মেঘমল্লার
বর্ষার সময় লোকজন নাকাল হলে কী হবে, আমার খুব মজা। বর্ষার পরই তো শরৎ—আমার ভালো লাগার সময়। সামনের মাঠটাতে জমা জলে ফড়িং ওড়ে। পুবদিক থেকে সকালবেলায় অদ্ভুত একটা হাওয়া আসে। আর আকাশে কত রকমের মেঘ। কোনটা হেঁড়ে মাথাঅলা জলহস্তি, কোনটা ষাঁড় আবার কখনও কখনও সিংহ ভাল্লুকের মতো মেঘেরা নানা দিকে ভেসে যায়। জন্মাষ্টমীতে আমাদের এখানে শিবমন্দিরে দুর্গাপ্রতিমার কাঠামোর মাটি পড়ে। কাঠামো পুজো হয়। এরপর একটু অপেক্ষা। বিশ্বকর্মা পুজোর ঠিক দুদিন আগে আসে মামার বাড়ির চিঠি। সেও এক কাণ্ড। মেজোমামা বড়মামাকে প্রতিবছরই প্রলোভিত করে বলে, বড়দা তুমি ডাক্তার। স্টেথো, ম্যানোমিটার, ফরসেপ এই সব নিয়ে তোমার কারবার। তুমি নাস্তিকতা ছেড়ে এইবার বিশ্বকর্মা পুজো কর। দেখবে পশার হু হু করে বাড়ছে। দেখনা আমি ছেলে পড়াই বলে সরস্বতী পূজো করি। বড়মামা বলে, আমি ডাক্তারি করি। কারখানা খুলে লেবারগিরি করি না। ডাক্তারের কাজ সেবা। সেবাই আমার পুজো। প্রতি বছরই এই একই এপিসোডের রিপিট টেলিকাস্ট হয়। মামার বাড়িতে দুই অভিনেতার নাটক দেখতে পাড়ার দর্শকদের ভিড় ভেঙে পড়ে। বয়স্করা বলেন, দুম্বোদুটোর বয়েসটাই হয়েছে আসলে ওরা শিশু। এরপর মামারা অভিমান করে কথা বন্ধ করে দেয়। দুজনেই আলাদা আলাদা করে চিঠি লেখেন আমাকে। তারপর পুজোর কটাদিন আগে আমি মামার বাড়ি গিয়ে মামাদের অন্ধ হওয়া কথা চালু করে দিই।
এবার বড়মামার চিঠির আগেই মেজোমামার চিঠি এসেছে। মেজোমামা লিখেছেন, অজাতশত্রু, আমাদের দুই ভাইয়ের শত্রুতা দূর করবার জন্যে এবারও তোকে আহ্বান করছি। গোপনে বলি শোন, বড়দা নাকি নিম্নচাপের ব্যবসা করবে বলে প্রজেক্ট পেপার তৈরি করছে। এলে নিজেই চোখেই সব দেখবি।
মামারা আমাকে যেমন ভালোবাসে তেমনি আমিও তাদের খুব ভালোবাসি। লোকের কাছে মামাদের কথা বলে যেন আমার আশ মেটে না। আমার বড়মামা ডাক্তার। মাঝবয়েসি। আত্মভোলা মানুষটি কখনও বিয়ে করবেন না বলে পণ করেছিলেন। এখনও চিরকুমার। নামকরা অ্যালোপ্যাথ ডাক্তার। একসময়ে নস্যি নিতেন। কিন্তু নাকের ডগায় নস্যি দেখলে রুগিরা সহ্য করতে পারত না। গত বছর পর্যন্ত রুগিদের আড়ালে ফোঁ ফোঁ করে নস্যি নিতে দেখেছি। আমার মেজোমামা দর্শনের অধ্যাপক। প্রকৃতিটা গম্ভীর। কিন্তু ভেতরে একটু দুষ্টু দুষ্টু হাসি সদাসর্বদাই খেলে বেড়ায়। কলেজে ক্লাস নেওয়া পরীক্ষার খাতা দেখা এবং পড়া, এই তাঁর জীবন। আর বাকি কাজের মধ্যে আছে ভালোমন্দ খাওয়া এবং সময় পেলে বড় ভাইয়ের পেছনে লাগা। দুজনের বয়েসের ব্যবধান খুব বেশি নয়। দুই ভাই পিঠোপিঠি। মাঝে মাঝে দুজনের মধ্যে তুমুল কাণ্ড বেধে যায়। তখন সামাল দিতে আসেন বোন কুসিমাসি, আমার একটা মাত্র মাসি। কুসিমাসি মামাদের বোন হলেও যেন মা। কিছুদিন স্কুলে চাকরি করেছিলেন কুসিমাসি। এখন সব ছেড়ে দিয়ে এই বিশাল বাড়ি, সম্পত্তি আর পরিবারটাকে সামলান। বাড়িতে কাজের লোক একাধিক। তারা কুসিমাসিকে যমের মতো ভয় পায় যেমন সেই রকম নিজের জীবনের চেয়ে ভালোবাসে। কুসিমাসি খুব আদর্শপরায়ণ। বাইরেটা কঠিন। ভেতরটা কোমল। শিশুর মতো ভাইদের দেখবার কেউ নেই বলে নিজে বিয়ে করেননি।
মামাদের বাড়িখানা বিশাল। সামনে পেছনে অনেকটা জমি। সেই জমিতে দুষ্প্রাপ্য সব গাছপালা আছে। দুই মামারই খুব বাগানের শখ। রাস্তার ধারে একতলার দুটো বড় ঘরে বড়মামার চেম্বার। বাড়িতে রঙ করা হয়েছে সদ্য। এখনও ভারা খোলা হয়নি। রকের ওপর নানারকমের ড্রাম থাক দিয়ে রাখা হয়েছে। বাড়ির প্রাচীন কাজের লোক সীতাপতি টুলে বসে ঢুলতে ঢুলতে গান গাইছিল—মোরঅ কনিতা দরশনিতা গোটে টঙ্কা দিঅ।
আমাকে দেখে ভাগিনা বলে আত্মহারা যেই উঠতে গেছে অমনি পা হড়কে টুলশুদ্ধ এটা কাত হওয়া ড্রামের ভেতর ঢুকে গেল। ঠিক সেই সময়ে হেড রাজমিস্ত্রী সোলেমান ইয়া একখানা শবল নিয়ে বাগানের দিকে যাচ্ছিল। ড্রামটাকে একবার সামনে একবার পেছনে গড়াতে দেখে শাবলের চাড় মেরে ঠেলে দিল। একবার শুধু বিকট একটা শব্দ হল—বাপঅ। তারপর ড্রামটা বোঁ বোঁ করে গড়াতে গড়াতে ষোলো গজ দূরে বড়মামার গ্যারাজের দরজায় ধাক্কা মেরে বাইরে বড় রাস্তার নর্দমার ধারেহেলে গেল। সবাই দেখল ভেতর থেকে ধুতি জড়ানো কী একটা নড়তে নড়তে পেঁকো নর্দমায় ঢুকে গেল।
সোলেমান বলল—দেখেই বুঝেছি বাড়িতে জিন ঢুকেছে। পরশু চিলেকোঠায় রঙ করতে গিয়ে দুবার চড় খেয়েছি। আজ সকালে যতবার বিড়ি খাচ্ছি দেখি আগনে বেশি বেশি করে পুড়ে যাচ্ছে। একটা বিড়ি যেন দুজনে মিলে খাচ্ছি।
ঠিক সেই সময়ে মেজোমামা এসে পড়েছেন। বললেন—উল্লুক কোথাকার! তোর বিড়ি তুই টানবি না তো কে টানবে!
সোলেমান বলল—সেইটাই তো জিনের খেলা। আপনি খেতে বসেছেন, খাবার মুখে তুলেছেন, চিবোচ্ছেনই, গিলছেন, দেখছেন পেটে যাচ্ছে না। খোদা কসম, ঠিক সময়ে ব্যাটাকে ভাগিয়েছি!
মেজোমামা আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে বললেন—মহাস্থবির এসেছ, ঘরে বসে খাতা দেখতে দেখতে শুনতে পাচ্ছি তুমুল হট্টগোল হচ্ছে। মিত্তিরবাড়ি মরে থাকবে কেমন করে। যত জগঝম্প যত হট্টগোল তত গুড সাইন তত লোকের শুভাগমন। ঠিক ধরেছি তুই আসছিস। কেমন! এসো মহাস্থবির এসো—মিত্তিরদের মহাবিহারে এসো। প্রজ্ঞাপারমিতা রান্নাঘরে।
কুসিমাসি কখন এসেছে কেউ খেয়াল করেনি। মাসি বলল—আমি প্রজ্ঞাপারমিতা? এখন বৌদ্ধ যুগ নিয়ে পড়েছ, পলাশকে আসতে দেবে তো।
ভেতরে যেই ঢুকতে যাব অমনি আকাশ থেকে একঝুড়ি পেয়ারা পড়ল। যে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল বাবারে বলে বসে পড়ল। মেজোমামা বললেন—দেখ তো বিলু নাকটা নাকে আছে তো? ভীমরুলের মতো ওটা কি?
কুসিমাসি বললেন—নাকে তোমার সিস্ট হয়েছে। ঠিক যেন বৈঠকখানা বাজারের বাড়ি!
মেজোমামা বললেন—যা বাব্বা, এক্ষুনি এক্ষুনি সিস্ট! আচ্ছা, পুষ্পবৃষ্টির কথা বইয়ে পড়েছি। কিন্তু পেয়ারাবৃষ্টির কথা তো শুনিনি! আমরা কে এমন মহাপুরুষ বলত! আমার না বর দিতে ইচ্ছে করছে। কুসি তোর যা ইচ্ছে এই বেলা চেয়ে নে। সোলেমান তুই কী চাস? রাজা হবি! এশিয়া ভূখণ্ডের সম্রাট হবি! নাকি সুফিসন্ত হয়ে দেশে দেশে প্রচার করবি—’আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। তিনিই আদি তিনিই অন্ত; তিনি যুগপৎ ব্যক্ত এবং তিনি সর্ব বিষয়ে সম্যক অবহিত। তিনি রাত্রিকে দিন, দিনকে রাত্রি পরিণত করেন; তিনি অন্তর্যামী!’ উফঃ তোরা কিরে, কেউ বরটুকুও চাইতে পারছিস না! ঠিক আছে চাইতে হবে না যাতে তোরা লোভনীয় সুখাদ্য খেতে পাস সেই বর তোদের আমি দেব!
আবার খানকতক পেয়ারা পড়ল ওপর থেকে। সবাই ওপর দিকে তাকিয়ে দেখল তিনতলার বারান্দায় বড়মামা মুখে চুষির মতো পেয়ারা আটকে দাঁড়িয়ে। মেজোমামা বললেন—ও তাহলে তুমি! আমি ভেবেছিলুম ভগবানটগবান কেউ হবেন। আচ্ছা খামোকা পেয়ারা বৃষ্টি করছ কেন?
বড়মামা বললেন—তোর গরম পেট ঠান্ডা করবার জন্যে।
মেজোমামা বললেন—মানে! পেয়ারা তোমার আইটেম—নস্যির সাবস্টিটিউট। আমার পেট ঠান্ডা কেন?
বড়মামা বললেন—শোন, একটু আগে কাকে যেন বর দিবি বলছিলি—পাকা পেয়ারা খেয়ে আগে পরিশ্রুত হ। তারপর বর দেবার কথা চিন্তা করিস। নিজের বোন, একমাত্র বোন কুসি তাকে কিনা প্রজ্ঞাপারমিতা। বড়মামা বক্তব্য পেশ করেই মুখের চুষির মতো পেয়ারাটা ফের আটকে নিলেন।
মেজোমামা বললেন—লে হালুয়া, নিজে পেয়ারা খামার করে, বাগানের সব গাছ উপড়ে পেয়ারার পেয়ারে সব কিছু মোরব্বা করে ফেললেন তাতে দোষ নেই—আমি যেদিকে হেলি সেদিকেই দোষ! আমার নাক ফুলিয়েছ পেয়ারাঘাতে। আমি নালিশ করব।
—কার কাছে? কে শুনতে তোর নালিশ!
—থানার দারোগা।
—সে আমার রুগি। আমার বিরুদ্ধে কেস করলে তার সুগার কে বাগে রাখবে?
—উকিল নাদু দত্তকে ধরব। তিনশো দুই আর চারশো কুড়ি ধারায় কয়েকদিন অধিবাস।
—সে রাস্তাও বন্ধ। নাদু বিশ্বতোতলা। তার টাং থেরাপি করছে এই মিয়া। হিয়ারিংয়ের সময় তো তো করলে জজ থাবড়া মেরে চেয়ারে চেপ্টে দেবে। জেলা আদালতে জজ কে জানিস তো? গবা মুহুরির ছেলে হেমন্ত। সেও আমার রুগি। রোগ আর রুগি দিয়ে জগৎকে একসূত্রে বেঁধে রেখেছিস ভ্রাতা! সব আমার অধীন।
—তারকেশ্বরে যাব। তিনি বিহিত করবেনই করবেন।
—সে আবার কে রে? তারকেশ্বর সাউ? যে মোড়ের মাথায় তেলেভাজা ভাজে! ও-হো বুঝেছি তারকেশ্বর সিং পাইন বাবুদের ড্রাইভার। তা বল না ওদের। ওরা আমার কী করবে! ক্ষতি ওদেরই হবে। মাথা ধরা বললে জোলাপের ওষুধ খাইয়ে দোব।
—আজ্ঞে না। এই তারকেশ্বর সে জিনিস নন। ইনি লর্ড শিবা। গুডনেম তাঁর তারকনাথ। যুগ যুগ ধরে রাঢ়ে তারকেশ্বর হয়ে আছেন।
—কী বললি তারকনাথ। তাঁর কাছে এন্ট্রি পেতে হলে সাধনা চাই বৎস! তোমার জীবনে যার বড়ই অভাব!
কুসিমাসি এইবার লাগাম ধরে বললেন—তোমরা সবার আগে একটু বড় হওয়ার চেষ্টা কর। ছেলেটা এসে অব্দি দাঁড়িয়ে আছে। আর তোমরা অকারণে তরজা করছ। অ্যায় গান্ধারী এদিকে আয়।
মাসির ধমক খেয়ে বড়মামা ওপর থেকে বলে উঠলেন—বিলু আমার, ওপরে চলে আয়। ডানদিক বাঁদিক দেখবি না। কেউ বললে শুনবি না কিছু। তুই আমার গেস্ট।
মেজোমামা সেই শুনে খ্যাঁক করে বলে উঠলেন—উঁহু সেটি হতে দিচ্ছি না। পলাশ আমার গেস্ট। আমি ওকে চিঠি দিয়ে আনিয়েছি। সুতরাং পলাশ আমার…বলেই মেজোমামা আমার হাত ধরে যেই টানতে যাবেন কুসিমাসি ফের ধমক দিলেন—কী হচ্ছে কী? ভাগনেকে গেস্ট বলতে লজ্জা করছে না। বিলু আমার কাছে থাকবে।
গান্ধারী দুই বিনুনি দুলিয়ে নাচতে নাচতে এসে দাঁড়াল। তারপর কুর্নিশ করে বলল—ফরমাইয়ে মালকিন!
মাসি বললেন—পলুর জিনিসপত্রগুলো ছোড়দার পাশের ঘরে তুলে দে। রাতে গরম গরম ইলিশ ভাজবি, বুঝলি!
মাসি এবার আমাকে বললেন, তুই আমাদের একমাত্র দিদির ছেলে। তোকে কি অনাদর করতে পারি! মুখখানা অমন শুকনো করে আছিস কেন সোনা?
বললুম—মাসি চারদিকে এত পেয়ারাগাছ কে পুঁতলে? এত পেয়ারা খায় কে?
মাসি বললেন—বড়দাকে নস্যি নিতে দেখেছিস তো! সেই নস্যি তাড়াতে গিয়ে পেয়ারা এল।
আমি বললুম—তার মানে?
মাসি বললেন—তোর বড়মামার নস্যির ঝোঁক এত বেড়ে গেছিল যে রুগিরা কমতে শুরু করল। কারণটা এই, কেউ হয়তো পেট খারাপ নিয়ে এসেছে। বড়দা প্রথমে পরীক্ষা করছেন। পালস দেখছেন। এক টিপ নস্যি। পেট টিপে রোগটা ধরার চেষ্টা করছেন। আবার এক টিপ। সঙ্গে সঙ্গে দেখা যাচ্ছে রুগিরও নাক সড় সড় করছে। শুরু হয়ে গেল হাঁচির পর হাঁচি। ব্যাপারটা এই রকম দাঁড়াল—এসে ছিল পেট খারাপ নিয়ে। চলে গেল সর্দি নিয়ে। শেষে মেজদাকে সঙ্গে নিয়ে অ্যাকশনে নামলুম। নস্যির কৌটোয় বার্লি ভরে রাখতে শুরু করলুম। রুগিরা বলতে লাগল—করছেন কী ডাক্তারবাবু দম আটকে মরবেন যে! দাদার কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। উলটে বলছেন—এ নিরাকার নস্যি। এ দিয়ে আমি আঘ্রাণ জয় করব। আমি হব ঘ্রাণজিৎ। মেজদা বললেন—আর অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। তারপর এমন সব আরম্ভ করতে লাগলুম যে বড়দা গতবার গঙ্গাসাগরে নিয়ে সাগরকে নস্যির ডিবে দান করে এলেন। তারপর ফিরে আসতে তাঁর মধ্যে বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে লাগল। ডিবে ত্যাগ করলেও নেশা তো তাকে ত্যাগ করতে চায়নি। ফল হল যখন তখন রাগ। বড়কর্তার রাগ সামলাবার জন্যে একটা লোক রাখা হল। রাগের প্রথমেই আমাদের দুই ভাইবোনকে তাঁর চিবিয়ে খেতে ইচ্ছে করতে লাগল। বড়দার রাগ সামলাবার লোক গোপালকে পাঠানো হল মোল্লার চক বাজারে! সেখান থেকে কাঁচা পেয়ারা এনে ডাক্তারি ব্যাগে ভরে রাখা হল। সেই তিরিক্ষি মেজাজটা এলেই একটা করে পেয়ারা বিচি শুদ্ধ চিবিয়ে খেতে লাগলেন। এক বছর পেয়ারা খেয়ে খেয়ে অ্যাডিক্টেড হয়ে গেলেন। পেয়ারার নেশা সাংঘাতিক নেশা। একদিন না খেলে বিকারের মতো অবস্থা হয়। বাড়িতে পেয়ারার রাজত্ব শুরু হয়ে গেল। রান্নায় পেয়ারা। শোবার ঘরে ছত্রিতে পেয়ারা। বাথরুমে জানলার ওপর শুকনো পেয়ারার স্কাল্পচার। বাগানে নানা জাতের পেয়ারার চারা লেগে গেল।
কিন্তু যার নাম পেয়ারা কালে সেই হয় বেয়াড়া। বড়কর্তার এমন পেট খারাপ ধরল যে নলি খুলে যাবার যোগাড়। দেড়মাস ধরে চলছে। ওপরে দিয়ে দেখ গামছা পরে ঘুরছেন। পেয়ারা খাচ্ছেন না বটে ওই চুষির মতো দাঁত দিয়ে আটকে রাখেন। যারা পেয়ারা খায় না তাদের ওপর খুব রাগ। গোপালকে দিয়ে ঝুড়ি ঝুড়ি পেয়ারা পাড়িয়ে ওপরে মজুত করে রাখেন। যাদের ওপর বেশি আক্রোশ তাদের টিপ করে ছোঁড়েন।
আমি বললুম—এখন তাহলে বড়মামা কী খাওয়া-দাওয়া করেন?
মাসি বললেন—অ্যান্টিবায়োটিক। এখন আবার অন্য উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। পেয়ারার পেটখারাপ কমের দিকে গেলেও এখন অ্যান্টিবায়োটিকের পেট খারাপ চাগাড় দিচ্ছে। বড়দার তাই গামছা ছাড়ার ফুরসত হচ্ছে না। তুই একবার দেখা করে আয় না।
এই বাড়িটা প্রাচীন আমলের। মোটা মোটা থাম। বাহারি খিলেন। বড় বড় ঘর। মার্বেল পাথরের মেঝে। চওড়া দালান। চারিদিক নিঃস্তব্ধ বলে হাওয়া কথা কয়। বারান্দা ভর্তি ফুলের টব। আদ্দেক ফুলের নামই জানি না। এই বারান্দায় দাঁড়ালে সামনে বিশাল খেলার মাঠ। মনটা সেই মাঠ বেয়ে কোথাও উধাও হয়ে যায়।
সন্ধে সাতটা নাগাদ নীচে কলতলায় বিকট চিৎকার করে কেউ যেন পড়ে গেল মনে হল। চারদিকে বাসনপত্র গড়িয়ে যাবার শব্দ হচ্ছে। কাজের লোকেরা দৌড়াদৌড়ি করছে। গান্ধারীকে দেখা গেল এক হাতে লাঠি আর এক হাতে লণ্ঠন নিয়ে কলতলার দিকে ছুটে গেল। মেজোমামা নীচে চিৎকার করছেন। বড়মামা তাঁর রাগ তাড়াবার লোক গোপালকে বলছেন—দে নীচে এক ঝুড়ি পেয়ারা ফেলে।
একটু পরে দেখা গেল কাজের লোকেরা কাকে যেন ধরে ধরে আনছে। তাদের পেছন আরও একজন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে আসছে। সর্বাঙ্গ কাদা মাখা। গান্ধারী চেঁচিয়ে বলল—ভূত দেখে বিমলার ফিট হয়েছে। ভূতকেও ধরা হয়েছে।
কে একজন বলল—জুতো এনে শোঁকা।
চারদিক থেকে জুতোর বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। নীচের দালানে জুতোর পাহাড়। তারপর বিমলা চিৎপাত হয়ে শুয়ে। নানাজনে তার সাড় আনার জন্যে নানা রকমের কাণ্ড করে চলেছে। এতক্ষণ পর বড়মামাকে নীচে দেখা গেল। তাকে মহাদেবের মতো লাগছে। খালি গা। ফরসা টকটকে রঙ। তরমুজের মতো ভুঁড়িখানা সামনের দিকে মাথা বাড়িয়ে রয়েছে। পরনে বাঘছালের জায়গায় রয়েছে কটকি গামছা। বিমলার সামনে এসে চারপাশে চোখ বুলিয়ে বললেন—ভীষ্মের হয়েছিল শরশয্যা আর আমাদের বিমলার হল পাদুকাশয্যা। বলেই তিনি একশিশি স্মেলিং সল্ট বিমলার নাকের কাছে ধরে বললেন—ফিট নয় ভিরমি।
খানিকক্ষণের মধ্যে বিমলা চোখ পিটপিট করে আঁ আঁ করতেই মেজোমামা মুখ ফাঁক করে গরম দুধ ঢেলে দিলেন।
একটু চুপচাপ থেকে বিমলার কান্না শুরু হল। মামারা যত বলেন—কী হয়েছে তোর, কাঁদছিস কেন? বিমলা তত কাঁদে আর বলে আমাকে দেশে পাঠিয়ে দেও। ইখেনে আর থাকবুনি।
কুসিমাসি গান্ধারীর হাত থেকে লাঠিটা কেড়ে নিয়ে বললেন—দেখ বিমলা ঢের হয়েছে। এবার আসল কথাটা বল।
বিমলা বলল—সন্ধের পর কলতলাতে বাসন নিয়ে মাজতে বসেছি। হঠাৎ কলাগাছগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখি পাঁচিল টপকে কে যেন একটা পড়ল কলার ঝাড়ে। তারপর দেখি সেটা মাথা দুলিয়ে আমার দিকে আসছে। পেছনে আবার ইয়া বড় একটা ন্যাজ নেতিয়ে আছে। সামনে এসে দাঁত বের করে হাসল। গা থেকে দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে। সাহস করে বললুম, কে তুই! সেটা বললে—তোর বাপরে বুড়ি। আমার হাতে পেতলের ঘটিটা ছিল। দিলুম সেটার ক্যাঁকালে ঠুকে। আঁক করে উঠে সে আমায় একচড় মেরে অজ্ঞান করে দিলে! আমি আর এখানে থাকবুনি। বিমলা আবার কান্না জুড়ে দিল।
বড়মামা গম্ভীর স্বরে বললেন—কার এত সাহস তোর গায়ে হাত তোলে!
উঠোনের প্রান্ত থেকে বাগানের মালি গৌরাঙ্গ চেঁচিয়ে বলল—এই যে এখানে আছে সে। বিড়ি খাচ্ছে।
মেজোমামা বললেন—নিয়ে আয় সামনে। কুসি আমার কুকরিটা নিয়ে আয় তো। কোতল করা হবে।
বড়মামা বললেন—দূর বোকা, কুকরি দিয়ে কি কোতল হয়! খাঁড়া চাই। গোপাল যা তোর কালীতলা থেকে খাঁড়াখানা নিয়ে আয়।
মাসি বললেন—গোপাল আসার সময় থানায় গিয়ে আগাম একটা ডায়েরি করে আসবি। নরবলির পর কে কখন কোথায় থাকবে তার ঠিক নেই। আজ বাদে কাল ষষ্ঠী।
গৌরাঙ্গ লোকটাকে টানতে টানতে নিয়ে এল। দেখা গেল তার চোখ দুটো ছাড়া বাকি সবই কাদা পাঁকমাথা অপরিষ্কার। মেজোমামা বললেন—কে তুই?
সে বলল—আপুনার সেনাপতি অছি।
মেজোমামা বললেন—মোরঅ সেনাপতি। তোরঅ নামঅ কাঁই?
সে বলল—সীতাপতি।
বড়মামা অট্টহাস্য করে বললেন—ওরে তোর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে তুই সীতাপতি নয় সীতাফেতি! গায়ে দুর্গন্ধ কেন রে? কার হাঁড়ি খেতে গেছিলি। দিয়েছে ব্যাটাকে পাঁদাড়ে ফেলে। ওরে এটাকে আগে সাবান সোডা দিয়ে ভাটিতে ফোটা। তারপর কথা কইব। কী গন্ধ বাবা বমি উঠে আসে!
বিমলা জুতোর পাহাড়ে শুয়ে বলছে—আ মরণ, তখন যদি জানতে পারতুম ওটা সেই মিনসেটা দিতুম বগি খুলে। নিয়্যাগ্গুন! ধরা পড়ে মড়ার লজ্জা নেই!
সীতাপতিকে কলতলায় ফেলে বালতি বালতি জল ঢালা হচ্ছে। একজন আর একজনকে বলছে, মুড়ো খ্যাংরায় হবে না। পাতকোর পাড়ে ঝামা আছে ওটা দিয়ে ঘষে যা। অন্য একজন বলছে, চোদ্দপুরুষের ময়লা গায়ে জমা হয়ে আছে। তোলা কি চাট্টিখানি ব্যাপার। দেখিস যেন ছালচামড়া উঠে না আসে।
খানিক পরে সীতাপতিকে রকে বসানো হল। জল ঘেঁটে গা সাদা হয়ে চামড়া কুঁচকে গেছে। থেকে থেকে হাঁচছে।
বড়মামা বললেন—কুসি হাঁচিটা নস্যির না ঠান্ডার—সাউন্ড কী বলছে?
মাসি বললেন—অতিরিক্ত ঠান্ডার।
বড়মামা বললেন—সীতাপতি তুই কি মেখেছিলি?
সীতাপতি বলল—আজ্ঞে পাঁক বাবু।
—বাড়িতে কি তোকে পাঁকের ঘরে থাকতে দেওয়া হয়?
—আজ্ঞে না বাবু।
—তবে?
—আজ্ঞে ফেলে দিয়েছে।
—কে সে?
—আজ্ঞে আপুনি।
—আমি!
—আজ্ঞে হ্যাঁ বাবু। আপনার টুলে বসে ঢুলছিলুম। তারপর আপুনার ভাগিনাকে দেখে উঠতে গিয়ে আপুনার ড্রামে ঢুকে গেলুম। তারপর আপুনার মিস্ত্রি এসে দিলে গড়িয়ে। গড়াতে গড়াতে ধাক্কা খেলুম আপুনার গ্যারাজে। ড্রাম থেকে পড়লুম আপুনার নর্দমায়। সেখানে থেকে পালিয়ে গেলুম আপুনার গোয়ালে। কেউ যাতে না দেখতে পায় তাই আপুনার সন্দে অব্দি অপেক্ষা করলুম। সন্দে হতে পঁচিল টপকে কলার ঝাড়ে পড়লুম। তারপর আপুনার বিমলার কাছে জল চাইলুম। আপুনার বুড়িটা জল না দিয়ে গালাগাল দিলে। আমি তাকে আপুনার চড় মারলুম। তারপর আপুনার লোকেরা ধরে পেটালো। চান করালো। এখন আপুনার কাছে বসে আপুনার বেত্তান্ত সব শোনাচ্ছি।
মেজোমামা হাততালি দিয়ে বললেন—এই না হলে প্রভুভক্ত। কী ডিটেল আর অনেস্টলি আর্গুমেন্ট। কিন্তু প্রশ্ন হল কয়েকদিন ধরে লক্ষ করছি একতলার রকে নানারকমের ড্রাম জড় হচ্ছে। হোয়াই? কি উদ্দেশ্য? পরশু ভকত সিং এসেছিল এক ঠ্যালা ভাঙা গাড়ির লোহালক্কড় নিয়ে। বড়দা নাম ধরে ডাকলে। বড়দা তখন টয়লেটে। আমি বললুম, কী চাই? সে বললে, ডাগদারবাবুকো ভেজ দিজিয়ে। খাস কাম হ্যায়। বললুম কী এমন কাম যা আমায় বলা যাবে না। আমি তার ভাই হই। সে বললে, পেলান্ট বনেগা। লাখোপতি সে কড়োড়পতি হো জায়গা। হন্ডিল ঘুমায়ে গা ফিন ইধার কা বারিষ উধার ছিড়কায় গা।
বড়মামা প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দিতে বললেন—তুই থাম তো মেজ। আমার পেটটা আবার কেমন গুলোচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে এ আমার অ্যান্টিবায়োটিকের পেট খারাপ হয়েছে। কী গেরো বলত। পেয়ারার পেট খারাপ সারাতে গিয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি অ্যান্টিবায়োটিক ঠুসে এবার পেয়ারা সরে গিয়ে অ্যান্টিবায়োটিকের পেট খারাপ এল। এটাকে সামলাই কী করে?
হঠাৎ এই এত রাতে দালানে ঝড়ের মতো এসে পড়ল এক আগন্তুক। মাথার চুল এলোমেলো। জামার বোতাম খোলা। কুলকুল করে ঘামছে। বড়মামা তাকে দেখেই বললেন—তুমি এত দেরি করলে কেন প্রশান্ত? তোমার এই অবস্থা কে করলে?
প্রশান্ত বললে—আজ্ঞে মিনিবাসে।
মাসি আর্তনাদ করে বললেন—কী সর্বনাশ চাপা দিচ্ছিল নাকি?
প্রশান্ত বলল—চাপা পড়তে না চাইলে কেউ কি চাপা দিতে পারে। আমি ভেতরের ভিড়ে আটকে গেছিলুম। গাড়ি যত আস্তে ছোটে লোকে তত ভিড় করে ওঠে। স্টপেজ আসছে এদিকে আমি নামতে পারছি না। ঘুড়ির প্যাঁচার মতো প্যাসেঞ্জারের প্যাঁচে আটকে গেছি। আমার হাঁটু এক যুবতীর কোলে। সে আমাকে হাঁটুকে পার্স ভেবে চাপড় মেরে বলছে, আরে আমার পার্সটাকে চেপ্টে দিচ্ছেন কেন! এইরকম করে যখন বেরবার উপায় নেই দেখলাম, কন্ডাক্টর বললে, আপনার কনস্টিপেশনের ধাত না আলগা ধাত? যদি প্রথমটা হয় তাহলে বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিন। পেটটাকে ভেতরে টানুন। তারপর ভিড় ঠেলে বেরিয়ে আসুন। ও মা! ওই এক প্রসেসেই দেখি কেল্লা ফতে। দেরি একটু হল বটে কি আর করা যাবে!
বড়মামা বললেন—কোটেশন পেপার রেডি করে এনেছ?
প্রশান্ত বলল—সব রেডি। সাইট প্ল্যানটা একটু দেখব।
এইবার মেজোমামা বললেন—জলের আবার সাইট কী! বিচিশুদ্ধ পেয়ারা খেয়ে তোমার বডির অল পার্টস ঢলঢলে হয়ে গেছে। তুমি ডাক্তার তোমারই এই হাল। শোন, ছেলেমানুষী কোর না। জলের সঙ্গে ইয়ারকি মেরো না। আমি তোমাদের মতলব জানি।
বড়মামার পেটে আবার মোচড় দিচ্ছে। ওপরে যেতে গিয়েও ফিরে এলেন। রাগে মুখটা থমথম করছে। বললেন—কী জানিস তুই।
মেজোমামা বললেন—তোমার বিজনেসের ব্লুপ্রিন্ট। দিন পনেরো আগে তোমার খাটের তলায় শুয়ে সব শুনেছি।
—কী শুনেছিস?
—বঙ্গোপসাগর লিজে নেবে বলে মতলব করছ।
—কি জন্যে লিজ নেব সেটা জানিস?
—অজ্ঞে হ্যাঁ তাও জানি।
—বল, বলতে থাক।
—অধ্যাপক মেজোমামা এইবার যেন ক্লাস নিতে শুরু করলেন। বড়মামার দিকে তাকিয়ে বললেন—না, না, ওইভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে হবে না। এতে ঔদ্ধত্য প্রকাশ হয়। খালি গা কেন? গোপাল ওই বস্তুটা পড়ে আছে ধুলো ঝেড়ে গায়ে চাপিয়ে দে। শোন, তুমি প্রকৃতির বিরুদ্ধে, নেচারের বিরুদ্ধে, চলতে চাইছ। তুমি চাইছ ছটা ঋতুর একটাকে নিজের স্বার্থের কাজে লাগাতে। সেটা হল বর্ষা। বর্ষায় রোগের বাড় হলে তোমাদের সুবিধে। মুশকিলটা হল এখনকার ঋতু ঋতুর মতো আচরণ করে না। শীতে শীত নেই। শ্রাবণের বর্ষা ঠেলা মারল কার্তিকে। এ যেন সেই গণ্ডারের কাতুকুতু।
—এর মধ্যে গণ্ডারের কাতুকুতু কেন?
—একবার আলিপুর চিড়িয়াখানায় একজন আদর করে গণ্ডারকে কাতুকুতু দিয়েছিল। গণ্ডারটা এক সপ্তাহ পরে শুধু একটু ফিক করে হেসেছিল। সেইরকমই সময়সাপেক্ষে চলে ঋতুসকল।
—আসল কথাটা বল না!
—তুমি চাইলে বর্ষার বর্ষণকে স্থায়ীভাবে আটকে রাখতে। সেই জন্যে করতে চাও পার্মামেন্ট ডিপ্রেশান প্ল্যান্ট। কয়েকশো নটিক্যাল মাইল বঙ্গোপসাগর লিজ নিয়ে তৈরি করবে ডিপ্রেশান প্রোজেক্ট। সমুদ্রের জলকে কৃত্রিমভাবে বাষ্প করে আকাশে তুলবে মেঘ করে। তারপর স্যাটেলাইট ওয়েভ মারফত সেই মেঘকে ডিম্যান্ড মতো ছেড়ে দেবে। যেখানে কম দরকার সেখানে কম। যেখানে বেশি দরকার সেখানে বেশি। জগৎকে ভাসিয়ে দিতে চাও। এটা তোমার গোপন ইচ্ছে।
বড়মামা আহ্লাদে আটখানা হয়ে বললেন—দেখ মেজো তুই না আমার ইহজন্ম পরজন্ম ভূলোক দ্যুলোক সব লোকের ভাই ছিলি। কী দূরদৃষ্টি! তুই দর্শনের সার্থক অধ্যাপক। শোন জগৎকে ভাসিয়ে দিতে চাই না রে! আমি দেশবাসীর সুখের জন্যে অসময়ে নিম্নচাপের বৃষ্টি তৈরি করতে চাই। শোন আষাঢ় মাসে যদি বেল পাকে তাহলে মানুষের কী দশা হয় বলত! আমার প্ল্যান্টটা চালু হয়ে গেলে লোকে না খেতে পাক নির্ঘুম রাত আর কাটাতে পারবে না। তবে কি জানিস আমি সায়েবদের ওপর শোধ তুলব।
মেজোমামা বললেন—কোন সায়েবদের কথা বলছ?
বড়মামা বললেন—ইংরেজরা। ওদের মতো শেয়ানা জাত আর আছে! এদেশটাকে ছিঁবড়ে করে গেছে। দেখনা আমার প্ল্যান্টটা চালু হয়ে গেলে টনক নড়বে। আমি ব্যবসা করব বিদেশে মেঘ বেচে। আমার গোডাউনে বেশি মেঘ জমে গেলে সেগুলোকে চুপি চুপি ব্রিটেনের মাথায় ছেড়ে দেব। ব্রিটিশদের জীবন থেকে সামার, উইন্টার তুলে দেব। লন্ডনটাকে সারা বছর বর্ষার আমহার্স্ট স্ট্রিট করে রেখে দেব। আর কিছুটা এক্সেস ক্লাউড রেখে দেব শত্রু দেশকে ঠান্ডা করবার জন্যে। হ্যাঁরে নোবেল অ্যাওয়ার্ডের চেয়ে আরও উঁচু কোনও অ্যাওয়ার্ড আছে নাকি? মেজোমামা বললেন—বলতে পারব না। তবে নলিনাক্ষ মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ডের জন্যে তোমার নাম সুপারিশ করতে পারি।
প্রশান্ত এইবার বললেন, আপনি কী লোক মাইরি! এতদিন ধরে গোপন করে রেখেও সব ফাঁস করে দিলেন! পেটেন্ট রাইটের বারোটা যে বেজে গেল। আমি আর আপনাদের মধ্যে নেই। আমার পাওনা মিটিয়ে দিন চলে যাই।
কুসিমাসি বললেন—এখন রাত বারোটা বাজে সে খেয়াল আছে! যাহোক সবাই কিছু খেয়ে নাও।
বড়মামা বললেন—কুসি আয় আমরা সবাই মিলে দই খেয়ে রাতটা কাটিয়ে দিই।
মাসি বললেন—টক দই খেয়ে খেয়ে অম্বলে তুমি জুবড়ে আছ। তার ওপরে লাগিয়েছ ঠান্ডা। তোমার পথ্যিতে আমরা নেই। তার চেয়ে চালে ডালে একটু চাপিয়ে দিই কি বল?
মেজোমামা বললেন—দেখ কুসি সংযম করতে শেখ। সারাটা জীবন কি খাব কি খাব করে কাটিয়েছি। দেখনা বড়দার জীবনে সংযম নেই বলে কি অবস্থা!
বড়মামা বললেন—কী বললি আমার সংযম নেই। তা যদি হত তাহলে সংসারে ঢুকলুম না কেন? যাকগে তোদের সঙ্গে ঝগড়া করব না। চারিদিক এখন অম্বলময় দেখছি। তোকে মনে হচ্ছে তেঁতুল জল। এই প্রশান্তটাকে হচ্ছে বাসি পাঁউরুটি। কুসি তুই হলি তেলেভাজা।
প্রশান্ত বড়মামার পায়ের ওপর ধড়াস করে পড়ে গেল। তারপর কেঁদে কেঁদে বলতে লাগল—আপনি কি করে জানলেন স্যার আমার ব্যাগে পাঁউরুটি আছে। সকালে মা টিফিনে খাব বলে চারপিস সেঁকে দিয়েছিলেন। খেতে ভুলে গেছিলুম। স্যার স্যার, প্রভু, আমি এবার আমার কলসালটেন্সি ফার্মটা খুলতে পারব তো?
বড়মামা বললেন—দেখ প্রশান্ত আমি ডাক্তার। আমি বিজ্ঞানী। আমি ওষুধ ছাড়া কাউকে কিছু দিই না। তুমি যা চাইছ তা পাবে আমার ভাইয়ের কাছে। শুনেছি লোককে সে আজকাল বরটর দিচ্ছে।
প্রশান্ত এখনও বড়মামার সামনে গড় করে বলছে—কী করব স্যার নিজের ট্যাঁকের জোর নেই। তাই পার্টনারশিপে গেলুম। এক বছর ধরে সেই পার্টনার মিস্টার দাগা আমায় ঘোরাচ্ছেন।
বড়মামা বললেন—প্রশন্ত ওসব দাগা টাগার কাজ নয়। যা করবে নিজের ওপর ভরসা রেখে কর। আচ্ছা আমার রাগটা আবার ফিরে আসছে কেন? হ্যাঁগো, মনে হচ্ছে রাগটা নস্যির ওপর হচ্ছে।
সেই রাতটা প্রায় না খেয়েই সকলে কাটিয়ে দিল।
আজ সপ্তমী। মণ্ডপে মণ্ডপে শুরু হয়ে গেছে মহাপূজার আয়োজন। সকাল থেকেই ঢাকের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আজ বেলার দিকে বড়মামা ঘোষণা করলেন তিনি সুস্থ। তাঁর অ্যান্টিবায়োটিকের পেট খারাপ পা দিয়ে বেরিয়ে গেছে। মামাদের বন্ধুরা দলে দলে আসছেন। পুজোর কদিন এই বাড়িটা অন্যরকম হয়ে যায়। প্রতিবেশিরা বলেন, পুজো হয় মণ্ডপে আর উৎসবটা হয় মিত্তিরদের বাড়িতে।
সেদিন দুপুরের পর এলেন বড়মামার বন্ধু হেমেনমামা। তিনি আবিষ্কার করলেন বড়মামার ডান পা-টা ক্রেপ ব্যান্ডেজে বাঁধা। হেমেনমামা শিউরে উঠে বললেন—কিরে মিত্তির ওটা কী করেছিস! ওটা পা না পাশ বালিশ!
বড়মামা বললেন—দেখ হিমু এক নস্যি থেকে এত কিছু হল।
হেমেনমামা বললেন—তার মানে!
বড়মামা বললেন—নস্যি ছাড়তে গিয়ে ধরে ফেললুম মোল্লার চকের পেয়ারার নেশা। সেই নেশায় হল পেট খারাপ। তখন কড়া ডোজের অ্যান্টিবায়োটিক মেরে দিলুম। পেয়ারা সেরে এল অ্যান্টিবায়োটিকের পেট খারাপ। সেটা সারাতে টক দই ধরলাম। এসে গেল অম্বল। বুকে সর্দি। তখন প্রকৃত রাগ এল নস্যি ওপরে। সেই রাগে পৃথিবীর সমস্ত নস্যির ডিবেকে লাথি মারতে ইচ্ছে করল। আমার ডাক্তারির ব্যাগে একটা টেনিস বল ছিল সেটাকে ছাতে রেখে লাথি মারতে শুরু করলাম। পরশু রাতে পা-টা স্লিপ করে বলে না লেগে লাগল ছোট একটা ড্রামে। সঙ্গে সঙ্গে চোট। নিজেই চিকিৎসা করলুম। বিছানায় শুয়ে ভাবতেই গোটা ঘটনাটা ছবির মতো ভেসে উঠল। নাকের নস্যি শেষকালে পা দিয়ে বেরিয়ে গেল।
হেমেনমামা বললেন—তোদের ছাতে তো ফুলগাছ ছিল। ড্রাম এল কোথা থেকে?
মেজোমামা বললেন—ওগুলো বড়টার টেস্ট টিউব। আর কদিন পরেই ওগুলোতে নানারকম বৃষ্টির জল নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা হবার কথা ছিল।
বড়মামা বললেন—বুঝলি হিমু এখন ভাবছি অতবড় রিস্ক আর নেব না। ভাবছি প্রশান্ত ছোঁড়াটাকে দিয়ে দেব। তুই বল আমি কি ব্যবসাদার লোক?
হেমেননামা বললেন—আমি তো কিছুই জানি না—বলব কি!
মেজোমামা বললেন—শোন, দাদা ঠিক করেছিল ক্লাউড ম্যানুফাকচারিং করবে। বঙ্গোপসাগরের কিছুটা সরকারের থেকে লিজ নিয়ে আল্ট্রাভায়োলেট মেশিন বসিয়ে স্যাটেলাইট কনট্রোলিংয়ের মাধ্যমে জল থেকে বাষ্প জমিয়ে মেঘ তৈরি হবার কথা ছিল।
হেমেনমামা বললেন—আইডিয়াটা গুটিয়ে গেল কেন?
বড়মামা বললেন—পেট খারাপটা থাকলে হয়ত ফার্স্ট প্রোজেক্টের কাজ শুরু হয়ে যেত।
প্রশান্ত বলল—স্যার ড্রামগুলো হাফ দামে ঝেড়ে দেব।
কুসিমাসি এক ট্রে-ভর্তি খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। প্রশান্তর দিকে তাকিয়ে বললেন—খবরদার, ড্রাম বেচা চলবে না। ওগুলো এখন মিত্তরদের যৌথ সম্পত্তি। ওতে গোলাপ গাছ লাগাব। বাগানের নাম দেব মেঘমল্লার। বিদেশ থেকে চারা আনাব।
দুই মামা ধন্য ধন্য বলে উঠলেন—এই না হলে আমাদের বোন!