মৌর্য – ১৬

১৬

রাক্ষসের স্ত্রী সর্বাণী মানসিক অস্থিরতায় আছেন। তিনি রক্ষসের একটি মূল্যবান জিনিস হারিয়ে ফেলেছেন। পলাতক অবস্থায় এঁরা এক জায়গায় থাকতে পারবেন না। চাণক্যের লোকজন তাঁর পেছনে লেগেই আছে। মূল্যবান জিনিসটি অনেক জায়গায় খোঁজ করেছেন, সম্ভাব্য স্থানসমূহে নিজস্ব লোক পাঠিয়েছেন। কোনো লাভ হয় নি। তাঁর সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোক চন্দন দাস। অলংকার নির্মাতা ও ব্যবসায়ী সর্বাণীর যত অলংকার আছে, রানিরও তত নেই। এ জন্য চন্দন দাস তাঁকে পছন্দ করে, চন্দন দাসকে মন্ত্রীপত্নীর খুব পছন্দ।

চন্দন, এখন কী করি। মন্ত্রী যেকোনো সময় মুদ্রাসিল চাইতে পারেন। তুমি কি একটা বানিয়ে দেবে?

না দেখে কী করে বানাব, মা ঠাকরুন?

তা-ও কথা।

মা ঠাকরুন, আমাকে চাণক্যের লোকজন খুঁজছে।

তুমি আমাদের সঙ্গে থেকে যাও।

তাদের আশ্রয়ে থাকা আর সঙ্গে থাকা ভিন্ন জিনিস। যেকোনো সময় তাদের হাতে ধরা পড়ার সম্ভাবনা। তাই চন্দন দাস বুদ্ধি খাটিয়ে বলল, মা ঠাকরুন, আমি আপনাদের সঙ্গে তো আছিই। জিনিসটা খুঁজে বের করার জন্য বাইরে যেতে হচ্ছে।

তা যাও। সাবধানে থেকো। জিনিসটা পেলে দ্রুত পৌঁছে দেবে। আর শত্রুপক্ষের লোকজন যেন কোনো অবস্থাতেই না জানতে পারে। মুদ্রাসিল লোক মারফত ততক্ষণে পৌঁছে গেছে মহামন্ত্রী চাণক্যের কাছে। চাণক্য চোখের সামনে নিয়ে অঙ্গুরিযুক্ত সিলটা ভালোভাবে নেড়েচেড়ে দেখলেন। মৃদু হাসলেন। ভাবলেন, অস্ত্রটা ব্যবহার করতে হবে। মারাত্মক অস্ত্র। পত্রলেখককে ডাকালেন তিনি। বললেন, লেখো।

মহামান্য রাজা মলয়কেতু,

পদ্মভূষণ, সুচরিতেষু,

আপনার মৌর্যদের পক্ষ ত্যাগ করার পর মহামন্ত্রী চাণক্য আপনাকে হত্যা করার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছেন। আমি তাদের লক্ষ্য পূর্ব থেকেই। আমি ভয় পাই না তাদের। মৌর্যদের আমি সমূলে উৎখাত করবই। পালানোরও পথ পাবে না এরা। স্মরণ করা যায় আপনার সঙ্গে এরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। বিশ্বাসঘাতকদের সঙ্গে কাজ করা খুবই বিপজ্জনক। আপনার পিতা ও পিতৃব্যকে হত্যা করে এরা আমার বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ প্রচার করেছে।

কিন্তু দুর্ভাগ্য যেন আমাদের ছাড়ছেই না। আমার কাছে খবর আছে, আপনি পাঁচ রাজ্যের জোট থেকে আমাকে, অর্থাৎ নন্দরাজ্যকে বাদ দিতে চাচ্ছেন। বিশ্বাসঘাতকদের আমি ঘৃণা করি। যুদ্ধে জিতে মৌর্য সাম্রাজ্য ভাগাভাগি করবেন নিজেদের মধ্যে, এ আশা কতটা দুরাশা, আমি তা বলতে চাই না। আজ থেকে আমি একাই লড়ে যাব। আপনি হয়তো ভুলে গেছেন রাক্ষস কোনো শক্তির পরোয়া করে না। আপনি ছাড়া জোটের অন্য রাজাদের সঙ্গে আলোচনা করে আমি আমার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ঠিক করব।

ইতি
মহামন্ত্রী রাক্ষস

চাণক্য মুদ্রাসিলটা পত্রে নিজেই লাগিয়ে দিয়ে নির্জলাকে ডেকে বললেন, তুমি নিজে এটি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করো। আর ভাগুর কোথায়? ডাকো ওকে।

ভাগুর উপস্থিত হলো।

তুমি আজকেই শক্তদাসকে হত্যা করবে। যেন ভুল না হয়। আর যুদ্ধমান দেশগুলোয় তোমাদের গতিবিধি, তৎপরতা বাড়াও। চন্দন দাস কোথায় আছে, খুঁজে বের করো।

অতঃপর চাণক্য সম্রাটের ছাউনিতে গেলেন। সম্রাটকে রাক্ষসের মুদ্রাসিল দেখিয়ে বললেন, আমাদের গোয়েন্দারা সংগ্রহ করেছে, মহামান্য সম্রাট, আপনার কাছে রাখুন।

সম্রাট হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলেন। পরে বললেন, এটি রাক্ষসকে ফেরত দিন। রাক্ষসের সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই। তাকে বোধ হয় জোর করে দমানো যাবে না।

তার সঙ্গে কী সন্ধি করব আমরা, সম্রাট, তা মোটেও ঠিক হবে না।

যুদ্ধ তো আর দীর্ঘায়িত করা যায় না, আচার্য।

আশা করি যুদ্ধ সহসাই শেষ হবে।

বেশ তো, তাই করুন।

গ্রিক রাজকুমারীর চিঠি এসেছে। মন্দাকিনী এ চিঠি নিয়ে অপেক্ষা করছে। এদিকে সম্রাট পত্রের জন্য কবুতরের পথ চেয়ে আছেন। তিনি অবশ্য মন্দাকিনীকে বলে যাননি যে পত্র যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়ে দিতে হবে।

এ নিয়ে বেশ অস্থিরতায় আছেন সম্রাট। মন্দাকিনী অনেকবার ভেবেছে, পত্রটা খুলে পাঠ করবে কি না? সে বিশ্বাস ভঙ্গ করতে চায় না। সম্রাট নিজে পত্রটি খুলে দেখবেন, অনুভব করবেন, না পড়তে পারলেও চোখ বুলোবেন, অতঃপর তাকে পাঠ করতে দেবেন। এটা একটা হৃদয় দিয়ে দেখার সংস্কৃতি, তাতে মন্দাকিনী হস্তক্ষেপ করতে চায় না। সে বুদ্ধিমতী। একবার চেয়েছিল কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিতে। কিন্তু কাকে দিয়ে পাঠাবে? সবাই ভাববে, মন্দাকিনী সম্রাটকে পত্র লেখে। রানি জানতে পারলে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারবেন। সে ভাবে, জগতে ছোট হয়ে জন্মানোর ঝামেলাই বেশি।

ওদিকে পত্রের উত্তরের প্রতীক্ষায় আছেন গ্রিক রাজকুমারী। প্রায়ই কবুতরের শূন্য খাঁচাটার দিকে তাকিয়ে থাকেন। খাঁচাটা স্বর্ণনির্মিত। তিনি নির্মাণ করিয়েছেন। খাঁচাটা মুহূর্তের মধ্যে প্রতীকী রূপ লাভ করে। মনে হয়, রাজকুমারী শূন্য খাঁচাটার মতোই পড়ে আছেন, তাঁর আত্মাটা কবুতরের সঙ্গে উড়ে চলে গেছে অন্য কারও কাছে।

এসব যখন ভাবছিলেন, সহচরী দিমিত্রি এসে বললেন, প্রিন্সেস, প্রিন্স আর্কিেেডস আসছেন মর্মে দূত এসেছে।

কবে আসবে?

দূতকে ডাকি?

ডাকো।

আর্কিমেডেস রাজকুমারীর ফার্স্ট কাজিন। ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে বড় হয়েছেন। খুবই বন্ধুত্ব, আর্কিমেডেসের কাছে বোধ হয় তার চেয়েও বেশি কিছু। দুজনের মধ্যে বেশ ঝগড়া-টগড়া হয়। আর্কিমেডেস তাই রাজকুমারীকে ইরিস বলে ডাকেন। ইরিস হচ্ছেন ঝগড়া বা বিরোধের দেবী। রাজকুমারীর দুই ভ্রাতা এবং দুই ভগ্নি রয়েছেন। এঁরা তাঁর বৈমাত্রেয় ভাইবোন। এক ভাইয়ের নাম এন্টিওকাস এবং এক বোনের নাম লাউডিস বলে জানা যায়। এঁরা সম্রাজ্ঞী আপামার সন্তান।

দূত বলল, প্রিন্স আসছেন আরাচোশিয়া থেকে। তাই পরদিনই পৌঁছার কথা। রাজকুমারীর তাতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হলো। প্রথম মনে হলো, কাউকে এখন যেন সহ্য করা তাঁর পক্ষে কঠিন হবে। সবাই তাঁর প্রাণবন্ত রূপ দেখে অভ্যস্ত। এখন তিরবিদ্ধ অবস্থা। প্রিন্স কীভাবে নেবেন অবস্থাটাকে। নিলেই-বা কী। ব্যক্তিগত ব্যাপারে তিনি এখন কাউকে হস্তক্ষেপ করতে দিতে চান না। আবার প্রিন্সের আগমনে মানসিক প্রশান্তিও ফিরে আসতে পারে। সত্যিই কি অন্তর বিদ্ধ করা তিরটা প্রিন্স উপড়ে ফেলতে পারবেন?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *