মেথুশীলা

মেথুশীলা

বাইবেল-বর্ণিত মেথুশীলা পুরুষ ছিলেন বলিয়াই আমাদের বিশ্বাস। কিন্তু বাংলাদেশে আসিয়া জ্যেষ্ঠা ভগিনী চারুশীলার সহিত মিল বজায় রাখিবার জন্য তাঁহাকে নারীমূর্তি পরিগ্রহ করিতে হইবে একথা যদি তাঁহার জানা থাকিত তাহা হইলে বোধ করি নয়শত উনসত্তর বছর বয়সেও তিনি মরিতে রাজী হইতেন না। কিন্তু মুশার ভগবান বৃদ্ধ বয়সে একটু রসিকতা করিবার বাসনা করিয়া ছিলেন, তাই–

সর্দা আইন পাস হইবার কিছুদিন আগেকার কথা। সনাতন ধর্মের জাত বাঁচাইবার জন্য নিষ্ঠাবান হিন্দু মাত্রেই আত্মীয় কুটুম্ব যে যেখানে আছে সকলের বিবাহ দিয়া ফেলিতেছেন; গ্রহণ লাগিলে আর আহার চলিবে না। ইত্যবসরে সন্দেশ ও মৎস্যের দর ভয়ঙ্কর চড়িয়া যাইতেছে।

জমিদার লালমোহন চৌধুরী মহাশয়কে সনাতন হিন্দু ধর্মের বিজয়স্তম্ভ বলিলে সম্ভবত তাঁহার বাবুর্চি নিয়াম মিঞা দাঁত বাহির করিয়া ভাল্লুকের মতো হাসিবে, অতএব সেকথা বলিব না; কিন্তু তিনিও এই হিড়িকে পুত্রের বিবাহ দিবার জন্য বদ্ধপরিকর হইয়াছেন। পুত্র অবশ্য নাবালক নয়, তাহার তেইশ-চব্বিশ বছর বয়স—আইনে বাধে না। কিন্তু চৌধুরী মহাশয়ের দুরভিসন্ধি অন্য প্রকার—তিনি একটি দশমবর্ষীয়া বালিকার সহিত পুত্রের বিবাহ দিতে চান। চৌধুরী পরিবারের কোনও বধূই আজ পর্যন্ত দশ বৎসরের অধিক বয়স লইয়া দুধে-আলতায় পা দেয় নাই।

কিন্তু পুত্র ব্রজমোহনের মনে ভাবী বধু সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ভিন্নরূপ পরিকল্পনা বিদ্যমান ছিল। তা দিয়া ডিম ফুটাইয়া ছানা লালনপালন করিয়া দাম্পত্য জীবনের কলকাকলির ভূমিকা প্রস্তুত করিতে সে উৎসুক ছিল না। সাধারণ বাঙালীর আয়ুষ্কাল যে মাত্র তেইশ বৎসর ইহা সে কলেজে পড়িয়া জানিয়া লইয়াছিল। তাহার ধারণা জন্মিয়াছিল যে বধু হইবে ডাঁশা পেয়ারার মতো, বয়স হইবে সতেরো কিংবা আঠারো, রূপের চেয়ে রসে বেশী ঢলঢল করিবে, প্রেমের অভিজ্ঞতা (পরোক্ষভাবে) ভিতরে ভিতরে ভাল রকম থাকিবে, এবং স্বামী প্রথম চুম্বন করিলে বাবা গো! বলিয়া কাঁদিয়া উঠিবে না। শেষোক্ত রূপ ঘটনা চৌধুরী পরিবারে ইতিপূর্বে একবার ঘটিয়া গিয়াছিল।

সুতরাং আদর্শ লইয়া পিতা-পুত্রে সংঘর্ষ উপস্থিত হইল। কিন্তু লালমোহনবাবু—সম্ভবত মুর্গী খাইতেন বলিয়া—পুত্রের আদর্শকে এক কথায় নাকচ করিয়া দিলেন না, তিনি কুটিল কুপথ ধরিলেন। ব্রজমোহনের পিছনে তার্কিক লাগিল, দুই আদর্শের আপেক্ষিক শ্রেষ্ঠত্ব লইয়া বাড়িতে অষ্টপ্রহর তর্ক চলিতে লাগিল।

বড় পক্ষের প্রধান কৌঁসুলী মেজবৌদি, মেয়েদের মধ্যে তাঁহার তর্কই সর্বাপেক্ষা যুক্তিসংগত। একদিন তিনি কোমর বাঁধিয়া ব্রজকে বুঝাইতে বসিলেন। অন্যান্য কথার পর বলিলেন, বিশ বছরের একটা ধাড়ি মেয়ে বিয়ে করে আনবে, সেটাই কি দেখতে শুনতে ভাল হবে?

ব্রজ বলিল, বিশ বছরের ধাড়ি মেয়ে মন্দ কিসে?

মেজবৌদি বলিলেন, সব দিক দিয়েই মন্দ। মাগো, ভাবতেই যেন গা কেমন করে ওঠে!

ব্রজ বলিল, শুধু মুখে বললে হবে না, প্রমাণ করতে হবে।

মেজবৌদি তর্কের ঝোঁকে বলিলেন, প্রমাণ আবার কি? তোমার যে অনাছিষ্টি কথা! বিশ বছরের পাকা মেয়ে কখনো ভাল হয়?

ব্রজ জিজ্ঞাসা করিল, তোমার এখন বয়স কত?

মেজবৌদি চালাকি করিয়া কথাটা এড়াইয়া গিয়া বলিলেন, তুমি বড় বাজে তর্ক করো। ধান ভাতে শিবের গীত!–দেখ দিকি আমাদের কেমন বিয়ে হয়েছিল, যখন শ্বশুরবাড়ি এলুম তখন বর কাকে বলে তাই জানি না। বলিয়া সুখের হাসি হাসিলেন।

ব্রজ বলিল, খুবই আনন্দের কথা! কিন্তু বর কি বস্তু তা জেনে শ্বশুরবাড়ি আসতেই বা দোষ কি?

বৌদি গম্ভীরভাবে মাথা নাড়িয়া বলিলেন, ছেলেবেলায় বিয়ে না হলে মনের মিল হয় না।

বিস্মিত ব্রজ বলিল, একথা তুমি কোথায় পেলে? তাহলে পিসিমার সঙ্গে পিসেমশায়ের মনের মিল হয়নি কেন?

নজিরটা খারাপ। হটিয়া যাইতেছেন দেখিয়া বৌদি বলিলেন, ওসব বাজে কথা, কনে-বৌ কচি মেয়ে না হলে কি মানায়? শাস্ত্রে কি লিখেছে জানো?

ব্রজ সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিল, কোন্ শাস্ত্রে? বেদে, না মনু-সংহিতায়?

বৌদি অধীরভাবে বলিলেন, অত জানিনে, তোমার খালি উল্টোপাল্টা কথা! তাছাড়া ধাড়ি মেয়ে বিয়ে করার অনেক বিপদও আছে।

কি বিপদ?

সে-সব কথা আমি বলতে পারব না। এই সেদিন আমাদের জানা-শোনা একজন লোক উনিশ বছরের এক মেয়ে বিয়ে করে নিয়ে এলো—তারপর সে-বৌ ত্যাগ করতে হল।

ব্রজ কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল, শেষে বলিল, মোপাসাঁর Madame Baptiste পড়েছ? পড়নি, কারণ ইংরেজি বা ফরাসী ভাষা তোমার জানা নেই। যা হোক, চন্দ্রশেখর পড়েছ নিশ্চয়। শৈবলিনীর বয়স তো উনিশ বছর ছিল না। তবে অমন হল কেন বলতে পারো?

বৌদি হাসিয়া ফেলিলেন, ও তো গল্প—ওকি সত্যি নাকি? সত্যি হলে চন্দ্রশেখরকেই শৈবলিনী ভালবাসত—প্রতাপের মুখে নুড়ো জ্বেলে দিত।

ব্রজও হাসিল, তা বটে। কিন্তু তোমার আসল প্রতিপাদ্যটা এখনো প্রমাণ হল না। বড় মেয়ে নিন্দনীয় কিসে?

মেজবৌদি গম্ভীর হইয়া বলিলেন, দেখ, তুমি ছেলেমানুষ (ব্রজ মেজবৌদির চেয়ে বছর খানেকের বড়), তোমার কাছে সব কথা খুলে বলতে লজ্জা করে। যে মেয়ে ষোলো-সতেরো বছর বয়স পর্যন্ত আইবুড়ো থেকে বাপের বাড়িতে কাটিয়েছে, সে ভেতরে ভেতরে পেকে ঝিঁকুট হয়ে গেছে। মনে মনে সে বুড়ি হয়ে গেছে, জীবনের কোনও অভিজ্ঞতাই তার জানতে বাকি নেই, বুকের মধ্যে তার আশি বছর বয়েস। এরকম মেয়েকে বিয়ে করে কেউ কোনও সুখ-শান্তি পায়নি ভাই—তুমিও পাবে না।

ব্ৰজ উদ্দীপ্ত হইয়া বলিল, কে বলে পাব না? নিশ্চয় পাব। বরং সংসারযাত্রার অভিজ্ঞতার সম্বল যার নেই তাকে নিয়েই পথ চলা মুশকিল হয়ে পড়বে। তুমি যাকে আশি বছরের বুড়ি বলছ, সেই আশি বছরের বুড়িই আমার চাই। দশ বছরের খুকী সুখ-শান্তির জানে কি? সে তা দেবে কোত্থেকে? দেবার ক্ষমতা এক ঐ আশি বছরের বুড়িরই আছে।

বৌদি মুখ টিপিয়া হাসিয়া বলিলেন, সে বরং মন্দ কথা নয়, কিন্তু আশি বছরের আইবুড়ো বুড়ি পাওয়া মুশকিল হবে! সেকালে কুলীনদের ঘরে থাকত শুনেছি।

ব্রজ ঈষৎ শান্ত হইয়া বলিল, আমি সে বুড়ির কথা বলিনি—আমি চাই বৃদ্ধত্বং জরসা বিনা। মন যার পরিপুষ্ট হয়নি তাকে বিয়ে করে লাভ কি? সে তো খেলার পুতুল! আমি খেলার পুতুল চাই না।

বৌদি বলিয়া উঠিলেন, আচ্ছা, বাবাকে সেই কথাই বলব। কিন্তু এ-মেয়েটিকে একবার দেখে এলে পারতে—কচি মেয়ে চোখে দেখলে পাপ হবে এমন তো শাস্ত্রে লেখেনি।

ব্রজ মুখ তুলিয়া বলিল,-আবার কোন্ মেয়ে?

নতুন সম্বন্ধ এসেছে কলকাতার মেয়ে। বাবার খুব পছন্দ হয়েছে কুষ্ঠীও মিলেছে। যাও না–দেখলে হয়তো পছন্দ হয়ে যেতেও পারে।

হুঁ। মেয়েটির বয়স কত? তিন না চার?

না গো না। আশ্বিন মাসে দশ পেরিয়ে এগারোয় পা দিয়েছে।

বলো কি! এখনো তার বাপকে কেউ একঘরে করছে না? তা—শিশুটির নাম কি?—পুঁটু না। বুঁচু?

ওর নাম মেথুশীলা।

ব্রজ কিছুক্ষণ হাঁ করিয়া চাহিয়া রহিল, শেষে হাসিয়া বলিল, ও, বয়সের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখবার জন্যেই বোধহয় এই নামকরণ হয়েছে। কিন্তু এখনি দেখতে যেতে হবে, আরো বছর দশেক অপেক্ষা করলে হয় না?

বৌদি রাগ করিয়া বলিলেন, তারা অতদিন হা-পিত্যেশ করে তোমার জন্যে বসে থাকতে পারবে না। তার ওপর আবার আইন হচ্ছে—

ব্রজ চিন্তা করিয়া বলিল—তাহলে বাবার ইচ্ছে আমি এই মেয়েকে দেখতে যাই?

হ্যাঁ। আর তোমার দাদাদেরও তাই ইচ্ছে।

বেশ, যাব। কলকাতায় একটা কাজও আছে। কিন্তু আগে থাকতে বলে রাখছি আমার পছন্দ হবে না। তখন দোষ দিও না।

.

বড়মানুষের বাড়িতে মেয়ে দেখা—যাহারা দেখিতে আসিতেছে তাহারাও বড়মানুষ সুতরাং উদ্যোগ আয়োজন ভালই হইয়াছিল। বৈঠকখানা ঘরের মেঝেয় কার্পেট পাতিয়া আসর প্রস্তুত করা হইয়াছিল। পাড়ার গণ্যমান্য কয়েকজন বয়োবৃদ্ধ বসিয়া গড়গড়া টানিতে ছিলেন। ব্রজর সঙ্গে আসিয়াছিলেন তাহার দুই বন্ধু।

যথাবিধি আদর-আপ্যায়নের পর কন্যার বাপ সর্গব হাস্যে জানাইলেন যে তাঁহার মেয়ে আজকালকার মেয়ের মতো নয়, তাহার বয়স মাত্র দশ বৎসর। বর্ষীয়ানগণ মাথা নাড়িয়া সায় দিলেন। তারপর মেয়ের বাপ অন্দরে গিয়া মেয়েকে হাত ধরিয়া লইয়া আসিলেন। মেয়ে গালিচার উপর বসিয়া করজোড়ে মাটিতে মাথা ঠেকাইয়া প্রণাম করিল।

মেয়েটি দেখিতে ছোটখাটো, দোহারা, রং খুব ফরসা, মুখের গড়ন চমৎকার। ব্রজ একবার তাকাইয়া নিরুৎসুক ভাবে বসিয়া রহিল, ভাবিতে লাগিল, মেয়েটা এখনো তাহাদের আগড়ুম বাগড়ুম খেলিবার জন্য আহ্বান করিতেছে না কেন? বন্ধুরা মেয়েকে প্রশ্ন করিতে লাগিলেন, সে মাথা হেঁট করিয়া জবাব দিতে লাগিল।

হঠাৎ কি একটা কৌতুককর প্রশ্নে মেয়েটি হাসিয়া মুখ তুলিয়া চাহিল। ব্রজর সঙ্গে তাহার চোখাচোখি হইয়া গেল।

ব্রজ তড়িৎস্পৃষ্টের মতো উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, দেখা হয়েছে এবার ভেতরে নিয়ে যান।

মেয়েটি প্রণাম করিয়া প্রস্থান কিরল।

কন্যার বাপ মতামত জানিতে চাহিলেন। ব্ৰজর সঙ্গে বন্ধুদের চোখে চোখে ইশারা হইল, তাঁহারা বলিলেন, পরে খবর পাঠাব।

পরে খবর পাঠানোর একটি মাত্র অর্থ হয়। গৃহকতা বিমর্ষ হইয়া কন্যার বয়সের অল্পতার দিকে আবার সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করিলেন। সকলেই তাহা একবাক্যে স্বীকার করিলেন। গৃহকর্তা তখন জলযোগের প্রস্তাব করিতেই ব্রজ কোনওমতে কাটাইয়া দিয়া উঠিয়া পড়িল।

ট্রেনে ফিরিতে ফিরিতে বন্ধুরা বহুবার জিজ্ঞাসা করিলেন, কিহে, ব্যাপারটা কি? খুলেই বলো না। পছন্দ হয়নি তা তো বুঝতে পারছি, কিন্তু কারণটা কি? মেয়েটি তো দিব্যি সুন্দরী। দেখতে একটু ছোট বটে, কিন্তু নেহাত দশ বছরের বলে তো বোধ হল না

ব্রজ বলিল, না, বয়স দশ-এগারো বছরের বেশী হবে না।

বন্ধুদের সে কোনও কথা ভাঙিয়া বলিল না, কেবল ভাবিতে লাগিল, মেজবৌদির সঙ্গে যখন এই লইয়া আলোচনা হইয়াছিল তখন কি ভগবান কান পাতিয়া শুনিয়াছিলেন?

বাড়ি ফিরিয়া ব্ৰজ জানাইয়া দিল যে মেয়ে পছন্দ হয় নাই—মেয়ে অত্যন্ত ছোট।

রাত্রে মেজবৌদিকে চুপি চুপি বলিল, বৌদি, সে মেয়ের বয়স দশ বছর নয়—আশি বছর। তার চোখের মধ্যে অনাদি কালের অভিজ্ঞতা জমাট হয়ে আছে। সে এক ভয়াবহ ব্যাপার,—সত্যিই ও-মেয়ে মেথুশীলা। তিনকালের বুড়ি জরাজীর্ণ হাড়-গোড় নিয়ে ওর বুকের মধ্যে বসে আছে।– ও মেয়ে নিয়ে আমি কি করব?—

এই বলিয়া ব্রজ শিহরিয়া চক্ষু মুদিল।

২ আষাঢ় ১৩৪০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *