মৌর্য – ৪৩

৪৩

সেলুকাস তাঁর সেনাবাহিনীর জেনারেলদের নিয়ে বসেছেন। জ্যোৎস্নার প্রখর আলোয় চলছে দীর্ঘ সভা। চারদিকে সেলুসিড সৈন্যরা প্রহরারত। পাহাড়ের ওপর এ সভায় যুদ্ধের নীতি নির্ধারণের সলাপরামর্শ চলছে। পরাজয়ের কারণ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পরাজয়ের ব্যাপারে সেলুকাস বেশ ক্ষুব্ধ। কমান্ড, সৈন্য, আক্রমণকৌশল, এমনকি যুদ্ধাস্ত্রেও পরিবর্তন এনেছেন। কৌশলটা গেরিলাযুদ্ধের। নদী ও পাহাড়ি অবস্থানের কারণে এখন তাঁর বাহিনী সুবিধজনক অবস্থানে আছে। নেমে মৌর্য বাহিনীর ওপর গুপ্ত আক্রমণ করে আবার ফিরে আসে।

সভা চলাকালে কর্নেলিয়া ও নিকোমেডেস উপস্থিত হলেন। সেলুকাস বিস্মিত হয়ে বললেন, কর্নেলিয়া তুমি? কোনো সংবাদ না দিয়ে একেবারে যুদ্ধক্ষেত্রে?

আমি কি যুদ্ধ করতে পারি না, বাবা?

যুদ্ধের তো নিয়ম আছে। যাক, এসেছ, ভালোই করেছ। আমার একজন কথা বলার মানুষ প্রয়োজন। নিকোমেডেসকে দেখে ভালো লাগছে। তুমি চাইলে নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারো। চাচা টলেমির কী অবস্থা?

বাবা, তুমি কী করে জানো টলেমির বাহিনীতে নিকো কাজ করে?

সম্রাটকে সব খবর রাখতে হয়, বলে হাসলেন।

তুমি সভা শেষ করো, আমরা বাইরের কক্ষে বসি।

চাইলে তোমরা এখানেই বসতে পারো।

কর্নেলিয়া নিকোমেডেসের দিকে অর্থপূর্ণভাবে তাকিয়ে বললেন, আমরা বাইরে গিয়েই বসি, বাবা।

বাইরে আসার সময় নিকোমেডেস বলল, কর্নি, তুই কি সম্ভাব্য সাক্ষাতের কথা আঙ্কেলকে জানাবি?

তোর কী মনে হয়?

মোটেও জানাবি না। অভিযানটা তাঁর অগোচরেই চালাতে হবে।

আমিও তা-ই ভেবেছি।

এরা বাইরে আসার পর সেলুকাস জেনারেল ফিলেকাসকে বললেন, কী বলছিলে বলো। ফিলেকাস বললেন, মহামান্য সম্রাট, নতুন একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। কতগুলো ভারতীয় উদ্বাস্তু পাহাড়-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং আমাদের গতিবিধির ওপর দৃষ্টি রাখছে বলে মনে হচ্ছে।

জিজ্ঞাসাবাদ করো নি?

করেছি। বলছে, এদেরকে এদের বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে, এরা যাবে কোথায়, পাহাড়ে-জঙ্গলে জীবিকার সন্ধান করছে।

আমাদের ক্যাম্পের কাছে আসতে দিয়ো না।

তা প্রতিহত করছে আমাদের সৈনিকেরা। তাদের কি হত্যা করব?

নিরীহ-নিরস্ত্র লোকদের সীমানা ঠিক করে দাও। আর বন্য মানুষদের কী অবস্থা?

এদের উৎপাত কমেছে। কিন্তু বোঝা মুশকিল কারা কী উদ্দেশ্যে আনাগোনা করছে।

এদের অর্থ-সম্পদ দিয়ে হাত করা যায় না? আমার মনে হয় এরা আমাদের তথ্য সরবরাহ করতে পারে। মৌর্যদের অবস্থানটা আমাদের ভালো করে জানা দরকার।

সে ব্যবস্থা করব, মহামান্য সম্রাট।

আমার মনে হয় অবস্থানগত কারণে আমরা যেমন সুবিধাজনক অবস্থায় আছি, তেমনি পরিকল্পনামতোই এগোচ্ছি, কী বলো তোমরা? বলে অপারপর জেনারেলদের দিকে তাকালেন সেলুকাস।

জেনারেলরা একমত পোষণ করলেন। একজন জেনারেল বললেন, হাজার বছর যুদ্ধ করেও মৌর্যরা আমাদের পরাস্ত করতে পারবে না, এত মজবুত আমাদের অবস্থান।

আরেকজন জেনারেল বললেন, ভারতীয় তিরন্দাজ সৈন্যরা দূর থেকে নাশকতা সৃষ্টি করতে পারে।

তা ঠিক বলেছ। এদের শক্তি হাতি আর তির-ধনুক। আমাদের অস্ত্রগুলো দূরপাল্লার নয়। হাতি আর তিরন্দাজদের মোকাবিলা করার পন্থা উদ্ভাবন করতে হবে। পাহাড়-জঙ্গলে অভিযানটা এরা এই দুই শক্তির ওপর নির্ভর করে চালাবে।

আরেকজন জেনারেল বললেন, আপনি এদের দেব-অস্ত্রের কথা বলেছিলেন।

স্পিরিচুয়াল অস্ত্র তাদের থাকতে পারে। দেবতা অ্যাপোলো নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করবেন। আমাদেরও আত্মবলে বলীয়ান হয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে শত্রুদের মোকাবিলা করতে হবে। জয় আমাদের হবেই। গ্রিকরা পরাজিত হতে পারে না। প্রাথমিক জয়ে এরা নিশ্চয়ই বিজয়োল্লাস আর উৎসবে মেতে উঠেছে।

জেনারেল ফিলেকাস বললেন, ক্ষমা করবেন, সম্রাট। আমাদের গুপ্তচরেরা জানিয়েছে, মৌর্যরা কোনো বিজয় উৎসব করে নি।

বলো কী? তার কারণ জানতে পেরেছ?

না, তা পারি নি

এ সংবাদটাও নিতে হবে। তার অর্থ, এমন কোনো কারণ আছে, যা বিজয় উৎসবকে ম্লান করে দিতে পারে। জরুরিভাবে গোয়েন্দাদের পাঠাও।

.

নির্জলা চাণক্যের নির্দেশে উদ্বাস্তুদের সঙ্গে সিন্ধু উপত্যকার পাহাড়ি ভূমিতে ঢুকে গেছে তার কয়েকজন গোয়েন্দা সঙ্গী নিয়ে। প্রথমে তাকে অর্থশাস্ত্রের অনুকরণে বনবিহারী বা নিঃসঙ্গ কাপালিকের বেশ ধরতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। নির্জলা অবস্থা পর্যালোচনা করে নৃত্যশিল্পীর বেশ ধরেছে। অর্থশাস্ত্রে এই বেশের সমর্থন আছে। নির্জলা বুদ্ধিমতী, সাহসী ও অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়, তা আমরা আগেই দেখেছি।

প্রথমে সে উদ্বাস্তুদের মাধ্যমে সেলুসিড আর্মির প্রহরীদের সঙ্গে ভাব জমিয়েছে। তারপর এদের দুর্বলতার সুযোগে সেনাক্যাম্পে পৌঁছে গেছে। সেখানে আসর গুলজার করে তুলেছে। একসময় সম্রাটের চোখে পড়েছে। সম্রাট ভারতীয় সংগীত ও নৃত্যকলা পছন্দ করেন। আলেকজান্ডারের স্নেহভাজন সেনানায়ক হিসেবে সম্রাটের সঙ্গে ভারতীয় নৃত্যকলা উপভোগ করেছেন। নির্জলার নৃত্য দেখে তাঁর আলেকজান্ডারের কথা মনে হলো। সে সময়কার গৌরবময় উপভোগের দিনগুলো যেন ফিরে এল। নির্জলা শ্বাপদসংকুল মানব অরণ্যে নিরাপত্তা ও প্রশ্রয় পেল স্বয়ং সম্রাটের কাছ থেকে। সবটাই দূরে থেকে সুন্দরমতো সাজিয়ে তুললেন মহামন্ত্রী চাণক্য নিজে।

সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত এত কিছুর খবর রাখেন না। তিনি অবশ্য ভদ্রবাহুর সাহচর্যে যুদ্ধের ভয়াবহতার ছায়াপাত ও নিজের বিমর্ষভাব থেকে ক্রমে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছেন। যুদ্ধের সেনাছাউনিতে স্বাভাবিক কাজকর্ম চলছে এখন।

এরই মধ্যে চন্দ্রগুপ্ত সংবাদ পাঠালেন মহামন্ত্রী চাণক্যের কাছে। তাঁকে আসতে হবে। চাণক্য সুবন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে সম্রাটের দরবারে এলেন। সম্রাটকে দেখে চাণক্য অবাক হলেন। সম্রাটের মধ্যে বিমর্ষভাব নেই। চেহারায় দারুণ রকম ঔজ্জ্বল্য ফুটে উঠেছে। সম্রাট তাঁর প্রিয় পোশাক পরিধান করেছেন। হীরা-মুক্তা আর মূল্যবান সব পাথর বসানো এ পোশাক। পুলক, ভগ্রা, ইন্দনীলা, সষ্যক, চক্রেতান, লোহিতাক্ষ, মরকত, প্রবাল, সৌগন্ধিকা, স্ফটিক, হামছাগর্ভ, অঙ্গদ, চন্দ্রকান্ত মণি প্রভৃতি রত্ন বসিয়ে পোশাকটিকে মহামূল্যবান করে তোলা হয়েছে। স্বর্ণের ওপর বসানোর পুণ্ড্রবর্ধনের হিরে এবং দামি পাথর বসানো রাজ-অলংকার পরিধান করেছেন পোশাকের সঙ্গে সংগতি রেখে। গলায় আঠারো, নয় ও তিন লহরের মুক্তার মালা, বাহুতে বাহুবন্ধনী (বাহুবাজু), কোমরে কোমরবন্ধ, গলায় গলাবন্ধ, হাতে ব্রেসলেট, আঙলে অঙ্গুরীয় এবং চুলে মানানসই ভূষণে অদ্ভুত লাগছে তাঁকে। তাঁর মুখমণ্ডলের আকর্ষণ এবং রাজকীয়তা বাড়িয়ে দিয়েছে রত্নখচিত কানপাশা ও অলংকারসদৃশ শিরস্ত্রাণ। কস্তুরিযুক্ত সুগন্ধির মোহময় স্নিগ্ধ গন্ধ আসছে সম্রাটের শরীর থেকে। গন্ধটা মিশ্র। মনে হয় কুন্দকলি থেকে নেওয়া নির্যাস।

বড় দীনহীন পোশাকে এসেছেন চাণক্য। সুবন্ধুও তাই। ভেবেছিলেন সম্রাট বিষাদগ্রস্ত, বিমর্ষাবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন, সাজসজ্জা করে তাঁর সামনে যাওয়া অশোভন হবে। এখন নিজেকে বড় দীনহীন মনে হচ্ছে। তবু চাণক্য সম্রাটকে অভিবাদন জানালেন পোশাক ও বিজয়লাভের জন্য। তিনি আশা করেছিলেন, সম্রাট বিজয়োৎসবের ঘোষণা দেবেন। কিন্তু তাঁকে অবাক করে দিয়ে বললেন, আচার্য, আমি গান্ধারা রাজপ্রাসাদে যাচ্ছি। সম্রাজ্ঞীর এখন আমার সাহচর্য প্রয়োজন। আমার মনে হয় যুদ্ধ আরও প্রলম্বিত হবে। আপনি গোয়েন্দাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে যুদ্ধজয়ের পরিকল্পনা করুন। আমি ফিরে এসে অভিযান শুরু করব।

মহামান্য সম্রাটের যা ইচ্ছা। পাহাড়-জঙ্গলে গ্রিকদের অবস্থানগুলোয় আমাদের গোয়েন্দারা কাজ করছে। শিগগিরই সংবাদ পাওয়া যাবে।

আদিবাসী কৌকাসেস ও উদ্বাস্তুদের দিকে খেয়াল রাখবেন। শত্রুদের মুখে এদের ফেলে আমি স্বস্তি পাচ্ছি না। এরা নিয়মিত যোদ্ধা নয়। সাধারণ প্রজা। আরেকটি কথা, আক্রমণ প্রতিহত করা অনিবার্য হয়ে পড়লে আক্রমণ মোকাবিলা করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, গ্রিক সম্রাট কিংবা তাঁর পরিবারের যেন কোনো ক্ষতি না হয়। তাঁদের বন্দী করে সম্মান প্রদর্শন করবেন এবং রাজকীয় মর্যাদায় রাখবেন।

চাণক্য বললেন, সম্রাটের ইচ্ছার কোনো ব্যত্যয় হবে না।

সম্রাটের গমনের জন্য চতুরাশ্বযানসহ নিরাপত্তা বাহিনী সঙ্গে থাকলেও তিনি রাজকীয় হস্তীতে আরোহণ করে গান্ধারা রাজপ্রাসাদে যাবেন। সেভাবেই ঐশ্বর্যময় সাজসজ্জায় সাজানো হয়েছে রাজকীয় হস্তীকে।

সম্রাটকে বিদায় জানাতে সেনাপ্রধানসহ উচ্চপর্যায়ের সভাষদ ও কর্মকর্তারাও এসেছেন। তার আগেই গান্ধারা প্রাসাদে একটি অগ্রবর্তী দল পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এদের কাজ শুধু সংবাদ পৌঁছানো নয়, সম্রাটের গতিপথের নিরাপত্তা সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া। সম্রাট ও রাজা-বাদশাদের যাতায়াত খুব একটা নিরাপদ নয়। তাই যাতায়াতে এরা নানা কৌশল অবলম্বন করেন। অন্য সময় হলে চাণক্য সুসজ্জিত হাতিতে সম্রাটের পোশাকে কাউকে সাজিয়ে বসাতেন। আর সম্রাটকে বসাতেন সাধারণ বেশে একটি ঘোড়া অথবা সহযাত্রী হস্তীতে। এ রকমটি আগেও করেছেন। আজ রাজপোশাকে সম্রাটকে দেখে তিনি এত মুগ্ধ যে তাঁর মনে হলো সম্রাটকে যদি মৃত্যুবরণ করতেও হয়, তবু তিনি এই পোশাকেই মরুন। মৃত্যুও তাহলে এত সুন্দর হয়।

সম্রাটের দেহরক্ষী বলে খ্যাত সুন্দরী রমণীকুল পরিবেষ্টিত হয়ে চন্দ্রগুপ্ত নেমে এলেন সমতল ভূমির বিস্তীর্ণ চত্বরে। অপেক্ষমাণ রাজন্যবর্গ সম্রাটকে অভিবাদন জানালেন। সম্রাট তাঁদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে জানানো অভিবাদনের জবাব দিতে দিতে অগ্রসর হয়ে হস্তীপৃষ্ঠে আরোহণ করলেন। অতি দ্রুত দেহরক্ষী রমণীরা ঝটপট হস্তী ও অশ্বপৃষ্ঠে চড়ে সম্রাটের অনুগামী হলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *