1 of 2

মোতিবিবির দরগা – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

মোতিবিবির দরগা – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

কী এক শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। যেন দরজা খোলার শব্দ। চোখ খুলে দেখি, ঘর অন্ধকার। একটু অবাক লাগল। আমার অভ্যাস জানালা খুলে রাখা। কেন জানালা বন্ধ করে শুয়েছি কয়েকমুহূর্ত ভেবেই পেলাম না। তারপর হঠাৎ মনে পড়ে গেল সব কথা। অমনি ওঠার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। শরীরে এতটুকু জোর নেই। মাথার ভেতরটা শূন্য লাগছে। তেষ্টাও পেয়েছে তাই ওঠা দরকার। মনে পড়ছে, কোনার দিকে কুঁজোয় জল রেখে গেছে দরবেশ সায়েব। বলে গেছে, অসুবিধা হলে ডাকবেন। পাশের ঘরেই আছি। কিন্তু ডাকতে গিয়ে টের পেলাম, গলায় আওয়াজ বেরুচ্ছে না।

কেন যে এই অলক্ষুণে বাসটায় চেপেছিলাম! অত ভিড়ের বাসে চাপার অভ্যাস নেই। পারি না। ইচ্ছে করলে বন্ধুর বাড়িতে রাতটা আরামে কাটিয়ে আসতে পারতাম। ভোরের বাসটা নাকি খালিই যায়। অথচ কী এক ভূতুড়ে জেদ আমাকে পেয়ে বসেছিল। সন্ধ্যার দিকে আগাপাছতলা লোকে ঠাসা বাসটা এসে দাঁড়াতেই নির্বোধের মতো গুঁতো মেরে ঢুকে গেলাম। পাদানিতে অনেকগুলো পায়ের ওপর পা রেখেছিলাম। ওরা আপত্তি করেছিল। বাসটা স্টার্ট দিয়ে খুব জোরে চলতে শুরু করল। প্রায় মাইলটাক ঝগড়াঝাঁটি চলতে থাকল গেঁয়ো লোকগুলোর সঙ্গে। তারপর কে যেন আমাকে হ্যাঁচকা টানে চলন্ত বাস থেকে টেনে নামাল। অর্থাৎ আমি ছিটকে পড়ে গেলাম। ভাগ্যিস পিচের ওপর পড়িনি। রাস্তার ধারে পুরু ঘাসের ওপর পড়ে সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম।

যখন জ্ঞান হল, টের পেয়েছিলাম সামনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে অদ্ভুত একচোখো একটা লণ্ঠন। লণ্ঠনটার আলোর রং নীল। এমন নীল কাতে ঢাকা বাতি নিয়ে মানুষ ঘোরাঘুরি করে, কস্মিনকালে দেখিনি। আলোর পেছনে আবছা দেখতে পাচ্ছিলাম লোকটাকে। দৈত্যের মতো প্রকাণ্ড। সে আলোটা আমার পাশে রেখে গম্ভীর গলায় বলেছিল—কে আপনি? এভাবে রাস্তার ধারে শুয়ে আছেন কেন? নেশা করেছিলেন বুঝি?

অত কষ্টের মধ্যে হাসি পেয়েছিল!—মাতাল নই। বাস থেকে পড়ে গেছি। তারপর কী হয়েছে, জানি না।

—সে কী! বলে লোকটা আমার পাশে ঝুঁকে এসেছিল। তারপর লণ্ঠনটা তুলে পা থেকে মাথা অবধি দেখে নিয়ে বলেছিল—জখম হয়নি তো?

—বুঝতে পারছি না। রক্তটক্ত দেখতে পেলেন কি?

—না। তবে হাড়ে আঘাত লাগতেও পারে। টের পাচ্ছেন না কিছু?

—কে জানে!

—ওঠার চেষ্টা করুন তাহলে। কাছেই আমার ডেরা।

এখন যেমন শরীরের অবস্থা তখনও ঠিক এমনি ছিল। লোকটা শেষে আমাকে দু—হাতে শূন্যে উঠিয়েছিল। তারপর ফের জ্ঞান হারিয়েছিলাম।

দ্বিতীয়বার জ্ঞান ফিরে দেখেছিলাম এই ঘরে শুয়ে আছি। খাটিয়ায় বিছানার ওপর। সেই নীল আলোর লণ্ঠনটা নেই। ঘরের মেঝেয় একটা হেরিকেন রয়েছে। আর আমার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আলখাল্লাধারী নীল লম্বাচওড়া এক দরবেশ। কালো আলখাল্লা। গলায় লাল—নীল পাথরের মালা। কাঁচাপাকা চুল ও দাড়ি। খাড়া নাক। লালচে টানাটানা চোখ। তার হাতে একটা গেলাস। আমাকে চোখ খুলতে দেখে বলেছিল—শরবতটা খেয়ে নিন। কই, হাঁ করুন। খাইয়ে দিচ্ছি।

একটু ঝাঁঝালো সুগন্ধ সেই শরবত কয়েক ঢোক গেলামাত্র আমার শরীরে যেন বিদ্যুতের খেলা শুরু হয়েছিল। ভয় পাওয়া গলায় বলেছিলাম—এ কীসের শরবত?

দরবেশ হেসেছিল—ভয় পাবেন না। বিষ নয়। খুব উপকারী দাওয়াই আছে ওতে। এক্ষুনি সুস্থ হয়ে উঠবেন।

একেবারে সুস্থ হতে না পারলেও উঠে বসার শক্তি ফিরে পেয়েছিলাম। তারপর ওঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথাবার্তা হয়েছিল। জানতে পেরেছিলাম, বিশাল মাঠের মধ্যে এক দিঘির ধারে নির্জন দরগায় আমি আশ্রয় পেয়েছি। এর নাম মোতিবিবির দরগা। এক তপস্বিনীর কবর আছে এখানে। তার ওপর একটা পাথরের ঘর আছে। সেই ঘরে দরবেশ থাকে। পিদিম জ্বালে। আগরবাতি পোড়ায়। সাধনা—টাধনা কী সব করে। এই ঘরটা পরে ইট দিয়ে বানানো হয়েছিল। ভক্ত বা দৈবাৎ বিপদে পড়ে কেউ এলে তাকে এ ঘরে থাকতে দেওয়া হয়।

কিছুক্ষণ পরে দরবেশ আমাকে খান দুই মোটা রুটি আর খানিকটা গুড় দিয়ে গিয়েছিল। বলেছিল—মেহেরবানী করে এই দিয়েই খিদে মিটিয়ে নিন। আমি ফকির। বুঝতেই পারছেন…

—এই যথেষ্ট। তবে খিদে আমার বিশেষ নেই। আপনি এগুলো…

দরবেশ আপত্তি করেছিল।—না, না। আপনার কিছু খাওয়া দরকার। খেলেই গায়ে জোর হবে। আল্লার দয়ায় আপনি বেঁচে গেছেন। ওভাবে চলন্ত বাস থেকে পড়লে মানুষ বাঁচে না। যদি বা বাঁচে, হাড়গোড় আস্ত থাকে না।

আমার হাড়গোড় আস্ত আছে, তা ঠিক। কিন্তু শরীর এত দুর্বল হয়ে গেছে কেন বুঝতে পারছি না। দরবেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখাতেই রুটির টুকরো ছিঁড়ে মুখে পুরেছিলাম।

ফের সেই শব্দটা হল।

খুব পুরোনো জংধরা লোহার কপাট খোলার মতো শব্দ। কিন্তু কিছুটা চাপা। ঘুরঘুট্টি অন্ধকার ঘর। অন্তত তেষ্টা মেটানোর জন্যে যথাশক্তি চেষ্টা করলাম উঠে বসতে। তারপর মনে পড়ল, পানজাবির পকেটে দেশলাই আর প্যাকেটটা আছে। সিগারেটও আছে। পানজাবিটা মাথার কাছে রেখেছিলাম। অতিকষ্টে হাত বাড়িয়ে দেশলাই আর প্যাকেটটা বের করলাম। দেশলাই জ্বেলে কুঁজোর কাছে গেলাম। মাথা ঘুরছে। প্রতিমুহূর্তে মনে হচ্ছে, আবার জ্ঞান হারাব। কুঁজোর মুখে গেলাস আছে। দেশলাই কাঠিটা নিভে গেল। আন্দাজ করে জল ঢেলে চোঁ—চোঁ করে গিলে ফেললাম। তারপর খাটিয়ায় ফিরে এসে সিগারেট ধরালাম।

তৃতীয়বার দরজা খোলার মতো বিশ্রী চাপা শব্দটা শোনা গেল। তারপর মনে হল, বাইরে এইমাত্র যেন ঝড় এসে পড়েছে। শন—শন শোঁ—শোঁ আওয়াজ বাড়তে থাকল। ছোট্ট দুটো জানালা আছে দুদিকে। একটা জানালা আচমকা খুলে গেল। ঘরে হু—হু করে ঢুকে পড়ল ঝড়টা। কষ্ট করে উঠতেই হল। জানালাটা বন্ধ করার জন্যে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলাম। কিছুক্ষণ চেষ্টার পর দেওয়াল ধরে উঠে দাঁড়ালে পারলাম। কিন্তু জানালাটা কিছুতেই আটকানো যাচ্ছে না। ঘরের ভেতর খড়কুটো ধুলোবালি ঢুকে পড়ছে ঝড়ের সঙ্গে। বাইরের ঘরে যেন কালো অন্ধকারে কী এক প্রাণী যেন হুলস্থূল বাধিয়েছে। তারপর বিদ্যুৎ ঝিলিক দিতে থাকল। বাজ পড়ল কাছাকাছি কোথাও। তখন ভাঙা গলায় ডাকার চেষ্টা করলাম—দরবেশ সায়েব। দরবেশ সায়েব!

কোনো সাড়া এল না। দরজা অনুমান করে পা বাড়ালাম। দরজাটা খুঁজে পাওয়ার পর যেই ছিটকিনি খুলতে গেছি, কানে এল চেরা গলায় সুর ধরে কেউ গান করছে বাইরে।

এই দুর্যোগের রাতে নির্জন দরগায় দরবেশের হঠাৎ গান করার ইচ্ছে কেন, জানি না। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে ঝড় যেন হাত বাড়িয়ে আমাকে টেনে নিল। বারান্দায় ছিটকে পড়লাম। দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে বললাম—আমার জ্ঞান হারালে চলবে না। মাথা ঠিক রাখতেই হবে।

বারান্দার সামনে বিদ্যুতের আলোয় ছোট্ট একটা উঠোন আর ইঁদারা চোখে পড়েছিল। দরবেশের ঘরের দিকে দেওয়াল ধরে এগোতে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়ল, বিদ্যুতের আলোয় মুহূর্তের জন্যে একটা সাদা ঝলসানো মূর্তি এবং মূর্তিটি স্ত্রীলোকের তাতে ভুল নেই—ইঁদারার ধারে দাঁড়িয়ে আছে।

সঙ্গে সঙ্গে ভয় পাওয়া গলায় চেঁচিয়ে উঠলাম—কে? কে ওখানে?

ফের বিদ্যুৎ ঝিলিক দিল। ফের দেখতে পেলাম মূর্তিটা। কিন্তু এবার সে ইঁদারার দিকে ঝুঁকে রয়েছে। ভূতে বিশ্বাস নেই। কিন্তু ভয়ংকর রাতে নির্জন দরগায় সেই বিশ্বাসের ভিত্তিটা নড়বড়ে হতে বাধ্য। ওদিকে সেই চেরা গলায় গানটা সমানে শোনা যাচ্ছে। আমি মরিয়া হয়ে ফের দরবেশকে ডাকলাম। তারপর দরবেশের ঘরের দরজায় জোরে ধাক্কা দিলাম।

দরজাটা খুলে গেল। ভেতরে পিদিম জ্বলছে কালো একটা বেদির শিয়রে। দরবেশ নেই। এ দিকটা ঝড়ের উলটোদিকে। তাই ঘরে ঝড়টা ঢুকছে না। ইঁদারার ধারে মেয়েটিকে ভূত ধরে নিয়েই আমি আক্রান্ত প্রাণীর মতো ঘরে ঢুকে পড়লাম এবং কাঁপতে কাঁপতে দরজা বন্ধ করে দিলাম।

হ্যাঁ, বেদিটাই কবর এবং সম্ভবত কষ্টিপাথরে তৈরি। ফার্সিতে কী সব লেখা আছে। কিন্তু পরক্ষণে চমকে উঠলাম। বেদির ওপাশে তিনটে মড়ার মাথার রয়েছে। আবছা আলোয় মাথাগুলো বিকট দেখাচ্ছে। আরও ভয় পেলাম।

এমন সময় বাইরে সেই গানটা থেমে গেল এবং মনে হল প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে।

বেদি থেকে একটু তফাতে কম্বলের আসন পাতা ছিল। সেখানে গিয়ে বসে পড়লাম। তারপর আশ্চর্য, বন্ধ করে রাখা দরজাটা হঠাৎ মচ মচ করে উঠল। তারপর খুলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বেদির পিদিমটা নিভে গেল।

দরজার সামনে সেই নীল একচোখা লণ্ঠন হাতে দরবেশ দাঁড়িয়ে আছে। সে আলোটা ঘরের ভেতর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিঃশব্দে কিছু দেখে নিল। তারপর বেদির দিকে ঘুরিয়ে রাখল।

দরবেশ আমাকে লক্ষও করল না। তার সিল্যুট মূর্তি ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এতক্ষণে তার মুখের দিকে তাকিয়ে দারুণ চমকে উঠলাম। এ কি কোনো জীবিত মানুষের মুখ হতে পারে? দৃষ্টি কেমন অদ্ভুত—নিষ্পলক, শূন্য। হাঁটু ভাঁজ করে পুতুলের মতো বসে পড়ল সে কবরের সামনে। তেমনি মৃতের চোখে তাকিয়ে বসে রইল। বাইরে বৃষ্টির শব্দ। ঝড়ের শব্দ। বজ্রপাতের ভয়ংকর শব্দ। মনে হচ্ছে, পৃথিবীর শেষ মুহূর্তটি আসন্ন। এদিকে বেদির মতো কবরের ওপর লম্বাটে নীল আলো থেকে ক্রমশ ধূপের ধোঁয়ার মতো ধূসর বা নীল কী আবছায়া ঘনিয়ে উঠেছে। তারপর নাকে তীব্র হয়ে ঝাপটা দিল একটা কড়া সুগন্ধ। সুগন্ধটা অসহ্য লাগছিল। চেতনা অবশ করে দিচ্ছিল।

তার আতঙ্কে কাঠ হয়ে দেখলাম, ইঁদারার ধারের সেই মেয়েটি যেন শূন্যে ভেসে এল এবং ধোঁয়ার মতো দরবেশকে ভেদ করে এগিয়ে বেদির ওপর স্থির হয়ে দাঁড়াল।

নীলাভ শরীর তার—হয়তো নীল আলোটাই এর কারণ হতে পারে। সে সুন্দর, না কুৎসিত, না সাধারণ—বুঝতে পারছি না। হয়তো সেই বোধও হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু সে একেবারে নগ্ন।

আমার তন্ময়তা ভেঙে গেল। দরবেশ ফের চেরা গলায় গান গেয়ে উঠল। কিন্তু এবার সুরটা অনেকটা মিঠে এবং চাপা। ঘুমঘুম আচ্ছন্নতায় দুর্বোধ্য কী এক গান গাইছে সে। সুরটাও অপরিচিত। একটু একঘেয়েও। কিছুক্ষণ পরে নগ্ন নারীমূর্তিটি বেদির ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ আমার দিকে তাকাল এবং তার চমকও টের পেলাম। সে অস্ফুটস্বরে একেবারে মানুষের গলায় আমার দিকে আঙুল তুলে বলে উঠল—ও কে?

সঙ্গে সঙ্গে দরবেশ ঘুরল আমার দিকে। প্রচণ্ড গর্জন করে বলল—বেরিয়ে যান। বেরিয়ে যান বলছি। কেন এ ঘরে ঢুকেছেন আপনি?

নীল আলোটাও নিভে গেল। ঘুরঘুট্টি অন্ধকার এখন। বাইরে ঝড়বৃষ্টি সমানে চলছে। অন্ধকারে একটা হাত এসে আমার কাঁধে খামচে ধরল। তারপর দরবেশ আমাকে টেনে ওঠাল এবং একটা থাপ্পড়ও মারল গালে।

ব্যাপারটা অপমানজনক। কিন্তু বাধা দেবার বা প্রতিবাদের ক্ষমতাও ছিল না এতটুকু। অসহায়ভাবে তার হ্যাঁচকা টানে কতকটা শূন্যে ভেসে চললাম। এই দৈত্যের কাছে আমি নেহাত বামন।

ভেবেছিলাম, আমাকে ঝড়বৃষ্টির মধ্যে বের করে দেবে। কিন্তু তেমন কিছু করল না। পাশের সেই ঘরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় ফেলে দিল। তারপর ধমক দিয়ে বলল—খবর্দার, আর বেরুবার চেষ্টা করবেন না। তাহলে আপনাকে বাঁচাতে পারব না। হুঁশিয়ার!

সে বাইরে থেকে দরজা আটকে দিল। আমি ভাবতে থাকলাম, ব্যাপারটা কি স্বপ্নে ঘটছে? নাকি সেই উগ্র আরক মেশানো শরবতের নেশায় যত সব উদ্ভট কাণ্ড দেখতে পাচ্ছি।

কিন্তু না তো! আমি সজ্ঞান পুরোপুরি—যদিও শরীরে প্রচণ্ড দুর্বলতার দরুন মাথাটা ঝিমঝিম করছে। দেশলাই আর সিগারেটের প্যাকেট বিছানায় রেখেছিলাম। খুঁজে নিয়ে প্রথমে লণ্ঠনটা জ্বালালাম। তারপর সেই জানালাটা বন্ধ করে দিলাম। ঘরের মেঝেয় যথেষ্ট বৃষ্টির ছাঁট এসে পড়েছে ততক্ষণে। বিছানার একটা পাশ ভিজে গেছে।

সিগারেট টানতে টানতে সেই দৃশ্যটা আগাগোড়া ভাবতে থাকলাম ফের! যা দেখলাম, তা বাস্তব, না অবাস্তব? সত্যি দেখেছি, না স্নায়ুবিকার?

শেষে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে না পেরে লণ্ঠনটা নিবিয়ে শুয়ে পড়লাম। বাইরে তখন ঝড়বৃষ্টির জোরালো ভাবটা অনেক কমেছে। শীতবোধ হচ্ছে! পানজাবিটা পরে ধুতির কোঁচাটাও খুলে গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পড়লাম।

একটু পরে ঘুমে চোখের পাতা জড়িয়ে এল।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম জানি না, ফের কি একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল।

এবারকার শব্দটা দরজা খোলার মতো নয়। কেউ কি আর্তনাদ করল কোথাও? ঘুম ভাঙার পর কয়েক সেকেন্ড তার জের ছিল। দৃঢ় বিশ্বাস হল, একটা প্রচণ্ড আর্তনাদই শুনেছি।

দরবেশকে ডাকা বৃথা। তাছাড়া লোকটার অমন ভূতুড়ে ব্যাপার—স্যাপার এবং আমার প্রতি অমন আচরণ—মন বিষিয়ে গেল।

কান পেতে থাকলাম। আর কোনো আর্তনাদ নয়। কিন্তু কে যেন চাপা গলায় কাঁদছে বাইরে। বৃষ্টি পড়ার শব্দ হচ্ছে। নিশ্চয় কাছাকাছি কোথাও বড়ো গাছ আছে। তার পাতা থেকে জল ঝরছে। ঝড়টা থেমেছে।

বদ্ধ ঘরে দম আটকে আসছিল। লণ্ঠনটা নিভিয়ে দিতে হয়েছিল বাধ্য হয়ে। ঘরে বিষাক্ত গ্যাস জমার ভয়ে। এবার উঠে গিয়ে জানালাটা খুলে দিলাম। বৃষ্টি টিপটিপ করে পড়ছে। দূর দিগন্তে বিদ্যুৎ ঝিলিক দিচ্ছে। কিন্তু মেঘ ডাকছে না।

লণ্ঠনটা আর জ্বালালাম না। কান্নার শব্দ সমানে শোনা যাচ্ছিল। পা টিপেটিপে এগিয়ে সাবধানে নিঃশব্দে দরজা খুললাম। তারপর বারান্দায় গেলাম। তেমনি অন্ধকার হয়ে আছে বারান্দা। কান্নার শব্দটা কবরের ঘর থেকেই আসছে।

নিঃশব্দে ও—ঘরের দরজায় উঁকি দিলাম। সেই নীল আলোটা তেমনি লম্বাটে হয়ে বেদির ওপর পড়ে আছে। তারপর যা দেখলাম, আতঙ্কে কাঠ হয়ে গেলাম। এত ভয়ংকর দৃশ্য কখনো দেখিনি।

বেদির ওপর মাথা রেখে দরবেশ চিত হয়ে দু—হাত ছড়িয়ে শুয়ে আছে। এবং তার গলাটা জবাই করা। চাপ চাপ টাটকা রক্ত ছড়িয়ে রয়েছে। চোখ দুটো তেমনি নিষ্পলক।

সেই মেয়েটির সিল্যুট নগ্ন মূর্তি বেদির পাশে এবং সে দু—হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তার কালো একরাশ চুল সামনের দিকে ছড়িয়ে রয়েছে। দু—হাঁটু ভাঁজ করে একটু ঝুঁকে বসে সে বিলাপ করছে।

কয়েক মুহূর্ত হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। মাথা ঘুরতে থাকল। যা দেখতে পাচ্ছি, তা কি স্বপ্নে, না বাস্তবে? কী করা উচিত ভেবে পেলাম না। আতঙ্কে কাঠ হয়ে তাকিয়ে থাকলাম।

তারপর কী একটা আমার পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকল।

একটা কালো প্রকাণ্ড বেড়াল।

বেড়ালটা ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি কান্না থামিয়েছিল। সে মুখ তুলে বেড়ালটাকে দেখতে থাকল। বেড়ালটা রক্ত চাটতে চাটতে ভয়ংকর মুখ তুলে যেন আমাকেই লক্ষ করছিল মাঝে মাঝে। এর ফলে স্নায়ুর ওপর বারবার আঘাত আসছিল। অসহ্য লাগায় একটু সরে গেলাম।

এইসময় ডাইনে ঘুরে আরেক বিচিত্র দৃশ্য দেখলাম।

অন্ধকারে একটু দূরে তিনটে আলো আসছিল। হঠাৎ তিনটে আলো মিলেমিশে একটা হয়ে গেল এবং প্রকাণ্ড আলোটা হলুদ বলের মতো ভাসতে ভাসতে এসে স্থির হল। তারপর আলোটা বুদবুদের মতো অনেকগুলো ভাগ হয়ে গেল।

এদিকে আসছে দেখে আমি দ্রুত পাশের ঘরে গিয়ে ঢুকলাম এবং দরজা নিঃশব্দে ভেজিয়ে কপাটের ফাঁকে চোখ রাখলাম।

আলোগুলো বুদবুদের মতো এবং এত চঞ্চল যে গোনা যাচ্ছে না। অনুমান করলাম এক ডজনের কম নয়।

আলোগুলোর কিন্তু একটুও ছটা নেই। অর্থাৎ কোনো কিছুকে আলোকিত করছে না।

আলোগুলো নাচতে নাচতে এসে বারান্দায় উঠল এবং কবরের ঘরেই ঢুকল, তা ঠিক। তারপর ওঘরে চাপা গলায় কারা কথা বলছে শুনলাম।

কয়েক মিনিট পরে দেখি, মেয়েটি সেই নীল লণ্ঠন নিয়ে বেরুল। আবছা দেখা যাচ্ছিল, তার পরনে এখন শাড়ি রয়েছে। তার পেছনে পেছনে অনেকগুলো সিল্যুট মূর্তি যেন শূন্যে হেঁটে যাচ্ছে। বেড়ালটাকে দেখতে পেলাম না।

ওরা অন্ধকারে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল। তখন লণ্ঠনটা জ্বেলে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। কবরের ঘরের দরজা খোলা। আলো তুলে ধরে দেখি, দরবেশের জবাই করা শরীরটা তেমনি পড়ে আছে এবং গলার ফাঁকটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। এক ফোঁটা রক্ত নেই। বেড়ালটা সব চেটে—পুটে খেয়ে ফেলেছে।

ঘরের ভেতর লণ্ঠনটা ঢোকাতেই কালো বেড়ালটা কোনার দিকে বসে আছে দেখতে পেলাম। সে নীল উজ্জ্বল চোখে তাকাল। মুখে রক্ত লেগে আছে।

তারপর সে দ্রুত আমার পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল।

বেদির কাছে গিয়ে দরবেশের গায়ে হাত রাখলাম। আলখাল্লাটা ভিজে রয়েছে। নাড়িতে স্পন্দন নেই। বরফের মতো হিম শরীর।

হঠাৎ সেইসময় চোখ গেল, সেই তিনটে মড়ার মাথার দিকে।

তিনটে মুণ্ডু নড়তে শুরু করছে।

নড়তে নড়তে বলের মতো তারা আমার দিকে গড়িয়ে আসতে থাকল। আর সহ্য করতে পারলাম না। লণ্ঠনটা তাদের ওপর ছুঁড়ে মারলাম। কাচ ভেঙে গেল। তেল ছড়িয়ে আগুন ধরে গেল। তার মধ্যে মুণ্ডু তিনটে নাচতে থাকল।

একলাফে আমি বারান্দায় পৌঁছুলাম। তারপর অন্ধকারে কীভাবে যে এগোলাম, বলার নয়। আছাড় খেলাম কতবার। কাদায় জলে জামাকাপড় আর শরীর যাচ্ছেতাই মাখামাখি হল। কিছুটা এগিয়ে আবছা ধূসর আলোয় ভরা মাঠে পৌঁছুলাম।

বৃষ্টি থেমেছে। আকাশের পশ্চিম—দক্ষিণ কোণে একটুকরো ভাঙা চাঁদ বেরিয়ে এসেছে। সামনে পিচের পথটা দেখা যাচ্ছিল। সেখানে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম। দরগার এদিকটা বিশাল পাহাড়ের মতো দেখাচ্ছে। কালো হয়ে আছে। বুঝলাম জায়গাটা ঘন জঙ্গলে ভরা।

রাস্তায় পৌঁছে সাহস বেড়ে গেল। হাঁটতে থাকলাম। শরীরের সেই দুর্বলতাটা আর নেই। দূরে একটা আলো দেখা যাচ্ছিল। মনে পড়ল, ওধারে সেই ছোট্ট চটি। যেখান থেকে বাসে চেপেছিলাম কাল সন্ধ্যায়।

লোহাগড়া ব্লকে নিশীথ—আমার বন্ধু নিশীথ রায়চৌধুরী কৃষি অফিসার। ভোরবেলা আমাকে জলকাদামাখা ভূতুড়ে চেহারায় দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিল।

সংক্ষেপে তাকে মোটামুটি সবটাই বললাম। সে কিছুক্ষণ নিষ্পলক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকার পর বলল—ঠিক আছে। আগে বাথরুমে ঢোক। আমার বউ বড্ড ঘুমকাতুরে। বেলা করে ওঠে। তোকে এ অবস্থায় দেখলে হুলস্থূল ঘটাবে।

কাপড়চোপড় ছেড়ে স্নান করে এবং নিশীথের পাজামা—পাঞ্জাবি পরে আরামে বসলাম। ততক্ষণে সূর্য উঠেছে। নিশীথ চা করে আনল।

চা খেতে—খেতে বললাম—এতক্ষণে কোমরে ব্যথা করছে একটু একটু।

নিশীথ বলল—ফিরে গিয়ে এক্সরে করাস। কিন্তু কথা হচ্ছে, ঝড়জলের সময় মোতিবিবির দরগায় নিশ্চয় তুই ভীষণ রকমের দুঃস্বপ্ন দেখেছিস। তা ছাড়া এর কোনো ব্যাখ্যা হয় না।

—অসম্ভব! দরবেশের ডেডবডিটা নিশ্চয় এখনও আছে। বরং পুলিশে খবর দেওয়া যাক।

নিশীথ হাসল।—কী বলছিস! ওখানে কেউ থাকে না। সে রকম কোনো ঘর—টরই নেই। তবে একটা কবর আছে বটে এবং সেটা কষ্টিপাথরে তৈরি। তুই বাস থেকে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলি—তা ঠিক। জ্ঞান ফেরার পর নিশ্চয়ই ঝড়ের আশ্রয় নিতে দরগায় ঢুকেছিলি। তারপর আঘাত পাওয়ার রিঅ্যাকশনে জ্বর—টর এসে গিয়েছিল। তারপর লম্বা চওড়া একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছিস।

রেগে গিয়ে বললাম—ঘর নেই তো ঝড়বৃষ্টিতে ছিলাম কোথায়?

নিশীথ বলল—নিশ্চয় দরগার বটতলায় গিয়ে ফের অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলি।

—অসম্ভব। এক্ষুনি আয় আমার সঙ্গে। স্বপ্ন হতেই পারে না। আমার ব্যাগ—ট্যাগ সব ওখানে আছে।

নিশীথ একটু হেসে বলল—ঠিক আছে। তোর ভুলটা ভাঙানো দরকার। একটু পরে ব্লকের জিপটা নিয়ে বরং বেরুব।

মুর্শিদাবাদ—সাঁওতাল পরগনা সীমান্তের এই দরগাটির নাম লোহাগড়া—বরমডি রোড। বরমডিতে রেলস্টেশন আছে। সেখান থেকে আমার বাড়ি পৌঁছুনোর অসুবিধে নেই। তাই নিশীথের বউয়ের কাছে দ্বিতীয় দফা বিদায় নিয়ে বেরুলাম। হাসতে হাসতে বলল—আপনি আবার ভূতের পাল্লায় পড়ে ফিরে আসুন! তবে আপনার বন্ধুর সাহসটা বড্ড বেশি। দেখবেন, সেই মেয়েটির প্রেমে পড়ে দরগায় না থেকে যায়। ও ভীষণ ন্যুডের। দেখছেন না, কত ন্যুড আর্ট টেবিলে সাজিয়ে রেখেছে?

মিনিট পঁচিশ এগিয়ে রাস্তার ধারে জিপ রেখে আমরা দরগার দিকে পা বাড়ালাম।

তারপর থমকে দাঁড়ালাম। নিশীথ বলল—কী হল?

বললাম—দেখ, দেখ! সেই কালো বেড়ালটা।

একটা কালো বেড়াল ভাঙাচোরা প্রকাণ্ড চত্বরে বসে একটা থাবা তুলে গাল চুলকোচ্ছে! চত্বরের মাঝখানে কষ্টিপাথরের কবর। বেড়ালটা থাবা নামিয়ে আমাকে দেখতে থাকল।

কিন্তু কী আশ্চর্য! সেই কবরটা! ফার্সিতে লেখা ফলকটাও! কিন্তু এ তো ফাঁকা জায়গায় রয়েছে। ওপাশে একটা প্রকাণ্ড বটগাছ। নিশীথ এগিয়ে গিয়ে জলকাদায় পড়ে থাকা আমার ব্যাগ কুড়িয়ে নিয়ে বলল—তোর ব্যাগ নিশ্চয়?

এই সময় ড্রাইভার একটু কেসে বলল—স্যার, শুনেছি এখানে এক ফকির থাকতেন। পরে তাঁকে কারা মার্ডার করেছিল। মেয়েমানুষ নিয়ে গন্ডগোল।

শুনে আমার মাথা ঘুরতে থাকল। ব্যস্ত হয়ে বললাম—নিশীথ, চলে আয়…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *