৪৫
চাণক্যের পরামর্শের প্রয়োজন নেই, তারপরও তিনি আবার আচার্য ভদ্রবাহুর কাছে গেলেন। বৃত্তান্ত শুনে ভদ্রবাহু বললেন, বলছেন কী, আচার্য? রাজকুমারী নিজে চলে এসেছেন? ব্যাপারটা গোপন রাখতে হবে। তাঁর উদ্দেশ্য এখনো বোঝা যাচ্ছে না। সম্রাটকে সংবাদটা দিতে চাই না।
কেন?
যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি জটিল দিকে মোড় নিতে পারে।
তিনি যে প্রিন্সেস, বুঝলেন কী করে? মিথ্যেও তো বলতে পারেন।
আপনার কথা ঠিক আছে। ঝিলামের বিনোদনপ্রাসাদে ঘোড়া বিক্রেতাদের গল্প বোধ হয় ভুলে গেছেন।
ও, আচ্ছা, আপনি তো আগেই তাঁকে দেখেছেন।
এবার হাঁটুও দেখেছি, আপনার দেবীর মতো টোল পরা, বলে দুজন বেশ হাসলেন। অসাধারণ কাজ করেছেন আচার্য। তা কেউ ভুলবে না।
রাজনৈতিক গুরু বলে আপনাকেই ফুলবৃত্ত পরাতে হবে মাথায়।
এ সুযোগ আমি হাতছাড়া করব না, বললেন চাণক্য।
কথাবার্তায় কেমন মনে হলো?
বেশ টনটনে বুদ্ধি।
কিন্তু আপনার জালে তো ধরা পড়ে গেল।
সাফল্য নির্ভর করছে ধরে রাখার ওপরে।
ধরে রাখার বেশি কসরত করবেন না যেন। অনর্থ হতে পারে।
ভয় আর আশঙ্কার দিকটা আমিও ভেবেছি। কারণ অবিশ্বস্ততা, হঠকারিতা, প্রতারণা, ছলনা, নির্বুদ্ধিতা, ধনতৃষ্ণা, অপরিচ্ছন্নতা–এ সাতটি মেয়েদের আচরণের স্বভাবত্রুটি।
হেসে ভদ্রবাহু বললেন, কৌটিল্যও অর্থশাস্ত্রে সে কথাই বলেছেন।
চাণক্য বললেন, আচার্য, আপনি মজা করতেই পারেন। কিন্তু কৌটিল্য কিছুমাত্র ভুল বলেন নি।
কৌটিল্য কিন্তু এ কথাও বলেছেন, যে ব্যক্তির গুণবতী প্রেমময় স্ত্রী আছে, যিনি সম্পদশালী, যার সুদগুণসম্পন্ন বিনয়ী সন্তান আছে, তার আর প্রভু ইন্দ্রের মহাজগতে ভোগ করার মতো অবশিষ্ট কিছু আছে কি?
আমরাও চাই সম্রাট ভোগে এমন পরিতৃপ্তি লাভ করুন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, কৌটিল্যের সেই উপদেশ, যেখানে তিনি বলেছেন, যদি বিতর্কিত পরিবারে জন্মগ্রহণকারী কোনো নারীর কাছ থেকে জ্ঞান-গরিমা অর্জন করতে হয়, তবে তাও নিঃসংকোচে গ্রহণ করতে পারো, এ কথা বলে বক্রভাবে তাকালেন চাণক্য।
ভদ্রবাহু বললেন, তার ভালো-মন্দ দুটো দিকই আছে।
আমরা মন্দ দিকটির কথাই ভাবব, বলে একটু থামলেন চাণক্য। পরে আবার বললেন, প্রিন্সেসের পরিবারটি বিতর্কিত। তাঁর মা তাঁর বড় ভাইয়ের সঙ্গে সংসার করছে। আমাদের সমাজে এটি অনেক বড় অপরাধ। শিক্ষা যদি নিতে হয়, এ কথা আগে মাথায় রাখতে হবে। নয় কি?
আচার্য, আপনি বিচক্ষণ ব্যক্তি। আমাদের সমাজে নৈতিকতার দিকটি অবজ্ঞা করা চলে না। সে কথা কৌটিল্যও বলেছেন।
চাণক্য হেসে দিয়ে বললেন, কী বলেছেন?
রাজাকে নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছেন। কাম, ক্রোধ, লোভ, মান, মদ ও হর্ষ পরিহারের মাধ্যমে ইন্দ্রিয় জয়করণ আবশ্যক।
এ কাজটি তো আধ্যাত্মিক গুরুকেই করতে হবে, বলে উচ্চ স্বরে হাসলেন চাণক্য। পরে বললেন, পরনারীর প্রতি কামভাব বা অভীপ্সা কলুষিত চিত্তে পরিত্যাজ্য রিপুর বসবাস। তা রাজা বা সম্রাটকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে। এ রকম বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। আমি সম্রাটকে সেদিকে ঠেলে দিতে পারি না।
আচার্য, সমস্যা করতে চাইলে নিজের রানিও করতে পারেন। কৌটিল্যই বলেছেন, রানির অনিচ্ছা সত্ত্বেও কাশিরাজ মহাসেন বলপূর্বক সংগত হতে উদ্যত হলে ক্ষুব্ধ রানি সুপ্রভা খাদ্যে বিষ মিশিয়ে আপ্যায়নের ছলে রাজাকে হত্যা করেন। বৈরন্ত রাজার পত্নী রাজা সম্পর্কে অপবাদ শুনেই যাচাই না করে প্রণয়লীলার ছলে বিষাক্ত নূপুরের আঘাতে রাজাকে হত্যা করেন। সৌবীর দেশের রানি হংসবতী রাজার কূটবাক্যে বিক্ষুব্ধ হয়ে কোমরের বিষমিশ্রিত বিছা দ্বারা পিটিয়ে রাজা বীরসেনকে হত্যা করেন। অযোধ্যার রাজা জালুথ অন্য রানিদের সঙ্গে সংগত হলেও রত্নবতীর প্রতি ছিলেন উদাসীন। অপমানিত রানি রত্নবর্তী রাজার আয়নায় বিষ মাখিয়ে তাঁকে হত্যা করেন। বৃষ্ণিবংশীয় রাজা বিদুরথ স্ত্রীর ধন অপহরণ করে গণিকাদের পেছনে খরচ করতেন। রানি বিন্দুমতি ক্রুদ্ধ হয়ে খোঁপায় লুক্কায়িত অস্ত্র দ্বারা রাজাকে হত্যা করেন।
এগুলো খুব মনে রেখেছেন দেখছি, আচার্য।
আমার প্রিয় বন্ধু কৌটিল্য লিখেছেন, আমি পড়ব না, মনে রাখব না, তা কি হয়, বলে হাসলেন ভদ্রবাহু। পরে বললেন, আপনার আশঙ্কা কি এ প্রিন্সেস রানিদের মতো ঘটনা ঘটিয়ে দিতে পারেন?
এ আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে বড় ভয় সম্রাজ্ঞী দুরধরাকে। তিনি শুনে ক্ষুব্ধ হবেন। তার পর কী করবেন বলা শক্ত।
সম্রাট বরাবরই অন্য রাজাদের মতো নন।
তা আমিও মানছি। আমার যত দূর ধারণা, ঝিলামে তাঁর চোখে কামভাব দেখি নি, প্রেমে বিগলিত চোখগুলো ছিল প্রিন্সেসের প্রতি স্থির ও পলকহীন, অর্থাৎ তিনি প্রেমে পড়েছেন।
তাহলে কঠিন এক বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যেতে হবে আপনাকে।
আমি ভাবছি সম্রাট সেলুকাসের কাছে আমি নিজেই যাব।
প্রিন্সেসের বিয়ের ব্যাপারে?
না, প্রিন্সেসের বদলে সম্রাটকে আত্মসমর্পণ করাতে।
প্রিন্সেসকে জিম্মি রেখে?
ঠিক তাই।
অনেক বড় খেলা, দুদিক থেকেই ঝুঁকি রয়ে গেছে।
এ ছাড়া গত্যন্তর নেই, আচার্য।
আমাকেও ভাবনায় ফেলে দিলেন আপনি। আপনাকে হারালে মৌর্য সাম্রাজ্যের বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে। আমি আমার বন্ধুকে হারাতে চাই না।
আমি পরামর্শ চাই আপনার কাছে। এখনই বলার প্রয়োজন নেই, দুদিন ভেবে বলুন। আমি পরিকল্পনা প্রস্তুত করতে থাকি। আমার বিশ্বাস, কন্যার জন্য সম্রাট সেলুকাস আমাকে বাঁচিয়ে রেখে আলোচনায় বসবেন। হত্যা করবেন না।
আপনি না গিয়ে দূত পাঠানো যায় না?
না, যায় না। এ কাজে আমাকেই যেতে হবে এবং সম্রাটের অগোচরে।
তারপরও অনেক বড় ঝুঁকি। কী করতে চান আপনি?
রক্তপাতহীনভাবে সিন্ধু অঞ্চল উদ্ধার।
প্রিন্সেসের ব্যাপারে?
এ সিদ্ধান্ত সিন্ধু অঞ্চল উদ্ধারের পর।
আমি আপনাকে যতই দেখছি, ততই অবাক হচ্ছি, বললেন আচার্য ভদ্ৰবাহু। আচার্য চাণক্য মৃদু হাসলেন।