মৌর্য – ৪২

৪২

ঝিলাম নদীর তীরে প্রমোদপ্রাসাদে কর্নেলিয়া যাত্রাবিরতি করলেন। শানবাঁধানো ঘাটে জোৎস্নারাত। জোৎস্নায় নদীর জল ঝিলমিল করছে। ছোট ছোট ঢেউ তীরে পৌছার আগেই মিলিয়ে যাচ্ছে। ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে নিকোমেডেস বলল, এ পাগলামির অর্থ কী, কর্নি? কর্নেলিয়া কিছু না বলে চন্দ্রগুপ্তের লেখা পত্রটি এগিয়ে দিলেন।

ফুটফুটে জোৎস্না। এ আলোকে পত্র স্পষ্ট পড়া যায়। নিকোমেডেস পত্রটায় চোখ বুলিয়ে গেল এবং পত্রটা ফেরত দিয়ে বলল, কী করতে চাস?

ক্ষমা চাইতে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করব।

আমি সবকিছু জানি না, তবু আমার বিশ্বাস, তুই ঠিক কাজই করছিস। আমার ভাবনা সময়টা নিয়ে। কদিন আগে মারাত্মক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। এখনকার অবস্থা কী, আমরা জানি না। আমি এতক্ষণ তোর ওপর বিরক্ত হয়েছিলাম। সে বিরক্তি কেটে গেছে। তুই যা করতে চাস, আমি তোর সঙ্গে আছি। আমার মনে হয়, মা-ও তোর পক্ষে আছে।

কর্নেলিয়া বললেন, সে সম্রাট হলেও আমার মতোই দুর্ভাগা। মায়ের দিক থেকে আমার মতোই প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে। তাকে আমি দুঃখ দিতে পারি না।

তুই ঠিক বলেছিস। মাঝেমধ্যে তোর কথা ভাবি। ফাওলিনকে বলি। ফাওলিন বলে, আমরা অনেক ভাগ্যবান, ‘নিকো, আমি কর্নিকেই বেশি গুরুত্ব দেব। সম্মান করব।’ তোর গল্প শুনতে শুনতে আমার মতো তার জগতে তোরও একটি অবস্থান তৈরি হয়ে গেছে। সে তোকে পছন্দ করে।

এই প্রাসাদটায় আমি অনেক দিন ছিলাম। নানা স্মৃতি আছে এখানে। এ জায়গাটাকে মনে হয় ভালোবাসি।

এখান থেকে চলে গেলি কেন?

চলে গেলাম কোথায়? ইচ্ছা করে গেছি? মৌর্য আক্রমণের ভয়ে আমাকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

প্রিন্স আর্কিমেডেস কি এখানে এসেছিল?

জেনে বলছিস?

নিশ্চিত হতে চাইলাম।

এসেছিল। সে তো দীর্ঘদিন ধরে পেছনে লেগে আছে। যুদ্ধশিবিরে পৌঁছালেও দেখবি সে একই যন্ত্রণা।

শুনে হাসল নিকোমেডেস। বলল, আর্কিেেডস তো পাত্র হিসেবে মন্দ নয়। প্রিন্স, সামরিক অফিসার এবং বনেদি পরিবারের সন্তান।

আমি তো বলি নি মন্দ পাত্র। এ ছাড়া তোদেরই তো বংশধর।

তাহলে সমস্যা কোথায় ছিল?

কোনো গ্রিককেই আমি বিয়ে করব না।

তাহলে তো ফাওলিনকে ধন্যবাদ দিতে হয়, না হলে আমাকেও আর্কিমেডেসের ভাগ্য বরণ করতে হতো।

দুষ্টুমি করবি না। মনটা একেবারেই ভালো নেই। তবে গ্রিক বিয়ে করলে তোকেই বেছে নিতাম।

আমার ভাগ্যটা তাহলে একেবারে খারাপ না।

খারাপ তো বটেই। ভালো হলে তুই চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য হতিস।

তোকে ভালো করেই পেয়ে বসেছে চন্দ্রগুপ্ত। ব্যাটাকে আমি একহাত দেখে নেব।

ওর দোষ কী? তুই কেন ওকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছিস? এমন নয় তো যে তুই গ্রিক নস। আমি গ্রিক ছেলেদের খুব অপছন্দ করি।

সে তালিকায় নিশ্চয়ই আমিও আছি।

অবশ্যই আছিস।

এই আমি রাগ করলাম।

কর।

না রে, তোর সাথে রাগ করব না। তুই হলি এক ধরনের উন্মাদ, যে নিজের ভালো-মন্দ বিবেচনায় না এনেই হুট করে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

আত্মঘাতী কেন?

