেড়িয়ে এখন ফিরে যাচ্ছে।

কিন্তু আঁখি অন্তত হাড়ে-হাড়ে টের পেয়েছে, অনুত্তমের কঠিন থাবা থেকে এখানেও ধারালো নখ বেরিয়েছিল, এখনও বেরিয়ে আছে। যেমন হোটেল থেকে এই এয়ারপোর্টে আসাটাও কোনও ইচ্ছাসুখের প্রতিচ্ছবি নয়, স্রেফ একজনকে অনুসরণ করে আসা।

কাকে?

একজন মহিলাকে।

হুঁ, মহিলাই। তবে ভারতীয় বলে বিশ্বাস হয় না। মুখে-চোখে ও রঙে মঙ্গোলিয়ান টাইপ হলেও মাথায় যথেষ্ট লম্বা—আন্দাজ পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি।

আঁখিকে নিয়ে ইতি-উতি চক্কর কাটতে-কাটতে হঠাৎ অনুত্তমের নজর আটকে গিয়েছিল ওই হলুদ সুন্দরীর প্রতি। তখন রাত আটটার কম নয়। ‘হোটেল আইস কিউ’তে ঢুকেছে অনুত্তম ও আঁখি। বিশাল চারতলা কাষ্ঠনির্মিত পাঁচতারা হোটেল, যেখানে পা রাখা মানেই অথই সমুদ্রে ঝুপ করে ডুব মারা। নরম রক্তবর্ণ কার্পেটে শরীরের সিকিভাগ মিলিয়ে গেল বুঝি। আলোগুলি রঙিন, কিন্তু এত কমজোরি যে, মনে হয় যেন ওদেরকে অহরহ পোকায় কাটছে।

অনুত্তম ঈষৎ ইতস্তত করছিল—ঠিক কোন তলায় গিয়ে বসা উচিত, তাই নিয়েই বুঝি ওর মস্তক ঘর্মাক্ত। একতলায় খানা পিনার গুরুভার, যার যেমন চাহিদা। চাইনিজ—স্প্যানিশ-পর্তুগিজ…কোল্ড অ্যান্ড হট; কোকাকোলা থেকে শুরু করে রাশিয়ান ভদকা অবধি। রহস্যময় আলোর তলায়-তলায় একটা করে টেবিলকে ঘিরে চারটে করে চেয়ার। ইচ্ছে হলে টেনে নাও পরদা, সঙ্গিনীর সঙ্গে গভীর নিভৃতে আলপচারী হওয়ার মহৎ সুযোগ, যে-সুযোগ তখন আঁখির অভিপ্রেত হলেও অবস্থাটা যে তার ‘ধরো ভাই লক্ষ্মণ’-এর মতন, অর্থাৎ অনুত্তম যেদিকে চালাবে, সে সেইদিকেই চলবে।

অনুত্তমের নজর ড্রাগন-আঁকা সিঁড়ির ওপর—সিঁড়ি ঘুরে-ঘুরে দোতলায়। সেখানে মজা আছে, এইসব নেপালি বনেদি হোটেলের যা-কিছু ম্যাজিক ওখানেই। ক্যাসিনোর রমরমা।

অনুত্তম কিছুটা অলস মন্থরতায় সিঁড়ির হাতলে আঙুল রাখে, ধাপে-ধাপে পা রেখে ওপরের দিকে উঠতে থাকে। তদনুযায়ী আঁখিও। আঁখি একবার বলেছিল, ‘তুমি খেলবে নাকি?’

অনুত্তম দেয়ালের কারুকার্য দেখতে-দেখতে উত্তর দিয়েছিল, ‘খেলতে পারি অথবা খেলাতেও পারি।’

চারদিকে দারুণ হইহই-রইরই।

ক্যাসিনোর বর্ণময় চাকা ঘুরছে, ‘হনুমানের লাঠি’ মাঝে-মধ্যে ঝিলিক মেরে ওঠে, মুদ্রাক্ষেপণ চলেছে, পয়সা যাচ্ছে, পয়সা কিছু আসছেও।

সকলেরই পকেট-ঠাসা হরেক দেশের কাগুজে নোট। প্রত্যেকে জীবনের এই সময়টাকে উদ্দাম ও স্মরণীয় করে রাখতে চাইছে। দেশে যে বড়সড় রাজনৈতিক ওলট-পালট হতে চলেছে—প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত থাপা মন্ত্রীসভা যে দুর্নীতির দায়ে টলমল, তার কোনও প্রতিচ্ছবি বা প্রতিক্রিয়া এখানে নেই।

আঁখি দেখছে, পুরুষ ও মেয়ে—প্রায় সকলেই ফোঁস-ফোঁস করে ধোঁয়া ছাড়ছে। পোড়া তামাকের কটু গন্ধ। মিশ্র অনুভূতি।

অনুত্তম আঁখির কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে বলল, ‘গন্ধটা কেমন?’

আঁখি : ‘কীসের গন্ধ?’

অনুত্তম : ‘এই এত তামাকের।’

আঁখি : ‘যেমন হয়।’

অনুত্তম : ‘উঁহু, যেমন হয়, তেমন নয়। একটু যেন অন্যরকম, অন্যরকম।’

আঁখি : ‘মানে?’

তখন অনুত্তম সারণির কুলকুল ধ্বনির মতন আবার ছড়া কেটে উঠেছিল

কাঠমান্ডু হয়েছে সরস,

নিয়ে প্রচুর গাঁজা চরস।

আঁখি একবার অনুত্তমের মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ পাকাল। তারপরই কিন্তু হেসে উঠল এবং চকিতে এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করল, যেন ওই পরিবেশে সে তার শৈশবাবস্থায় ফিরে গেছে। সেই অসরল পথে লাফিয়ে-লাফিয়ে চলা, যখন কিনা সে স্বয়ং অপরাধ জগতের পাখি ছিল। সর্বজনস্বীকৃত সোসাইটি গার্লের মতন অনুত্তমের বুকপকেট হাতিয়ে একটা সিগারেট ধরাল এবং তারপর কোমর দুলিয়ে-দুলিয়ে এগিয়ে চলল ছায়াচ্ছন্ন জগতটার দিকে।

‘ব্রেভো, ডার্লিং! ব্রেভো!’ প্রায় নিঃশব্দে হাততালি দিল অনুত্তম।

কিন্তু এই আবিল পরিবেশে বিস্ময়ের ওখানেই শেষ নয়।

আঁখি ঘূর্ণায়মান বোর্ডে বাজি ধরবে বলে ব্যাঙ্কারের কাছে গুটিগুটি এগিয়ে যাওয়ার সময়ই লক্ষ করা গেল আর একটি নারীমূর্তিকে।

অনুত্তমের শরীরে একটা ঝাঁকি লাগে, তার দুই চোখে চাকচিক্য বৃদ্ধি পায়। নারীমূর্তি তো অনেকগুলিই, কিন্তু ওই সুন্দরী দর্শনে বুঝি এমন কোনও স্পর্শকাতরতা আছে, যার প্রভাবকে অনুত্তম অস্বীকার করতে পারে না। অথবা, অনুত্তম যেহেতু বহুলাংশে স্মৃতিজীবী, স্বমহিমাতেই সে চিনবার চেষ্টা করে ওকে। সে শিস দিয়ে ওঠে।

নারী ভারতীয় নয়, নেপালিও নয়, কিন্তু শরীরে যে মঙ্গোলিয়ান রক্ত বইছে, সেটা মালুম হয় ওর চেরা-চেরা চোখ, চাপা নাক এবং হলুদ রং দেখলে। অসচরাচর হল ওর দৈর্ঘ্য, প্রায় বুঝি ছয় ফুট ছুঁই-ছুঁই। স্কার্টের লাল ফিতে সরু কটির ওপর এবং মানানসই স্তনবতী।

