মৌনী মহেশ্বর
এক
তিনদিন হয়ে গেল বড়মামার সঙ্গে কোনও কথাই বলা যাচ্ছে না। না, তিনি ব্যস্ত নন, তিনি মৌনী হয়ে আছেন। হিমালয় থেকে বরফের মতো এক সাধু মহারাজ এসেছিলেন সেদিন। আসা মাত্রই বড়মামা তাঁকে চিনতে পেরেছিলেন, কারণ গত এক বছর ধরে তিনি বড়মামার শেষ রাতের স্বপ্নে আসা-যাওয়া করছিলেন। সে-কথা বড়মামা আমাদের বলতেন। সেই স্বপ্নের মহারাজ রোজই আসতেন এক-একরকম জিনিস হাতে।
প্রথম দিন এসেছিলেন হাতে একটা বিরাট বড় গ্যাস বেলুন নিয়ে। সুতোটা ডান হাতের আঙুলে জড়ানো, বেলুনটা কাঁধের পাশ দিয়ে মাথার পেছন দিকে উড়ছে। টকটকে গেরুয়া রঙের একটা বেলুন। চা খেতে-খেতে চায়ের টেবিলে সংবাদটি তিনি আমাদের ভেঙেছিলেন, অবশ্য যথেষ্ট ভূমিকার পর। ভালো স্বপ্ন, দিব্য স্বপ্ন কারওকে বলতে নেই। অ্যাকসান নষ্ট হয়ে যায়।
মেজোমামা কায়দা করে ক্রিমক্যাকার বিস্কুট খাচ্ছিলেন। কায়দাটা মাসিমার শেখানো। কায়দাটা শেখার আগে সারা টেবিলে গুঁড়ো ছড়িয়ে বিশ্রী একটা ব্যাপার করে ফেলতেন। আর নিত্য মাসিমার কাছে বকুনি। ইঁদুরের মতো না খেয়ে মানুষের মতো খেতে শেখো না। এতবড় একজন অধ্যাপক, সভ্যসমাজে মেলামেশা করো, অথচ ইউ ক্যান নট ট্যাক্টফুলি ম্যানেজ এ সিম্পল ক্রিমক্যাকার বিস্কিট।
বড়মামা যেমন খুঁচিয়ে ঘা করা স্বভাব। সব ব্যাপারে কমেন্ট করা চাই-ই চাই। বড়মামা বলেছিলেন, ওটা সায়েবদের কাছে শিখতে হয় কুসি। বিস্কুট, কেক এসব সায়েবি জিনিস। কাকে কী বলছিস! তুই বরং ওর হাতে একটা ফুলঝাড়ু ধরিয়ে দে। বলে দে, খাওয়ার পর জায়গাটা সাফ-সুতরো করে দিয়ে যেতে, যাতে সভ্যমানুষরা এসে বসতে পারে!
কোনও ঝগড়া নেই, অশান্তি নেই, মেজোমামা নিঃশব্দে একটা বিস্কুট এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘যদি দয়া করে দেখিয়ে দেন, সভ্যমানুষের বিস্কুট খাওয়ার সভ্য কায়দা!’
বড়মামা বিস্কুটটা স্মার্টলি নিয়ে সামনের দাঁতে কটাস করে কামড়ালেন এবং ফল! অতি শোচনীয়। বলা চলে মিজারেবল। ক্রিমক্র্যাকার, পাঁপড়, নিমকি, খাস্তা-কচুরি, সোনপাঁপড়ি এসব জিনিস যে কী সাংঘাতিক, সে, যে জানে সে জানে। বড়মামার সামনে টেবল ক্লথের ওপর ছড়িয়ে পড়ল টুকরো-টাকরা। মেজোমামার চেয়ে অনেক বেশি নোংরা করে ফেললেন। সিদ্ধান্তে এলেন, ‘ভেজা দাঁতে খেলে তবেই হবে, অথবা বিস্কুটটাকে চায়ে ভিজিয়ে খেতে হবে।’
‘ভিজে দাঁতটা কি জিনিস! ভিজে বেড়াল শুনেছি!’ মেজোমামার প্রশ্ন।
বড়মামার সঙ্গে-সঙ্গে উত্তর, ‘একবার করে কুলকুচো একবার করে বিস্কুটে কামড়। খুব সোজা ব্যাপার। এক গেলাস জল নিয়ে বোসো, এক ঢোঁক জল, এক কামড় বিস্কুট, এক চুমুক চা, আবার এক ঢোঁক জল, এক কামড় বিস্কুট, এক চুমুক চা।’
‘তার মানে, ঠান্ডা গরম, গরম ঠান্ডা। এবং গো টু সিক বেড।’ মেজোমামা হাসতে-হাসতে বললেন।
মাসিমা বললেন, ‘দুটোরই মাথামোটা। কায়দাটা হল দাঁত তোলার সময় ডেন্টিস্টরা যে-কায়দায় চেয়ারে বসান, সেই কায়দায় মুখটা সিলিং-এর দিকে তুলে হাঁ করে বিস্কুটে কামড়, গুঁড়ো সব গলায়, এইবার ঘাড় সোজা করে চিবোও, এক ঢোঁক চা, আবার মুখ তোলো, ঘাড় হেলাও, মারো কামড়, ঢালো চা।’
দুই
মেজোমামা বার কয়েক অভ্যাস করে বললেন, ‘ওয়ান্ডারফুল! কী টেকনিক শেখালি কুসি। তোর শিবপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেনে চাকরি হওয়া উচিত! তোর এই কায়দা, ব্যায়াম কে ব্যায়াম, খাওয়া কে খাওয়া! টু ইন ওয়ান। স্পন্ডিলাইটিস ভালো হয়ে যাবে।’
তা সেই কায়দায় বিস্কুট ম্যানজ করে মেজোমামা স্বপ্নবৃত্তান্ত শুনে প্রশ্ন করছিলেন, ‘হাতে বেলুন কেন?’
উত্তরটা মাসিমা দিলেন, ‘বালককে বেলুনই উপহার দিতে হয়। বেলুন, বেলুন বাঁশি, সফটভলস।’
মেজোমামা জিগ্যেস করলেন, ‘দ্বিতীয় স্বপ্ন?’
বড়মামা বললেন, ‘একটা কোদাল কাঁধে এসে আমার চারপাশে ঘুরছেন, আর গাইছেন, ‘চল কোদাল চালাই ভুলে মানের বালাই।’
মাসিমা বললেন, ‘এর অর্থ হল। একটু উঠে হেঁটে খেটে খাও। দিন-দিন আয়েসি হয়ে পড়ছ। ধামার মতো ভুঁড়ি। নীচের দিকটা যেন আলুর বস্তা।’
মেজোমামা বললেন, ‘তৃতীয় স্বপ্ন?’
বড়মামা বললেন, ‘কোলে একটা বাচ্চা হনুমান। হনুমানটা দেখতে-দেখতে বিরাট একটা বীর হনুমান হয়ে গেল।’
মাসিমা বললেন, ‘ওটা তুমি। শৈশবেও হনুমান, এখনও হনুমান। হনুমানের ধারাবাহিকতা।’
মেজোমামা বললেন, ‘চতুর্থ স্বপ্ন?’
‘তিনি একটা ছবি দেখালেন, ছবিটা আমার। বেদীতে বসে আছি। হাজার-হাজার মানুষ আমাকে প্রণাম করছে। অর্থাৎ আমার ভবিষ্যৎ। সেই দলে তোরাও আছিস। কত বড় সৌভাগ্য যে আমি তোদের দাদা। গর্ব করে পরিচয় দিতে পারবি।’
সেই মহাপুরুষ হঠাৎ এসে হাজির। মেজোমামা দেখা মাত্রই ফিসফিস করে বললেন, ‘কুলফি মালাই।’
তাঁর শুনতে পাওয়ার কথা নয়, কী আশ্চর্য! মেজোমামার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘উপমাটা ঠিক হল না। কুলফিতে রং থাকে। বলো, আইসক্রিম।’
মেজোমামা ঘাবড়ে গেলেন।
মহাপুরুষ বললেন, ‘তুমি লোক ভালো, তবে একটু কৃপণ।’
‘আমার একটু কাজ আছে’ বলে মেজোমামা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
বড়মামা মৌনী। একটা কাগজে আমাকে লিখে জানালেন, ‘জীবনে আর কথা বলব না।’
তিন চার দিন পরে লিখলেন, ‘ভেতরে ভীষণ শক্তি জমছে।’
হঠাৎ দোতলায় ভীষণ শব্দ। দুমদাম। নীচের উঠোনে দাঁড়িয়ে মাসিমার চিৎকার, ‘আরে কে দরজা ভাঙছে।’ দোতলার বাথরুম থেকে বড়মামার গলা, ‘কোন মর্কট বাইরে থেকে দরজার ছিটকিনি আটকে দিয়েছে? কোন মর্কট!’
মেজোমামা নাচছেন আর গাইছেন, ‘দরজা নয়, দরজা নয়, মৌনী ভেঙেছে। হরি বোল হরি বোল শক্তি বেড়েছে।’