তুই শুধু আত্মজনদেরই নয়, নিজেকেও হনন করতে পা বাড়িয়েছিস। কী পেয়েছিস চন্দ্রগুপ্তের মধ্যে?

চন্দ্রগুপ্তের মধ্যে কী পেয়েছি? যদি সত্যিই তোকে ভালোবাসে, তাহলে তার সঠিক জবাব দেবে ফাওলিন। আর আমার জবাবটা অন্যভাবে দিতে চাই। তোরা যখন অত্যাচারে অত্যাচারে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিস, তখন সে আমাকে আশ্রয় দিয়েছে। অথচ তাঁকে আমি বলেছি, গ্রিক ট্র্যাজেডিগুলো সম্পূর্ণভাবে ডায়নোসাসের দুর্ভোগের ওপর নির্ভরশীল, তার ভাগ্যেও সে ট্র্যাজিক দুর্ভোগ আছে।

সে কী বলল?

কিছু বলে নি, মনে হচ্ছে ভাগ্যকে মেনে নিয়েছে। শুধু আমাকে দেখতে চাইছে, জানিস তো যুদ্ধক্ষেত্রেই অপেক্ষা করছে। বলে ক্রূর হাসি হাসলেন কর্নেলিয়া।

ভাগ্যকে মেনে নিয়ে যুদ্ধ করছে? ব্যাপারটা পরিষ্কার নয়।

কী বলতে চাচ্ছিস তুই? ঠিক বুঝলাম না।

এ রকম একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এড়ানো যেত না?

কীভাবে?

তোদের দুজনের মধ্যে আলোচনা করে।

যুদ্ধের যখন সূচনা, পরিস্থিতিটা তখন আমাদের কারও পক্ষে ছিল না। পক্ষে থাকলেও রাজনৈতিক বিষয়ে আমি হস্তক্ষেপ করতে চাইতাম না।

কেন?

সম্রাট সেলুকাস আমার কথা শুনতেন না।

কেন শুনতেন না?

তার কারণ, বিনা যুদ্ধে তিনি ভারতীয় অংশের দখল ছেড়ে দিতেন না। এ ছাড়া আমাদের সম্পর্কের বিষয়টি সম্রাটকে জানাতে চাই নি।

তুই যদি সিদ্ধান্তে অটল থাকিস, তোর সম্পর্কের কথা সম্রাট একসময় জানবেনই।

সেটা তখন দেখা যাবে।

মা-সহ পরিবারের কেউ কেউ সে কথা জানে।

লাউডিস আর তুই জানিস। আমি না বললে কোনো দায়িত্বশীল মানুষই বাবাকে সে কথা বলবে না। এ্যাই, একটু আগে কী বললি? যদি সিদ্ধান্তে অটল থাকিস, মানে কিরে, তুই কি এখনো সন্দেহ করিস?

না, বলছিলাম…

তোকে ফাওলিন বিশ্বাস করে কী করে? তোর ভেতর এত আস্থার অভাব।

ভুল হয়ে গেছে। এই কান ধরছি, আর বলব না।

তুই কথাটা তোর ছায়ার দিকে তাকিয়ে বল। তাহলে মনে থাকবে। ছায়া সাক্ষী।

নিকোমেডেস তা-ই করল।

.

পাহাড়ের ওপর সমতল একটা জায়গায় পদ্মাসনে বসে আছেন ভদ্রবাহু। তাঁর সামনে হাঁটু গেড়ে নিতম্বের ওপর বসেছেন সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত। আকাশের চাঁদটা পৃথিবীর খুব কাছাকাছি এসে যায় ষাট থেকে সত্তর বছর পরপর। তখন পৃথিবী থেকে চাঁদকে খুব বড় দেখা যায় এবং অন্য সময়ের চাইতে তার আলো থাকে বেশি।

আজ সে রকম একটি রাত। চারদিকটা অদ্ভুত রকম আলোকিত। পাহাড়ের ওপর সমতল ভূমিতে, যেখানটায় এঁরা বসে আছেন, সেখানটায় কোনো বৃক্ষ নেই, স্বপ্নপুরী মনে হচ্ছে। বাস্তবে এরা কেউ এমনটি দেখেন নি। যেন পৃথিবী এইমাত্র স্নান করে উঠেছে। ভদ্রবাহু সম্রাটকে এখানে নিয়ে এসেছেন। কেন এসেছেন, তা তাঁর জানা নেই।

সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত বললেন, আচার্য, অনেক দিন ভেবেছি কল্পসূত্রের কিছু বিষয় নিয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলব, সুযোগ হয় না। আজ একটি বিষয়ে নিয়ে কথা বলতে চাই।

কী বিষয়, সৌম্য হাসি হেসে জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রবাহু।

আজকের রাতের এই চাঁদকে নিয়ে যেন কথাগুলো বলেছেন।

রানি ত্রিশূলার স্বপ্নের কথা বলছ?

ঠিক তাই, আচার্য।

চাঁদের সৌন্দর্যের একটা চিরন্তনতা আছে। আজ তার যে সৌন্দর্য লক্ষ বছর পরও তাই থাকবে।

কিন্তু সৌন্দর্যবোধে আপনার মধ্যে একটা অতৃপ্তি দেখেছি।

যেমন?

চাঁদের উপমা এতভাবে দিয়েছেন যে…

চন্দ্রগুপ্তের মুখ থেকে কথাটা টেনে নিয়ে ভদ্রবাহু বললেন, ঠিক ধরেছ। প্রথমটায় মনে হলো চাঁদটা দুধের মতো। আবার মনে হলো লক্ষ লক্ষ সাদা বুদ্বুদ। আবার মনে হলো জলপ্রপাতের জল পড়ে তৈরি হওয়া ফোয়ারার কথা। তাতেও যেন ঠিক বলা হলো না। মনে হলো রূপো থালা—সবই জড় পদার্থ। হঠাৎ করেই মনে হলো শ্বেতবসনা পর্বতবাসী এক উপদেবী এই চাঁদ, গৌরবদীপ্ত, হাস্যোজ্জ্বল তার চোখ, উৎফুল্ল হৃদয়। পূর্ণ যৌবনা। সে সফেদ, তবে সূক্ষ্মভাবে পৃথক সবকিছু থেকে। কলহংস যেন, নক্ষত্রকপাল অলংকার। প্রেমের (রোমান) দেবতা কিউপিডের ধনুকের তির যেন বিদ্ধ করছে হৃদয়, টানছে সাগরের জোয়ার, জ্বালিয়ে দিচ্ছে প্রেমিকের হৃদয়, তাকে ছেড়ে যে দূরে চলে গেছে।

এ কথা শুনে চন্দ্রগুপ্ত একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন, গোপন করতে গিয়েও চেপে রাখতে পারলেন না। ব্যাপারটা ভদ্রবাহুর দৃষ্টি এড়াল না। কিন্তু তিনি এ ব্যাপারে কিছুই বললেন না, বললেন, দেখো, কত বিশাল আর গৌরবদীপ্ত এ চাঁদ। অন্তর আর আত্মাকে ভালোবেসে সারা আকাশের কপালজুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে বিশ্বময়।

সে কি বিভ্রান্ত, আচার্য?

নাহ্, সে তার সীমারেখা জানে।

কেন সে জাগায় জোয়ার, কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন চন্দ্রগুপ্ত। দূরে তাকালেন, আকাশের দিগন্তসীমায় শুধু সিন্ধু নদীটাই চোখে পড়ে। ধবল জ্যোৎস্নায় নদীর বহতা দেখা যায়। এ রাতে হয়তো তারও ভাঙছে হৃদয়। নিভৃতে-নিঃশব্দে-নীরবে। আর কেন মানুষের মৃত্যু, আচার্য? হঠাৎ করেই কথাটা বলে ফেললেন চন্দ্রগুপ্ত।

এ কথা বলছ কেন, চন্দ্ৰ?

আমি হাজার হাজার চিতার আগুন দেখেছি, আচার্য। সে আলোয় বীভৎসতা। নিশ্বাসে বিষ। প্রেতপুরী যেন। সংঘাত। আর সাংঘাতিক লাগছে সবকিছু। স্নিগ্ধতা, সৌন্দর্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। জ্যোৎস্নাও যেন তার আলোয় পোড়াচ্ছে ভুবন। ক্ষমা করবেন, আচার্য, শান্তিটা সত্যিই কি হারিয়ে গেছে?

ক্ষত্রিয়কুলে জন্ম তোমার। জন্মদাতাকে স্বীকার না করলেও এ সত্য মুছে যাওয়ার নয়, যুদ্ধই তোমার ধর্ম এবং যুদ্ধই তোমার নিয়তি।

আপনি এ কথা বলছেন?

শান্ত হও, ভেবে দেখো। রাজা, মহারাজা, সম্রাটের কাছে যুদ্ধ, হত্যা, ধ্বংস এক অনিবার্য সত্য। তার ভেতর থেকে বের হতে হবে। তোমার কাঙ্ক্ষিত অর্জন এ যুদ্ধজয়েই সম্ভব।

যুদ্ধ জয় করে ভূমির মতো মানুষের দখল আমি চাই না, আচার্য। যা আমি জয় করতে চাই, তা আর সম্ভব নয়।

তুমি কল্পসূত্রের স্বপ্ন পর্যায়ের দুগ্ধসাগরও নিশ্চয়ই দেখেছ। চন্দ্রালোক তার ওপর আলোকধারা বইয়ে দিয়েছে। জোয়ারে জল স্ফীত হচ্ছে সে আকর্ষণে আন্দোলিত অতি উচ্চ ঢেউ। ঝটিকা যেন উন্মত্ত নর্তনের সৃষ্টি করেছে। বেলাভূমিতে আছড়ে পড়ছে নিষ্ফল আক্রোশে। উদ্দাম অস্থির। দলে দলে ছুটছে তরঙ্গ, ঠিক সেনাবাহিনীর মতো। মাথায় শুভ্র ফেনা। ফেনা সত্য নয়, ঢেউও সত্য নয়, নিমেশে নিঃশেষ হয়ে যায়। কিন্তু বার্তাটা রেখে যায়, একদিন ঢেউ জেগেছিল, জোয়ার এসেছিল।

প্রাপ্তি কি শুধুই হাহাকার?

তা হবে কেন?

এ যুদ্ধে জয়ী হব, আচার্য। কিন্তু তার শেষ কোথায়?

সবকিছুর শেষ আছে আগে অথবা পরে। তোমাদের আরও কিছুকাল ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হবে। সামনে কিছু সমস্যা আছে।

সমস্যা? কী সমস্যা, আচার্য?

দুর্যোগ, মানবসৃষ্ট দুর্যোগ।

যুদ্ধও তো তাই।

হ্যাঁ, যুদ্ধ মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। তবে এ দুর্যোগ তোমাদের জন্য সমস্যা নয়, মঙ্গল বয়ে আনবে। তাহলে সমস্যা কোথায়?

ধৈর্যের কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে তোমাকে। সাবধান থেকো। আমি পাটালিপুত্রে যাচ্ছি না, তোমার সঙ্গেই থাকব।

যুদ্ধ খবু প্রলম্বিত হবে, আপনিই বলেছিলেন।

অবস্থা তো সে রকমই। যুদ্ধজয়ে আগের মতোই মহামন্ত্রী চাণক্যের ওপর নির্ভর করো। তিনি একজন রণকৌশলী।

কূটকৌশলীও, আচার্য। আমার দুশ্চিন্তা সেখানেই।

কাটাবৃক্ষ ফল ভালো দেয়, তার ছায়ায়ও কোনো যন্ত্ৰণা নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *