৪০
কর্নেলিয়ার হাতে চন্দ্রগুপ্তের পত্র। তাতে লেখা আছে :
রাজকুমারী,
আমার শুভেচ্ছা নেবেন। যুদ্ধক্ষেত্রে আপনার প্রতীক্ষায় ছিলাম। পুরো থর মরুভূমিতে আপনার খোঁজ পাওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু আমাকে খুঁজে পাওয়া সহজ ছিল। আমি আপনাকে অভ্যর্থনা জানাতাম। কেউ আপনার বিরুদ্ধে তরবারি ওঠাত না। কারণ, আপনার ঘোষিত যুদ্ধটা ছিল আমার বিরুদ্ধে। প্রথম পর্যায়ের যুদ্ধ শেষ হয়েছে, আপনি সম্ভবত তার ফলাফল জানতে পেরেছেন। পাশাপাশি গ্রিক বাহিনীর অবস্থানও আপনার জানার কথা। যুদ্ধ আমাদের শেষ হয় নি। এ যুদ্ধের মাঠেই নিশ্চয় আপনার সাক্ষাৎ মিলবে।
আপনার হৃদয় সাধারণ প্রজাদের মঙ্গলচিন্তায় ভরপুর, তা না হলে আর্টেমিসের কাছে গিয়ে তাদের পরিত্রাণ চাইতেন না। আমার আজ মনে হচ্ছে সম্রাট না হয়ে তার প্রজা হলে আপনার সহানুভূতি পেতাম এবং ডায়নোসাসের ট্র্যাজিক ভাগ্য বরণ করতে হতো না। জানেন, ভাগ্য আমাকে মায়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করেছে। সে এক নিষ্ঠুর পরিহাস। তবু আমি নারীর প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা হারাই নি। আপনি রাক্ষসপত্নী সর্বাণীর রাজকীয় মর্যাদা চেয়েছেন, এমনিতেও তাঁর প্রতি অসম্মান করা হতো না, আপনি বলায় তাঁকে যথাযোগ্য মর্যাদায় গৃহে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তিনি রাজবন্দী, তাই এর বেশি কিছু করা সম্ভব নয়।
যুদ্ধের যে পরিণাম এবং যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা কাঙ্ক্ষিত ছিল না। এখন আমার মানবমৃত্যুর যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা আর ভালো লাগছে না, তাকেও ভাগ্যের নির্মম পরিহাস মনে হচ্ছে। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। কঠিন হলেও যুদ্ধটা শেষ করতে হবে।
পুনশ্চ : আপনার প্রতীক্ষায় রইলাম।
ইতি
চন্দ্ৰগুপ্ত
চিঠিটা কয়েকবার পাঠ করলেন কর্নেলিয়া। অন্তর স্পর্শ করা চিঠি। মায়ের বঞ্চনাটা কী, এটা মনে হতেই হু হু করে উঠল তাঁর হৃদয়। নিজেকেও সমব্যথী মনে হলো। তাঁকে আঘাত করা বোধ হয় ঠিক হয় নি। যে মানুষ নারীকে সম্মান আর শ্রদ্ধা করে, তাঁকে তুচ্ছ জ্ঞান করা অন্যায়। কর্নেলিয়ার মনে হলো তাঁর ক্ষমা চাওয়া উচিত। ভাবলেন, পত্রে নয়, সাক্ষাৎ করেই ক্ষমা চাইবেন। নিকোমেডেসকে ডাকলেন। বললেন, দ্রুত তৈরি হয়ে নে, সিন্ধু ভ্যালিতে যাব।
যুদ্ধক্ষেত্রে! অবাক হয়ে বলল নিকোমেডেস। বোধ হয় মজা করছিস।
না, মজা করছি না। চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হবে।
কী বলছিস তুই? তিরের আঘাতে মরতে চাস? পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে চাস?
নিকো, তুই না বলেছিলি চন্দ্রগুপ্তের মুখোমুখি করাবি আমাকে।
বলেছিলাম তো মজা করার জন্য। কর্নি, একদম পাগলামি করবিনে। তুই মজা করাও বুঝতে পারিস না।
তুই ভয় পেলে যাসনে। এসব রাস্তাঘাট-জনপদ আমার ঢের চেনা। দিমিত্রি, তুমি তৈরি হয়ে নাও। অন্য সহচরীদেরও বলো। আর একটি চতুরাশ্বযান তৈরি করতে বলো।
নিকোমেডেস কর্নেলিয়াকে না থামাতে পেরে লাউডিসকে নিয়ে এল। লাউডিস অনুনয়ের স্বরে বললেন, পাগলামি করিসনে বোন আমার। আমি তোকে হারাতে চাই না। চন্দ্রগুপ্তের লোকজন তোকে চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে যুদ্ধ করতেই দেবে না। তার আগেই মেরে ফেলবে। প্রথম পরাজয়ের পর সেলুসিড শিবিরের কী অবস্থা, আমরা জানি না। যেতে চাইলে আরও খোঁজখবর নিয়ে যাওয়া উচিত।
আমাদের লোকজন তো সেখানে আছে, সবাই মারা যায় নি। এত ভয় পাচ্ছিস কেন? আমার যাওয়ার ব্যবস্থায় সহায়তা কর।
লাউডিস বললেন, ঠিক আছে। আসলে ঠিক নেই, তিনি গেলেন দিদাইমেইয়ার কাছে। দিদাইমেইয়া প্রার্থনায় বসেছিলেন। সেলুকাস ও সেলুসিড সাম্রাজ্যের জন্য আরাধনায় চোখ বন্ধ করে আছেন। লাউডিস তাঁর ধ্যান ভাঙতে চাইলেন না। তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে রইলেন।
চোখ খোলার পর দিদাইমেইয়া জিজ্ঞেস করলেন, লাউডিস, কিছু বলবি?
লাউডিস কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন, পিসি, কর্নেলিয়া যুদ্ধের ময়দানে চলে যাচ্ছে।
তুই কাঁদছিস কেন? যেতে চায় যাক।
কী বলছ তুমি?
আচ্ছা চল, আমার সঙ্গে আয়। দিদাইমেইয়া কর্নেলিয়ার কক্ষে এসে দেখলেন, কর্নেলিয়ার প্রস্তুতি প্রায় শেষ। কর্নেলিয়া বললেন, পিসি, তুমি কি আমাকে যেতে বারণ করতে এসেছ?
না, আমি তোকে যেতে সাহায্য করতে এসেছি।
নিকোমেডেস অবাক হয়ে বলল, কী বলছ মা, ঠিক বলছ তো?
হ্যাঁ, আমি ঠিক বলছি। এ সময় ওর বাবার কাছে তার থাকা উচিত। সেলুকাস নিশ্চয়ই বেদনাহত। কন্যাকে পাশে পেলে দুঃখটা লাঘব হবে। শক্তি ফিরে পাবে।
সে (কর্নি) তো, মা, চন্দ্রগুপ্তের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাচ্ছে।
দিদাইমেইয়া হেসে দিয়ে বললেন, তোরাও যা, সে বলল আর তোরা বিশ্বাস করলি? আমি চাই, নিকো, তুই ওর সঙ্গে যা। ভালো একটা জার্নি হবে। শরীর সমর্থন করলে আমিও যেতাম। তোদের মতো তো এ বয়সে দৌড়াতে পারি না, চন্দ্রগুপ্তের সৈন্যরা আমাকে ধরে ফেলবে। ওদের হাতে আমি মরতে চাই না, বলে সৌম্য হাসি হাসলেন তিনি।
কর্নেলিয়া পিসির গলা জড়িয়ে ধরে বললেন, পিসি, শুধু তুমিই আমাকে ভালো বোঝো। আমার মায়ের অভাব পূরণ করেছ তুমি, আমাকে সাহস জুগিয়েছ।
কর্নির এসব পাগলামির জন্য, মা, তুমিই দায়ী।
তুই কি আমাকে বকাঝকা করবি, না ওর সঙ্গে যাবি?
যাচ্ছি মা।
কর্নেলিয়া নিকোমেডেসের দিকে তাকিয়ে রহস্যের হাসি হাসলেন।
লাউডিস একটু আবেগপ্রবণ, তাই চোখের জল মুছতে মুছতে কর্নেলিয়াকে বিদায় দিলেন। আর দিদাইমেইয়া হাসলেন তাঁদের বিদায় বেলায়। বললেন, অ্যাপোলো সহায় হোক।
নিকোমেডেস বলল, আমাকে তুই ঠিকই বহির্গার্ড বানালি।
কর্নেলিয়া এ কথার কোনো জবাব না দিয়ে শুধু হাসলেন এবং পিসিকে জড়িয়ে ধরে হেঁটে গিয়ে চতুরশ্বযানে উঠলেন। নিকোমেডেস তাঁকে অনুসরণ করল। সহচরীরা বসল যানের পেছনে কয়েকজন অশ্বারোহী রক্ষী তাঁদের নিরাপত্তার জন্য সঙ্গে সঙ্গে গেল।