৫১
চাণক্য খুব উত্তেজিত। ভদ্রবাহুকে উদ্দেশ করে বললেন, আমি কল্পনাও করি নি আপনার দ্বারা এ রকম একটা ঘটনা ঘটতে পারে।
দেখুন আচার্য, আমি অনেক ভেবেচিন্তে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আপনি নিজেই ভাবুন, সম্রাজ্ঞীর এ অকালমৃত্যুর পর সম্রাট যদি জানতে পারতেন আপনি প্রিন্সেসকে আটকে রেখে সম্রাটের অগোচরে সন্ধির প্রস্তাব পাঠিয়েছেন, কী অবস্থা হতো। সম্রাজ্ঞীর মৃত্যুর পর আপনাকে দায়ী করতে কেউ কেউ সম্রাটের কান ভারী করছে।
তা আমি জানি। কিন্তু সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেল।
এই পরিকল্পনায় আমার সমর্থন ক্রমে ফিকে হয়ে আসছিল। সম্রাটকে বোঝানো বেশ কষ্টকর ছিল যে কাজটি আপনি ভালো করেছেন। প্রিন্সেস এলেন, আপনার জন্য তাঁর সঙ্গে সম্রাটের সাক্ষাৎ হলো না, সম্রাট তা কোনোভাবেই মেনে নেবেন না।
এখন যুদ্ধটা অনিবার্য, বলেই চাণক্য যেন কিসের সন্ধান পেয়ে গেছেন, তেমনি লাফিয়ে বলে উঠলেন, আচার্য, সব সমস্যার সমাধান এখন আপনার হাতে। সম্রাটের দৃষ্টি ফেরাতে হবে যুদ্ধের দিকে।
কীভাবে?
আমি যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্য সমাবেশ ঘটাচ্ছি।
এতে লাভ?
সম্রাজ্ঞীর শোক, আমার প্রতি প্রতিশোধ—সব ভুলে যাবেন। যুদ্ধে নামিয়ে আনতে হবে তাঁকে। যুদ্ধ ছাড়া উদ্ভূত সমস্যা মাটিচাপা দেওয়া যাবে না।
সম্রাট নিশ্চয়ই প্রিন্সেসের আগমনের সংবাদ একদিন পাবেন, তখন কী করবেন?
জবাবটা আমার তৈরি আছে।
কী বলবেন আপনি?
বলব, সম্রাটকে সংবাদ দেওয়ার জন্য প্রিন্সেসকে আটকে রেখে আমি গান্ধারা প্রাসাদে গিয়েছিলাম। সম্রাজ্ঞীর মৃত্যু সবকিছু ভন্ডুল করে দিয়েছে। ইত্যবসরে প্রিন্সেস পালিয়ে গেছেন। সময়-সুযোগমতো সম্রাটকেই আমি এ কথা বলব।
ভদ্রবাহু ভাবলেন, যাক, সমস্যা চুকে গেছে। চাণক্য আবার বললেন, তবে এ যুদ্ধে প্রচুর রক্ত ক্ষয় হবে।
ভদ্রবাহু ভাবছিলেন সেনাপতি সদাচারণ ভট্টের কথা। বললেন, আপনার সে সেনাপতিকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা কী?
তা বোধ হয় আর সম্ভব নয়।
বেচারা।
নিজে পালিয়ে আসতে পারলে রক্ষা পাবে।
.
সদাচার আবার ছদ্মবেশ নিয়ে ঠিকই পালালেন। রাতেও তাঁর ছাউনিতে মৌর্যপতাকাটা উড়ছিল। সদাচার পতাকার দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে মাথা নুইয়ে বললেন, আমরা আবার আসব বিজয়ীর বেশে। তখন তোমার হৃত গৌরব আবার প্রতিষ্ঠিত হবে।
ঘন অরণ্যে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল গোয়েন্দা নির্জলার সঙ্গে।
সবাই আসতে পেরেছে?
পেরেছে।
আপনাদের এখন তক্ষশীলা থেকে আসা উদ্বাস্তুদের সঙ্গে থাকতে হবে। এখানে এরা আমাদের হয়ে কাজ করছে।
বেশ, চলুন।
তক্ষশীলা থেকে যেসব উদ্বাস্তু এখানে
এসেছে, এরা দ্বিতীয়বার বাস্তুচ্যুত। প্রথমবার আলেকজান্ডারের আক্রমণে তক্ষশীলায় এসেছিল, দ্বিতীয়বার সেলুকাসের আক্রমণে ভিটেছাড়া। চাণক্য এদের কৌশলগত কারণে এখানে ঠাঁই করে দিয়েছেন। মূলত সেলুসিড সৈন্যদের অবস্থান ও গতিবিধি সম্পর্কে এরাই তাঁকে এবং তাঁর গোয়েন্দাদের খবরাখবর দেয় এবং গোয়েন্দাসহ মৌর্য লোকদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে থাকে।
.
সেলুকাস শত্রুর সৈন্যসমাবেশের চাপ সত্ত্বেও সকালে কর্নেলিয়াকে ডেকে পাঠালেন। সেলুকাস বলে দিলেন যেন এখানে জৈন সন্ন্যাসীকে না আনা হয়।
কর্নেলিয়া আসার পর বললেন, মৌর্যরা পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তে ব্লকেট তৈরি করেছে এবং থর মরুভূমিতে সৈন্যসমাবেশ ঘটাচ্ছে। যুদ্ধ অনিবার্য। আর তোমাকে আটকে রেখে মৌর্য মহামন্ত্রী যা করতে চেয়েছিল, এই পত্র পাঠ করলেই জানতে পারবে। বলে তিনি জরুরি সভায় চলে গেলেন।
কর্নেলিয়া দ্রুত পত্রটা পাঠ করলেন। পত্র পাঠ করে প্রথমেই তাঁর মনে পড়ে গেল ভদ্রবাহুর কথা। তিনি নিকোমেডেসের কাছে পত্রটা পাচার করে তার দিকে তাকালেন। নিকোমেডেল পত্রটা পাঠ করে মন্তব্য করল, চাণক্যকে আমার কখনো ভালো লাগে নি। দেখ, আমি ভদ্রবাহুকে আগেই শ্রদ্ধা করতাম। সে শ্রদ্ধাটা এখন আরও অনেক বেড়ে গেছে। তোকে বলেছিলাম মহামন্ত্রী লোকটি কোনো একটা ফন্দি করছে।
এখন আমি কী করব, বলে দে।
নিকোমেডেস বলল, যুদ্ধ, তোর যুদ্ধ করার সময় এসেছে। তার আগে, বলে থামল সে, আবার বলল, কথাটা অবশ্যই রাখবি, শর্মিলা যদি যেতে চায়, তাকে সীমান্ত পর্যন্ত পার করে দিয়ে আয়।
হঠাৎ এ কথা বলছিস কেন?
ভদ্রবাহু চিন্তা করবেন, এই মহৎ লোকটিকে আমরা কষ্ট দিতে পারি না।
এই মানুষটিকে আমিও পছন্দ করি। তোর কথা আমার বিবেচনায় সঠিক। কিন্তু পরের পদক্ষেপ কী?
রক্তপাতটা বন্ধ করার চেষ্টা করা উচিত। পত্র পাঠে মনে হয় এক ভয়াবহ যুদ্ধ অপেক্ষা করছে।
আমি থেকে যেতাম, সেই ভালো ছিল, রক্তপাত ছাড়াই যুদ্ধ শেষ হতো।
পরাজয় মেনে নিয়ে?
এত রক্তপাত আমি চাই না।
মর্যাদারও লড়াই এটা, কর্নি। গ্রিকরা এভাবে আত্মসমর্পণ করতে পারে না।
এরা জানে না কখন এসে শর্মিলা এদের পেছনে দাঁড়িয়েছেন। বললেন, আচার্যও সে কথাই চিন্তা করছেন। মর্যাদাবোধ ও প্রতিহিংসার মাঝখানে পড়ে যাতে রাজকুমারীর জীবন বিপন্ন না হয়, সেদিকে তিনি মনোযোগী ছিলেন।
কারণ কী, শর্মিলা?
দিদি, আচার্য তাঁর শিষ্য চন্দ্রগুপ্তকে অনেক ভালোবাসেন। তিনি চান না চন্দ্রগুপ্তের কষ্টের কারণ হয়, এমন কোনো ঘটনা ঘটুক। এ ছাড়া তিনি আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন। গ্রিকদেরও মর্যাদাহানি ঘটে, এমন কিছু তিনি চান না। যুদ্ধ করে পরাজয়ের মধ্যেও গৌরব আছে।
যুদ্ধ আর ঠেকানো গেল না, শর্মিলা। তোমার এখানে অবস্থান করাটা ঠিক নয়। তুমি কী বলো?
শর্মিলা হেসে দিয়ে বললেন, দিদি, আমরা সন্ন্যাসী মানুষ। যুদ্ধের নীতিতে আছে, যোদ্ধা নয় এমন কাউকে শত্রুসৈন্যরা হত্যা করে না, সন্ন্যাসীদের তো নয়ই। তবু আপনি যখন চাইছেন, ফিরে যাব।
আমি চাইছিলাম তুমি আমাদের সঙ্গে থাকবে। কেন বলেছিলাম, তা তুমি বুঝবে না। আর যদি সম্ভব হতো এই নিকোর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে তোমাকে রেখে দিতাম।
এ কথা শুনে শর্মিলা হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ার অবস্থা। নিকোমেডেসকে উদ্দেশ করে বললেন, দাদা, সত্যিই তুমি আমাকে বিয়ে করতে?
নিকোমেডেস লজ্জা পেয়েছে। এ লজ্জা কাটানোর জন্য কর্নেলিয়া বললেন, শোনো কথা, ওর মাথায় ফাওলিন ভনভন করছে।
তিনি কি এখানে আছেন? আমার তাকে দেখতে খুব ইচ্ছা হচ্ছে।
এখানে নেই। অনেক দূরে থাকে, পশ্চিম ইজিপ্ট জায়গাটার নাম।
দাদা, বিয়েতে আমাকে নিমন্ত্রণ না করলে খুব রাগ করব কিন্তু। যেতে খুব কষ্ট হচ্ছে, শর্মি?
কষ্ট কী, দিদি? খুব বেশি দেরি নেই, তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে। সম্রাজ্ঞী হলে কিন্তু তাড়িয়ে দেবে না।
নিকোমেডেস নিজেই শর্মিলাকে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিল। হাঁটতে হাঁটতে শর্মিলা বললেন, দাদা, তুমি এটুকু কষ্ট না করলেও পারতে। দিদির খুব মন খারাপ হয়েছে, না? আড়ালে চোখের জল মুছতে দেখেছি। আমাদের এ রকম মায়াময়ী এক সম্রাজ্ঞী দরকার।
তুমি এত আশাবাদী যে আমার অবাক লাগছে। কিন্তু সামনে যে যুদ্ধ, তা কাকে কোথায় নেয় কে জানে?
আমাদের আচার্যের কথা ভুল হয় না, দাদা। তুমি তোমার পরিচয় না দিলেও আমি জানি।
কী জানো?
তুমিও একজন সৈনিক!
কীভাবে? অবাক হয় নিকোমেডেস।
আচার্য বলেছেন, তুমি যখন হাঁটো, তোমার বাঁ পা আগে যায়। এটা শুধু সৈনিকদের বেলায় সম্ভব। চাণক্য বুঝতে পারলে খবর ছিল।
আমি সচেতন ছিলাম।
তাই বুঝতে পারে নি।
কিন্তু আচার্য ভদ্ৰবাহু?
অনেক প্রজ্ঞার অধিকারী তিনি।
আমারও তা-ই মনে হয়। শর্মি, তুমি এত কম বয়সে কেন সন্ন্যাসী হয়েছ?
শর্মিলা হেসে দিয়ে বললেন, বয়স কি দাদা, সূর্যের আলো সব বয়সী জীবের ওপর প্রভাব ফেলে। তুমি আচার্যের সঙ্গে কিছুদিন থাকো, এই পোশাক-আশাক তোমাকেও ছেড়ে দিতে হবে। এবারে ফাওলিন দিদির কথা বলো। খুব কি সুন্দরী?
তোমার মতো নয়।
ভারতীয়রা তো সুন্দরী হয় না।
সৌন্দর্য বাইরের বিষয় নয়, ভেতরের। তোমার সঙ্গে যদি ফাওলিনের পরিচয় হতো। কিছুটা আলো হয়তো সে-ও পেত।
তুমি বেশি বলছ।
ভারতবর্ষকে জানার জন্য তুমিই যথেষ্ট, শর্মি। আচার্যকে বোঝার বয়স আমাদের হয় নি তোমাকে দিয়ে তাঁর বিশালত্বও অনুভব করার সুযোগ পাচ্ছি। দূর থেকেই আমি তাঁকে নমস্কার জানাচ্ছি, বলে হাত জোড় করল এই যৌবনদীপ্ত গ্রিক সৈনিক।
তুমি কিন্তু ফাওলিন দিদির কথা বলো নি।
নিকোমেডেস হেসে দিয়ে বলল, ও খুব সাধারণ মেয়ে।
খুউব ভালোবাসো, না?
খুব।
আমি আচার্যকে বলব তিনি যেন তোমাদের মঙ্গল কামনা করেন। তিনি আশীর্বাদ করলে অবশ্যই তোমাদের মিলন হবে। তোমরা সুখী হবে।
আমার মনে হয় তুমি আশীর্বাদ করলেও হবে।
কেন?
ভারতে ভক্তিবাদ বলে একটা কথা আছে না?
এ সম্পর্কে তুমি জানো?
ভক্তিতে মুক্তি, ভক্তিতেই সব প্রাপ্তি।
দাদা, তুমি এসব জানলে কী করে?
আমাদের সৈনিকদের ভারতীয় দর্শনও পড়তে হয়। আমি অনেক সৌভাগ্যবান, দর্শনে যা পড়েছি, বাস্তবে তা দেখার সুযোগ হলো।
তুমি অনেক উদার, দাদা, ফাওলিন দিদি বড় ভাগ্যবতী। ভারতবর্ষে ভাগ্যও একটা বড় ব্যাপার।
গ্রিকরাও ভাগ্যকে স্বীকার করে, শর্মি।
ভাগ্য আমাদের কোথায় নেয় কে জানে?
আমার বিশ্বাস, তোমরা ঠিক পথেই আছ। গন্তব্যে একসময় পৌঁছে যাবে, বলে হাসলেন শর্মিলা।
আমার মনে হয় এসে গেছি। সামনেই গ্রিক চৌকি দেখা যাচ্ছে। বাকি পথ একা একা যেতে পারবে?
খুব পারব।
চৌকির সেলুসিড সৈন্যরা এগিয়ে এল। নিকোমেডেস নিজের পরিচয় দিতেই এরা তাকে স্যালুট করে দাঁড়াল। মনে হয় আদেশের জন্য অপেক্ষা করছিল। সে বলল, চলো আমরা তাকে সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দিই।
সৈন্যরা বুঝতে পারল না এই গ্রিক রমণীকে কেন সীমান্ত পার করে দিতে হবে। কারণ, সে তখন গ্রিক পোশাক পরিহিত ছিল এবং অনর্গল গ্রিক ভাষায় কথা বলে যাচ্ছিল। তবু এরা ওদের অনুসরণ করল।
সীমান্তের এপারে পৌঁছেই শর্মিলা তার গ্রিক পোশাক একে একে খুলে ফেলল। নিকোমেডেসের দিকে ফিরে ভেনাসের মতো মাথার লম্বা চুল দিয়ে লজ্জার স্থান বাঁ হাতে ঢেকে স্মিত হাসি হেসে বলল, বিদায় দাদা, সম্ভব হলে এ পোশাকগুলো রাজকুমারী দিদির কাছে পৌঁছে দিয়ো। জানো, আমাদের সর্বশেষ তীর্থঙ্কর মহাবীর এভাবে চুল, নখ, অস্থি এবং পোশাক পরিত্যাগ করে মহানির্বাণে গিয়েছিলেন। এটা অবশ্য আমাদের বিশ্বাস, বলে শর্মিলা চলে যাচ্ছিলেন, নিকোমেডেস বলল, দেবী, তোমাকে একটা প্রণাম করি। মহাবীরের অস্থি-মজ্জার মতোই পবিত্র জ্ঞান করে আমরা তোমার পোশাকগুলো সংরক্ষণ করব।
শেষে নিকোমেডেস দুহাত জোড় করে শর্মিলাকে প্রণাম করল। শর্মিলা শুধু দেবীর মতোই স্মিত হাসলেন।