৫০
সম্রাজ্ঞী দুরধরার মতা হয়েছে। অসময়ে খালাস হওয়া সন্তানকে নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত সবাই। বিষাদে ছেয়ে গেছে গান্ধারা রাজ্যের প্রতিটি ধূলিকণা। সম্রাট বাকশূন্য। অতিবুদ্ধিমান মহামন্ত্রীও ঘটনার আকস্মিকতায় ভরকে গেছেন। একটি অনভিপ্রেত ঘটনা সমস্ত মৌর্য সাম্রাজ্যকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। ঘটনাটা এ রকম : মহামন্ত্রী চাণক্য সম্রাটকে তাঁর অগোচরে খাদ্যের সঙ্গে স্বল্প মাত্রায় বিষ খাওয়াতে শুরু করেন এবং ক্রমান্বয়ে এই মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে। উদ্দেশ্য খারাপ নয়, খুবই মহৎ। সম্রাটকে কেউ যাতে বিষ খাইয়ে না মারতে পারে, তাই এ ব্যবস্থা। চাণক্য জানেন, বিষ খাইয়ে খাইয়ে সম্রাটের বিষক্রিয়া প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব।
গান্ধারা প্রাসাদে আসার পর একদিন সম্রাটের ইচ্ছা হলো সম্রাজ্ঞীকে সঙ্গে নিয়ে দুপুরের খাবার খাবেন। দুপুরে এভাবে সম্রাজ্ঞীকে সঙ্গে নিয়ে খাবার খাবেন সম্রাট, তা কাউকে জানানো হয় নি। সন্তানসম্ভবা সম্রাজ্ঞী সাধারণ খাবার খান না, তাঁর জন্য রাজবৈদ্যের তালিকা করে দেওয়া খাবার খান।
হঠাৎ করে সম্রাটের সঙ্গে খাবারের আমন্ত্রণ পেয়ে অনেক দিন পর তৃপ্তিসহকারে প্রচুর খাবার খেলেন। খাবারের পর বিষক্রিয়া শুরু হলো।
এদিকে সম্রাট সেলুকাসের শিবিরে যাওয়ার আগে মহামন্ত্রী চাণক্য স্বচক্ষে সম্রাটের অবস্থা ও মনোভাব দেখার জন্য একদিন আগে গান্ধারা প্রাসাদে এসেছেন। সম্রাজ্ঞীর বিষক্রিয়ার কথা শুনতে পেয়েই ছুটে এলেন। সম্রাজ্ঞীর মরমর অবস্থা। সম্রাট কিছুই বুঝতে পারছেন না এ অবস্থা কেন হলো। একই খাবার তিনিও গ্রহণ করেছেন।
চাণক্য বললেন, সম্রাট, আর দেরি নয়, সম্রাজ্ঞীর পেটের সন্তানকে বাঁচাতে হবে।
কী করতে চান আপনি? রাজবৈদ্যকে ডাকা হয়েছে।
রাজবৈদ্য কিছুই করতে পারবে না। সম্রাজ্ঞীর মৃত্যুর আগে অনাগত সন্তানকে বের করে আনতে হবে।
রাজবৈদ্য একবার চেষ্টা করে দেখুন।
কোনো ফল হবে না। দেখছেন না মুখে ফেনা, আর সম্রাজ্ঞী নিথর হয়ে যাচ্ছেন।
চাণক্যের কাছে সব সময়ই একটি ধারালো ছুরি থাকে। কোমর থেকে সে ছুরি বের করে সম্রাজ্ঞীর পেট কেটে সম্রাটের সন্তানকে বের করে আনলেন এবং যেন একটি সফল অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করেছেন, সে রকম সুখানুভূতি প্রকাশ করলেন।
সম্রাট ঘটনার আকস্মিকতায় বিস্ময়ে বিমূঢ়। তাঁর কী করা উচিত, বুঝতে পারছেন না। তবে চাণক্যের ওপর ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছেন। কথার মধ্যে ক্রুদ্ধভাব প্রকাশ করে বললেন, একি করলেন, আচার্য?
স্বাভাবিক কণ্ঠে চাণক্য বললেন, অন্তত সন্তানকে তো বাঁচাই, সম্রাট।
একজনকে মেরে ফেলে আরেকজনকে বাঁচাবেন?
দুজনকে বাঁচানো সম্ভব নয়।
এ সময়ই রাজবৈদ্য উপস্থিত হলেন। তাঁকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চাণক্য বললেন, শিশুটি অপরিণত। তাকে বাঁচানোর ব্যবস্থা করো।
কীভাবে বাঁচাব। অসময়ে তার প্রসব ঘটানো হয়েছে।
চাণক্য চটে গিয়ে বললেন, মূর্খ কোথাকার! স্বাভাবিক অবস্থার চিকিৎসা সবাই জানে। জটিল আর কঠিন অবস্থায় চিকিৎসার জন্যই রাজবৈদ্য।
সদ্য প্রসব করানো শিশুটি মৃদুভাবে হাত-পা নাড়ছে। সে এখনো মায়ের জঠরের জলবৃত্তের আবরণে আবদ্ধ। রাজবৈদ্য শিশুটিকে আবরণমুক্ত করতে চাইলে চাণক্য বাধা দিয়ে বললেন, থামো মূর্খ। এ জলবৃত্তেই শিশুটি ঠিক থাকবে। মাতৃজঠরের পরিবেশ পাবে।
তারপর তিনি ভাবতে লাগলেন কী করা যায়। এভাবে কতক্ষণ রাখা যাবে। বিকল্প উপায় কী হতে পারে। হঠাৎই বললেন, সম্রাট, রাজ্যের যত সন্তানসম্ভবা ছাগল আছে, এখনই আনিয়ে নিতে হবে।
এসব দেখে সম্রাটের ক্ষোভে ফেটে পড়ার অবস্থা। প্রায় চিৎকার করে বললেন, কী হবে এসব দিয়ে? আপনি এমন স্বাভাবিক থেকে কী সব করে যাচ্ছেন? আমি আপনাকে শূলে চড়াব।
আপনি যা চাইবেন, তা-ই হবে সম্রাট। এখন আপনার সন্তানকে বাঁচাতে সন্তানসম্ভবা ছাগল আনার আদেশ দিন।
সম্রাটের কিছু বলার আগেই চাণক্য তাঁর অনুচরদের ধমক দিয়ে বললেন, তাকিয়ে দেখছটা কী? ছাগল জোগাড় করো।
একটি-দুটি করে ছাগল এসে গেল। একের পর এক এদের পেট কেটে সম্রাটতনয়কে এই প্রাকৃতিক ইনকিউবেটরে রাখা হলো। সে এখানেই ক্রমে বড় ও শক্ত হয়ে উঠতে লাগল। মাঝেমধ্যে বাইরে রাখারও ব্যবস্থা হলো। রাজবৈদ্য এসব কাজ করতে করতে বিস্ময়াভিভূত। চাণক্য লোকটির প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা হতে লাগল।
সম্রাট সম্রাজ্ঞীর বিয়োগব্যথায় বিমর্ষ। সন্তানের লালন হচ্ছে কীভাবে, তার খোঁজও নিচ্ছেন না। এদিকে সংবাদ পেয়ে ভদ্রবাহু এসে উপস্থিত হয়েছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতি ধীরস্থির এই মানুষটিকেও স্তব্ধ করে দিয়েছে। তিনি সম্রাটকে শোক জানানোর ভাষা ভুলে গেছেন।
খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন চাণক্য। বললেন, আপনি আসাতে ভালোই হলো। পরিস্থিতি আমার একার পক্ষে সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। সম্রাটকে বোঝা যাচ্ছে না, অবস্থা এমন যে তিনি আমার শিরশ্ছেদ করলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
আপনি শিরশ্ছেদের পর অবাক হতে চাচ্ছেন, আচার্য?
আপনি কঠিন সময়কে নিয়েও কৌতুক করতে পারেন, মাননীয় শ্রুতকেবলী। শ্রুতকেবলী?
আপনি তো সবই জানেন!
এ ব্যাপারে কিছুই জানি না।
চাণক্য সম্রাটের খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দেওয়া থেকে সবই খুলে বললেন।
ভদ্রবাহু শুনে বললেন, আপনার অবস্থা তো তাহলে ভয়াবহ। তবে ভয় নেই। পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে।
কীভাবে?
আপনাকে সঙ্গে নিয়েই। সম্রাজ্ঞীর শেষকৃত্যটা ভালোভাবে শেষ করুন।
সম্রাট পাথর হয়ে গেছেন।
বুঝতে পারছি না তাহলে গ্রিক রাজকুমারীর প্রতি আসক্তির কারণটা কী? মানবচরিত্র বড় বিচিত্ৰ।
চাণক্য সুবন্ধুকে এই রাজকীয় শেষকৃত্যের দায়িত্ব দিয়ে বললেন, কোনো ত্রুটি করা চলবে না। সবকিছু রাজকীয় রীতি ও অনুশাসন মেনে সম্পন্ন করতে হবে। আচার্য ভদ্রবাহু শেষকৃত্যের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পরিচালনা করবেন।
আচার্য ভদ্ৰবাহু বললেন, নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখবেন না, আচার্য, সব কর্মে সম্পৃক্ত হোন।
একটু চিন্তা করে চাণক্য বললেন, ঠিক বলেছেন, আচার্য, আমি ভুল করতে যাচ্ছিলাম।
.
জৈন সন্ন্যাসিনীকে ভালো লাগল কর্নেলিয়ার। তাকে প্রথমে অপছন্দ ছিল। বস্ত্রবিহীন নারী পছন্দ না হওয়ারই কথা। নিকোমেডেস তার সঙ্গে কথা শুরু করেছিল। জানতে চেয়েছিল, তুমি গ্রিক শিখলে কোথা থেকে?
শর্মিলা চটপট জবাব দিয়ে বলেছিল, গ্রিকদের থেকেই।
কীভাবে ওদের সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ হলো?
আচার্য পুণ্ড্রবর্ধন হয়ে তক্ষশীলায় গেলেন। আলেকজান্ডার তখন ওসব জায়গাও দখল করে নিয়েছেন। সঙ্গে আমাকেও নিলেন। আমরা সন্ন্যাসী মানুষ, কেউ বাধা দেয় নি। আচার্য সেখানে অবস্থানকালে অনুভব করলেন, গ্রিক ভাষাটা আমাদের জানা দরকার। তিনি শিখলেন এবং মজা করে আমাকেও শেখালেন। যত দ্রুত তিনি শিখেছিলেন, তত তাড়াতাড়ি আমি পারি নি। এখনো ভুল হয়। হয় না?
নিকোমেডেস বলল, উচ্চারণটা এদিক-সেদিক হয়, ভাষাজ্ঞান ঠিক আছে। আচ্ছা শর্মিলা, আপনাদের এভাবে থাকতে খারাপ লাগে না?
খারাপ লাগবে কেন? মানুষ ছাড়া আর সবাই তো এভাবেই থাকে। অভ্যস্ত হয়ে গেলে আর খারাপ লাগে না। প্রথমে খারাপ লাগত না, তা কিন্তু নয়। আপনি যখন অন্তরের দিকে তাকাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়বেন, বাইরেটা তখন গৌণ হয়ে যাবে।
আপনি আধ্যাত্মিকতার কথা বলছেন?
ঠিক তাই।
চারদিকে জীবনকে ভোগ-উপভোগের এত কিছু আছে, তারপরও এত ত্যাগ?
শর্মিলা হেসে দিয়ে বললেন, সেটা মনমানসিকতার ওপর নির্ভর করে। আপনাদের গ্রিসে সংসারত্যাগী মানুষ নেই?
আছে, তবে এ রকম নয়। পাগল ছাড়া এভাবে কেউ থাকে না।
শর্মিলা এবার উচ্চ হাসি হেসে বললেন, আমরা তো পাগলই। তবে ভাবের পাগল। কর্নেলিয়াকে লক্ষ্য করে বললেন, দিদি তো কথাই বলছেন না। দিদির কি মন খুব খারাপ?
কর্নেলিয়া বললেন, মন খারাপ ছিল, তোমার কথা শুনে ভালো হয়ে গেছে। এত সহজ অথচ দৃঢ়ভাবে কথা বলো তুমি। তোমাকে তুমি বললাম, কিছু মনে করো নি তো?
না দিদি, মনে করি নি। কদিন পর তো তুমি আমাদেরই হয়ে যাবে।
এ কথা কে বলল তোমাকে?
আচার্য বলেছেন। তিনি সব জানেন। সম্রাট এ বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ করেছেন।
সম্রাট কী বলেছেন?
আচার্যের পরামর্শ চেয়েছেন। আচার্য শুধু পরামর্শ নয়, সম্মতিও দিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, এ সম্পর্কটা নির্ধারিত হয়েই আছে।
এ কথা শুনে নিকোমেডেস কর্নেলিয়ার দিকে ফিরে তাকাল। পরে শর্মিলার দিকে তাকিয়ে বলল, তিনি কীভাবে জানলেন?
আধ্যাত্মিক শক্তিতে। আচার্য শ্রুতকেবলী, অর্থাৎ সব জানেন।
ভূত-ভবিষ্যৎ সব বলে দিতে পারেন? তিনি কি হাত দেখে বলেন, প্রশ্নটা কর্নেলিয়ার।
হাত দেখে নয়, চোখ বুজে বলে দেন।
আমার সম্পর্কে বলতে পারবেন?
পারবেন না কেন?
তুমি আমাকে একদিন নিয়ে যাবে?
এভাবে তো আর তোমার আসা হবে না।
কীভাবে আসা হবে?
সম্রাজ্ঞী হয়ে।
কথা শুনে দুজনই প্রাণ খুলে হাসল।
তোমরা হাসছ কেন? আমি হাসির কথা বলি নি।
কর্নেলিয়া বললেন, তুমি খুব সরল আর ভালো মেয়ে, শর্মিলা। ভারতীয় সব মেয়েই কি তোমার মতো?
সবাই কি এক রকম হয়, হয় না।
এবার তুমি একটি সত্যি কথা বলো।
আমরা জৈন সন্ন্যাসীরা মিথ্যে বলি না।
বেশ। তাহলে বলো আচার্য কেন আমাদের এভাবে চলে আসতে বললেন?
কারণ ঠিক আমি জানি না। তবে তিনি কখনো এমন কাজ করেন না, যা ক্ষতির কারণ হতে পারে। কারও বরং অমঙ্গল দেখলেই তার সাহায্যে এসে দাঁড়ান। তোমাদের নিশ্চয়ই অমঙ্গল দেখেছেন তিনি।
চাণক্য মানুষটা কেমন?
পণ্ডিত ব্যক্তি, তক্ষশীলায় আচার্য ছিলেন। তবে খুবই বুদ্ধিমান এবং…
বুঝতে পেরেছি। তাঁর সঙ্গে আচার্যের সম্পর্ক কেমন?
খুবই ভালো।
এখন বুঝতে পারছি না। যা-ই হোক, তোমার সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লাগছে। তুমি আমাদের সঙ্গে থেকেই যাও, শর্মিলা।
এভাবে? আমাদের একটা সমাজ আছে। সবাই এক রকম। তোমাদের ওখানে আমাকে বেখাপ্পা লাগবে। তা তোমাদের অস্বস্তির কারণও হবে।
কর্নেলিয়া হেসে দিয়ে বললেন, তুমি এভাবে থাকবে কেন? আমাদের মতোই থাকবে। রাজকীয় পোশাক পরবে।
ধর্ম বিসর্জন দিয়ে? তা হয় না, দিদি। দিদি, তোমাদের একটা দেবী আছে, নাম আফ্রোদিতে। তার বিবস্ত্র মূর্তি কিন্তু আমি দেখেছি।
ওরা তো ঈশ্বর-ভগবান, যেভাবে খুশি থাকতে পারেন।
শর্মিলা একবার ভাবল বলবে, তোমরা আমাকে সে রকম দেবীই ভাবো। পরে আর বললেন না। কর্নেলিয়া অনুনয় করে বললেন, একবার পরো না, শর্মিলা। তোমার যে আমার অনেক প্রয়োজন।
এতে তো ক্ষতি নেই, বলল নিকোমেডেস।
সব ত্যাগ করব?
অনুনয় করছি, বললেন কর্নেলিয়া।
আচার্য রেগে যাবেন না তো?
তিনি রাগ করতে পারেন?
বেশ, তা-ই হবে।
কর্নেলিয়া তাকে বস্ত্র বের করে দিলেন।
গ্রিক পোশাক পরব?
পরেই দেখো না।
শর্মিলা গ্রিক পোশাক ও জুতো পরিধান করল। স্বর্ণের একটি চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ে দিলেন কর্নেলিয়া। এক সেট গয়নাও পরিয়ে দিলেন। নিজের অজান্তেই বলে উঠলেন, বাহ্, কী সুন্দর! নিকো, ঠিক বলেছি?
অপূর্ব! বলে নিকোমেডেস হাততালি দিল।
.
শেষকৃত্যের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার আগে আচার্য ভদ্ৰবাহু শোকে মুহ্যমান সম্রাট, রাজপারিষদসহ সমবেত সবার উদ্দেশে বললেন, প্রাত্যহিক জীবনে মৃত্যু কষ্টের। কিন্তু মৃত্যু হচ্ছে নির্বাণলাভ। আত্মার মুক্তি। আজ দেওয়ালির রাত। মহাবীর আধ্যাত্মিক আলো জ্বালিয়ে এ রাতে বিদায় নিয়েছিলেন। সম্রাজ্ঞী পুণ্যবতী। এ রাতে তাঁরও তিরোধান ঘটেছে। তার এ পুণ্য আত্মা তাঁর দেহ থেকে বিদায় নিয়েছে বটে, কিন্তু তা অন্য কোনো দেহে নবজন্ম লাভ করবে। আত্মার মৃত্যু নেই। অনাত্মা বা অজীব বস্তুর সঙ্গে এখানেই তার পার্থক্য। মহাবীরের নির্বাণরাতে আমরা আলোক উৎসব করি। এ রাতে সে উৎসব হবে পুণ্য আত্মাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে। জীনসেনের মহাপুরাণে আছে, মহাবীরের শেষকৃত্যে স্বর্গীয় জীবেরা নেমে এসেছিলেন। তিনি স্বর্গীয় আত্মাদের কথা বলেছেন। স্বর্গীয়, অর্থাৎ নির্বাণপ্রাপ্ত আত্মা। প্রতীকী কথা। আমরা যেমন ঈশ্বরে বিশ্বাসী নই, তার সৃষ্টিতেও বিশ্বাসী নই। বিশ্বের সৃষ্টি কেউ করে নি। স্বর্গ-নরকও কেউ সৃষ্টি করে নি। মানবাত্মার চেয়ে বড় কিছু নেই। তাই আত্মারই আরাধনা করি। পুণ্যাত্মাকে অনুসরণ করি।
আমরা যৌক্তিক ধর্মে বিশ্বাস করি। সম্রাজ্ঞীর মৃত্যুর নিশ্চয়ই যৌক্তিক ব্যাখ্যা আছে। তাঁর মোক্ষলাভের সময় এসে গেলে তাঁকে আমাদের সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাতে হবে। মোক্ষলাভের চাইতে ভালো কিছু নেই। এই মোক্ষলাভকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাতে আসুন আমরা মশাল প্রজ্বলিত করি।
আচার্যের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সম্রাট ও ভদ্রবাহু প্রথম মশাল প্রজ্বলিত করলেন। ভদ্রবাহু চাণক্যকেও এ উৎসবে যুক্ত করলেন। ক্রমে ক্রমে মশাল প্রজ্বালন সারা গান্ধারা নগরীতে ছড়িয়ে পড়ল। নগরীর অন্ধকার তিরোহিত হয়ে গেল। কেউ একজন এ মশাল বয়ে নিয়ে গেল সিন্ধু অববাহিকার যুদ্ধক্ষেত্রে। যুদ্ধক্ষেত্রেই এক-দুহাত করে সর্বত্র আলো ঝলমল করে উঠল।
সেলুসিড আর্মিরা কৌতূহল নিয়ে তাকাল তাদের শত্রুশিবিরের দিকে। তাদের মনে প্রশ্ন, এ আলোকের উৎস কিসে? এরা অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে দিল। সর্বত্র সাজ সাজ রব। সম্রাট সেলুকাস ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তিনি কি আত্মরক্ষা করবেন প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মজবুত রেখে, নাকি আক্রমণ করে বসবেন, স্থির করতে পারছেন না! তাঁর মধ্যে আশঙ্কা ও সংশয়। রাতে যুদ্ধ বন্ধ থাকার কথা। তাহলে?
এ সময় উপস্থিত হলেন কর্নেলিয়া। সম্রাট বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলেন। তিনি যেন কথা হারিয়ে ফেলেছেন। সংবিৎ ফিরে পেয়ে জেনারেলদের ডাকলেন। জেনারেলরা প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। আদেশ পাওয়ামাত্র ছুটে এলেন। এঁরা ভেবেছেন, রাতে আত্মরক্ষার জন্য প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা কেমন হবে, সম্রাট সে নির্দেশই দেবেন। রাতে আক্রমণের আদেশ নিশ্চয়ই দেবেন না।
জেনারেলরা উপস্থিত হয়ে অবাক হয়ে গেলেন। সম্রাট এরই মধ্যে সব বৃত্তান্ত জেনে নেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। জেনারেল কিউকেকাস খেপে যাচ্ছিলেন। সম্রাট তাঁকে থামালেন। বললেন, এ বিষয় নিয়ে বিস্তারিত কথা হবে কাল। এখন এ মশাল প্রজ্বালন-রহস্য জানতে হবে। গুপ্তচরদের পাঠাও আর যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে রাখো। এই রাতে এরা আক্রমণ করবে বলে কি মনে হয়?
জেনারেল ফিলেকাস বললেন, মশাল বহনকারীদের গতিবিধি লক্ষ করেছি, মহামান্য সম্রাট। এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে মশাল ছড়াচ্ছে বটে, আক্রমণের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
তাহলে এ রকম আলো প্রজ্বালন কেন?
ক্ষমা করবেন সম্রাট, অনুমতি দিলে আমি কিছু বলতে পারি। সম্রাট শর্মিলার দিকে তাকালেন। কর্নেলিয়া তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, বলো, কী বলতে চাও।
তিনি বললেন, আজ দেওয়ালি উৎসব। তাই এত আলো। মহাবীর এ রাতে নির্বাণ লাভ করেছিলেন।
সেলুকাস ভাবলেন, এই উৎসবের সময় আক্রমণ করে শত্রুদের পরাজিত করতে হবে। কর্নেলিয়া বললেন, এটি অন্যায়। যারা ধর্ম পালন করে, তাদের সম্মান ও সুযোগ দেওয়া উচিত।
জেনারেলরা সম্রাটকেই সমর্থন করলেন। ফিলেকাস বললেন, উৎসব অনুষ্ঠান চলাকালে শত্রুদের আক্রমণ করে বিজয়ের সম্ভাবনা বেশি। এ সুযোগ আমাদের নেওয়া উচিত।
পবিত্র উৎসবে মেতেছে এরা। আমাদেরও উচিত ওই উৎসবে যোগ দেওয়া। তাহলে শত্রুরা রাতের বেলায় আমাদের অবস্থান চিহ্নিত করতে পারবে না। এ ছাড়া ওরা অবাক হয়ে নিজেদের কৌশল পরিবর্তন করবে। এ পরিবর্তনটা আমাদের পক্ষে আসতে পারে। কর্নেলিয়া শেষে বললেন, আমাদেরও উচিত মশাল প্রজ্বলিত করা।
নিকোমেডেস তাঁর কথা সমর্থন করে বলল, কর্নেলিয়া ফিরে আসার উপলক্ষে উৎসবের অংশ হিসেবে মশাল প্রজ্বলিত করা যায়।
তা করা হলে আমাদের ধর্মবিশ্বাসকে সম্মানিত করা হবে, বললেন শর্মিলা। সম্রাট সেলুকাস এবার মনোযোগ দিয়ে তাকে দেখলেন। বললেন, এ মেয়ে কে?
কর্নেলিয়া তার পরিচয় দিয়ে বললেন, তিনি এক জৈন সন্ন্যাসিনী।
গ্রিক পোশাকে কেন? এত ভালো গ্রিক জানে কী করে? তুমি শিখিয়েছ?
পোশাকটা আমার। ভাষাটা নিজে শিখেছেন।
এখানে কেন নিয়ে এসেছ?
কথাটা কাল বলব। এখন চলো মশাল প্রজ্বালন করি।
সম্রাট রাজি হয়ে গেলেন। গ্রিক সেলুসিড শিবিরে অগ্নিমশাল প্রজ্বলিত হলো। আলো আলোকময় হয়ে ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র।
এবার দূর থেকে অবাক হওয়ার পালা মৌর্য সৈন্যদের।
রাত গভীর হচ্ছে। আলোর মশালগুলো তখনো জ্বলছে। আজ একধরনের উচাটন ভাব সেলুকাসের ঘুম কেড়ে নিয়ে গেছে। মেয়েটা ফিরে এসেছে। এই ফিরে আসা তাকে ভাবগ্রস্ত করেছে, সন্দেহ নেই। মেয়ের ফিরে আসার মধ্যে এ ভাবগ্রস্ততা থেমে থাকে নি। ভাবনার বোধ হয় নানা পথ-উপপথ রয়েছে। দূরের কোনো চিন্তাস্রোত সে পথে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। কেউ কেউ ফিরে আসে না। অথচ মন তার কাছে ছুটে চলে যায়। তাদের স্মৃতি হাতড়ে বেড়ায়। স্মৃতি মনকে দুঃখ ভারাক্রান্ত করে। বিষণ্ণ করে তোলে। সেলুকাসের মন এখন বিষণ্ণ। তাঁর নিজের জন্য যতটা নয়, মেয়ের জন্য তার চেয়ে বেশি। মেয়েটা প্রচণ্ড একটা ঘৃণা নিয়ে আছে। মায়ের প্রতি ঘৃণা। ভাইয়ের প্রতি ঘৃণা। কেন সে মৌর্য শিবিরে গিয়েছিল? যুদ্ধের কী রকম সমাপ্তি চায় সে? যুদ্ধের বাইরে মৌর্য সম্রাটের কাছে কী চাওয়ার আছে তার? সে বলেছিল, স্বেচ্ছায় সেখানে গেছে সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। কী সাংঘাতিক ব্যাপার! তার বড় রকমের ক্ষতি হতে পারত। তার চেয়ে বড় ক্ষতি হতে পারত সেলুসিড সাম্রাজ্যের। মৌর্যমন্ত্রী চাণক্য কী শর্ত চাপিয়ে দিত কে জানে? ফিরে আসায় সব রক্ষা পেয়েছে। এসব ভাবতে ভাবতে উঠে দাঁড়ালেন সেলুকাস। হাঁটতে হাঁটতে মেয়ের কক্ষে গেলেন। পাশেই মেয়ের কক্ষ। নিঃসার ঘুমোচ্ছে মেয়েটা। মেয়ের মাথায় হাত রাখতে ইচ্ছা হলো। দুই পা এগিয়ে আবার পেছনে এলেন। নিঃশব্দে কক্ষ থেকে বের হয়ে এলেন। বাইরের দিকে তাকালেন।
আলো জ্বলছে, অনেক আলো। উৎসবের আলো বলছিল ভারতীয় মেয়েটা। চিন্তার স্রোত বইছে সেলুকাসের মধ্যে। উৎসবের আলো একসময় তাঁর চেতনায় বড় হতে হতে চিতার আগুনে পরিণত হলো। ভারতীয়রা মরদেহ সৎকার করে আগুনে পুড়িয়ে। সেদিন যুদ্ধক্ষেত্র থর মরুভূমিতে একসঙ্গে হাজার হাজার চিতা জ্বলেছিল। কী ভয়ংকর দৃশ! মৃত মৌর্য সৈন্যদের সঙ্গে সেলুসিড সৈন্যদেরও পুড়িয়ে দিয়েছিল ওরা। তাঁর মনে হয়েছিল, প্রতিশোধের ঘৃণা আগুনের লেলিহান শিখা হয়ে রাতের আকাশে উড়তে চাচ্ছে। মৃতের আত্মারা কি কষ্ট পেয়েছে? কী রকম কষ্ট ছিল তাদের? নিজেদের সৈন্যের মৃতদেহ ফেলে আসায় সেলুসিড সৈন্যদের কঠোর ভাষায় গালি দিয়েছিলেন সেলুকাস। মনে হচ্ছে এ কাজ আর এরা করবে না। এ কথা ভেবে এখন তিনি একটু উত্তেজিত। উত্তেজনা ভালো। তা বিষাদগ্রস্ততা থেকে মানুষকে মুক্ত করে দেয়। সেলুকাস এখন বিষাদগ্রস্ত নন। কিন্তু তাঁর ঘুম আসছে না। ঘুমহীনতার একটি কারণ উত্তেজনাও। উত্তেজনায় রক্তচাপ বাড়ে। সেলুকাসের রক্তচাপের সমস্যা আছে। আগামীকাল সকালে তিনি কর্নেলিয়ার হাতে চাণক্যের লেখা পত্রটা দেবেন। দেখবেন তার প্রতিক্রিয়া কী? তাকে নিশ্চয়ই চক্রান্তের কথা বলা হয় নি।
একেবারে শেষ রাতের দিকে চোখ লেগে এল তাঁর। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় স্বপ্ন দেখলেন তিনি। দেখলেন, সম্রাট আলেকজান্ডার তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছেন। আলেকজান্ডার ভীষণ রাগান্বিত। তাঁর সামনে রাজা পুরুকে ধরে আনা হয়েছে। সম্রাটের সৈন্যরা তাঁকে মাথা নোয়াতে বলছে কিন্তু তিনি মস্তক উন্নত করে দাঁড়িয়ে আছেন। আলেকজান্ডারের রাগটা এখানে। কী করবেন তিনি বুঝে উঠতে পারছেন না। এই অবস্থায় আলেকজান্ডারের সৈন্যদের মধ্যে অস্বস্তি সৃষ্টি হয়েছে। এই অস্বস্তির ভাবটা সেলুকাসকেও পেয়ে বসেছে। তিনি এপাশ- ওপাশ করছেন। তাঁর ঘুম ভাঙল জেনারেল ফিলেকাসের ডাকে। অত্যন্ত জরুরি কথা জানাতে হবে সম্রাটকে।
সেলুকাস জেনারেলের ওপর বিরক্ত হলেন। সাধারণ সৈনিকদের কেউ ঘুম ভাঙালে তার মৃত্যুদণ্ড দিতেন। ঘুমের জন্য তাঁর কষ্ট নেই, কষ্ট স্বপ্নটা শেষ হলো না। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট অনমনীয় মনোভাবের জন্য পুরুকে কী শাস্তি দিচ্ছেন, তা দেখা দরকার ছিল। ঘুম ভেঙে যাওয়ায় মনে হয় কাঁপছেন তিনি। অসম্পূর্ণ ঘুমে এটা হতে পারে।
এই অবস্থায়ই ফিলেকাস জানালেন, মৌর্যরা থর মরুভূমিতে সৈন্য জড়ো করছে। যুদ্ধের আহ্বান জানানো সময়ের ব্যাপারমাত্র।
তোমার সৈন্যরা প্রস্তুত আছে?
প্রজ্বলিত মশাল দেখে গতকাল থেকেই এরা তৈরি, মহামান্য সম্রাট।
আমাদের থর মরুভূমিতে গিয়ে শত্রুর মুখোমুখি না দাঁড়ালে সমস্যা কী?
এটা যুদ্ধের নীতি নয়, সম্রাট।
একে নতুন কৌশল মনে করা যায় না?
আজ পর্যন্ত এমনটি ঘটে নি। আপনি রীতি ভাঙতে চাইছেন?
সামান্য কিছু অশ্বারোহী সৈন্য পাঠিয়ে বাকিদের এই পাহাড়ি উপত্যকার ভাঁজে ভাঁজে অবস্থান করতে বলো। আর জেনারেলদের সভা ডাকো। আমি তৈরি হয়ে আসছি।