২৪
জন্মোৎসবের অষ্টম দিন আজ। সকাল থেকেই নানা আয়োজন। মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন এই অষ্টম দিবসেই। ব্যাপক আয়োজন শোভাযাত্রার। শোভাযাত্রায় অনেকেই অংশ নিয়েছেন। সম্রাট আছেন, তাঁর পারিষদেরা আছেন। শুধু ভদ্রবাহু ও চাণক্য নেই। ভদ্ৰবাহু কেন নেই, তা আগেই বলা হয়েছে। চাণক্য থাকবেন না, তাঁর শরীরে তাপ বেড়েছে। তাই শোভাযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রয়েছেন বরাহ মিহির। সম্রাটের ডান পাশে তাঁর অবস্থান। সম্রাটকে বললেন, সম্রাজ্ঞী এক ক্ষণজন্মা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। কুন্তি যেমন যুধিষ্ঠিরকে জন্ম দিয়েছেন, রুদ্রের (শিব) স্ত্রী পার্বতী যেমন মহাসেনাকে (কার্তিক) জন্ম দিয়েছেন, দুরধরা তেমনি জন্ম দিয়েছেন সম্রাটতনয়কে। দেখুন সম্রাট, দেখুন, কান পেতে শুনুন, এই যে ঢোলকধ্বনি, তা স্বর্গ থেকে আসছে, এই যে নৃত্য, তাতে স্বর্গের দেবীরা অংশ নিয়েছেন, বিদ্যাধরের সব অতিথি নেমে এসেছেন নৃত্য করতে। এই যে পুষ্পবৃষ্টি হচ্ছে, তা হচ্ছে স্বর্গ থেকে। মর্ত থেকে তা গ্রহণ করছে মর্তমানবীরা। ওই দেখুন, স্বর্গীয় পুষ্পঘ্রাণে ভ্রমররা গুঞ্জন তুলেছে। বাতাস বইছে, সুবাতাস। রৌদ্রকরোজ্জ্বল সকালবেলায় দেবতারা যেন সূর্যের মতো হাসছেন।
জৈনধর্মের অনুসারী সম্রাট দেব-দেবীদের বিশ্বাস পেছনে ফেলে এসেছেন। তবু আজ মিহিরের কথা অমৃতের মতো শোনাচ্ছে তাঁর কাছে।
হঠাৎ করেই মিহির বললেন, দেখুন, এ রকম দিনেও ভদ্রবাহু নেই শোভাযাত্রায়। তিনি কি দেবতাদেরও ছাড়িয়ে গেছেন? মহামন্ত্রী নেই, তার যৌক্তিক কারণ আছে।
তিনি (মহামন্ত্রী) না এলেও শোভাযাত্রার সব দিক, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা ভালোভাবে দেখছেন, বললেন সম্রাট।
রাজপথে স্থানে স্থানে নৃত্যগীত হচ্ছে। সংগীতে সম্রাটের প্রশস্তি এবং নবাগত শিশুর কল্যাণ ধ্বনিত হচ্ছে।
আনন্দের মধ্যেও সম্রাটের ভেতর একটি ক্ষোভ দুঃখ আকারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাহলে কার সেবা করেছেন তিনি এতকাল। আধ্যাত্মিক গুরু কি তাহলে মৌর্যদের মঙ্গল চান না?
এ রকম সময়ে অশ্বযানে চড়ে চাণক্য ছুটে এলেন শোভাযাত্রার সামনে। সম্রাটের কানে কানে কী যেন বললেন। সম্রাট হস্তীপৃষ্ঠ থেকে একরকম লাফিয়ে অশ্বযানে চড়লেন। মহামন্ত্রী চাণক্য শোভাযাত্রাকারীদের উদ্দেশে বললেন, অনিবার্য কারণে শোভাযাত্রা এখানেই শেষ করতে হচ্ছে, সম্রাটের এই নির্দেশ।
চতুর্শ্বযান দ্রুত ছুটছে সম্রাটের প্রাসাদের দিকে। পথ যেন শেষ হচ্ছে না। সম্রাট জিজ্ঞেস করলেন, কী করে ঘটল এই দুর্ঘটনা?
আমি জানি না, সম্রাট।
এদিকে বরাহ মিহির শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের বললেন, কেউ যাবে না। কী হয়েছে, সংবাদ না শুনে শোভাযাত্রা ভঙ্গ হবে না। আমরা দাঁড়িয়ে থাকব। শোভাযাত্রাকারীরা আনন্দ করতে এসেছে। তাই মিহিরের কথা শুনে অপেক্ষা করতে থাকল।
সম্রাট প্রাসাদে প্রবেশ করেই দ্রুত চলে গেলেন সম্রাজ্ঞীর কক্ষে। সম্রাজ্ঞী কেঁদে কেঁদে ক্লান্ত। তাঁর সহচরী, দাস-দাসী—সবাই কাঁদছে। তাদের সামনে রক্তাক্ত শিশুর মৃতদেহ।
কীভাবে ঘটল এ দুর্ঘটনা?
রাজবৈদ্য বললেন, রাজকুমারকে নিরাপত্তার জন্য যে গোপন কক্ষে রাখা হয়েছিল, তার দরজা খুলে পড়ে যায় শিশুর ওপর।
আচার্য, চলুন তো দেখি।
গোপন কক্ষটি এমনিতে বেশ মজবুত। এখানে নাশকতার কোনো সুযোগ নেই। সম্রাট স্বয়ং দরজার খিলি প্রভৃতি পরীক্ষা করে দেখলেন। চাণক্য ততক্ষণে খুলে পড়া দরজাটি দেখছেন। এক জায়গায় এসে তাঁর চোখ স্থির হয়ে গেল। এখানে বিড়ালের একটি ছাপচিত্র স্পষ্টভাবে মুদ্রিত হয়ে আছে। লেগে আছে শিশু রাজকুমারের মস্তকের রক্ত।
মহামান্য সম্রাট, দেখুন, শিশুর মাথায় বিড়ালের ছাপ।
সম্রাট এ চিত্র দেখে একেবারে পাথর হয়ে গেলেন।
চাণক্য সম্রাটকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, যুবরাজের এ হচ্ছে নিয়তি সম্রাট, যা পূর্বনির্ধারিত, ভাগ্যের অমোঘ বিধানকে কেউ খণ্ডন করতে পারে না।
শোভাযাত্রার জন্মোৎসব শোকের মিছিলে পরিণত হলো। মিহির পালিয়ে গেলেন। রংবেরঙের পতাকা গুটিয়ে ফেলল ধ্বজাধারীগণ, ঢোলকের কাঠি চামড়ার ভেতর ঢোকানো হলো। অতি শোকাতুর উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ শোভন পোশাকেই মাটিতে গড়াগড়ি খেলেন। শোভাযাত্রাটা ছত্রভঙ্গ হয়ে বিষাদের বিধ্বস্ত রণক্ষেত্রের রূপ পেল। দিগ্বিদিক ছুটে গেল সবাই পদদলনে পিষ্ট হলো মিহির-কথিত স্বর্গীয় ফুল, শিরস্ত্রাণ ও অঙ্গভূষণ।
সম্রাট সম্রাজ্ঞীর কাছে গেলেন। কী সান্ত্বনা দেবেন তাঁকে। ভাষা কোথায়? শুধু সম্রাজ্ঞীর হাত ধরে বসে আছেন তাঁর শয্যাপাশে।
সংবাদটা ভদ্রবাহুর কাছেও গেছে। তিনি ছুটে এলেন সম্রাটের প্রাসাদে।
আচার্য, শোক জানাতে এলেন। রাজকুমারকে কি রক্ষা করা যেত না? সম্রাট খুব ভেঙে পড়েছেন।
এটা কৰ্মফল চন্দ্ৰ, যা ভোগ করতেই হয়। চেষ্টা করেও ঠেকানো যায় না। আমি কম চেষ্টা করি নি।
তা আমি জানি, আচার্য, কিন্তু একি হয়ে গেল।
ধৈর্য ধারণ করো চন্দ্র, ধৈর্যই তোমার শোক-তাপকে ভুলতে সাহায্য করবে।
আপনি তো ঠিক বলেছিলেন, মিহির ভুল বলে আশার ছলনায় ভুলিয়ে দিয়েছিল। তার কথায় চল্লিশ দিনের উৎসব, মঙ্গল শোভাযাত্রা। কী হলো এখন!
ভুল তো মানুষই করে, চন্দ্র।
এটা অনেক বড় ভুল, আচার্য, আমাকে ক্ষমা করুন। আমি আপনাকে ভুল বুঝেছিলাম। ভুল বুঝিয়েছিল আমাকে। হায় রে ভাগ্য!
শান্ত হোন সম্রাট, ভাগ্যকে কেউ অতিক্রম করতে পারে না। সবই নিয়তি, বললেন চাণক্য। অদ্ভুত ব্যাপার, আচার্য, আমার হস্তীপদপিষ্টে বিড়ালটির যে অবস্থা হয়েছিল, আমার রাজকুমারও সে অবস্থা প্রাপ্ত হয়েছে। এই কষ্ট আমি কী করে ভুলব? ভাগ্যই আমার এই দুর্দশার কারণ। কাকে বলব এ ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য?
কর্মের মাধ্যমে সব পরিবর্তন করা সম্ভব, চন্দ্র। জগৎ পরিবর্তনশীল। ভাগ্যেও পরিবর্তন আসে, বললেন ভদ্রবাহু। অবসর্পিণীর অবসান একদিন ঘটবেই, আসবে উৎসর্পিণী। যোগ করলেন তিনি।
.
মৌর্য রাজধানী পাটালিপুত্র থেকে পালানোর সময় অসাবধানতাবশত বরাহ মিহির দুর্ঘটনায় কবলিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তাঁর অতৃপ্ত আত্মা আবার পাটালিপুত্রে ফিরে আসে। ভদ্রবাহুর দুজন শিষ্য জৈন মঠের বাইরে এক কুটিরে বসে ছিল। সে কুটিরে প্রবেশ করে মিহিরের আত্মা। তাদের বলে, আমি রাজকুমার। আমাকে প্রণাম করো, নইলে গর্দান নেব।
শিষ্য দুজন ভয় পেয়ে কাঁপতে থাকে, পরে মূর্ছা যায়। এরা ভদ্রবহুকে ঘটনা জানায়। এ রকম ঘটনার কথা আরও কেউ কেউ বলেছে। সবচেয়ে লোমহর্ষ কথা বলে চাণক্যের গুপ্তচর জীবসিদ্ধি। সে দেখতে পায়, রাক্ষস তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলছে, তুই একটা বিশ্বাসঘাতক, আমার মতো তোর মাথাও থাকবে না। জীবসিদ্ধি দেখতে পায়, রাক্ষসের মাথা নেই, ধর থেকে রক্ত ঝরছে।
উৎপাতে জৈনদের একেবারে অতিষ্ঠ করে তুলছে বরাহ মিহিরের দুষ্টু আত্মা। পাটালিপুত্রে তার একচ্ছত্র আধিপত্য।
জীবসিদ্ধি ঘটনাটা চাণক্যকে অবহিত করে। চাণক্য বললেন, তুমি ভালো করে ঘুমাও। তুমি মনে হয় অনিদ্রা করেছ। ঘুম না হলে এ রকম বিভ্রান্তিকর দৃশ্য দেখে।
রাত্রে চাণক্য ভদ্রবাহুর সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেন। ভদ্রবাহু বলেন, পৃথিবীতে এমন অনেক কিছু ঘটে, যা আমরা জানি না। আত্মা অমর। বরাহ মিহিরের অতৃপ্ত আত্মা যেকোনো রূপ ধারণ করতে পারে।
তারপরও চাণক্য কথাটা বিশ্বাস করেন নি। চাণক্যের ধর্মশাস্ত্রে এ রকম আত্মার আবির্ভাব অসিদ্ধ।
চন্দ্রগুপ্তের কাছে তাঁর আধ্যাত্মিক গুরুর গুরুত্ব অনেক পরিমাণে বেড়ে গেছে। চন্দ্রগুপ্ত এখন ভদ্রবাহুর সব বাণীকেই ধ্রুব বলে জ্ঞান করেন। পুত্র মারা যাওয়ার পর বেশির ভাগ সময়ই সম্রাজ্ঞী আর ভদ্রবাহুর সঙ্গে কাটান। তাতে সম্রাটের বহু কাজ অসম্পন্ন থেকে যাচ্ছে। চাণক্য শুধু জরুরি কাজগুলো সম্পাদন করেন। কাজকর্মের বিষয়গুলোর প্রতি বেশ কয়েকবার সম্রাটের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গিয়ে ব্যর্থ হন চাণক্য। এবারে ভদ্রবাহুর শরণাপন্ন হন।
ভদ্রবাহু বললেন, সে কথা? আচার্য, আপনি ভাববেন না, আমি তাঁকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে বলব।
যুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দিতে হবে।
নিশ্চয়।