আঁখি এবং সেই দীর্ঘাঙ্গিনী বোর্ডের দু-পাশে গিয়ে দাঁড়াল। প্রত্যাশা, এখনই হয়তো দুজনে চাল দেবে এবং শ্রীমতীদের হাতের গুণে রাতের ক্যাসিনো আরও জমে উঠবে।

আঁখি চাল দিল ঠিকই।

কিন্তু অন্যজন তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে একবার ওইদিকে চেয়ে পরক্ষণে মুখ ফিরিয়ে নেয়, হাতির দাঁতের হোল্ডারে সিগারেট বসিয়ে মেজাজে অগ্নিসংযোগ করে।

অনুত্তম তীব্র দৃষ্টিতে চেয়ে আছে বিদেশিনীর দিকে। কিন্তু সে ওর দেহটাকে জরিপ করছে না, চোখ নিবদ্ধ হয়ে আছে ওর ডানহাতে, যেখানে রয়েছে একখানা অসাধারণ গ্রন্থ—’ম্যাকবেথ’।

অনুত্তমের রক্তে চঞ্চলতা বাড়ে। তার সমগ্র একাগ্রতা দ্রুত আত্মমুখী হয় ওই এক লক্ষ্যে—ম্যাকবেথ। ভিড় যত বাড়ছে, জুয়ার আবেষ্টনী থেকে ততই দূরে সরে যেতে থাকে হলুদ রূপসী। সরতে-সরতে সিঁড়ির কাছাকাছি। আঁখির কাঁধে মৃদু চাপড় দিয়ে অনুত্তম তার পিছু নেয়। আঁখি হকচকিয়ে যায়। প্রথম দানে মার খাওয়ার পর দ্বিতীয় দফায় সে মাত্র চাকতি ছুড়েছে, অনুত্তম তার চোখের সামনে দিয়ে হাওয়া হয়ে গেল।

আঁখি নড়ে না, পাথরের মতন দাঁড়িয়ে থাকে।

সেই অনুত্তম যখন ফিরে এসেছিল, তখন প্রায় মধ্যযাম। বাইরে হু-হু ঠান্ডা বাতাস। আঁখি বিছানায় টান-টান, সিলিং-এর কারুকর্ম দেখছিল। অনুত্তম ফিরে এলেও সে তার দিকে ফিরেও তাকায় না। অনুত্তম মুচকি হেসে কোটটা খুলে রেখে আঁখির পাশে হাঁটু মুড়ে বসে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘রাগে যে একেবারে বাক্যহীনা।’

‘মূল্যহীন রাগ করি না।’

‘না, না, তোমার অভিমানের অসীম মূল্য গো আমার কাছে।’

অনুত্তমের ঠোঁট নেমে আসবার আগেই আঁখি উঠে বসে, তীক্ষ্নস্বরে জিগ্যেস করে, ‘কোথায় গিয়েছিলে মেয়েটার পিছু-পিছু?’

অনুত্তম দু-হাত দু-ধারে ডানার মতন বিস্তারিত করে বলে, ‘হেথায়, হোথায়, তারপর একেবারে এই হোটেলে, যেথায় স্বয়ং সুন্দরী একটি ঘর নিয়ে আছেন।’ অনুত্তম একটু থেমে অপেক্ষাকৃত গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলল, ‘একটা জিনিস সম্পর্কে কনফার্মড হয়ে এলাম। ইন্টারপোলের এক ঝানু গোয়েন্দা তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন, হংকং-এর বিখ্যাত স্মাগলার গারভিন চু-র ”আদান-প্রদান” কাজের মধ্যে অনেক অভিনব বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা গেছে। এদের মধ্যে একটি হল—তার লোকেরা তথাকথিত বুক-ওয়ার্ম এবং হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় পৃথিবী-বিখ্যাত সব সাহিত্য-গ্রন্থের মোড়ক। আদতে ওই মোড়কের অন্তরালে প্রতিটি পাতায় সূক্ষ্ম রাসায়নিক পদ্ধতিতে সাঁটা আছে মহামূল্যবান স্মাগলিং বস্তুসমূহ।’ একটানা বলে অনুত্তম থামল।

আঁখি ঠোঁট ওলটায় : ‘তার সঙ্গে ওই মেয়েটার কী সম্পর্ক?’

অনুত্তম ঈষৎ অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে : ‘তোমার কি ধার কমে যাচ্ছে নাকি, আঁখি? খেয়াল করোনি, মহিলার হাতে ছিল শেকসপিয়ারের ড্রামা ”ম্যাকবেথ”? নেপালের ওইরকম একটা মার-মার কাট-কাট হোটেলে কেউ সাহিত্যগ্রন্থ হাতে নিয়ে ঢুকছে, দৃশ্য হিসেবে এটা নিশ্চয় অস্বাভাবিক। বরং, যদি হাতে কোনও অশ্লীল ছবি বা পত্রিকা থাকত, ব্যাপারটা মেনে নেওয়া সহজ হত। চিন্তা করে দ্যাখো—।’

আঁখির এখন আগ্রহ বৃদ্ধি পায়, একটু নড়েচড়ে ওঠে সে : ‘তাহলে ফলো করে কী টের পেলে?’

অনুত্তম বলল, ‘টের পেলাম, শ্রীমতী আমাদের এই সাদামাটা হোটেলটারই সেকেন্ড ফ্লোরে আশ্রয় নিয়েছেন এবং ওঁর এক শাগরেদকে জানিয়ে দিলেন, কাল সকালের ফ্লাইটেই নাকি দিল্লি নামবেন।’

‘ইন্টারেস্টিং!’

‘রিয়েলি।’

‘তোমার কী করণীয়?’

‘আমার করণীয় হল, ওঁরই সঙ্গে একই ফ্লাইটে দিল্লি অবধি ধাওয়া করা। তারপর এরোড্রোমেই ম্যাকবেথের চরিত্র বিশ্লেষণ।’

অনুত্তমের কথার ভঙ্গিমায় আঁখি সশব্দে হেসে ওঠে।

আঁখির বিশ্বাস ছিল, অনুত্তমের অনুমান নির্ভুল। ঠিক এরোড্রোমে নামামাত্র ওর ”ম্যাকবেথ” বইখানায় টান মারবে। এবং সম্ভবত ‘ম্যাকবেথ’-এর পাতায়-পাতায় পাওয়া যাবে তীব্র মাদকদ্রব্যের সঞ্চিত ভাণ্ডার। অদ্ভুত!

তবু বিমান আরোহিণী ওই সুন্দরীর দিকে সে সরল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তাকিয়ে থাকে ওই চকচকে ”ম্যাকবেথ”-এর দিকে। শেকসপিয়রের দুই উজ্জ্বল চক্ষু যেন উচ্চারণ করছে ‘ফেয়ার ইজ ফাউল, ফাউল ইজ ফেয়ার…’

আঁখি মনে-মনে প্রার্থনা করে আহা, বইখানা যেন নির্দোষ হয়!

সেই প্রার্থনার জের টেনেই সামনের সিটের দিকে ঝুঁকে পড়ে আঁখি তাকে বলল, ”ম্যাকবেথ”, দ্য গ্রেট অ্যান্ড ফেবারিট শেকসপিয়ারিয়ান ট্র্যাজেডি। মে আই প্লিজ হ্যাভ ইট ফর আ ফিউ মিনিটস?’

সঙ্গে-সঙ্গে চাবুকের মতন জবাব, ‘এক্সকিউজ মি, ম্যাডাম। আই কান্ট নেভার পার্ট মাই বুক, ইভন ফর সেকেন্ডস। ইটস অলওয়েজ পার্ট অফ মাই বডি।’

গভীর হতাশায় আঁখি কাঁধ ঝাঁকায়। একটা কাঁচা খিস্তি ওর ঠোঁটের ডগায় এসে গিয়েছিল প্রায়, যদিও স্পষ্টত সে ফিসফিসিয়ে ওঠে : ‘তুমি মরবে!’

মাসিক ক্রিমিনাল

পুজো সংখ্যা, ১৯৮৩

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *