1 of 2

মোচার ঘণ্ট – বাণী বসু

মোচার ঘণ্ট – বাণী বসু

সকালের ডাকের মধ্যে ছিল আঁকাবাঁকা হাতের লেখাওয়ালা একখানা পোস্টকার্ড। পড়তে— পড়তেই বাবা ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন, ‘ওরে শামু, তোর ছোটঠাকুরমার চিঠি এসেছে। অনেক দিন ধরে একাজ্বরি হয়ে রয়েছেন। আশ্চর্য! হারুও তো একটা খবর—টবর দেবে! তুই কাল সকালের ট্রেন ধরেই চলে যা। আজই আমি ডাক্তারবাবুর কাছ থেকে ওষুধ—পত্তর সব এনে রাখছি।

মা বললেন, ‘কী হয়েছে গো?’

‘আরে আজ একমাস হতে চলল ছোটো খুড়িমার রোজ সন্ধেবেলা জ্বর হচ্ছে। না একটা খবর, না কিছু!’

শমু বলল, ‘বাবা, আমার বন্ধুদেরও নিয়ে যাব? যাই, হ্যাঁ?’

মা বললেন, ‘মোটেই না। শুনছ, তিনি আজ একমাস ধরে ভুগছেন, বুড়ো মানুষ! দেখতে যাবার নাম করে দৌরাত্ম্য করতে যাবে, না?’

বাবা একটু ভেবে বললেন, ‘কথাটা কিন্তু মন্দ না। শমুর বন্ধুরাও অনেকদিন ধরে ‘গ্রাম দেখতে যাব, গ্রাম দেখতে যাব’ আবদার করছে, টেস্ট পরীক্ষা শেষ! ক—দিন ঘুরেই এলে বা! হারু না হয় বামুন মেয়েকে ডেকে আনবে, তিনিই রান্নাবান্না করে দেবেন। খুড়িমা ছেলেপুলে ভালোবাসেন। অসুখ শরীর, ছেলেগুলোকে পেলে ওঁর ভালোই লাগবে।’

মা বললেন, ‘জানি না বাবা। দস্যি সব! একা শমুতেই রক্ষে নেই।’

‘তায় তিনটে বাঁদর দোসর।’ শমু যোগ করল।

‘সবই তো জানো দেখছি! জ্ঞানপাপী!’ মা হাসতে—হাসতে চলে গেলেন।

আর তিনটে বাঁদর হচ্ছে গোরা, টুলু আর রঞ্জু। চারজনেই ক্লাস টেনে পড়ে। টেস্ট পরীক্ষা হয়ে গেছে, মাধ্যমিকের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।

গোরা বলল, ‘চল, দু—চারদিনের জন্যে ফ্রেশ হয়ে আসা যাবে। জিয়োমেট্রি আর জিয়োগ্রাফি, এই দুই জিয়োর ভূত এখনও আমার মাথার মধ্যে কিলবিল কিলবিল করছে।’

শমু বলল, ‘সাবধান গোরা, ভূতগুলোকে রায়নায় ছোটঠাকুমার আশেপাশে ছেড়ে দিয়ে আসিসনি যেন। মা বলেছে, আমরা চারটে বাঁদর।’

রঞ্জু বলল, ‘না রে না, আমরা কি সেই ছেলে? ভীষণ ভালো হয়ে থাকব। খালি তোদের হারুদাকে একটু পুকুরে জাল—টাল ফেলতে—টেলতে বলিস। আর ছোটো ঠাকুমার ভাঁড়ারের চাবি—ফাবিগুলো।…’

টুলু বলল, ‘তোরা এত হ্যাংলা না! যাচ্ছিস একজন অসুস্থ বৃদ্ধার সেবা করতে। তা না পুকুরে জাল, ভাঁড়ারের চাবি।…’

‘তা বটে, তা বটে,’ রঞ্জু বলে উঠল, ‘আমাদের টুলুবাবু আবার একজন ভালো ছেলে। সমাজ—সেবক। ছুটিতে—ছুটিতে বস্তিতে গিয়ে জ্ঞানের আলো বিতরণ করে আসেন…’

শমুর বাবার এখন কোর্টে অসম্ভব কাজ। সুতরাং বর্ধমান জেলার অন্তর্গত রায়না গ্রাম নিবাসী তাঁর ছোটোকাকিমাকে দেখে আসবার ভার চার বন্ধুর ওপরেই পড়ল। সকাল ৬—৫৫ মিনিটে এক্সপ্রেস ট্রেন ছাড়ে। মোটামুটি খালি কামরায় জানলার ধারে বসতে পেরেছে চার বন্ধু। সঙ্গে একটা করে ব্যাগ।

ট্রেন ব্যান্ডেল পেরিয়ে গেল। পৌষের সকালের শান দেওয়া হাওয়া। দু—পাশে খোলা মাঠ। গাছপালা, টেলিগ্রাফের তারে ফিঙের দোল। একটু আগেই আবার চা—শিঙাড়া হয়ে গেছে।

টুলু বলল, ‘কী যে সব যা—তা খাওয়াস তোরা। একটা টক ঢেকুর উঠল।’

গোরা বলল, ‘বয়স হয়েছে তো? ও একটু উঠবেই। দাদুদের অমন একটু—আধটু উঠে থাকে। ভাস্কর লবণ দেব?’

‘যা যা, ফাজলামি করিস না।’

রঞ্জু বলল, ‘শমু, আজ কিন্তু আমাদের হরিমটর মনে হচ্ছে। রায়নায় পৌঁছতে অন্তত আড়াইটে—তিনটে। কী হবে বল তো?’

বর্ধমানে নেমে রেলওয়ে—রেস্তোরাঁয় খেয়ে নেব এখন।’ শমু বলল, ‘আজকের দিনটা কষ্ট কর। কাল থেকে তোদের যা খাওয়াব না! জীবনে ভুলতে পারবি না।’

‘কীরকম? কীরকম?’ তিনবন্ধু একসঙ্গে বলে উঠল।

‘ছোট ঠাকুমা রান্না করেন ফার্স্টক্লাস। আমরা প্রতিবছরই একবার, কোনো কোনো বছর দু—বারও যাই। পাশের বাড়ির বামুনদিদি হেল্প করে আর ছোটঠাকুমা রাঁধেন। এই বয়সেও হেভি খাটতে পারেন। কীসব আনাজ—টানাজ দিয়ে ডাল বানান, সুক্তুনি, ধোঁকার ডালনা, ফুলকপির বড়া। কিন্তু সবচেয়ে দারুণ কী জানিস? মোচার ঘণ্ট। দুর্দান্ত!’

রঞ্জু মুখ ব্যাজার করে বলল, ‘এইসব সুক্তুনি—ফুক্তুনি, মোচা—ফোচা খাওয়াবি? কোথায় ভাবলুম পুকুরের বড়ো বড়ো রুই মাছ…’

‘সে তো আছেই’, শমু বাধা দিয়ে বলে উঠল, ‘কিন্তু আমি বাজি ধরে বলতে পারি তুই মাছ ফেলে মোচার ঘণ্ট খাবি, রুই—কাতলা ফেলে মৌরলার অম্বল খাবি।’

গোরা বলল, ‘হতেও পারে। ঠাকুমা—দিদিমাদের রান্নার স্বাদ সত্যি সত্যিই আলাদা।’

টুলু বলল, ‘একটা কথা কিন্তু তোরা সবাই ভুলে যাচ্ছিস। ছোটঠাকুমা এখন অসুস্থ। খুবই অসুস্থ। তিনি তোমাদের জন্যে এতসব রাঁধতে পারবেন না। এবং দোহাই তোমাদের, গিয়েই তাঁর কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান আরম্ভ কোরো না। তাহলে বলা যায় না। হয়তো অসুস্থ শরীরেই…’

পাশে এক ভদ্রমহিলা উল—কাঁটা নিয়ে তীব্রগতিতে বুনে যাচ্ছিলেন। এতক্ষণ কিছু বলেননি। এবার মিটিমিটি হেসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা চার পেটুক দামুতে কোথায় চলেছ?’

অপ্রস্তুত হয়ে গন্তব্যস্থলটার নাম করেই চার বন্ধু চুপ হয়ে গেল।

রায়না গ্রামে শমুদের প্রচুর জমিজমা। ধান জমি, পুকুর—বাগান, গোরু—বাছুর। সমস্ত কিছুরই দেখাশোনা করেন শমুর বাবার নিঃসন্তান ছোটকাকিমা। ও অঞ্চলে এক ডাকে সকলে তাঁকে চেনে, ভালোবাসে, ভক্তি করে। বিষয়—সম্পত্তি যেমন দেখাশোনা করেন, তেমনি আবার ছোটঠাকুমার অন্য কতকগুলো অদ্ভুত গুণ আছে। হাত গুনতে পারেন, অনেক রকম তুকতাক জানেন, যার জন্য আশেপাশের গ্রাম থেকে বহু লোক বিপদে—আপদে রায়নার মা—ঠাকরুনের কাছে ছুটে আসে। সঙ্গে সঙ্গে সবসময় থাকে মাদুর্গার পাশে নন্দীর মতো হারুদা। যেমন বিশাল চেহারা আর স্বাস্থ্য, তেমনি কর্মক্ষমতা। হারুদাকে ফাঁকি দিয়ে কেউ এক পয়সাও ছোটঠাকুমার কাছ থেকে আদায় করতে পারবে না। তাই শমুর বাবা বিষয়—সম্পত্তি এবং ছোটঠাকুমার দেখাশোনা সম্পর্কে একেবারে নিশ্চিন্ত।

ট্রেন একটু লেট ছিল। বর্ধমানে নেমে রেলওয়ে রেস্তোরাঁয় খেয়ে নেবার প্ল্যানটা ওদের ভেস্তে গেল। রায়নার বাস তখন ছাড়ে—ছাড়ে। শুকনো মুখে চার বন্ধু বাসে উঠে পড়ল। সঙ্গে কমলালেবু ছিল, খেয়ে তেষ্টা মিটল বটে, কিন্তু খিদে আরও বেড়ে গেল। শমুর মা ছোটঠাকুমার জন্যে ভালো সন্দেশ দিয়ে দিয়েছেন। তাতে তো আর হাত দেওয়া যায় না! রঞ্জু দু—একবার বলেছিল, ‘দ্যাখ অত সন্দেশ তো বুড়োমানুষ একলা খেতে পারবেন না!’ শুনে শমু এবং টুলু বলেছিল, ‘সন্দেশের বাক্স এক্কেবারে সীল করা অবস্থায় ঠাকুমার হাতে পৌঁছে দিয়ে তবে আমাদের ছুটি। তারপর যা করতে হয় উনিই করবেন। একলা খাবেন কি পাঁচজনকে বিলিয়ে দেবেন, আমাদের জানবার দরকার নেই।’ রঞ্জু দুঃখিত হয়ে বলেছিল, ‘একটু সীতাভোগ মিহিদানা কেনবারও সময় দিলি না। বর্ধমানের কতদিনের ঐতিহ্য!’

পিচের রাস্তা দিয়ে হু হু করে বাস ছুটেছে। দু—দিকে চাইলেই বোঝা যায় রীতিমতো বর্ধিষ্ণু অঞ্চল। হৃষ্টপুষ্ট গোরু চরছে, বাচ্চাগুলো তেল—চুকচুকে। মাঠ থেকে ধান উঠে গেছে, অনেক বাড়ির সামনেই স্তূপীকৃত সোনালি ধান আঁটি বেঁধে রাখা, কোনো কোনো জায়গায় মরাইয়ে তোলা হয়ে গেছে।

রায়নায় যখন বাস পৌঁছল তখন বেলা প্রায় দুটো। এই দুপুরেও কেমন একটা হাড়—কাঁপানো হাওয়া দিচ্ছে। শমু বন্ধুদের আশ্বাস দিল ডাইনের পায়ে চলা পথটা ধরে খানিকটা গেলেই ওদের বাড়ি এবং বাড়ি গেলে চিড়ে মুড়ি দুধ কলা নারকোল ইত্যাদির কোনো অভাব হবে না। তার সঙ্গে ভালো পাটালি। পেটটা ভরিয়ে ওরা একটু বিশ্রাম করে নেবে। তারপর গ্রাম বাংলা দেখা যাবে।

‘ওই তো দেখা যাচ্ছে বাড়ির গেট’, শমু চেঁচিয়ে উঠল। বেড়ার গায়ে বাঁশের গেট। ভেতরে উঠোন, দু—পাশে করবী গাছ।

শমু ডাকল, ‘হারুদা—আ।’

সাড়া নেই।

‘ছোটঠাকুমা—আ!’ দু—তিনবার ডাকের পর ভেতর থেকে ক্ষীণ কণ্ঠ ভেসে এল, ‘কে এলি? খিড়কি দিয়ে ঘুরে আয়। ওদিক বন্ধ।’

বাড়ি প্রদক্ষিণ করে পুকুরের ধারে খিড়কির দরজা। ঢুকতেই ভেতর—উঠোন। বিরাট এক মরাই। পাশেই দাওয়ার ওপর ঠাকুমার ঘর। বললেন, ‘কে এলি, গোপাল?’

শমু বন্ধুদের জুতো খুলতে ইশারা করে নিজেও জুতো খুলতে খুলতে বলল, ‘হ্যাঁ গো ঠাকুমা, আছ কেমন? এত শরীর খারাপ, আগে খবর দাওনি কেন?’

তিন বন্ধু ঢুকে গেল, পরিষ্কার একটি গ্রাম্য ঘর। কুলুঙ্গিতে সিঁদুর মাখানো ঠাকুর—দেবতার ছোটো ছোটো মূর্তি। একধারে জলচৌকির ওপর বিশাল বিশাল তোরঙ্গ। এদিকে তক্তপোশের ধবধবে বিছানার ওপর আলো—আঁধারিতে একটি বৃদ্ধা শীর্ণ হাত বাড়িয়ে তাদের ডাকছেন। ‘এসো এসো, দাদুভাইরা। ছোটঠাকুমাকে দেখতে অ্যাদ্দিনে এলে?’

শমু বলল, ‘তুমি ওঠো তো, আগে ওষুধ খাও। এই নাও, মা তোমার জন্য সিমলের সন্দেশ পাঠিয়েছে।’

‘রাখ রাখ, ওই চৌকিটার ওপর রাখ দাদু। হাতটা ধুয়ে এসে কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে দে, তবে তো ওষুধ খাব!’

‘আমার ট্রেনের কাপড়। জল খাবে তো?’

‘না খেলে আর যাচ্ছি কোথায় মানিক? তোমার হাতের জল যে অমর্ত ভাই!’

শমু বাইরে থেকে হাত ধুয়ে এসে ঠাকুমার হাতে পাথরের গেলাসে জল গড়িয়ে দিল। ব্যাগ থেকে ট্যাবলেট বার করে বিছানার ওপর রেখে বলল, ‘কোথায় তোমার চিড়ে—মুড়ি? কলা—টলা দিয়ে বন্ধুদের যাহোক কিছু খাওয়াই!’

‘ওমা, ছেলের কী চ্যাটাং—চ্যাটাং কথা গো! ফলার খেতে যাবি কোন দুঃখে? রান্নাবান্না সব তৈরি। যাও তো দাদুরা, কুয়োতলায় গিয়ে চান করে এসো তো! তেল গামছা, সাবান সব আছে ওখানে। আমি ততক্ষণে সব ব্যবস্থা করে রাখছি।’

‘রান্নাবান্না মানে?’ শমু অবাক।

ফোকলা দাঁতে হাসতে লাগলেন ঠাকুমা, ‘আমি যে হাত গুণতে জানি দাদুভাই। কত খিদেই না জানি পেয়েছে! যাও, তাড়াতাড়ি এসো।’

বিরাট ইঁদারা। এই পৌষমাসের শীতেও তার জল ভারী চমৎকার উষ্ণ। ঘানিভাঙা সর্ষের তেল মেখে চান করে ফেলল চার বন্ধুতে। শরীরে আর ক্লান্তি নেই। ঠাকুমার ঘরের দাওয়ায় এসে দেখে সব সাজানো হয়ে গেছে। বড়ো বড়ো চারটে পিঁড়ে পাতা। সামনে কানা—উঁচু বগি—থালায় গোল করে ভাত বাড়া। থালা ঘিরে কত বাটি। থালার মধ্যেও নানা ব্যঞ্জন। পাশে জলের গ্লাস, ছোট্ট রেকাবিতে মুখশুদ্ধি। নিশ্চয়ই ঠাকুমার কিছু স্পেশাল।

টুলু বলল, ‘ইশ, করেছেন কী ঠাকুমা! জ্বরের ওপর এই এত্তোসব করেছেন? কী কাণ্ড!’

‘জ্বর তো সন্দেবেলায়! সকালবেলাটা একটু দুব্বল—দুব্বল লাগে। সে এমন কিছু না। ও— বাড়ির বামুন—মেয়ে জোগাড় দিলে, একটু খুন্তি নেড়ে দিলুম। কিচ্ছু কষ্ট হয়নি। তোমাদের জন্যে এটুকু করতে পারব না। যা দরকার হয় চেয়ে নিয়ো। লজ্জা কোরো না।’

গোরা বলল, ‘এর ওপর আবার চাওয়া? এই খেয়ে উঠতে পারলে হয়!’

‘সে বাবা!’ তোমাদের বাপ—ঠাকুরদারা যে তোমাদের বয়সে বাজি ধরে হাঁড়ি খেয়ে নিত।’

খেতে খেতে রঞ্জু অবাক। বললে, ‘তুই যা যা বলেছিলি সবই যে রান্না করেছেন রে ঠাকুমা! এই দ্যাখ আনাজ দিয়ে ডাল, সুক্তুনি, মোচার ঘণ্ট, এটা কী? ছানার পাতুরি? ধোঁকার ডালনা, মৌরলা মাছের অম্বল…’

গোরা বললে, ‘তোর রুই মাছের চাকাও বাটির মধ্যে থেকে ঘাই মারছে রে!’

শমু দেখল বন্ধুদের পাতে পড়লেও ওর নিজের পাতে মৌরলার অম্বল, রুই মাছের ঝাল কোনোটাই পড়েনি। তাড়াতাড়িতে কি ঠাকুমা অত জোগাড় করতে পেরেছেন? বলল, ‘নতুন গুড়ের পায়েসের কী গন্ধ বেরিয়েছে দেখেছিস?’ তারপর চেঁচিয়ে বলল, ‘ঠাকুমা, এ যে ফাঁসির খাওয়া খাওয়াচ্ছ!’

ঘরের মধ্যে থেকে ক্ষীণ কণ্ঠ ভেসে এল, ‘বালাই ষাট, খেয়ে নাও দাদু, কিচ্ছুটি ফেলো না!’

এক—একটি পদ মুখে দিচ্ছে আর তিন বন্ধু মুখ চাওয়া—চাওয়ি করছে। শমু একটুও বাড়িয়ে বলেনি। সত্যিই এমন জিনিস তারা জীবনেও খায়নি। গোরা বলল, ‘আমার দিদিমার থেকেও ভালো। কী গন্ধ বেরোচ্ছে দেখেছিস?’

শমু বলল, ‘বাড়ির গোরুর দুধের সরের ঘি, গন্ধ তো বেরোবেই। কিন্তু সত্যি, ছোটঠাকুমা আজ একটা কাণ্ডই করেছেন।’ চেঁচিয়ে বলল, ‘ঠাকুমা, আজ নিজের রেকর্ড নিজেই ব্রেক করেছে।’

ঘর থেকে সারা এল না। টুলু উঁকি মেরে বলল, ‘ঘুমিয়ে পড়েছেন। বেশি চেঁচামেচি করিস না।’ খাওয়ার পর ওদিককার ঘরে নিয়ে গেল শমু। বিরাট কারুকার্যকরা সেকেলে পালঙ্ক। চারজনে চারটে বালিশ নিয়ে গড়িয়ে পড়ল। আরামে চোখ বুজে আসছে। ক্লান্তি, ইঁদারার জলে স্নিগ্ধ স্নান, অপূর্ব খাওয়া, গ্রামের তাজা হাওয়া, শেষ বেলার রোদ। দেখতে—দেখতে চারজনে ঘুমিয়ে পড়ল।

ঘুম ভাঙল সন্ধেবেলায়, ঘরের দরজায় প্রবল ধাক্কাধাক্কিতে। চোখ মুছতে মুছতে খিল খুলে দিল শমু। সামনে হারুদা। এই শীতেও খালি গা। নতুন কোরা কাপড়ের কোঁচাটা গলায়।

‘কখন এলি?’

কেন, ঠাকুমা বলেনি? দুটো নাগাদ এসে পৌঁছেছি।’

‘ঠাকুমা বলেনি মানে?’ হারুদার মুখ হাঁ।

‘তুমি ছিলে কোথায়? এখনও ঠাকুমার সঙ্গে দেখা করোনি?’

সে কথার উত্তর না দিয়ে হারুদা বললে, ‘সব তো তালা দেওয়া, ঢুকলি কী করে?’

শমু বলল, ‘খিড়কি খোলা ছিল। ঠাকুমা ওদিক দিয়েই আসতে বলল।’

‘তারপর?’

‘তারপর আবার কী? চান করলুম, ঠাকুমা রেঁধে রেখেছিল খেলুম। হ্যাঁ, ঠাকুমাকে ওষুধ খাইয়েছি, বাবা পাঠিয়েছেন।’

‘কী খেলি?’

‘ওরে বাবা, সে অনেক, সুক্তুনি, মোচার ঘণ্ট, ধোঁকার ডালনা…’

হারুদার হাতে লণ্ঠন। আলো পড়ে চোখ দুটো চিকচিক করতে লাগল। বলল, ‘গোপাল এই মাত্র মা—ঠাকরুনকে দাহ করে ফিরছি।’

‘মানে?’ চিৎকার করে উঠল শমু, ‘আমাদের খাইয়ে—দাইয়ে ঠাকুমা মারা…’

‘না, তোদের খাওয়াবার আগেই। গতকাল রাত একটায়। টেলিগ্রাম করে দিয়েছি। বাবু আজ কী কাল পাবেন। মা—ঠাকরুনের হুকুম ছিল, ছ—সাত ঘণ্টার বেশি যেন দেহ না রাখা হয়। ও—পাড়ার রতন ভটচাজ মুখাগ্নি করলেন।’

শমুর গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না, কোনোমতে বলল, ‘কিন্তু আমরা যে… আমাদের যে…’

হারুদা বলল, ‘আয়, দেখবি আয়।’

সারি—সারি ঘরে তালা ঝুলছে। দালানে ওদের ভূরিভোজের চিহ্নমাত্র নেই। ঠাকুমার ঘরের তালা খুলতে খুব সুন্দর একটা গন্ধ ওদের নাকে এসে লাগল। রঞ্জু দেখল, জলচৌকির ওপর রাখা সন্দেশের বাক্সটাতে পিঁপড়ে ধরেছে। ঘরের কোণে একটা পিদিম জ্বলছে। আর, সেই পিদিমের আলোয় শমুদের দেখে গ্রাম্য বাড়ির দেওয়ালে টাটকা রজনীগন্ধার মালার মধ্যে থেকে একটি মমতাময়ী বৃদ্ধার মুখ তাদের দিকে তাকিয়ে ঈষৎ কৌতুক আর স্নেহের হাসি হাসছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *