2 of 2

মেঘনার গল্প – প্রফুল্ল রায়

মেঘনার গল্প – প্রফুল্ল রায়

চনমনে রঙে যেন মাতামাতি শুরু হয়েছে। জলদ বাজনার মতো হৃৎপিণ্ডটা গুরুগুর করে উঠছে। সামনের দিকে নজরটা একবার ছড়িয়ে দিল আইনুদ্দি। আকাশে সোনামুখী মেঘ। নীচে মেঘমতী মেঘনা; রাশি রাশি ঢেউয়ের নাগরদোলায় উথালপাথাল হচ্ছে কালনাগিনী গাঙ। আর সেই গাঙের গর্ভকোষ চিরে একটি কনকপদ্মের মতো বেরিয়েছে ছোট্ট চরটা। নাম চরবেহুলা। এখান থেকে একটা ধূসর বিন্দুর মতো দেখায়।

শ্রাবণের দুপুর। আকাশের সোনামুখী মেঘে মেঘে সজল বর্ষার ছায়ালিপি।

সামনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই একটা স্থির সিদ্ধান্তের বিন্দুতে এসে পৌঁছল আইনুদ্দি। এই মুহূর্তে গিরিগঞ্জের এই বন্দর থেকে চরবেহুলার দিকে নৌকাটা চালিয়ে দিতে হবে। তা না হলে প্রাকসন্ধ্যার সেই নারকেল-কুঞ্জটায় কিছুতেই পৌঁছন যাবে না। সেখানে এসে তারই জন্য প্রতীক্ষার প্রহর একটা একটা করে গুনতে থাকবে জমিলা।

জমিলা! জমিলা! নামটা বার বার আবৃত্তি করল আইনুদ্দি। চোখ দুটো মাছের আঁশের মতো ঝকঝক করে উঠল তার। হ্যাঁ, আজই চরবেহুলার সেই নারকেলকুঞ্জ থেকে তার স্বপ্নের সেই কেশকন্যাকে নিয়ে সে উধাও হবে। পদ্মা-মেঘনা আরিয়াল খাঁর উত্তাল জলতরঙ্গ বৈঠার ফলায় ফালা-ফালা করে একেবারে সেই দক্ষিণ-শাহাবাজপুরে। আপাতত ছোট ফুফুর বাড়ি কয়েক দিনের আশ্রয়। তার পরের ভাবনা এখন আসমানে নিরুদ্দেশ। অত ভাবতে পারে না আইনুদ্দি।

আকাশে সোনামুখী মেঘ। শ্রাবণের মেঘনাকে একেবারেই বিশ্বাস নেই। যে-কোনও মুহূর্তে সে গর্জে উঠতে পারে। ফণার ঢেউ ফুঁসে ফুঁসে উঠতে পারে তীব্র তীক্ষ্ণ আক্রোশে। অতএব কেরায়াঘাট থেকে ‘পারা’ তুলে ফেলল আইনুদ্দি। এখুনি চরবেহুলার দিকে একমাল্লাই নৌকাটাকে ভাসিয়ে দিতে হবে।

মেঘনার জলে বৈঠার প্রথম আঘাতটা তখনও তলোয়ারের মতো কেটে বসেনি। সঙ্গে সঙ্গে প্রায় আকাশবাণী শোনা গেল।

“এই মাঝি, কেরায়া যাইবা?’ সওয়ারি কণ্ঠ। পারের নরম মাটিতে এসে দাঁড়িয়েছে দুটি জল-পুলিশ। তাদের কাঁধে একটা নরদেহ। সারা শরীর, পা থেকে মাথা পর্যন্ত, তার গেরুয়া কাপড় দিয়ে জড়ানো।

মনটা জমিলার স্বপ্নে আবিষ্ট হয়ে ছিল আইনুদ্দির। জমিলার দুটি শ্যামল বাহুর লয় দিয়ে, দুটি দূরায়ত চোখের আবেগ দিয়ে, দীঘল ভূঁইচাঁপার মতো সরস দেহটির সুর দিয়ে চেতনার মধ্যে একটি রমণীয় সংগীতের আমেজ ঘনিয়ে তুলেছিল আইনুদ্দি। সওয়ারির কণ্ঠ বর্শার মতো সেই সংগীতকে চৌচির করে দিল। কদর্য একটা গালাগালই দিয়ে উঠত আইনুদ্দি। জল-পুলিশ দুটি দৃষ্টির উপর পড়বার সঙ্গে সঙ্গে অমন একটা সদিচ্ছাকে বাগ মানাতে হল।

বেজার গলায় আইনুদ্দি বলল, “যাইবেন কই পুলিশ ছাহাব?’

“চরবেহুলা।”

“চরবেহুলা!” এক মুহূর্তে ভাবনার অতল তলায় তলিয়ে রইল আইনুদ্দি। তারপর শংকিত গলায় বলল, “দুই ট্যাকা কেরায়া ভাড়া লাগব।”

“তাই সই। গরমেন্টের ট্যাকা, দুই ক্যান, বিশ হইলেও পিছপা হমু না।”

“তবে নায়ে ওঠেন।” একটু থামল আইনুদ্দি। তার দুটি চোখে তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টি; “চরবেহুলায় নামবেন কই পুলিশ ছাহাব?”

“ঘাটলায় নামাইয়া দিও। মেঘনায় একটা খুন হইছে সেই দিন; তার কিনারা করন লাগব।”

চরবেহুলার মাটি থেকে তার স্বপ্নকন্যাকে নিয়ে উধাও হবে। এমন একটা শুভ কাজের আগে পুলিশ। শরিফ মেজাজটা বদখত হয়ে গেল আইনুদ্দির। পুলিশ! আচমকা দিন কয়েক আগের একটা ঘটনা স্মরণের মধ্যে দোল খেয়ে উঠল। চেতনার উপর দিয়ে বাদুড়ের ডানার মতো কুটিল একটা ছায়া নামতে লাগল। নাঃ, পুলিশকে সে সওয়ারি নেবে না। ভাবলে বটে, ভাবনাটা কিন্তু কথার রূপ নিয়ে মুক্তি পেল না। তার নিস্ক্রিয় দৃষ্টির উপর দিয়ে এক সময় জল-পুলিশ দুটি নিথর নরদেহটিকে ধরাধরি করে পাটাতনে উঠে এল।

নিভন্ত চোখে অনেকটা সময় তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল আইনুদ্দি। তারপরেই একরাশ বরফ-কণার মতো চেতনা থেকে পুলিশের দুর্ভাবনাকে ঝাঁকিয়ে ফেলে দিল। এর চেয়ে অনেক, অনেক মনোরম প্রেরণা রয়েছে মনে। সে-প্রেরণার বাস্তবতা একটি সরস শ্যামল নারীর বরতনুতে। সে-প্ররণার নাম জমিলা। মেঘনার চড়াই উৎরাই ঢেউয়ের দোলায় দোল খেতে খেতে জামিলার দুটি অপরূপ চোখ, নিটোল বাহু, মসৃণ কপোল আর মুক্তো দাঁতের শুভ্র হাসির স্বপ্নে বদখত মেজাজটাকে ডুবিয়ে আবার শরিফ করে নেওয়া যাবে। ভাবতে ভাবতে রীতিমতো উৎসাহিত হয়ে উঠল আইনুদ্দি।

এক সময় একমাল্লাই কেরায়া নৌকার মাথায় বাদাম টাঙিয়ে দিল আইনুদ্দি। রাজহাঁসের পাখার মতো ধবধবে পালের পাখনা। তীব্রগামী একটি ফলুই মাছের মতো জল কেটে কেটে এগিয়ে চলল আইনুদ্দির কোষডিঙি। অনেক, অনেক দূরে কচ্ছপের পিঠের মতো চরবেহুলা স্থির হয়ে রয়েছে।

হালের বৈঠাটা প্রখর থাবার মধ্যে চেপে দৃষ্টিটাকে সরাসরি ছইয়ের মধ্যে চালান করে দিল আইনুদ্দি। জল-পুলিশ দুটি একপাশে বসেছে আর পাটাতনের মাঝখানে নিথর নরদেহটিকে একটি সরল রেখার মতো শুইয়ে দিয়েছে। সারা দেহ তার গেরুয়া কাপড়ে জড়ানো। শরীরে একটি বিন্দুও অনাবৃত নেই।

জল-পুলিশ! হৃৎপিণ্ডের উপর ছলাৎ করে একঝলক রক্ত আছড়ে পড়ল। নাঃ, চোখের সামনে দুটি বিভীষিকা। মূর্তিময় আতঙ্ককে সামনে বসিয়ে আর যাই হক জমিলার খোয়াব দেখা চলে না।

আচমকা গেরুয়া কাপড়ের আবরণ চৌফালা করে একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ উঠল, “আ—আ—আ— আমাবে সড়কি দিয়া মাইর‍্যা ফেলাইল। আ—আ—আ—”

একটা জল-পুলিশ প্রচণ্ড গর্জন করে উঠল, “এই চুপ, চুপ সুমুন্দির পুত।”

আর্তনাদের রেশ তখনও থামেনি। শুধু কণ্ঠ নিস্তেজ হয়ে এল লোকটির, “আ—আ—আ—”

আর লোকটির এই আর্তনাদের সঙ্গে চেতনার উপর থেকে একটা উল্কা খসে পড়ল আইনুদ্দির। শিউরে উঠল সে।

এক বছর আগের সেই দিনটা আজও একটা অসত্য স্বপ্নের মতো মনে হয়।

নিশিরাত্তিরে ইলশাজাল আর ইলশাডিঙি নিয়ে হাসেম বেরিয়েছিল মেঘনায়। দুটি তীক্ষ্ণ চোখের মণিতে তার মেঘনার রূপালি ফসলের সন্ধান। হাসেমের সেই ইলশাডিঙির সঙ্গে আচমকা ধাক্কা লেগে গিয়েছিল আইনুদ্দির কেরায়া নৌকার। অমাবস্যার রাত। নিকষ অন্ধকারের মধ্যে তলিয়ে ছিল মেঘনা।

কদর্য গালাগাল উচ্চারণ করেছিল আইনুদ্দি, “কে রে বউয়ার ভাই—”

হাসেমও কম তৎপর নয়। তার ভাণ্ডারও অফুরন্ত, “আ রে সুমুন্দির পুত—”

ততক্ষণে ডোরার তলা থেকে হ্যারিকেন বের করেছে হাসেম। হ্যারিকেনটা আলোর একটা বৃত্ত রচনা করেছিল মেঘনার কালো জলে। সেই আলোতে আইনুদ্দির চোখ দুটো আশ্চর্য ক্রূর দেখাচ্ছিল।

সহসা সেই ক্রূরতাকে প্লাবিত করে বিস্ময় ফুটে বেরুল “আরে মিতা যে!”

“আরে আইনুদ্দি দোস্ত! অনেকদিন পর দেখা হইল আবার।”

অমাবস্যার কুটিল মেঘনাকে শিহরিত করে উচ্চগ্রামে হেসে উঠেছিল আইনুদ্দি। “দুই নৌকায় ধাক্কা লাইগ্যা ভালই হইল মিতা; আবার দেখা হইল তোর লগে। না হইলে আবার কবে মিল্তি হইত, তার কি ঠিক আছিল।”

“ঠিক কইছিস মিতা। দুই নৌকা দুই দিকেই ভাইস্যা যাইত; আমাবইস্যার মেঘনা পুরান দুই মিতারে এক কইর‍্যা দিল। আইজ আর মাছ মারুম না; ঘরে চল। তোর লগে আমার অনেক কথার কাম আছে।”

“সেই ভাল। আমারও আইজ সওয়ারি নাই। মনটা উথালপাথাল হইছিল, খামাকা মেঘনার উপুর দিয়া নৌকা ছুটাইলাম।”

“বুঝছি।” প্রচণ্ড বিস্ফোরণের মতো হেসে উঠল হাসেম, “বুঝছি, বিছানায় বউ নাই। মনটা তাই ফাকুর ফুকুর করে! ‘আইচ্ছা, একটা ব্যবস্থা করন লাগে। মাইয়ার অভাব আছে না কি আমাগো এই জলের দ্যাশে। দুই একদিনের মইধ্যে পণের টাকা বায়না দিমু।”

হাসেমের হাসির সঙ্গে নিজের সমর্থন যুক্ত করেনি আইনুদ্দি। বিস্বাদ গলায় সে বলেছিল, “মনের মতো মাইয়া কি মিলে মিতা! যাউক ওই সব কথা। যা কইতে আছি, তোর ঘরে যামু না। এই গাঙের পানিই ভাল। ঘরে গিয়া কী লাভ? তোর ঘরও তো রুখা-শুকা, রস নাই। রং নাই। ঘরে বউ আছে?”

“আছে, আছে রে মিতা। না হইলে পরান এমুন খুসবু হইছে! গন্ধ পাইস না।” ফিক ফিক হেসে উঠল হাসেম।

“যামু, তবে যামু তোর ঘরে। সাদি করলি, দাওয়াত করলি না আমারে?”

“তোর কি ঠিকানা মিলে? তুই তখন জারির দলে গান গাইতে গেছিস বরিশাল। নে চরবেহুলার দিকে নৌকার গলুই ফিরা। চল্ চল্—” খুশি খুশি আমন্ত্রণে মুখর হয়ে উঠল হাসেম।

“সড়কি, সড়কি দিয়া আমারে মাইর‍্যা ফেলাইল। আ—আ—আ—” পাটাতনের ওপর সেই নিথর নরদেহটি আবার আকাশ ফাটানো চিৎকার করে উঠল। শরীরের সমস্ত রক্তকণাগুলো একসঙ্গে যেন চমকে উঠল আইনুদ্দির। ভাবনাটা বিস্রস্ত হয়ে গেল। সড়কি! শ্বাসনালীর ওপর যেন একটা অতিকায় রোমশ থাবা চেপে চেপে বসছে। পাটাতনের মধ্যে থেকে দৃষ্টিটাকে আকাশের দিকে সরিয়ে নিয়ে গেল আইনুদ্দি। শ্রাবণের আকাশে সোনামুখী মেঘ থরে থরে ভেসে বেড়াচ্ছে। একঝাঁক প্রবাসী চখা-চখি মেঘনার ঢেউয়ে চলমান ছায়া বুলিয়ে বুলিয়ে উধাও হচ্ছে দিগন্তের দিকে।

অনেকটা সময় পার হল। ভাবনাটাকে নিজের মধ্যে সংহত করে নিল আইনুদ্দি। ইতিমধ্যে পাটাতনের সেই আর্তনাদও থেমে গিয়েছে। জলপুলিশ দুটি নিষ্ক্রিয় বসে রয়েছে। আকাশের সোনামুখী মেঘের ফাঁকে ফাঁকে আবার একটি শ্যামল সরস মুখ উঁকি দিয়েছে। দুটি ভ্রমর-চোখ নিষ্পলক তাকিয়ে রয়েছে। সে-মুখ, সে-চোখ জমিলার। স্মরণের মধ্যে দোল খেতে খেতে আইনুদ্দি ফিরে গেল চরবেহুলার সেই অপরূপ রমণীয় দিনটিতে।

মেঘনা থেকে সরাসরি হাসেম আর আইনুদ্দি চলে এল চরবেহুলায়। ছৈতানের ছায়াকুঞ্জে হাসেমের দুখানা দোচালা ঘর। উপরে বেনাঘাসের চাল। সেই চালে লাউলতার আলপনা।

উঠানে দাঁড়িয়ে খুশি-খুশি গলায় হাসেম ডেকেছিল, “কই গো হাসেমের ঘরের শাজাদি, বাইর হও দেখি। দেখ তোমার লেইগ্যা কী খোশবান আনছি মেঘনা থিকা।”

“কী-কী—” উদ্দাম একটা ঝড়ের মতো দোচালা ঘরখানা থেকে বেরিয়ে এসেছিল জমিলা। আর উঠানে নেমেই থমকে গেল চরবেহুলার এক দোচালা ঘরের উত্তাল তুফান।

প্রচণ্ড হাসিতে শতখান হয়ে ভেঙে পড়ল হাসেম। ‘কী হইল, তোমার লইগ্যা এমুন একখান খাসা জিনিস লইয়্যা আসলাম! আমার মিতা গো শাজাদি! মস্ত বড় কবিদার আর গায়েন। জারি গায়, রয়ানি গায়। আবার হিন্দুগো ঢপও গায় সৌদামিনীর দলে। আর বর্ষার দিনে কেরায়া বায়। তোমার কাছে আইনুদ্দি মিতার নাম কই নাই? এই হইল সেই আইনুদ্দি। আমার মিতা, তুমিও মিতালি পাতাইয়া লও।”

আলোকলতার মতো সরল দীঘল দেহ জমিলার। একটা কামরাঙা শাড়ি সারা দেহ ঘিরে সাপের রেখা টেনে টেনে উঠে গিয়েছে। দু চোখে তীক্ষ্ণ বিজুরির নিশানা টেনে সে বলেছিল, “তোমার মিতা, তার উপুর কবিদার, আবার গায়েনও। তিনে মিলা একেবারে ত্রস্পশ্য। আসেন গো মিতা, ঘরে আসেন। নাম শুনছি আপনের অনেক।”

আকাশে প্রথম সকালের রক্তলেখা। সামনে মেঘমতী মেঘনা। নৈঋৎ আকাশে সোনামুখী মেঘ, জমিলার সারা দেহে মদির কুহক। সুন্দর আর সুকণ্ঠ আইনুদ্দি মুগ্ধ হল।

গর্বিত গলায় হাসেম বললে, “কেমুন বউ দেখলা মিতা?”

“এই বউ ছাইড়্যা মাছ মারতে যাইস ক্যামনে? পরান ফাকুর-ফুকুর করে না?’

দু চোখে তীব্র কটাক্ষ শানাল জমিলা, “আমি ঘরে থাকতে দিলে তো!”

হাসেম আবার বন্য গলায় হাসল, “দেখলা তো মিতা, কেমুন একখানা বউ ঘাড়ে চাপাইছি। কথায় পারার উপায় নাই। কথা আর গান লইয়্যা তো তোমার বাণিজ্যি। বউর মুখ থিকা বেবাক কথা তুইল্যা লইয়া যাও। তোমারও উপকার, আমারও উপকার। তুমি নয়া কথা বেচতে পারবা। আমি বউর কথার ঘাই থিকা বাচুম।”

“আইচ্ছা দেখা যাইব।” মিটি মিটি হাসল জমিলা। সেই হাসি মেঘনার ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ল আইনুদ্দির রক্তে।

সারাটা দিন গানের গমকে গমকে, কথার চেকনাই বুনে বুনে ছৈতানের ছায়াকুঞ্জকে মাতিয়ে রেখেছিল আইনুদ্দি। ক্ষণে ক্ষণে চোখের কোণের তীব্র বিজুরির আশনাই এঁকেছিল জমিলা। আর নির্বোধ গলায় হা হা করে হেসেছিল হাসেম।

সারাটা দিন গানের বাদাম উড়িয়ে, মাঝরাত পর্যন্ত অফুরন্ত কথা আর হাসির গুন টেনে টেনে কাটিয়ে দিল তিনজনে। নিশিরাত্তিরে ইলশাডিঙি নিয়ে বেরুল হাসেম। আর সঙ্গে সঙ্গে আইনুদ্দি।

বৈঠার তল্লাসে ঘরের আড়ায় উঠেছিল হাসেম। সেই অবসরে একান্ত নিরালায় ফিস ফিস গলায় জমিলা বলেছিল, “আইজ থাকেন না মিতা। আপনের লগে কথা কইয়াও সুখ। আপনের মিতা এমুন মানুষ, প্যাচের কথা, রসের কথা যদি বোঝে! খালি চাইয়্যা থাকে ড্যাব ড্যাব কইর‍্যা। না হইলে খ্যাক খ্যাক কইর‍্যা হাসে।”

মুগ্ধ চোখে তাকাল আইনুদ্দি, “না মিতানি, আইজ থাকন যাইব না।”

আবিষ্ট গলায় দোলন লাগল জমিলার, “ঘরে তো বউ নাই জানি; বাইরে বুঝি মনের মানুষ আছে! তার লেইগ্যা বুঝি পরান উথালপাথাল?”

জমিলার আবেশ স্পর্শ করেছিল আইনুদ্দিকে, “মনের মানুষ! ও বুঝছি। এতদিন আছিল না। এইবার মিলছে।”

“কে? কে?” তৃষিত চোখে তাকাল জমিলা।

“সে এক ময়নাফুল। তার চাইর পাশে চোখা চোখা কাঁটা।” বলতে বলতেই বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল আইনুদ্দি।

আর পিছন থেকে ছলাৎ করে মেঘনার একটা ঢেউ আছড়ে পড়েছিল তার কানে, “আবার আইসেন মিতা। মিতানি কিন্তুক দিন গনব আপনের লেইগ্যা।”

পিছনের দিকে একবার তাকিয়েছিল আইনুদ্দি। দরজার উপর নিথর আলস্যে এক পরম রমণীয় ছবি স্থির হয়ে রয়েছে। সে-ছবির নাম জমিলা।

“সড়কি, সড়কি দিয়া আমারে মাইর‍্যা ফেলাইল! আ—আ—আ—” সমস্ত পৃথিবীকে ফালা-ফালা করে চিৎকার উঠল। পাটাতনের সেই গেরুয়া কাপড় জড়ানো লোকটা রীতিমতো কাতরাতে শুরু করেছে। এক ভয়াল আতংকে পেশীগুলো যেন কুঁকড়ে আসতে শুরু করল আইনুদ্দির। চেতনার দিগন্ত. থেকে জলের লেখার মতো মুছে গিয়েছে জমিলা। আঙুলের ডগাগুলো চৌচির করে ফিনকি দিয়ে যেন রক্ত ছুটবে। তবে কি, তবে কি মেঘনার অতলান্ত থেকে সেই প্রেতটা উঠে এসেছে তারই নৌকার পাটাতনে!

একটু পরেই পাটাতনের লোকটির চিৎকার থামল। আর সঙ্গে সঙ্গেই মেঘনার একটা ঢেউয়ের সওয়ার হয়ে আইনুদ্দির মনটা ফিরে গেল চরবেহুলার কতকগুলি আশ্চর্য মনোরম দিনের অতীতে।

চরবেহুলার মাটিতে সেই প্রথম সকালটির পর আরও অনেকবার এসেছিল আইনুদ্দি। বর্ষায় এসেছে, আকাশে আকাশে কাশফুলি মেঘের শরতে এসেছে, এসেছে মধুময় বসন্তদিনে। নদীর পারের সেই নারকেল-কুঞ্জে যখন অশ্রান্ত বাতাস মর্মরিত হয়ে উঠেছে, তখন দুটি মানুষ পরস্পরের নিবিড় সান্নিধ্যে বসে এক উপভোগ্য পৃথিবীর ছবি এঁকেছে। জমিলা আর আইনুদ্দি।

জমিলা বলত, “আমার বড় ডর করে। যদি তোমার মিতা জানতে পায়।”

হা-হা করে আকাশ ফাটিয়ে হেসে উঠত আইনুদ্দি, “ডর করে! ডর করলে কি রসের নাগরেরে, পিরিতের পুরুষেরে পাওয়া যায়! তুমি শয়তানটারে তালাক দাও।”

“তালাক দিমু।” বিচিত্র এক আশঙ্কায় গলাটা শিউরে শিউরে উঠেছিল জমিলার, “না, না, ও আমারে কত ভালবাসে। কত সোহাগ করে!”

“সোহাগ করে! ভালবাসে! আমি বাসি না? এতটুক তো একটা মন তোমার। সেই মনেরে দুই টুকরা কইর‍্যা স্বোয়ামিরে দিবা, আবার পিরিতের মানুষেরে দিবা; কারু যে তিয়াস মিটবে না। তোমার ওই মন হয় আমি, না হয় হাসেম পাইব। দুইজনের বখরা চলব না।”

“আমি কী করুম?” দুটি অসহায় চোখ তুলে তাকাল জমিলা।

“তোমার কিছু করন লাগব না। যা করনের আমি করুম। তুমি খালি আমি যা কই তাই করবা। আমার উপুর মন আছে তো?”

“আছে।”

“তবে আমার লগে যাইতে হইব। যাইবা তো?” তৃষ্ণাভরা চোখে তাকিয়েছিল আইনুদ্দি।

“যামু! কিন্তুক তোনার মিতা?” ঠোঁট দুটো থর থর করে কেঁপে উঠেছিল জমিলার।

“সেই ভার আমার।” আশ্চর্য শব্দ করে হেসে উঠেছিল আইনুদ্দি।

একটা শিকারি সরীসৃপের মতো তারপর থেকে সুযোগের জন্য থাবা পেতে বসেছিল আইনুদ্দি। অবশেষে দিনদুয়েক আগে সেই সুযোগ এসেছিল। প্রাকসন্ধ্যায় যখন একটা ধূপছায়া রঙের অতলতায় সমস্ত চরবেহুলার চরটা ডুবে গিয়েছে, ঠিক তখনই একমাল্লাই কেরায়া নৌকাটা এনে ভিড়িয়েছিল আইনুদ্দি।

“সড়কি, সড়কি দিয়া মাইর‍্যা ফেলাইল—” পাটাতনের লোকটি আবার আর্তনাদ করে উঠল। ভাবনাটা বিস্রস্ত হয়ে গেল আইনুদ্দির। বিচিত্র এক আতংকে বুকের মধ্যটা দুরু দুরু করে উঠল। গুরু গুরু করে কাঁপল হৃৎপিণ্ড। তবে কি, তবে কি মেঘনার অতলান্ত থেকে সেই জীব উঠে এসেছে তারই নৌকার পাটাতনে! শিউরে উঠল আইনুদ্দি।

চিৎকার থামল। আবার ভাবনা শুরু হল আইনুদ্দির।

চরবেহুলা থেকে হাসেমকে নিয়ে বেরিয়েছিল আইনুদ্দি। তার আগে সে বলেছিল, “যাই গো মিতানি, আবার আসুম, আসুম আবার। নাইরকেল গাছগুলির কিনারে বিষ্যুদ্বার সন্ধ্যায় আইস্যা থাইক। সেইখান থিকা দক্ষিণশাহাবাজপুর। ফুফুর বাড়ি।” কণ্ঠটা ধীরে ধীরে একটি মধুর আবেগের উত্তাপে গলে গলে মস্থর হয়ে এসেছিল আইনুদ্দির।

“কিন্তুক তোমার মিতা!” আশংকায় স্বরটা আশ্চর্য বিকৃত শুনিয়েছিল জমিলার।

“মিতা! হা-হা-হা” —রাক্ষসের মতো বিশাল মাথাটা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে তারস্বরে হেসে উঠেছিল আইনুদ্দি। সে-হাসিতে চমকে উঠেছিল শ্রাবণদিনের অপরাহ্ণ। “সেই ব্যবস্থা আইজই করুম।”

বৈঠার তল্লাসে বাইরে গিয়েছিল হাসেম। আইনুদ্দির হাসির আওয়াজে ছুটে এসেছিল, “কী হইল মিতা?”

বিন্দুমাত্র বিকার নেই আইনুদ্দির। নির্বিকার গলায় সে বলেছিল, “ডরাস ক্যান মিতা; মিতানির লগে ইট্টু রঙ্গ করি। চল, চল, মনটা কেমুন জানি উদাস হইয়্যা গ্যাছে। ইট্টু গাঙ্গের পানিতে ঘুইর‍্যা আসি।”

হাসেমকে নিয়ে মেঘনার দিকে চলে গিয়েছিল আইনুদ্দি। তারপর—

আজ সেই বৃহস্পতিবার। নারকেলের ছায়াকুঞ্জে এসে তারই জন্য অপেক্ষা করবে জমিলা। মেঘনার ঢেউ করাতের মতো কেটে কেটে চরবেহুলার দিকে এগিয়ে চলেছে আইনুদ্দির কেরায়া নৌকা। মনটাকে দিন দুই আগের একটা ভয়াবহ কবর থেকে তুলে এনে একটি প্রসন্ন ভবিষ্যতের প্রেম দিয়ে মধুময় করে তুলতে চাইল আইনুদ্দি। একটু পরেই চরবেহুলার মাটি থেকে তার স্বপ্নকন্যাকে নিয়ে সেই মেঘনার সুদূর চক্ররেখায় উধাও হয়ে যাবে। দুদিন আগের সেই রক্তাক্ত স্মৃতি দিয়ে চেতনাকে বেজুত করে লাভই বা কী? সামনের দিকে একটি রূপমতী নারীর বিচিত্র আকর্ষণ। তার দুটি শ্যামল বাহু ফুল মালা হয়ে হু হু করে ছুটে আসছে। কী প্রয়োজন সেই শুভ্র স্বপ্নে দিন দুই আগের একটি আর্তনাদ আর এক রাশ রক্তের কলঙ্ক ছিটিয়ে দেবার? কী প্রয়োজন দিন দুই আগের এক ভয়াল হত্যাকে বার বার স্মৃতিতে টেনে এনে চেতনাকে বিক্ষত করার? নিজের জীবন থেকে এক জমিলা ছাড়া চরবেহুলার সমস্ত অতীতকে একটা কদর্য অধ্যায়ের মতো নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে।

“আ—আ—আমারে সড়কি দিয়া মাইর‍্যা ফেলাইল—আ—আ—আ—” —ছিলা-মুক্ত তীরের মতো সাঁ করে পাটাতনের লোকটা উঠে বসতে চাইল। জল-পুলিশ দুটি তার কাঁধে চাপ দিয়ে আবার শুইয়ে দিল।

সড়কি! আইনুদ্দি ভেবেছিল, দুদিন আগের একটি ঘটনাকে স্মৃতি থেকে চিরকালের জন্য নির্বাসন দেবে। কিন্তু মেঘনার অতলান্ত থেকে দিনদুই আগের সেই প্রেত যেন তারই পাটাতনের উপর উঠে এসেছে। এই মুহূর্তে শ্রাবণের এই বিকেলকে সাঙ্ঘাতিক মনে হচ্ছে। আকাশের সোনামুখী মেঘ কী ক্রূ? মেঘনার বাজনার মধ্যে কোটি কোটি শয়তানের গর্জন শুনতে পাচ্ছে আইনুদি! সড়কি, পাটাতনের লোকটির আর্তনাদ, জল-পুলিশ, এই মেঘনা—সব মিলিয়ে একটা ভয়ংকর প্রতিক্রিয়া ঘটে গেল আইনুদ্দির স্নায়ুগুলোতে। হাতের পেশীগুলো যেন শিথিল হয়ে আসছে। চোখের মণিদুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসবে।

“আমারে—আ-আ—সড়কি দিয়ে মাইর‍্যা ফেলাইল”—আর্তনাদ করে উঠে বসল পাটাতনের লোকটি। সারা দেহ গেরুয়া কাপড় দিয়ে জড়ানো। শরীরের একটি প্রত্যঙ্গও দেখা যাচ্ছে না। “আ— আ—আ—সড়কি—সড়কি—”

হাতের থাবা থেকে হালের বৈঠা খসে গিয়েছে। চিৎকার করে উঠল আইনুদ্দি “আমি, আমি হাসেমরে সড়কি দিয়া খুন করছি পুলিশ ছাহাব। আমারে বান্ধেন। ওর বউর রূপ দেইখ্যা আমি মজছিলাম। আমারে বান্ধেন। বান্ধেন। আমারে ফাঁসি দেন—ওর বউরে আনতেই যাইতে আছিলাম এখন।”

“সড়কি—সড়কি দিয়া”—আর্তনাদ করতে করতে কেমন করে যেন লোকটির দেহ থেকে আবরণটা সরে গিয়েছে। মুখ দেখে চমকে উঠল আইনুদ্দি। এ তো হাসেম নয়। এ তো অন্য কেউ। একে সে চেনে না। জানে না। শিউরে উঠল আইনুদ্দি। একটা বিচিত্র বিস্ময়ে চেতনাটা আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছে তার। কিছুতেই সে ভেবে উঠতে পারছে না, শ্রাবণী বিকেলের এই মেঘনা কেমন করে তাকে বিভ্রান্ত করল।

আচমকা আইনুদ্দির দৃষ্টি পড়ল সামনের দিকে। হিংস্র শ্বাপদের মতো জল-পুলিশ দুটি তার দিকেই এগিয়ে আসছে।

৮ এপ্রিল ১৯৫৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *