২৫
কর্নেলিয়া নিজেকে এখন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন। সম্রাটের সঙ্গে যোগাযোগকে তাঁর ভুল বলে মনে করছেন। এন্টিগোনাসের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধপ্রস্তুতি বা প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, সেদিকে তিনি মনোযোগ দিয়ে সম্রাটের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইলেন।
সম্রাট বললেন, ঘরের শত্রুদের আগে দমন করা দরকার, তোর এ যুক্তি ঠিক আছে। কিন্তু আমাদের শক্তি ক্ষয় করে ফেললে মৌর্যদের মোকাবিলা করব কী করে?
মৌর্যদের আক্রমণের কালে এন্টিগোনাসরা আক্রমণ করলে তখন তো কোনো উপায় থাকবে না।
তোর এ কথায়ও যুক্তি আছে। আমরা সে জন্য উভয়ের ক্ষেত্রেই ডিফেন্সিভ থাকতে চাই।
আমি এবার তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধে যাব।
বেশ তো, আর্কিমেডেসকে বলি তোকে প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলুক।
তোমার কাউকে বলার দরকার নেই, আমিই তরবারি চালনা শিখে নেব।
নানার কাছ থেকে কর্নেলিয়াকে নিয়ে আসার জন্য হারমিজকে পাঠালেন লাউডিস। তখন প্রবীণ এক জেনারেল সেলুকাসকে বললেন, একটা ভালো সংবাদ আছে, মহামান্য সম্রাট।
কী সংবাদ, প্রশ্ন করলেন সেলুকাস।
কর্নেলিয়া উৎকর্ণ হয়ে তাকালেন জেনারেলের দিকে।
মৌর্য সম্রাটের নবজাতকটি মারা গেছে, তাই সাম্রাজ্যজুড়ে শোক পালন করা হচ্ছে।
এটা ভালো সংবাদ হয় কী করে? প্রায় রুক্ষ কণ্ঠে জেনারেলের উদ্দেশে বললেন কর্নেলিয়া।
শত্রুর দুর্বল দিকগুলো আমাদের জন্য খুশির বার্তা আনে। জেনারেলের কথার জবাবে কর্নেলিয়া বললেন, এটা কাপুরুষতা। অমানবিক, বলেই তিনি হারমিজকে নিয়ে চলে এলেন।
লাউডিস কর্নেলিয়ার রুক্ষ মেজাজ লক্ষ করে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। পরে বললেন, একটা খারাপ খবর আছে, কর্নেলিয়া।
কী খবর?
চন্দ্রগুপ্তের সন্তানটা মারা গেছে। তাদের শোক পালন চলছে সমস্ত সাম্রাজ্যজুড়ে।
একই সংবাদ দুভাবে শুনলেন কর্নেলিয়া। শেষের সংবাদটি কোথায় যেন স্পর্শ করে গেল তাঁকে।
লাউডিস বললেন, আমার খুব খারাপ লাগছে, কর্নেলিয়া।
কবুতরের খাঁচাটার দিকে দৃষ্টি গেল কর্নেলিয়ার। কবুতরটা তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। কেমন যেন অসহায় সে সোনার খাঁচায়। চোখ দুটো লাল।
তুই একটা শোকবার্তা পাঠা।
একদিন আগে রাগে-ক্ষোভে অভিনন্দনবার্তা আর উপহার পাঠিয়েছিলেন কর্নেলিয়া। সে জন্য এখন তাঁর খুব খারাপ লাগছে। তবু বললেন, কেন দিদি, কী লাভ?
লাভ-ক্ষতির হিসাব করে কেউ কাউকে ভালোবাসে না। এ ছাড়া ওর সঙ্গে তোর পরিচয় আছে। নিজের জীবন নিয়ে কী করবি তুই, সে সিদ্ধান্ত তোর একার। মানবিক দিকগুলো ধরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমার। যা, দেরি করিসনে। সম্ভব হলে আমি বলতাম সশরীরে গিয়ে শোক জানিয়ে আসতে।
তুই আমাকে দুর্বল করে দিচ্ছিস, দিদি।
আমি না বললে তুই চুপ করে থাকতিস? আমি তা মনে করি না, তুই এতটা নির্বোধ নস।
কর্নেলিয়া কবুতরটা খাঁচা থেকে বের করে গণ্ডদেশে স্পর্শ করলেন। মাথায় একটা চুম্বন দিয়ে কাঁদলেন।
আন্টি, তুমি কাঁদছ কেন? কান্নার কারণ জানে না হারমিজ।
কবুতরের জন্য কাঁদছে সে। কবুতরটাকে ছেড়ে দেবে তো, তাই, বললেন লাউডিস।
কবুতরটা খাঁচায় রেখে কর্নেলিয়া তিন বাক্যের একটি শোকবার্তা লিখলেন।
চন্দ্ৰগুপ্ত,
অকালে সন্তান বিয়োগের ঘটনায় আমি শোকগ্রস্ত ও মর্মাহত। আশা করি এ শোক অচিরেই আপনি কাটিয়ে উঠতে পারবেন। সম্রাজ্ঞীকে সমবেদনা জানাই।
ইতি
প্রিন্সেস।
কবুতরের মাধ্যমে পত্রটি পাঠিয়ে নিজেকে হালকা মনে হলো তাঁর। লাউডিস বললেন, দেখ, কঠিন কিন্তু সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে হয় সংকটের সময়ে। তোর আজকের সিদ্ধান্তকে আমি সাধুবাদ জানাই। তোর হিতাহিত জ্ঞান লোপ পায় নি। এখন বিশ্রাম নে। পরে আবার আমি আসব।
না, দিদি, যাসনে। তুই একটু বোস। কী হবে বল তো, আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
কেন মজাই তো হবে। তোর একজন সতিন থাকবে ভারতীয়। সম্রাটদের অনেক স্ত্রী থাকে। দাসীও থাকে। তুইও থাকবি। মজাই হবে। সম্রাট কি সে রকম শৌখিন?
তোকে এ জন্য বসতে বলেছি? আমার জীবনটা একাই কাটিয়ে দেব, দিদি, এ আমার দৃঢ় সংকল্প।
সেসব ভাববার সময় এখনো আসে নি। একটু সহ্য কর। আরও ভাব, গভীরভাবে ভাব। এ নিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলার দরকার নেই।
তোমরা কী বলো, আমি তো কিছুই বুঝি না, বলল হারমিজ। কবুতরটি ছেড়ে দিলে কেন?
লাউডিস বললেন, কবুতরটি একজন রাজাকে নিয়ে আসবে তোর খালামণির জন্য।
ধ্যাৎ, কবুতর মানুষ আনবে কেমন করে? মিথ্যে বলছ। শুনে ওঁরা দুজন হাসলেন।
.
চাণক্য গভীর চিন্তামগ্ন। সম্রাট এখনো স্বাভাবিক হচ্ছেন না। শোকগ্রস্ত সম্রাজ্ঞীর কাছে থেকে নিজেও শোক পালন করছেন।
চাণক্যের সামনে বরাহ মিহির দাঁড়িয়ে। চাণক্য এতটা নিমগ্ন যে তা টের পান নি। হঠাৎ করে বরাহ মিহিরের দিকে তাকিয়ে প্রথমে বিরক্ত হলেন। বাইরের দ্বারবান বা প্রহরীদের বলেছিলেন সম্রাট আর ভদ্রবাহু ছাড়া কাউকে যেন ভেতরে প্রবেশ করতে না দেওয়া হয়। আবার মানুষটির দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলেন, তুমি কে?
আমাকে চিনতে পারছেন না, মহামন্ত্রী? আমি বরাহ মিহির।
তাই তো দেখছি। তুমি না মরে গেছ।
ভুল শুনেছেন। আমি জীবিত আছি। দেহান্তর ঘটেছে বটে। দেহান্তর ঘটলে মানুষের মৃত্যু হয় না। জৈনশাস্ত্র সে কথাই বলে।
চাণক্য প্রথমে ভাবলেন কুহেলিকা। চোখ মুছলেন। দেখলেন বরাহ মিহির দাঁড়িয়ে আছে। সাহস করে বললেন, মিহির, কী জন্য এসেছ, বলো।
আপনি কাজটা ঠিক করেন নি, মহামন্ত্রী।
কী কাজ?
আপনি ভদ্রবাহুর সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন।
ভদ্রবাহুর সঙ্গে আমার সম্পর্ক আগে যা ছিল, এখনো তা-ই আছে, হাত মেলালাম কোথায়?
রাক্ষসের মতো ভদ্রবাহুকেও আপনাকে হত্যা করতে হবে।
তাঁর দোষ কী? তিনি তো মৌর্য সাম্রাজ্য আক্রমণ করেন নি। মিহির, তুমি অন্য কিছু বলো।
তাঁর জন্য আমার মৃত্যু হয়েছে। হত্যার জন্য শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হলে সম্রাট মৃত্যুদণ্ড দেন, আমি না। তুমি সম্রাটের কাছে যাও। যাও ভায়া, যাও।
তিনি তো শোক করছেন। রাজকাজ করছেন না। দেখুন, আপনাকেই মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে।
বিরক্ত করো না তো, যাও। তুমি গিয়ে হত্যার প্রতিশোধ নাও।
আপনাকেও দেখে নেব আমি। বলে পলকের মধ্যে উধাও হয়ে গেল বরাহ মিহিরের দুষ্টু আত্মা।
চাণক্য ঘাম ছেড়ে বাঁচলেন। কিন্তু ব্যাপারটাকে সহজ মনে করলেন না। তাঁকে ভদ্রবাহুর কাছে যেতে হবে। কিন্তু ভদ্রবাহু এখনো নগর জৈন মঠেই থাকছেন, প্রাসাদে আসছেন না।
শোকের মধ্যেও মন্দাকিনী বার্তাবাহক কবুতরের আগমনের প্রতি লক্ষ রাখছিল। দূতদের অভিনন্দনবার্তা ও উপহারসামগ্রী আসার আগেই কবুতর শোকবার্তা নিয়ে পৌঁছে গেছে। বার্তাটি নিজের কাছে রেখে মন্দাকিনী কয়েকবারই চেষ্টা করল সম্রাটের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। অবশ্য পত্রের ভেতরে কী আছে, সে তা জানে না। সে সম্রাটের অনুমতি পেলেই শুধু পত্র খুলতে ও পড়তে পারে। তাই তারও উৎকণ্ঠা কম নয়।
অবশেষে তার চেষ্টা সফল হলো। সম্রাট শোকবার্তা পাঠ করে নিজের মধ্যে পরিবর্তন উপলব্ধি করলেন। মন্দাকিনীকে বললেন, তুমি এখন যাও, আমি উত্তর লিখে তোমাকে সংবাদ দেব।
কিছুক্ষণ পর দুরধরা এলেন সম্রাটের কাছে। বললেন, আর কত দিন, সম্রাট। এবার রাষ্ট্রীয় কাজে মনোযোগ দিন। দ্বারে শত্রু গ্রিকরা, আপনার উচিত হবে প্রতিরক্ষাব্যবস্থার খোঁজখবর নেওয়া। রাজকুমারের ভাগ্যে যা ছিল, তা-ই হয়েছে।
কী করে ভুলি, সম্রাজ্ঞী? প্রথম সন্তান আমাদের। ভবিষ্যৎ সম্রাট। ভেবেছিলাম, একসময় সাম্রাজ্যভার তার হাতে দিয়ে অবসর নেব। ভাগ্য সে সুখ কেড়ে নিল।
সম্রাজ্ঞীকে মানসিকভাবে শক্ত হতে দেখে সম্রাট কিছুটা স্বস্তি পেলেন। আজ থেকেই রাজকর্ম শুরু করবেন বলে স্থির করলেন। মহামন্ত্রী চাণক্য ও সভাসদদের ডাকালেন। সাম্রাজ্যের হালনাগাদ খোঁজখবর নিলেন।
সম্রাট রাজকর্মে ফিরেছেন, তাতে সমগ্র সাম্রাজ্যে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এল। নতুনভাবে যুদ্ধপ্রস্তুতি নিল সেনাবাহিনী।
চাণক্য তাঁর গোয়েন্দাদের ডাকলেন। জীবসিদ্ধি মানসিক সমস্যায় পর্যুদস্ত। চাণক্য বললেন, তুমি বিশ্রাম নাও। নির্জলাকে বললেন, আমার কাছে সংবাদ আছে, রাক্ষসপত্নী সর্বাণী গ্রিকদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছে, তুমি তার পিছু নেবে। সিদ্ধার্থককে উদ্দেশ করে বললেন, তুমি আমাদের সঙ্গে এসেছ রাক্ষসের দল ত্যাগ করে। আমাদের দল পরিত্যাগ করলে তার পরিণাম হবে ভয়াবহ। নিশ্চয়ই তুমি বুঝতে পেরেছ।
সিদ্ধার্থক শুধু মাথা নুইয়ে রাখল।
তিনজনকে আলাদা আলাদাভাবে কাজ বুঝিয়ে দিলেন চাণক্য। পোশাক ও চরিত্র কী ধরনের হবে, তা-ও বললেন।
ওরা চলে গেলে চাণক্য তাঁর শিষ্য সুবন্ধুকে ডেকে পাঠালেন। সুবন্ধু সব কাজে পারদর্শী। তিনি তাকে গড়ে তুলছেন ভবিষ্যতে মন্ত্রী বানানোর জন্য। তবে তাকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ থেকে দূরে রাখেন। চাণক্যের প্রায় সব নীতিকথা সুবন্ধুর পেটে আছে। তারপরও চাণক্য প্রতিবারই তাকে নীতিকথা বলতে ভোলেন না।
সুবন্ধু এসে বলল, আমাকে ডেকেছেন, আচার্য?
কী করছিলে তুমি?
একটা হিসাব কিছুতেই মেলাতে পারছিলাম না।
একদিন তোমাকে কী বলেছিলাম, নিজের দুর্বলতা ও গোপনীয় বিষয় কাউকে জানাবে না,
তোমার বিরুদ্ধে তা ব্যবহৃত হতে পারে।
তা জানি, আপনাকে গোপনীয় কথা বলতে তো কোনো বাধা দেখছি না, আচাৰ্য।
ভুল বললে, পৃথিবীতে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের প্রতিদ্বন্দ্বী, সুযোগের অপেক্ষামাত্র, তার আগে একজন অপরজনের বন্ধু। আচ্ছা, যা-ই হোক, তুমি এখন আচার্য ভদ্রবাহুর কাছে যাবে, তাঁকে মঠে পাওয়া গেলে বলবে আমি আসছি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। তুমিও থাকবে।
সুবন্ধু চলে গেলে চাণক্য একা হয়ে পড়লেন। তাঁর ভেতর ভয়ের উদয় হলো, আবার যদি বরাহ মিহির আবির্ভূত হয়। এ সময় নির্জলা এসে উপস্থিত হলো। চাণক্য প্রথমে প্রায় ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। পরে বললেন, তুমি আবার কেন?
দেবী সর্বাণীর কথা আপনাকে কে বলেছেন, মহামন্ত্ৰী?
কেন, পাওয়া তথ্যে কি ভুল আছে?
তা নেই। মলয়কেতুর সেনাপ্রধান তার সঙ্গে যোগ দিয়েছেন, সে কথা কি আপনি জানেন?
কে বলল?
আমি এখানেই শুনলাম। ব্যাপারটা বিশ্বাস হলো এ জন্য যে উচ্চাভিলাষী সেনাপ্রধান আপনার কাছে রাজা হতে সহায়তা চেয়েছিলেন।
আমার মনে আছে।
রাক্ষস ও মলয়কেতুর সৈন্যরা গ্রিকদের পক্ষে কাজ করবে।
এসব তথ্য তুমি এখনই জানলে কী করে?
আমি আগে থেকেই জানি, মহামন্ত্ৰী।
তখন বলো নি কেন?
ওরা উপস্থিত ছিল।
তোমার পূর্ব জানা তথ্য বলছে, আমি তোমাকে ঠিক জায়গায় নিয়োগ করেছি। আরেকটি ব্যাপার, তুমি নদীর ওপারে গেলে রাজকুমারীর তথ্যও সংগ্রহ করে আনবে।