মেঘাবৃত চাঁদ – আবু রুশদ
মালেকা যতই খুশি হবার ভান করুক, এটা সে অনেকদিন থেকেই বুঝেছে যে সে অসুখি। অথচ অসুখি হওয়ার কোন কারণ নেই। রউফ খুব সুশ্রী না হতে পারে, কিন্তু তা নিয়ে মালেকার মনে কদাপি আফসোস্ জাগেনি। হতে পারে, রউফের বুদ্ধি খুব প্রখর নয়—সেটা কিছু না। আর তাদের আর্থিক অবস্থাও এখন এত খারাপ হয়ে পড়েনি যাতে সে সম্বন্ধে তাদের মন খুব শঙ্কিত হয়ে উঠতে পারে। না, সে-সব কিছু নয়। রউফ যথার্থই অত্যন্ত ভদ্র ছেলে ও তাদের আর্থিক অবস্থা রীতিমত সচ্ছল। তবুও……।
নারী-পুরুষের মনের কামনায় এমন এক সূক্ষ্ম রহস্য আছে যা গোপন ও অনির্দেশ্য। অর্থের অজস্র প্রাচুর্য, যশের অপরিমাণ পরিবৃদ্ধি এবং রূপ-গৌররে জাজ্বল্যমান মহিমা কোনটাই সে শিথিল অথচ গৃঢ় কামনাকে শৃঙ্খলিত করবার পক্ষে যথেষ্ট নয়। তবে মালেকার পক্ষে কি কারণে যে এ-ভাবটা ক্রমেই কষ্টদায়ক হয়ে উঠেছে, অবান্তর, অশোভন ও পরিমাণহীনভাবে বিস্ময়কর, সেক্ষেত্রে অসুখি হওয়ারও কয়েকটা বিরক্তিকর দিক আছে। অস্বস্তিকর উদ্ধত পরিব্যাপ্তি যুবতী মালেকার কামনা-অন্ধ মনকে নিরন্তর বিব্রত ও বিমূঢ় করছে। এক এক সময়ে তার মনে জাগে বিক্ষুদ্ধ সমুদ্র-উন্মাদ আলোড়ন, মন দুরন্ত তীব্রতায় ঝক্কাসক্ত কুটিলতায় হয়ে ওঠে অশাসনীয়, হৃদয়ারণ্যের প্রতি পুষ্প ও মুকুলে, আকাঙ্খরুদ্ধ প্রতি গোপন স্তরে অতৃপ্ত কানার প্রজ্জ্বলিত অগ্নি ভীতিপ্রদ উত্তাল বিক্ষোভ জাগিয়ে তোলে। চঞ্চলবিহারী পৃথিবী যৌবনের মাতাল গরিমায় শরাহত হয়ে যখন কুহকমুগ্ধ আবেশে শিথিলিত, যুবতী মালেকা তখন তার নিরুদ্ধ আবেগকে কি করে শান্ত রাখতে পারে? হে অনন্ত আকাশ! মদির আনন্দের মায়াস্পর্শে লীলনারসোচ্ছল ধরণী মহিমময়ী, কিন্তু মালেকার মনে এ কি ব্যথার গুঞ্জরণ!
মফঃস্বল শহরের অনেকরকম অসুবিধার মধ্যে এটা অন্যতম প্রধান যে, এখানে বেড়াবার জায়গা কম। সময় যখন নির্জনতা রউফের মন্দ লাগে না, কিন্তু নীরবতা ও নির্জনতার বিরামহীন ভারে তার মন জর্জরিত। রউফ বার্ণাড শ’ বা সলোমান না হলেও সে একথা চমৎকার বোঝে যে ব্বিাহে মালেকা সুখি নয়। কেন নয় তা রউফ-এর কাছে এক আশ্চর্য রহস্য। সুতরাং সে নির্জনতা না পেতে চাইলেও নির্জনতা তার মধ্যে কামনা করে। স্থূপীকৃত নীরবতা রউফের সক্রিয় কর্মচঞ্চল মনকে ক্রমশ পঙ্গু করছে।
নদীর দিকে রউফ বেড়াচ্ছিল। আশ্বিনের মাঝামাঝি। সন্ধ্যা আসন্ন। বিবাহের পর থেকে একটা নিতান্ত অস্বস্তিকর ভাব রউফের মনকে অভিভূত করে আসছে। স্পষ্টত রউফ একথা নির্বিবাদে মানে যে মালেকাকে সে ভালবাসে। প্রতিদানে মালেকার সামান্য ভালবাসা পেলেও সে নিজকে ধন্য মানবে। বিবাহের প্রথম রাত থেকেই ধরা যাক না কেন। অবশ্য তাতে বোঝা যাবে না, মালেকা রউফের প্রতি এত নির্দয় কেন। বিবাহের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তকারী বাক্যের বাণ ছেড়ে আমরা আকাশে আগুন ধরাতে পারি, কিন্তু মনের নিভৃততম কামনায় এটা আমরা মানবই যে একেবারে বিয়ে না করার চেয়ে বিয়ে করে অসুখি হওয়াই বরং ভাল। অতএব বিবাহের যে একটা অনাস্বাদিত ও স্বতন্ত্র মাধুর্য আছে তা সর্বদা স্বীকার্য। তাই রউফ যদি বিয়ের প্রথম রাতে নবপরিণীতা বধুর সঙ্গে খানিকটা হৃদ্যতা করবার চেষ্টা করে থাকে, আমরা তাকে দোষতে পারি না। কিন্তু রউফের সে একান্ত স্বাভাবিক প্রয়াস করুণ অধ্যবসায়ে পরিণত হয়েছিল মাত্র। যে কামনা স্বতঃস্ফূর্ত তা কৃত্রিমতার অনুশাসনে কক্ষভ্রষ্ট হতে পারে না। হদয়ের-উচ্ছল মাধুরী মালেকার শীতল কঠোরতায় প্রতিহত হয়ে রউফকে ব্যথিত করছিল। মানব-মনের গতি বিচিত্র বিচিত্রতম প্রেমের গতি। মালেকা যে খুশি হতে পারছে না সে-দোষ নিশ্চয়ই রউফের নয়। বরং বিপরীত। কিন্তু মালেকা নিজের যৌবনকে ব্যর্থ করছে কেন? রউফের প্রতি মালেকার এমন কি অপরিসীম করুণা থাকতে পারে যাতে সে তার নিজের সুখকেও সমাধি দিতে কুণ্ঠিত নয়? রউফ একটা কসম খেয়ে বলতে পারে, মালেকা নিজের সুখের পথ বেছে নিলে সে দুঃখিত হলেও রুষ্ট হবে না। মালেকার সুখেই তার সুখ। এটা নিশ্চয়ই আশা করা যেতে পারে না যে একটা মেয়ে তোমাকে ভালবাসতে না পারলেও ভালবাসবে। একথা বুঝবার মত বুদ্ধি রউফের আছে যে ডাকাতি করে কারও হৃদয় জয় করা যায় না। তবে এটা হাস্যকর যে মালেকা তাকে না ভালবাসলেও তার ঘর করবে, কোন কোন রাত্রে একই বিছানায় শুয়ে দাসীদের সাথে কথা বলে মাঝে মাঝে তাদের ধমকাবে প্রেমের বাহ্যিক একটা কৃত্রিম আবরণে নিজের মনের ক্ষুব্ধ কামনা সব রাখবে আবৃত। এখন দুঃসহ কষ্টদায়ক কৃত্রিমতার কুটিল তরঙ্গ যদি ক্লান্তিকর প্রাত্যহিকতায় নিত্যই তাদেরকে আবৃত করতে থাকে, তবে একদিন রউফ নিশ্চয়ই পাগল হয়ে যাবে।
সংশয়হীন ভাবে একথা বলা যেতে পারে, রউফ ও মালেকা কেউ এ-বিবাহে সুখি হতে পারছে না। দীর্ঘ তিন বৎসর পারস্পরিক প্রবঞ্চনার কুহেলিকায় কেটে গেছে। এখনও কাটছে এবং মনেতে দুঃখ হয়, হয়ত এমনি করেই তাদের জীবনের হবে যবনিকাপতন ব্যর্থতার শুষ্কতায়, যৌবনের করুণ অপমৃত্যুতে, অতৃপ্তির সীমাহীন হাহাকারে।
অবশ্য এমন নয় যে নিত্যই তাদের ঝগড়া হচ্ছে। যেখানে প্রেমের ভিত্তি সুদৃঢ় নয়, সেখানে বিবাদ হয় কচিৎ। যা রউফ পৌরুষের বর্বর শাসনে মালেকাকে নিপীড়িত করেছে। মনে মনে মালেকা তার প্রতি রউফের বিস্ময়কর কোমলতার কথা উপলব্ধি করে অভিভূত, বিমূঢ় ও শঙ্কিত হয়। রউফের আশ্চর্য বিবেচনা-বোধ মালেকার মানসিক অশান্তিকে নানাভাবে বাড়িয়ে তুলেছে। তবুও বাইরে থেকে দেখলে এটা বোঝা যাবে না যে তারা অসুখি। সামাজিক প্রয়োজনের চাপে মাঝে মাঝে তাদের এমন জায়গায় এসে পড়তে হয়, যেখানে ভালবাসার অভিনয় করা অপরিহার্য এবং সংসারে থাকতে হলে আরও বিবিধ আনুষঙ্গিক অনুশাসন তো আছেই।
অত্যন্ত নবীন উকিল বলে রউফের ওপর কোন মামলা-মকদ্দমার ভার ছেড়ে দিতে অনেকেই ভরসা পায় না। যে দু’একটা পায় তা সময়ের অন্তহীন প্রাচুর্যকে পূরণ করবার পক্ষে যথেষ্ট নয়। এখানে এমন কোন লোকের সাথে রউফের জানাশোনা নেই যাদের বন্ধু বলা যেতে পারে। আর আড্ডা দিতে ভালও লাগে না রউফের। কিন্তু যে অখণ্ড অবসর এখনও রউফকে পীড়া দিচ্ছে তা রসে, লীলায় ও যৌবনোচ্ছল কামনায় ভরপুর হয়ে উঠতে পারত, যদি….তবে মানব জীবন ‘যদি’র স্থান নেই। তাই রউফের ওকথা নিয়ে আফসোস করা শোভা পায় না যে মালেকা তার প্রেয়সী নয়। তথাপি রউফ তার জীবনের এ বৃহৎ দুঃখ নিয়ে সব সময় দুঃখাভিভূত হয়ে থাকতে পারে না। আচম্বিতে তার মন এক-এক সময় অযথা খুশি হয়ে ওঠে—মনের চাপা আনন্দ আকস্মিক আশ্রয় পেয়ে দিগ্বিদিকে সুতীব্র বেগে ছড়িয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে এমন হয়। অকারণ পুলকের গাঢ়চ্ছন্দে মন নাচতে তাকে। টুকরো টুকরো রঙ মনের সর্বত্র একটা মদির-মোহ জাগিয়ে তোলে। ইচ্ছে হয়, লুকিয়ে গান করবে। আর গোপনে চোখের পাতা ভিজে ওঠে। পরিব্যাপ্তিহীন আনন্দের রঙ্গ ঝলকে ঝলকে রূপান্তরিত হয়ে মনে জন্ম দেয় এক অধকরুণ বিভ্রম। একারণেই সহস্র দুঃখ-বেদনা সত্ত্বেও মানব-জীবন এত অসম্ভবভাবে অপরূপ। রউফের মনে সে পরিমাণহীন সুখ উত্তাল হয়ে উঠলো সন্ধ্যারদিকে। কি এক উৎসব উপলক্ষে রউফের কোন এক আত্মীয় তাদের নিমন্ত্রণ করেছেন। মালেকা সেজেগুঁজে এল। মালেকার সাজসজ্জার নিপুণ ভঙ্গিমা রউফকে বিস্মিত, অভিভূত, বিমুগ্ধ করে তুলল। পশ্চিমের আকাশে তখন রঙের আগুন লেগেছে। রঙের বিচিত্র সমারোহে ঘন-সন্নিবিষ্ট শ্যামল বৃক্ষের পত্র পুষ্প-পল্লব বিচিত্র হয়ে এক বিভ্রান্তকারী শোভার সৃষ্টি করেছে। বিলীয়মান সূর্যরশ্মির সুরঞ্জিত তির্যক গতি মালেকার শাড়িতে চোখে ঠোঁটে গালে ও কেশের মধুর হিল্লোলে প্রতিফলিত হয়ে রউফের মনকে অদম্য আকাঙ্খায় উদ্বেলিত করছে। মালেকার কি পরিমাণ-জ্ঞান নেই। এ কি কৌতুক? রউফ আজকে সুখি—পরিপূর্ণ নিবিড় একান্তভাবে সুখি।
করুণাময়ীর মত মিষ্টি হেসে মালেকা বলল–অমন করে তাকিয়ে আছ যে! যাবে না?
—নিশ্চয়ই। মিনিট দশেক দাঁড়াও, এবান্দা এখনই এসে হাজির হবে। বলে রউফ বিসদৃশ এক দ্রুত ভঙ্গিতে চলে গেল।
ঘোড়ার গাড়িতে। যে-গতিতে গাড়িটা চলছে তাতে মনে হয় না ঘণ্টাখানেক আগে নির্দিষ্ট জায়গায় তারা পৌঁছতে পারবে। নীরবতা জানালা দিয়ে চোখ বাড়িয়ে মালেকা বাইরের দিকে চেয়ে আছে। ইচ্ছাকৃত ঔদাসীন্য। আড়চোখে মালেকার দিকে চেয়ে রউফ দেখল সমস্ত বিশ্বের নির্লিপ্ততা যেন তার মুখে। কিন্তু রউফ পুরুষ, সেও কঠিন হতে জানে। বাইরের দিকে চেয়ে মালেকা বুঝি কিছু একটা সঙ্কল্প ঠিক করছিল। হঠাৎ নিষ্কম্প চোখ রউফের দিকে চেয়ে মালেকা বল্লে : তুমি আমার থেকে পালিয়ে থাক কেন? কে তোমায় বলেছে তোমায় যে তোমায় আমি ভালবাসি না বা তোমায় কখনও ভালবাসতে পারব না?
চারদিকে যে মধুর পারিপার্শ্বিকতা মোহিনী মায়ায় কোমল ও মৃদু হয়ে আছে, তার সাথে, মনে হয়, সুন্দরী মালেকার এই মায়া-স্মিত অভিযোগের কেমন বিচিত্র সামঞ্জস্য। রউফ খানিকক্ষণের মত হতভম্ব হয়ে যায়। কিন্তু মালেকার স্বরে এমন এক শীতল অনাসিক্ত, এমন এক অথর্ব ঢং আছে যে রউফ সহসা হেসে ওঠে। তাই তো, কে বলল আমাকে যে তুমি আমায় ভালবাসো না। তাই তো রউফের মুখ কৃত্রিম বিস্ময়ে হাল্কা। রউফের ঘুম অনেক, তবে অভিনয়ে সে পটু নয়। কিন্তু তাকে নিয়ে মালেকা ছিনিমিনি খেলবে— এ্যাবসার্ড। মালেকা হাজার হলেও স্ত্রীলোক। তাকে না ভালবাসার যথার্থ অধিকার মালেকার নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু তাই বলে সে রউফকে এমন করে আঘাত করতে পারে না। মালেকা ভুলে গিয়ে ভাল করেনি যে তার সমস্ত সুখ ও সম্মান রউফের করুণার উপর নির্ভর করছে। ইচ্ছে করলেই রউফ তার জীবনকে কুত্র শাসনে অতিষ্ঠ করে তুলতে পারে। তার রূপ সুখ-সমৃদ্ধি সব কিছু সে নির্দয় ঝটিকাঘাতে করে দিতে পারে বিধ্বস্ত। সে সীজার।
ফেরবার সময়! এত রাতে মফঃস্বল শহরে গাড়ি পাওয়া যায় না। তাদের বাসা অবশ্য মাইলখানেকের বেশি হবে না। সুতরাং হেঁটে ফিরে আসতে এমন কষ্ট হওয়ার কথা নয়। হেঁটে হেঁটে তারা এগিয়ে চলেছে। আকাশে চাঁদ নেই। চারদিকে নিবিড় আঁধার। সুউচ্চ বৃক্ষের শাখায়, দুপাশের গভীর খাদে নিস্তব্ধ নিশীথের নিরঙ্কু আঁধারের ভয়াবহ নিষ্পেষণ। টর্চের আলো ফেলে পথ চিনে নিতে হয়, মনে হয় কোন বিশাল কৃষ্ণগ্রহ আকাশ থেকে বিপুল বেগে খসে পড়ে তার বিরাট অবয়বের নির্দয় চাপে ধরিত্রীকে এসে শ্বাসরুদ্ধ করে তুলছে। পাঁচগজ দূরের জিনিস দেখা যায় না। সর্বত্র দিকচিহ্নহীন তমিস্রার অন্তহীন পরিব্যাপ্তি আঁধারে ভয় পেয়েই হয়ত মালেকা রউফের একান্ত সন্নিকটে সরে এল। এত কাছে সে সচকিতা মালেকার ভীরু মৃদুশ্বাস রউফের মনে এক উষ্ণ শিহরণ জাগিয়ে তোলে। কি পরিপূর্ণ নির্ভরতা মালেকার এ করুণ অসহায়তার মধ্যে ফুটে উঠেছে! চারদিক স্থির নিষ্কম্প। কেউ কোথাও নেই। খালি রউফ আর মালেকা। চন্দ্রহীন রাত্রি নিরস্ত্র তমিস্রা যৌবনচঞ্চলা ধরিত্রীকে সমাধি-ভূমির বীভৎস গোপনতায় সমাহিত করছে। আর সে-ধরিত্রীর কর্কশ বুকে বিচরণ করছে মাত্র দুটো মানুষ রউফ আর মালেকা। খালি মালেকা–রউফকে ভালবাসে না। হঠাৎ রউফের মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে! আচ্ছা, এখন যদি সে মালেকাকে বুকে পিষে ধরে অজস্র চুম্বনের বন্যায় তার ঠোঁট পুড়িয়ে দেয়, নির্দয় দস্যুর মত মালেকার শরীরের সমস্ত সৌরভ কলঙ্কিত করে দেয়—পারবে মালেকা তার বর্বর শক্তি প্রতিরোধ করতে? পারবে? মালেকার দেহ নিয়ে রউফ এখন ছিনিমিনি খেলতে পারে। পারে। পারে তো? আলবৎ পারে। কিন্তু মালেকা একথা কি বোঝে? উত্তেজনার চাঞ্চল্যে রউফ লক্ষ করবার সময় পায়নি, স্টেশনটা কাছে এসে পড়েছে। বাসা আর নি মিনিটের রাস্তা। মালেকা রউফের আর অত কাছ ঘেঁষে নেই। সিগন্যালের লাল সবুজ হলদে রঙের তীক্ষ্ণ প্রখরতা চারদিকের গাঢ় আঁধারকে রহস্যাচ্ছন্ন করে তুলছে।
বছর দেড়েক এমনি করেই কাটল। এ-সময়ের ব্যবধানে সহস্রভাবে মালেকা রউফকে ভালবাসবার চেষ্টা করেছে। সফল হয়নি। ফলে মালেকা অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। সঙ্গে সঙ্গে রউফও যৌবনের অপরিমিত ক্ষুধায় গোপনে গোপনে বহির্মুখী হয়ে উঠছে। এমন অপরিবর্তিত কৃত্রিমতায় যদি অবস্থার স্রোত প্রবাহিত হতে থাকে, তবে তা নিশ্চিতভাবে কেলেঙ্কারির স্তরে পর্যবসিত হবে। হতে বাধ্য।
সেদিন হাসি হাসি মুখে মালেকার কাছে এসে রউফ বললঃ একটা সুখবর আছে, আন্দাজ করতে পার?
—আমি গণক নই! মালেকার সংক্ষিপ্ত উত্তর।
—অবশ্য এ-খবরে তোমার সুখি হওয়ার কথা নয়, কিন্তু আমার মন নাচিছে আজিকে ময়ূরের মত নাচিছে।
বলেই ফেল খটা। দেখি এসুখ শুনে আমার মনও ময়ূরের মত নেচে ওঠে কিনা।
ব্যাপারটা হল এইঃ আমার এক বাল্যবন্ধু না হল না, আমার এক অভিন্নহৃদয় শ্রেষ্ঠবন্ধু দীর্ঘ বারো বৎসর পরে এ অভাগার গৃহে খুব শীঘ্র শুভাগমন করছে। ছেলেটা অদ্ভূত, এখন বিয়ে করেনি। আসামে ইঞ্জিনিয়ার রউফের স্বর ক্রমেই ভাবোদ্বীপক হয়ে উঠছে—আচ্ছা, এটা ভাবতে তোমার মজা লাগছে না যে যার সাথে এককালে আমার স্বচেয়ে বেশি ভাব ছিল তাকে এ বারো বৎসর না দেখেও আমার দিন সুখেই কাটছিল অথচ এখন সে আসবে বলে আমার মনে খুশি উপচে পড়ছে। সত্যি সত্যি আজকাল সকলের সাইকোলজি পড়া উচিত।
কিন্তু রউফ উৎসাহের প্রাবল্যে যদি অনর্গল কথা না বলে যেত, তাহলে সে দেখতে পেত, মালেকার মুখ ছাইয়ের মত ধ্বির্ণ হয়ে ওঠে রাগরক্তিম প্রখরতায় ঝলসাচ্ছে। এবং তাহলে নিশ্চয়ই সে অবাক হবার সময় পেত।
রউফ বলে যেতে লাগল। ছেলের নাম মফিজুল। কম বজ্জাত ছিল ছোটবেলায়? লালমনির হাটে থাতে আমাকে সঙ্গে নিয়ে পেয়ারা চুরি করতে গিয়ে কি বিপদেই না ফেলেছিল।
কথা বলার মাঝখানে যদি রউফ একবার মালেকার দিকে চেয়ে দেখত, সে আবার দেখতে পেত, মালেকার মুখ পাষাণের মত স্থির অস্বাভাবিক।
মালেকার ঠোঁটের কোণে তির্যক হাসি শাণিত তীক্ষ্ণতায় ঝকঝক করতে থাকে। রউফের বন্ধু অনেক দিন পরে কি এক কাজে এখানে আসছে, তাতে মালেকার খুশি বার বাস্তবিকই কি থাকতে পারে? মফিজুল হল রউফে ভিন্ন হৃদয় শ্রেষ্ঠবন্ধু। নয় মালেকার।
মনোবিচ্ছেদের একাহিনী যে সর্পিল গতিতে ক্রমেই জটিল হয়ে উঠেছে, তাতে একটা জিনিস সম্বন্ধে অবহিত হবার সময় আমরা পাইনি। মালেকার মানসিক অস্বাচ্ছন্দ্যের মূলভিত্তি কোথায় সে সম্বন্ধে মালেকার কোন স্পষ্ট ধারণা না থাকলেও আমরা অন্তত আংশিকভাবে তা অনুমান করতে পারি। সংক্ষিপ্ত কথায় ও কিশোর বয়সে মালেকা একবার প্রেমে পড়েছিল। তার বিস্তৃত আলোচনা আমাদের আগ্রহের বিষয় নয়। লু মালেকার মনের অশাস্তির সঙ্গে ও এ অতীত প্রেম এক সূক্ষ্ম সূত্রে গ্রন্থিত, এমন এক সংশয় আমাদের মনে ছায়াপাত করা অন্যায় হবে না।
যে বয়স সবেমাত্র পৃথিবীর অজস্র ইঙ্গিতে ধ্বনিত হয়, রূপস গন্ধের নিটোল সমারোহ ধরিত্রীকে মর্মরিত করে, ছায়াস্বপ্নে মানুষের মন মদির আকুলতায় হয়ে ওঠে আবেশমুগ্ধ, ধরনী যখন সঙ্কেতময়, সঙ্গীতময় অপরূপ, মালেকা তার কিশোরহৃদয়ে সমস্ত সুধা উজাড় করে একজনকে ভালবেসেছিল তখন।
–আমাদের মফিজুলকে।
তবে মালেকাকে যদি প্রশ্ন করা হয়ঃ মফিজুলকে তুমি এখনও ভালবাস কিনা, ব্যর্থ প্রণয়ের বেদনাই তোমার, অসুখি হওয়ার কারণ কিনা মালেকা তৎক্ষণাৎ উত্তর দিবে না। সে যে সুখি হতে পারছে না তার কারণ নয় সে অতীত প্রেম! অন্তত মালেকা তা কিছুতেই মানবে না। মফিজুল সম্বন্ধে তার সমস্ত দুর্বলতা এখন মৃত, নির্জীব।
সুতরাং একাহিনী যে বিরক্তিকর মনোবিচ্ছেদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে একটা ভীতিপ্রদ রূপ নেবার অপেক্ষায় ছিল তা আকস্মিক পরিবর্তনের আঘাতে একটা স্বতন্ত্র গতি বেছে নিচ্ছে। মালেকার জীবনে এসেছে বসন্ত এসেছে আকাশকে রক্তিম স্মৃতিতে রঞ্জিত করে, বাতাসকে নিগূঢ় মাধুর্যে উজ্জীবিত করে, হৃদয়ের নবোগত মুকুলকে পুষ্পসৌরভে আকুল করে। হোক সে ক্ষণিক। সমুদ্রের বুকে সাইক্লোনের ক্ষুব্ধ অভিব্যক্তি ক্ষণিক হলেও বিপজ্জনক।
অবশেষে মফিজুলের আসারদিন আসন্ন হয়ে এল। দিন সাত পরেই সে আসবে। আশা করা যায়। বাসার বাগানে বেড়াতে বেড়াতে রউফ মালেকাকে প্রশ্ন করল? যাঃ, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে একেবারে ভুল হয়ে গেছে। মফিজুল এখানে। আসবে বলে তোমার তো কোন অসুবিধা হবে না?
–অর্থাৎ? মালেকার–দুটো প্রশ্নে শরনিক্ষেপ করল।
—মানে, একটা অপরিচিত লোক এখানে আসবে, তাতে তুমি খানিকটা অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলেও তো করতে পার।
-কোন ভদ্রলোকের বাসায় একজন ভদ্রলোক এলে কোন ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলা সঙ্কোচ হওয়ার কথা নয়। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে কথ্যভাষার ওপর মালেকার দখল যথার্থই লক্ষযোগ্য।
—আই বেগ ইওর পাৰ্ডন। রউফ যেন লজ্জিত।
শীতকালের দ্বিপ্রহরে। শীতল বাতাসের শন শন ধ্বনি নারকেল গাছের পাতাগুলোতে দোল দিচ্ছে। বহু ঊর্ধ্বে দিগব্যাপী আকাশে পাখিরা উড়ে বেড়াচ্ছে। মুক্ত বন্য অপ্রতিহত তাদের গতি। মফিজুলকে আনতে রউফ স্টেশনে গেছে। ঘরে মালেকা একা। জানলা দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে। শ্রান্তির আবেশে মালেকার শরীর শিথিলিত। মন তার ফাঁকা।
সহসা মৃদু শীতল বাতাস চাপা সঙ্কেতের শিহরণে মালেকার শরীর বিদীর্ণ করে তার হৃদয়ের সর্বত্র ভীরু রোমাঞ্চ জাগিয়ে তোলে। মর্মনিহিত আনন্দের কুণ্ঠিত স্পন্দনে তার প্রাণ কাঁপছে ভীরু পায়রার মত। কাঁপছে, কাঁপছে। মৃদু সঙ্গীতময়। অনেক দুরে ঝাঁপসা রেখার ছায়াবরণে যেন দেখা যায়, কোন নারীর চুম্বন-শিথিল ওষ্ঠ কাঁপছে, প্রিয়তমের দিকে চেয়ে প্রণয়িণীর মায়াকাজল চোখে যেন লেগেছে কুহকের প্রলেপ। সূক্ষ্ম গোপন অব্যক্ত আনন্দের গাঢ়চ্ছন্দ। এবং মালেকা তার কম্পিত দৃষ্টির সম্মুখে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মফিজুলের মুখ।
আমরা জানি না, মালেকাকে দেখে মফিজুলের মন কেমন করেছিল-সে বিবরণ আমাদের কাহিনীতে প্রক্ষিপ্ত। তবে মফিজুল সম্বন্ধে আমরা একটা ধারণা করতে পারি। মফিজুল সে শ্রেণীর লোক, যাদের হৃদয় অত্যন্ত কোমল। প্রেমের মধ্যে যারা নিজেদেরকে পরিপূর্ণভাবে ডুবিয়ে দিতে পারে, অথচ প্রেম-পথ যদি বাধাসঙ্কুল হয়, তারা বুঝতে পারে না–তলিয়ে যায়, হারিয়ে যায় যদিও মালেকাকে রউফের স্ত্রী হিসাবে দেখবার প্রত্যাশা মফিজুল তথাপি করেনি, তথাপি এ-আবিষ্কার তার পক্ষে এমন-কিছু নয় যাতে একটা রোমান্টিক সম্ভাবনা কাউকে চকিত করে তুলতে পারে।
চায়ের জলসায়।
মফিজুল বললঃ থাকিত জঙ্গলে, তাই এখানে এসে মনে আনন্দ অনুভব করতেও ভয় হয়। এ-টাউনটা সত্যিই চমৎকার।
রউফ আচমকা প্রশ্ন করল? তোমার বয়স কম-সেকম ত্রিশের কোঠায়। অতএব এখনও তোমার বিয়ে না করাটা আশ্চর্য ব্যাপার।
চোখ নিচু করে শান্তস্বরে মফিজুল বলে? বিয়ে করার আকর্ষণ এখনও টের পাচ্ছিনে। যখন দেখব, বিয়ে করাটা আমার পক্ষে খুব দরকারি হয়ে উঠেছে, তৎক্ষণাৎ বিয়ে করে ফেলব। মালেকার মাথায় বিদঘুঁটে খেয়াল আসে। দুঃসাহসী কণ্ঠে বলল : যদি কিছু না মনে করেন, একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করি।
–বলুন! মফিজুলের স্বর অবিচলিত।
–কখন কোন মেয়েকে আপনি ভালবেসেছিলেন?
এ সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে খানিকক্ষণের মত মফিজুল স্তব্ধ হয়ে গেল। মুহূর্তে সামলিয়ে নিয়ে বল ব্যবহারিক দিকটা আমার মধ্যে এত নিবিড় যে আমার পক্ষে প্রেমে পড়া কস্টিটিউশানালি অসম্ভব।
—ওঃ মালেকা যেন ক্ষুব্ধ হয়েছে।
শহরের যে দিকটায় নদী, ওখানে যারা থাকে না, তারা কয়েক দিন সেদিকে বেড়িয়ে আনন্দ পেতে পারে। সেদিকেই রউফ, মফিজুল আর মালেকা যাচ্ছিল। আজকের সন্ধ্যা মিষ্টি। শীতের হাওয়া তীক্ষ্ণ হয়নি। রঙের প্রদীপ্ত বৈচিত্র্যে আকাশ রক্তিম, মনোহর। কোথায়ও রেডিওতে গান হচ্ছে। শীতের মৃদু বাতাসে সে মাধুর্যের প্রলেপ। নানারকমের বিচিত্র পাখির ধ্বনি চিত্তহারী। শীতকালে এমন স্বচ্ছ মধুর সন্ধ্যা সচরাচর দেখা যায় না।
—মফঃস্বল শহরে এসে খানিকটা ভোলা জায়গা পাওয়া আর ফ্রি এয়ার নেওয়া মনের পক্ষে বাস্তবিকই স্টিমুলেটিং! নীরবতা ভেঙে মফিজুল বলে উঠল।
-মাস দুয়েক থেকে যাও, দেখবে এখান থেকে পালিয়ে যাবার জন্য তোমার মন ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছেড়েছে। রইফের ঠাট্টা করবার একটা সরল ভঙ্গী আছে।
–আপনার মত কি? মালেকার দিকে আড়চোখে চেয়ে মফিজুল জিজ্ঞেস করে।
মালেকা মৃদু হেসে জবাব দিল : এ মফঃস্বল শহরে একটানা আমি আট বৎসর ধরে আছি তাই আপনার কথার ঠিক জবাব আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু ছোট বেলায় স্বাস্থ্যশিক্ষায় যা পড়েছি, সে-বিচারে আপনার কথাটা নিখুঁতভাবে সত্যি।
—আপনার কথাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। মফিজুল বিনা দ্বিধায় স্বীকার করল।
এবার নির্দয়ভাবে মালেকা খোঁচা দেয় ও কয়েকটা এমন এলেমেন্ট্রি কথা আছে। যা বোঝাতে গেলেই বরং গোলোযোগ হয়ে পড়ে।
প্রত্যাগমন। ইতিমধ্যে কখন পৃথিবীর বুকে গাঢ় হয়ে আঁধার নেমে এসেছে। ঝি ঝি পোকার ধ্বনি। চলতে চলতে এমন জায়গা এল যেখানে দুপাশে ঝোঁপের মাঝখান দিয়ে একটা খুব সরু রাস্তা এঁকে বেঁকে গেছে। যেতে যেতে মালেকা তার আনত চোখ তুলে মফিজুলের দিকে সহসা চায়। তার মনে হয়, কোন এক নিপুণ শিল্পী একটা কঠিন শীতল ভাব মফিজুলের মুখে খুদে খুদে বসিয়ে দিয়েছে। আর কেমন অদ্ভুত বিষণ্ণ! হয়ত মালেকা ঠিক দেখেনি। অথবা আঁধার সেখানে নিঃসীম বলেই হয়ত মালেকার এ সাময়িক বিভ্রম। কে জানে! তারপর খানিকদূরে গিয়ে বিস্মিত মালেকা বিমূঢ় দৃষ্টিতে ওপরে চেয়ে দেখে শীতের ধূসর সবুজ আকাশে সোনালী চাঁদ। সঙ্গে সঙ্গে একটুকরো মেঘ চাদকে ছেয়ে ফেলল। পাণ্ডুর চাঁদ। নিষ্কম্প। মলিন। বেদনার বিকৃতিতে নীল। কঠিন ব্যথার দুঃসহ আঘাতেই হয়ত বা পাণ্ডুর; কিন্তু মালেকা জানে, চ্যাঁদের এ মলিন আবিলতা ক্ষণস্থায়ী, কিছুক্ষণ পরেই চাঁদের শুভ্র সোনালী দ্যুতি এই ক্ষণিক মলিনতা দূর করে ধরণীর সমস্ত কিছুকে আনন্দোজ্জ্বল মাধুর্যে ঝলমলে করে তুলবে। কি আশ্চর্য! মালেকা কিন্তু জানে না, সে মফিজুলকে ভালবাসে কি না? প্রেম? ধ্যেৎ। কি ও? ভালবাসা, মফিজুল; রউফ। ফু।
কালকে ভোরে মফিজুল আসামে ফিরে যাবে। যে নিরতিশয় মধুর উচ্ছ্বাসে মালেকার হৃদয়কে এ কয়দিন উদ্বেলিত করে আসছে, কালকে তার অপমৃত্যু। মালেকার জীবনে যে ক্ষণবসন্ত সুপ্রচুর আনন্দ নিয়ে দেখা দিয়েছিল, আর ঘণ্টা কয়েক বাদে তার আকস্মিক পরিসমাপ্তি। তার হৃদয়ে যে অঙ্কুর এতদিন মুকুলে রূপান্তরিত হয়ে পুষ্পপল্লবের অপেক্ষায় ছিল, ঘনঝঝা তাকে নির্মমভাবে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
মাঝরাতে মালেকার ঘুম ভেঙে যায়। পাশে চেয়ে দেখে, রউফ অঘঘারে ঘুমুচ্ছে। মালেকার মন ধীরে ধীরে বিপজ্জনকভাবে উন্মাদ হয়ে উঠছে। মালেকা এ কথাটা এখন অভ্রান্তভবে বুঝেছে : মফিজুল তার মন, হৃদয়, সমস্ত সত্তা জুড়ে বিরাজ করছে। বিবাহ-অবধি যে-সুখের সামান্য ছোঁয়াচ তার মনে লাগেনি, সে কয়দিন এসে মফিজুল সে তুলনারহিত সুখের প্রখর প্রবাহে তার মনকে উদ্দাম করে তুলেছে। মালেকা এটা নিশ্চিতভাবে জানে যে মফিজুলও তাকে ভালবাসে। চিরকালের ভীরু মফিজুল এখনও তাকে আগেকার মতই নিবিড়ভাবে জানে যে মফিজুলও তাকে ভালবাসে। চিরকালের ভীরু মফিজুল এখনও তাকে আগেকার মতই নিবিড়ভাবে কামনা করে। সন্দেহ নাই, পরস্পরের প্রতি তাদের প্রেম এখনও অম্লান। তবু একটা কি অদ্ভুত, তারা মিলিত হতে পারছে না তাদের মাঝখানে একি দুস্তর বাধা? মালেকা
স্পষ্ট অনুভব করছেঃ দুর্বল হৃদয়, নিজের অধিকার সম্বন্ধে সদা-সঙ্কুচিত মফিজুল তাকে না পাওয়ার সান্ত্বনাহীন দুঃখে কেঁদে কেঁদে হয়রান হচ্ছে। কাছে বোকার মত, শিশুর মত। অবোধ বোকা শিশু মফিজুল!
বিদ্রোহের নিরুদ্ধজ্বালা মালেকার মনকে আবেগের কঠিন প্রতিঘাতে দুর্দমনীয় করে তুলছে। হঠাৎ মালেকার দুর্বার ইচ্ছা হয় বারান্দায় টহল দিতে। ইংরেজি অনেক বইয়ে সে পড়েছে, এমন অবস্থায় এমন সময় বারান্দা পরিভ্রমণ করলে আকাঙ্খিত প্রিয়জনের দেখা পাওয়া যায়। পালিয়ে যাবে তারা এখান থেকে অনেকদূরে, কোন। অদৃশ্য ছায়ালোকে—যেখানে বেণীকুঞ্জ পাখি ফুল নদী আর তারা দুজন। কিন্তু অপরিসীম আলস্যে মালেকার শরীর ও মন দুই ভেঙে পড়েছে। মালেকার সামর্থ্য নেই সাড়া দেবার। মালেকা প্রাণহীন অচেতন।…..
এত গভীর রাতেও আকাশ আশ্চর্যভাবে নীল। আকাশ থেকে নীল গলে গলে পড়ছে যেন। আকাশস্থিত অজস্র তারা দিগ্বিদিকে একটা বিভ্রমকারী শোভর সৃষ্টি করেছে। এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে পড়েছে যেন অগণিত শাদা ফুল! মালেকা অবাক হয়। নিজের নিরুপম সৌন্দর্যে আকাশকে নিত্যই নীলায়িত করবার এ কি লজ্জাকর নিবিষ্টতা! কেউ বোঝে না, কি এ শোভার অর্থ!
মফিজুলকে বিদায় দিতে গিয়ে কেঁদে লাভ আছে। এত ভোর যে আকাশ এখনও ঠিক করে রাঙেনি। দূরবর্তী বৃক্ষরাজির নিবিড় শ্যামলতায় ঈষৎ রক্তাভ আভা লেগেছে মাত্র। স্টেশনটা খুব কাছে। ট্রেন আসার ঘণ্টা পড়ল। ক্রমে পূর্বদিক লালটকে হয়ে সূর্য উঠছে। ট্রেনটা এসে পড়ল। তখন বহুদুরের গাছের সারি দেখা যাচ্ছে–স্বচ্ছ আকাশ ধীরে ধীরে প্রভাত্রে প্রথম বর্ণচ্ছটায় রঞ্জিত হচ্ছে সহসা-উদিত সূর্যের দিকে চেয়ে মালেকার চোখ জলে ভরে ওঠে।
তোমার রাগরক্তিম বদনের দিকে চেয়ে যদি কোন কলঙ্কিনী বন্ধুর আনত চোখপল্লব ভাবাবশে মিছিমিছি কেঁপে ওঠে বা তার নিষ্ঠুর প্রেমিকের কথা মনে কোন হতভাগিনীর বুক কেঁপে ওঠে এমনিই, তাহলে হে মোহিনী উষা, তাদের চোখে বুকে তোমার মায়া-স্নিগ্ধ মমতা বুলিয়ে দিও! তৃতীয় ঘন্টা পড়ার সাথে সাথে ট্রেনটা চলতে আরম্ভ করল। গতি ক্রমেই বাড়ছে। আচ্ছা এটা কি অদ্ভুত নয়, যখন পৃথিবীময় নূন আশার স্পন্দন, তখন তার চোখে জল কেন? মালেকা কি জানে! অনেক দূরে চলে-যাওয়া ট্রেনের ক্ষীণ শব্দ যখন একেবারে মিলিয়ে গেল, পাখির কলরবে তখন রাচর মুখরিত হয়ে উঠেছে।