৪৯
যুদ্ধের ব্যাপারে যে পরামর্শ করবেন, সে রকম কেউ এখানে নেই। তাই ভদ্রবাহুর সঙ্গেই চাণক্যকে এ নিয়ে পরামর্শ করতে হয়। কথাটা শুনে ভদ্রবাহু পরামর্শ দেবেন কী, নিজেই একেবারে হতবাক। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, কী বলছেন আপনি, আচার্য! আপনি নিজেই যাচ্ছেন সেলুকাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। এটা অনেক বড় ঝুঁকি।
আপনি যা ভাবছেন, সমস্যাটা তা নয়, ঝুঁকি আছে অন্য জায়গায়। সেটি হচ্ছে সম্রাটকে না জানিয়ে যাওয়া। এ জন্য তিনি ভুল বুঝতে পারেন, বললেন চাণক্য।
সেলুকাসের কাছে যাওয়া ঝুঁকি নয় কেন?
তাঁর কন্যা আটক আছে আমাদের কাছে। যাক সে বিষয়। এখন আপনি বলুন আমি যে বিষয়গুলোকে আত্মসমর্পণের শর্ত হিসেবে উল্লেখ করেছি, এগুলো ঠিক আছে কি না।
মন্তব্যের আগে আবার সেলুকাসের পত্রটি শুনতে চাইলেন আচার্য! পত্রটি এরকম :
মাননীয় মহামন্ত্রী
পণ্ডিতাচার্য চাণক্য,
আপনার পত্রের মর্ম অনুধাবন করতে আমার কোনো অসুবিধা হয় নি। আমি আপনার সঙ্গে আলোচনা করতে চাই। আমার কন্যার মুক্তির জন্য তা আবশ্যক মনে করছি। সিন্ধু অববাহিকার গ্রিক অধিকৃত এলাকাসমূহের বিষয়ে আলোচনা ও সমঝোতা হতে পারে। তবে আমার কন্যাকেও সে আলোচনায় থাকতে হবে।
গ্রিকরা বীরের জাতি। আত্মসমর্পণ তাদের ইতিহাসে নেই। আপনি বা আপনারা অমর্যাদাকর কিছু চাপিয়ে দিতে চাইলে তার ফয়সালা আবার থর মরুভূমির যুদ্ধক্ষেত্রেই হবে। সৈনিক হিসেবে আমি আত্মসমর্পণ নয়, যুদ্ধ করেই মৃত্যুবরণ করার পক্ষপাতী। সেভাবে প্রস্তুতি নিয়ে আসুন। আপনার পাঠানো সেনাদলও এখানে রাজকীয় অতিথি হয়ে আছে। এরা আপনার সঙ্গেই যাবে।
ইতি
সেলুকাস
প্রিন্সেসকে ফেরত পেলে সিন্ধু নদের অববাহিকায় তাদের দখলে থাকা জায়গার দখল ছেড়ে দেবে বলে আমি নিশ্চিত। কিন্তু প্রিন্সেসের বিয়ে, বলে চাণক্যের দিকে তাকালেন ভদ্রবাহু।
বিয়ের প্রস্তাব আমি সেখানেই দেব কাগজপত্রে।
তিনি মানবেন না।
তাঁকে বাধ্য করতে হবে। আমি সে সুযোগই চাচ্ছি।
আত্মসমর্পণ করবে না, এটা ঠিক। কোনো কোনো বিষয়ে সমঝোতা হতে পারে।
সম্রাটের অগোচরে ব্যাপারটা কত দূর আগানো যাবে, আর তার পরিণতি কী হবে? আমি এ ব্যাপারে আপনার সাহায্য চাচ্ছি।
কিছু একটা ঘটে গেলে আমি সম্রাটকে বোঝানোর চেষ্টা করতে পারি। এখনই কি আলাপ করতে বলছেন?
না, তা তো আমিই পারি। কিন্তু আমি তা সম্রাটকে জানাতে চাই না।
অনেক বড় ঝুঁকি হয়ে যায়। তবে সম্রাট যা চাইছিলেন, এটা ঠিক রেখে যেকোনো চুক্তি করা যায়।
অধিকৃত এলাকা না ছাড়লে আমি কোনো চুক্তি করার পক্ষপাতী নই।
কথা বলে দেখুন। সুযোগ তৈরি হয়েছে। আমিও রক্তপাতটা চাই না। আর একটা বিষয়, রাজকুমারীর প্রতি সম্রাটের আগ্রহের ব্যাপারটা মাথায় রাখতে হবে।
চাণক্য ভদ্রবাহুর কথা শুনে হেসে দিলেন। বললেন, আধ্যাত্মিক গুরু আত্মার বন্ধনের প্রতি সাত্ত্বিক।
ভদ্রবাহু আবার বললেন, রাজকুমারীকে এভাবে ভুলভাল বলে ভুলিয়ে রেখে নিজেদের স্বার্থ বা লাভের জন্য ব্যবহার করাটা…
বিবেকে বাধছে, তাই তো?
ঠিক বলেছেন।
যুদ্ধ ও প্রেমে সবই চলে। আমরা দুটোর মধ্যেই আছি, বলে হাসলেন চাণক্য। আবার বললেন, দেখুন, বড় একটা রক্তপাত যদি মিথ্যে কিছু অভিনয় দিয়ে এড়ানো যায়, সে অভিনয় করা উচিত নয় কি?
এটা ঠিক বলেছেন। যান, আপনি এগিয়ে যান। আমি আপনার সঙ্গে আছি।
এখন আমি ভরসা পাচ্ছি। সম্রাটকে ভুল বোঝানোর লোকের অভাব নেই।
আপনি আত্মবিশ্বাসী ও দূরদর্শী।
মাঝেমধ্যে তা ভুলে যাই।
এখন থেকে আমি মনে করিয়ে দেব।
এ কথার পর দুজনই প্রচুর হাসলেন। ভদ্রবাহু হাসি শেষ করে আবার বললেন, অনেক বড় খেলায় নেমেছেন, আচার্য। আপনার জয় হোক।
.
সম্রাট সেলুকাস সম্ভবত বয়সের কারণেই একটু বেশি অস্থির। আগের চেয়ে অস্থিরতা তাঁর বেড়েছে। সব কাজেই তার প্রকাশ ঘটছে। কথা হচ্ছিল জেনারেল ফিলেকাস ও জেনারেল কিউকেকাসের সঙ্গে। নাটকীয়ভাবে তিনি মৌর্য সেনাপতি সদাচারকে ডাকলেন। জেনারেল দুজন মুখ-চাওয়াচাওয়ি করলেন।
সদাচার বন্দী না অতিথি, তা তাদের কাছে পরিষ্কার নয়।
সদাচার ভারতীয় কায়দায় অভিবাদন জানালেন। সেলুকাস তাকে বসতে না বলে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, আমার প্রিন্সেসকে কোথায় রাখা হয়েছে, জানো? হঠাৎ চমকে গিয়ে বললেন, এ্যাই, তোমাকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে।
সদাচার বললেন, না, সম্রাট, এ ব্যাপারে আমাকে কিছু বলা হয় নি। আর আমাদের ভারতীয় সবাইকে এক রকম চেহারারই মনে হয়।
তুমি শুধু কি বার্তাবাহক?
অবস্থাটা সে রকমই
তার অর্থ, তুমি বলবে না। তোমাকে জিজ্ঞাসাবাদ সেলে নিয়ে জিজ্ঞেস করা হবে। সৈনিক হিসেবে তার পরিণাম তোমার বোঝার কথা।
যত নির্যাতনই করা হোক, আমি যা জানি না, তা বলব কী করে? এ ছাড়া আমাকে বন্দী বা জিজ্ঞাসাবাদ করা আন্তর্জাতিক রীতিবিরুদ্ধ।
জেনারেল ফিলেকাস বললেন, আপনি আমাদের সৈনিক না হয়েও আমাদের সেনা ইউনিফর্ম পরেছেন, এ অপরাধেই আপনার বিচার হবে।
জেনারেল কিউকেকাস বললেন, এটা প্রতারণা, এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
তা দিতে পারেন। কিন্তু বার্তাবাহককে বন্দী বা জিজ্ঞাসাবাদ করা বেআইনি।
সেলুকাস বললেন, তাহলে মৃত্যুদণ্ড তুমি মেনে নিচ্ছ?
তার আগে আপনার কন্যার কথা ভাববার অনুরোধ জানাব। আমার মৃত্যু শুধু আমার ক্ষতি। প্রিন্সেসের মৃত্যুর ক্ষতি অনেক বড়। তা আপনি কখনো চাইবেন না।
তুমি ধূর্ত। পত্রে বলা হয়েছে, আমাদের তোমরা ঘিরে ফেলেছ, সত্যি নাকি?
মাননীয় মহামন্ত্রীর পত্রেই তার উল্লেখ রয়েছে। তার বেশি কিছু আমি বলতে পারি না।
তুমি কোন ইউনিটে কাজ করো?
আপনারা যাকে মাউন্টেন রেজিমেন্ট বলেন, এই রেজিমেন্ট 1
সেখানে আপনার অবস্থান কী, জিজ্ঞেস করলেন ফিলেকাস।
সেনাপতি।
মানে কমান্ডিং অফিসার?
ঠিক তাই।
সেলুকাস একটি চেয়ার আনিয়ে সদাচারকে বসতে দিয়ে বললেন, তোমার মতো একজন সেনানায়ককে বার্তাবাহক করা ঠিক হয় নি। আর আমাদের পোশাক পরে তুমি আমাদের ধোঁকা দিতে চেয়েছ।
এটা আমাদের মহামন্ত্রীর নির্দেশ।
তুমি কি আমাদের সেনাবাহিনীতে কাজ করতে চাও? তোমার সঙ্গে যারা এসেছে, সবাইকে নেব।
শত্রুসৈন্যদের সেনাবাহিনীতে নিয়ে চিন্তামুক্ত থাকা যায়?
কেন, বিশ্বাসঘাতকতা করবে?
শত্রুর সেনাবাহিনীভুক্ত হওয়াই বিশ্বাসঘাতকতা। ক্ষমা করবেন সম্রাট, আমি বিশ্বাসঘাতক হতে চাই না।
মৃত্যুদণ্ড চাও?
সৈনিকদের জন্য তা গৌরবের I
তোমার সাহসিকতায় আমি মুগ্ধ। কিন্তু একটা ব্যাপার আমাকে ভাবাচ্ছে। তুমি আমাদের ইউনিফর্ম পরে নির্বিঘ্নে আমাদের বিভিন্ন অবস্থান দেখে নিয়েছ। এটা আমাদের অনেক ক্ষতির কারণ হতে পারে।
ক্ষতি হবে কেন, সম্রাট? আমি তো চুক্তি না হওয়া পর্যন্ত এখান থেকে ছাড়া পাচ্ছি না। চুক্তি বাস্তবায়িত হলে এ স্থানগুলো আপনাদের ছেড়ে যেতে হবে। তাই ক্ষতির কোনো সম্ভাবনা নেই। অবশ্য আপনারা চুক্তিভঙ্গ করলে সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। আপনার অবগতির জন্য বলছি, পার্বত্য বাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে এসব স্থান আমার খুব চেনা। অন্য পার্বত্য সৈন্যরাও চেনে।
আমাদের অবস্থান তো ওরা জানে না।
আপনাদের সব সংবাদ আমাদের কাছে আছে। আপনারা সব দিক থেকে বৈরী পরিবেশে আছেন। দখলদারদের কেউ পছন্দ করে না। বনের পশুপাখিও না। আমার প্রাণ নিতে পারেন এবং আমার সৈনিকদেরও। কিন্তু তা সমাধান নয়।
সমাধান তাহলে কী?
আমাদের মহামন্ত্রীর পত্রে তার উল্লেখ আছে। আমার একটা আবেদন ছিল।
কী আবেদন?
আমি আপনাদের পোশাক ছেড়ে দিচ্ছি। আমার আবাসস্থলে মৌর্য পতাকা ওড়ানোর অনুমতি দিন।
এ কথা শুনে সম্রাট ও জেনারেলরা চমকে উঠলেন। জেনারেল ফিলেকাস উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, কী বলছেন আপনি জানেন?
কিউকেকাস বললেন, কী সাংঘাতিক কথা? আপনাকে এর জন্য চড়া মূল্য দিতে হবে।
সদাচার বললেন, মহামান্য সম্রাট, ভুল কিছু বলেছি কি? একজন জেনারেল যেখানেই থাকুন, তিনি তাঁর দেশের প্রতিনিধি। একজন সৈনিক অন্যের দেশে মারা গেলে তাঁকে যেখানে সমাধিস্থ করা হয়, সে স্থান চিরকালের জন্য তাঁর দেশের অংশ হয়ে যায়। জীবিত একজন সৈন্য তো আশা করতেই পারেন তাঁর মাথার ওপর তাঁর দেশের পতাকা উড়বে।
সম্রাট সেলুকাস এ নিয়ে একটু ভেবে কেন যেন সম্মতি দিলেন। বললেন, তোমার সঙ্গে কি তোমার সাম্রাজ্যের পতাকা আছে?
সদাচার মাথা নাড়লেন। তার অর্থ, আছে।
.
চাণক্য ও ভদ্রবাহু চলে যাওয়ার পর কর্নেলিয়া কিছুক্ষণ পায়চারি করলেন। নিকোমেডেস্ তা লক্ষ করল। এগিয়ে এসে বলল, কর্নি, তোকে অস্থির দেখাচ্ছে। কোনো সমস্যা?
ইন্ডোজের আইন তো বড় কঠিন মনে হচ্ছে, নিকো। আমরা এদের ছোট করে দেখি, এরা মনে হয় অনেক সভ্য।
কর্নেলিয়া যা নিয়ে ভাবিত, তা কিন্তু বললেন না। তাঁর মাথায় নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কের শাস্তিটা এখানে কী, তা-ই শুধু নয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধ কতটা প্রবল এবং সঠিক, তা-ও ঘুরপাক খাচ্ছে। পাশাপাশি তাঁর মা ও ভাইয়ের মুখমণ্ডল চোখের সামনে ভাসছে। তাঁদের প্রতি তাঁর ভেতরে ঘৃণা ক্রমাগতভাবে স্ফীততর হচ্ছে।
নিকোমেডেস বুঝতে বা অনুমান করতে পারে নি, তা নয়। তাই বলল, ইজিপ্টও সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্কের গুরুত্ব দেয়। যুদ্ধে এরা পরাজিত বটে। সে পরাজয় রাজনৈতিক, সামাজিক মূল্যবোধে কিন্তু আপসহীন। সম্রাট টলেমি তাঁদের সামাজিক মূল্যবোধকে সম্মান জানিয়ে ফারাওদের একজন হয়ে গেছেন।
পারসিক মাতা আফামার মধ্যেও আমি শুধু মায়ামমতা নয়, তাঁদের মূল্যবোধের প্রতি সম্মান জানাতে দেখেছি। দুর্ভাগ্য আমার, মা তাঁর নিজের সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রতি সম্মান দেখান নি। জানিস নিকো, সম্রাট আমাকে গ্রহণ করুক বা না করুক, আমি সেলুসিয়ায় আর ফিরে যাব না, আবেগঘন কণ্ঠে কথাগুলো বললেন কর্নেলিয়া।
অবস্থাটা হালকা করার জন্য নিকোমেডেস বলল, তুই থেকে যাবি, ভালো, কিন্তু আমার কী হবে?
তুই আজীবন আমার দেহরক্ষী হয়ে থাকবি, এই তোর সাজা।
সাজা কেন?
তুই ফাওলিনকে পাবি, আমি চন্দ্রগুপ্তকে পাব না, এ হয় না।
ফাওলিনের কী হবে?
প্রথমে ও তোর জন্য অপেক্ষা করবে, তারপর কান্নাকাটি করবে, একসময় তোকে ভুলে যাবে।
চন্দ্রগুপ্তকে না পেলে তুই আমাকে বিয়ে করছিস?
আমি কোনো গ্রিককে বিয়ে করব না।
আমি কি বলি শোন, সব ভুলেটুলে গিয়ে তুই আর্মি অফিসার আর্কিমেডেসকেই বিয়ে কর। সে তো প্রিন্সই। বেচারা! তাকে দেখলে আমার খুব কষ্ট হয়।
তাহলে এত বড় একটা মিশন কী জন্য? সবটাই কি অর্থহীন?
অর্থহীন হতে যাবে কেন? আমাদের সৈনিকদের কল্পিত যুদ্ধের মহড়া দিতে হয়। ধরে নে এ রকম মহড়ায় অংশ নিয়ে কিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিস।
তুই আমাকে খেপাবি না, নিকো। ফাওলিনকে কাছে পেলে তোর ভালোবাসার মহড়ার (অভিনয়) কথা বলব। দেখবি ওর প্রতিক্রিয়া কী হয়।
আমি সে কথা বলেছি নাকি?
তাহলে কী বলেছিস? নিজের বেলুন বগলে রেখে অন্যের বেলুন ফোটাও? তোকে ভালোবেসে বেচারি কতটা ঠকেছে, সে কথা ভাবলে কষ্ট হয়।
কর্নেলিয়ার কথায় নিকোমেডেস মিটিমিটি হাসে। কর্নেলিয়া আবার বললেন, আমার মনে হয় তোর ভালোবাসায় ঘাটতি আছে। তুই ফাওলিনকে ঠকাবি না।
তোর কথা শেষ হয়েছে? এবার আসল কথায় আয়। আমার মনে হয় চাণক্য কোনো ফন্দি আঁটছে। ভদ্ৰবাহুই খাঁটি মানুষ। সম্ভব হলে তাঁর সঙ্গে কথা বল। অথবা তুই চাইলে আমি কথা বলি। অবস্থাটা আমার একেবারেই সুবিধার মনে হচ্ছে না।
কেন?
আমার মনে হয় কালক্ষেপণ করছেন তিনি। তাঁর অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে।
সম্রাট এখানে নেই, তাই বিলম্ব ঘটছে।
তোকে তাঁর কাছে নেওয়া যেত।
আমি চাই এখানেই তাঁর সঙ্গে কথা বলি।
বেশ, অপেক্ষা কর, বলে নিকোমেডেস কক্ষের বাইরে এসে দাঁড়াল। পাহাড়ের ওপর থেকে বহু দূর পর্যন্ত দেখা যায়। সে মুক্ত পরিবেশে একটা নিঃশ্বাস নিতে চাইল। কিন্তু হঠাৎই দূরে এক জায়গায় তার দৃষ্টি আটকে গেল। সে চিৎকার করে ডাকল, কর্নি।
কর্নেলিয়া ছুটে এল বাইরে। বলল, কী?
দেখ দেখ কী হচ্ছে দূরে।
কর্নেলিয়া দেখলেন, জঙ্গলের আইন মেনে দুজন জংলি মানুষ প্রকাশ্যে রতিক্রিয়ায় রত। বানর, শেয়াল কিংবা বিড়ালজাতীয় প্রাণীদের মতোই সম্ভ্রমহীন, সংকোচহীন। এরা অবশ্য পোশাক ছাড়াই বাঁচে। মেগাস্থিনিসের বিবরণে এদের প্রকাশ্য যৌন মিলনের কথা আছে।
নিকোমেডেস বলল, এদের জন্য কৌটিল্য কোনো আইন লিখে যান নি?
কর্নেলিয়া বললেন, ভারতবর্ষের বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্যের একটি দিক এটি। গ্রিক দেবতাদের কল্পনায় যেভাবে দেখি আমরা। ভারতবর্ষে নাকি মানুষেরাই দেবতা।
আমি কখনো মানুষকে এই অবস্থায় দেখি নি।
আমিও না। তবে শুনেছি এটা মঙ্গলের প্রতীক। হয়তো আমরা অচিরেই কোনো ভালো সংবাদ পাব।
তাদের পেছনে লোকজনের উপস্থিতি টের পেয়ে দুজনই ফিরে তাকালেন। অবাক হয়ে দেখলেন, ভদ্রবাহু অপেক্ষা করছেন। তাঁর সঙ্গে একজন দিগম্বর নারী। কমবয়স্ক। তাঁদের উপস্থিতিতে কৌতূহল দুজনের মধ্যেই। নিকোমেডেস বলল, আচার্য, চলুন ভেতরে গিয়ে বসি। আপনাকে দেখে ভালো লাগছে।
কর্নেলিয়ার মধ্যে একধরনের অস্বস্তি। তবু হাসি দিয়ে এদের ভেতরে এনে বসালেন।
ভদ্রবাহু বললেন, আমাদের এভাবে দেখে আপনাদের মনে অনেক প্রশ্ন জাগবে। মানুষের মূল্যবান জিনিস আত্মা। এটি চামড়া দিয়ে ঢেকে সংরক্ষণ করা আছে। সংস্কারের ওপরে উঠতে পারলে সংকোচটা থাকে না। আমরা যে জন্য এসেছি, সে কথায় আসি। আপনারা এখন এ স্থান ত্যাগ করে নিজের এলাকায় চলে যাবেন। আপনাদের এগিয়ে দিতে এই মেয়ে সাহায্য করবে। আমার এ শিষ্য গ্রিক জানে।
এ কথা শুনে চমকে উঠলেন কর্নেলিয়া। কী বলছেন, আচার্য! আমি সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছি। সাক্ষাৎ না করে কেন যাব?
সাক্ষাটা সম্ভব নয় রাজকুমারী।
মন্ত্রী বলছিলেন তিনি ব্যবস্থা করছেন।
তিনি সত্য বলেন নি।
সত্যটা তাহলে কী?
সম্রাট সেলুকাসের কাছে ফিরে গেলেই জানতে পারবেন। আমি চাই না আপনাদের সঙ্গে এ রকম একটি অবস্থার সৃষ্টি হোক!
যা-ই ঘটুক আচার্য, আমি সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে যাব।
জেদ করবেন না, রাজকুমারী, বোঝার চেষ্টা করুন। রাজকুমার নিকোমেডেস, তাকে বোঝানোর চেষ্টা করুন। অবস্থাটা আপনাদের খুবই প্রতিকূল। রাজকুমারী, ভবিষ্যতে আপনাদের নিশ্চিত সাক্ষাৎ ঘটবে। তবে এখন, এ অবস্থায় নয়।
কখন? কোন অবস্থায়?
একটু ধৈর্য ধরুন। আপনাদের সময় খুব কম। এখনই যেতে হবে।
নিকোমেডেস বলল, এখানকার লোকজন বাধা দেবে না?
এ দিকটা আমি দেখব।
সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ একেবারেই অসম্ভব?
একেবারেই অসম্ভব। কারণ, সম্রাট বড় এক পারিবারিক সমস্যায় আছেন।
কর্নেলিয়া তাৎক্ষণিক বললেন, আমরা কি সে সমস্যার কথা জানতে পারি না?
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই একসময় জানবেন, এখন নয়, রাজকুমারী।
আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না, আচার্য।
আপনারা এক্ষুনি রওনা হন। সময় একদম নেই।
নিকোমেডেস উদ্যোগী হয়ে কর্নেলিয়াকে তাঁর ইচ্ছার বাইরে নিয়ে বের হয়ে গেল।
আচার্য ভদ্রবাহু বললেন, যাত্রা শুভ হোক।