২৮
লাউডিস আর কর্নেলিয়া কথা বলছেন।
অ্যাপোলো মন্দিরে চন্দ্রগুপ্তের জন্য আশীর্বাদ চেয়েছিস?
তার জন্য আশীর্বাদ চাইব ডায়নোসাসের কাছে।
কেন?
পাগলামির দেবতার কাছেই তার জন্য কিছু চাওয়া উচিত। তার জন্য ডায়নোসাসের মতো দুর্ভাগ্যজনক ট্র্যাজেডি অপেক্ষা করছে। যুদ্ধে সে গ্রিকদের কাছেই হারবে।
গ্রিক ট্র্যাজেডির বৈশিষ্ট্য তো জানা, পরাজিত হবে কিন্তু ভেঙে পড়বে না। তার জয়টা হবে মানসিক। ভালোবাসায়ও তার জয় অনিবার্য।
কীভাবে?
মনে কর, তিনি পরাজিত হয়ে ধরা পড়লেন গ্রিকদের হাতে। তাকে বন্দী করে নিয়ে আসা হলো সম্রাটের সামনে। সম্রাট তার মৃত্যুদণ্ড দিলেন। তুই সেখানে উপস্থিত আছিস। তুই কি করবি? খুশি হবি?
অবশ্যই।
আমার হিসাব বলছে, না, তুই খুশি হবি না। তক্ষুণি সম্রাটকে বলবি, বাবা, মৃত্যুদণ্ড নয়, তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিন। কষ্ট ভোগ করে যেন তার মৃত্যু হয়।
এটা দিদি তোর কল্পনা, হেসে দিয়ে বললেন কর্নেলিয়া।
আমার কথা শেষ হয় নি। তোর অনুনয়ে সম্রাট তার মৃত্যুদণ্ড ক্ষমা করে রজ্জীবন কারাবাসের জন্য আদেশ দেবেন। তখন তুই অন্ধকার কারাগারে প্রবেশ করবি। সম্রাটের অবস্থা দেখে তোর খুব দুঃখ হবে, কিন্তু তা প্রকাশ না করে শক্ত চোখে তাকাবি এবং বলবি, বিশ্বাসঘাতকদের এমনই অবস্থা হয়। ফিরে এসে কারারক্ষীদের বলবি, এ বন্দী ভারতবর্ষের সম্রাট। তার যাতে কোনো অসুবিধা না হয় এবং সম্রাটের উপযোগী খাবার যেন পাঠানো হয়।
গল্প তো তুই ভালোই বানাস, দিদি।
আরও আছে।
বল শুনি, শুনতে ভালোই লাগছে।
একদিন তুই নিজেই সহচরীর হাতে করে সম্রাটের জন্য খাবার নিয়ে কারাগারে যাবি। তোর সান্ত্বনা তখন কোথায়, জানিস? সান্ত্বনা এই যে সম্রাট সম্রাজ্ঞী থেকে বিচ্ছিন্ন আছেন এবং একান্তভাবে তোর দখলে আছেন। ছেড়েও দিবি না পাছে হাতছাড়া হয়। মৃত্যুদণ্ড তো নয়ই, বলে খুব হাসলেন লাউডিস।
হারমিজ বলল, মা, তোমরা হাসছ কেন?
তোর মা হাসছে চন্দ্রগুপ্তের মৃত্যুদণ্ড হচ্ছে না বলে। আচ্ছা দিদি, তুই পুরুষ দেবতার নামে মেয়ের নাম রাখলি কেন?
সম্ভব হলে আমার নামটাও অ্যাপোলো রাখতাম। পুরুষ-মেয়েদের নামে পার্থক্য থাকবে কেন? কে করেছে এ পার্থক্য?
যে-ই করুক, বুঝেশুনে করেছে, সে ঈশ্বরও হতে পারে। তবে কাজটা ভালো করে নি এ্যাই, তুই প্রসঙ্গ পাল্টাবি না।
দেখ দিদি, ওটা একটা প্রাচীন অধ্যায়। এ নিয়ে কথা বলা আর প্রাসঙ্গিক নয়।
অন্তর থেকে বলছিস?
হ্যাঁ, বিশ্বাস হচ্ছে না?
না।
কেন?
তুই চন্দ্রগুপ্তকে ভুলে থাকতে পারবি না।
সমবেদনা জানিয়ে পত্র লিখেছি বলে?
তুই এ পত্রের উত্তরও পাবি।
সহচরী দিমিত্রি তখনই চন্দ্রগুপ্তের পত্র নিয়ে উপস্থিত হলো। লাউডিস জানতে চাইলেন, এটা কী? দিমিত্রি স্মিত হেসে পত্রটি কর্নেলিয়ার হাতে দিয়ে বিদায় হয়ে গেল। লাউডিস বললেন, আমিও যাই?
কর্নেলিয়া দ্রুত চিঠির ওপর চোখ বুলিয়ে গেলেন। চন্দ্রগুপ্ত শোক ও সমবেদনা জানানোয় রাজকুমারীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। আর লিখেছেন, শীঘ্রই রাজকুমারীর সঙ্গে তাঁর দেখা হবে। ট্রয়ের হেলেনের মতোই যুদ্ধ জয় করে তাঁকে নিয়ে যাবেন।
চিঠির ওপর থেকে চোখ তুলে কর্নেলিয়া লাউডিসের দিকে তাকিয়ে বললেন, যুদ্ধ করে হেলেনের মতো উদ্ধার করে নাকি নিয়ে যাবেন আমাকে।
আমি বলেছিলাম না, তোর জন্য চন্দ্রগুপ্ত যুদ্ধ করতে প্রস্তুত আছেন।
আমিও ভাবছি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব।
সে যুদ্ধ দেখার জন্য অপেক্ষা করব আমি। লাউডিসের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আর্কিমেডেস উপস্থিত হলেন। সেনা পোশাকেই এসেছেন।
ভালোই হলো, লাউডিসকেও পেয়ে গেলাম। এই যে হারমিজ, আঙ্কেলকে একটি গান শোনাবে না?
হারমিজ সরাসরি বলল, না।
কেন?
তুমি এই পোশাক পরে এসেছ কেন?
সে কথা? ঠিক আছে।
তুমি একটু অভিনয় দেখতে পারো।
বেশ, তাই দেখাও।
হারমিজ একটু অভিনয় করে দেখিয়ে দিল। সবাই হাসি দিয়ে হাততালি দিল তাকে উৎসাহিত করার জন্য।
শুনলাম তুমি তরবারি চালনা শিখছ, যুদ্ধ করবে নাকি?
আর্কিমেডেসের প্রশ্নের জবাবে কর্নেলিয়া বললেন, তরবারি চালনা শেখা হয় যুদ্ধ করার জন্যই, জাদু দেখানোর জন্য নয়।
ভালো তরবারি চালনার জন্য জাদুর ছোঁয়া থাকতে হয়। জাদুর সঙ্গে তরবারি চালনার যোগসূত্র আছে।
তোমার সঙ্গেই আমার প্রথম তরবারি যুদ্ধ হবে।
বেশ তো আমি প্রস্তুত আছি।
লাউডিস বললেন, আরে তোমরা, এখনই না, রাজকুমারী, যুদ্ধ হলে মাঠে হবে, এখানে নয়। আর আর্কিমেডেসকে বলি, কোনো সৈনিক ইউনিফর্ম পরে নাই, এমন কারও সঙ্গে যুদ্ধ করে না।
বেশ তো, আমি ইউনিফর্ম পরেই তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করব, বলে হাসল কর্নেলিয়া।
তুমি কাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, মৌর্য না এন্টিগোনাস?
হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?
আমি তাহলে ঠিক করব কার বিরুদ্ধে আমার যুদ্ধ করা উচিত।
কমান্ডার যার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বলবেন, তার বিরুদ্ধেই লড়তে হবে। এখানে নিজের ইচ্ছার কোনো দাম নেই। তোমার পরিণাম আমাকে দেখতে হবে।
তুমি আমার শত্রুপক্ষ হলেই ভালো হতো। যুদ্ধক্ষেত্রে আমরা মুখোমুখি হতাম।
এ্যাই, তোদের কী হয়েছে, একে অন্যকে শত্রুপক্ষে ঠেলে দিচ্ছিস কেন?
শোন দিদি, তোর স্বামীর বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করার ইচ্ছা আমার।
না বোন, তুই এ রকম ইচ্ছা করিস নে। তুই যা চেয়েছিলি, আর্কিমেডেসের বিরুদ্ধেই লড়ে যা।
তুই তাহলে স্বীকার করছিস তোর বোন যে কাউকে হারিয়ে দিতে পারে।
আরে, সে জন্য নয়, আমি তখন অনেক বিপদে পড়ে যাব, তুই না সে, কাকে সমর্থন দেব?
মাম্মি, আমি কিন্তু বাবার পক্ষে থাকব, বলল হারমিজ।
হারমিজ খুব বুদ্ধিমতী, সে ঠিক কথা বলেছে, বললেন আর্কিমেডেস।
এবারে তোরা একটু সিরিয়াস কথা বল। আমি আসি তাহলে?
না, লাউডিস, তুমি যাবে না। তুমি থাকবে। কর্নেলিয়া, তুমি জানো যুদ্ধ অত্যাসন্ন। যুদ্ধ কার ভাগ্যে কী লেপন করে দেয়, জানি না। তাই আজ তোমার মুখ থেকে কিছু একটা শুনতে চাই।
ঝিলাম নদীর ওপর নৌযানে তোমাকে কী বলেছিলাম তোমার মনে আছে, আৰ্কিমেডেস? সে অবস্থান থেকে আমার সরে আসার কোনো সুযোগ নেই। এখন মনোযোগ দিয়ে ভূমি যুদ্ধ করতে যাও, আর নিজের দিকে সব সময় খেয়াল রেখো।
লাউডিস, তুমি কিছু বলবে না?
দেখো আর্কিমেডেস, তোমরা দুজনই যথেষ্ট পরিণত, তোমরা তোমাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য যথেষ্ট। আমি সে কথাই বলব, রাগ, অনুরাগ, অভিমান কিংবা জেদ এখন আর মানায় না। দুজনই চিন্তা করো, ভাবো কী তোমাদের করা উচিত। আমি তোমাদের সঠিক সিদ্ধান্তের পক্ষে আছি। তবে সিদ্ধান্তটা তোমাদের নিজেদেরই নিতে হবে এবং তা উভয়ের সম্মতির মধ্য দিয়ে।
আমার এ যুদ্ধটাই শেষ যুদ্ধ কি না, জানি না, হতাশভাবে বললেন আৰ্কিমেডেস।
লাউডিস তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, তুমি সেনা অফিসার, তোমাকে কি হতাশা মানায়? কর্নেলিয়াকেও বলি, এ ব্যাপারে চিন্তা করে সিদ্ধান্ত জানাও।
আমি চিন্তা করেছি, দিদি, ওকে জানিয়েও দিয়েছি। আমার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত।
তারপরও আমি অপেক্ষা করব, কর্নেলিয়া, বলে বের হয়ে গেলেন প্রিন্স আর্কিমেডেস।
চন্দ্রগুপ্তের ব্যাপারেও তোকে আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনে, কর্নেলিয়া।
আমি কোনো গ্রিককে বিয়ে করব না।
তাহলে চন্দ্রগুপ্ত?
বিয়ে করতেই হবে, এমন তো কথা নেই।
গ্রিকদের তুই যতই ঘৃণা করিস, তোর পরিচয় গ্রিকই। সবাই তো আর এন্টিওকাস নয়! যারা এন্টিওকাস, তাদের সবাই পরিত্যাগ করে, তাদের বোন থাকে না, ভাই থাকে না, বাবা-মা থাকে না। আমি এন্টিওকাসকে পরিত্যাগ করেছি একই কারণে, কথাগুলো বলে গেলেন লাউডিস।
লাউডিস চলে যাওয়ার পর কর্নেলিয়া চন্দ্রগুপ্তের পত্রটি আবার পড়লেন। তখন চোখ বোলানোর সময় মনে হয় নি, এখন মনে হলো পত্রে একটি আবেগের প্রবাহ আছে, যা হৃদয় ছুঁয়ে যায়। একজন সম্রাট তাঁর রোগাক্রান্ত প্রজাদের দুঃখে মুহ্যমান এবং সে কথা তাঁর প্রিয়জনকে বলছেন, এ রকমটি শুধু একজন হৃদয়বান সম্রাটের বেলায়ই ঘটে। কর্নেলিয়া নিজেই বলেছিলেন হেলেনের মতো তাঁকে উদ্ধার করে নিতে। হয়তো মজা করে বলেছেন, সম্রাট একে সিরিয়াসলি নিয়েছেন। তাঁর দোষ কোথায়? সম্রাটের কোনো সম্রাজ্ঞী নেই, সে কথা তো সম্রাট বলেন নি। কেন তাঁকে দোষারোপ করা, এসব ভেবে কর্নেলিয়া নিজেই আবেগাক্রান্ত হয়ে গেলেন।
মনে হয় কাঁদলেন।